বেরুনোর মুখে মায়ের চোখের স্থিরদৃষ্টির মুখোমুখি এক যুগ তাকিয়ে থাকল ইশরাত, অতঃপর মুখ খুলল :
‘আমি তোমাদের সৃষ্টি ঠিকই, তবে ঘটনাচক্রে। সুতরাং আমার ওপর কর্তৃত্ব করতে চেও না।’
‘তার মানে?’
‘মানে তোমাদের চান্স-মিটিংয়ের ফসল আমি – ’
‘তার মানে?’
‘মানেটা গভীর, নিগূঢ় -’
‘তবু আমার জানতে হবে – এত বড় একটা আদেশ দিয়ে ফেললি যখন।’
প্যানপ্যানে মা পেছনে লেগেই পড়েছেন যখন মেয়ের শেষ কথাটা আজ তাঁকে শুনতেই হবে। কুপিতা কন্যার শেষ কথাটি ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত :
‘মানেটা হচ্ছে – তোমাদের দুজনেরই যার যার সঙ্গে প্রেম ছিল তাদের সঙ্গে বিয়ে হলে সে-মিলনের সন্তান আমি হতাম না। সে অর্থে আমি তোমাদের পালিতা কন্যামাত্র। ভালোভাবে পালিতাও নই। তোমার ‘হা পুত্র! হা পুত্র!’-ব্যারামের ঘোরে আমি এক উপেক্ষিতা কন্যামাত্র। অতএব আমার ওপর মালিকানা ফলাতে যেও না।’
‘মালিকানা ফলাতে চাইলে তোকে ওই ঘরটিতে তালাবন্ধ করে রেখে দিতাম, সিনেমার মতো। কিন্তু এখন এটুকু তো অন্তত জানতে হবে – আমরা কখনো জন্মনিয়ন্ত্রণ করিনি, তাহলে তৃতীয় সন্তান তুই আমাদের আকস্মিক মিলনের ফসল হলি কীভাবে?’
‘আকস্মিক, মানে ‘ঘটনাক্রমিক’ আরকি। তোমাদের এই তৃতীয় সন্তানটি কি আমি হতাম? তোমার মিলনটা খালেদ আংকেলের সঙ্গে হলে? কিংবা বোরহান আংকেলের সঙ্গে হলে? যাদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল? বিয়ের সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছিল বলে বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করেছিলে?’
‘অন্যদের সঙ্গে বিয়ের সম্ভাবনা কি শুধু আমার জীবনেই সৃষ্টি হয়েছিল? তোর বাবার জীবনে হয়নি?’
‘হয়েছিল। সেও আমি তোমাদের গল্পগাছা থেকেই জেনেছি – সালমা অ্যান্টির সঙ্গে, রেশমা খালার সঙ্গে।’
‘তবে?’
‘তবেই তো বলছি – সালমা ী বাবার বা রেশমা ী বাবার তৃতীয় সন্তানটি ‘আমি’ ইশরাত হতাম না। অর্ধেক হতাম আমি আর বাকি অর্ধেক হতো সালমা অ্যান্টির তৃতীয় সান এলিজা বা রেশমা খালার তৃতীয় সন্তান ফারিহা। তেমনি হাজেরা ী খালেদ আংকেলের বা হাজেরা ী বোরহান আংকেলের তৃতীয় সন্তান আমি হতাম না। অর্ধেক হতাম আমি আর বাকি অর্ধেক হতো খালেদ আংকেলের তৃতীয় সন্তান রেহানা বা বোরহান আংকেলের তৃতীয় সন্তান বারখা – ’
‘এসব কথার তাৎপর্যটা কী রে? ঠিক কী বলতে চাচ্ছিস তুই ইশরাত?’
‘হুবহু লেবাননের বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর ও কবি খলিল জিবরান বা কাহলিল জিবরান যা বলেছেন তা-ই। বিষয়টির ওপর চমৎকার একটা পরোক্ষ আলোকপাত আছে তাঁর ‘অন চিলড্রেন’ নামক কবিতাটিতে :
Your children are not your children.
They are the sons and daughters of Life’s
longing for itself.
‘আমি কি ইংরেজি পড়ি? না পড়াই। আমি পড়াই বাংলা এবং পড়িও বাংলা -’
‘তাহলে বাংলাতেই বলি। জগজ্জীবনে মনুষ্যের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর এমন আশ্চর্য আলোকপাত আমার পড়াশোনায় আমি আর কোথাও পাইনি। তাই এ মহৎ কবিতাটি আমি নিজেই অনুবাদ করছি, কোথাও ছাপানোর জন্য – যাতে আমাদের জীবনের এই পরম সত্যটি এ-সমাজের যথাসম্ভব বেশি পাঠকের বোধে গিয়ে হানা দেয়। তুমি শুনবে তো মা আমার অনভ্যস্ত অনুবাদ?’
‘না শুনলে তোর ওই কঠিন কথাগুলো আমি বুঝবো কী করে -’
‘তবে শোন :
তোমাদের সন্তানগণ তোমাদের নন।
পুত্র-কন্যা তাঁরা জীবনের নিজেরই ব্যাকুলতার।
তাঁরা আসেন তোমাদের থেকে নয়, তোমাদের তৎপরতাতে,
তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নন তাঁরা, যদিও তোমাদের পরিবারভুক্ত।
তোমরা তোমাদের ভালোবাসা দিতে পার তাঁদের, ভাবনা নয়,
কারণ, তাঁদের আছে নিজস্ব চিন্তা।
তোমরা তাঁদের দেহের নিবাস দিতে পার, অন্তরের নয়,
কারণ তাঁদের অন্তর বসত করে আগামীর ঘরে,
যে-ঘরে অভ্যাগমন তোমরা তোমাদের স্বপ্নেও করতে পার না।
তোমরা আপ্রাণ চেষ্টা করতে পার তাঁদের মতো হতে,
কিন্তু কখনো তোমাদের মতো করতে চেয়ো না তাঁদের।
কারণ জীবন পেছনে চলে না, অধিষ্ঠান করে না গতকালে।
বাকিটা অনুবাদ এখনো হয়নি। কী বুঝলে মা?’
‘কী আর বুঝবো। আমি করি ঘর-সংসার। বুঝিও সংসার আর পরিবার ’
‘না মা, পরিবারও বোঝ না তোমরা। বুঝলে সন্তানদের তোমাদের ভাবতে না।’
‘তোরা আমাদের না?’
‘না।’
‘কবি বলেছেন বলে?’
‘হাঁ। কবি-সাহিত্যিকগণ মৌল সত্যটি সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন। তাই তাঁরা জানেন সন্তানেরা তোমাদের দ্বারা এ-সংসারে আসে বটে। তবে তারা তোমাদের কেউ না, তারা কেবল নিজেদেরই। এই সহজ সত্যটাই উপলব্ধি করতে পার না বলেই তোমরা ভাইয়াদের ওপর এত রাগ কর, তাদের এত ভুল বোঝ। অবশ্য ভুল বোঝার খুব জোর কারণও আছে তোমাদের। জন্ম থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর পর্যন্ত সন্তানদের বুকের ভেতর আগলে রেখে একটা ঘোরের মধ্যে থাক তোমরা। জানতেও পার না কবে থেকে তাদের নিজেদের মুক্ত পরিবারের নেশা ডেকে চলেছে, তোমাদের যুক্ত পরিবারের ঘোরটা কাটিয়ে।’
‘বাহ্! আমাদের ঘোর কাটিয়ে তবেই তোদের নেশার ডাকে সাড়া দেওয়া!’
‘নেশাটা একেবারে অকাজের জিনিস নয় মা, বেশ কাজের জিনিসও হতে পারে। যেমন প্রেমের নেশা, বিত্তের নেশা, মদের নেশা, ব্যবসার নেশা – এমনকি ধর্মের নেশাও। জীবনটা তার প্রতিটি পর্বেই একটা নেশার ঘোরে চলে। আসলে বাঁচাটা আগাগোড়া একরাশ নেশারই যোগফল। সে-অর্থে নেশা নিজেতে তেমন খারাপ কিছু নয় মা। যেমন সন্তান ধারণ এবং লালনপালন জীবনের পর্ববিশেষের একটা স্বাস্থ্যকর নেশা। কিন্তু সে-নেশার ঘোরটা একটা রোগবিশেষ – যেটা থেকে নিরাময় প্রয়োজন। তোমাদের এই রোগ-নিরাময়ের অপরিহার্য প্রয়োজনের কথাটাই আজ আমি তোমাকে আমার ভাষায় এবং আমার অভিব্যক্তিতে বলতে বাধ্য হলাম। তোমাকে বলা এজন্যে যে, তুমিই আমাকে গর্ভে ধারণ এবং লালন করেছ।’
‘এ ব্যাপারে এই বয়েসেই এত বিদ্যা তুই পেলি কোথায় রে মেয়ে?’
‘বিদ্যালয়ে মা। ভুলে যাও কেন, আমি সামাজিক নৃবিজ্ঞানের ছাত্রী। আমাকে সামাজিক এবং পারিবারিক বন্ধনগুলি নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা আর গবেষণা করতে হয়।’
‘তোর বাবাও আমার মতো ‘জয়েন্ট ফ্যামিলি’র ঘোরের মধ্যে আছে। কবির ওই ‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’র মূলতত্ত্বটা সংক্ষেপে আবার বল তো শুনি – তাঁর চিকিৎসাটা আমিই করতে পারি কি না, আমারটা যেমন তুই করলি?’
‘সন্তানেরা তোমাদের দ্বারা এ সংসারে আসে বটে। তবে তোমাদের থেকে আসে না। তারা ভ্রূণ থেকেই নিজেদের মতো করে বেড়ে ওঠে। ফলে তারা কেবল নিজেদেরই, তোমাদের কেউ না।’
বিব্রত, বিচলিত মাতা মুদ্রাদোষের মতো বেখেয়ালে আবারও বলে বসলেন :
‘তার মানে?’
‘মানেটা প্রায় অজ্ঞেয় বলেই দীর্ঘ ব্যাখ্যার ব্যাপার। আপাতত শুধু এ-কথাটি মনে রেখো যে, মানবসভ্যতার বিকাশে দুটি শক্তির সংঘর্ষের চেয়ে দুটি ব্যক্তির সঙ্গমের ফলাফলই অধিক স্থায়ী অবদান রেখেছে। কবি তাই মানবসভ্যতার মৌল সত্যরূপে দম্পতি-কেন্দ্রিকতার প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন।’
মাতার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা দৃষ্টি উপেক্ষা করে ইশরাত আকরাম হনহন করে বেরিয়ে গেল, যেন মানবসভ্যতার বিকাশে নিজের ওই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটিরই কোনো কাজে। ‘অধিকারিণী’-নামের নারী-অধিকার প্রতিষ্ঠাকামী বিদেশি সাহায্যে পরিচালিত এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আধিকারিক তাঁর এই একরত্তি মেয়েটির এই সব কিসের উদ্গার, হাজেরা আকরাম তা পুরোপুরিই জানেন। তার নিত্যনতুন ছেলেবন্ধু নিয়ে ফেরা এবং ঘরে ঢুকে রুম বন্ধ করা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রচলিত মাতৃ-অধিকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার নিত্যনতুন অধ্যায়ের সম্ভবত অন্তিম কিস্তি এটি।
বস্তুত পরিণত বয়সের মেয়েটির এত উৎকট-উদ্ভট কথা এতক্ষণ ধরে ধৈর্য সহকারে শোনার কারণ হলো প্রশ্নসংকুল মেয়েটি মায়ের প্রশ্নহীন মনটিকে অবশেষে বিচলিত করে তুলতে পেরেছে। এমনকি এরপরে হাজেরার শান্ত-সুখী জীবনটি যে চেনামহলে কখনো কখনো খুবই অস্বস্তিকরই হয়ে উঠতে পারে এও তিনি এ মুহূর্তেই উপলব্ধি করছেন।
সোশ্যাল অ্যানথ্রোপলজির ছাত্রীটির মাতাও তো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরই ছাত্রী ও শিক্ষয়িত্রী – সাহিত্যের। তিনিও তো অধ্যয়ন এবং অধ্যাপন সূত্রে নর-নারীর শারীরিক-মানসিক সম্পর্কের জটাজাল-বেড়াজাল নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে থাকেন এবং সে সূত্রেই বুঝতে পারেন যে, বদ্ধঘরে যুবক-যুবতীর নামাজে রত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু অন্য কোনো কাজে রত হওয়ার অব্যক্ত সন্দেহ সম্পর্কেও জাগ্রত চেতনা-ধন্যা কন্যার ভাষণ শুনতে হয়েছিল মাতাকে আরেকদিন।
সেটার তাপমাত্রা ছিল আরো উচ্চ – এক শব্দে ‘বিপজ্জনক’ ভল্টেজের। কন্যার বিপজ্জনক জীবনযাপন দিন দিন আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে চলেছে দেখে সেদিন একটা ভাষণদানের খেয়ালে হাজেরা সবে উচ্চারণ করেছিলেন, মহাপুরুষগণ বলেছেন – যৌবনের উদগ্র কামনা আর ব্যগ্র বাসনার যাবতীয় জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে নির্বাণলাভের পথ যথাসময়ে অবলম্বন করাটাই শ্রেয়। অমনি শুরু হয়ে গিয়েছিল কন্যার প্রশ্নের বন্যা আর তর্কের ঘূর্ণাবর্ত :
‘কিন্তু কোন পথটি অবলম্বনে বিশ্বাসী তুমি? নির্বাণলাভের পথ তো বিভিন্ন মহাপুরুষের মতে বিভিন্ন। অস্তিত্বকে আনন্দ-বেদনার ওপারে নিয়ে যাবার উপায় নাকি একাধিক – বোধগুলিকে এড়িয়ে অথবা বোধগুলিকে ছেদিয়ে। অর্থাৎ সভয়ে সংবেদনগুলির পাশ কাটিয়ে গিয়ে কিংবা নির্ভয়ে বেদনগুলির মধ্য দিয়েই পেরিয়ে গিয়ে। কোন পথটি ধরবে তুমি?’
‘আমি তো দেখতে পাই যে প্রথম পন্থাটি অবলম্বন করে স্বস্তি পায় প্রাচ্য আর দ্বিতীয় পথটি গ্রহণ করে তড়পায় প্রতীচ্য -’
‘প্রথমত প্রাচ্যের পথটি মানবিকই নয়, যেহেতু ওটা স্রেফ ইন্দ্রিয়-ভয়। দ্বিতীয়ত প্রতীচ্যের পথটি সত্যিকারের ইন্দ্রিয়-জয় বলে সঠিক অর্থেই মানবিক। কারণ ইন্দ্রিয়ের আকর্ষণে সাড়া দেওয়া যেমন মানবিক, তেমনি তাকে গ্রহণ-চর্বণ ও আস্বাদনশেষে চূড়ান্ত বিকর্ষণে পর্যবসিত করা – অর্থাৎ আক্রমণকারী শিঙেল মোষটির শিঙ ধরে লড়ে শেষ পর্যন্ত তাকে ভূলুণ্ঠিত করে ফেলাটাও মানবের প্রজাতীয় বৈশিষ্ট্য। তাই আমার মতে, সকল অর্থে ওটাই মানবিক।’
‘আমার কোনো কোনো বান্ধবী কিংবা তাদের কোনো কোনো বান্ধবীর ইন্দ্রিয়জয়ের সরজমিন দৃষ্টান্তগুলি দেখে এবং শুনে এ যাবৎ আমি নিজের মনে অন্তত প্রাচ্য পথটিকেই শ্রেয় জ্ঞান করে এসেছি। ভেবেছি যে, অন্তিম উদ্দেশ্যটি যখন আনন্দ-বেদনার অপর পারে পৌঁছে গিয়ে মানবিক দুর্বলতাগুলিকে কোনোমতে পেছনে ফেলে দেওয়া, তখন মেঠোপথের দীর্ঘযাত্রায় নিজেকে ক্লেদাক্ত না-করে নভোপথে উড়ে গিয়ে পরিচ্ছন্ন শরীরে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়াটাই তো শ্রেয়।’
‘তাহলে কামনাগুলির কী হবে?’
‘সীমাবদ্ধ থাকবে।’
‘হোয়াই? জীবন তো একটাই।’
‘জীবনের পাত্রটা যখন সসীম, তখন প্রাপ্যটাকেও সসীমই থাকতে হবে।’
‘ডিজগাস্টিং!’ বলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঘড়ি দেখে বেরিয়ে গিয়েছিল মেয়ে। হয়তো বাইরে অপেক্ষমাণ তার কাম্য কোনো ছেলেবন্ধু বিরক্ত হচ্ছিল।
সেদিনটি থেকেও অশান্ত হয়ে গেল এদিনটি। নষ্ট হয়ে যাওয়া ধৃষ্ট দুটি ভাইয়ের পিতা-মাতার প্রতি অমানবিক আচরণের সমর্থনে মেয়েটির পণ্ডিতি ফলিয়ে জোর ওকালতি করা ‘হা পুত্র! হা পুত্র!’-করা এই মাতাটিকে এতটাই বিচলিত করেছে যে, স্বামী ঘরে ফিরতেই তাঁকে মেয়ের আজকের সকল সীমা লঙ্ঘন করা তাবৎ বয়ান হুবহু শুনিয়ে তবেই আত্মস্থ হতে পেরেছিলেন তিনি।
স্বস্থ হতে পেরেছিলেন বটে, কিন্তু থাকতে পারলেন কোথায়? এদিনটি যে আবার শনিবার! প্রতি শনি-রোববার আকরাম-দম্পতির একজোড়া সাপ্তাহিক ঝগড়াকে বিশেষত্বের মর্যাদা দিতেই হয়। জোড়া বলা এজন্য যে, কলহের বিষয়বস্তু অভিন্ন। আর সাপ্তাহিক তো বটেই যেহেতু খিটিমিটি-দুটি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে নির্দিষ্ট দুটি দিনের নির্ধারিত দুটি ক্ষণে – মৃদুতর্জনে, মন্দগর্জনে, তবে সাড়ম্বরে নয় কখনো। প্রতি শনিবার রাত আটটা আর প্রতি রবিবার রাত দশটার দিকে নাজুক সংলাপটি শুরু করেন বেগম ওয়াসিফ, যদিও প্রায়শই শেষ হয় তাঁরই নিঃশব্দ বিলাপে, আর বিপক্ষের অনুচ্চ বিক্ষোভে।
সমাজগণ্য এই সচ্ছল দম্পতি স্ব-স্ব নামে হাজেরা আর ওয়াসিফ। সরকারের কুলীন চাকরি থেকে, সময় হতেই, স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে সংরক্ষিত কর্মশক্তি ব্যবসায় বিনিয়োগ করে পড়তি যৌবনের উঠতি ধনের যোগে জীবনের বিকেলটি অনবসর কাটিয়ে জনাব ওয়াসিফ স্বনামধন্য না হলেও সমাজগণ্য হয়েছেন। ফলে বেগম ওয়াসিফও তাঁর শখের শিক্ষকতায় ইস্তফা দিয়ে সমাজসেবিকার ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। অতঃপর নর-নারীর এই সুসংসারী জুটিটি তাঁদের গুলশানের আলিশান ‘আশিয়ান’ ভাড়া দিয়ে বনানীর ‘কোজি কর্নারে’ বিরামহীন বিশ্রাম আর অনুক্ষণ বিনোদনেই দিনযাপন করতে পারছেন।
উত্তরপঞ্চাশের হলেও জীবন তাঁদের সম্পূর্ণ সপ্রেম এবং সময়ও সম্পূর্ণ ভরপুর – বাহুল্য-বাতুল সামাজিক অনুষ্ঠানের বর্ধিষ্ণু জৌলুসে। সর্ব অর্থের এই-যে জমাট জীবন, এর একমাত্র ফাঁকটি হচ্ছে আকরাম-দম্পতির দুটি পুত্রের দুটিই প্রবাসী – যাদের প্রত্যাবাসনও আর প্রত্যাশিত নয়। বড় ছেলে ইউনুস গিয়েছে নিজের উদ্যমেই, তবে পিতার পকেট থেকে পথভাড়া আর মাতার আঁচল থেকে হাতখরচা নিয়ে। ছোট ছেলে ইউসুফও বিভুঁই পাড়ি দিয়েছে যথাসময়েই, অগ্রজের স্পন্সরশিপ আর মেয়াদি ধারের হাতখরচায় – অর্থাৎ জনক-জননীকে এক্ষেত্রে কেবল রাহাখরচই মেটাতে হয়েছে।
এরা গিয়েছে বস্তুত ইদানীংকালের নিত্যশ্র“ত ফ্যালাসির ঠ্যালাতেই। কী? এদেশে ‘লাইফে শাইন’ করার সুযোগই নেই, থাকলেও নিতান্তই সীমিত, অতিমাত্রায় নিয়মশাসিত ইত্যাদি। ওদেশে ‘লাইফ এনজয়’ করার সীমা সিম্পলি ঊর্ধ্বে আকাশ আর নিম্নে পাতাল। আর সর্বোপরি, ওখানে সবকিছুই লাগামছাড়া যা খুশি, যেমন খুশি, যত খুশি, যখন খুশি প্রভৃতি। তবে বহুল পরিচিত এই শ্রেণীটির দেশত্যাগের গূঢ়তর হেতুটি খুলে তুলে ধরলে বলতে হয় যে, এদেশে ‘সুখী শূকর’ হওয়া প্রায়শই অসৎ তরিকাসাপেক্ষ আর ওদেশে অবস্থাটা ঠিক অতটা পতিত নয় যদিও পন্থাটার ব্যবহার ওখানেও সমানই উদার। বিকল্পে ‘শুচিশুভ্র মনুষ্য’ হবার উপকরণ এবং উপায় দুয়েরই উপস্থিতি এদেশে যথেষ্ট থাকলেও – লক্ষ্যটি যেমনি নিরামিষ, ওটির অর্জনও তেমনি কৃচ্ছ্রসাধনাসাপেক্ষ।
যাহোক, আকরাম-পুত্রদ্বয় গিয়েছে যথাস্থানেই, মানে বিপুল বিজ্ঞাপিত মার্কিনধামে। প্রায় বছরদশেক হচ্ছে মন্টু আছে ইস্টকোস্টে, নেওয়ার্কের কাছে, এমবিএ-কিসিমের কিছু একটা পড়েছে বা পড়ছে, গোমস্তা-মার্কা কিছু একটা করেছে বা করছে। সে সাদা মার্কিন বিয়ে করেছে অনেকদিন, তবে তার মাতা বীথির ব্যথার দিকটি হচ্ছে তাঁর অপছন্দ কীর্তিটি টিকেও রয়েছে এতদিন। ঝন্টু গিয়েছে প্রায় সাত বছর আগে, আছে মিড্ওয়েস্টে উইস্কন্সিনের ম্যাডিসনে। বিয়েটি এখনো নিষ্পন্ন না হলেও জনৈকা ফরাসিনীর সঙ্গে ডেটিং ‘স্টেডি’ যাচ্ছে দীর্ঘদিন। এ-বৎসটির শিক্ষা এবং জীবিকানির্বাহও ওই অগ্রজের ধরনেরই। তবে বিবাহোত্তর জীবনের জন্যে অপরিহার্য অধিক আয়ের পেশা হিসেবে নাকি লিমুজিন-ড্রাইভিংয়ের পাবলিক সার্ভিসে জব ‘সুইচ’ করেছে সম্প্রতি।
স্পষ্টতই এসব অকালবিদেশযাত্রীদের অভিযাত্রা সাধারণত ‘বডিড্রেন’ মাত্র – কদাচিৎই ব্রেন্ড্রেন্। বিশেষ কোনো শিক্ষা কিংবা ক্রিয়ায় কৃতবিদ্য হওয়ার বদলে এই শরণার্থীদলের অনতিসচেতন লক্ষ্য : কঠোর মূল্যবোধ কর্ষণ থেকে মুক্তি এবং ভৌত সুখসমৃদ্ধির প্রয়োজনাতীত প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তিযোগপুষ্ট আকরাম-পুত্রগণ তাদের সুসময়ে, অনর্থক হলেও, পিতামাতাকে কিছু অর্থও প্রেরণ করে থাকে। প্রয়োজন না থাকলেও পিতা মানা করেন না এজন্যে যে, এতে মাতার একরকমের সান্ত্বনা আছে, এমনকি গর্বও। তা প্রকাশ করার জন্যেই গরিব আত্মীয়স্বজনকে দান-খয়রাতও তিনি ওই ফান্ড থেকেই করে থাকেন।
এসবেতে আকরাম সাহেবের তেমন কিছু আসে-যায় না বটে, তবে হাজেরা বেগমের অনেক কিছুই আসেও এবং যায়ও। আসার খাতে আছে : তাঁর দু-দুটি পুত্রই পবিত্র পশ্চিমভূমে বাড়ি বাগিয়েছে, প্রচুর ‘অধ্যয়ন’ করছে, উপার্জন করছে প্রচুরতর প্রভৃতি। আর যাবার খাতে থাকে : দুটি ছেলেই বহুকাল যাবৎ চোখের আড়ালে, মনে হচ্ছে আসবেও না কোনো কালে; পৌত্রপৌত্রীসহ বউমায়েদের সম্মিলনে চাঁদের হাটটি তাঁর এ জীবনে আর মিলল না, অর্থাৎ পরিণত বয়সের শেষ শখটাই অপূর্ণ রয়ে গেল ইত্যাকার বঞ্চনাযাতনা।
বয়েসে সবার নিচে এবং মেধায় সবার ওপরে ইশরাত-নামের একমাত্র কন্যাটির ওপরই বা আর ভরসা কিসের – মাস্টার্স পাশের পর থেকে কথায় তো সারাক্ষণই উড়–-উড়–, কাজেও যে-কোনো মুহূর্তেই ফুড়–ৎ হওয়ার অপেক্ষায় আছে। সে গিয়ে ওয়েস্টকোস্টে অবতরণ করলে আকরাম-সন্তানেরা তাদের স্বর্গরাজ্যের এপার-ওপারময় হয়ে যায়। গর্বের কথাই বটে – অন্তত তাদের মাতার কষ্টকল্পিত সান্ত্বনাসূচক বিবেচনায়।
যোগ-বিয়োগের এ-জাতীয় অনুকূল জরিপের জের হিসেবে মিসেস আকরামের পুত্রগর্বের দ্রুততানটি থিতিয়ে গিয়ে সেখানে ইদানীং শুধু পুত্রশোকের গভীর মীড়ই মোচড় দিয়ে ওঠে, থেকে থেকে। বোধের এ-বদলটা ঘটেছে দ্বিতীয় ছেলেটিরও বিদেশিনী বিয়ে করে বিভুঁইয়ে থিতু হয়ে যাবার পরিচিত প্রক্রিয়াটি গোচরীভূত হবার পর থেকে। সচ্ছলতা বাড়ামাত্রই উভয় পুত্রের ক্ষেত্রেই নিয়মিত লিখিত পূর্ণপৃষ্ঠা পত্রের বদলে চালু হয়ে গিয়েছিল অনিয়মিতকৃত ক্ষণকালীন টেলিফোন। তাও দিনদিন ক্ষীণ হতে হতে একদিন কেবল এ-পক্ষের ওপর এসেই বর্তে গিয়েছে অনুষ্ঠানটি সংঘটনের একতরফা প্রয়োজন। কেননা, প্রয়োজনটি পরিহার্য বিবেচিত হওয়ায় এমন ভাবপ্রবণ অপচয় তো সুহিসাবী পশ্চিমবাসীদের প্রান্ত থেকে আশা করা যায় না।
এই পটভূমিতেই বেগম আকরাম তাঁর অনাগ্রহী স্বামীকে ফোনের প্রয়োজনটি নিয়মিত স্মরণ করিয়ে থাকেন – বারো ঘণ্টা পেছনের ছোট ছেলেটির বেলায় প্রতি শনিবার রাত আটটায়, এই অভিজ্ঞতায় যে অবিবাহিত পুত্রটির কেনাকাটার বহর কম থাকায় তাকে সপ্তাহান্তের শপিংয়ের দিনেও ঘরেই পাওয়া যায়, বিশেষত ভোরবেলায়। আর এগারো ঘণ্টা পেছনের বড়ো ছেলেটির ক্ষেত্রে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ওয়ার্কিং উইকের বকেয়া ঘুম উশুলের সময় দিয়ে রোববার রাত এগারোটায় – এই অনুমানে যে বিবাহিত ছেলেটি শনিবারে সাপ্তাহিক বাজার সেরে সারাটা রোববার ঘরেই কাটায়। বিশেষত বাড়িটি নিজের হওয়াতে ঘরের কিছু না-কিছু কাজ এই দিনটির জন্যে সারা সপ্তাহ ধরে জমতেই থাকে – যা ওই বেনিয়াদের দেশে পরকে দিয়ে করাতে হলে নিজের গলাটাই কাটা পড়ে বেঘোরে।
আকরাম সাহেবের এই দূরালাপন অনুষ্ঠানে অনাগ্রহ ততটা বিত্তঘটিত নয়, যতটা চিত্তজনিত। তবু সন্তানশোকে কাতরা মাতার যাতনার বহর মেপে ডিরেক্ট ডায়েলিংয়ে সহৃদয় পিতা লং কল উভয়পুত্রকেই করে থাকেন মাঝেমধ্যে। বিধুরা মাতাকে পুত্রদের অমূল্য এই শারীরসান্নিধ্যটুকু উপহার দিতে গিয়ে টেলিফোনের প্রাণরাসায়নিক এই উপঢৌকনের ক্ষমতাটি – সাম্প্রতিক উদ্ভাবিত প্রযুক্তির সুদীর্ঘ তালিকায় কেন-যে এখনো একক বলে বিজ্ঞানী মহলেই স্বীকৃত তা – আকরাম তাঁর মৃতবৎ অনুভবেও বোধ করে থাকেন। বোধটিকে যদিও ক্ষণিকেই বধ করে ফেলে অপরপ্রান্তে সহানুভবের অগোপন অভাব। সেই অভাবের প্রকাশটা যে এবারে একেবারে শনির দশাতেই গড়াবে, সেটা স্নেহান্ধ মাতার পূর্বাহ্নে জানা থাকলেও হয়তো তিনি তাঁর চিরায়ত ভূমিকাটি থেকে বিরত না-হয়ে আলোচ্য শনিবারের রাত আটটায় স্বামীর সঙ্গে নিয়মিত এই সংলাপটি ঠিকই ফেঁদে বসতেন :
‘ঈদটা যত ঘনাচ্ছে, ছেলেদুটির জন্যে বুকটাও যেন ততই তড়পাচ্ছে। ঈদে-চাঁদেও কি ওদের ফোন-টোন একটু করবে না তুমি?’
‘বুকটা যখন তোমারই তড়পাচ্ছে, টেলিফোনটাও তখন তুমিই করতে পারো।’
‘ওসব কান্ট্রিকোড-এরিয়াকোড-লোকাল নম্বরের লটবহর ভয়ংকর ভজকট লাগে আমার। তাছাড়া তোমার মনটা কি মোটেই জ্বলছে না?’
‘না। এতকাল ধরে মনটা কেবল জ্বলতেই থাকলে মানুষের জীবনটাই কি অচল হয়ে যেতো না?’
‘আচ্ছা, তুমি কি একটা পিতা নও?’
‘আমি তো অনেক দিন ধরে শুধুই-পিতা, ওরাই বরং আর শুধুই-পুত্র নেই বহুদিন থেকে।’
‘তোমাকে বোঝার ক্ষমতা বিধাতা অন্তত কোনো সন্তানের মাতাকে দেননি। কী-যে তুমি বলতে চাও -’
‘বলতে চাই – পুত্র হয়ে জন্মেছিলাম আমিও, স্বভাবতই থাকতে পারিনি; পিতাতে পরিণত হতে হয়েছে। প্রক্রিয়াটি অপরিবর্তনীয়। ফলে এ ধরাধাম থেকে আমাকে চলে যেতে হবে কেবল পিতা হিসেবেই। তেমনি আমার পুত্রদ্বয়েরও পুত্রত্বের পুনরাবৃত্তি আর আদৌ সম্ভব নয়। বরং পিতৃত্বের ভূমিকাটি প্রাপ্তিই ওদের এখন একমাত্র সম্ভাব্য বাস্তব -’
সম্ভাব্য তো রইল দূরে, উপস্থিত-বাস্তব থেকেই বিদায় নিয়ে বীথি তাঁর স্বপ্নের-বাস্তবে চলে গেছেন চলতি সংলাপের কোন ফাঁকে কে জানে। তবে সেটা মাতার নয়নের দর্পণে দর্শনমাত্রই কর্ডলেস ফোনের বেস সেট থেকে হ্যান্ডসেটটি পিতার হাতে উঠে এলো সন্তর্পণে, কানে বেজে উঠল ডায়েল-টোন এবং ডজনখানেক ডিজিট ঘুরে গেলে পরে তাঁর ছোট ছেলে ইউসুফের স্পষ্ট কণ্ঠও ভেসে এলো পিতার পেতে-রাখা সটেনশন কর্ণে :
‘হ্যালো! কে, বাবা?’
‘হাঁ। ঝন্টু তোরা কেমন আছিস?’
‘ভালো। তোমরাও ভালো তো?’
‘ভালোই – ’
‘ফোন করলে কী জন্যে?’
‘তোর মায়ের জন্যে। ঈদের মৌসুম বলে তোদের খুব বেশি করে মনে পড়ছে তাঁর -’
‘কেন, আমাদের গ্রিটিং কার্ড পাওনি? তোমাদের কার্ড তো পেয়ে গিয়েছি আমরা।’
‘পেয়েছি বটে, তবে সে-মুদ্রিত কার্ড তো মৃত হরফের। এই কণ্ঠস্বর তো আস্ত জ্যান্ত এবং একমাত্র তোরই অংশ -’
‘কত-কী-যে ভাবতে পারো তোমরা বাবা! শুধু এটুকুর জন্যই কি এত খরচ করে টেলিফোনটা করলে? আমি ভাবলাম কোনো দরকারি খবরটবরই বুঝি -’
‘এটুকু দরকারি না হলে, তোর ওই বারোয়ারি গ্রিটিং তো নয়ই – মহার্ঘ্য ডলার পাঠানোও দরকারি নয়। তাই ওসব আর পাঠালে অবশ্যই ফেরত যাবে। তোর মাকে দিলাম।’
‘কি রে টাকার কথা আবার কী হলো, বুঝলাম না তো!’
‘রাখো মা, বাবার কথার আমি অনেক কিছুই বুঝি না। বুঝতে চাইও না বেশি। কোথা থেকে কোথা চলে যায়। তা, তোমার কথা কী বলো।’
‘আমার আবার কথা কী রে? আমি যে তোর মা, আমার তো শুধু ব্যথা –
‘তবে কি অযথাই এই কস্টলি টেলিফোনটা করলে?’
‘অযথা কেন, তোরা কেমন আছিস?’
‘ভালো, মা ভালো। এদেশে মানুষ সাধারণত ভালোই থাকে। একমাত্র অ্যাকসিডেন্ট ছাড়া -’
‘খুব তাড়া আছে মনে হচ্ছে তোর কথার ধরনে?’
‘হাঁ, মা। দূরের একটা ‘ওপেন মার্কেটে’ যাচ্ছি। ইজাবেলের কিছু স্পেশাল শপিং আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে বেচারী ভারি বিরক্ত হচ্ছে -’
‘বিরক্ত হচ্ছে! দুনিয়ার আরেক প্রান্ত থেকে ফোন করে মা-বাবা তাদের সন্তানের সঙ্গে দু’দণ্ড কথা -’
‘কথা তো হয়েই গেল। তবু যদি আরো বাকি থাকে, সে আরেক দিন বলা যাবে। এখন রাখি মা, চলি।’
ছেলে ফোনের কথা ছেঁটে মাঝপথে রেখে দেওয়াতে মায়ের নিরুদ্ধ নিঃশ্বাসের বাষ্প হঠাৎ হিমেল প্রবাহে গলে গিয়ে টলটল করতে থাকল ছলছল চোখের ক্লান্ত দুটি পাতায়। অশ্র“র উৎস চক্ষুকর্ণের পুরোপুরি অগোচর ছিল না পিতারও। তাই পত্নীকে সান্ত্বনা দান কর্তব্যজ্ঞান করলেন দায়িত্বশীল পতি :
‘বীথি, তুমি অযথা এত ব্যথা পাও কেন বলো তো? এরা আমাদের সোনালি অতীত। আমাদের ভবিষ্যৎ আর রূপালীও নয় বলেই আমরা বারে বারে এদেরই দিকে ফিরে ফিরে যাই। তাই বলে, ভবিষ্যতের পিতৃত্বের জন্যে যুধ্যমান বর্তমান নিয়ে ব্যতিব্যস্ত এসব সন্তানেরা আমাদের মতো অস্পষ্ট অতীতের দিকে ফিরতেই বা চাইবে কেন সময় অপচয়ের কথা বাদ দিলেও।’
চোখ দুটি বারবার মুছলেন বটে, তবে নিজের মনটাকে একবারও চোখ ঠারতে না পেরে বীথি আজ আচমকা এক অভূতপূর্ব অনুরোধ করে বসলেন তার ‘ঘরেতে পরবাসী’ স্বামীকে :
‘আচ্ছা, তোমার ওই প্রিয় গানটা একবার গাও দেখি আজ – সন্তানে কুকর্ম করে/ ভোলে তারে পিতামাতা/ -’
‘আরে, ওসব তো হলো ভক্ত রামপ্রসাদের ভিন্নমাত্রার কথা, জগৎমাতার কথা – ’
‘তবু গাও না একটু শুনি, সকল মাতার কথাও তো হতে পারে।’
গানটি ওয়াসিফ গাইলেন, তবে যেখান থেকে কণ্ঠে আপনা-আপনি এসে পড়লো : ‘দশমাস দশ দিন/ যাতনা পেয়েছেন মাতা/ -।’ চিরনবিশ ওয়াসিফ গান কিছুক্ষণ প্রতি রাতেই করে থাকেন প্রাণ ভরে, তবে শুধু নিজেরই তরে – যার মারফত অতুলপ্রসাদী আর্তিও ঝরে : ‘দগ্ধ যবে চিত্ত হবে এ মরুসংসারে/ স্নিগ্ধ করো মধুর সুরধারে’।
কিন্তু স্নিগ্ধ হয়েছিল না বলেই সম্ভবত পরদিন রোববার রাত দশটায় বীথির নিত্যকার মিনতি বিনেই জ্যেষ্ঠ পুত্রটিকে ফোন করতে বসে গেলেন ওয়াসিফ। বীথিও কেন জানি গুটিগুটি এসে পাশে বসে গেলেন, হয়তো প্রেরণা আজ দুজনারই একই বেদনাপ্রসূত। হঠাৎ অপর প্রান্তে রিং হতে শুনেই ওয়াসিফ কেন যেন আঁতকে উঠে ফোনটি স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সরে গিয়ে বসে গেলেন তাঁর হারমোনিয়ামের পাশে। এ-শার্পের সুরটি টেনে দিয়ে বেদনাবিধুর একটি বিখ্যাত তালছাড়া গান গুনগুন স্বরে ভাঁজতেও শুরু করে দিলেন – ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’।
বস্তুত চাইছিলেনও তিনি মনটাকে বাঁধতেই, বিগত রাতের জীবন্মৃত মনটাকে। বাঁধতে কিন্তু পারছিলেন না, যেহেতু মাতা-পুত্রের দূরালাপনের ক্রমবর্ধমান সুরচ্যুতি মর্মগোচর হয়ে যাচ্ছিল বিশেষত হ্যান্ডসেট হাতে বিব্রত বীথির ত্বরিতে দূরে সরে যাওয়ার কসরত দেখে। গানের ভান ছেড়ে ওয়াসিফকে তাই ফোনের প্যারালাল সেটটাই বরং কানে তুলে নিতে হলো। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলেন যে ভুল করলেন – মহাভুল। কেননা না-তুললে তো তাঁকে এসব শুনতে হতো না :
‘কী রে মন্টু, তোদের কি এখনো কোনো খবরটবর নেই?’
‘সন্তানের কথা বলছ তো? না, মা। তবে আইরিন এ ব্যাপারে কথা বলার সিদ্ধান্ত শিগগিরই নিতে পারে বলে জানিয়েছে।’
‘সে কী রে, এত বছর পরেও আবার কথা বলার কী আছে! এটা তো একটা চিরন্তন বিষয় -’
‘চিরন্তন হলেও, বিষয় তো। আর বিষয়মাত্রেই এসব দেশে আগে আলোচনা, মধ্যে বিবেচনা, অন্তে সম্পাদনা। তুমি অতসব বুঝবে না মা। মূলত রীতিনীতিপদ্ধতির প্রতি এই বিশ্বস্ত আনুগত্যই এদের এতখানি উন্নত করেছে।’
‘তাহলে নাতি-নাতনির মুখ আমাদের আর দেখা হলো না।’
‘নাতি-নাতনি হলেও তো দেখা হতো না, হতো বড়জোর শোনা। দেখার সম্ভাবনার কথা তো আপাতত ভাবাও যায় না মা – যা খর্চা!’
‘খর্চাটা আমরা জোগালে? যাবারটার মতো আসারটাও না-হয় তোর বাবাই – ’
‘তোমরা তো করবে শুধু টাকা খরচ, কিন্তু সময়টা খরচ করবে কে? জানো না তো এখানে সময়ের দামটা কত বেশি -’
‘তার মানে আমরা দুনিয়া থেকে চলে যাবার আগে একবার দেখা দিয়ে যাবার বাসনাও তোদের নেই!’
‘ব্যস, অমনি অভিমান করে বসলে। কোনো সাবস্ট্যানশ্যাল কথা না, এসব সেন্টিমেন্টাল কথার জন্যে উইকেন্ডের ঘুমটা-যে ইতিমধ্যেই ছেঁটে দিয়েছ সেও তো বলিনি শুধু অযথা রাগ করবে বলেই। এসব কাজের সমাজে সপ্তাহটা যে কি কঠিন শ্রমে কাটে, সে তোমাদের বোঝারই কথা নয় মা। তবে আজকে ঘুম কমিয়ে দিয়ে কিন্তু ভালোই করেছো আইরিনের ওয়ালপেপার বদলানোর শখটা এ-রোববারে একেবারে মিটিয়েই দেওয়া যাবে।’
‘(ব্যাকুল কণ্ঠে) আমি তোর স্বল্প শিক্ষিতা মা, অতশত বুঝি না। একা হলেও একটিবার অন্তত দেখা দিয়ে যা না বাবা। আজকাল খালি ভয় হয় : তোদের বুঝি আর এক নজরও দেখে যেতে পারব না। তুই-যে আমার প্রথম সন্তান রে মন্টু!’
‘মা, এইটুকু শুধু বোঝার চেষ্টা করো যে, এত বড় একটা অপচয় বাঁচাতে পারলে ওটা দিয়েই তো চট করে ইশরাতকে নিয়ে আসা যাবে এদেশে -’
অতঃপর নিজেকে আর সামলাতে না-পেরে মাতার পক্ষে অগত্যা পিতাই কথা বলে উঠলেন শীতল কণ্ঠে এবং নির্মম শব্দে :
‘তোদের টাকা ছাড়াই ওই মূঢ়ের স্বর্গে মেধাবিনী ইশরাত সসম্মানেই পৌঁছে যাবে, স্কলারশিপ নিয়ে। ভাইদের মতো ডাল্ সে নয়। বরং বাপের চেয়েও শার্প্। তাই মা-বাপের কাছেও হাত পাততে হবে না ওর, তোদের মতো -’
পিতার অপমানকর কথাবার্তা আর বাড়তে না দিয়ে স্বভাবতই টেলিফোন রেখে দিলো পুত্র। পিতা ওয়াসিফ যেন পুঞ্জীভূত গ্ল¬ানির দুঃসহ বোঝাটা নামাতে পেরে এবারে পূর্ণপ্রাণে গানে বসতে পারলেন। দীর্ঘক্ষণ নিভৃতে রোদনের পরে স্খলিতপদে এসে পতির পাশে আসন টেনে বসে ব্যথাতুর বীথি কালকের মতো অভিনব অনুরোধটি আজও করে বসলেন :
‘আজো না-হয় রামপ্রসাদীই গাও। ওই-যে আরেকটা আছে না – ‘কুপুত্র অনেক তো হয় মা/ কুমাতা নয় কখনো তো।’
‘না বীথি, ওই গানের মেজাজ আজ পাওয়াই যাবে না।’
‘তাহলে একটু আগে-যে গুনগুনাচ্ছিলে, সেই অতুলপ্রসাদীটাই একটু প্রাণ খুলে গাও ‘এবার তুই একলা ঘরে নয়ন ভরে কাঁদ।/ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ ॥’
তাই গাইলেন ওয়াসিফ এবং পূর্ণ প্রাণেই গাইলেন। হাজেরাও মগ্ন হয়েই শুনলেন কিছুক্ষণ। পরে বোধহয় শ্রবণের চেয়ে নয়ন ভরে ক্রন্দনেরই প্রয়োজন বেশি বোধ করলেন এবং যেন কাকে খুঁজতে খুঁজতে উঠে চলে গেলেন ধীরে ধীরে, আরেক অতুলপ্রসাদী ‘ক্রন্দসী পথচারিণী’র মতোই ‘তুমি কোথা যাও, তুমি কারে চাও?’ অতঃপর নিজেকে নিয়ে একাকী হতে পেরে পীড়িত ওয়াসিফ তাঁর সংগীতসরোবরে এবারে পুরোপুরিই নিমজ্জিত হতে পারলেন। সে-নিমজ্জন এমনি সংজ্ঞাহরণ যে, কালজ্ঞান তাঁর একদম রহিত হয়ে গিয়েছিল। তাই ঠিক কতক্ষণ পর ধিকৃত পুত্রটি জ্বালা জুড়ানো কিংবা ক্ষোভ মেটানোর জন্য টেলিফোনটা করল ওয়াসিফ ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। বুঝতে অবশ্য চাইলেনও না তেমন করে।
কিন্তু বীথি যেন আহত পুত্রের জরুরি শুশ্রƒষার সুযোগটির অপেক্ষাতেই রাতের দুটো পর্যন্ত নিদ্রাহীন প্রহর গুনছিলেন ফোনের জন্যে উৎকর্ণ হয়ে। তাই রিং একবার বাজতেই শয্যা থেকে ছুটে এসে ফোন ধরলেন তিনি। ছেলে কিন্তু মায়ের সঙ্গে একটি কথাও বললো না, বলতে থাকলো শুধু বাবাকে দিতে। এদিকে স্ত্রীর অধীর তাগিদও স্বামীর সুধীর সংগীত থামাতে পারলো না। শুধু মাঝে মাঝে শুনলেন – ‘আগে তোমাদের কথা শেষ হোক’। অবশেষে বিব্রত মাতাকে বলতেই হলো ফোনের মুখ চেপে ধরে – মায়ের কথা শেষ হবে কী, ছেলে তো কথা শুরুই করলো না। কেবল পীড়াপীড়ি করতে থাকলো – বাবাকে দাও, বাবাকে দাও। ফোনটা হাতে নিতে বাধ্য হলেন নির্যাতিত পিতা। ফোনের কাছে মুখ নিয়ে শুধু একটা ফরমানই জারি করলেন অবসন্ন ওয়াসিফ :
‘ওকে বলে দাও বীথি : ওই জড়জগতের একটি জড়পিণ্ডের সঙ্গে কথা বলে অপচয় করার মতো সময় আমার এক মুহূর্তও নেই। কারণ আমি এখন মনোজগতের আনন্দমার্গে বিচরণ করছি।’
ক্ষুব্ধ জনকের এই কঠোর উত্তর অবাধ আকাশপথে রুষ্ট পুত্রের কর্ণগোচর হতেই টেলিফোনটা সে রেখে দিলো সশব্দে। আহত মাতাও সশব্দেই জুড়ে দিলেন ক্রন্দন। থেমে গেল ওয়াসিফের শান্তরসমণ্ডিত সংগীতের সপ্রাণ সেবনও। কিছুক্ষণ সমস্তটা ঘর যেন শ্মশানই হয়ে রইল। অবশেষে বীথির ক্রন্দনমথিত নিন্দাবাদেই নীরবতাটা ভাঙলো :
‘তুমি কি একটা পিতা, না এক টুকরা পাথর? স্বভাবগত পুত্রস্নেহও কি পিতার মনে অবশিষ্ট নেই যৎসামান্য?’
‘যৎসামান্য কেন, অসামান্যই আছে তবে আছে কেবল পুত্রেরই জন্য। আমার পুত্রদ্বয় এত কাল আগে গত হয়েছে যে ওদের প্রতি স্নেহবোধও কালে কালে সম্পূর্ণই লোপ পেয়ে গিয়েছে বলতে পারো। আর তুমিও যা! যারা চলে গিয়েছে তাদের জন্য অযথা অশ্র“পাত না করে, যে আছে তাকে দিয়ে তোমার মাতৃমনের চাহিদা মিটিয়ে যাও না কেন? আমার মেধাবিনী ইশরাতকে দিয়ে?’
‘তার মানে মন্টু-ঝন্টুকে তুমি কাল ঈদের দিনেও আর ফোন করবে না? অন্তত ঈদ মোবারক জানাবার জন্যেও না? এমন একটা খুশির ঈদের মুখে অমন সব দুখের কথায় সন্তানদের দোষী সাব্যস্ত করে কি সুখে থাকতে পারবো আমি?’
‘তা না পারো, তবু ফোন আমি তোমার জন্যও আর করবো না – যার জন্য এতদিন করে এসেছি। আমার জন্য কোনোদিনই করিনি।’
‘জঙ্গম পশুও নও, তুমি একটা স্থাবর পাষাণ – সন্তানের টান থেকে পশুও বঞ্চিত নয় তোমার মতো।’
শ্বেত ঘৃণায় পাষাণের মতোই জমাট বেঁধে-যাওয়া স্বামী আর একটা কথাও বাড়ালেন না দেখে স্ত্রীও ইতি টানলেন – তাঁর অতি-উগ্র ওই উপসংহারেই। কিন্তু বিন্দুমাত্র স্বস্তি নেই যে-মায়ের মনে, তার পক্ষে ইতি টানা কি সম্ভব? দ্রুতপদেই চলতে থাকলেন বীথি – যাকে বলে, ডাউন দ্য মেমারি লেন। পৌঁছে গেলেন প্রথম বিপর্যস্ত ঈদের সেই চারচোখে বান-ডাকা চাঁদরাতটিতে – যে রাতে হৃদয়হীন বড় ছেলেটির যান্ত্রিক আচরণের প্রথম আঘাতটি পেয়েছিলেন তার হার্দিক পিতা এবং মাতা দুজনেই।
বিনিদ্র রজনীশেষে ঈদের ময়দান থেকে ফিরে এসে স্বামী নিজের ঘরের কোণে বসে আছেন শুনে সেবারের অতি সুন্দর ঈদী শাড়িখানি পরে আনুষ্ঠানিক দাম্পত্য কর্তব্য পালন করতে গিয়ে এক অদৃষ্টপূর্ব দৃশ্য দেখে চমকে উঠেছিলেন স্ত্রী। ওয়াসিফ তাঁর ঈদের লেবাসেই হেলান চেয়ারটায় যেন জীবনের হালটাই ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পিত হয়ে পড়ে রয়েছেন। অবিশ্রান্ত অশ্র“ধারে ফুরফুরে পাঞ্জাবিটির সমস্ত বক্ষটাই ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছে। তবু বুকের অগ্নি-যে নেভেনি, তার প্রমাণ – চোখের পানি থামেনি। ঘাবড়ে গিয়ে জরুরি কণ্ঠে জানতে চাইলেন বীথি :
‘কাউকে কাছে না ডেকে একা-একা এখানে হচ্ছেটা কী? কী হয়েছে তোমার?’
চিরনির্বিকার পুরুষটি নিরুত্তর। চোখের জলের জোয়ারেই কেবল তরঙ্গভঙ্গ বেড়ে গেল।
‘শুধু এটুকু তো বলতে পারো যে আমার সর্বনাশের কি আরো কিছু বাকি ছিল?’
‘হাঁ, কাল পর্যন্তও হয়তো ছিল। আজ আর কিছুই বাকি নেই, সবই শেষ। তবে এটুকু ভেবে সান্ত্বনাও পেতে পারো যে, হারাবার মতো কিছুই আমাদের আর বাকি রইলো না বাকি পুত্রটিও আজ হারিয়ে গেলো চিরতরে।’
‘কে হারিয়ে গেলো? সব খুলে বলে ফেলছো না কেন তুমি? কালরাতের পর সইতে না পারার মতো কোনো কষ্টই আর থাকতে পারে না আমার -’
‘তাহলে দুঃসংবাদটি দুঃসহতম হলেও সহজেই নিতে চেষ্টা করো। সবে ধন যে-নীলমণিটি কাল পর্যন্ত আমাদের পূর্ণ করে রেখেছিল, সেই শেষ পুত্রটিও তার পিতামাতাকে সম্পূর্ণ শূন্য করে দিয়ে চিরতরে বিদায় হয়ে গেল -’
‘কী বললে? তোমার সঙ্গেই তো ঈদের জামাতে গিয়েছিল ঝন্টু -’
‘গিয়েছিল এবং ফিরেওছিল। ওকে নিয়ে বরাবরের মতো প্রথমেই বড় ভাইকে ঈদের সালাম করে আসার জন্যে ওর ঘরেও গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু গিয়ে দেখলাম, প্রাণের টুকরো ঝন্টু আমার তার আগেই কখন যেন আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চিরতরেই হারিয়ে গিয়েছে -’
পাশের শয্যায় ঢলে পড়ে সংজ্ঞা হারাবার আগে কাজের ছেলেটিকে ডেকে ডুকরে উঠলেন বীথি, অস্বাভাবিক চিৎকারে :
‘হাফিজ রে! আমাকে খুলে বল কীভাবে চলে গেলো আমার ঝন্টু? কোথায় গেলো?’
সাহেবের কথাবার্তা শুনে ঘাবড়ে গিয়ে দরজার বাইরে কর্মরত হাফিজ থতমত খেয়ে ছুটে এসে দুচোখ মুছতে মুছতে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বললো :
‘ভাইয়া তো আমারে বইলা গেলেন যে সাদেক ভাইয়ার বাসায় যাইতাছেন।’
ঝন্টুর নিকটতম এ-বন্ধুটির ফোন নম্বর হাফিজ জানতো। সুতরাং উদ্ভ্রান্ত হয়ে কারো অনুমতি ব্যতিরেকেই সে-নম্বরে ফোন করলো সে এবং ভাইয়াকে পেয়ে গিয়ে বাসার কান্নাকাটির উল্লেখটুকু করেই ‘লাইনে থাকেন’ বলে ফিরে এসে খবর দিলো :
‘ভাইয়া তো যেইখানে গেছেন সেইখানেই আছেন, বন্ধুদের সঙ্গে ঈদের নাস্তা খাইতাছেন -’
হাফিজের শেষের কথাকটি বীথির কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো, ঠিক যেন স্বপ্নে :
‘নাস্তা খাচ্ছে! আমার ঝন্টু ঈদের নাশতা খাচ্ছে?’
‘হাঁ খালাম্মা, ঈদের নাস্তা। বইলা যাওয়ার পরেও ডিস্টার্ব করাতে একটু রাগও করছেন, তবু কান্নাকাটির কথা শুইনা ফোন ধইরা আছেন। এই যে ফোন নেন, কথা বলেন!’
হাফিজ হ্যান্ডসেটটি বীথির কানে ধরিয়ে দিতেই অধৈর্য ঝন্টু বিরক্ত স্বরে বলে উঠলো :
‘আমাকে নিয়ে হঠাৎ কান্নাকাটির কী হয়ে গেল মা?’
‘আগে বল বাবা তুই কেমন আছিস -’
‘ভালো আছি। কিন্তু এবার তুমি বলো এইসব হচ্ছেটা কী?’
ওয়াসিফ সবকিছু জেনেশুনেও নির্বিকার বসে আছেন। তাঁর মুখে কোনো কথাই সরছে না, চোখের পানিও থামছে না। ঝন্টুর সকারণ বিরক্তির মুখে বলার মতো তেমন কথা আর না-পেয়ে, চিরতরে হারিয়ে যাওয়া পুত্রটিকে মুহূর্তে ফিরে-পাওয়া মাতা তাঁর হর্ষোজ্জ্বল কণ্ঠে কেবল বাড়তি কিছু আদর ছড়িয়ে অবশেষে বললেন :
‘কিন্তু তোর বাবা-যে ঈদের লেবাসে বসে আছেন প্রতিবারের মতো তোকে নিয়েই ঈদ-বেড়াতে যাবেন বলে। প্রত্যেক বছর সেই-যে তোর বড় চাচার বাসা থেকে শুরু করে -’
মায়ের বক্তব্য পূর্ণ শুনতে না চেয়ে ঝন্টু আজ নিজের মন্তব্যই পূর্ণ শোনাতে শুরু করলো :
‘সব সময় আমি কি খালি বাবার সঙ্গেই বেরুবো? কোনোদিনই কি আমি নিজে-নিজে বেরুবো না? নিজের বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াবো না?’
প্রশ্নের বহরে, কণ্ঠের স্বরে ঝন্টুকে আজ অতিসচেতন বোধ হওয়াতে আরো নরম সুরে, আরো আদরভরে – বরং আদরের সঙ্গে অনেকখানি আবদার মিশিয়ে, বীথি এবার মিনতি করেই বললেন :
‘হলো তো বাবা, সবই তো হয়ে গেল। নিজে-নিজে বেড়ালি, বন্ধুর বাড়ি গেলি, সকলে মিলে খেলি। এবার চলে আয়! বাবারও তো একটু পাওয়া চাই আমাদের কলজের টুকরো ঝন্টু মিয়াকে ’
‘না মা, এখন আসা যাবে না। মেলা দেরি হবে। আমাদের আরো অনেক প্রোগ্রাম আছে। বাবাকে বলো এবার একা-একা বেরুতে, না-হয় তোমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরুতে।’
‘সে কি করে হয় রে? আমিও না থাকলে বাসায় ঈদের গেস্ট রিসিভ করবে কে?’
উত্তর না দিয়ে টেলিফোনই রেখে দিলো ঝন্টু। এতক্ষণে মুখ খুললেন ওয়াসিফ, তবে কণ্ঠে তাঁর বিদ্রুপের রেশ বেশ অপ্রচ্ছন্নই শ্র“ত হলো :
‘কী বললো তোমার পুত্র?’
সদ্যমাত্র শঙ্কামুক্ত মাতার জবাবে বরং ক্ষাণিকটা প্রগলভতারই ছটা :
‘বললো, বাবাকে এবারে মাকে নিয়ে বেরুতে বলো -’
মাকে তাঁর কথা আর শেষ করতে হলো না, বাকিটুকু বাবাই বলে গেলেন :
‘শুধু এবারেই নয়, এখন থেকে প্রতিবারেই – তাই না?’
সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে হেলান-চেয়ার থেকে উঠে পড়ে সাদরে বীথির হাতখানি ধরে উঠে দাঁড়িয়ে চলতে চলতে বলতে লাগলেন ওয়াসিফ :
‘চলো, তোমাকে আজ দেখিয়েই দিই : আমাদের পুত্রগণ জনক-জননী থেকে কীভাবে বিচ্ছিন্ন হন, কখন বিগত হন, যার পরে তাঁরা আর পুত্ররূপে থাকতেই পারেন না – রূপান্তরিত হতে থাকেন পিতৃরূপে।’
বিভ্রান্ত বীথিকে ঝন্টুর কক্ষে নিয়ে গিয়ে তার পড়ার টেবিলের দেরাজটা দেখিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন ওয়াসিফ, কিছুটা যেন রহস্য করেই :
‘ঝন্টুর দেরাজটা খোলো তো দেখি।’
বীথি টেনে দেখলেন যে ওটা তালা-মারা। ওটার খুলে না যাওয়াটাই যেন মাতার গোটা মাথাটাই খুলে-যাওয়া। সুতরাং এই স্বতঃসিদ্ধটিরই শুধু স্বীকৃতি চাইলেন ঝন্টুর পিতা :
‘এবার বুঝলে তো?’
‘এতে আবার বোঝার কী হলো?’
‘কাল পর্যন্তও যা ছিল মুক্ত-দেরাজ তার পিতামাতারসহ সকলেরই কমন ভুবন। আজ থেকে বন্ধ-দেরাজটি শুধু ঝন্টুরই আপন ভুবন হয়ে গেলো।’
‘সে তো বটেই। কালই তো মনুমিস্ত্রিকে ডাকিয়ে নিয়ে ঝন্টু তার দেরাজটিতে তালা লাগিয়ে নিয়েছে।’
‘আমিও তো তাই বলছি : ঠিক তখন হতেই আমাদের শিশুপুত্র ঝন্টু মিয়া তার মাতা-পিতা থেকে চিরবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে কেবল নিজের জন্যে জনাব ইউসুফ আকরাম হয়ে গিয়েছে। গোটা পরিবারের এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি আমি তো মাত্র কিছুক্ষণ আগেই আবিষ্কার করলাম : সামান্য একটা দরকারে ওর ড্রয়ার থেকে একটা হাইলাইটার নেবার জন্য ওর ঘরে গিয়েছিলাম বলে। ওটা নিতে না-পারাটাই যে এমন অসামান্য একটা ব্যাপারের হাইলাইটার হয়ে যাবে, সেটা যে আগে ভাবাই যায়নি।’
‘তা ভাবা না-ই বা গেল। কিন্তু হাইলাইট হলো কোন পয়েন্টটা?’
‘পয়েন্টটা এই যে, অবশেষে আমাদের শেষ পুত্রটিও তার মনের কুঠুরিতে নিজস্ব তালাটি লাগিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ, পিতামাতার সঙ্গে কমন জীবনের মেয়াদ তার এ-জন্মের মতো ফুরিয়ে গিয়েছে : তার বদলে জন্ম নিয়েছে আরেকজন ‘সে’, আরেকজন পিতা – পুত্র আর নেই আমাদের ঝন্টু।’
বীথি কিন্তু আরো একজন সাবালক পুত্রের মাতা হয়ে যাবার সুসংবাদে হৃষ্টস্বরে সুখের লহর তুলেই যেমন সংবাদটির সমর্থনে প্রমাণ জোগান দিলো :
‘তাই তো মনে হয় ‘আমি’-শব্দটির ব্যবহারও ঝন্টু যেমন আজ একটু বেশি-বেশিই করছিল আমি, আমি, আমি।’
‘তবেই বোঝো, প্রবাসী মন্টুর ক্ষেত্রে পুত্রশোক আমাদের কতখানি বাসি।’
মন্টু-নামটি মনে মনে উচ্চারিত হতেই স্মৃতিপথটির ঠিক এইখানটায় হোঁচট খেয়ে বারান্দার সোফা-দুটির একটিতে হাজেরা যেন, ঠিক বসে নয় – একেবারে উলটেই পড়ে গেলেন বাস্তবজগতের এবারের ঈদের সকালটিতে। ঘোর-লাগা স্ত্রীকে এভাবে বসে পড়তে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওয়াসিফও পাশের সোফাটিতে বসে পড়লেন। বিষন্নতার অভিব্যক্তিতে এখন আর কোনোই ভিন্নতা নেই – প্রায় বিপরীত প্রকৃতির এই দুটি ব্যক্তিতে। নব-আবিষ্কৃত এই হৃতসর্বস্বতা একটা একমুখীনতা এনে দিয়েছে বিষম দৃষ্টিভঙ্গির দুটি নরনারীর মধ্যে। এ মুহূর্তে দুজনের দৃষ্টিও প্রসারিত একই দিকে, সম্মুখে; নাসিকাপ্রান্ত থেকে সুদূর দিগন্তের যে-দূরত্বেই হোক : তা যেন স্থাপিতও আজ একই স্থানে।
ঠিক এমনি একটি নতুন মৈত্রীবন্ধনে একসময় সুস্থির বোধ করলে জননীর কাছে জানতে চাইলেন জনক :
‘কার জন্য কাঁদছো? বড় আর ছোট ছেলের জন্য?’
‘হ্যাঁ। আমার কাছে তাদের অন্তত একটিবার এনে দাও টেলিফোনের লাইনে।’
‘ওরা তো হাজার-হাজার মাইল দূরে। সরাসরি শ্রবণ-দূরত্বের তোমার পাশের কামরার ইশরাতকেও তো আর কখনোই আমাদের ‘কাছে’ আনা যাবে না বীথি। এ দুঃসহ শোকই তো জগজ্জীবনে মনুষ্যলোকের জন্য বরাদ্দকৃত গুরুতম দণ্ডটি।’
তবে দণ্ড গুরুতম হলেও – তরতাজা শরতের এই ঝকঝকে সকালের সন্তানশোক আকরাম-দম্পতিকে এমন এক নিবিড় বন্ধনে একাত্ম করে তুলছিল, যেমন একাত্ম বন্ধনে এককালে তাঁরা এই সন্তানদের জন্ম দিয়েছিলেন।