‘সাগুফতা…’ বলে স্যার চুপ হয়ে গেলেন। আমি তাঁর ঘনঘন নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম। যেন কেউ ড্রাম পেটাচ্ছে। যেন আফ্রিকার জেম্বে ড্রামিং রিদম। এত জোরে, কারো নিশ্বাস পড়ার আওয়াজ আমি আগে কখনো শুনেছি বলে মনে করতে পারলাম না। আমার ভেতরে কেমন একটা শিহরণ টের পেলাম। সেটা ভয় না অন্য কিছু ঠাহর করতে না পেরে আমি স্যারের পরবর্তী কথা শোনার জন্য কান খাড়া করলাম। উদগ্রীব হয়ে উঠলাম বাড়াবাড়ি রকমভাবে। তিনি যে আমাকে অবশ্যই কিছু বলবেন বা বলতে যাচ্ছেন, সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। বলা যায়, আমি ছিলাম ওভার-কনফিডেন্ট। কেননা, এর আগে এতবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে – এত গম্ভীর স্বরে কখনই তিনি আমাকে সাগুফতা বলে ডেকে ওঠেননি। যেন তাঁর গলার গভীরতম খাদ থেকে অপরিচিত অলৌকিক এক মধুর সিম্ফনি মৌসুমি বাতাসে ভেসে এলো সাগুফতা হয়ে।
‘সাগুফতা, তুমি আমার তেরোতম ভুল…’ বলে স্যার আবার চুপ হয়ে গেলেন। এবার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম না বটে, যেহেতু তিনি একটি সম্পূর্ণ বাক্য বলে শেষ করেছেন। কিন্তু আমি তাঁর ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠা ছাই রঙে ছেয়ে যাওয়া একটা মুখচ্ছবি পরিষ্কার কল্পনা করে নিতে পারলাম। কল্পনাই করতে হয়েছে। কারণ, এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় আমার সামনে খোলা ছিল না। কারণ জানতে চেয়ে দয়া করে আমাকে বিব্রত করবেন না। আমি কিছুতেই বলতে পারব না। আপনারা বরং আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করুন।
আমার কোনোরকম সাড়া না পেয়েই বুঝি স্যার একটু কেশে গলাটা ঝেড়ে নিলেন। পুনরাবৃত্তি করলেন সেই দারুণ রহস্যে মোড়ানো বাক্যটি।
‘সাগুফতা সুইটি, তুমি আমার তেরোতম ভুল…’
একটা অধৈর্য প্রতিক্রিয়া আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।
‘মানে?’ বলেই অবশ্য আমি জিব কাটলাম। ছিঃ, ছিঃ, আমি তো ইয়ার-বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছি না যে, তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠলাম, ‘মানে, কী বলছিস তুই অথবা কী বলতে চাস?’ আমি কথা বলছি রীতিমতো সম্মানিত স্যারের সঙ্গে, যাঁকে আমি ভীষণরকম শ্রদ্ধা করি এবং…, থাক, সে-কথা পরে হবে। অথবা বুঝে নিতে পারেন। শুধু আপাতত জেনে রাখুন এতটুকু – তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত শ্রদ্ধেয় মানুষ। ব্যস, এ পর্যন্তই। এ মুহূর্তে এরচেয়ে বেশি বলা আমার পক্ষে একদম সম্ভব নয়।
‘তুমি বুঝতে পারছ, সাগুফতা, আমি তোমাকে কী বলতে চাইছি?’
‘স্যার, বুঝতে পেরেছি… কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?’
‘বুদ্ধিমতী সাগুফতা… আমি নিজেও কি জানি? জানি না কখন, কীভাবে তুমি আমার সবটুকু চিন্তার পরিধি অধিকার করে বসে আছ। এজন্যে আমি তোমাকে দোষী করব না। দোষ যদি কাউকে দিতে হয়, সে দিতে হবে আমাকেই। গত দুমাস দিন-রাত ধরে নিজের সঙ্গে কী ভয়ংকর যুদ্ধটাই না করলাম! তারপর দুদিন আগে হতাশ হয়ে বুঝতে পারলাম, আমার তেরোতম ভুলটা তোমাকে কেন্দ্র করেই ঘটতে যাচ্ছে। ঘটেছে, ইনফ্যাক্ট। যদিও আমি সবটুকু চেষ্টা করেছি নিজেকে নিয়ন্ত্রণের… কিন্তু, হায়, এ-বয়সেও উন্মাতাল আবেগের কাছে আমি কত অসহায়!’
স্যারের গলায় কান্নার মতো কেমন এক করুণ সুর! আমার মনটা ভেসে গেল ওনার কথার জাদুময়তায়। এ মুহূর্তে আমার কী বলা উচিত, কী বললে সবদিক রক্ষা হয় ভেবে আমি কোনো কিনারা করতে পারলাম না। চেষ্টা করলাম, আমার কণ্ঠস্বরটাও সামান্য ভেজানোর। স্যারের কষ্টে সমব্যথী হওয়ার অভিপ্রায়ে। সবচেয়ে বড় বিষয়, ঘটনাটার কেন্দ্রবিন্দু আমি নিজে। কাজেই তাঁর এ-অসহায় সময়ে আমার সব ধরনের সহানুভূতি প্রকাশ করাই তো উচিত। তারপরও কিছু একটা বলতে গিয়ে আমাকে বারদুয়েক ঢোক গিলতে হলো। তারপরও বললাম।
‘স্যার, তেরোতম কেন বলছেন? তার মানে কী…?’
‘হুম… এর আগে ডজনখানেক এমন পরিস্থিতিতে আমি পড়েছি। তবে সেটা একজনকে ঘিরেই। শুধু এতটুকুই মনে আছে। এর বেশি কিছু জানতে চেয়ো না। কিন্তু, আমার মুখে এরকম কথা শুনে আমার সম্পর্কে তোমার এতদিনের ধারণা বদলে যাবে না তো, সাগুফতা? এই চিন্তাটাই গত দুদিন ধরে আমাকে কুরে কুরে শেষ করে দিয়েছে। এখনো একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলছে ভেতরে ভেতরে। হয়তো তুমি সেটা বুঝতে পারছ না। যা হোক, তারপর একটা সময় নিজের সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে তোমার কাছে এই আত্মসমর্পণ। তুমি কি বলতে পারো, এ-মুহূর্তে আমার কী করা উচিত?’
‘জানি না, স্যার। শুধু এতটুকু বুঝতে পারছি, এতদিন ধরে যে- আবেগ আমি নিজে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছি, শুধু আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে, সেখানে আমিও আজ বোকার মতো সবটুকু ধরা পড়ে গেলাম। খুব ভালো হতো, যদি আমি আপনার কথার সুর বুঝতে পেরেই সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠতাম। ছিঃ ছিঃ করে উঠতাম। তা না করে এমন প্রতিক্রিয়া দেখালাম যে, আমার ভেতরটাও উন্মুক্ত হয়ে গেল। এখন, আপনি আমাকে বলুন, আমার কী করা উচিত?’
এরপর দুপক্ষের কথা, সংগত কারণে, আর বেশিদূর এগোতে পারে না। কীভাবে পারবে যখন দুজনই এই হতচ্ছাড়া দুর্দমনীয় প্রেম নামক আবেগ রোগের শিকার। একেবারে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো সংক্রামক। একজনের হাঁচিতে আরেকজনের তৎক্ষণাৎ আক্রান্ত হওয়ার স্বীকারোক্তি। অথচ দিনের পর দিন তারা কথা বলেছে কত বিষয় নিয়ে, কত ব্যক্তির জীবনে ঘটে যাওয়া নানারকম চমকপ্রদ অথবা দুঃখজনক ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করে! অথচ একটিবারের জন্যও তাদের চোখেমুখে, অভিব্যক্তিতে অথবা শারীরিক কোনো ইশারায় ফুটে ওঠেনি সেই অদ্ভুত ছোঁয়াচে অনুভূতির কোনো অনুরণন। আহ্, মানুষের মন! আর আজ কী যে হলো! স্যার কেমন আশ্চর্যজনকভাবে কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই খুলে দিলেন তাঁর মনের অর্গল।
‘সাগুফতা, আমার সুইট সাগুফতা…’
‘স্যার, প্লিজ, আপনি কথা বলা বন্ধ করুন। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার শোনার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। প্লিজ…।’
আমি স্যারের মায়াভরা চোখদুটো মনে করার চেষ্টা করলাম। তাঁর চোখ পানিতে টলমল করছে। সে-দৃশ্যও আমাকে দেখতে হলো ভেবে, নিজের অজান্তে আমার চোখের কোণজাড়া ভিজে উঠল। কিন্তু যখনই মনে হচ্ছে ওই ‘তেরোতম’ শব্দটির কথা, তখনই এক গা-পোড়ানো জ্বলুনিতে শরীরটা আমার ছাই হয়ে যাচ্ছে। কেন তেরোতম? কেন প্রথম নয়? কেন একমাত্র নয়? কেন?
আবার শুনতে পেলাম স্যারের ঘনঘন নিশ্বাস পতনের শব্দ। আমার কান গরম হয়ে উঠল। সামান্য স্বস্তির জন্য আমি পাশ ফিরলাম। এবং দেখলাম, একটা বাইসাইকেল নিয়ে হেঁটে যাচ্ছি স্ট্রাসবুর্গের ‘ছোট্ট ফ্রান্স’ নামের ঐতিহাসিক অলিগলির ভেতর দিয়ে। যখন সাইকেলটার প্যাডেলে পা রাখলাম নিজের ঘরে ফিরে আসব বলে, তখনই ভূত দেখার মতো আবিষ্কার করলাম, ওটার ব্রেকটা ভাঙা। আমাকে নিয়ে যাবে কী, ওটাকেই এখন আমার টেনে টেনে নিয়ে যেতে হবে। হায়!
হঠাৎ করে এক পশলা বিষন্নতা এসে আমাকে গ্রাস করল আর আমি এত অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম! একটা ট্রাম ঘাড়ের ওপর এসে পড়লেও টের পেলাম না। একটিবারের জন্যও কানে ঢুকল না তার সেই সতর্কতামূলক টুংটাং ধ্বনি। আমার যে কী হলো (আমি কি জীবনানন্দীয় বেভুলতায় বিহ্বল হয়ে গেলাম?) বুঝতে পারি, তেরোতম ভুল আমাকে পাগল করে দিয়েছে। কিন্তু ঠিক এখন আমি আর স্যারকে ওরকম গভীরভাবে অনুভব করছি না, যেমনটা কিছু সময় আগে করছিলাম যেন তাঁর নিশ্বাসের উষ্ণ স্রোত আমার প্রতিটি শিরার ভেতর ঢেউ তুলছিল। যদিও তিনি আমার পাশেপাশেই হাঁটছেন। মুখটা গম্ভীর। লম্বা শরীরের ওপর কালো রঙের বিশাল আকারের এক ওভারকোট। তার ওপর যত্রতত্র লেগে থাকা সাদা বরফকুচি। গলায় ছাই রঙের মাফলারটা সুন্দর করে ঝোলানো। ওভাবে শৈল্পিক চতুরতায় মাফলার প্যাঁচানো আমিই তাঁকে শিখিয়েছি। শেখাতে গিয়ে তাঁর গরম নিশ্বাস আমার গালের ওপর পড়তে দিয়েছি। শিহরিত হয়েছি তাঁকে কিছু বুঝতে না দিয়ে। অথচ কী আশ্চর্য, তখনো বুঝিনি, আমি প্রথম নই, আমি তাঁর তেরোতম…!
‘কী, কথা বলছ না কেন?’ ঈষৎ উষ্মা স্যারের কণ্ঠে।
‘কী বলব, ক্ষুধা পেয়েছে ভীষণ।’
‘চলো, কিছু খেয়ে নিই কোথাও ম্যাকডো অথবা টার্কিশ কোনো দোকানে।’
‘না, আমার ইচ্ছা করছে না।’
‘কী কাণ্ড, এই না বললে ক্ষুধা পেয়েছে?’
‘ক্ষুধা তো আমার ঠিকই পেয়েছে। কিন্তু, আমি জানতে চাই, আমি কেন তেরোতম…?’
এত জোরে চিৎকার করে উঠলাম যে, নিজের কানে নিজেই হাত দিতে বাধ্য হলাম। আমার মনে হয় হুঁশ-বুদ্ধি সব লোপ পেতে বসেছে ওই দুর্ভাগা সংখ্যাটার জন্য। তারপর আবার পাশ ফিরলাম।
এবার দেখলাম, একা একা টিউলিপের বাগানে পা টিপে-টিপে হাঁটছি। রবীন্দ্রনাথের মতো হাত-দুখানা পেছনে রেখে। কিছুক্ষণ আগে কেউ একজন পাশ থেকে সাবধান করে দিয়েছে, যেন ভুল করে আবার ফুলের বিছানায় উঠে না পড়ি। তাই পা টিপে-টিপে! এ মুহূর্তে আমার পাশে কেউ নেই। না স্যার, না অন্য কেউ। শুধু টিউলিপ আর টিউলিপ – বিচিত্র বর্ণের, নানা আকৃতির টিউলিপ আমার চোখে ধাঁধা ধরিয়ে দিলো।
ছবি তোলার জন্য ব্যাগের ভেতর ক্যামেরা খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু, কী আশ্চর্য, ক্যামেরার পাশাপাশি আরো দুটো জিনিস পেলাম ওটার মধ্যে স্যারের লেখা একটা চিরকুট, যেটা তিনি আমাকে লিখেছিলেন ট্রেনে হেগ থেকে আমস্টারডাম আসার পথে। আমি নাকি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আর ভীষণ জোরে নাক ডাকছিলাম। সেই নাক ডাকার শব্দের মধ্যেও তিনি নাকি রবীশঙ্করের সেতার-ধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন। হায় প্রেম, মূর্খ-অশিক্ষিত-ছোটলোক প্রেম! কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা!
চিরকুটে স্যার লিখেছেন, ‘সাগুফতা, আমার সুইট সাগুফতা… আমার কাঁধে মাথা রেখে তুমি এভাবেই ঘুমাও অনন্তকাল। আমরা এভাবে পাশাপাশি ট্রেনে চেপে চলতে থাকি সারাজীবন। ব্রাউনিংয়ের ‘লাস্ট রাইড টুগেদার’ কবিতার মতো, আর এ-মুহূর্তটা – এই মাহেন্দ্রক্ষণই হয়ে যাক চিরকালীন – ‘দ্য ইনস্ট্যান্ট মেইড ইটারনিটি’।
আর পেলাম চিরকুটের ভাঁজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া দুশো ইউরোর দুটো চকচকে সবুজ নোট। আহ্, চিরকুটটা আবার পড়ে যত না আনন্দ পেলাম, তার চেয়ে বেশি খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলাম ইউরোর নোট দুটো দেখে। কত কান্নাই না কেঁদেছিলাম টাকাটা হারিয়ে! হাততালি দিতে গিয়ে ক্যামেরা ছিটকে পড়ল হাত থেকে আর সেটা খুব যত্ন করে মাটি থেকে তুলে দিলেন স্যার। সুন্দর করে হাসলেন সেই পাগল-করা হাসি। আর ডান হাত দিয়ে দারুণ একটা কায়দা করে বসন্ত বাতাসে উড়তে থাকা এলোমেলো চুলগুলো কপালের একপাশে সরিয়ে দিলেন। তখন তাঁকে দেখতে লাগছিল ঠিক ওমর শরিফের মতো।
‘হুম, ঠিক আছে, ওভাবেই বসে পড়ো। আর একটু মিষ্টি করে হাসো। মুখটা এত গোমড়া করে রেখেছ কেন? বুঝতে পারছি, আমাকে দেখে খুশি হওনি একদম।’ স্যার ক্যামেরা ঠিক করতে করতে বললেন।
আমি ওনাকে কী করে বোঝাই, আমি কীভাবে চাইছি তাঁকে এড়িয়ে যেতে, তাঁর ছায়া না মাড়াতে। অথচ বারবার তিনি আমার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন। যেন পণ করেছেন আমার পিছু ছাড়বেন না কিছুতেই। আমি ওনার প্রতি কখনো বিরক্ত হয়ে উঠি কিনা, বিরক্ত হলে আমি কেমন আচরণ করব তা দেখার জন্য স্যার যেন মরিয়া হয়ে উঠেছেন। হায়, কপাল! আমি এখন কোথায় লুকাই! স্যার কি সত্যি সত্যি বুঝতে পারছেন না যে, আমি আর ওনার সামনে পড়তে চাই না। অথবা আমি চাই না তিনি আমার মুখোমুখি এসে পড়–ন বারবার সেই মাথা-খারাপ-করা হাসিটা দু’ঠোঁট বরাবর ঝুলিয়ে দিয়ে। আর ঠিক ওইরকমভাবে – রোমান্টিক সিনেমার নায়করা যেভাবে হাতদুটো ভাঁজ করে মাথাটা ডানপাশে কাত করে চোখ দিয়ে কিউপিডের তীর ছুড়তে থাকে।
উফ্, আমি সত্যি এ মুহূর্তে ভীষণ অসহায় অনুভব করছি। এক থোক ক্লান্তি আমাকে কাবু করে দিয়েছে। আর আমি বুঝতে পারছি না, কেন স্যার আমার মানসিক অবস্থাটা কিছুতেই ধরতে পারছেন না? কেন, কেন তিনি বুঝবেন না? এত বড় একজন মানুষ – যিনি এত এত বুদ্ধি মাথায় রাখেন, যিনি এত সুন্দর করে কথা বলেন, জাদুকরের মতো মানুষের মনের সব ভাবনা ফুটিয়ে তোলেন নিজের অসামান্য লেখনীতে, তিনি কেন আমার মতো সামান্য একজন মানুষের মর্মবেদনা অনুভব করবেন না?
আমি তাঁকে এড়িয়ে যেতে চাই, কারণ আমি তাঁর জীবনে কোনো ভুল হতে চাই না – না প্রথম, না তেরোতম। যদি কিছু হতেই হয়, আমি ফুল হয়ে ফুটতে চাই তাঁর মনের গোধূলির ছায়াঘেরা পড়ন্ত বাগানে Ñ হোক তা রজনীগন্ধ্যা, অথবা হাসনাহেনা অথবা নিদেনপক্ষে সন্ধ্যামালতি। তবু আমি ফুলই হতে চাই, ভুল নয় কিছুতেই, তেরোতম তো নয়ই।
‘আমাকে বুঝিয়ে বললেই তো আমি বুঝতাম। একজন মানুষের পক্ষে কি সবসময় সবকিছু বুঝতে পারা সম্ভব?’ স্যার আমার হাতদুটো ধরে তাঁর পাশে বসিয়ে বললেন।
আমাদের সামনে ততক্ষণে সিডনি অপেরা হাউস। অথবা আমরা তখন সিডনি অপেরা হাউসের সামনের চত্বরটায় পাশাপাশি বসে আছি। চারপাশে নানা ঢঙের নানা রঙের মানুষ। কীরকম সহজাত স্বতঃস্ফূর্ততায় প্রেমিক-প্রেমিকারা কোমর ধরাধরি করে হেঁটে বেড়াচ্ছে, শরীরে শরীর লাগিয়ে বসে আছে। কেউ কেউ আরো প্রগলভ হয়ে প্রগাঢ় চুম্বনে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেলেও যেনবা তাদের কিছুই আসবে-যাবে না।
লোবাসা-নিবেদনে ঘটবে না এতটুকু ঘাটতি। আর আমি বা আমরা কী করছি? আমি স্যারের পাশে বসে আছি কেমন জড়সড় আড়ষ্ট হয়ে, যেন ওনার শরীর স্পর্শ করলেই আমি নাপাক হয়ে যাব অথবা রাই-কলঙ্কিনী। একবার আড়চোখে তাঁর দিকে তাকাতেই দেখি, চারপাশের সবকিছু ভুলে তিনি আমাকেই খেয়াল করছেন নিবিড়ভাবে। আহ্, সেই অপলক দৃষ্টির সবটুকু জুড়ে কী যে এক অপূর্ব অলৌকিক মায়া খেলা করছে!
‘বিকেলের এই অদ্ভূত সোনা-গলা আলোয় তোমাকে ঠিক যেন রানী নেফারতিতির মতো লাগছে।’
‘কেন, তার মতো লাগতে হবে কেন? আমাকে আমার মতো লাগলে বুঝি আপনার ভালো লাগবে না?’
‘তোমাকে যেমনই লাগুক, যার মতোই লাগুক, তোমাকে আমার সবসময়ই ভালো লাগবে… শুধু একটা আফসোস মনটাকে খোঁচাতে থাকে অহর্নিশ…’
আমি তাঁর আফসোসের ব্যাপারটা অনায়াসে উড়িয়ে দিলাম, কারণ তাঁর বলা আগের কথাগুলো শুনে মন ভরে গেছে। যদিও ভেবে রাখলাম, বিষয়টা নিয়ে তাঁকে পরে জিজ্ঞাসা করব। কোনো আফসোসের হাহাকার এ স্বর্গীয় সময়টা কলুষিত করুক তা আমি চাইছিলাম না। তাই কথা ঘোরালাম।
‘স্যার, আপনি কি আমির খানের দিল চাহ্তা হ্যায় ছবিটা দেখেছেন? ওই ছবির পুরো শুটিংটাই নাকি এখানে করা ওই যে সনু নিগমের তানহায়ি গানটা আছে না? গানটার মাঝখানে একবার চট করে মিলসন্স পয়েন্ট স্টেশনটা দেখানো হয়েছে। যেদিন প্রথম আমি বিষয়টা আবিষ্কার করলাম, কেমন যে লেগেছিল!’
‘কেমন লেগেছিল’ – স্যার কেমন ঘোরলাগা চোখে আমার দিকে তাকালেন। বেশ কিছুক্ষণ আগে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি হাঁটাহাঁটি করছিলেন। আমার মুখে হিন্দি সিনেমার কথা শুনে মনে হয় সামান্য অবাকই হয়েছেন। হাতদুটো অদ্ভুত সুন্দর কায়দায় ভাঁজ করে রেখেছেন। এরকমভাবে হাত বেঁধে আর একটা পা একটু বঁাঁকিয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় স্যারকে দেখলে আমার মনে হতে থাকে, আমি শুধু বিশেষ এ ভঙ্গিমার জন্যই সারাজীবন তাঁর…
থাক, কথা বাড়ানোর দরকার নেই। আমি যা ভেবেছি, তা আমার মনের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের মধ্যেই থাকুক তার ভেতরটা আলোকিত করে। যদিও এ-মুহূর্তে চোখ মেলে দেখি, আমার চারদিক কেমন এক রহস্যঘেরা আঁধারে ছেয়ে আছে। আমি কোথায় বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। অ্যারোসলের হালকা মিষ্টি গন্ধটা নাকে এসে একবার ঝাপটা দিয়ে আবার মিশে গেছে চারপাশের বাতাসের মাঝে। আমি আর স্যারের কোনো অস্তিত্ব টের পাচ্ছি না। ওহ্, তাঁকে তো জিজ্ঞাসা করার সুযোগই পেলাম না, সনু নিগমের ওই গানটা তাঁর ভালো লেগেছিল কিনা।
আমার কেন যেন ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। বিশ্রীরকম শব্দে মুখ হাঁ করে আমি যখন লেভিয়াথান-মার্কা একটা হাই তুললাম আর নিজের অবচেতন মনে সেই হা-করা মুখের ওপর ডান হাতের তালুটা চেপে ধরলাম, টুপ করে মেঝেতে তালুর ভেতর থেকেই বোধকরি কিছু একটা পড়ার মৃদু আওয়াজ পেলাম। অন্ধকারে হাতড়ে সাইড-ল্যাম্পটা জ্বেলে দেখতে পেলাম হলুদ রঙের পোস্টিট নোট। স্যারের হাতে লেখা একটা চিরকুট ‘সাগুফতা সুইটি-টুইটি… যে এই তীরন্দাজের তীর্থযাত্রায় তেরোতম ভুল হয়ে এসেছে…। জানি, তাকে আমি ফেলে দিয়েছি এক অনির্ধারিত…’
স্যারের কথা শেষ হয়নি। শেষ বাক্যটা কেন তিনি অসম্পূর্ণ রেখেছেন তিনিই ভালো বলতে পারবেন। আমারও কেন জানি না আর পড়তে ইচ্ছা করল না। জানতে ইচ্ছা করল না তিনি আসলে কী বলতে চেয়েছিলেন। যাক, কোনো একসময় জেনে নিলেই হবে। আমার অতো তাড়া নেই। বরং ভীষণ অবসন্নতায় আমি পাশ ফিরলাম।