গঞ্জের পাশ দিয়ে বয়ে চলা মরা খালের কাছে এসে দাঁড়ায় সে। অনেকক্ষণ হলো ছাইরঙা সন্ধে উতরে অন্ধকার নেমেছে। অন্ধকার এখনো তেমন জমাট হয়নি। তবে অন্ধকারটা জমাট বাঁধবো-বাঁধবো করছে। কচুরিপানা এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অন্ধকারের ভেতর কচুরিপানাগুলোকে অধিকতর অন্ধকার বলে ভ্রম হয়। কচুরিপানার পাশে বাঁধা লতাপাতা দিয়ে জাংলার মতো করে বানিয়ে অনেকটা জায়গা দখল করে রাখা হয়েছে। দেখে মনে হতে পারে, বুঝি মাছ ধরার জাল পাতা আছে। পানি টান লাগার সময় বাঁশ, লতাপাতার নিচে অজস্র মাছ ভিড় করে।
মরা খালের কাছে এসে দাঁড়িয়ে সে একটু জিরোয়। হাটবার বলে দ্রুত পা চালানোর ফলে সে ক্লান্ত। শরীর বেঁকে আসছে। গোড়ালির নিচ থেকে চিনচিনে এক ধরনের ব্যথা মেয়েলোকের কান্নার মতো বেরিয়ে কোমর অবধি চলে আসতে চাইছে। আজ হাটবার। মহিম নিজের বলদ জোড়া নিয়ে এসেছিল হাটে। উদ্দেশ্য বিক্রি। ‘বলদ জোড়া বিক্রি করব বিক্রি করব’ বলে বলে মহিম প্রায় বছরখানেক ধরে রেখেছিল। এই সময়টুকু সে হাতে নিয়েছিল এই ভেবে যে, এর মধ্যে যেভাবেই হোক অন্য কোথাও থেকে সে টাকার ব্যবস্থা করে ফেলবে। টাকার ব্যবস্থা করার জন্য মহিম কম কসরত করেনি। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। মহিম অতগুলো টাকা একসঙ্গে জোগাড় করতে পারেনি। একসঙ্গে কে-ই বা আর মহিমকে অত টাকা দেয়! না হয় টাকাগুলো কেউ একসঙ্গে কোনোমতে মহিমকে দিলোই বা, তারপর ধার নেওয়া টাকাগুলো মহিম যদি ঠিক সময়ের মধ্যে ফেরত না দিতে পারে? এসব ছোটলোক গরিব-গুর্বোদের টাকা ধার দিয়ে কখনো একসঙ্গে পুরোটা পাওয়া যায় না।
মহিম এরকম বিপদের মধ্যে বড়ভাই মঙ্গাকে টাকার কথা বলেছিল। মহিমের মেয়ের বিয়েতে টাকার দরকার। মহিমের বড় মেয়ে। দেখতে বেজায় কালো। অন্ধকার রাতে মহিমের মেয়েটা হাসলে তার দাঁতগুলোই শুধু দেখা যায়। মেয়েটার গড়ন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশের ভেতরে ঢুকে-পড়া বড় বড় ভারতীয় গরুর মতো। মহিম তার এ-মেয়ের বিয়ে নিয়ে বেশ চিন্তার মধ্যে আছে। এমনিতেই বিয়ের সম্বন্ধ আসে না। চৌদ্দ মাসের মাথায় বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে মেয়েটার। দুগ্রাম পর থেকে। ছেলেটা বোকা কিসিমের। বাপের টুকটাক জমি-জিরেত আছে। আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু কী কারণে যেন সে-বউ চলে গেছে। বউ চলে যাওয়া নিয়ে গ্রামের লোকজন নানা ধরনের কথা বলে। সেসব কথা শুনলে ছেলেটারই যে দোষ বেশি তা বোঝা যায়। ছোট মেয়ে সরস্বতী অবশ্য মহিমকে বিয়ের খরচ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। একই গ্রামের নখাকে নিয়ে সে রাতের অন্ধকারে ভেগে গেছে। এ নিয়ে সালিশ হয়েছে। সালিশে নখার বড়ভাই অজয় মহিমকে দায়ী করে একহাত নিয়ে নিয়েছে আর গলা উঁচিয়েছে, ওই মহিম কুণ্ডুই ওর ছিনাল মেয়েটারে দিয়া আমার ভাইরে ভাগাইয়া নিয়া গেছে।
অজয়ের কথায় কথায় মহিম রেগে যায়। সেও নখার ওপর দোষ চাপায়, আমার মাইয়ার কী এমুন ঠ্যাকা পড়ছে যে ওর ভাইরে ভাগাইবো? মহিম অবশ্য অজয়ের মতো মুখ খারাপ করে নখার সম্বন্ধে কথা বলেনি। শত হলেও মেয়ের জামাই তো! সালিশে কোনো কূলকিনারা হয় না। দুপক্ষের অপরাধ সমান সমান। মহিম সালিশে চেহারায় একটা রাগ-রাগ ভাব তুলে রাখল। মেয়েটা তাকে খরচের হাতে থেকে বাঁচিয়ে পালিয়ে গ্রাম ছাড়ল। মুখে চুনকালি মেখে দিলো। এসব কারণ উপলক্ষ করে মহিম স্বাভাবিকভাবে চেহারায় যতটা সম্ভব রাগ-রাগ ভাব ঝুলিয়ে রাখল। তবে মহিম মনে মনে তৃপ্ত। মেয়েটা তাকে এত খরচ থেকে নিষ্কৃতি দিলো! সালিশ শেষে মন খারাপ নিয়ে বিড়ি ধরিয়ে টানতে টানতে বাড়ি ফিরল মহিম। রাতের আকাশে বিড়ির ধোঁয়া মহিমের স্বস্তির ধোঁয়া হয়ে উড়তে লাগল।
মহিম বড় ভাইকে টাকার কথা বলতেই মঙ্গা খেঁকিয়ে উঠল, আমার হাতে নাই টাকা-পয়সা আর তুই আইছস টাকা ধার লইতে? পারলে তুই আমারে কিছু টাকা দিয়া যা ।
মঙ্গার কথায় মহিম চমকে ওঠে, বলে কী!
মহিম জানে মঙ্গা ওর বউয়ের কথামতো চলে। ওঠবস করে। মঙ্গার বাজারে আছে মুদির দোকান। আয়-রোজগার ভালোই। মঙ্গার কোনো ছেলেপুলে নেই। মঙ্গার বউকে নিয়ে আশপাশের লোকজন আজেবাজে কথা বলে। সেসব কথা মঙ্গার কানেও যায়। তাতে মঙ্গার কিছু যায়-আসে না। মানুষের কথা কানে তুললে কী নিজের আয়-উন্নতি হয়?
টাকাটা আমার খুব দরকার। থাকলে তুমি না কইরো না। কিছুদিন বাদে আমি টাকাগুলো তোমারে দিয়া দিমু। মহিম বিশ্বাসী দৃষ্টি নিয়ে মঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকে।
তোরে দেওনের মতো টাকা আমার কাছে নাই। আমার কাছে যে-টাকা নাই, বিশ্বাস না-হয় তোর ভাবিরে জিগা।
মহিম তার ভাইয়ের বউকে শুধু চেনে না, খুব ভালো করেই চেনে। আলমারিভর্তি টাকা থাকলেও কৃষ্ণা কখনো মহিমকে এক টাকাও দেবে না। আর অন্যের মেয়ের বিয়ের কথা শুনলে কে কাকে টাকা দেয়?
মহিম মঙ্গার সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
দুই
মহিম তার জোড়া বলদ নিয়ে যখন বাড়ি থেকে বের হলো তখন সূর্য মাঝ আকাশে। যেনবা সূর্যমুখী ফুল। মহিমের কতকাল আগের পুরনো জংধরা টিনের চালে রোদ পড়ে খাঁ-খাঁ করছে। টিনের চালের ঠিক নিচে কবুতরের খোপ-খোপ দেওয়া ঘরগুলো থেকে টানা গুনগুন শব্দ ওঠে। ঘরের চালে নেটের জালের ভেতর সুপারির দুটো পুঁটলি উলটোমুখো হয়ে শরীরে রোদ লাগায়। ঠিক সে-সময় মহিম বলদ জোড়া নিয়ে হাটের দিকে রওনা দেয়। মহিমের বউ কিছু না বলে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। মায়ের মতো মায়ের পাশে দরোজায় দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটাও। মহিমের মেয়েটা হয়েছে অবিকল মায়ের মতো।
মহিম উঠোন পেরিয়ে যায়। গরু দুটোকে একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে আবার ফিরেও আসে। এসে বউকে বলল
কিছু কইবি? আনন লাগবো কিছু? বলে মহিম চুপ মেরে থাকে। বাকি কথা তার গলায় ঝুলে থাকে। সবটা বেরোয় না।
মহিমের বউ ঘরের দরোজা ছেড়ে নেমে আসে উঠোনে। চারদিক থেকে নিচু হয়ে এসে উঠোনের মাঝখানটা আপনাআপনি কিছুটা উঁচু হয়ে গেছে। উঠোনটা মাঝখানে উঁচু হয়ে যাওয়াতে সুবিধাই হয়েছে। বৃষ্টির পানি উঠোনের উঁচু জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। গড়িয়ে নামে নিচে। পানি নিচে নেমে যাওয়ার পর উঠোনময় গুটিকয়েক রেখার ভাঁজ পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে।
মহিমের বউ নেমে আসা গলায় বলল, বলদজোড়া বিশ হাজারের নিচে বেইচো না। দাম না পাইলে বেচনের দরকার নাই। গরু বেচনের পর টাকা সাবধানে রাইখো বলে মহিমের বউ এতক্ষণের জমাটবাঁধা কান্না আর আটকে রাখতে পারল না। সে হু-হু করে কাঁদতে লাগল। মহিম কিছু বলল না। বলতে পারল না। বউয়ের কান্নাকে এখন প্রশ্রয় দিলে চলবে না।
মহিম বউকে ধমক দিলো, যাইতাছি গরু বেচতে আর তুই শুরু করছস প্যানদানি, বলে বউকে আরো জোরে ধমক লাগাল মহিম, ওই কালী তোর মারে ঘরের ভিত্তে লয়া যা
মহিম খুঁটির সঙ্গে বাঁধা বলদের রশি ভালো করে পরখ করল। তারপর ঘরের দাওয়ায় এসে বসল। মেয়েকে পানি আনতে বলে মহিম ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম ঝেড়ে ফেলল। মাথার ওপর চৈত মাসের প্রখর সূর্য। গরমে হাঁপাতে থাকে সে। গরু দুটোও তার মতো হাঁপাচ্ছে। গরু আর মহিমের মধ্যে পার্থক্য হলো এই, গরু দুটোর মুখ গড়িয়ে লালা পড়ছে। মহিমের পড়ছে না। গরু দুটোকে দেখতে দেখতে মহিমের খুব রাগ হলো। তার ইচ্ছে করল, বলদ জোড়াকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে। আবার মনে মনে এটাও ভাবে, কালীকে বলে দেবে সে, যেন সরস্বতীর মতো নিজের বিয়ের ব্যবস্থা নিজেই করে নেয়। পরক্ষণেই তার মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়। দেখা দেয় প্রশ্ন, আচ্ছা, কালী কি ইচ্ছা করলে সরস্বতীর মতো নিজেই নিজের বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবে! মনে হয় না। কালীটা যে খুব বোকা স্বভাবের। বোকা মেয়েদের দুঃখ-কষ্ট এক জীবনে শেষ হয় না। সৃষ্টিকর্তা তাই বোকা মেয়েদের বারবার পৃথিবীতে পাঠান।
মহিম পানি খেয়ে উঠোন ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। পেছনে পড়ে থাকে ঘর। চৈত্র মাসের তেজালো রোদ।
মহিম গরু নিয়ে হাটে ঢোকে। হাটে আসার সময় পথে অনেকেই তার গরু জোড়া দেখে তাকে জিজ্ঞেস করেছে
বেচবানি! কত অইলে গরু দুইটা বেচবা মিয়া?
বড় মেয়ের বিয়েতে যত খরচ হয়, তত হলেই সে গরু দুটোকে বেচে দেবে।
বেচনের দাম কও মিয়া। আকতা-কুকতা কইও না। ঠিকমতন দাম কও।
মহিমের বলদ জোড়া যে দেখে, তারই চোখে লেগে থাকে। সবার চোখে মহিমের গরু জোড়ার টান-টান শরীর ভাসে। মসৃণ চামড়া। গরু দুটোর শরীরে তেলতেলে একটা ভাব আছে ছড়িয়ে। মহিমের বউ যে-দাম বলে দিয়েছিল সে সেই দামই বলেছে। না, না, মহিম বুদ্ধি করে সে-দামের সঙ্গে আরো তিন হাজার যোগ করেছে। এই দামে পছন্দ হয় কেন নাইলে আগে বাড়বার পারো। তেইশ হাজারের জায়গায় যদি দুই-এক হাজার কমেও যায় তাতে লাভটা বিশ হাজারের চেয়ে একটু বেশি হলো।
হাটের মুখে পাটের বেল নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনেকটা জায়গা দখল করে রেখেছে ব্যাপারীর লোকজনেরা। লোকজন দরদাম নিয়ে চেঁচামেচি করছে। গদিতে তেলামাথায় আরাম করে বসে থাকে একটা লোক। ডান হাতের তর্জনী চালান করে মুখের ভেতর। পানের দলার চূর্ণবিচূর্ণ অংশ এ-মাঢ়ি থেকে ও-মাঢ়িতে পাঠায়। তর্জনী চালানোর সময় মুখ বিকৃত হয়। আয়েশে সিগারেটে বড় করে টান দেয়। সিগারেটে টান দেওয়ার ফলে গলগল করে সিগারেটের ধোঁয়া আকাশে অজানা দেশের মানচিত্র তৈরি করে।
পাটের দোকানগুলো অতিক্রম করে মহিম গরু নিয়ে বাজারে ঢোকে। পেছন থেকে কেউ একজন মহিমকে গলা উঁচু করে ডাক দেয়, ওই মহি হুইনা যা মহিম ডাক শুনে পিছিয়ে আসে। পাটের ব্যাপারী জাহাঙ্গীর হোসেন। যুদ্ধের সময় জাহাঙ্গীর ভারতে চলে গিয়েছিল। স্বাধীনতার অনেক আগে থেকে জাহাঙ্গীরের পাটের ব্যবসা। বড় বড় তিনটা নৌকা আছে। নৌকাগুলো সারাবছর পাট কেনার জন্য বিভিন্ন জেলায় যায়। সস্তায় পাট কেনে। বাড়িতে প্রচুর জমিজমা। বছরে দুই-তিন হাজার মণ ধান পায়। বাজারে জাহাঙ্গীরের নিজের ধান ভাঙানোর কল আছে। ঘরে দু-দুটো জোয়ান বউ। সবার ঘরই ছেলেমেয়েতে ভরপুর।
আমারে ডাকছেন?
মহিম গরু নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীর পেছন থেকে লিকলিকে কালো চেহারার বাবরকে ডাক দেয়। বাবরকে দেখতে লাগে বাংলা সিনেমার জোকারদের মতো। বাবর বলল
ওই মহি, তর গরু দুইখান হুজুরের পছন্দ হইছে। দাম কত ক।
মহিম ব্যাপারীর দিকে তাকায়। অযথা কথাকাটাকাটি এড়ানোর জন্য সে একদাম বলে, তেইশ হাজার টাকা। ঝিরঝিরে বাতাসে গাছপালা যেমন মৃদুমন্দ দুলে ওঠে মহিমের দাম শুনে জাহাঙ্গীর হোসেনও সেরকম নড়েচড়ে ওঠে। হাসে। জাহাঙ্গীরের হাসি বাবরকে সংক্রমিত করে। বাবরের সঙ্গে থাকা দু-চারজনও মিনমিন করে হেসে ওঠে।
ব্যাটা, আজাইরা দাম কইছ না। কত অইলে বেচবি হেইডা ক।
আজাইরা দাম কই নাই। এক দামই কইছি। মহিম চুপ করে গরু দুটোকে দেখে।
বাবর জাহাঙ্গীরের কানের সঙ্গে কান লাগিয়ে ফিসফাস করে কথা বলে মহিমকে বলল, মিলঝিল কইরা তরে বারো হাজার দেই। গরু দুইটা দিয়া দে।
মহিম জাহাঙ্গীরের কাছে গরু বিক্রি করে না। সে গরু নিয়ে বাজারের ভেতর ঢুকে যায়। পেছন থেকে বাবরের গলা শোনা যায়, বারো হাজার টাকায় বিক্রি করলে গুরু দুইটারে পাড়ের নৌকায় রাইখা যাইছ।
বাবরের কথায় মহিমের রাগ চড়ে যায়। সে কোনো কথা বলে না। কথা বলার প্রয়োজন মনে করে না। একদাম বিশ হাজার। এর নিচে সে গরু বিক্রি করবে না।
মহিমের আশপাশে আরো অনেক গরু-ছাগল। মহিষও আছে বেশ কয়েকটা। তবে বয়সের ভারে লালচে কালো রঙের মহিষগুলো বুড়িয়ে গেছে। পিঠের কুঁজে কচি ধানের চারার মতো লোম। লোমের নিচে নরম কাদার মতো দগদগে ঘা। বড় নীল ডুমোমাছি ভনভন করে সে-ঘায়ের আশপাশে ওড়াউড়ি করছে।
মহিম অনেকক্ষণ ধরে বেঁটেমতো একটা লোককে তার আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখছে। লোকটাকে সে আগে কখনো দেখেনি। সেই লোকটা লুঙ্গির পেছনের দিকটা প্রায় পশ্চাৎদেশের কাছাকাছি উঠিয়ে তার পেছন ঘুরঘুর করছে। বেলা পড়ে আসছে। রোদের তেজ একটু একটু করে কমছে। মরা খাল থেকে একটা ঠান্ডা হাওয়া আম-কাঁঠালের গন্ধের মতো মহিমের নাকে এসে লাগছে আর চারদিক শীতল করে দিচ্ছে।
চা লাগবো, চা।
এগারো-বারো বছরের একটা ছেলে। হাতে বড় চায়ের ফ্লাস্ক। খয়েরি রঙের। ছেলেটা দু-তিনটে সস্তা কাচের গ্লাসে আওয়াজ তুলে যাচ্ছে। ওর ভাবটা এরকম কেউ চা চাইলে সে জায়গামতো গরম চা পৌঁছে দেবে। ছেলেটাকে দেখে মহিমের চা খেতে ইচ্ছে করে। সে ছেলেটাকে এক কাপ চা আনতে বলে। ছেলেটা কাপে টুংটাং আওয়াজ তুলে সামনে আসে। কিছুদূর থেকে আরেকজন দুই কাপ চায়ের অর্ডার দেয়। ছেলেটি দ্রুত হাঁটে, আয় চা গরম। বেঁটেমতো লোকটা আরেকজন লোক সঙ্গে নিয়ে মহিমের সামনে এসে দাঁড়াল। বাজার আস্তে আস্তে করে জমে উঠতে শুরু করেছে। লোকজনের কথাবার্তা বলার গমগম কানে বড় বিশ্রী ঠেকে।
লোক দুটোর হাবভাব দেখে মহিমের খদ্দের বলে ভ্রম হয়।
গরু জোড়া তো খুব ফাইন বলে বেঁটে লোকটা তার সঙ্গের লোকটাকে গরু দেখায়।
মহিম লোক দুটোর ভাবগতিক খেয়াল করে। তাদের চালচলন দেখে। মহিম দাম বললে তার দামের সঙ্গে খদ্দেরদের দাম মেলে না। দামে বনিবনা হলে সে চোখ বন্ধ করে গরুজোড়া বিক্রি করে দেবে। বিকেলের শেষভাগে আঠারো হাজার আটশ টাকা বলে খুব জোরাজুরি করেছিল লেবুতলার মতিন ডাক্তার। মতিন লোকটা খুব ত্যাঁদড় প্রকৃতির। কথা বলার সময় মোরগের ঝুঁটির মতো তার গোঁফ নড়ে। ইচ্ছে করলে মতিন ডাক্তার কিছু টাকা বাড়িয়ে দিয়ে মহিমের কাছ থেকে গরুজোড়া কিনে নিতে পারতেন। মহিমের একবার ইচ্ছে হয়েছিল ওই টাকায় গরুজোড়া বিক্রি করে সন্ধ্যার আগে আগে সে বাড়ি ফিরে যায়। সন্ধ্যার পর অত টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে মহিমের ভয় লাগে। যদি পথেঘাটে কোনো বিপদ ঘটে! আজকাল বলা তো যায় না কিছু।
আপনেরা কী সত্যই গরু কিনবেন? মহিম লোক দুটোকে জিজ্ঞেস করে।
হ মিয়া গরু কিননের লাইগাই তো হাটে আইছি। কও দেহি জোড়া কত?
একদাম কমু না উলটাসিধা দাম মহিমকে আর বাকি কথা বলার সুযোগ দিলো না। লোকটা তার আগে বলে উঠল, আন্দাকুন্দা দাম কইলে গরু বেচন যাইবো? একদামই কও।
বেঁটেমতো লোকটা সঙ্গের লোকটাকে কোনো কথা বলতে দিচ্ছে না। বেঁটে লোকটার তুলনায় সঙ্গের লোকটাকে বেশ ভদ্র বলে মনে হলো মহিমের। কিছুটা লাজুক প্রকৃতিরও মনে হলো।
একদাম বিশ হাজারে গরু জোড়া লইতে পারেন।
বিশ হাজার! বলে বেঁটে লোকটা যেন আকাশ থেকে পড়ল, দূর মিয়া কী যে কও। গরুর আবার এত দাম অয়নি!
সারাবছর গরুর পিছে যে খাওন-দাওন লাগে হের দামই মিয়া হাজার হাজার টাকা Ñ কথাটা বলতে গিয়েও মহিম থেমে যায়।
বেঁটে লোকটা নাছোড়বান্দা। সঙ্গের লোকটা তাকে বলল, শ্যামল, গরুজোড়া কিন্তু আমার পছন্দ হইছে। তুমি দাম ঠিক করো। সঙ্গের লোকটার কথায় মহিম বেঁটে লোকটার নাম জানে। আর সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যায় বেঁটে লোকটা আসলে কে। অনেক কথাকাটাকাটির পর গরুর দাম ঠিক হলো উনিশ হাজার পাঁচশো। বিশ হাজারের নিচে মহিমকে গরু বিক্রি করতে মানা করে দিয়েছে তার বউ। এদিকে সন্ধে হয়-হয়। বাজারে ভারতীয় গরুও উঠেছে বেশ। সবদিক চিন্তা করে শেষমেশ মহিম বিশ হাজার থেকে পাঁচশো টাকা ছাড় দিয়েছে। মহিমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাড়-জিরজিরে টাইপের গরুর মালিক মহিমকে বুঝিয়েছে, শেষকালে পাঁচশো টাকার লাইগা গরু জোড়া না আবার বাড়িত ফেরত লয়া যাইতে হয়।
শেষমেশ মহিম ওই দামেই গরু বিক্রি করল। অবশ্য টাকা দেওয়ার সময় বেঁটেমতো লোকটা মহিমকে দুশো টাকা কম দিয়ে হাত ধরে ফেলেছে, দুইশো টাকা আবদার কইরা কম দিলাম। আটত্রিশটা পাঁচশো টাকার নোট আর তিনটা একশ টাকার নোট। একশ টাকার নোটগুলোকে মহিম শার্টের পকেটে রাখে। বাকি টাকা সে কায়দা করে রেখে দেয় লুঙ্গির নিচে আন্ডারওয়্যারের গোপন চেইনঅলা পকেটে। শহর থেকে এই আন্ডারওয়্যারটি সে কিনেছিল। টাকাগুলো খুব শক্ত করে বাধা। পথে যদি চোর-ছিনতাইকারী মহিমকে টাকার জন্য ধরে তবে সে আচমকা একটা কৌশল দেখিয়ে সবাইকে হতবাক করে দেবে। চোর-ছিনতাইকারী যখন তাকে ধরবে তখন সে করবে কী শক্ত করে বাধা লুঙ্গির গেরোটা খুলেই লাগাবে এক দৌড়। আন্ডারওয়্যার পরে সে দেবে প্রচণ্ড এক দৌড়। অর্থাৎ যে-কোনো মারাত্মক পরিস্থিতির জন্য মহিম প্রস্তুত। তিনশো টাকা দিয়ে সে একটা রংচঙা লাল গামছা আর বড় মেয়ের জন্য একটা বক্ষবন্ধনী কিনবে। মহিমের বউ তাকে এসব জিনিস কিনে আনতে বলেছে। মহিম বউকে জিজ্ঞেস করলে বউ জবাব দিয়েছে, দরকার আছে, কামে লাগবো। মহিম একটা দোকানে ঢুকে ঝটপট কিনে নেয় সেসব। জিনিসগুলো কাগজের প্যাকেটে মুড়ে নেয়, যাতে কেউ দেখতে না পারে। দেখলে অবশ্য মহিমের এমন কিছুই হবে না। গ্রামের সবাই জানে মহিমের যুবতী মেয়ে আছে ঘরে। এ-জিনিস তো লাগতেই পারে, লজ্জার কী আছে! তবু মহিমের বড় লজ্জা।
তিন
মরা খালটার কাছে আসতেই মহিমের মনটা বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে উতল হয়ে উঠল। খালের শরীর থেকে একটা হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস তার মনকে যেন কেমন করে দিলো। তার ভালো লাগতে শুরু করল। সে কিছুক্ষণ খালপাড়ে দাঁড়িয়ে রইল। সন্ধ্যারাত্তিরে খালের কালো জল তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। মহিম কেন যে খালপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেটা সে নিজেও বোঝে না। দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে, তাই দাঁড়িয়ে থাকা। মানুষ মাঝে মাঝে খুব অদ্ভুত ভালো লাগায় আক্রান্ত হয়। এই যেমন এখন হয়েছে মহিম।
মহিম বাড়িমুখো হাঁটা দেয়। তার সঙ্গে আরো দু-চারজন। কারো হাতে টর্চ। কারো হাতে টিমটিমে হারিকেন। কারো আবার এসবের বালাই নেই। মহিমের হাতে একটা দিয়াশলাই। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে সিগারেট। অন্ধকারে মহিমের হাতে জ্বলতে থাকা সিগারেটের আগুন দ্রুত ছোটাছুটি করে। দূর থেকে মনে হয় বুঝিবা আলোর নাচন!
মহিম খুব সন্তর্পণে আন্ডারওয়্যারের গোপন পকেটে হাত ঢুকিয়ে অনুভব করে তার টাকাগুলো নিরাপদে আছে। আশপাশে তাকায় সে। সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। তারপর সে আরো জোরে হাঁটা শুরু করে।
মহিম বাড়ির প্রায় কাছাকাছি চলে আসে। বাড়ির ভেতর থেকে পরপুরুষের গলা উঠে আসে। এক মানুষ সমান উঁচু বাঁশে কলাগাছের পাতা লম্বা করে ঝোলানো। কলাপাতাগুলো শুকিয়ে বেড়ায় পরিণত হয়েছে। বাতাসে কলাগাছের সেই বেড়া নড়েচড়ে উঠলে শর-শর করে একটা আওয়াজ ওঠে। পুরুষের কণ্ঠটি মহিমের কাছে পরিচিত ঠেকে। পুরুষ কণ্ঠস্বর কলাপাতা বেড়ার ফাঁক দিয়ে উগলে বাইরে এসে পড়ে, বিয়ার সময় কোনো ট্যাকা-পয়সা লই নাই। অহন আমার ট্যাকার দরকার। তর বাপেরে ক ট্যাকা দিবার।
আমারে লয়া ভাগনের সময় তো ট্যাকার কথা কও নাই। অহন কও ক্যা? কথাগুলো বলে সরস্বতী দম নেয়, অহন এতো ট্যাকা দিয়া তুমি কী করবা?
ব্যবসা না করলে তরে খাওয়ামু কী?
নখা বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সরস্বতী ঘরের দরোজার সামনে বসে আছে। মহিমের বউ রান্নাঘরে ভাতের মাড় গালে। লাল চালের গন্ধ রাতের বাতাসে ভেসে বেড়ায়।
বাবায় এতো ট্যাকা পাইবো কই?
ট্যাকা না দিলে ব্যবসা করুম ক্যামনে? ব্যবসা না করলে খাইবি কী? বিশ হাজার ট্যাকা অইলেই ব্যবসা করন যাইবো।
নখার এক বন্ধু গুলিস্তানে পুরান ছেঁড়া-ফাটা টাকার ব্যবসা করে। নখার সেই বন্ধু নখাকে বলেছে, এ-ব্যবসায় কোনো লস নাই। তুই খালি টাকা আইনা আমারে দে। লাভের চিন্তা আমার মহিম বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে সব শোনে। রাত এগিয়ে চলে সামনের দিকে। মহিমের কাছে গাছগাছালির সারিগুলোকে কেমন ধোঁয়াটে-ধোঁয়াটে লাগে। নখার টাকার কথা শুনে মহিমের কী হয়, সে অজানা এক ভয়ে কেঁপে ওঠে। হাতে ধরে রাখা বড় মেয়ের জন্য বাজার থেকে নিয়ে আসা জিনিসটা তার হাত থেকে পড়ে যায়। লুঙ্গির নিচে রাখা টাকাগুলো আবার পরখ করে দেখে নেয়। না, ঠিক আছে। তারপর বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহিম। দীর্ঘশ্বাস ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাজারে সদ্য বিক্রি করে আসা গরু দুটোর চেহারা। তারপর ভেসে ওঠে তার দু-মেয়ের মুখ। কালী আর সরস্বতী।