প্যারালাইজড ওউল্ড হ্যাগার্ডের মৃত্যুসংবাদে চিত্রার্পিত মাছের নির্বাক চোখে চৈতালি প্রজাপতি বিভ্রম সৃষ্টি করলে আলো অথবা রঙের বিক্ষিপ্ত বিন্যাসে মৌমি বিষন্ন হয়ে ওঠে। অতঃপর সহসা সমস্ত আলো, রং ও কান্নার ক্রাউডি বিষাদের মধ্যে নীরবতা নামে। তখন ছড়ানো রংপেনসিল, কাগজ, ম্যাজিক মাউন্টেনের উড্ডীন হরিদ্রাভ পৃষ্ঠা, সেলাইয়ের লাল-নীল-আসমানি-হলুদ সুতা এবং এলোমেলো বালিশের মধ্যে তন্দ্রা তাকে রূপান্তরিত করে মৃত প্রজাপতিতে। তন্দ্রার মধ্যে মৃদু কম্পিত আঁখিতারা ক্ষীণ উন্মোচিত হলে দেখে মৃত বুড়ো লোকটি টুকরো টুকরো কাগজ রৌদ্রে উড়িয়ে দিচ্ছে। ঝিলিমিলি কাগজের প্রজাপতি উড়তে উড়তে রাস্তার ধূলিতে দৃশ্য হলে মৌমি তন্দ্রার মধ্যে মৃত লোকটিকে ভাবতে চাইছিল। আসলে তার নির্বাক উপলব্ধির মধ্যে চারপাশের জগতের যতটুকু তার মন ও দৃষ্টিকে বিস্ময় ও আতঙ্কিত অথবা নিছক কৌতুকময় করে তোলে সেই সমস্ত ভাবনার তরঙ্গে এখন পলেস্তারা খসে পড়া লাল দগদগে বাড়িটা সন্ধ্যার প্রেতার্ত আঁধারের প্রহেলিকায় ইনস্যানাটিতে আর্দ্র, কিম্ভুতদর্শন। তমিস্রনিবিড় কুজ্ঝটিকায় প্রাগৈতিহাসিক হোমোস্যাপিয়েন্সের কঙ্কাল উবু হয়ে রয়েছে যেন। কুয়াশাবিকীর্ণ সন্ধ্যার জলজ আঁধারে তন্দ্রায় ডুবে যেতে যেতে দেখে বৃদ্ধ লোকটির নিশ্বাস আটকে গেল। ভয়ানক ক্লান্তি বোধ করে, দেখে মৃদু দোদুল্যমান চূর্ণ আঁধারে নিজের উত্থানরহিত হাত-পা, দেখে শরীরের এই নীরবচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মাথা এবং কাঁধের সঙ্গে খোলসহীন আহত সাপের মতো নিস্পৃহ আর তখন বুড়োর ক্ষুধা পায়। গলি রাস্তা থেকে মাছওয়ালার নিষ্ঠুর চিৎকার দুপুরের স্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে ছুটে আসে। এতক্ষণ নিঃশব্দে ঘরের দেয়ালে রৌদ্রের ঝাঁঝালো আভা পিঠের ঘায়ের লালচে কষানি ঝরিয়েছে, নিস্তব্ধ ছাদ ঘামছিল দুপুরে, চিমসে তেতো গন্ধে দূরের শব্দগুলো মিইয়ে চুপ… নিশ্চুপ! অতঃপর মাছওয়ালার ই-শ মাঁ-উ-ছ চিৎকার বুড়োর নিশ্বাসে ঢুকিয়ে দেয় গরম গুঁড়ো গুঁড়ো রৌদ্রের ঝলমলে রেণু, রৌদ্রের কুয়াশাপ্রপাতে চারদিক ঝলসে সাদা ফ্যাকাশে মেরে যাওয়া একটা নিথর নদী; সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে তন্দ্রাচ্ছন্ন মাছ। মাছওয়ালার বুকের মধ্যে দুপুরের ঝাঁঝাল রৌদ্রে স্তব্ধ মৃত নদীর মোহনাজুড়ে ইলিশ, তেলাপিয়া আর কই ঘুমিয়ে কাদা, স্তূপীকৃত পড়ে আছে পলিচরের চিকচিকে বালি। মাছওয়ালা পুরনো লাল বাড়ির ছায়ায় বসে মাথার অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়ি নামায়। ছাদের কার্নিশে উড়ন্ত সাদা রৌদ্রের হাওয়ায় মিঠাই অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়ির মোহনায় নেমে এলে পুনরায় বুড়োর ক্ষুধা পায় আর রাস্তায় একটা দৈত্যাকৃতি মাইক্রো দাবড়ে এলে বিস্তর ধূলিকুণ্ডলি উজ্জ্বল বর্ণালি রচনা করে। রিকশার ঘণ্টাধ্বনি, বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া অথবা নিরেট সাক্ষরজ্ঞানহীন বালক-বালিকাদের কোলাহল সহসা অসহ্য হয়ে উঠলে বুড়ো বাঁহাতে গু মোছা কাগজ ছুড়ে মারে। ভুল বানানে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ লেখা পোস্টার ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল মিনার মা। রৌদ্রে কাগজের টুকরো প্রতিফলিত আলোর কুহকে প্রজাপতির দৃশ্য রচিত ধূলিবিকীর্ণ রাস্তায় কেউ গালি দেয় শালার বুইড়া মরেও না!
এইসব খিস্তিখেউড় শুনে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বৃদ্ধ ক্রুর হেসে ওঠে, তার হাসি দুর্বোধ্য কীটনাশকের গন্ধ ছড়িয়ে দিলে ঝাঁঝালো রৌদ্র ঘরের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যেন আততায়ী। তখন চিলেকোঠা ঘরের ঝুলন্ত মিহি আঁধার অপসারিত হলে বুড়ো ক্ষুব্ধ, তিতিবিরক্ত আর জনকোলাহল ছাপিয়ে মাছওয়ালার চিৎকার বুড়োর ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয়। পৃথিবীর সমস্ত বস্তু ও রৌদ্রছায়াকণার গন্ধে তীক্ষè ক্ষুধার অনুভূতি স্নায়ুকে বিবসিত করে, জন্তুর তীব্র ঘ্রাণশক্তি এবং শ্র“তির যাবতীয় সংহতি আর ভীত শঙ্খের করুণা নিয়ে মাছওয়ালার ক্রমাগত হাঁকাহাঁকি শুনে বুড়ো দূরের বাড়িগুলোর কার্নিশে রৌদ্রের লুকোচুরি দেখে, ঝলসানো আকাশ দেখে আর ছড়ানো রংপেনসিল, কাগজ, সেলাইয়ের রঙিন সুতা, এলোমেলো বালিশ এবং উড়ন্ত বইয়ের পৃষ্ঠায় চিত্রার্পিত মাছের মধ্যে মৃত প্রজাপতি দেখতে দেখতে নারী ও শিশুকণ্ঠের কান্না ভেসে আসে। গ্রীষ্মিত কুহকী রৌদ্রে ক্লান্তি জমা হয়, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে জানালাবিহীন টিনশেড বস্তির নারী-পুরুষের দল হাড় থেকে মাংস শিথিল হয়ে যাওয়া উত্তাপ এড়ানোর জন্য নাভানা অথবা মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেডের মেঘদলের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো স্কাইস্ক্যাপারের ছায়ায় উবু হয়ে বসে ঝিমায়, গ্যাস না থাকায় পনেরো ঘর অর্থাৎ পনেরো পরিবারের জন্য নির্ধারিত একটি চুলায় দ্রুত রান্না সেরে নেওয়ার আগ্রহে আঁধার জমে থাকা শেষ রাতের নিদ্রা ত্যাগ করে দীর্ঘ সিরিয়াল নিয়ে প্রায় হাতাহাতি হয়ে যাওয়া প্রতিবেশীরা এখন পরস্পরের উকুন বাছে। ক্ষুধা নিয়ে কেউ কেউ নিঃশব্দে আততায়ী নিদ্রায় ঢুলতে থাকলে ন্যাতানো লাল শাকের দুটি নিঃসঙ্গ আঁটি বিক্রির স্বপ্নে বিভোর সবজি-ভ্যানওয়ালা করুণ বাক্য তৈরি করে। রাস্তার একপাশে ক্ষুধার্ত শিশুদের ইচিংবিচিং খেলা দেখতে দেখতে একটা পথকুকুর শ্রবণের সূক্ষ্মতা ভুলে নিদ্রার আয়োজন করে। একজন ময়লার স্তূপে জুট বেরিয়ে যাওয়া পরিত্যক্ত একটা বালিশ কুকুরটির মাথার নিচে গুঁজে দেয় এবং আরামে অথবা ক্ষুধায় নির্জীব কুকুরটি একটিবার কেবল কালো সজল রেখার গভীরতা ঘেরা চোখ উন্মুক্ত করে সেবাদানকারীকে দেখে। তখন পরীক্ষার উত্তরপত্র, প্রশ্নপত্র, লাল কলম, নম্বরপত্র আর পাইরেটেড মাই নেম ইজ রেড বগলদাবা করে বিদ্যালয়-ফেরত তাহের ওসমান এই দৃশ্য দেখে শ্রেণিকক্ষের যাবতীয় সৃজনশীল সিলেবাস, প্রশ্নপত্র, হেডমাস্টার, কমিউনিকেটিভ ইংরেজি আর কাগজের উড়োজাহাজ ছাপিয়ে তাঁর মাথার মধ্যে তৈরি হতে থাকে উচ্ছ্বসিত কবিতার পঙ্ক্তিমালা। সেলফোনের ক্যামেরায় তাহের কুকুরটির ফটোগ্রাফি করে আর বুকের মধ্যে অশ্র“পাত ক্রমশ স্তব্ধ হয়, নিঃসঙ্গ হয়। যুদ্ধবাজ মার্কিন দেশের কোনো এক হোটেল ব্যবসায়ী লিওনা হেমসলির চ্যারিটেবল ট্রাস্টের ছবি ভেসে আসে Ñ হেমসলির মৃত্যুর আগে তার কুত্তার জন্য এক কোটি কুড়ি লাখ ডলার উইল করে রেখে যাওয়ার গল্প রূপকথা হয়। ফটোগ্রাফি শেষ হলে ক্ষুধার্ত লোকটি নির্বোধ হাসির উপাখ্যান তৈরি করে। মানুষের অনুভূতি ও সংবেদনশীলতা কোনো না কোনোভাবে উন্মোচিত হয়, হতে হয় Ñ এই বোধ সহসা ব্যাখ্যাতীত অবিরল আনন্দ এবং দুঃখের চিরন্তন আবর্তনে বিলীন হয়ে যাওয়া বিগলিত অশ্র“র শুকনো রেখায় তাকে স্থির ও নির্বাক করে তোলে। তখন কারো চায়নিজ সেলফোনে ধামাকা হিন্দিগানের আয়োজন শেষে কথাবন্ধুরা নিউজ আপডেট করে, যদিও ইদানীং ক্রসফায়ারে মৃত্যুর সংবাদ খুব একটা দুঃখী করে না কাউকে তবু চিলেকোঠার বুড়োর মৃত আত্মা মেলানকলি হয়ে এলে তাহের ভাবল সেলফোনে কুকুরের এই ফটোগ্রাফিটি ক্রসফায়ারে নরসিংদীর রক্তাক্ত মাইক্রোবাস এবং মৃত ছয় যুবকের ছবির সঙ্গে তার সদ্য খোলা ফেসবুকে পোস্ট করবে। ছেলেটি কথাবন্ধুদের কণ্ঠস্বর পালটে দিলে রৌদ্রে দর্পিত কৃষ্ণচূড়ার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ প্রজ্বলিত সবুজ ঝাণ্ডাবাহী শাখায় পিপাসার্ত নিঃসঙ্গ একটা দাঁড়কাকের চিৎকার শোনে। মেইন রোড থেকে ছুটন্ত গাড়ির বিলীয়মান ধ্বনিসমষ্টি শোনে; রিকশা, মোটরবাইক এবং সর্বোপরি লোডশেডিং কবলিত নারী ও শিশুদের কোলাহল শোনে। এতসব শব্দ শ্রবণের সঙ্গে এতক্ষণ হিপোক্র্যাসি করেছিল, দাঁড়কাকের কর্কশ চিৎকারে নিস্তব্ধতা ছিন্ন হলে কুকুরটি মাথা তুলে অনর্থক উৎস সন্ধান করে, পরক্ষণেই ক্ষুধায় প্রায় মুমূর্ষু প্রাণিটি ম্যাসটিফ প্রজন্মের দূরাগত স্বপ্নের আবেগে নিদ্রায় ডুবে যায়। কুকুর অত্যন্ত সূক্ষ্ম শ্রবণশক্তির অধিকারী, মাছির পাখার শব্দও কুকুরকে সচকিত করে এরকম এক তথ্য শৈশবের দিনগুলোতে তাহেরের ভোকাবুলারির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল, অতঃপর ছুরির তীক্ষè ফলায় অন্ধকারে আততায়ী চোরের ভয় মস্তিষ্কজুড়ে মৃত্যুকষ্ট ছড়িয়ে দিলে প্রভুভক্ত শিশুকুকুরের প্রতি অনুভূতি আচ্ছন্ন করা ভালোবাসা জাগ্রত হলো, নিদ্রিত কুকুরের জন্য সহানুভূতি করুণাধারা হয়ে এলো। শহরের এত চিৎকার আর যান্ত্রিক কোলাহলে কুকুরের শ্রবণ কি বন্যজীবনের সংবেদনশীলতা বাঁচাবার কোনো সৃজনশীল কৌশল শিখেছে?
তাহেরের মনে হলো কুকুরটি যেন তার দুষ্পাঠ্য মনের সমস্ত অনুচ্চারিত ভাষা উপলব্ধি করে জন্তুজীবনের সাহস ও সহিষ্ণুতায় প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে স্পর্শকাতর ও উন্মুখ করে তুলছে। তাহের খুব কাছে উপস্থিত হলে কুকুরটি তন্দ্রার ভেতর তাহেরের পায়ের ঘ্রাণ গ্রহণ করে। বিবিধ যান্ত্রিক কোলাহলেও তাহেরের দীর্ঘশ্বাস শুনে ভেজা আঁখিতারা খোলে অস্ফুটে। তাহের বলে Ñ হে কুকুর, তুমি কি টোস্ট খাবে? অথবা পাউরুটি? এবং তাহের বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করে, কুকুরটি তার আহ্বানে সাড়া দিলো। কুকুরটির সঙ্গে তার কথোপকথন মনোলগ হয়ে এলো। তাহের পুনরায় বলেওহে কুকুর, তুমি কী খাবে?
– ক্ষুধিতের আবার পছন্দ অপছন্দ!
– কেন? একটা অন্তত পছন্দের কিছু থাকা উচিত!
– আমার নেই। তাছাড়া পছন্দ কখনো একটা হয় না, খাবার; খাবারের পর নির্বিঘেœ শান্তিতে ঘুম; ঘুমের জন্য নিরাপদ আশ্রয়…
– তোমার আবার ঘুমের সমস্যা কী? জানোয়ারদের কি শীত গ্রীষ্ম আছে যে লোডশেডিংয়ে গরমে তোমার গায়ের পশম খসে যাচ্ছে!
– সবাই এত অশালীন আর নিষিদ্ধ পল্লির ভাষায় কথা বলে, ঘুম আসে না, লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়!
– কাদের কথা বলছ তুমি? কোনো প্রোটাগনিস্ট?
– না, না, মর্গের মাতাল ডোম থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী সকলেই চিৎকার করছে। এত অশ্লীল চিৎকারে ক্ষুধামান্দ্য হয়, ক্ষুধার বোধ শূন্য হয়ে যায়। তাছাড়া চারদিকে ছড়ানো-ছিটানো সারি সারি মৃতদেহ, লাশের কোটর থেকে উদ্গত বীভৎস চোখ, মাংস ক্ষয়ে যাওয়া তোবড়ানো গাল ভেদ করে উৎপাটিত দাঁত, রক্তাক্ত করোটি, বিস্ফারিত অ-কোষ এবং আগুনে ঝলসানো যোনি। বাবা-মা সন্তানকে কেটে টুকরো টুকরো করছে নিদারুণ উন্মত্ত আক্রোশে, সন্তানও বাবা-মায়ের বুকে ছুরি বেঁধাচ্ছে নির্দ্বিধায়। ক্রসফায়ার, রোড অ্যাক্সিডেন্ট, বেডরুমে হৃৎপিণ্ড বরাবর ছুরি চালিয়ে খুন অথবা হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে মানুষ। চোরছ্যাঁচড়, ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি, শিল্পী, আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, কেউই বাদ যাচ্ছে না; পুরো রাষ্ট্রই যেন খুনোখুনির প্রেতান্ধ মৃত্যুলোক।
তুমি কি বেডরুমেও পাহারা বসাতে বলো? তাছাড়া চোর- বাটপারদের বেঁচে থেকে কী উপকারটা হবে? আর রাস্তায় তো নিজেকেই চোখ-কান খোলা রেখে চলা উচিত। সকলে রাষ্ট্র রাষ্ট্র করে মুখে ফেনা তোলে, নিজের ভূমিকা নিয়ে নির্বিকার। নিজের সব রূপান্তর বৈধ অথবা বৈধতা দেবার জন্য নিজেকে এতটাই নিচে নামায় যে, পতনের অবসম্ভাব্যতা নিয়ে কোনো ধারণাই করতে পারে না। চিন্তা আর কাজের মধ্যে কোনোই সমন্বয় নেই। মানুষ প্রকৃতপক্ষে অন্যের সংস্পর্শে, অপরের সঙ্গে তুলনার মধ্য দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করে, নিজেকে দেখে। যে দেখতে পায় না সে সবচেয়ে অন্ধ, সেই সবচেয়ে বেশি পতিত।
– তুমি উত্তেজিত হচ্ছো!
– না, না। তুমি ক্ষুধার্ত ছিলে…!
– ভেবে দেখো, এখানে কেউ বেঁচে থাকে না, বাঁচিয়ে রাখে। চোর-বাটপার প্রমাণ হবার আগেই খুন হয়ে যাচ্ছে নয়তো ঠ্যাঙ ভেঙে নুলো করে দিচ্ছে। দোকানের রাশি রাশি রঙিন খাবার দেখে আহ্লাদ হয়েছিল, কিন্তু ওইসব খাদ্যের পুষ্টি শিশুদের শিরায়-ধমনিতে নীল হলুদ কালো রক্তের রঙিন দুঃস্বপ্ন বুনে দিচ্ছে। হৃৎপিণ্ড আর চামড়ার নিচে জমাট বিষের রঙিন বিচ্ছুরণে প্রতিটি বাড়ি এক একটি স্যানাটোরিয়াম। জীবিতদের প্রত্যেকের মুখে মৃত্যুর কালো ছায়া। আমার আদিম জীবনের সমগ্র ইন্দ্রিয় সজাগ ও সূক্ষ্ম হয়ে উঠছে, নাসিকায় কেবল মৃতের গন্ধ, পচে খসে যাওয়া লাশের গন্ধ, কেউ কথা বললেই তার পেটের ভেতর থেকে পচনশীল নাড়িভুঁড়ির দুর্গন্ধ মুখের লালা ও ধ্বনির সঙ্গে বাতাসে মিশছে। আর আমার তীক্ষè শ্রবণ পৃথিবীজুড়ে কেবল ধ্বংসের শব্দ শুনছে। মৃত্যুশীল মানুষের বীভৎস কাতরোক্তি, বুলেট আর দিগি¦দিক আগুনের লেলিহান ধ্বনি শুনছি। পৃথিবীর বিস্তীর্ণ চরাচর রক্তাক্ত লাশ, অঙ্গার লাশ, অগ্নিদদ্ধ, হাড়ের মধ্যে রক্তাক্ত অগ্নিশলাকা, আগুনের লকলকে হাড়। অনুভূতির ভেতর টের পাই বারুদ, ইউরেনিয়াম, সিসা আর গুঁড়ো কাচের রেণু শিরিষকাগজের মতো খসখসে পিপাসা। আমার জিব লালাশূন্য, চোখ-মুখ, ঘাড়-গলা, নাক কাচের ধুলোর আস্তরে ঢাকা। ক্ষুধা বুকের ভেতর আতশবাজির জ্বলজ্বলে প্রদর্শনীর মতো আগুনের চক্রজালে যকৃত অন্ত্র পাকস্থলী সব পুড়ে খাক। এখন আর ক্ষুধা পায় না, অভ্যাসের কারণে খাই, ক্ষুধা না থাকলেও কেবল খেতেই ইচ্ছে করে। পৃথিবীর সমস্ত বস্তুকণা নিজের দখলে নিয়ে একা খাবার আকাক্সক্ষা মাঝে মাঝে নিজেকে জানোয়ারে পরিণত করে!
এসব স্বগতোক্তির ভেতর কুকুরটির দৃষ্টি সহিষ্ণু ও নুয়ে ম্রিয়মাণ হলে তাহের বিমূঢ়, পথের ধুলো আর ভাঙা পাথরের চোখা টুকরোর মধ্যে রক্তের ফোঁটার মতো সে গড়াগড়ি খায়। তার চারপাশে লাল পিঁপড়ার ঝাঁক, হলুদ পাতা ঝরার দিন, উড়ন্ত ধূলির ঘূর্ণি কুজ্ঝটিকা বিস্তার করে। তার চারপাশে মৃত পাতা, মৃত মাছ, মৃত পাখি, মৃত পিঁপড়া, মৃত সিঁড়ি, মৃত বই, মৃত গাজর, মৃত জুতা, মৃত আকাশ, মৃত বাঁধাকপি, মৃত ইনস্যানাটি, মৃত হাসপাতাল, মৃত নিউরোলজিস্ট, মৃত স্তালিনোভস্কি, মৃত কবিতা, মৃত মাই নেম ইজ রেড, মৃত কন্যা, মৃত হকিং, মৃত স্ট্রিট, মৃত কাঁঠালচাঁপা… এভাবে এইসব মৃতের তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। তখন সমস্ত যান্ত্রিক কোলাহল থিতিয়ে গরগরে দুপুরকে নিস্তব্ধ করে তুললে কোনো ওয়েল্ডিংয়ের দোকানে লোহা পেটানো শুরু হলো। ধাতব সংঘর্ষের বীভৎস বিকট শব্দ বিশ্বচরাচরে চিৎপাত পড়ে থাকা দুপুরকে বারবার লেহন করে, উগরে দিয়ে বিস্ফারিত করে, এভাবে বারবার লেহন উদরস্ত ও উগরে দিতে দিতে চারপাশে ছিটকে ছিটকে পড়তে লাগল দুপুরের রক্তাক্ত থরথর মাংসপিণ্ড। চিন্তার সূক্ষ্ম শব্দরাশি ওই উচ্চ- লেলিহান শব্দের আগুনে ঝলসে গেলে সহসা তাহের বধির হয়ে পড়ে। কুকুরটি তাহেরের পায়ের ঘ্রাণ নেয়, ওর রোমশ স্পর্শে অনুভূতির গভীরতর আলস্য থেকে জাগিয়ে তোলে হে কুকুর, জানোয়ারের জীবন যেন তোমাকে গ্রহণ করতে না হয়!
না হয়! না হয়! অস্ফুটে স্বগতোক্তি করতে করতে তাহের একটা পাউরুটি কিনে ছিঁড়ে ছিঁড়ে দেয় আর কুকুরটি পাউরুটি চিবুতে চিবুতে দেখে চিলেকোঠার মৃত বুড়ো থিকথিকে ঘায়ের রক্তপুঁজ মাখা রোগা-পটকা শীর্ণ শরীর নুইয়ে রুগ্ণ কুকুরের মতো তার পাউরুটির দিকে ঝুঁকে আসছে। মৃত বুড়ো ক্ষুধা নিয়ে মরেছিল, দীর্ঘদিন পক্ষাঘাতে শরীরে ক্ষত ও ক্ষুধা স্থায়ী হয়ে উঠেছিল, এখনো ওই হাহাকার দীর্ঘশ্বাসে বিপুল ও স্ফীত হয়ে এলে কুকুরটির মুখ থেকে এক টুকরো পাউরুটি ছিনিয়ে নিল মৃত বুড়ো। পাউরুটির টুকরো ছিনতাই হয়ে গেলে কুকুর আর অদৃশ্য মৃত বুড়ো কামড়াকামড়ি শুরু করে। তাহের কতিপয় কুকুরের কামড়াকামড়ি আর করুণ আর্তনাদ শুনতে শুনতে দেখল অজ্ঞাত পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী খাদ্য অধিদপ্তরের চাল না পেয়ে শূন্য ঝোলা হাতে রক্তাক্ত কপালে একাশিয়া গাছের নিস্তব্ধ ও ধস্ত পাতার তরঙ্গ অতিক্রম করে উঠে আসছে, রক্ত আর চিৎকারের উচ্ছ্রিত তরঙ্গে ক্ষুধার্ত প্রাণীর কান্নার সংক্রামক ধ্বনি ছুঁয়ে ক্রোধের অবরুদ্ধ ঘূর্ণিপাকে উঠে আসে শিশু, নারী ও পুরুষের দল। চাল না পেয়ে এই সমস্ত মানুষের নিষ্ফল ক্রোধ স্থির আগুনের ম্রিয়মাণ শিখায় দপদপ করে আর যারা সকলের অলক্ষ্যে চালের বস্তা সরিয়ে ফেলেছিল তারা শোকে অশ্র“র গ্লিসারিন ঝরালে পুলিৎজার জিতে নেওয়া শকুন, মৃতপ্রায় শিশু এবং কেভিন কার্টার তাহেরের রক্তে উস্কে ওঠে, তাকে মরবিড করে। তখন সেলফোনের ক্যামেরা থেকে ডিলিট করে কুকুরের ছবিটি। কুকুরটির একটা নাম দেবার কথা ভাবে। কী নাম দেওয়া যায়? কুকুরটি কি নারী, না পুরুষ? কমন জেন্ডারের কোনো নাম, ধর্ম-গোত্রহীন, বস্তু অথবা দৃশ্যহীন কোনো চেতনাগত ধ্বনিপুঞ্জ! রং অথবা সংখ্যাতাত্ত্বিক কোনো শব্দ!
প্রতিটি নামশব্দের সঙ্গে এক-একটা মেরুদণ্ডহীন বিকৃতি, একটা স্বার্থান্ধ ট্রোমা, প্রেতার্ত ফসফরাস আর ফরমালিন মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। প্রতিটি নাম ভয়ানক অপাঙ্দর্শিত। অকস্মাৎ স্বপ্নবিভোর শৈশবের দিনগুলোর নক্ষত্রমণ্ডল, সূর্য, চাঁদ, বৃক্ষ, নদী চল্লিশোর্ধ্ব যৌবনে দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া সময়ের একটি সাদা অগ্নিগোলকের মধ্যে ঢুকে যায়, আর তাহের নিজের আবেগ-কল্পনা ও নিষ্পলক চোখের ভেতর লাফিয়ে লাফিয়ে প্রৌঢ়ত্ব বরণ করে, মেটারফোসিস হয়ে যায়। ফলে সে গ্রেগর সামসার মতো গুটিসুটি মেরে পরীক্ষার উত্তরপত্র, প্রশ্নপত্র, নম্বরপত্র, লাল কলম, মাই নেম ইজ রেড নিয়ে কলাপসিবল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দোতলার লোডশেডিং কবলিত কলিংবেল টিপতে লাগল। অত্যন্ত বিভ্রান্ত বোধ করে এলোমেলোভাবে প্রত্যেকটি সুইচ তীব্র আক্রোশে চেপে চেপে ধরল। চারপাশে হাসির হল্লা, চ্যাপলিন অথবা মি. বিনের চলচ্চিত্র দর্শকের মতো সম্মিলিত অট্টহাসি অন্ধ ও বধির হয়ে ছুটে আসে। চিলেকোঠার মৃত বুড়ো আমোদে দেখে তাহেরের হাতের আঙুলগুলো কলিংবেলের সুইচে ছুটে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ মৃত বুড়ো দেখল কলিংবেলের সুইচগুলো এক-একটা ডায়নামো আর বিকট একটা মাকড়সা ডায়নামোর ফাঁকে ধুঁকছে।
দুই
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হবার পর লন্ডন থেকে এক সিলেটি বন্ধুর ফোন আসে। খোয়াবের ঘোরে কোনো এক স্যানাটোরিয়ামে ইলিয়াসের পা কেটে ফেলার দিনগুলো ফিরে আসে। আর একজন অমিতাভ বচ্চনের পা সিনেমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল? পা লুপ্ত হয়ে যাবার পূর্বে তুলে রাখা ইলিয়াসের ছবি স্মৃতির মধ্যে অনুবাদ হতে হতে এইসব নিরুদ্দেশ এবং গোপন হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে বন্ধুর বিষন্নতা ও উত্তেজনা তাহেরকে সংক্রামিত করে। হাত-পায়ের শক্তি লুপ্ত হয়। একজন ঘুমন্ত বাসচালক পেট্রোলে ঝলসে পোড়া মাংস ও রক্তের ভেতর অচেনা হয়ে এলে একটানা তিনদিনের হরতালে হাঁপিয়ে ওঠে। ফাহমিদা কন্যার মাথার দিব্যি দিয়ে ওকে বাসায় আটকে রাখে। যদিও এইসব নাকিকান্না আর দিব্যির সেন্টিমেন্ট ওকে কোনোভাবে প্ররোচিত করে না, বরং কোথাও একটু বিপন্নতা চৈতন্যের ভেতর উস্কে উঠতে চাচ্ছে। রক্তের মধ্যে দগ্ধ বারুদের মতো ভয় ঢুকে পড়ে। সিপিবির রেখা আপার ফোন আসে। ভদ্রমহিলা কবিতা লেখেন, ওর জুনিয়র বন্ধু নাট্যকর্মী দোলন শীল একদিন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, তারপর থেকে কোনো কবিতার পঙ্ক্তি লিখলেই তাহেরকে তিনি ফোন করেন। তাহের বারুদ আর বিষন্নতার ভয় থেকে উঠে আসে, এবং কবিতা শুনবার প্রস্তুতি নিতে নিতে ওয়ার্ল্ড পোয়েটসের কথা ভাবল। ভাবল ওয়ার্ল্ড পোয়েটসের আসরে রেখা চৌধুরীকে আসতে বলবে। রেখা আপা একই বাক্য তৈরি করলেন – এরপর কে তাহের? তাহের ধন্দে পড়ে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করে। বুঝতে পারে, এসব নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া, হত্যা হয়ে যাওয়ার অশ্র“পাতে ধীরে ধীরে কণ্ঠ দীর্ঘ ডিপ্রেশন রপ্ত করে চলেছে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যর্থতা অথবা সমস্যা নিয়ে একমাত্র ওঁর সঙ্গেই কথা বলা গিয়েছিল। ওঁর লেকসার্কাসের ফ্ল্যাটে সাদা আঠালো পোকায় উজাড় করে দেওয়া ঝামরে ওঠা নিমগাছটি কেটে ফেলবার গোপন শোক তখন অশ্র“ময় হয়ে থাকলেও চৈত্র সংক্রান্তির পাটশাক, তিতা করলা ভাজি আর বিবিধ মাছের মেন্যু গভীর সহানুভূতি বিস্তার করেছিল। এসব বাক্য বিনিময়ের অবসরে মনে হলো তাহেরের Ñ মানুষের মৃত্যু, মৃত লাশের হলুদ-কালো শরীর, হত্যাযজ্ঞ, চাকরি হারাবার দাঁতাল ভয়, লাশ গুম, ধর্ষণ অথবা বিরোধী দলের হুইপকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করার কৃতিত্বে তেতাল্লিশ সিঁড়ি টপকে পুলিশের বড়কর্তা হয়ে যাওয়ার টেক্সট! ভাববে না, এসব ভাববে না। রেখা আপা কথা বলেই চলেছেন, আর তাহেরের মাথার মধ্যে ইথার থেকে শব্দগুলো চিৎকার করে ফেটে পড়ে, আর দোলন ওদের নতুন পথনাটকের স্ক্রিপ্ট দেখায় ‘লাশের দেশ’, আর ‘গর্তে’র ইম্প্র“ভাইজ টেক্সট নিয়ে কিছু খুচরো আলাপ হয়।
‘গর্তে’র স্ক্রিপ্টে চোখ বুলাতে বুলাতে তাহেরের মগজের মধ্যে দিনগুলো গল্প হয়ে আসে, চিৎকারগুলো গহিন গর্তের ভেতর থেকে প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়ে। নিজেকে সে আবিষ্কার করে কালো কংক্রিটের ভাঙা ধারালো পাথরের গর্তের মধ্যে। তার চোখের রক্তাক্ত শিরায় বৃত্তাকার মানুষের মুখ, তাদের নড়াচড়া হিংস্র দানবের মতো। দোলনের ডাকে কংক্রিটের গর্ত থেকে উঠে আসে হাসান ভাইয়ের খবর জানেন? তাহের নিজের ভাবনার অতলান্তিক আঁধার থেকে মুমূর্ষু মাছের মতো বলে কোন হাসান? দোলন যথারীতি চিরাচরিত মানে আপনাকে নিয়ে আর পারি না, আমাদের তো দুই হাসান ভাই। একজন সমকাল থেকে প্রথম আলো এবং সেইসূত্রে আজ চেন্নাই তো কাল হয়তো জার্মানি, আর একজন বণিক বার্তা থেকে অন্যদিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে ব্যস্ত। দিজ ইজ বিশ্বায়ন ম্যান! দেখ শালা, দশটা-ছয়টা অফিসের চোদন, খ্যাপা কুত্তার মতো বিশ্বায়নের চাপাকলে হার্ডল রেস কীভাবে বলাৎকার করে, দুম করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেখা তুই কারো দাসানুদাস না, গলগলে রক্তফেনা মাখা মুখে দাস হয়ে গড্ডলিকায় ভেসে যাবি, আমি তুড়ি বাজিয়ে ধেই ধেই করে নাচব!
হঠাৎ দোলন খ্যাপাটে ঝড়ের তাণ্ডবতায় চঞ্চল হয়ে উঠলে তাহের ওর মুখের দিকে দেখে, চোখের ভাষা পড়ে! ওর খয়েরি পোলো টি শার্টের নিচে গলগলে রক্তের উচ্ছ্রিত নীল তরঙ্গ। আপন খেয়ালে স্বগতোক্তি করে, সুদূর নীলিমার মেঘপুঞ্জ ছাড়িয়ে ওর কণ্ঠস্বর মঞ্চের নেপথ্যসংগীত হয়ে বাজে, ইদানীং ও ব্লগে লেখার চেষ্টা করছে। বিজ্ঞানমনস্কতার চর্চা শুরু করেছিল এমন বন্ধুদের ফেসবুক বিপ্লবী হয়ে ওঠার গল্প বলে। আর শহরজুড়ে রাস্তা খোঁড়ার উৎসবে গর্ত-নাটকের দৃশ্য রচনা করে চলেছে দেখে ওরা অনেকক্ষণ হাসে। মাথাভর্তি কাশফুলের গুচ্ছ উড়িয়ে প্রিয়দর্শিনী কলিগের বাবার লাল চায়ে চুমুক দেওয়া দেখে নাটকের বাদামওয়ালা ক্যারেক্টারের স্টেপ ভুল হওয়ার স্মৃতি স্মরণ করে তাহের বলে হাসানদের দোষ দিয়ে কী হবে বলো। আমরাও তো চাকরিই করছি, এই চাকরি ছেড়ে নতুন কোথাও যাবার চেষ্টা ভেতরে ভেতরে আমাদেরকেও নির্লজ্জ কুকুরের মতো ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে না! দোলন বিমর্ষ হয়, স্যাটায়ার করে Ñ ওই মিয়া কুত্তা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না? কুত্তার মতো গরম, কুত্তার মতো যানজট, কুত্তার মতো নির্লজ্জ ছুটছি, আর কী কী আছে কুত্তার মতো একবারে কইয়া ফ্যালান। সহসা দোলনের পরিহাস অসম্ভব নির্লিপ্ত ও প্রশান্ত হয়ে ওঠে। তারপর বলে, কুত্তার মতো ছুটছি সত্যি, কিন্তু আপনার হাসান ভাইদের মতো অন্যের দৌড় দেখে বাথরুমের স্যান্ডেল ছুড়ে মারি না। অতঃপর দুজনে অনেকক্ষণ নীরবতার গল্প রচনা করে। রেটিনার স্বচ্ছ তারায় কুটো পড়ে আর চোখের পাতা কাঁপে, গালের মাংস কাঁপে, ঠোঁট কাঁপে। দোলনের ব্ল্যাকিশ চামড়ার নিচে লোহিত কণাগুলো ফুটছে উঠছে নামছে নিভছে জ্বলছে। সিগারের আগুন হঠাৎ প্রলয়ে বিদীর্ণ হলো, স্খলিত ছাই হাওয়ায় উড়িয়ে দোলন পার্বতী বাউল আর প্রতিমা পাণ্ডের গান তাহেরের মোবাইলে ব্লুটুথ করে।
কথায় কথায় মাহমুদ ভাইয়ের প্রসঙ্গ এলো এক স্বপ্নের শহরে ট্যাক্সিচালকের পেশা ছেড়ে পুনরায় মাতৃভূমিতে ফিরে আসার বৃত্তান্ত। হৃৎপিণ্ড বুলেটে ছ্যাঁদা করে স্বৈরাচারী কবির প্রজা হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন মাহমুদ ভাই। তখন সেই দুর্যোগের কালে মাহমুদ ভাইয়ের বিচিন্তা চির-অন্ধকারে ঘুম পাড়িয়ে দিলে পিজি হাসপাতালের বটবৃক্ষের ঝিলিমিলি পাতার শীতধূসর সন্ধ্যায় ভৌতিক হয়ে ওঠে। ফলে ম্যারিকা ফেরত ট্যাক্সিচালক স্বদেশের জেন্ডার সেনসেটিভ নতুন স্বৈরাচারদের জাপানি বিউটিশিয়ান এবং হঠাৎ হিজাব পরা ডটার অব পিস দেশপ্রেমের একমাত্র দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠায় নিজেকে অর্বাচীন মনে হয়েছিল। মেনে নিতে না পারার রোগ রক্তের মধ্যে হাতছানি দিতে থাকলে একদিন অকস্মাৎ পত্রিকার আঁধার বর্ণমালা হয়ে গেলেন মিনার ভাই ওরফে মিনার মাহমুদ। মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে দেওয়া সন্ধ্যায় একদিন হন্তদন্ত মাহমুদ ভাইকে দেখেছিল প্রেস ক্লাবের সামনে। তাহেরের সঙ্গে সেই শেষ দেখা। হাসানের সঙ্গে মাহমুদ ভাই প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল, বণিক বার্তা যাবার পথে ছেলের প্রথম জন্মদিনের উৎসবে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজের ভাবনা বলেছিলেন আসলে রূপান্তরিত হতে হবে প্রত্যেককে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে একজন মিনার মাহমুদ কতটুকু নির্যাতিত হয়েছেন, এবং সেই একই চৈতন্যে কুড়ি বছর পর রাষ্ট্রের কাছে আপনি কী চাইতে পারেন? এর মধ্যে কত ধরনের রূপান্তর ঘটেছে, আপনি পনেরো বছর পর দেশে এসে মিলতে পারবেন না, দুম করে আত্মহত্যা করবেন, পরিবর্তিত রাজনৈতিক এবং অপরাপর সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে রূপান্তর না করলে তো হবে না! তাহের কিছু বিস্ময় জমিয়ে ভেবেছিল আত্মহত্যা করতেও অনুমতি নিতে হবে নাকি! উড়ন্ত হলুদ বটপাতা দেখতে দেখতে প্রসঙ্গ পালটাতে চেয়েছিল আপনার সম্পাদকের খবর কী? হাসান মৃদু হাসি আবিষ্কার করে, যৎকিঞ্চিৎ বিষন্ন হলো কিনা বোঝা যায় না, বরং সিগারের ধোঁয়ার রিং প্রস্তুত করে বলে দামি মাইক্রো, প্রতিদিন নতুন নতুন রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ, সন্ধ্যায় বারিস্তা অথবা অন্য কোনো ক্যাফেতে ড্রিংকস; আমার ধারণা উনি এখন ইয়াবা-আসক্ত। লোকটাকে এখন চেনাই যায় না! আনু স্যারদের সঙ্গে কাজ করে আলী ভাইয়ের কথা মনে আছে আপনার? ব্রোশিয়রের জন্য রোজা লুক্সেমবার্গ অথবা কী একটা বিষয়ে লেখা চাইতে এসেছিল, উনি তো রীতিমতো ক্ষিপ্ত হলেন, আপনারা এখনো ওইসব নিয়া আছেন কইতে কইতে বেরিয়ে গেলেন! আলী ভাইয়ের মুখ গাড়ির হর্নের সঙ্গে ইথারে মিশে গোপন এক চক্র ক্রমশ তাহেরের স্মৃতিভ্রংশ বিস্তৃত করে চলে। অচেনা পক্ষিকুল অলক্ষে বটফল ছড়িয়ে দেয়। অনেকক্ষণ আলী ভাইয়ের মুখ মনে করতে চেষ্টা করে ডানা মেলা বটবৃক্ষের শাখাপ্রশাখা, লাল ইটের চন্দ্রাকার সিঁড়ির ওপর নিজেকে আবিষ্কার করে সিগারের ধোঁয়ার নিষ্করুণ ভেসে যাওয়ায়। বারবার কেভিন কার্টারের অস্পষ্ট ফটোগ্রাফিটি পাতার ফাঁকে ফাঁকে বাতাসে দোল খায়। মনে হয় রোজা লুক্সেমবার্গ কি ব্যালে ডান্স জানতেন? হাসান পুনরায় স্বগতোক্তি করে পঞ্চাশ কোটি টাকার প্রজেক্ট, বাংলাদেশে তো কোনো বাণিজ্যবিষয়ক ডেইলি নেই, এটার একটা ব্রাইট ফিউচার ছিল! ওনার মতো ইয়াং মেরিটরিয়াস, কী দুর্দান্ত নিউজ করে একসময় ঝড় তুলেছেন, ভাবা যায় সেই লোকটা এত দ্রুত বদলে যাবে! তবে কী জানেন, উনাকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হয় মাঝে মধ্যে, চেহারার জেল্লা দেখতে পাওয়া কালো সু, দামি ব্র্যান্ডেড পোশাকের আড়ালে লোকটা কোথায় যেন পরাজিত তাড়া খাওয়া বন্ধুহীন একা। আপনি তো জানেন পত্রিকার নাম নির্বাচন থেকে শুরু করে পেজ মেকআপ, ডিজাইন, বানানরীতি কী হবে এভরিথিং দুজনে ঠিক করলাম, এখন আমার সঙ্গে ওনার কোনো কথা হয় না বললেই চলে। ওনার কাছের লোকগুলোকে বলা নেই কওয়া নেই বলে দিচ্ছে সাম্স সাহেব ৩০ তারিখে আপনার ফেয়ারওয়েল! এটা কোনো কথা হলো বলেন? তাহেরের অপভ্রংশ স্মৃতি ফিরে এলো মাসকয়েক আগে হাসানের সম্পাদকের সঙ্গে দোলনের দেখা হয়েছিল। ঢাকা শহরের লুপ্তপ্রায় একমাত্র অ্যান্টিক মুড়ির টিন ছয় নম্বর বাসের রড ধরে উনি দাঁড়িয়েছিলেন। হু-হু হাওয়া বটের ঝিরিঝিরি পাতায় কাঁপন তোলে। অকারণ মিথ্যে মিথ্যে হাসির গল্প বানায় আর করুণার ক্রুদ্ধ অশ্র“ সংবরণের জন্য কোনো ডোডো পাখির বিচরণকালে মদ্যপানের আয়োজন করতে চেয়েছিল বব মার্লির লিরিকস গাইতে গাইতে তাহের বলে পঞ্চাশ কোটি টাকা পেলে আমিও আপনাকে চিনব না। তারপর হাসানকে চলে যেতে হয়েছিল বণিক বার্তার ইভিনিং শিফটের সূর্য দৌড়ে গেলে। আর তাহের ছুটন্ত বাসের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করেছিল আরে শোনেন শোনেন, রূপান্তর মানে কি বাদামের খোসা পকেটে পুরা…!
কীভাবে সেদিন নিজের ভেতর এত নাটকীয়তা, এত উত্তেজনা উস্কে উঠেছিল, স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে কেমন করে এত উন্মত্ততা আবিষ্কৃত হয়েছিল ভেবে নিজেই বিস্ময়ের ধন্দে পড়ে। সেদিন মনে হয়নি, এখন মনে হলো হাসানরা কেউ গ্রেগর সামসা নয়, প্রত্যেকে মিস্টার হাইড, ভেতরে ভেতরে পচে গলে এক-একটা মূর্তিমান আতঙ্ক। তাহের ভাবল সে কি আসলেই ছুটন্ত বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করেছিল? আড়চোখে দোলনকে দেখে, সিগারের আগুনটা ধকধক করে জ্বলছে প্রতিটি টানে। এখন চিৎকার করে ডাকবে দোলনকে! ওর পিঠে আলতো করে হাত ছুঁয়ে অনুভব করবে রক্তের স্পন্দন! মেনে নিতে না পারা বিপরীত স্রোতে ছুটতে ছুটতে ক্লিশে জীবনকে গ্রেগর সামসায় রূপান্তরিত না হবার প্রতিজ্ঞায় কর্কশ, রুক্ষ, নিষ্ঠুর দোলনকে চিৎকার করে ডাকবে! ডাকবে চিৎকার করে দোলনকে! চিৎকার করে ডাকবে দোলনকে! তাহেরের কণ্ঠ ছিঁড়ে কোনো চিৎকার ধ্বনিত হলো না, বরং দেখল অসংখ্য যান্ত্রিক শব্দ আর প্রতিধ্বনির মধ্যে বৌদ্ধপূর্ণিমার বিজন জ্যোৎস্নায় দোলন ধূসর হয়ে দূরে সরে সরে যাচ্ছে।
তিন
নিদারুণ দুপুরে রেখা আপার ফোন এলো। উদারতাহীন রৌদ্রের স্ফুলিঙ্গ উড়ে উড়ে রেখা আপার মগজে কবিতার শব্দ মরীচিকা হয়ে যাচ্ছে কবিতাটা লিখতে পারছি না, তবু তোমাকে ভাবনাটা জানাই এদেশকে যারা পরিবর্তন করবে তারা এখনো মাতৃজঠরে! শোনো, আমি তোমাদের মতো আধুনিক কবিতা লিখতে পারি না। তাছাড়া এসব কবিতা হয় কি না তাও জানি না। আমার ছেলে পড়ে আর মাঝে মাঝে বলে, মা তুমি রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে উঠছ। এসব ঠিক না। আচ্ছা সাতক্ষীরার সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে মানববন্ধনে তুমি ছিলে? তোমাকে দেখলাম না… শোনো, শুনতে পাচ্ছ, পুলিশ যেভাবে মারমুখী হয়ে উঠছে, কোর্ট এরিয়ায় একজন মেয়েকে শ্লীলতাহানির প্রতিবাদে সমাবেশ করবে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি। তুমি এসো, প্রেসক্লাবের সামনে, কাল বিকেলে, আজ কবিতাটা নিয়ে ভাবছি, কিছু দাঁড়ায় কি-না দেখি। পত্রিকা খুলতে ভয় লাগে, প্রতিদিনই খুনোখুনির সংবাদ, শুনছ, শুনতে পাচ্ছ…।
তাহের শুনছে, শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু শ্রবণ ভয়ানক পরিত্রাণহীন হিপোক্রেসি রপ্ত করে চলেছে; কোনো শব্দই মস্তিষ্কে থিতু হয়ে বসছে না। ভাবল এ কী শ্রবণের জটিলতা না কী মস্তিষ্কের সেরিব্রালসমূহ অর্থহীন নিস্পৃহতায় নিদ্রাতুর! কেবল বর্তমান, বর্তমান, বর্তমান… এক-একটি বর্তমানের বুদ্বুদ ফেটে পড়ছে। তাহের মস্তিষ্কের কোষে কোষে প্রতিবাদলিপি রচনা করে। পরদিন পরাক্রান্ত রোদ অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে দিচ্ছে। পুনরায় রেখা আপার ফোন এলো শুনছ, তাহের শুনতে পাচ্ছ, শুনতে পাচ্ছ… পরীবাগে এত তরুণীর ছাব্বিশ টুকরো লাশ পাওয়া গেছে, আমি খেতে পারছি না, ভেতর থেকে বমি উঠে আসছে, বাথরুমের কমোডে রক্ত, বাথরুমে যেতে পারছি না, শুনছ… তাহের শুনতে পাচ্ছ… শুনতে পাচ্ছ তাহের… তাহের কিছুই শুনতে পায় না, নিঃসীম বধিরতার মধ্যে ন্যালাভোলা কন্যার জন্য বুকের ভেতর রক্তপাত হয়। দেখে লেলিহান অগ্নিশিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে ঘর, টিনের চাল, নারকেল গাছের চিরল চিরল পাতা। আর পোড়াবাড়ির কালো অঙ্গারস্তূপে হু-হু বাতাসের দীর্ঘশ্বাস, পোড়া কাপড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছে অগ্নিরক্তে দগ্ধ স্ত্রী-কন্যা। খণ্ডিত স্তন, ছিন্ন যোনি, কণ্ঠার হাড়, ছাড়িয়ে নেওয়া চামড়ায় ঝুলন্ত কালো চুলের তরঙ্গভয়ের ঘূর্ণিচক্র রচনা করে। মগজের সূক্ষ্ম শিরা-উপশিরা ছিঁড়ে টুকরো হয়ে যেতে লাগল তাহেরের। নাক-মুখ দিয়ে গরম নিশ্বাস-প্রশ্বাস শঙ্খিল হয়ে উঠছে। ভয়ে ক্ষুধার্ত শীতকুকুরের মতো গুটিয়ে যেতে যেতে দেখল মৌমি সেলাই নিয়ে বসেনি। বরং শুকিয়ে যাওয়া নদীমাতৃক দেশের মানচিত্র রচনা করে বিচিত্র রঙের সুতার জট। দুপুরটা অন্ধকার হয়ে যেতে যেতে দেখল এলোমেলো বালিশ আর রঙিন সুতোর জালের মধ্যে বালক আইনস্টাইন নিদ্রায় মরে গিয়ে নেফারতিতি হয়ে রয়েছে। মমি! মমি! মমি! কেন! কেন! কেন! কেন রেখেছিল ওই বিষাদমাখা নাম! জীবনের সমস্ত আবেগ-উপলব্ধি স্তব্ধ হয়ে থাকা চঞ্চল রক্তের স্পন্দনে বিষণœ আত্মার নৈঃশব্দ্য কেবল উন্মুক্ত রেটিনার মধ্যে খেলা করে বেড়ানো ওই মৃত্যুশীতল অভিজ্ঞতার ধ্বনিপুঞ্জ কেন ওর জীবনের সঙ্গে সেলাই করে দিয়েছিল! শব্দগুলো তাহেরের বুকের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলল আর ও চিৎকার করল তুই মমি না, মমি না! চিৎকারে ফাহমিদা ছুটে এসে বিস্ময়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বসে। ছোট্ট শিশুর মতো তাহের হাত-পা মুড়ে ফাহমিদার বুকের ভেতর ঢুকে পড়ে। অতঃপর এইসব অগ্নিরক্তের চলচ্চিত্র ভাবতে ভাবতে ঘরের মসৃণ ফ্লোরে গাল পেতে শোয়। মুছে দেওয়া ফ্লোরে তখনও পানির বিহ্বল চূর্ণ। বিগলিত অশ্র“র অবরুদ্ধ ফোঁটা এক-একটা হীরকখণ্ডের দ্যুতিতে চিকচিক করে উঠলে বিষন্নতার দুর্জ্ঞেয় ব্যাখ্যাতীত অভিব্যক্তি তাদের আচ্ছন্ন করে। বিষাদগ্রস্ত নীরবতার মধ্যে দুজনেই ঠান্ডা ফ্লোরে শুয়ে ক্রমেই উষ্ণ হয়ে ওঠে। দেখে ফাহমিদার বুক শুকনো পরিত্যক্ত শস্যের মতো নরম এবং ফ্যাকাশে, দেখে ভ্রƒণের গোপন প্রতিধ্বনির বিস্তার, দেখে জরায়ুকুঞ্জের অবলুপ্ত আঁধার, ঊরু, জঙ্ঘার ম্যাড়মেড়ে দরিদ্র ঠান্ডা বরফ। তাহের মুখ রাখে পিঙ্গল নাভিমূলে, শুনতে চেষ্টা করে ভেতরে ভ্রƒণের প্রস্ফুটন, নড়াচড়া। কান্না পায়, কান্নার গভীর আবেগে তাহেরের সমস্ত শরীর বিপন্ন পতঙ্গের পাখার মতো কাঁপে। ফাহমিদা ওকে শিশুর মতো বুকে তুলে নেয় আর তাহেরের শরীর শিরশির করে ওঠে। বুকের প্রাগৈতিহাসিক মাংসের অ্যাপোক্যালিপটিক আঁধার থেকে উচ্ছ্রিত দুর্জ্ঞেয় ধ্বনি ভ্রুকুটি করলে আত্মবিস্মৃত তাহের প্রচণ্ড উন্মত্ততায় ফাহমিদার পেট খামচে ধরে, নাভির ছিদ্রে আঙুল ঢুকিয়ে অপুষ্ট ভ্রƒণ টেনেহিঁচড়ে বের করে আনতে চায়, বুক কামড়ে দেয়, সাঁড়াশির মতো হাতের মোটা গিঁটগুলো গলার দিকে এগিয়ে গেলে ফাহমিদা আতঙ্কে বিস্ফারিত। কাণ্ডজ্ঞান লুপ্ত তাহেরের চোখে নীল চঞ্চল শিরা অকস্মাৎ উত্তপ্ত রক্তের ফোঁটায় ফোঁটায় ফেটে পড়ছে। ভয়ে ফাহমিদার কণ্ঠ চিরে স্বর বের হলো কিনা, তখন নিস্তব্ধ রাগী অশ্বের মতো ঝাঁঝা দুপুর বিদীর্ণ করে দরজার সামনে দুর্বোধ্য চিৎকার করল মৌমি।
তারপর নিদারুণ জ্বর এলো মৌমির। প্রলম্বিত রাত নিসাড় হয়ে রইল; নীরবতা প্রহেলিকাময় রাত্রির গভীরতম প্রদোষে নিঃশব্দ ও বিমর্ষ দোলকের মতো ঝুলন্ত। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকে চলে, স্বপ্ন দেখে, জলমগ্ন নদীতীরে সে এক বুড়ো মৎস্য ফেরিওয়ালাকে খুঁজছে। পথের দুধারে কাঁটাঝোপে হলুদ ফুলের রেণু উড়ছে, তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ ঘাসফড়িং, পুষ্পগন্ধময় মৃদু বাতাসের নৈঃশব্দ্যে মা দূরে সরে সরে ইশারায় তাকে ডাকে; কাঁটাঝোপগুলো সহসা তীক্ষè আর লম্বা হয়ে ওঠে, আঁচলে গুচ্ছগুচ্ছ মৃত প্রজাপতি; নদী থেকে সে বিছানায় উঠে আসে, বিছানাটা নদী, আঁধারে ডোবা নদী, সে একটা কই মাছ, তার শরীরে তীক্ষè কাঁটার আঁচড়ে লাল আঁধার নদীর জলে মিশছে, লাল মেঘপুঞ্জ, রক্তের নেশায় উন্মত্ত হাঙর ছুটে আসে, হাঙরের তরবারির দাঁত গলার দিকে এগিয়ে আসে, চোখের রেটিনার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে; মৃত জুঁইফুলের মতো ফ্যাকাশে চুল উড়িয়ে বাবা হাঙরটা মুঠোর মধ্যে পুরে তাকে দিলে সে উল্লাসে লাফিয়ে উঠল।
আর বাবার ফোন বেজেই চলেছে! বাবা শুকনো কাগজে হিজিবিজি লিখছে, দ্রুত লেখার খসখস শব্দে বাবার মুখ মৃতের মতো ফ্যাকাশে। মোমের আলোয় বৃত্তচিহ্নিত বাবার মুখ মোবাইলের ইনকামিং টোনে স্পাইরাল হয়ে প্রতিধ্বনি তোলে। আবার দেখল, বাবা গুচ্ছগুচ্ছ রঙিন চিরুনি সুতোয় বেঁধে আকাশের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিচ্ছে, সে আর মা ছোট্ট শিশু, প্রজাপতির পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ভাঙা পুরনো বাড়ির ছাদের ওপর বাবা হাওয়াই মিঠাই নিয়ে আকাশ থেকে লাফিয়ে পড়ল। বাবা আনন্দে চিৎকার করছে আর আকাশের রং নীল, বাবা হাসছে আর আকাশের রং কমলা, আকাশের রং বেগুনি, আকাশের রং সবুজ, হলুদ, গোলাপি, খয়েরি, বাদামি…। বাবা আকাশের পৃষ্ঠায় কবিতা লিখছে আর আকাশ রক্তাক্ত অক্ষর হয়ে উঠছে। সে রক্তাক্ত কাগজ ছিঁড়ে জানালা দিয়ে উড়িয়ে উড়িয়ে প্রজাপতি তৈরি করল, দেখল Ñ
রৌদ্রে প্রজাপতির ডানা
রৌদ্রে ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন চিরুনি
রঙিন চিরুনি রঙিন চিরুনি
লাল প্রজাপতি
লাল প্রজাপতি
অতঃপর দেখল, সে একটা মৃত প্রজাপতি হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে।
চার
লেখাটি শেষ পর্যন্ত অসমাপ্তই থেকে যায়। সাতিশয় হারামজাদা মদু সাকে নিয়ে ভাবছিল এবং এমন আরো নানাবিধ বিষয় ঠাসাঠাসি বুকশেলফের কোনাকাঞ্চিতে বন্দি হয়ে রয়েছে। প্রথম আলোর জন্য বুক রিভিউটি করোটির ভেতর নিঃসঙ্কোচ অনাগ্রহ তৈরি করে। এক সন্ধ্যায় শিশু চিকিৎসক হেলথ ইকোনমিক্সে ইভিনিং কোর্সে ডিপ্লোমা সমাপ্ত করে ফিরে আসা তরুণ বন্ধু শাহীনের সঙ্গে দেখা হলো অনেকদিন পর। অবশ্য তরুণ চিকিৎসক শিল্পের রাজনৈতিক পরিভাষা ও চলচ্চিত্র নিয়ে নিজের ভাবনা অনুবাদ করতেই গভীর আত্মীয়তা অনুভব করে, তথাপি একদা বাবার সহকর্মী বোহেমিয়ান কবি ও শিক্ষকটিকে শাহীন প্রথম আলোতে কবিতা পাঠাতে বলে। প্রশ্ন করে ওরা আপনার কবিতা ছাপবে? বুক রিভিউ কি আপনার কাজ? কেন করেন? ওরা তো অপোগণ্ড, নপুংসক করে ছাড়বে! আপনাকে গিলে খাবে! প্রথম আলোতে লিখবেন আবার টাকাও নেবেন না, আপনি তো বোহেমিয়ান কবি থেকে বুর্জোয়াদের সহযোগী হয়ে উঠছেন? তাহের মৃদু হাসে না, তা নয়, আজিজের সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা, ওর রিকোয়েস্টে লিখেছি, নইলে কি দরকার ছিল, তাই না! তারপর শাহীনদের চলচ্চিত্রচর্চার কথা জিজ্ঞেস করে তোমার ষোলো মিলিমিটার অনেকদিন বন্ধ, পত্রিকাটা হওয়া উচিত! ফিল্মের কাগজই তো নেই! তাই না! ইত্যাদি বাক্যবিনিময়ের কোনো এক নির্লিপ্ত মহূর্তে ভেবেছে সত্যিই তো, কেন সে বুক রিভিউ করছে প্রথম আলোতে? কেবলই কি বন্ধুকৃত্য? নাকি পরিচিতির গোপন উল্লসিত কোনো সূক্ষ্ম অভিলাষ! তবে কবিতা কেন ছাপছে না প্রথম আলো? প্রশ্নগুলো, জিজ্ঞাসাগুলো ধুলোর ঘূর্ণিতে চারপাশ আঁধার করে দিলো। ইদানীং মৌমির দৃষ্টি এড়িয়ে কবিতার একটা-দুটো উপলব্ধি লেখাও দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। লেখার কাগজ দেখলেই মেয়েটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে জানালার বাইরে উড়িয়ে দেওয়ার উদ্ভুত শুশ্রƒষাহীন খেলার আনন্দে কদিন বিভোর। বাচ্চাদের পরীক্ষার খাতা ছিঁড়তে শুরু করলে তাহের নিজেই মহা-উৎসাহে অলিখিত কাগজ ছিঁড়ে দেয় এবং এই নির্দোষ হিপোক্রেসি হাসির তরঙ্গ বিস্তার করে জানালার বাইরে দেখে। সেখানে উড়ন্ত ঘূর্ণনশীল প্রজাপতির মতো রৌদ্রের মরীচিকায় কাগজের টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়ে। ভাবে, সত্যিই যদি এইসব পরীক্ষার উত্তরপত্র ছিঁড়ে টুকরো করে ছড়িয়ে দেওয়া যেত? যদি খাতা আর কখনো দেখতে না হতো? সাদা কাগজের চতুষ্কোণ ঘরের মধ্যে কালো বর্ণগুচ্ছ বিপুল মাংসাশী; এক-একটা মেরুদণ্ডহীন অক্টোপাস, তার শরীর থেকে রক্ত চুষে ছোবড়া বানিয়ে ফেলছে, অক্ষরগুলো কালো বিড়ালের মতো নিঃশব্দে তাকে ছোবল দিতে থাকে। পুনরায় ভাবল যদি খাতাগুলো সত্যিই ছিঁড়ে ফেলা যেত, মৌমি যেভাবে ছিঁড়ে ছড়িয়ে দেয়!
আর মৌমি রংবেরঙের চিরুনি ভালোবাসে। আকাশি, নীল, হলুদ হেয়ারব্যান্ড, শুকনো মাছ, গাছের শুকনো পাতা আর নানান কিসিমের কলমের প্রতিও ওর দারুণ ফ্যাসিনেশন। সমস্ত কলম মৌমির আন্ডারগ্রাউন্ডে অদৃশ্য হলে অসম্ভব বিরক্তি মাথার মধ্যে চিৎকার করে রক্তপাত ঘটায়। কিছু বলতে পারে না তবু, কিছু বলা যায় না, বলতে পারা যায় না; প্রতিকারহীন ক্ষোভে দুঃখে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। ময়ূরাক্ষী দুপুর, হলুদ বাল্বের মতো সূর্য কেন লিখেছিল এমন পঙ্ক্তি? সূর্যস্নাত দিনের চুল্লিতে হীরের বিষের মতো কান্না আসে।
নিরপরাধ দৃশ্যহীন অশ্র“র অন্ধকারে গতিমান বাসে যাত্রীর মুখে নতুন দ্রুতি দেখতে দেখতে একটা চলন্ত বাসের হ্যান্ডেল চেপে ধরে। জানালায় মমি-করা স্বপ্নগুলো দাঁতে দাঁত চেপে সরে যায়। মিরপুর রোডে অন্তহীন খোঁড়াখুঁড়ি, কল্যাণপুরের জ্যাম লাগাতার ছড়িয়ে পড়ছে শহরের অপেক্ষাকৃত অব্যবহৃত নির্জন রাস্তায়। গাড়ির মধ্যে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বিরক্তি চেপে রাখা প্যাসেঞ্জারদের ঘামের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে এই অগ্নিঘর থেকে তাহের বেরিয়ে আসে, অবশ্য সিটিং সার্ভিস ইদানীং লোকাল চলছে, কিন্তু ভাড়ার কোনো কমতি নেই, এখন নেমে যেতে টাকার শোক হৃৎপিণ্ড ছ্যাঁদা করে দিলো। ফুটপাতে উঠে উষ্ণ বাতাস পেল আর ভাবল Ñ হাঁটতেই তো সে ভালোবাসে। কিন্তু রাস্তায় জনসমুদ্র! সকাল দুপুর বিকেল রাত্রি জনস্রোতের বিরামহীন উত্তুঙ্গ উল্লম্ফন। মনে হয়, এদের কোনো উদ্দেশ্য নেই, বিধেয় নেই, নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই; কেউ ছুটছে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য ও অপ্রতিরোধ্য, কেউ লিকলিকে আলস্যে নির্বিকার। আর ফুটপাত তো হিউম্যান বিইয়িংয়ের উন্মুক্ত বাথরুম। ফলে হাঁটার আনন্দ উদ্যাপনও একটা এক্সপেরিমেন্ট। তবু বনস্পতির ছায়ায় দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ ভাষা প্রতিযোগিতায় অধ্যাপকদের তিন কলামে বেলুন ওড়ানোর রঙিন ফটোসেশন দেখে, মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালের উঠোনে মেঘযাত্রার স্বপ্নে বিভোর উড়ে বেড়ানো খড় আর ধূসর আকন্দ ফুল দেখে। সোহরাওয়ার্দীর সামনে শিলকড়ইয়ের নিচে থামে, ছায়া; টুপটাপ হলুদ পাতার বদ্ধভূমি আর ধুলোর সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কাচের টুকরো। ছোট-বড় অসংখ্য বিলবোর্ড চোখে পড়ে আর উড্ডীন কংক্রিটের কাঠামো সবই হাসপাতাল নয়তো ডায়াগনস্টিক সেন্টার সহসা লাল বর্ণমালা চোখে পড়ল সেবাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। তাহেরের মনে হলো, হাসপাতালগুলো রোগীদের গলায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে ক্রূর হাসছে। সে একবার ভাবল, ধন্দে পড়ে দ্রুত হাঁটল, দেখল সংসদ এভিনিউর মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেড, ট্রাফিক সার্জেন্টদের ত্রস্ত ফুৎকার, সারি সারি গাড়ির লুকোচুরি, এমনকি পথচারীদের পদযাত্রাও স্থির। লাল দেয়ালে অতিক্রান্ত দুপুর নিদারুণ নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। গণভবনের কৃষ্ণচূড়ার নিচে কুঁড়েঘরের ছায়ায় শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের উজ্জীবিত চেতনা সম্প্রতি অবলুণ্ঠিত হলে প্রধানমন্ত্রী কণ্ঠে সুর তুলতে চেয়েছিলেন, আব্বাসী সাহেব এমন পৌঢ় শিক্ষার্থী পেয়ে বিগলিত হৃদয়ে অনেকদিন পর হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধতে বসেন।
তাহের এসব ভাবছিল আর একটা মৃত লাল কৃষ্ণচূড়া কুড়িয়ে ঢাকার রাস্তায় সমুদ্র জয়ের গান শুনতে আসা নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, নাটোর, যশোর, ময়মনসিংহ, চাঁপাই, ঝিটকা, শরীয়তপুর ইত্যাদি অঞ্চলের রকমারি গাড়ির বহর দেখে, উত্তেজিত স্লোগান শোনে, যুব-গণসংবর্ধনার মিছিল; পতাকা; ব্যানার দেখে। আইল্যান্ডজুড়ে নীল জলরাশির তরঙ্গশীর্ষে কিশোর দেবদারু ও অপরাপর গুল্মের সবুজতা লুপ্ত করে সজ্জিত প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিবিধ স্থানীয় নেতার রঙিন চিত্রময় ডিজিটাল ব্যানার দেখে। যদিও সে ক্লান্তিহীন হাঁটার ছন্দে বোবা বধির কৃশ ন্যুব্জ শহরকে পদতলে নতজানু করে ফেললে সমুদ্র গবেষকবৃন্দের নাম বা ছবির উল্লেখ দেখে না। দেখে সেনগুপ্ত বাবু রেললাইনে আটকে পড়ায় বিষন্ন শহর, দেখে মানসিক ট্রোমা আক্রান্ত কোনো সহকর্মীর গোপন ক্লিষ্টতা। দেখে ঘনঘন ডিহাইড্রেশনের স্থায়ী প্রভাবে শরীর ভেঙে পড়লেও সেনগুপ্ত বাবু সংবাদ সম্মেলনে বিরামহীন বক্তৃতা করছেন। তার রাশভারী বক্তৃতা এবং নিরুদ্দেশ গাড়িচালকের জন্য শোক পাথর হয়ে এলে অদৃষ্ট বদলে দেওয়ার স্বপ্নবিভোর অবসরপ্রাপ্ত জনৈক লেফটেন্যান্ট কর্নেলের ট্রি প্লান্টেশনের হিপোক্রেসি সংবাদ শোকার্ত পাথরে পিষ্ট হতে থাকে। চিনি ছাড়া কনডেন্সড মিল্কের চায়ে চুমুক দিতে দিতে সমুদ্র গবেষক সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করতে শোনে তরুণ কণ্ঠে। হোম ইকোনমিক্সের ফুটপাতে পরিত্যক্ত তোশকের ধুলো আর ধূসর কটন উড়ে যায়। উড়ন্ত কটনের নিরুদ্দেশ যাত্রা, আনন্দবাজারের পাইরেটেড বইয়ের কোলাহলে গুম হয়ে যাওয়া পুরনো পৌঢ় বইয়ের পৃষ্ঠা দেখতে দেখতে মেসেজ আসে। প্রাচ্যনাটের গ্র“পে গর্ত-নাটকের অনুশীলন ফাঁকি দিয়ে দোলন এসএমএস করে, সেনগুপ্ত বাবু হ্যাজ নো মোর! মুহূর্তে মৃত্যুর শোকে নিথর নদীর মতো মন খারাপ হয়। পুনরায় এসএমএস আসে, নো মোর অর্থাৎ মন্ত্রিত্ব ফাকিং। অতঃপর হাসির হল্লা! কারা যেন হাসছে পিলে চমকে।
সন্ধ্যায় আচমকা ঝুমবৃষ্টি এলো। রাস্তাগুলো সমুদ্রসংগীতের দখলে। অফিস-ফেরত নারী-পুরুষ শোভাযাত্রার উৎসবের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষায় ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। একজন নারী চিৎকার করল এই তো বাবা, আমি অফিস থেকে বেরিয়েছি, তুমি পড়তে বসো, এখানে বাস নেই, প্রচণ্ড বৃষ্টি, সিএনজি? বসে বসে পণ্ডিতি করিস না, কিছুই পাবার উপায় নেই, ঈশ্বর জানেন কীভাবে বাসায় ফিরব…। ততক্ষণে হাজার হাজার মানুষ বৃষ্টির অব্যর্থ তীর থেকে মাথা বাঁচাবার জন্য ভয়ার্ত কীটের মতো দৌড়াল। রাস্তার ট্রাফিক সার্জেন্ট আর ডিউটি পুলিশ মানবপ্রাচীর ভেঙে দিগি¦দিক ছুটল, চৌদিকে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল আরশোলার মতো যেনবা মড়কে শহর উজাড় হবে। অপ্রসন্ন বিপন্ন বিদ্যুৎ, মেঘ, জল, হাওয়া, ময়ূরের মতো হাওয়ার বর্ণালি চিৎকার উপেক্ষা করে যুবক শহীদ কাদরী গামবুট পরে নিরুদ্দেশ হলো তীব্র হিংস্র খল অন্ধকারে। তাহেরের বেজায় ইচ্ছে হলো বাউন্ডুলে, লক্ষ্মীছাড়া, উন্মূল বালকের মতো র্যাঁবো হয়ে যেতে। বৃষ্টিকণ্ঠে ফাহমিদার ফোন এলো Ñ তুমি কোথায়? বৃষ্টিতে ভিজো না, তোমার কাশি বাড়বে। সহসা রাগ লো এসব পরামর্শ শুনে, সে কি বালক! মূঢ়, অর্বাচীন! তবু আচমকা শ্রাবণের বৃষ্টি-উৎসারিত স্বতঃস্ফূর্ত লক্ষ লক্ষ ঝিঁঝিপোকার একটানা ঝিঝিট ঝিঝিঝিট ঝিঝিঝিঝিট আনন্দের অবিরল উচ্ছ্বাসে প্রতিপন্ন ও প্রজ্বলিত রহস্য থেকে বিষাদের দিকে সে গেল না। ততক্ষণে তার পায়ে বিরামহীন বৃষ্টির রুপো, চুলে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফসফরাস। শার্টার নামানো নিঃসঙ্গ দোকানের অপরিসর সূর্যবারান্দার নিচে সে আর বৃষ্টিদগ্ধ নিশিপতঙ্গের মতো বিপন্ন উ™£ান্ত একজন দেহপসারিণী। আরো দুজন তরুণ গা ঘেঁষাঘেঁষি দাঁড়ায়। তারা নিজেরা কথা বলছিল বৃষ্টির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কোনো বাস নেই, পল্টন থেকে হেঁটে আসছি, সব রাস্তা বন্ধ। একজন চিৎকার করে হাসল আরে ভাই তিস্তায় পানি না থাকলে কী হবে, ঢাকার রাস্তায় পানির অভাব নাই!
একজন জিজ্ঞেস করল কোথায় যাবেন? তরুণীর স্থূল শরীর বৃষ্টির সঙ্গে মিশে যাওয়া পাউডার ও বিবিধ প্রসাধনীর কড়া গন্ধে তাহের কাশল আর বলল মিরপুর। তরুণী লুপ্ত স্যান্ডেল খুঁজল, না পেয়ে অস্ফুটে অশ্লীল ধ্বনি করল নির্বিকার। সহসা প্রলয়ঙ্করী বিদ্যুতের তীব্র চাবুক ফেটে পড়ে। চকিতে নিমিষের দিবালোকে দেখে ভেজা কাপড়ে প্রস্ফুটিত তরুণীর প্রোজ্জ্বল শরীর, চিবুকে বৃষ্টির হীরেকুচি, বুকে প্রাচীন রাজপুরীর দুটো ঝাড়বাতি ধকধক করে জ্বলছে। অবরুদ্ধ ঝড়ো হাওয়া, পতঙ্গের উদ্ধত পাখা, ধূসর কণ্ঠস্বর, পিঙ্গল চিৎকার, হৃদস্পন্দন, ঝুমবৃষ্টির ঠান্ডা স্ফটিক; কোথাও শহর ভেঙে পড়ছে হুড়মুড়, গাছের ডাল ফেটে চিরে ছত্রখান, বিপর্যস্ত রক্ত মাংসে নূহের উদ্দাম রাগী গরগরে লাল আত্মা জ্বলে, ভেজা শার্টের ভেতর অগ্নিকুণ্ড জ্বলে ওঠে তাহেরের। পুনরায় প্রেতার্ত আঁধার আর বৃষ্টির তীব্র তীক্ষè ফোঁটার অপ্রতিহত গতি দৃষ্টি ঝাপসা করে দিলে চৈতন্যের গোপন আঁধার ছেড়ে বেরিয়ে এলো তিনটা বা চারটা শব্দের সচল অনুভূতি, একটি ব্যক্তিক বিশেষণ, তুচ্ছার্থক সর্বনাম অথবা ক্রিয়া বিশেষণ। কবিতার কোনো কোনো পঙ্ক্তি গভীর তন্দ্রা অথবা অসুস্থতার আলস্য থেকে যেমন জাগিয়ে তোলে তাকে, তেমনই আত্মার স্থৈর্য ভেঙে অপ্রতিরোধ্য উত্তেজনায় চঞ্চল তাহের তীরন্দাজ বৃষ্টির প্রহেলিকা মাথায় করে দূর থেকে ছুটে আসা বাসের আলোকিত টানেলের দিকে ছুটে গেল।
বিপুল বিক্ষুব্ধ মেঘপুঞ্জ, ঝঞ্ঝাবিদ্যুতের ক্রূর উল্লাস আর ঝুমবৃষ্টির আঁধারে বাসটা একটি বিপন্ন লুপ্তপ্রায় কীটের মতো ঢাকা কলেজের সামনে ভেঙে পড়া গাছের ডালে আটক হলো। এগোবার সম্ভাবনা এবং বৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এলে তাহের নেমে পড়ে। হাঁটতে সে ভালোবাসে, কিন্তু এমন বৈশাখী বৃষ্টির মাতাল রাতে! লোডশেডিংয়ের ঘুটঘুটে আঁধারে ওর গা কাঁটা দিলো। চারপাশের দোকানপাট প্রায় সবই আঁধারের রাজত্বে গা-ঢাকা দিয়েছে। বিপরীত দিকের রাস্তায় একটা-দুটো গাড়ির তীব্র গতিময় আলোয় ঝলমল করে বৃষ্টির সূচ। বেশ এক রোমাঞ্চ এখন, এখন শহীদ কাদরী হয়ে সে রাস্তায় নামল। সুগোল তিমির মতো আকাশের পেটে বিদ্ধ হলো বিদ্যুতের উড়ন্ত বল্লম! বজ্র শিলাসহ বৃষ্টি, বৃষ্টি : শ্র“তিকে বধির করে গর্জে ওঠে যেন অবিরল করাত কলের চাকা, লক্ষ লেদমেশিনের আর্ত অফুরন্ত আবর্তন!… কী বিপদগ্রস্ত ঘরদোর, ডানা মেলে দিতে চায় জানালা-কপাট নড়ে ওঠে টিরোনসিসের মতন যেন প্রাচীন এ-বাড়ি! জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় জনারণ্য, শহরের জানু আর চকচকে ঝলমলে বেসামাল এভিনিউ এই সাঁঝে, প্রলয় হাওয়ার এই সাঁঝে বৃষ্টি পড়ে মোটরের বনেটে তেরচা, ভেতরে নিস্তব্ধ যাত্রী, মাথা নিচু ত্রাস আর উৎকণ্ঠায় হঠাৎ চমকে দেখে জল অবিরল, জল, জল, জল তীব্র হিংস্র খল, পথে পথে ঝড়ের তাণ্ডব, মৃত ডাল, দোমড়ানো টিন আর ফুটপাত উপচে ওঠা ঘোলা জলের দাঁতাল সমুদ্র!
হিংস্র জলে আটকে পড়া রিকশার ওপর কৃষ্ণচূড়ার ডাল ভেঙে পড়েছে। রিকশাচালক আর রিকশারোহী লাল কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে রক্ত উৎসর্গ করে সমুদ্র বিজয়ে। ফুটপাতে পলিথিনের ঘরে মাথা বাঁচিয়েছিল নিরন্ন যারা তারা ঝঞ্ঝাবৃষ্টি উপেক্ষা করে জড়ো হয়েছিল রক্তপুষ্পের বিপুল তরঙ্গে। তাহের আইল্যান্ডের ওপর দাঁড়িয়ে উড়ন্ত বৃষ্টির বল্লমে শীতের উপলব্ধি অনুবাদ করে। দেখে রক্তপুষ্পের ক্রুদ্ধ বিদ্যুৎ সড়কে আবদ্ধ জলরাশির অতল আঁধার থেকে তুমুল বেগে কালো তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে। তখনই একটা রাজসিক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো ঝকঝকে মাইক্রো পানির ফোয়ারা ছড়িয়ে তাহেরকে অন্ধ করে দিয়ে গেল।