আমার একটি গল্পের চরিত্র হতে চায় নূরুল ইসলাম বাদল। বাদলভাই পদ্মমণি পুকুরের জলের মতো সবার জন্য নিবেদিত – শহরের কোন সাংস্কৃতিক কর্মী অসুস্থ, হাসপাতালে নিতে হবে; কার স্কুলের বেতন বাকি, দিতে পারছে না – কার কাছে গেলে কিছু টাকা পাওয়া যাবে; বিরাম নেই বাদলভাইয়ের। সেই ছেলেবেলা থেকে সংগঠন করছে; এখনো করে – বউ-বাচ্চা ফেলে, অফিস ফাঁকি দিয়ে, খেয়ে না-খেয়ে…।
বাদলভাইকে নিয়ে গল্প একটা ফাঁদাই যায়। আমার মাথায় ছিলও – বাদলভাই আর অরুদিকে নিয়ে গল্প লিখব। একসঙ্গে সংগঠন করতে-করতে বাদলভাই অরুণিমা নন্দীর – মানে আমাদের অরুদির প্রেমে পড়ে। রবীন্দ্রসংগীত গাইত অরুদি। স্টেজে যখন অরুদি গাইত – ‘আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো…’ – তখন বাদলভাইয়ের চোখের পলক পড়ত না। মিথ্যে বলব না, আমরাও হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম অরুদির মুখের দিকে। শুরুতে বিষয়টা গোপন ছিল। একসময় ফাঁস হয়ে যায়। ছোট্ট শহর। সবার চোখে ধুলো দেওয়া কঠিন। কে যেন ছড়া লিখে রমেশ হলের দরজায় লাগিয়ে দিলো – ‘বাদল-অরু, মাঠে গরু – খায় তরু…।’ আমরা সন্দেহ করছিলাম মীর শহীদের কাজ হতে পারে এটা। শহীদভাই যা পোংটা লোক! কদিন পর আমাদের কানে আসে – অরুদিকে বস্তাবন্দি করে – হরিজন পল্লীর লোকেরা যেভাবে বস্তায় ভরে শূকর আনে, বস্তার ভেতর ঘোঁতঘোঁত করে শূকর; সেরকম করে হাওড়া পাঠানো হয়েছে। অরুদি কীরকম কাঁদছিল কেউ জানে না। সে-গল্প আমার এখনো লেখা হয়নি। আজো থাক। সেটি অন্য গল্প। সুযোগমতো একদিন বলা যাবে…।
আমাদের এ-গল্পে আচমকা ঢুকে পড়ল নূরুল ইসলাম বাদল – যেদিন শক্তি চট্টোপাধ্যায় এলেন আমাদের শহরে।
শক্তি কলকাতার বড় কবি। বাউন্ডুলে। তাঁর সম্পর্কে অনেক গল্প পড়েছি সুনীলের কী একটা লেখায়, বিশেষ করে মদ খাওয়ার গল্প। মদ খেয়ে, দোতলা বাড়িকে একতলা ভেবে লাফ দিয়েছেন, মরতে-মরতে বেঁচে গেছেন…। সেই কবি এসেছেন আমাদের শহরে। আমাদের পুলক দেখে কে! শক্তিকে সামনাসামনি দেখছি, কথা বলার সুযোগ হবে – আমরা যারা কবি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর – জাহিদ মুস্তাফা, শফিক ইমতিয়াজ, নূরুল ইসলাম বাদল, আমি – আমরা সবাই রমেশ হলের সামনে বকুলগাছের নিচে বসা শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি। কথা বলছেন আদালত-সম্পাদক কামাক্ষানাথ সেন, কবি মাহমুদ কামাল…।
শক্তি সপরিবারে এসেছেন। সঙ্গে স্ত্রী মীনাক্ষী, ছেলে তাতার, মেয়ে তিতি…। বাদলভাইকে লক্ষ করে শক্তি বললেন, ‘এই যে ছেলে, তোমার নামটা যেন কী?’
– বাদল। নূরুল ইসলাম বাদল।
– কবিতা লিখো?
বাদলভাই নিরুত্তর। বুক কাঁপছে। শক্তি যদি বলেন, পকেটে আছে নাকি কবিতা? পড়ে শোনাও তো দেখি কী লিখো…।
কামাক্ষানাথ সেন বললেন, ‘লেখে, ওরা সবাই লেখে।’
– মীনাক্ষী, তোমরা একটু বসো। কথা বলো। আমি ওকে নিয়ে একটু ঘুরে আসছি…।
– কোথায় যাবেন? জিজ্ঞেস করলেন কামাক্ষানাথ সেন। তাঁর আমন্ত্রণেই এসেছেন শক্তি।
– না, তেমন কোথাও না। এই একটু ঘুরে বেড়াব আর কী…।
– বড়োরা কেউ সঙ্গে…।
– না, না। তার দরকার হবে না। শহরটা তো আমার চেনাই…।
– চেনা!
সবাই শক্তির মুখের দিকে তাকাল।
– আরে! সবার চোখ কপালে কেন? মানিকবাবু এ-শহরে থেকেছেন না? আমি তাঁর সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। আকুরটাকুর, প্যারাডাইসপাড়া, শান্তিকুঞ্জ…। আমাদের সঙ্গে মানিকবাবুর এক বন্ধু থাকতেন। তাঁর নামটা এখন ঠিক মনে করতে পারছি না।
– কী বলছ তুমি এসব পাগলের মতো? তুমি এর আগে কবে বাংলাদেশে এসেছ? কবে এখানে এসেছ? মানিকবাবু যখন টাঙ্গাইলে ছিলেন, তখন তো তোমার জন্মই হয়নি।
– শোন মীনাক্ষী। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কবি। কবির জন্মের আগেও তাঁর সঙ্গে কারো কারো দেখা হয়ে যায়। এজন্যেই তারা কবি। চলো বাদল…।
যাক। শক্তি শহরটা ঘুরে দেখুক। স্বপ্নের সঙ্গে মিলিয়ে নিক।
নিরালা মোড় থেকে দক্ষিণ দিকে সোজা পথ। মেইন রোড। শহরে চামড়াপোড়া রোদ। ললিতা ওষুধ বিতানের সামনে চৌরাস্তায় রিকশার জট। এই রোদ আর রিকশার জট কেটে-কেটে হাঁটছেন শক্তি আর বাদল। অসমবয়সী দুই বন্ধু। এটুকু পথ হাঁটতে-হাঁটতেই বাদল কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধু হয়ে গেছে। বন্ধু হতে সমান বয়স লাগে না…।
– তোমাদের বেশ্যাবাড়িটা চেন বাদল?
– চিনি।
– স্কুলছাত্র মানিক, সেই বালক বয়সে; অন্ধকারের ভেতর আলো খুঁজতে এখানে এসেছেন। চিন্তা করা যায়? মুচিবাড়ি চেন?
– চিনি। বেশ্যাবাড়ির পাশেই। আগে বেশ্যাবাড়ি, পরে মুচিবাড়ি।
– বাহ্। বেশ। চলো, আমরা বেশ্যাবাড়ির ঘ্রাণ শুঁকতে-শুঁকতে মুচিবাড়ি যাব। এক বোতল বানুটি খাব। খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। তোমাদের মুচিবাড়ির বানুটি নাকি ইন্ডিয়ান রামের চেয়েও সুস্বাদু। কড়া মেজাজ।
থানার সামনে থমকে দাঁড়ালেন শক্তি। বাদলও দাঁড়িয়েছে। থানার ভেতর থেকে চিৎকার করে কান্নার শব্দ আসছে। যাকে বলে মরণচিৎকার…।
চলো দেখি, লোকটা কী করেছে?
থানা-ভবনের সামনে, ভবনে ঢোকার পথের বাঁপাশে একটা আমগাছ। সে-গাছের নিচে ভুঁড়িওয়ালা দুই পুলিশ একটা লোককে বাঁশডলা দিচ্ছে। ডলা খেয়ে চিৎকার করছে লোকটা। ভিড় জমছে মানুষের। কী এমন অপরাধ করেছে লোকটা! এভাবে বাঁশডলা…।
– দাদা, একটু শুনবেন?
সোজা হয়ে দাঁড়াল দুই ভুঁড়িওয়ালা। একটু বিশ্রাম দরকার। বাঁশডলা দেওয়াও খুব পরিশ্রমের কাজ। গাছের নিচে ছায়া তারপরও দুজনের শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে…।
এক ভুঁড়িওয়ালা কপালের ঘাম মুছে জিজ্ঞেস করল আপনে?
– না। আমি তেমন কেউ না।
– তাহলে?
– জানতে চাইছিলাম, এই লোকটা কী করেছে। বাঁশডলা দেওয়াটা কোনো আইনের মধ্যে পড়ে না। চোর হোক, ডাকাত হোক; মানুষ তো…।
– তুই ব্যাটা আইন শেখাতে চাস? তুই কি চোরের থাইলতদার? তোকেও…।
– ধীরে দাদা, ধীরে? সবাইকে বাঁশডলা দেওয়া সহজ নয়। আপনাদের পুলিশ সুপার আমার বন্ধু…।
– তাই নাকি? আগে বলবেন তো…!
– আমরা একসঙ্গে ফুটবল খেলেছি। ও ছিল স্টপার ব্যাক। আমি খেলতাম অফেন্সে…।
– স্লামালেকুম স্যার। এই লোকটা দাগি চোর স্যার। গরুচোর। কইছা ডাকাতের শিষ্য…।
– কইছা ডাকাত?
– কইছা ডাকাতকে চিনবেন না স্যার। দুর্ধর্ষ ডাকাত ছিল। থানায় এসে বড়বাবুর সঙ্গে চা খেত…।
-ঠিক আছে। লোকটা গরুচোর। দেশে আরো বড়-বড় অনেক চোর আছে। ওকে এভাবে না-মেরে কোর্টে চালান দিয়ে দিন। চলো বাদল…।
থানা পেছনে রেখে, ডাইনে মোড় নিল ওরা। একটু সামনে, রাস্তার বাঁপাশে বেশ্যাবাড়ি। হাঁটতে-হাঁটতে চৌরাস্তার মোড়। দক্ষিণ দিকে গেলে রাস্তার বাঁপাশে বেশ্যাবাড়ি; ডানপাশে দোকানপাট। দোকানে ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজছে হিন্দি গান ‘দমাদম মাস কালান্দার…।’ সামনে রাস্তার ডানপাশে মুচিবাড়ি। হাঁটতে-হাঁটতে, বাদলভাইয়ের নাকে কী একটা ঘ্রাণ এসে কালবাউসের মতো ঘাঁই মারল। শক্তি বলছিলেন, বেশ্যাবাড়ির ঘ্রাণ শুঁকতে-শুঁকতে এটা কি সেই ঘ্রাণ? বেশ্যাবাড়ির ভেতরে কি অনেক ফুলগাছ? কামিনী-বকুল-হাস্নাহেনা? অকাতরে বিলিয়ে যাচ্ছে সুবাস…।
– আমাদের লালবাজারের পুলিশ আর তোমাদের টাঙ্গাইলের পুলিশের একই চরিত্র।
– জি…।
বাদলভাই একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটছে। রাস্তার পাশে ছোট-ছোট ঘর। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মেয়েরা। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। চোখে সুরমা টানা। কেউ-কেউ সিগারেট টানছে। চোখে-মুখে সকাতর আহ্বান – ‘এসো ভাই, এসো বন্ধু, একটু ভালোবাসা নিয়ে যাও।’ এখানকার মাটির গন্ধও অন্যরকম…।
পথে রঘুর সঙ্গে দেখা। পাটকাঠির মতো চেহারার রঘু রওশন টকিজের গেটকিপার – বাদলভাইয়ের পরিচিত। ওকে বলে কখনো বিনা পয়সায়, কখনো সিকি-আধুলি দিয়ে অনেক ছবি দেখেছে সে।
– বাদল তুই!
রঘুর চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময়। এটা খারাপ পাড়া। এখানে রাতদিন চলে মদ-মাগির খেলা; খিস্তি-খেউর। কে কার পকেট মারে, কার বুকে চাকু মারে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। এই তো সেদিন, সাইকেল চালিয়ে কাগমারী কলেজে যাচ্ছিল এক ছাত্র। বটতলা, রাস্তার কতকটা দখল করে বসে নূরু গুণ্ডারা আড্ডা দিচ্ছিল। রাস্তায় রিকশা, পথচারী; বেশ্যাবাড়ির দালাল, খদ্দের; বেওয়ারিশ কুকুর…। ছেলেটি বেশ জোরে সাইকেল চালাচ্ছিল। দ্রুত এলাকা ত্যাগ করবে। হঠাৎ সাইকেলের সামনের চাকার নিচে পড়ে একটি কুকুর। বিকট শব্দে ঘেউ-ঘেউ করে ওঠে কুকুরটি। আর এতেই ক্ষেপে যায় নূরু গুণ্ডা। ব্যাটা, সাইকেল চালাবি বেশ্যাবাড়ির পথে; পথঘাট দেখে চালাবি না? নূরু গুণ্ডাকে ডিস্টার্ব? ছেলেটির গালে কষে চড় লাগায় নূরু গুণ্ডা। রঘুর চোখের সামনেই। বাদলের মতো ভালো ছেলে এখানে কেন? সঙ্গে আবার অচেনা লোক…।
– কাকা, উনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা থেকে এসেছেন। বড় কবি। তোমাদের বানুটি খেয়ে দেখতে চান।
– তাই! তা আগে কবি তো। আমি কি থুইয়া কি ভাবতাছি। আর তিনি যে বড় মানুষ; তা দেইখাই বোঝা যায়। কান্ধে সিনামার নায়কগো মতো ব্যাগ। চলেন বাবু। আমার বউ খাসা দারু বানায়।
শক্তি দুবোতল বানুটি খেয়েছেন। না। তাঁর পা একটুও টলছে না। স্বাভাবিকভাবেই হাঁটছেন। আমরা শক্তির গলা পর্যন্ত মদ খাওয়ার গল্প আগেই শুনেছি। সুতরাং টেনশন করার কিছু নেই। তারপরও কিছুটা টেনশনে পড়েছেন কামাক্ষানাথ সেন। তার আমন্ত্রণ রক্ষা করতেই তো টাঙ্গাইলে এসেছেন শক্তি। হঠাৎ কোনো অঘটন ঘটে গেলে লজ্জার সীমা থাকবে না। সেনবাবুর চোখ-মুখ দেখেই মীনাক্ষী বউদি তার ভেতরটা পড়ে ফেলেছেন। বললেন, ‘দাদা, অযথা টেনশন করবেন না। ও লোকটাই এরকম। দেখবেন, ঠিক চলে এসেছে।’
– বাদল, এবার আমরা সুধীরবাবুর বাড়িতে যাব।
– সুধীরবাবু?
– সুধীর রায়। কবি তারাপদ রায়ের বাবা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি তার বন্ধু ছিলেন।
– তাই নাকি?
– হ্যাঁ।
– সুধীরকাকা আমাকে খুব আদর করেন।
– তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম, তুমি একটা জুয়েল ছেলে।
– রিকশা নেব?
– না। হাঁটব। আকণ্ঠ মদ খেয়েও আমি কলকাতা শহর চষে বেড়াতে পারি। আর এ তো ছোট্ট শহর…।
– এক দৌড়ে বুড়ি ছোঁয়ার মতো…।
– চমৎকার উপমা দিলে তো! তোমাকে দিয়ে হবে…।
থানার দক্ষিণ পাশের পথ দিয়ে শক্তি আর বাদল পূর্ব আদালতপাড়ার পথে হাঁটছেন। পথের দুপাশে বকুলগাছ। আমাদের শহরে একসময় প্রচুর বকুলগাছ ছিল। এখনো কম নেই। একটা শুকনো বকুলপাতা টুপ করে ঝরে পড়ল শক্তির মাথায়। ছয়আনি বাজার পেছনে রেখে উত্তরদিকে পথ। সামনেই মোড়। মোড়ের ওপর একটা পুরনো দালান। বারান্দায় টিনের চালা। বিখ্যাত ঐতিহাসিক রামপ্রাণ গুপ্তের বাড়ি। রামপ্রাণ গুপ্ত হজরত মোহাম্মদের জীবনীকার। বাড়ির সামনে তাঁর সমাধিফলক। শ্বেতপাথরের ফলকে উৎকীর্ণ রামপ্রাণ গুপ্ত; জন্ম-১৮৬০, মৃত্যু-১৯২৭, – ‘যে যায় যাক/ যে থাকে থাক/ শুনে চলি/ তোমারই ডাক।’ কে কার ডাক শুনে চলে! মিনিট পনেরো হাঁটার পরই একটা পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়াল ওরা।
– দাদা, আমরা এসে গেছি।
– এত দ্রুত? ক’মিনিট হাঁটলাম?
– ওই যে পুকুরপাড়ে লালফুলওয়ালা অশোকগাছ। ওইটাই সুধীরকাকার বাড়ি। পুকুরটা পৌরসভার…।
দুদিকে টানা বারান্দাঘেরা পলেস্তারা-খসা পুরনো দালান। বিশাল বড় উঠান। উঠানের মাঝখানে অশোকগাছ। ঝাঁকরা মাথা। সামনে পুকুর। জলে হাঁস। ছাদের কার্নিশে পায়রা ডাকছে বাক্বাকুম, বাক্বাকুম…। সুনসান দুপুর। শক্তি হাঁকডাক শুরু করলেন – ‘সুধীরকাকা বাড়ি আছেন? সুধীরকাকা…।’
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত কবিতা – ‘অবনী বাড়ি আছো?’ এই নামে কবিতার বইও আছে। কবিতাটি বাদলের মুখস্থ। আবৃত্তি করতে শুরু করল – ‘দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া/ কেবল শুনি হাতের কড়া নাড়া/ অবনী বাড়ি আছো?’
শক্তি বিস্মিত-মুগ্ধ চোখে তাকালেন বাদলের মুখের দিকে…। কোত্থেকে একটা প্রজাপতি এসে বসল বাদলের মাথায়।
– কবিতাটি তোমার মুখস্থ?
– হ্যাঁ। পুরোটাই মনে আছে।
সুধীর রায়ের বাড়িটিও ঘুমিয়ে আছে। ছাদের কার্নিশে পায়রার ডাক ছাড়া কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। দু-তিনবার জোরে কড়া নাড়ার পর বেরিয়ে এলো এক বৃদ্ধা। কুড়ানির মা। সুধীরবাবুর স্ত্রী মারা গেছে অনেকদিন আগে। বড় দুই ছেলে বউবাচ্চাসহ কলকাতায়। কলকাতাবাসী মেজ ছেলে তারাপদ রায় বড় কবি – শক্তির মুখে আমরা শুনেছি। এখানে সুধীরবাবু ছোট ছেলে বাচ্চুকে নিয়ে থাকেন। বাচ্চুর মাথায় সামান্য গোলমাল আছে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি দেখাশোনা, সংসার আগলানো; সব করে কুড়ানির মা। মহিলা বাদলের পরিচিত। শুধু বাদল কেন, অশোকমঞ্চে যারা নাটক করে – সবাই তার পরিচিত।
অশোকমঞ্চ! একটু ব্যাখ্যা দরকার? দিচ্ছি। সুধীরবাবুর বাড়ির উঠানের অশোকগাছটির গোড়া বাঁধানো – বেশ জায়গা জুড়ে। নাটকের মঞ্চের মতো করে বাঁধানো হয়েছে। পাড়ার ছেলেরা এখানে নাটক করে তাই নাম অশোকমঞ্চ…।
– মাসিমা এতক্ষণ কোথায় ছিলে? ডাকতে-ডাকতে গলা ভেঙে গেল।
– ইট্টু ঘুমাইতাছিলাম। তগোরে তো আর সময়-অসময় নাই। দিলি তো কাঁচা ঘুমটা ভাইঙ্গা…।
– মাসিমা উনি কলকাতা থেকে এসেছেন। কাকার সঙ্গে দেখা করবেন…।
– বাবু কি দুপুরবেলা বাড়িত থাকে? আদালতে গেছে।
– বাচ্চুদা?
– তার কী। কই ঘুরতাছে, ক্যারা জানে!
শক্তি অশোকগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ পুকুরে। জলে সাঁতার কাটছে একঝাঁক হাঁস। মৃদু ঢেউ উঠছে জলে। ঢেউয়ের ওপর রোদ পড়ে সৃষ্টি করছে অপার্থিব এক সৌন্দর্য। শক্তির চোখ পলকহীন…।
– দাদা, সুধীরকাকা তো বাড়িতে নেই। কোর্টে গেছেন।
– তাই? এই দুপুরবেলা আসাটা আমাদের উচিত হয়নি।
– চলুন, বিকেলে না-হয় আসব আবার।
– এক কাজ করি বাদল। এখানে, এ-অশোকগাছের ছায়ায়, শানের বিছানায় একটু ঘুমিয়ে নিই। অশোকগাছের স্নিগ্ধ ছায়া দেখে আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। ততক্ষণে সুধীরকাকা এসে যাবেন।
– এখানে ঘুমাবেন? বউদিরা চিন্তা করবেন না?
– তুমি গিয়ে খবর দাও।
শক্তি অশোকমঞ্চের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। যেন কতকাল এত আরাম করে শোয়া হয়নি। শুতে-শুতেই ঘুম। মৃত্যুর মতো আরামদায়ক ঘুম…। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কুড়ানির মা মনে-মনে বলল – ‘লোকটা নিশ্চয়ই পাগল। নইলে কালকাতা শহরের মানুষ এখানে আইসা, এভাবে ঘুমায়! বাড়িতে এমনিতেই পাগলের আড্ডা। আরেক পাগল আইসা জুটল…।’
সুধীরবাবুর সব ছেলের মধ্যেই একটা পাগল-পাগল ভাব আছে। মোষের মতো সবার শরীর। সবাই বাঁদিকে ঝুঁকে হাঁটে। দূর থেকে দেখেই যে-কেউ বলে দিতে পারে, ওই ছেলেটা সুধীর উকিলের ছেলে…।
বাদলকে একা দেখে বজ্রপাতে ভ্রাতৃহারার মতো হাহাকার করে উঠলেন কামাক্ষানাথ সেন। ‘দাদা কই বাদল?’
– ঘুমুচ্ছেন।
– কোথায়?
– অশোকমঞ্চে।
– অশোকমঞ্চে! বলো কী?
মীনাক্ষী বউদি বললেন, ‘আপনি উতলা হবেন না দাদা। যেখানে-সেখানে ঘুমিয়ে পড়ে – এটা ওর অভ্যেস।’
একটু পরই বাড়িতে এলেন সুধীরবাবু। কে একজন আইনজীবী মারা গেছেন। তার সম্মানে কোর্ট স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু অশোকমঞ্চে এভাবে শুয়ে আছে কে? অচেনা লোক। ‘কুড়ানির মা, কুড়ানির মা…।’
সুধীরবাবুর হাঁকডাকে শক্তির ঘুম ভেঙে গেল।
– কাকা, নমস্কার। আমি শক্তি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়…।
– শক্তি চট্টোপাধ্যায়! কবি…?
– কবি আর হলুম কখন। কবিতার দুয়ারে কড়া নাড়ছি আর কী…।
সুধীরবাবু জড়িয়ে ধরলেন শক্তিকে। ‘বসো, বসো। সুনীলের কাছে তোমার কত গল্প শুনেছি।’
– সুনীলের কাছে!
– হ্যাঁ। সুনীল এসেছিল এ-বাড়িতে। ’৭৮ সালে। সঙ্গে ওঁর স্ত্রী স্বাতী, দেশ-সম্পাদক সাগর…।
– কাকা, মানিকবাবু নাকি আপনার বন্ধু ছিলেন। ওঁর বালককালের গল্প শুনব বলে এসেছি।
কুড়ানির মা এগিয়ে এলো। রসুইঘর থেকে ভাজা মাছের গন্ধ আসছে।
– বাবু…।
– রান্নাবান্না কদ্দুর রে? অতিথি এসেছে।
– কই মাছ ভাজছি। কইতরের বাচ্চার ঝোল। মুগের ডাইল। ভাত চড়াইছি কেবল।
– ভাত হোক। তার আগে তেল-কাঁচামরিচ মেখে মুড়ি দে আমাদের।
মুড়ি খেতে-খেতে বন্ধু মানিকের গল্প করছেন বুড়ো আইনজীবী সুধীরবাবু। ‘সন্ধ্যামালতী’র কবি সুধীর রায়।
আমি তখন বিন্দুবাসিনী বয়েজ হাইস্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি। এই স্কুলের আগে নাম ছিল গ্রাহাম ইংলিশ হাইস্কুল। মার্চ মাসের দিকে চিকনমতো একটা ছেলে এসে আমাদের ক্লাসে ভর্তি হলো। নাম প্রভাতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ডাকনাম মানিক। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের সাঁওতাল পরগনায়। ওর বাবা সরকারি চাকুরে। বদলি হয়ে টাঙ্গাইল এসেছেন। বাবার সঙ্গে এসেছে মানিক…।
আমরা ওকে মানিক নামেই ডাকতাম। মানিক নামেই তো ও পরে বিখ্যাত হয়। সে-বয়সেই ওর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। তখন, আমাদের ক্লাসে আর কেউ চশমা পরে না। ক্লাস টেনের দু-চারজনে পড়ে। মানিকের চোখে কী একটা সমস্যা যেন ছিল – তাই ওকে চশমা পরতে হয়। চোখে সমস্যা না থাকলে চশমা পরবে কেন? কদিন যেতেই আমরা টের পেলাম, শুধু আমরা কেন – অংক স্যারও টের পেলেন; মানিক অংকের জাদুকর। বীজগণিত-পাটিগণিত-ক্যালকুলাসের সব ফর্মুলা ওর মুখস্থ। মুখে-মুখে অংক কষতে পারে…।
আমি ইংরেজি-বাংলা-ভূগোলে মোটামুটি চলনসই; কিন্তু অংকে খুব কাঁচা। মানিককে জিজ্ঞেস করলে ভদ্র ছেলের মতো দেখিয়ে দেয়। নতুন এসেছে তো ওর দুরন্তপনা-দস্যিপনা তখনো প্রকাশ পায়নি…।
– দুরন্ত-দস্যি ছেলে ছিলেন মানিকবাবু? কোথাও পড়িনি তো!
কোথাও হয়তো লেখা নেই। তাই পড়োনি। আমরা দেখেছি দস্যি ছেলে কাকে বলে! সেখানে পড়ে আসব। আগে বলি, আমরা বন্ধু হই কীভাবে। মূলত টুকটাক অংক শিখতে-শিখতেই ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সেই বন্ধুত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করে এ-অশোকগাছ।
– অশোকগাছ!
হ্যাঁ। এই অশোকগাছ। বলি শোনো। মানিকরা থাকত রেজিস্ট্রিপাড়া। আমাদের এ-বাড়ি। বাবা বড় আইনজীবী। বাড়িটাও বিশাল – দেখছ তো। উঠোনের মাঝখানে অশোকগাছ। বাবা নিজের হাতে লাগিয়েছে। চারা এনেছে এলাসিন থেকে। এলাসিন আমাদের গ্রামের বাড়ি। গাছটা তখন বেশ ঝাঁকরা হয়ে উঠেছে। ফুল ধরেছে প্রথমবারের মতো। আগুনরঙা ফুল। মানিক এক বিকেলে আমাদের বাড়িতে এসেছে। অশোকফুল দেখে ও কেমন পাগলের মতো হয়ে গেল…।
জানতে চাচ্ছো – আমি বা আমাদের কোনো টিচার বুঝতে পেরেছিলাম কিনা – মানিক একদিন বড় লেখক হবে। পাগল হয়েছ? কীভাবে বুঝব? অংকের জাদুকর একদিন বিখ্যাত সাহিত্যিক হবে – কে জানত এটা! তবে ও অন্যরকম ছিল। অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিল…।
কী রকম?
আমাদের শহরটা ছোট – কিন্তু ভয়ংকর সুন্দর ছিল তখন। শহরের পশ্চিম পাশ দিয়ে নদী – লৌহজং। দারুণ এক গল্প আছে এ-নদীর জন্ম নিয়ে। গল্পটি এরকম তখন দেশের মালিক ইংরেজ। সিপাহি বিদ্রোহের কদিন পরের কথা – সবে টাঙ্গাইল শহরের পত্তন ঘটেছে। যদ্দুর চোখ যায় – খালি জঙ্গল আর জঙ্গল। নদী-নালার বালাই নেই। দশ-বিশ মাইলের মধ্যে নেই লোকবসতি। সামনে-পেছনে, ডাইনে-বাঁয়ে বেশুমার গাছপালা। সকালে-বিকেলে হাওয়া খেয়ে বেড়ায় বুনো মোষের দল…। পানির বড়ো কষ্ট। কুয়োর বন্দোবস্তও নাই কোথাও। শুধু মাটির মায়ায় পড়ে আছে মানুষ। মাটির মায়া কঠিন মায়া…।
এ-সময় শহরে এলেন এক দরবেশ। করোনেশন পার্কে – বটতলা তার আস্তানা…।
– বাবা, এমন দেশে ঘর বাঁধলাম, যেখানে পানির নাম-নিশানা নেই। তুমি দয়া করো বাবা। জার-জার করে কাঁদে শহরবাসী…।
দুদিন। তিনদিন। শহরের মানুষের কান্না দেখে দিল নরম হলো দরবেশের। চারদিনের দিন তিনি বললেন, ‘তোরা সব ঘরে যা। আল্লাহ-নবীর নাম কর। আমি দেখি পানির কী করতে পারি…।’
দরবেশ ধ্যানে বসলেন। দুপুরের পর, কথা নেই বার্তা নেই; হঠাৎ উত্তর-পশ্চিম কোণ, যুগনির দিক থেকে ছুটে এলো চিতার মতো ক্ষ্যাপা বাতাস; সেইসঙ্গে ঢলবৃষ্টি। বৃষ্টির পানির রং রক্তের মতো লাল…!
দরবেশ বললেন, ‘রক্তবৃষ্টি। আর চিন্তা নাই। আলহামদুলিল্লাহ…।’
সেই রক্তবৃষ্টির ঢল থেকে জন্ম নিল নদী রক্তের নদী; মানে লোহুজং – আজকের লৌহজং…। শহরের মধ্য দিয়ে পুবে-পশ্চিমে শ্যামাবাবুর খাল। বর্ষায় সে কী স্রোত – যেন বাঘের গর্জন! নদীতে-খালে বেদের বহর। পথের দুপাশে বকুলগাছের সারি। মোড়ে-মোড়ে বটপাকুড়। শহরটা ছিল বটপাকুড়-বকুলময় শহর। গাছে-গাছে কত যে মাছরাঙা পাখি! ইট-বিছানো রাস্তায় চলে একঘোড়ার টমটম। আমার পকেটে মোটামুটি ভালো পয়সা থাকে। টমটমে চড়ে শহরে ঘুরতে পারি। কিন্তু মানিকের এক গোঁ – হেঁটে বেড়াবে। আমার হাঁটতে একটু সমস্যা হতো। বাঁদিকে ঝুঁকে হাঁটতাম। এটা আমাদের বংশগত সমস্যা। কষ্ট হলেও মানিকের সঙ্গে হাঁটতাম। ওর সঙ্গে হেঁটে সুখ ছিল। বেদের বহর, আকুরটাকুরের মাঝিবাড়ি, বেতকা ধোপাবাড়ি, কান্দাপাড়া মুচিবাড়ি, এমনকি বেশ্যাবাড়ি পর্যন্ত হাঁটতাম আমরা। হাঁটতে-হাঁটতে চারাবাড়ি কিংবা এলাসিন ঘাট পর্যন্তও গিয়েছি। ধলেশ্বরীর এই দুঘাটেই কলকাতার জাহাজ ভিড়ত। এলাসিন শহর থেকে ১০ মাইল দূরে…।
হাঁটতে-হাঁটতে কত কথা! জেলে-মাঝি-ধোপা-মুচি-বেশ্যাদের জীবন…। পরে বুঝেছি – নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবনপ্রণালি দেখার প্রতি ঝোঁক ছিল মানিকের। ওঁর গল্প-উপন্যাসে এসব এসেছে পরে।
চশমাপরা ছেলেরা সাধারণত একটু আলাভোলা হয়। মানিক ছিল উলটো। সাহসী, গোঁয়ার ধরনের। একদিন করল কী – বেশ্যাবাড়ির ভেতরে যাবে। আমার তো পা কাঁপছে। বলে কী ছেলে! মেয়েরা ওকে ভেতরে যেতে দেবে না। এক মেয়ে বলল – তোমার শরীরে তো স্কুলের গন্ধ, কলেজে উঠে এসো। মেয়েটির কথা শুনে ওর রাগ আরো বেড়ে গেল। দাঁত কটমট করছে। বলল, চলো সুধীর; মুচিবাড়ি থেকে মদ খেয়ে আসি। মদ খেলে সাহস বাড়বে। তখন জোর করে ঢুকে পড়ব…। মানিক সে-বয়সেই মদ খেত। স্কুলছাত্র মদ খায় – কল্পনা করতে পারো?
চমৎকার বাঁশি বাজাত মানিক। ওর একটা পিতলের বাঁশি ছিল। দামি বাঁশি। বাঁশিটা ভেঙে পকেটে ভরা যেত। ওর ‘অতশী মামি’ গল্পে আছে না এক বাঁশিওয়ালার কথা! সেই বাঁশিওয়ালা আর কে? আমার তো মনে হয় ওই বাঁশিওয়ালা মানিক নিজেই…।
বাঁশিটা মানিক কিনেছিল এক বেদের কাছ থেকে। কী নিয়ে একদিন ওর বাবার সঙ্গে মনকষাকষি। রাত ১০টা বাজে। মানিক তখনো বাড়ি ফেরেনি। ঘুটঘুটে অন্ধকার। পৌরসভার কেরোসিন-বাতি নিভে গেছে। ওর বাবা হারিকেন হাতে শ্যামাবাবুর খালের কাঠের পুল পেরিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছেন। মানিক থাকতে পারে আমাদের বাড়িতে। কিন্তু নেই। কোথায় গেল হতভাগা…।
সকালে বাঁশি হাতে মানিক আমাদের বাড়িতে উপস্থিত। চোখ লাল। বোঝাই যাচ্ছে Ñ রাতে ঘুমায়নি।
– কোথায় ছিলি রাতে?
– নদীতে। বেদের বহরে। রাতটা চমৎকার কেটেছে – বাঁশি শুনে। এটা কিনে এনেছি।
– তোর বাবা খুঁজতে এসেছিলেন।
– খুঁজুক। বাবাদের বোঝা উচিত ক্লাস টেনের ছাত্র কোথাও হারিয়ে যাবে না।
এলাসিন আমাদের গ্রামের বাড়ি। পাশেই ধলেশ্বরী নদী। ধলেশ্বরী তখন সাগরের মতো বিশাল। কূলকিনারা নেই। বাতাস উঠলে মানুষ-সমান ঢেউ ওঠে। মাঝ-নদীতে জেলেরা মাছ ধরে। রুপার থালার মতো চকচকে ইলিশ। ধলেশ্বরী দেখে আশ মেটে না মানিকের। আমরা মাঝেমধ্যেই যাই। জেলেরা বেশিরভাগ মাছ ধরে রাতে। দূরে-দূরে হারিকেনের টিমটিমে আলো। দিনে মাছ ধরে কম। মানিক বলে, একবার রাতে আসতে হবে। কোনো জেলেকে বলেকয়ে থাকব মাছধরা নৌকায়। জানি, মানিক তা পারবে। একদিন রাস্কেলটা করল কী – নদীতে নেমে সাঁতার শুরু করল; জেলে-নৌকায় যাবে…।
– তাহলে পদ্মানদীর মাঝি…!
মানিক আমাকে বই পাঠিয়েছিল। বহুবার পড়েছি। কোথায় পদ্মা? সবটুকু ধলেশ্বরী। ওকে চিঠি লিখলাম। ব্যাটা, তুই ধলেশ্বরীকে পদ্মা বানিয়ে দিলি? মানিকের কাছ থেকে ওই চিঠির কোনোদিন উত্তর পাইনি। পদ্মানদীর মাঝিতে আমাদের আকুরটাকুর মাঝিবাড়ির উল্লেখ আছে। কপিলার শ্বশুরবাড়ি। তাহলে…?
মানিক বছর-দেড়েক ছিল এখানে। ওর বাবার বদলির চাকরি। একদিন চলে গেল ওরা। যাওয়ার দিন দুরন্ত মানিকের সে কী কান্না! চোখে শ্রাবণের ঢল…।
এতক্ষণ আমি, এই গল্পের কথক, সুধীরবাবু আর শক্তির গল্পের ভেতর ছিলাম না। সুধীরবাবু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প করছিলেন। শক্তি শ্রোতা।
দু-চার কথা শক্তিও বলেছেন। বলেছেন, মানে; দু-একটি প্রশ্ন করেছেন। এবার আমি গল্পে ঢুকে পড়লাম। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। কমলারঙের রোদ পড়েছে ওদের চোখেমুখে। রায়বাড়ির রোদ অন্যরকম। যে-কাউকে তীব্রভাবে টানে। আমাকেও টানছিল…।
শক্তি বললেন, ‘ভারী ইন্টারেস্টিং গল্প। অকথিত ইতিহাসও আছে। কোথাও এসব পড়িনি। কোথাও লেখা নেই।’
– লিখতে জানলে আমি লিখে রাখতাম…। বললেন সুধীরবাবু।
ব্যস্ত উকিল হওয়ার আগে, বড় কবি হওয়ার স্বপ্ন ছিল সুধীরবাবুর। কবিতা লিখতেন। একটা কবিতার বইও আছে – সন্ধ্যামালতী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বড় কবি হতে পারেননি। কে জানত তাঁর পাগলা ছেলে খোকন (তারাপদ রায়) বড় কবি হবে। লিখবে – ‘বৃষ্টি হলে তোমাদের কথা মনে পড়ে/ বৃষ্টি না হলেও তোমাদের কথা মনে পড়ে/ যখন অনেক কাজ/ যখন কোথাও কোনও কাজ হাতে নেই/ বৃষ্টি হলে/ বৃষ্টি না হলেও/ তোমাদের কথা মনে পড়ে।’
হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল সুধীরবাবুর। কার কথা মনে পড়ছে তার? মা-বাবা কিংবা স্ত্রীর কথা? নাকি বাল্যবন্ধু মানিকের কথা? কে জানে!
– একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব কাকাবাবু…। শক্তি সম্মতি চাইলেন।
– করো…।
– আপনার ছেলেরা কলকাতা, কাকিমা স্বর্গে গেছেন। বাচ্চু তো থেকেও নেই। আপনি একাকী কেন এখানে…?
– কী বলো শক্তি! এ-বাড়িতে আমার মা-বাবার আত্মা ঘুরে বেড়ায়; স্ত্রীর আত্মা ঘুরে বেড়ায়। রায়বাড়িতে কমলারঙের রোদ পড়ে; যা পৃথিবীর কোথাও নেই; এসব রেখে আমি কোথায় যাব? আর দ্যাখো, এই যে অশোকগাছ; বাবার সৃজিত; এ গাছের ফুল দিয়ে পাড়ার গৃহিণীরা ষষ্ঠীব্রত পালন করে। আমি ভিটে ছাড়লে গাছটিকে দেখবে কে, বলো?
– বাংলাদেশে নাকি হিন্দুদের…।
– না, না, না। মিথ্যে কথা। সব বানানো। সব অসৎ মানুষের কূটচাল। অশুভ রাজনীতি। ’৪৭ সালে কী হয়েছিল দেখোনি তোমরা? দেশত্যাগ আর মাতৃত্যাগ তো একই কথা…। ’৭১ সালে পাকবাহিনী যখন আমাদের গ্রামের শিক্ষক যোগেন্দ্র শীলকে গুলি করে হত্যা করল, তখন, তাদের বন্দুকের নলের মুখে পড়েও মাতৃভূমি ত্যাগ করিনি। আর এখন, এই দেশি বন্দুক দেখে…!
সুধীরবাবু অশোকগাছটিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। শক্তির চোখেও জল…।