স্কুলগেটের কাছে পৌঁছে হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে কমলিকা দেখলো তখনো ১৫ মিনিট বাকি আছে শুভমের স্কুল ছুটি হতে। এই জায়গাটায় একটুকুও ছায়া নেই। বাইপাসের পাশে, পূর্ব কলকাতায় এই ইন্টারন্যাশনাল স্কুলটা নতুন হয়েছে। হয়েছে মানে এখনো তৈরি হচ্ছে। তিনতলা বিরাট স্কুলবাড়িটা তৈরি হয়ে গেলেও এখনো গাছের চারা পোঁতা চলছে, ঘাসের চাদর বিছানো হচ্ছে স্টুডেন্টদের খেলার মাঠে। আর চলছে ভিক্টোরিয়ান শৈলীর রড-আয়রনের বেড়া দেওয়ার কাজ। কমলিকা আস্তে আস্তে বাইপাসের সামনে বাসস্ট্যান্ডের ছায়ার নিচে এসে দাঁড়িয়ে, অাঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছলো।
এখন বিকেল সাড়ে তিনটা, ঠিক অফিস ছুটি হওয়ার সময় নয়। তবু রাস্তায় কী ভীষণ ব্যস্ততা, কত গাড়ির ছোটাছুটি। আনমনে কমলিকা ভাবছিল, কারা যাচ্ছে এই গাড়ি করে, কোথায় বা যাচ্ছে তারা। এবার কমলিকার গাড়িটার ডেলিভারি পাওয়া দরকার। কতদিন আর এভাবে বাসে-অটোতে যাতায়াত করা যায়। তার আগে নতুন চাকরিটাতে জয়েন করা, প্রথম মাসের স্যালারি পাওয়া না হলে এসব গাড়ি-টাড়ি কিছুই অবশ্য হওয়ার নয়। চিন্তায় ছেদ পড়লো একটা অটোরিকশার ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষার শব্দে। মাথায় মেহেন্দির লাল আভা, গলায় হাতে সোনার হলুদ চেইনওয়ালা ড্রাইভার মুখ বার করে, রাস্তায় পানের পিক ফেলে, কমলিকার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, যাবেন নাকি?
কমলিকা ঘাড় নাড়লো। এখনো শুভমের ছুটি হয়নি। যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে হয়তো তাকে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটা ভেবেছে, সে অটো বা ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছে। ভাবা আস্বাভাবিক নয়। কমলিকা ঘাড় নাড়লো। অটোওয়ালা বিরক্তিভরা মুখে হাতের এক্সিলেটরে চাপ দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, গেলে ভালো করতেন। দেখবেন হয়তো পেছনেই হোন্ডা গাড়ি নিয়ে শারাফত সাহেব আসছেন, আপনাকে লিফট দেওয়ার জন্য।
অসহ্য কটূক্তি, কদর্য ইঙ্গিত। কিছুদিন আগে, পার্ক স্ট্রিটের এক হোটেল থেকে বেরোনো একা একজন মহিলাকে লিফট দেওয়ার নাম করে গাড়িতে উঠিয়ে কয়েকজন যুবক তার মর্যাদাহানি করে। সেই নিয়ে কলকাতা তোলপাড়। বেশিরভাগ কলকাতাবাসী অত রাতে পার্ক স্ট্রিটের হোটেলে যাওয়া মহিলার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। যেন একা মহিলা বলে তাকে নিয়ে যা ইচ্ছে করার অধিকার সবার থাকে। কমলিকার কান লাল হয়ে ওঠে। মুখে আগুনের হালকা আভা বোধ করে। অটো ড্রাইভার ওই বিশ্রী ঘটনাটার ইঙ্গিত করেছে। কমলিকার সঙ্গে ওইরকম ঘটনা ঘটার কুৎসিত সম্ভাবনার কথা বলেছে। কমলিকার দুচোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে নোনা অশ্রুর জোয়ারে। কলকাতার লোকগুলো কী বিশ্রী! সামান্য সহবত, শিষ্টাচার জানে না। মানুষকে সম্মান দিতে পারে না। কী সহজে, কত সামান্য প্রচেষ্টায়, তাদের আচরণ, কথা আর ব্যবহার দিয়ে এরা একজন মানুষের একটা সুন্দর দিন নষ্ট করে দিতে পারে। ব্যথায় মন ভরিয়ে দিতে পারে। সে কি ভুল করলো যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে? হঠকারিতা হলো কী, অতীশের থেকে দূরে থাকবে বলে কলকাতায় চলে আসা?
স্কুল ছুটির ঘণ্টা শোনা যাচ্ছে। আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। শুভম নিশ্চয়ই এতক্ষণে গেটের কাছে ছুটে এসে পৌঁছেছে মায়ের জন্য।
দুই
গঙ্গা এখানে একটু কম খরস্রোতা। হিমালয় থেকে নেমে এসে গঙ্গা এখানে প্রথম সমতলে পা রাখি রাখি করছে। যেন চপল বালিকার কৈশোরে প্রবেশ। অকারণে হাসি এখনো কমেনি, তবে প্রয়োজনে গাম্ভীর্যের মুখোশও ধরতে পারে। নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে, এই জায়গাটায় হঠাৎ চওড়া হয়ে যাওয়া, আপাত শান্ত গঙ্গার এই রূপটা দেখে কমলিকার সেই রকমই মনে হচ্ছে। গঙ্গা যেন কিশোরী এখানে। অথচ গতকাল দুকিলোমিটার উজানে যে-জায়গাটায় জিপ লাইনিং করতে গিয়েছিল, সেখানে নদী অনেক বেশি খরস্রোতা। বড় বড় বোল্ডারে ধাক্কা খেয়ে রুপালি জল আকাশের দিকে লাফিয়ে উঠছিল। রোলার থেকে ঝুলে নদী পারাপারের সময় মাঝে মাঝে সেই সুশীতল জল কমলিকার পা ছুঁয়েছে। স্বপ্নের মতো সেই অনুভূতি। একটু যে ভয় হয়নি প্রথমদিকে তা নয়। তবে ট্রেনের ভদ্রলোক প্রথম থেকেই বেশি রিস্ক নিতে দেননি। দলের বেশিরভাগই প্রথম জিপ লাইনিং করছে বলে, ট্যান্ডেম রাইডের ব্যবস্থা করেছিলেন। একটা রোলার থেকে দুজন ঝুলন্ত মানুষের নদী পারাপার। কমলিকার সঙ্গী হয়েছিল শুভঙ্কর। তারই মতো, সেও এই মাসে একই সর্বভারতীয় আইটি কোম্পানির সল্টলেক সেক্টর ফাইভের অফিসে জয়েন করেছে। কোম্পানি অন বোর্ড ট্রেনিংয়ের টিম বিল্ডিং প্র্যাকটিস মডিউলের জন্য, একদল ছেলেমেয়েকে হৃষিকেশ পাঠিয়েছে। চারদিনের সেই ট্রেনিংয়ের আজই শেষ দিন। বিকেলে হৃষিকেশ ছেড়ে সন্ধেবেলায় দিল্লি থেকে প্লেনে কলকাতায় ফিরে যাওয়া। আজ তাই একটু ভোরেই উঠেছে কমলিকা। ইচ্ছে গঙ্গার ধার দিয়ে একটু হাঁটা। গঙ্গার সঙ্গে নতুন হওয়া সখ্যটা যাওয়ার আগে একটু মজবুত করে গড়ে-পিটে নেওয়া। একটা বড় পাথরে বসে নদীর জলে পা ডুবিয়ে, আর পাথরে ধাক্কা খাওয়া জলের ফেনায় মুখ ভিজিয়ে, মনে মনে গঙ্গার সঙ্গে কথা বলছিল কমলিকা। আবার ফিরে আসার অঙ্গীকার ভুলে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি। পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়া একটা পাথরের আওয়াজে হুশ ফিরলো, পেছন ফিরে তাকালো কমলিকা। ওপরে নদীর পাড়ে ট্র্যাকস্যুট আর ফ্লিশের জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়ে শুভঙ্কর। হেসে বললো, আপনিও বুঝি সকালের ঠান্ডা হাওয়া খেতে গঙ্গার ধারে বেড়াতে এসেছেন? কতক্ষণ?
কমলিকা হাত নেড়ে বললো, এই কিছুক্ষণ, আয় বোস এখানে। শুভঙ্কর ছেলেটা বেশ হাসিখুশি। কিন্তু মোটেও চ্যাংড়া ধরনের নয়। বেশ কিছুদিন আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করলেও অন্যদের মতো দেখনদারি নেই। কথায় কথায় লেটেস্ট মডেলের আইফোন কেনার বা লাস্ট নাইটের দামি বারে যাওয়ার গল্প করে না। হঠাৎ হঠাৎ একটা কবিতার লাইন বা পুরনো দিনের গানের দু-এক কলি গেয়ে দিতে পারে। এখনকার ছেলেদের মতো একদমই নয়। অফিসের কথা, ভবিষ্যতের কথা বলছিলো দুজনে। অজানা কর্মজীবনের অনিশ্চয়তার কথা, না-জানা আশঙ্কার কথা।
শুভঙ্কর কমলিকার থেকে পাঁচ বছরের ছোট হলেও বেশ কিছুদিন কাজ করেছে ইন্ডাস্ট্রিতে। এ-ধরনের চাকরি কমলিকার নতুন। আমেরিকায় থাকতে কাজ করার প্রয়োজন হয়নি কোনোদিন। মাঝে মাঝে বাড়িতে একা একা ভালো না লাগার অভিযোগ তুলে চাকরি করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেও অতীশ কখনো কানে তোলেনি সেসব কথা। তখন তাদের মধ্যে ভালোবাসা ছিলো। অতীশ তাকে সুখে থাকতে দেখতে চেয়েছিল।
তিন
সুখে থাকার চাবিকাঠি কি শুধুই টাকা-পয়সা আর বাড়ি-গাড়ি? পরস্পরের সান্নিধ্য, সাহচর্য, ভালোবাসা বিনিময়ের কি কোনো প্রয়োজন নেই? লস অ্যাঞ্জেলেসের অদূরে, সান বারনাডিনোর ফুট হিলসের এই বাড়িতে, অতীশ যখন কমলিকার চোখ হাত দিয়ে বন্ধ করে এনে, তার সাম্প্রতিক সারপ্রাইজ গিফট কমলিকাকে দিয়েছিলো, মনে হয়েছিল যেন স্বর্গের নন্দনকাননে এসে ঘর বসিয়েছে তারা। কল্পনার সব প্রত্যাশা ছাড়িয়ে এই বাড়ি, এই জায়গা, চারপাশের দৃশ্যাবলি তার মন ভরিয়ে দিয়েছে। সামনেই সারিবদ্ধ অনুচ্চ সবুজ পাহাড়ের চূড়া, আবার এক-দেড় ঘণ্টার ড্রাইভের মধ্যেই প্রশান্ত মহাসাগরের সমুদ্রতট, লাগুনা বিচ।
পাকা রাস্তা থেকে এক মাইল ধুলোভরা ডার্টরোড ধরে তাদের বাড়ি পৌঁছানোর মধ্যেও কী ভীষণ একটা ভালোলাগা বোধ করতো কমলিকা। হাজারবার, এই পথে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি এলেও কখনো পুরনো মনে হয়নি। বাড়ির দেড় একর জায়গায় দাঁড়িয়েছিল বেশ কিছু আভোকাডো গাছ, ভ্যালেন্সিয়া লেবুর গাছ। কলকাতা থেকে লুকিয়ে নিয়ে আসা গন্ধরাজ লেবুর চারা, জুঁই ফুলের চারা কিছুদিনের মধ্যেই তরতর করে বেড়ে উঠে দিয়েছে সুগন্ধি ফল ও ফুল। দেশের বাইরে নিজের মতো করে এক চিলতে দেশ গড়তে চেয়েছিলো কমলিকা, তাদের দেড় একরের মানচিত্রে। বড় যত্ন করে বাড়ি সাজিয়েছিল নিজের মনের মতো করে। বাছাই করা পর্দা, ল্যাম্পশেড, সোফা, লাভশিট, ডাইনিং টেবিল সেট কিনেছে পছন্দসই দোকান থেকে। তার সঙ্গে দেশ থেকে আনা পুরুলিয়ার ছোউ নাচের মুখোশ, মঞ্জুসার শোলার তৈরি দুর্গার মূর্তি, মধ্য প্রদেশের ডোকরার ভাস্কর্য। বাড়ি নিয়ে তার পাগলামির শেষ ছিলো না। ঘরবাড়ি যাতে একঘেয়ে পুরনো না মনে হয়, তাই প্রায়দিন বাড়ির আসবাবপত্রের স্থান পরিবর্তন করে একটু-আধটু সাজ পালটে দিতো সে। অতীশকে অবাক করে দেবে বলে এসব করে, স্নান সেরে, সাজগোজ করে, পশ্চিমের বারান্দায় বেতের সোফায় বসে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে অতীশের জন্য অপেক্ষা করতো সে। প্রথম প্রথম অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে সেসব দেখে হইচই বাধিয়ে দিতো অতীশ। তারপর আস্তে আস্তে অফিসে তার পদোন্নতি হলো, দায়িত্ব বাড়ল, অর্থ-প্রতিপত্তি বাড়লো আর তার সঙ্গে তাল দিয়ে বাড়ল দেরি করে, রাত করে বাড়ি ফেরা। ততদিনে শুভম এসে গেছে। কতদিন শুভমকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে দিতে ওর পাশেই ঘুমিয়ে পড়েছে কমলিকা। অতীশ অফিস থেকে ফিরে ওকে ডাকেনি। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে নিজের মতো। এ নিয়ে বললেই অতীশ বলেছে, সে ক্লান্ত ছিলো। বুঝতে চায়নি তার জন্য অপেক্ষা করে করে কমলিকাও কতখানি ক্লান্ত।
আর কিছু চায়নি কমলিকা অতীশের কাছে। শুধু একটু সময়, খানিক সঙ্গ আর সাহচর্য। কমলিকা আমুদে, হইচই ভালোবাসে। জীবনটা হালকাভাবে হেসেখেলে সহজভাবে উপভোগ করে কাটিয়ে দিতে চায়। ওর এই গুণগুলোর জন্যই একদিন অতীশ কমলিকার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছিল। ইউনিভার্সিটির সেই দিনগুলোতে, ওই আপাতমূল্যহীন, সরল হইচই আর হুল্লোড়পনার জন্যই, কম্পিউটার সায়েন্সের মাস্টারস ডিগ্রির ছাত্র ক্লাস পালিয়ে কমলিকার সঙ্গ উপভোগ করতে এসেছে কতদিন। প্রাথমিক ভালোলাগা, মুগ্ধতা কবে যে একদিন ভালোবাসার সম্পর্কে উত্তীর্ণ হলো, দুজনের কেউ তা বুঝতে পারেনি। সেই অতীশের এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারেনি সে। প্রথম প্রথম কতদিন কান্নাকাটি আর অভিমান করেছে। শেষে সহ্য করতে না পেরে একদিন চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে। অতীশের থেকে মুক্তি চায় সে। জীবনটাকে নিজের মতো করে, নিজের শর্তে বাঁচতে চায় সে আবার নতুন করে। হয়তো আরেকটু সহনশীল হওয়া উচিত ছিল তার। কলেজের দিনগুলো তো আর সারাজীবনের জন্য নয়। দাম্পত্য মানেই যে কম্প্রোমাইজ, সে কি তা বোঝে না। কিন্তু অতীশেরও কি কিছুটা কম্প্রোমাইজ করা উচিত ছিলো না! সমস্ত মানিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব কি শুধু কমলিকার একার। নিজের ইচ্ছা-সম্মান বন্ধক রেখে, মেকি সাজানো সুখের সংসার করতে মন আর সায় দেয়নি। অতীশের কাছে ডিভোর্স চায় সে। সম্পত্তি খোরপোশের আশা করেনি সে। শুধু চেয়েছে শুভমের অধিকার পেতে। আদালতে অতীশের অন্য রূপ দেখে সে অবাক হয়ে গেছে। শুভমকে নিজের কাছে রাখার দাবি মজবুত করতে পাগল প্রমাণ করার চেষ্টা অবধি করতে চেয়েছিল লোরেটো গার্লস, লেডি ব্রাবোর্ন, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ছাত্রী কমলিকাকে। বাবা নামি মার্কেন্টাইল কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতায় পড়তে আসা চা বাগানের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ছেলে অতীশের সঙ্গে বিয়েতে বাড়ির সবাই আপত্তি তুলেছিল। বাবার ঘোরতর অমত ছিল বিয়েতে। সকলের মতের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে সে অতীশকে বিয়ে করেছে, শুধু তাদের সম্পর্কটাকে বিশ্বাস করে। আজ সেই সম্পর্কের এ-পরিণতি কমলিকা মেনে নিতে পারেনি। তাই ডিভোর্সের মামলা শেষ হতেই শুভমকে নিয়ে অতীশের থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে কলকাতায় চলে এসেছে। কিছু শুভানুধ্যায়ী তারও ছিল, যাদের সাক্ষ্য-বিচারে তাকে শুভমকে পেতে সাহায্য করেছে। সাম্প্রতিক খবরে শোনা নরওয়ে প্রবাসী সেই বাঙালি ভদ্রমহিলার মতো নিদারুণ ভাগ্য অন্তত তার হয়নি। সন্তানের দেখভাল করার দায়িত্বহীনতার কারণ দেখিয়ে তার ছেলেকে যখন নরওয়ে সরকার জাতীয় হেফাজতে নিয়ে নেয়, সেই মহিলার স্বামীও ছেলেকে নিজের কাছে পেতে নিজের স্ত্রীর মানসিকতার স্বাভাবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ডিভোর্স চায়। ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে বয়ে চলেছে তাতে হয়তো ভদ্রমহিলা তার সন্তানকে নিজের কাছে পাবেন না। প্রেমের, বিশ্বাসের এই পরিণতি কমলিকার হৃদয়কে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।
প্রেমহীন প্রিয়জন-সান্নিধ্যহীন এই আপসকামী জীবন আর টেনে নিয়ে চলার আর্তি বোধ করেনি সে মনের ভেতর থেকে। অজানা ভবিষ্যতের অন্ধকারে একলা ঝাঁপ দিয়েছে সে, শুধু অতীতের হানা দেওয়া দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে।
শুভমকে নিয়ে নিঃসঙ্গ কমলিকা যখন নতুন করে জীবন শুরু করার অঙ্গীকার নিয়ে কলকাতায় এসে পৌঁছল, তখন সে আক্ষরিক অর্থেই সম্বলহীন। হাতে থাকার মতো শুধু সদ্য উপার্জিত আমেরিকান ইউনিভার্সিটির একটা মাস্টারস ডিগ্রি, অতীশের সঙ্গে দুর্বিষহ শেষ দুবছর থাকার সময় বাস্তবকে ভুলে থাকতে অনলাইন কোর্স করে যা সে সংগ্রহ করেছে।
চার
নিউটাউন রাজারহাটের এই জায়গাটাকে একেবারেই কলকাতা বলে মনে হয় না। সুদীর্ঘ সরল, চওড়া চওড়া অ্যাসফল্টের রাস্তা, মাঝখানে ডিভাইডারে কেয়ারি করা ফুল, গাছপালা আর সুদৃশ্য লাইটপোস্ট। দুপাশে সমান্তরালে চলা ফ্রন্টেজ রোড-সাইকেল আর ছোট গাড়ির জন্য। দিগন্তে উঁচু উঁচু গ্লাস আর স্টিলের অফিসবাড়ি, বিরাট হাইরাইজ অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স দেখে জায়গাটা কেমন বিদেশ বিদেশ মনে হচ্ছিল কমলিকার। প্রায় একযুগ সে দেশের বাইরে কাটিয়েছে। আর সেই সময়টায় কলকাতা যেন তার পঞ্চাশ বছরের সুদীর্ঘ ঘুম থেকে উঠে গা-ঝাড়া দিয়ে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের দৌড়ে যোগ দিতে দেরি করে হলেও একটা প্রচেষ্টা শুরু করেছে। সেটা ভালো না মন্দ, তা বোঝার সময় হয়তো এখনো আসেনি।
পনেরো তলা উঁচুতে শুভঙ্করের এই অ্যাপার্টমেন্টটাও খুব সুন্দর। শীতের প্রায় শেষ। নীল আকাশে সাদা সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘেরা আলসেমিভরা ভঙ্গিমায় ভেসে চলেছে, যেন কোনো তাড়া নেই কোথাও যাওয়ার। উন্মুক্ত বিরাট কাচের জানালা দিয়ে কমলিকা দমদমের দিকে নামতে যাওয়া আর উড়ে আসা প্লেন দেখছিলো একমনে। এসব প্লেনে কত মানুষ আজ প্রথম কোথাও যাচ্ছে – তাদের চেনা গন্ডির, চেনা শহরের, দেশের পরিচিতির বাইরে। নতুন জীবন, নতুন আশার সন্ধানে ঠিক যেমন অতীশের কাছে কমলিকা গিয়েছিল একদিন।
সম্বিৎ ফিরল মাসিমার ডাকে। চলো খাবার দেওয়া হয়েছে, এই শুভ তোর হলো? বললেন মাসিমা। শুভঙ্কর জোরাজুরি করে আজ কমলিকাকে তাদের বাড়ি নেমন্তন্ন করে এনেছে, মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে বলে। কমলিকা আসতে চায়নি। কিন্তু শুভঙ্করের ছেলেমানুষি আবদারের কাছে তার আপত্তি টিকল না। শেষ পর্যন্ত আসতেই হলো। মাসিমা অনেক রেঁধেছেন, মোচার ঘণ্ট, লাউ, কচুশাক, মাছের মুইঠ্যা, আরো কত কী। দেশ ছাড়ার পর এসব খাবারের কথা স্মৃতি থেকে ফিকে হয়ে এসেছিল। ছেলেবেলায়ও এরকম খাবার খুব কমই খেয়েছে কমলিকা। বাবার ছিলো সাহেবি মানসিকতা। ভালো খাবার মানেই পার্ক স্ট্রিটের কোনো ওয়েস্টার্ন বা চায়নিজ রেস্টুরেন্ট। এই দেখেই বড় হয়েছে সে। শুভঙ্করের কাছে শুনেছে, একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার বাবা-মা এদেশে চলে আসেন। বনগাঁর দিকে, অশোকনগরের কলোনিতে কেটেছে ওর ছেলেবেলা। পড়াশোনায় ভালো ছিলো বলে, কিছুটা সংগ্রাম করতে হলেও শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যায় ছেলেটা। এই নতুন অ্যাপার্টমেন্টটায় বছরখানেক হলো উঠে এসেছে বিধবা মাকে নিয়ে সল্টলেকের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে।
তাদের আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারছিল না কমলিকা। অনেকদিন এমন যত্ন করে তাকে কেউ খাবার সাজিয়ে দেয়নি। মাসিমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর কে কে আছেন তোমার বাড়িতে?’ এক ছেলে শুনে বললেন, ‘আর স্বামী কী করে?’ কমলিকাকে চুপ থাকতে দেখে শুভঙ্করই বললো, ‘ওর ছেলেই ওর সব মা।’ মাসিমার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল না, তিনি এর কী অর্থ করলেন। আজকাল এদেশেও নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদের কথা প্রায়ই শোনা যায়। মাসিমার প্রজন্মের মানুষেরা তার খবর কতটা রাখে, কমলিকার জানা নেই। তাছাড়া তার মতো অফিসের সহকর্মী একজন মেয়েকে ছেলের বাড়িতে নেমন্তন্ন করে ডেকে আনায় তিনি কী ভাবছেন, তাও কমলিকার জানা নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনার জন্য সে তার পুরনো দিনের আমুদে মেজাজে বললো, ‘শুভঙ্করের একটা বিয়ে দিচ্ছেন না কেন মাসিমা? এত সুন্দর বাড়ি, ভালো চাকরি আর কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন?’ এরকম প্রশ্ন বোধহয় তিনি আগেও অনেক শুনেছেন। গড়গড় করে বলতে লাগলেন, কীভাবে কলেজের দিনগুলো থেকে বেড়ে ওঠা শুভঙ্করের একটা সম্পর্ক একদিন হঠাৎ করে ভেঙে গেল। কীভাবে কল্পনারও বাইরে তার অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী বান্ধবী একদিন শুভঙ্করের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক মিটিয়ে দিয়ে চলে গেল তার নিজের অফিসের বসের সঙ্গে ঘর বাঁধতে, মাসিমা তার বর্ণনা দিয়ে গেলেন শুভঙ্করের আপত্তি সত্ত্বেও। ছেলের অসহায় মৃদু প্রতিবাদ মায়ের জমে থাকা দুঃখ স্রোতের কাছে ভেসে গেল খড়কুটোর মতো। বাড়ি ফিরতে ফিরতে কমলিকার মনে হচ্ছিল, লড়াইটা সে শুধু একলাই করছে না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে হয়তো সবারই নিজস্ব একটা কষ্ট, একান্তে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা লড়াই আছে। বাইরে থেকে তা সবসময় হয়তো বোঝা যায় না। কলকাতা শহরের দৃশ্যমান বহির্জীবনের চলমান সংগ্রামের স্রোতের মধ্যেও কেউ কেউ নিজের অন্তর্বেদনা ঢেকে রেখে, নিজস্ব আরো একটা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়েই। যেমন শুভঙ্কর।
পাঁচ
কদিন ধরে শুভঙ্করকে দেখা যায়নি। ওর সুন্দর ব্যবহার, অন্যের জন্য ওর চিন্তা, অন্যকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ওর সহজাত অভ্যাস, রোজ রোজ দেখা হলে আলাদা করে উপলব্ধি করা যায় না। এই কদিন দেখা না পেয়ে, ওর অনুপস্থিতি কমলিকা যেন একটু বেশিই অনুভব করছে।
অবাক লাগছে ভেবে, কেন সামান্য হলেও একটু যেন বিষণ্ণ বোধ করছে শুভঙ্কর না থাকায়। পরশু ফোন করার সময় মাসিমা ফোন তুলেছিলেন বাড়িতে। বললেন, ওর নাকি ঠান্ডা লেগে অল্প জ্বরজ্বারি হয়েছে। শীত যাই-যাই করে, বসন্ত আসার তোড়জোড় চলছে কলকাতার বাতাসে। ফেব্রুয়ারির শেষে এই সময়টায় এমন ঠান্ডা লেগে যাওয়া কিছু আশ্চর্যের নয়। কদিন ধরে অফিসে খুব কাজের চাপ চলছে। আমেরিকায় একটা নতুন ক্লায়েন্ট ধরার জন্য কোম্পানি নেগোশিয়েট করার চেষ্টা করছে খুব। আমেরিকায় থাকায় আর ওদের কালচার পরিচিতির অভিজ্ঞতার জন্য ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে ওকে সঙ্গে রেখেছে বস। সেসব ভিডিও কনফারেন্স মিটিং শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কদিন খুব রাত হয়ে গেছে। আজ সকালবেলায় কমলিকা তাই এত ক্লান্তি বোধ করছে। শুভমটাও সন্ধেবেলা মাকে কাছে না পেয়ে একটু অভিমানী হয়েছে আজকাল। সন্ধেবেলাটা তাকে দিদার বাড়িতে একলা থাকতে হয়েছে। আগে কখনো-সখনো সন্ধেবেলায় মাঝে মাঝে অফিস-ফেরত শুভঙ্কর এসেছে ওদের বাড়ি। শুভমের সঙ্গে মজার মজার সব খেলা হয়েছে ওদের। শুভঙ্করের ছোটদের সঙ্গে ছেলেমানুষ হয়ে যাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতার জন্য আর ওর নামের সঙ্গে নিজের নামের মিল খুঁজে পেয়ে শুভম খুব সহজেই ওর বন্ধু হয়ে গেছে। এক সপ্তাহ শুভঙ্করও আর আসে না ওদের বাড়ি, শরীর খারাপ হওয়ায়। আজ তাই কমলিকা ভাবছিল, সন্ধে হলে ছেলেকে নিয়ে কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে অথবা নিদেনপক্ষে তার মাসতুতো বোনের বাড়ি। এই একঘেয়েমির একটা পরিবর্তন দরকার, সামান্য হলেও আজ একটু অন্যরকমভাবে সময় কাটাবে সে গতানুগতিকতা ছেড়ে।
ওয়াটার বটলটায় জল ভরে নিজের কিউবিকলে ফিরতেই দেখা শুভঙ্করের সঙ্গে। টেবিলের পাশে রাখা এক্সট্রা চেয়ারটায় এতক্ষণ বসেছিলো সে। কমলিকাকে দেখেই দাঁড়িয়ে উঠে বললো, ‘চলুন সিটি সেন্টারে যাই কফি খেতে। এখন তো প্রায় লাঞ্চটাইম, কেউ খেয়াল করবে না।’ ‘কখন এলি, এখন কেমন আছিস’, অবাক হয়ে বললো কমলিকা। ‘এতদিন শরীর খারাপ হয়ে বিছানায় পড়েছিলি, আগে একটু বোস।’ ওর কথার জবাব না দিয়ে প্রায় টানতে টানতে কমলিকাকে লিফটের ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে পার্কিং লেভেলের বোতাম টিপে দিলো শুভঙ্কর।
বারিস্তা কফিশপের ভেতরে এক কোনার দিকের টেবিলে বসলো দুজনে। অনাদরে বেড়ে ওঠা গোঁফদাড়ি, ঝাঁকড়া চুলের একটা ছেলে গিটার বাজিয়ে গান করে যাচ্ছিল আপনমনে। বাংলা ব্যান্ডের গান, নিজের লেখা গান। দেখে মনে হয় কলেজের ছাত্র, হয়তো সে নিজেও কাস্টমার একজন এই কফিশপের। ঝকঝকে পোশাকের উজ্জ্বল কিছু ছেলেমেয়ে কফি বানানো এবং সার্ভ করার জন্য হালকা পায়ে দ্রুত ছুটে বেড়াচ্ছিল এ-টেবিল থেকে ও-টেবিল। তার মাঝেই একটু দাঁড়িয়ে নেওয়া, পুরনো চেনা কোনো কাস্টমারের গায়ে হালকা ঠেলা দিয়ে মজার কোনো কথা ভাগাভাগি করে নেওয়া, হাসিতে গড়িয়ে পড়া। দেখতে মন্দ লাগছিলো না। কমলিকার ছেলেবেলায় কলেজ স্ট্রিট আর যাদবপুরের ইন্ডিয়ান কফি হাউস ছাড়া আর কোনো কফি হাউস ছিল না। তার পরিবেশ, আর এই উজ্জ্বল রঙে সাজানো আধুনিক কফি হাউসের আবহাওয়ার মধ্যে কোনো মিল নেই। কমলিকা ভাবছিল, এখনকার ছেলেমেয়েরা কত সহজেই কত কিছু পেয়ে যাচ্ছে জীবনে। সেসবের মূল্য কি তারা বুঝতে পারে? শুভঙ্কর আজ একটু চুপচাপ, মুখখানা অল্প বিষণ্ণ। কমলিকার চেনা রোজকার শুভঙ্করের থেকে একটু যেন আলাদা। সদ্য তৈরি এক পট কফি রেখে গেছে বারিস্তার মেয়েটি। তাজা ব্রু করা কফির গন্ধ আর উষ্ণতা অনুভব করছিলো কমলিকা তার স্নায়ুতন্ত্রীতে। তারা দুজনেই কেউ ব্ল্যাক কফি খায় না। টেবিলের একপাশে ক্রিম আর চিনিও রাখা আছে। কিন্তু শুভঙ্করের কী যেন কেন আজ কফি বানানোয় মন নেই। চামচের উলটোদিক দিয়ে টেবিলের ওপর পাতা সাদা কাগজটায় অাঁকিবুঁকি কাটা থামিয়ে একসময় সে বলে ওঠে, ‘কমলিকা আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।’ এই নৈঃশব্দ্য কমলিকার ভালো লাগছে না একদম। নৈঃশব্দ্য-বরফ ভাঙানোর জন্য তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘কী কথা?’ শুভঙ্কর একটু থেমে একটা ছোট নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘কদিন ধরেই তোমাকে কথাটা বলব ভাবছিলাম। কিন্তু কীভাবে কোথায় বললে তোমার কোনো আঘাত লাগবে না, ভেবে পাচ্ছিলাম না। এই কদিনে তোমায় যতটুকু দেখেছি, তোমার আমার চিন্তাভাবনা মানসিকতা, রুচিতে, জীবনছন্দে কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পেয়েছি। কমলিকা বেশি কিছু চাইবো না। বাকি পথটুকু একসঙ্গে পাড়ি দেওয়ার জন্যে, আমি কি তোমায় জীবনের পথে চলার সঙ্গী হিসেবে পেতে পারি?’ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু দম নিলো শুভঙ্কর। এমন যে কিছু একটা বলে বসতে পারে শুভঙ্কর কোনো একদিন, এমন আশঙ্কা মাঝে মাঝে কমলিকা যে করেনি, তা নয়। কিন্তু তা যে এত তাড়াতাড়ি, আজই, এইখানে, কমলিকা তা কল্পনা করেনি। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। বাকি জীবন চলার জন্যে, কী করা উচিত, এখনো ভেবে উঠতে পারেনি সে। কমলিকাকে নিঃশব্দে বসে থাকতে দেখে ব্যাকুল হয়ে শুভঙ্কর বলে ওঠে, ‘তোমাকে হারাতে চাই না আমি কিছুতেই, অন্তত বন্ধু হিসেবেও তোমার পাশে থাকতে চাই আমি। চিরাচরিত প্রথাগত সম্পর্কের সঙ্গে জড়ানো চাহিদাগুলোর কিছুই করব না আমি। শুধু তোমার পাশে পাশে আমাকে একটু চলতে দিও কমলিকা।’ শুভঙ্করের কণ্ঠস্বরের আর্তি আর ব্যাকুলতায় মন কেমন করে ওঠে কমলিকার। কী বলবে সে জানে না, কোন সম্পর্কের আশা সে দেবে শুভঙ্করকে, তাও তার জানা নেই এ-মুহূর্তে। সে শুধু দেখেছে শুভঙ্করের উদ্বেগ, তাকে হারানোর আশঙ্কাজনিত বিষণ্ণতা। আজ শুভঙ্কর প্রথম তাকে আপনি থেকে তুমি বলে সম্বোধন করেছে। এসব কি শুধুই তাকে একজন সাধারণ বন্ধু হিসেবে পাওয়ার জন্য? আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কমলিকা শুধু বলে, ‘তুমি কি আমায় একটু সময় দিতে পারো শুভঙ্কর?’ শুভঙ্কর সামান্য মাথা নেড়ে একটু করুণ হেসে তাড়াতাড়ি একটা কাপ টেনে নিয়ে কমলিকার জন্য কফি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। যেন এই পরিস্থিতিটা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে এমনই একটা মুহূর্তের অপেক্ষা করছিলো সে। তার আচরণ দেখে কমলিকা বুঝতে পারছে, অনেকদিন ধরে একটু একটু করে এই মুহূর্তটার জন্যে সাহস সঞ্চয় করেছে সে, প্রস্ত্ততি নিয়েছে। এখন সব শেষ। পরিণতি কী হবে তা তার জানা নেই। শুভঙ্করের জন্য মায়া হচ্ছিলো কমলিকার। তার দিকে বাড়ানো কফি কাপটা নিয়ে চুমুক দিতে গিয়ে দেখলো স্যুট-প্যান্টপরা মধ্যবয়সী একজন ভদ্রলোক, শুভঙ্করের দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাসিমুখে তাকিয়ে রয়েছে। ‘তারপর শুভঙ্কর, কী খবর? কতদিন পরে দেখা বলো?’ শুভঙ্কর আলাপ করিয়ে দিলো ভদ্রলোকের সঙ্গে। পুরনো অফিসের বস। আগের অফিসের দু-চার কথার পর শুভঙ্করের দিকে সামান্য হেলে ফিসফিস করে, অথচ কমলিকা যেন শুনতে পায় এমন করে, ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘গার্লফ্রেন্ড নাকি?’ শুভঙ্কর এমনিতেই মরমে মরে ছিলো। খসখসে উদাস কণ্ঠে খানিকটা দার্শনিকভাবে বললো, ‘পথের সাথি মি. দত্ত হয়তো তাই, নয়তো তাও না, ঠিক জানা নেই।’ মি. দত্ত, এমন উত্তর আশা করেননি। তবে জীবনে অভিজ্ঞতার ঝুলি তারও কিছু কম নয়। প্রাথমিক হকচকিত ভাবটা দ্রুত কাটিয়ে নিয়ে মুখে একটা ভাব করলেন, যেন এমন কথা আগেও অনেক শুনেছেন। চোখ কুঁচকে, ভ্রুভঙ্গিমায় আমুদে রেশ টেনে বললেন, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, এনজয়।’ বলেই হাসি-হাসি মুখে হনহন করে দোকানের বাইরে হাঁটা দিলেন। কমলিকা ভাবছিল, এরকম মানুষ সে আগেও অনেক দেখেছে। জগৎটাকে এরা স্রেফ সাদা-কালোর হিসাবে দেখে। সাদা-কালোর মধ্যে যে একটা বিস্তীর্ণ ধূসর প্রান্তর পড়ে আছে, তা এদের চোখে ধরা পড়ে না। কমলিকার হঠাৎ কেন জানি ভীষণ মজা লাগলো। অল্প হেসে বলল, ‘তাড়াতাড়ি কফি শেষ করো। অফিসে ফিরতে হবে না বুঝি।’
শুভঙ্কর তার কফিটা একটু বেশিই মিষ্টি করে ফেলেছে। এত মিষ্টি সে খায় না। তবু এ নিয়ে কিছু বললো না আজ। তার মধ্য থেকে কে যেন বলে উঠলো, জীবন মানেই কম্প্রোমাইজ, জীবন মানেই মানিয়ে চলা।
ছয়
আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়লো কমলিকা। এ সপ্তাহটায় বড্ড ধকল গেছে। রোজ লেটনাইট মিটিং, শুভমের রোজ সন্ধেবেলায় মাকে কাছে না পাওয়া। মনটা একটু খচখচ করছিলো। এই উইকেন্ডটার দিকে সাগ্রহে তাকিয়েছিল সে। আজ শুভমকে একটা ট্রিট দিতে হবে, তার অভিমান ভোলানোর জন্য। ভাগ্যিস অফিসের সামনে থেকেই একটা শেয়ারের ট্যাক্সি পেয়ে গিয়েছিলো বেরোতে না বেরোতেই। তাই রুবি হসপিটালের কাছেই এম বাইপাসের স্কুলে পৌঁছে গেলো ছুটি হওয়ার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে। ছেলেকে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আবার বিস্ময়। কী আশ্চর্য, ধাঁ করে কোথা থেকে একটা অটো এসে দাঁড়ালো সামনে। যাবেন নাকি দিদি? আমি আনোয়ার শাহ কানেক্টরের দিকে গাড়ি গ্যারেজ করতে যাচ্ছি’, হাসিমুখে জানালো মধ্যবয়সী ড্রাইভারটি। ছেলেকে নিয়ে উঠে বসতে না বসতেই হুহু করে গাড়ি ছুটিয়ে দিলো ড্রাইভার। মাত্র দুজন যাত্রী তারা। পরপর তিনটে বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে গেলো গাড়ি, একটুও স্পিড না কমিয়ে। কমলিকা অবাক, একটু অস্বস্তিও যে না হচ্ছে, তা নয়। জিজ্ঞাসা করলো, ‘ভাই, আপনি আর প্যাসেঞ্জার তুলবেন না?’
না দিদি, গাড়ি গ্যারাজ করেই ছেলেকে স্কুল থেকে তুলতে হবে। কাল ওর যাদবপুর বিদ্যাপীঠে অ্যাডমিশন টেস্ট। মা-বাবার, মানে আমাদেরও নাকি ইন্টারভিউ নেবে বলেছে। আজ আমার তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরা দরকার। মালিক মানতে চায় না দিদি। অটো চালাই বলে কি আমাদের পরিবার থাকতে নেই? ছেলেটার পড়াশোনায় মাথাটা ভালো। একটা ভালো স্কুলে চান্স পাওয়ার জন্যে অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছি। মানসিক প্রস্ত্ততি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে? ঠিক কি না, আপনিই বলুন? একদিন আগে গাড়ি গ্যারাজ করলে কী এমন হয় বলুন?
কমলিকার থেকে একটা সাপোর্ট চাইছিল লোকটা। এই লোকটাও তার নিজের মতো একটা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, ছেলেকে জীবনে দাঁড় করানোর। তার মতো সাচ্ছল্যহীনতা, দারিদ্র্য আর অনিশ্চয়তার বৃত্ত থেকে সন্তানকে মুক্তি দেওয়ার। কমলিকার ভালো লাগলো কথাগুলো। বলল, ‘নিশ্চয়ই ভাই, পরিবার নিশ্চয়ই সবার আগে। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।’
সাত
বাইপাস ছেড়ে আনোয়ার শাহ কানেক্টরে ঢুকে পড়েছে অটো। এই রাস্তাটা বছর ১৫ হলো হয়েছে। এর মধ্যেই দুধারে লাগানো গাছগুলো ঝাঁকড়া হয়ে বেড়ে উঠে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছগুলো ফুলে ফুলে মাথার ওপর আগুনের চাদোয়া বিছিয়ে দিয়েছে যেন। এমন রাস্তাকেই বিদেশে এভিনিউ বলে। এখন বসন্তকাল। কয়েকদিন পরেই দোল। রঙের উৎসব। জীবনের, যৌবনের জয়গাথার উৎসব।
শুভম বললো, মা শুভঙ্কর আঙ্কেল আর আমাদের বাড়িতে আসে না কেন? কমলিকা বললো, শরীর খারাপ হয়েছিল তো তাই আসতে পারেনি বোধহয়। এই তো আবার আসবে দোলের দিন, তোমার সঙ্গে রং খেলতে।
শুভমের বোধহয় ভালো লাগলো কথাটা। হাসি-হাসি মুখে আবদার করে বললো, কাল তো ছুটি, উইকেন্ড। আজকে কিন্তু বাড়ির খাবার খাবো না। কমলিকা আগেই ভেবে রেখেছিলো। বলল, চলো আজ আমরা পিৎজাহাটে যাই। শুভম হইহই করে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, আই লাভ ইউ মম। কমলিকার মনে হলো, শুধু এরকম একটা দুটো মুহূর্তের জন্য জীবনের হাজার ঝড়ঝাপ্টা সওয়া যায়।
শীত চলে গেলেও এখনো তেমন গরম পড়েনি। ছুটন্ত অটোর বাইরে থেকে ধেয়ে আসা হাওয়ায় দারুণ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ। কপালের ওপর থেকে উড়ন্ত দামাল চুলগুলো সরাতে সরাতে কমলিকার মনে হলো, আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর প্রথম প্রথম যেমন খারাপ লাগত, কলকাতাকে এখন আর তেমন লাগছে না। কলকাতার সব মানুষও হয়তো তেমন খারাপ নয়। ভালো লোকও কিছু আছে নিশ্চয়ই। তাদের কয়েকজনের দেখা তো সে নিজেও পেয়েছে। একটা ভালোলাগার আবেশে আর ঠান্ডা হাওয়ার ছোঁয়ায় তার চোখ বুজে এলো। মনে হলো, এ-শহরে আবার নতুন করে শিকড় গাঁথার কথা ভাবা যায়।