আমার চেম্বারে আজ বেশ ভিড়। সাধারণত এত ভিড় থাকে না রোজ। হতে পারে আমি কিছুদিন দেশের বাইরে ছিলাম সে-কারণেই। সুতরাং বিকেল তিনটে থেকে রোগী দেখতে দেখতে আজ একটু রাতই হয়ে গেল। সবশেষের রোগীটা যখন চেম্বারে ঢুকল তখন রাত প্রায় নটা বেজে গেছে।
আমার শেষ রোগীটি একজন বোরকা-পরিহিত মহিলা। বস্তুত আমার রোগীদের রোগী না বলে বলা উচিত ক্লায়েন্ট বা পরামর্শ গ্রহণকারী, যেহেতু আমি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং আর দশজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতোই আমাকে অনেক কথা খরচ করে সমস্যার সমাধান করতে হয়।
আবার ওষুধও দিতে হয়। তবে সেটা প্রয়োজন হলে। রোগী দেখা শেষের পর্যায়ে এলে সব ডাক্তার একটু ক্লান্ত হয়ে ওঠে। আমিও ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলাম। রোগী তাই ঘরে ঢুকলে আমি গোপন একটা হাই তুলে তাকে আমার বাঁপাশের চেয়ারে বসতে বললাম। রোগী একা আসেনি। তার সঙ্গে একজন পুরুষও এসেছে। তাই তাকেও অনুরোধ করলাম আমার সমুখে রাখা চেয়ারে বসতে। সাধারণত মানসিক রোগগ্রস্তদের বা রোগ নয় এমনিতেই মনোপীড়নে আছে তাদের আমি সামনাসামনি বসতে দিই না। এতে তাদের পক্ষে নিজের সমস্যা বাইরের মানুষের কাছে তুলে ধরতে সুবিধা হয়। যদিও তারা ডাক্তারের কাছেই আসে, তবু।
আগে হলে হয়তো আমার এই রোগীর দিকে তাকিয়ে আমি একটু চমকে উঠতাম। কিন্তু আজকাল আর হই না। আগে বোরকা-পরা রোগী প্রায় দেখাই যেত না, কিন্তু আজকাল চেম্বারের অর্ধেক রোগীর শরীরেই বোরকার প্রকোপ।
রোগী একটু পরে থিতু হলে আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। সমস্ত শরীর তার ঢাকা কালো বোরকায়। কিন্তু সে-বোরকা খুব স্টাইলের বলতে হবে। পায়ের কাছে এসে বোরকা তেরছা কাট হয়ে গেছে। এবং নিচের দিকের বোরকার কাপড়ের রংও পালটে গেছে। খয়েরি রঙের হয়ে গেছে। শুধু রং পালটেছে নয়, তেরছা কাটের বোরকার কাপড় ইচ্ছে করে ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং পায়ের দিকে সেটা একটু ঝালুম-ঝুলুম হয়ে গেছে। মিথ্যে বলব না, তাতে করে কিন্তু বোরকাটিকে বেশ আধুনিক মনে হচ্ছে এবং বোরকার অধিকারীর দেহসৌষ্ঠব দেখেও মনে হচ্ছে সে রোগা ও একহারা চেহারার মহিলা। শরীরের তারুণ্য ইচ্ছে হলেই ঢেকে রাখা যায় না।
মহিলার সঙ্গী পুরুষটিও সুপুরষ বলতে হবে। তার মুখে হালকা দাড়ি। পরনে ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি। রং ফর্সা। মুখে একটি শান্তসৌম্য ভাব। দেখলে খুব ভালো মানুষ বলে মনে হয়। তবে চেহারার ভেতরে এক ধরনের মলিনতা যা কেবল অর্থনৈতিকভাবে পীড়িত মানুষদের ভেতরেই দেখা যায়। বয়স খুবসম্ভব পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। এই যুবকটি কি মহিলার স্বামী, নাকি ভাই? মনে মনে ভাবলাম।
চেয়ারে দুজনই থিতু হলে আমি মহিলার মুখের দিকে তাকালাম। এবং মনে মনে বিরক্ত বোধ করলাম। চেম্বারে ঢুকে একজন মহিলা ডাক্তারের সামনে বসেও সে তার মুখ নেকাবে ঢেকে রেখেছে। মুখ না দেখলে একজন ডাক্তার তার রোগী বা ক্লায়েন্টকে পরামর্শ দেবে কী করে? এ তো এক প্রকারের অসম্ভব। জানি এমন দিনও ছিল এই পাকভারতবাংলা উপমহাদেশে, যখন মহিলা রোগীদের পর্দার আড়ালে রেখে চিকিৎসা করা হতো। এবং এর ফলে কত নারী যে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েছিল তার কোনো সমীক্ষা এখন পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু সেসব ভয়াবহ দিন নারীদের জন্যে মোটামুটি গত হয়েছে বলা যায়। এখন অন্তত একজন মহিলা রোগী ডাক্তারের কাছে সরাসরি তার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের অসুখের বর্ণনা দিতে পারে। এমনকি কিছুদিন আগেও মহিলা রোগীদের রোগের বিবরণ পুরুষেরা এসে ডাক্তারের কাছে বলত। মহিলা কোনো স্ত্রীরোগের জটিলতায় ভুগলেও স্বামীই ছিল মূল বক্তা। মহিলা নিজে কখনো মুখ খুলে নিজের অসুখের কথা বলতে চাইলে পুরুষ স্বামী চোখ গরম করে বলত, তুমি চুপ করো, আমাকে বলতে দাও।
এখন অবশ্য সে-অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে।
আমি যেহেতু ভেতরে ভেতরে একটু ক্লান্ত তাই অলস চোখে মহিলার দিকে তাকালাম। তার মুখের কিছু দেখা যাচ্ছে না, শুধু চোখ দুটো ছাড়া। কিন্তু আমার মনে হলো, আর কিছু কি দেখার দরকার আছে? চোখ দুটিই কি দেখার একমাত্র বিষয় হতে পারে না? এরকম বিশাল এবং টানা দুটি চোখ কবে আমি মহিলাদের মুখের ওপর বসানো দেখেছি। চোখের বড় বড় পাপড়ি, ঘন কালো মণি, ভেতরের শাদা-নীলাভ জমিন আমাকে মনে মনে বিস্মিত করে তুলল। আমি গম্ভীর হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনার নাম?
সা-বি-না।
আপনার বয়স?
এ-এ-কুশ।
বুঝলাম মেয়েটি তোতলা।
লেখাপড়া?
আমি মা-মাদ্রাসার ফা-ফা-ফা জিল। তারপর আর পড়িনি।
থাকেন কোথায়?
ব-ব-বনানীতে। আ-আ-মার মা আর ভাইয়ের সঙ্গে।
আপনার ভাই কী করেন?
ব্যবসা। এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা। আবার গার্মেন্টও আছে। ম্যাডাম, আ-আ-আমাকে আপনি তুমি বলবেন।
তোমরা ক-ভাইবোন?
মাত্র দু-ভাইবোন। আমি আর আমার ভাই। আমি ছোট। আসলে আমার বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসা আমার ভাই দেখে। আমি আর আমার মা ভাইয়ের সঙ্গে থাকি। কিন্তু আমার মা অসুস্থ। প্যারালাইসিস হয়েছে।
তোমার ভাই কি বিবাহিত?
না। তবে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে।
আর ইনি? আমি আঙুল তুলে আমার সামনে বসা সুশ্রী যুবকটিকে দেখালাম।
ইনি আমার একজন ভাইয়া। আমার ভাইয়ের ছেলেবেলার বন্ধু। আমার আব্বা-আম্মা যখন মাহুতটুলীতে ছিলেন তখন থেকে তারা পরস্পরের বন্ধু।
তোমার ভাইও কি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছেন?
না। তিনি ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া করেছেন। তাকে বড় হয়ে ব্যবসা দেখতে হবে তো তাই।
নির্বিকার মুখে বলল সাবিনা।
এবার একটা কথা বলি সাবিনা?
বলেন।
তোমার মুখের নেকাব সরাতে হবে। যদি বলো, তোমার এই ভাইয়া বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারেন। কারণ মানুষের মুখ না দেখলে আমি কোনো কিছু ঠিকমতো আন্দাজ করতে পারি না।
না, না, ভাইয়া থাকবেন। আমি খুব ছোটবেলা থেকে তাকে চিনি। আমাকে উনি ছোটবেলা থেকে আদর করেন। আমার ভাইয়া নিজে খুব ব্যস্ত বলে এই নাসিম ভাইয়ার সঙ্গে আমাকে পাঠিয়েছেন।
কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে সাবিনা তার মুখের নেকাব একটানে খুলে ফেলল। নাসিম সেদিকে মাত্র একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
আমি যেন মনে মনে হতভম্ব হয়ে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
মনে হলো মিশরের নেফারতিতি বুঝি কোনো কারণে ঈশ্বরের আদেশে বাংলাদেশে এসে বাঙালির ঘরে জন্ম নিয়েছে!
তার নাক, ঠোঁট, মুখ, গালের মসৃণতা, চিবুক একেবারে যেন পটে আঁকা একটি ছবি।
মনে মনে বিস্মিত হলেও নিজেকে সামলে রাখার ট্রেনিং আমার বহু আগে নেওয়া সারা হয়েছে। গম্ভীর মুখে আমি একটু নড়েচড়ে বসে বললাম, তোমার সমস্যার কথাটা কি তুমি এখন বলবে? তোমার নাসিম ভাইয়া কি এখন বাইরে গিয়ে বসবেন?
হাত উঠিয়ে সাবিনা আমাকে বারণ করল। অর্থাৎ তার পাতানো ভাইটি আমাদের থেরাপি ঘরেই থাকবে। ইতোপূর্বে বহু অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়েছি আমি। তাই এ-কথায় অবাক হলাম না।
আমি এবার বললাম, তাহলে তোমার সমস্যাটা এবার শুনি। এই ফাঁকে বলে রাখি, সাবিনা যে আমার হাতে আজ আর বেশি সময় নেই, একটু তাড়াতাড়ি সবকিছু সারতে হবে।
আমার প্রশ্ন শুনে হঠাৎ চোখ নিচু হয়ে গেল সাবিনার। সে তার মসৃণ নিটোল হাত দুটি টেবিলের ওপর অযথা যেন নাড়াচাড়া করতে লাগল। তারপর একটু চোখ তুলে নাসিমের দিকে তাকাল।
যুবকটি এতক্ষণ চুপ করে আমাদের কথোপকথন শুনছিল। এবার সে বলে উঠল, সমস্যাটা আমি বলি ম্যাডাম? ও বলতে লজ্জা পাচ্ছে আর তাই আমাকে আসতে হয়েছে ওর সঙ্গে।
আমি নিরুত্তরে এবার নাসিমের মুখের দিকে তাকালাম।
নাসিম বলল, এই বিশ-পঁচিশ দিন হলো, সাবিনা হঠাৎ তোতলা হয়ে গেছে। কথা বলতে গেলেই সে তোতলাচ্ছে। আগে তার কোনোদিন এরকম কিছু হয়নি। এই বিশ-পঁচিশ দিনে তিন-চারজন ডাক্তার দেখানো হয়েছে, কেউ কোনো অসুখ খুঁজে পাচ্ছে না। শেষে একজন আপনার কাছে আসতে পরামর্র্শ দিলেন। এদিকে হাতেও আর বেশি সময় নেই!
সময় নেই, তার মানে?
মানে, তিন মাস আগে সাবিনার বিয়ে হয়েছে। স্বামী বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে আবুধাবিতে চাকরি করছে। সেখানে সে ম্যারেড কোয়ার্টার পেয়েছে। সাবিনাকে সে এখন তার কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু সাবিনা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মানে সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছে না। কথা বলতে গেলেই তোতলাচ্ছে। এর আগে কোনোদিন তার তোতলামি ছিল না। সাজ্জাদ এ-ব্যাপারে ভীষণ আপসেট।
সাবিনা কি বিদেশ যেতে চায় না?
প্রশ্নটি আমি ইচ্ছে করে মাঝপথে ছেড়ে দিলাম।
না। বিদেশ যেতে তার আপত্তি নেই। অনেকবার সে তার মা-বাবার সঙ্গে বিদেশ গিয়েছে। অথচ ম্যাডাম, সাজ্জাদ ছেলেটি অত্যন্ত ভালো এবং পরহেজগার। এক ওয়াক্ত নামাজও সে কাজা করে না। সাবিনা সেখানে না যাওয়াতে সে অত্যন্ত মনোকষ্টে আছে। বারবার করে মোবাইল করছে। বারবার করে সাবিনাকে অনুরোধ করছে তার কাছে যেতে। সাবিনা যাবে বলে সে তার কোয়ার্টার খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। এই নিয়ে বাড়িতে ভীষণ অশান্তি। আর এদিকে সাবিনার তোতলামিও শুরু হয়েছে! এর আগে কোনোদিন তার তোতলামি ছিল না।
নাসিমের বিবৃতি শুনে বুঝলাম, ভ্যালা এক ঝামেলার ভেতরে পড়ে গেছি। তাও এই বিদায়বেলায়। অর্থাৎ চেম্বার বন্ধ হবার আগে আগে।
এখন কী করা?
মনে মনে আমি একটু বিব্রত হলাম। তারপর বললাম, তুমি কি তোমার স্বামীর কাছে যেতে চাও না সাবিনা?
বাহ্, স্বামীর কাছে কে যেতে না চায় বলেন তো? কিন্তু এ-অবস্থায় কী করে যাব? স্বামী কি আমাকে গ্রহণ করবে?
সাবিনা আমার দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলো।
আমি মনে মনে মাথা চুলকে বললাম, না, মানে অনেকেই মা-বাবা ছেড়ে বিদেশে যেতে চায় না তো তাই।
না, না, আমার সেরকম কিছু না। যদিও মাকে আমি খুব ভালোবাসি।
স্বামীকেও নিশ্চয় ভালোবাসো, তাই না?
না!
তার সোজাসাপ্টা উত্তর শুনে আমি একটু থমকে গেলাম। নাসিম যুবকটি একটুখানি কেশে উঠল। বুঝলাম এরকম উত্তর সেও যেন সাবিনার কাছ থেকে আশা করেনি। কেন? জানি আমার এ-প্রশ্নটি একটু বোকার মতো হয়ে গেল তবে সবসময় কি থেরাপিস্টের মগজ থেকে বুদ্ধিমান প্রশ্ন বেরোয়?
কী করে ভালোবাসবো? আমি তাকে কতটুকু চিনি? বলল সাবিনা।
তাহলে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
তাহলে আর কী, যাকে ভালোবাসিনে তার কাছে কেন যাবো?
যেন একটু আগে স্বামী সম্পর্কে সাবিনা কী বলেছিল ভুলে গেল।
আমি মনে মনে সতর্ক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বিয়ের আগে কি তোমাদের দুজনের কোনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছিল সাবিনা?
কীভাবে? আমরা পর্দানশিন ঘরের মেয়ে, কীভাবে বিয়ের আগে পরপুরুষের সঙ্গে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হবে? তার ওপর আমি মেয়েদের মাদ্রাসায় পড়েছি, কোনো ছেলে সতীর্থকেও আমি কোনোদিন পাইনি। ভাইয়া বললেন, বিয়ে হবার পর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, তো আমিও রাজি হয়ে গেলাম। নইলে মাকে ছেড়ে এখন আমার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। ভাইয়ার বিয়ে হয়নি, আমি দূরে চলে গেলে মাকে কে দেখবে?
সব কথা তোতলাতে তোতলাতে বলে চলল সাবিনা।
তাহলে কি মায়ের জন্যেই তুমি বিদেশে স্বামীর কাছে যেতে চাও না? কারণ সম্বন্ধের বিয়েতে ভালোবাসা ধীরে ধীরে হয়। সেটা অবশ্য কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয়।
আমার প্রশ্নে মেঝেয় চোখ ফেলে সাবিনা ভাবল কিছুক্ষণ। আমি তার নত চোখের নিবিড় ও বড় বড় পাপড়ির দিকে তাকিয়ে তার চিন্তা করা দেখলাম। নাসিমও তাকিয়ে দেখল সেদিকে। তার মুখেও এক চিন্তার ছায়া ফুটে উঠল।
হঠাৎ মুখ তুলে সাবিনা নাসিমের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আপনি একটু বাইরে গিয়ে বসেন ভাইয়া, আমি কিছু প্রাইভেট কথা বলতে চাই।
তার কথা শুনে লজ্জিত নাসিম আমার দিকে একপলক তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
সাবিনা আমার মুখের ওপর একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেয়ালে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল, আপনার কাছে যা বলব সব গোপন থাকবে তো ম্যাডাম?
অবশ্যই। জোর গলায় বলে উঠলাম আমি।
তাহলে বলি, এসব কথা আমার বাড়ির কেউ জানে না, আমার মা কোনো ফ্যাক্টর না, ফ্যাক্টর হলো আমার স্বামী। আমার স্বামী সাজ্জাদ একটা সেক্সুয়াল পারভার্ট!
সাবিনার কথা শুনে এবার আমি চিন্তিত হলাম। এটা একটা অভিযোগ বটে। গুরুতর অভিযোগ। বিশেষ করে মেয়েদের তরফ থেকে।
কিন্তু সেক্সুয়াল পারভার্ট বলতে সে কী বোঝাতে চায়? সেক্সুয়ালিটি মূলতই প্রকৃতির সৃষ্টি। সেক্সুয়াল ভেরিয়েশনও মূলত প্রকৃতির আরেকটি দিক। সাবিনা তাহলে সেক্সুয়াল পারভার্ট বলতে কী বোঝতে চাচ্ছে?
কীরকম? মুখে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
কাছে পেলে মনে হয় সে আমাকে খুবলে খাবে! বলল সাবিনা। কথা বলার সময় তার মুখে একটি ভয় ফুটে উঠল।
আমি তার কথায় তাল দিয়ে চোখ কপালে তুলে বললাম, কী সর্বনাশ!
মনে মনে বললাম, বুভুক্ষু মানুষ সামনে খাবার পেলে খাবে না? বিশেষ করে যে-খাদ্য তার জন্যেই তৈরি করা হয়েছে?
সাবিনা তখন ফিরিস্তি দিতে লাগল একের পর এক। বিয়ের রাতে অনুরাগের পূর্বকালে সাজ্জাদের কথা, মেয়েদের নিয়ে কিছু কাঁচা হাসিঠাট্টা, স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশের ব্যগ্রতা, তার সঙ্গে খুনসুটি, সময় সময় স্ত্রীর প্রতি শারীরিকভাবে তার আগ্রাসী মনোভাব Ñ সবকিছু একের পর এক সে বলে যেতে লাগল আমাকে। সেদিন সারারাত সাজ্জাদ তাকে ঘুমাতে দেয়নি।
বলতে বলতে সে কেঁদে ফেলল একসময়। তারপর বলল, আমি তাকে ভালোবাসিনে। আমার তাকে ভয় করে ম্যাডাম।
আমি মন দিয়ে তার কথা শুনলাম।
তারপর জিজ্ঞেস করলাম, বিয়ের আগে তুমি কি কাউকে পছন্দ করতে সাবিনা?
এসব কথা সোজাসুজি জিজ্ঞেস করা ভালো।
আমার প্রশ্নের উত্তরে সাবিনা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো, না। তারপর বলল, আমি প্রেম করলে আমার আম্মা খুব কষ্ট পেতেন। আমার আম্মা বলতেন বিয়ের আগে কারো সঙ্গে প্রেম করলে হাবিয়া দোজখে আমার জায়গা হবে। আমার বাবার কবরে গোরাজাব নাজিল হবে। তাছাড়া প্রেম করার মতো কাউকে তো চোখেই দেখিনি!
পছন্দ করা আর প্রেম করা কিন্তু আলাদা ব্যাপার সাবিনা। আমি আমার ক্লায়েন্টকে স্মরণ করিয়ে দিলাম।
তা হোক, আমাদের ফ্যামিলিতে পছন্দ করাটাও এক ধরনের প্রেম। না, কাউকে আমি পছন্দ করিনি। বলল সে।
তার মানে সাজ্জাদই তোমার জীবনের একমাত্র পুরুষ যাকে তুমি খুব কাছ থেকে দেখেছ, কী বলো?
আমার প্রশ্নে সাবিনা মাথা নেড়ে সায় জানাল। বলল, হ্যাঁ, তা সত্যি। আর কাউকে যে কাছে থেকে দেখব তার তো কোনো সুযোগ ছিল না। আমাদের বংশে সবসময় বাবা-মায়েরাই বিয়ে ঠিক করেন। তবে আমার বাবা সবসময় আমাকে ভীষণ আদর করতেন আর বলতেন, আমি বড় হলে তিনি এমন ছেলের কাছে আমাকে বিয়ে দেবেন যেন কোনোদিন আমাকে মা-বাপ ছাড়া থাকতে না হয়। কিন্তু আব্বা হঠাৎ হার্টফেল করলেন। আর ভাইয়ার ঘাড়ে সব দায়িত্ব পড়ল। ভাইয়ার মন-মানসিকতা আবার আলাদা। ভাইয়া বললেন, আমাদের সমাজে ঘরজামাইকে লোকে খারাপ বলে। তাই একজন ভালো ছেলে হাতে পেয়ে মাকে রাজি করিয়ে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। কিন্তু আমি তো তাকে ভালোবাসি না। বরং সে আমার কাছে এলেই ভয় করে। মনে হয়, মনে হয় ¬
কথা শেষ করল না সাবিনা, কাঁদতে শুরু করল।
আমি তাকে কাঁদতে দিলাম। কান্না হচ্ছে স্বাস্থ্যের লক্ষণ।
কিছুক্ষণ কেঁদে নিয়ে সাবিনা বলল, নাসিম ভাইয়াকে এবার ভেতরে ডাকি, ম্যাডাম?
অবশ্যই। এই নাসিম ভাইয়াটা তোমাকে খুব পছন্দ করে তাই না?
জি। আমিও তাকে খুব পছন্দ করি। আমার ভাইয়ের সবরকম ঝামেলা এই নাসিম ভাইয়া ডিল করে। আসলে ভাইয়ার ফ্যাক্টরিতেই তার চাকরি তো, তাই। নাসিম ভাইয়ার অনেকগুলো ভাইবোন। তার আব্বা ছোটবেলায় মারা গেছে। কোনোরকমে বিএ পাশ করার পরে ভাইয়া তাকে তার ফ্যাক্টরিতে একটা চাকরি দিয়েছে। ছেলেবেলার বন্ধু তো। খুব মায়া করে।
শুধু মায়া, আর কিছু না? আমি হাসতে হাসতে বলে উঠলাম।
আমার কথা শুনে এতক্ষণে কান্নাভেজা চোখে সাবিনাও একটু হাসল। তোতলাতে তোতলাতে বলল, আবার ভালোও বাসে। আমার ভাইয়া নাসিম ভাইয়াকে বলে, তুই বিয়ে কর নসু, আমি তোর বিয়ের সব খরচপাতি দেবো।
তাই নাকি? আমি বললাম।
জি। কিন্তু নাসিম ভাইয়া বলে, আরে, আমার বিয়ের আগে তুমি বিয়ে করো। দেখি তুমি কীভাবে ম্যানেজ করো, তাই দেখে আমি বিয়ে করব।
বাহ্, বেশ। বলে আমি বেল টিপে অ্যাসিস্ট্যান্টকে বললাম, নাসিম সাহেবকে ভেতরে আসতে বলো।
নাসিম ভেতরে এলো। সাবিনা তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, দুঃখিত ভাইয়া, আপনাকে বাইরে বসতে বলার জন্যে। আমি কিছু পারসোনাল কথা বললাম।
না, না, ঠিক আছে। কিন্তু তোমার তোতলামি যে আগে কোনোদিন ছিল না, এ-কথাটা কি ম্যাডামকে ভালো করে বুঝিয়ে বলেছ?
না, এখনো বলিনি। নতমুখে বলে উঠল সাবিনা।
নাসিম বলল, আসলে ম্যাডাম, তার কিন্তু আবুধাবি যাবার টিকিট কেনা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেদিন সে ফ্লাই করবে, তার আগের দিন সকাল থেকেই শুরু হলো তোতলামি। সকলে তো একেবারে ঘাবড়ে গেল। এ-অবস্থায় কীভাবে একটি মেয়েকে প্লেনে তুলে দেওয়া যায়? শারীরিক কোনো সমস্যা হলো কিনা তা না জেনে অসুস্থ মানুষকে কীভাবে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবো? আমরা তাকে তৎক্ষণাৎ স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করে দিলাম, সেখানে সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বলা হলো তার কোনো রোগ নেই। তারা পরামর্শ দিলো মানসিক ডাক্তারকে দেখাতে। কিন্তু আমরা তাদের পরামর্শ না শুনে আবার অন্য আরেকটি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম আরেকজন ইএনটি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে। সেখানেও একই কথা বলল। তবু আমরা বিশ্বাস করলাম না। চোখের সামনে দেখছি মেয়েটি শারীরিকভাবে অসুস্থ, এর ভেতরে আবার মন কী? আবার আরেকটি হাসপাতাল। সবশেষে আপনার কাছে। মাঝখানে প্রায় পনেরো-ষোলো দিন নষ্ট হলো। এর ভেতরে পির, ফকির, পানি পড়া এসবও করা হয়েছে। তার ওপর এখন আরো এক সমস্যা –
কী রকম? নাসিম থামলে আমি জিজ্ঞেস করলাম।
তার শ্বশুরবাড়ির কথা বলি। তারা এদিকে বলতে শুরু করেছে আমরা নাকি জেনেশুনে অসুস্থ মেয়েকে তাদের ছেলের ঘাড়ে চাপিয়েছি, কিন্তু কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যে। আমি সাবিনাকে ছোট্টবেলা থেকে দেখছি, এরকম হাসিখুশি প্রাণবন্ত মেয়ে খুব কম আছে। ছেলেবেলায় সে আমার কোলে পর্যন্ত উঠেছে, চকোলেট খাওয়ার বায়না ধরেছে, আমি ওর সব কথা জানি। তার ভেতরে কোনো প্রকারের মানসিক কোনো ব্যাধি নেই, ম্যাডাম।
কথা বলতে গিয়ে নাসিমের সুন্দর চেহারায় বিষাদের ছাপ পড়ল।
আমি মন দিয়ে তার কথা শুনলাম। তারপর সাবিনার রাতে ঘুম হচ্ছে না শুনে তাকে কিছু ওষুধ দিয়ে পরের সপ্তহে আসতে বললাম। আমি ঠিক জানি, এই কয়েকটা দিনের ভেতরে আমার ওষুধ কিছুদূর অন্তত কাজ করবে। সেটা হচ্ছে তার মনটাকে অনেক শিথিল করবে। তখন সে আরো মন খুলে কথা বলতে পারবে। মনের উপসর্গের প্রথম অবস্থায় মন এত শক্ত হয়ে থাকে যে পেট থেকে কোনো কথা বের করা যায় না।
সাতদিন বাদে সাবিনা হাজির হলো আমার কনসালটিং চেম্বারে।
এসো, সাবিনা। আমি মৃদুস্বরে তাকে ভেতরে আসতে বললাম।
সাবিনা ঘরে ঢুকল। আমাকে বলল, আ-আ-আ-আ-
তার কথা শুনে আমি বললাম, আমি ভালো আছি সাবিনা। এইটেই তো শুনতে চেয়েছিলে আমার কাছে, নাকি?
জি। বলে ম্লান হেসে আমার কথায় সায় দিলো সে।
আমি খেয়াল করলাম সাবিনা গত সপ্তাহের চেয়েও যেন আরও বেশি তোতলা হয়েছে। দেখে তো আমার আক্কেল গুড়–ম! এত হেভি ডোজের ওষুধ দেবার পরেও এই অবস্থা? হায়, হায়!
কিন্তু দুশ্চিন্তাটা মনের ভেতরেই চেপে রাখলাম।
আমি যেন তার তোতলামি লক্ষ না করে বললাম, আজ আমরা এখানে বসেছি কিন্তু অনেক কথা বলব বলে, তুমি সেটা জানো তো?
হ্যাঁ। বলে মাথা নাড়ল সে।
তাহলে শুরু করো। বললাম আমি। বলে চুপ করে গেলাম। ব্যস এরপর আমরা দুজনেই চুপ। সাবিনা চুপ করে বসে আছে আমার টেবিলের বাঁপাশে। আমি সোজাসুজি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছি। বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে যাওয়ার পর আমি একবার হাত তুলে ঘড়ি দেখলাম। শুধু ঘড়ি দেখলাম না, একটুক্ষণ ঘড়ির ব্যান্ড নিয়েও খেলা করলাম, যেন আমি আনমনা হয়েছি।
আমি জানি সাবিনা আমার ব্যবহার লক্ষ করছে। এটাও জানি যে, সে জানে বেশ বড় অঙ্কের একটি টাকার অঙ্ক সে কাউন্টারে তার নাসিম ভাইকে জমা দিতে দেখেছে কাউন্সেলিং সেশনের জন্যে। এই কাউন্সেলিং সেশন একেক ক্লায়েন্টের জন্যে একেক রকম। প্রত্যেক থেরাপিস্ট তাদের ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুয়ায়ী ছক কেটে রাখে। শুধু বেসিক নিয়মটুকু অনুসরণ করতে হয়। সেই বেসিক নিয়মের ভেতরে আছে সময়। ঠিক এক ঘণ্টার ভেতরে এই সেশন শেষ হবে। যদি ক্লায়েন্ট মুখ খুলে কিছু বলে তো ভালো, তা না হলে ব্যাড লাক। ঘণ্টা শেষ হয়ে গেলে আর এক মিনিটও সময় দেওয়া যাবে না। এমনও ক্লায়েন্ট আমি জীবনে পেয়েছি, যারা দিনের পর দিন থেরাপি সেশনে বসে মুখ খোলে না, কিন্তু নিয়মিত আসে এবং এসে বসে থাকে।
তারপর এরকম কয়েকটা সেশনের পর সে যখন মুখ খোলে তখন থেরাপিস্টকে একেবারে তুলোধোনা করে ছাড়ে। তারপর শুরু হয় তার ভেতর থেকে উঠে আসা কষ্ট-দুঃখের ফিরিস্তি, যা শুনলে হয়তো পাথরও দুঃখে গলে যাবে।
সুতরাং পয়সা দিয়ে সময় কিনে তারপর থেরাপিস্টের সমুখে মুখ বুজে বসে থাকা কোনো কাজের কথা নয়। বদ্ধ উন্মাদও তার অর্থের মূল্য বোঝে!
বিশ মিনিট সময় আমরা দুজনেই চুপ করে বসে থাকলাম। সাবিনা নিশ্চয় আশা করেছিল আমি প্রথমে মুখ খুলব, কিন্তু আমি চুপ থাকাতে অনেকটা যেন বাধ্য হয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, আজ আপনি কিছু বলছেন না যে ম্যাডাম?
কথা তো তোমার বলার কথা। কখন তোমার মুড হবে কথা বলার সেজন্যে অপেক্ষা করছি।
আমার আবার কথা বলার কী আছে? সব তো আপনাকে বলেছি। আপনার ব্যবহার দেখে আমার কিন্তু খুব রাগ হচ্ছে। আপনি সেশনে বসার আগে আগে বললেন, এই থেরাপির নাম টকিং কিওর। অর্থাৎ কথা বলে সব সমস্যার সমাধান করবেন, অথচ আপনি কথাই বলছেন না? বাহ্।
লক্ষ করলাম আবেগে বা রাগে বা বিরক্তিতে যে-কারণেই হোক তার তোতলামি কমে গেছে।
আমি নিচু স্বরে বললাম, কথা তো বলতেই চাই। তার চেয়েও তোমার কথা শুনতে চাই বেশি। কিন্তু যেরকম তুতলে তুমি কথা বলো যে শোনার ধৈর্য থাকে না!
আমি তো এখন তুতলে কথা বলছি না। আমি অনেক কিছু আপনার কাছে জানতে চাই। আর সেটা হলো সব বিবাহিত জীবনই কি দৈহিক সম্পর্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত? দৈহিক সম্পর্ক না করে কি বিবাহিত জীবন বজায় রাখা যায় না?
তার কথা শুনে ঠোঁটের ডগায় যে-উত্তরটা এসেছিল তাকে চেপে রেখে শান্ত গলায় বললাম, তোমার নিজের কী মনে হয়?
আমার আবার কী মনে হবে? আমি তো স্বামীকে মাত্র দুদিন চোখে দেখেছি। সেই দুদিন আমি খুব সাবধানে ছিলাম। সে হাজার আমাকে আদর করলেও আসল আদরটা আমি তাকে করতে দিইনি! এটা খুব নোংরা একটা ব্যাপার। খুব জঘন্য। মেয়েদের আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে দেয়। একটা অচেনা লোক কোত্থেকে হঠাৎ এসে আমার শরীরে হানা দেবে, এটা একটা অকল্পনীয় ঘটনা!
কিন্তু সাবিনা, বিয়ে মানে তো অনেকটা তাই, তাই না? এই গায়ে হাত দেওয়া তো সেই হাত দেওয়া নয়, এই গায়ে হাত দেবার পেছনে ছয়-সাতদিন ধরে ক্রমাগত আয়োজন করা হয়ে থাকে। কনে দেখা থেকে আংটি বদল, সেখান থেকে গায়ে হলুদ, সেখান থেকে বিয়ে, সেখান থেকে আয়নায় মুখ দেখা, সেখান থেকে ফুলশয্যা, একের পর এক শুধু আচার-অনুষ্ঠান। এর ভেতর দিয়ে কনে এবং বরকে নতুন এক ধরনের জীবনের জন্যে প্রস্তুত করে তোলা হয়। আমাদের ভেতরে তো পশ্চিমের মতো লিভ টুগেদার করা নেই, তাই না? অথচ বিয়ে মানেই নারী-পুরুষের শারীরিক সম্পর্ক। বিয়ে হয়ে গেলে তারপর তো আদর-সোহাগ করে সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীর গায়ে হাত, তাই না? বিয়েটা একটা সামাজিক ব্যাপার। তাই সামাজিক পূর্ণ অনুমোদন থাকে কনের গায়ে স্বামীর হাত দেবার ব্যাপারে।
এত সহজ না, বুঝলেন ম্যাডাম? সমাজ অনুমোদন দিলো আর আমি বিছানায় নেতিয়ে পড়ে থাকলাম, তিনি আমার কুমারী শরীরে হাত দেবেন বলে, এ অসম্ভব!
তোমাকে তো দেখে মনে হচ্ছে তুমি বেশ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলো, আমাদের ধর্মেও তো –
সেজন্যেই তো বিয়ে করেছিলাম। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে বিয়ে করেছিলাম। তখন তো আমি ধর্ম থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখিনি। কিন্তু বিয়ের পর কী দেখছি? দেখছি আমি একজন মানুষ। একজন নারীমানুষ। এবং এভাবে ধর্মের জন্যে নিজেকে জবাই করতে আমি এখনো রাজি নই।
বলো কী মেয়ে, তাহলে এভাবে বিয়েটা করলে কেন?
মাকে আর ভাইয়াকে শান্তি দেবো বলে। কিন্তু বিয়ের পর কী হয় আমি জানতাম না। না, না, ভুল বলছি আমি জানতাম। আমি যখন খুব ছোট্ট তখন আমার বাবার একজন কর্মচারী আমাকে আদর করার ছলে আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করত। আমি চিৎকার করে কাঁদতাম। মা বা বাবা দৌড়ে এলে আমি তাদের কিছু বলতে পারতাম না। আমার মুখে তখনো পুরোপুরি ভাষা ফোটেনি। আর ফুটলেও বলতে পারতাম কি-না, আমার এখনো সন্দেহ আছে। সেই বীভৎস স্মৃতি এখনো আমাকে স্বপ্নের ভেতরে তাড়িত করে। আমি তখন ভুইল্যা যাই যে আমি বড় হইছি। কায়েতটুলীতে আমার আব্বার বোতলের মুটকি তৈয়ারের কারখানা আর নাই, আমার মায়ে সারারাত বইয়া আর কাগজের ঠোঙা তৈয়ার করে না। তখন আমরা খুব গরিব আছিলাম। টিনের ঘরে থাকতাম। কিন্তু আমার বাবা খুব চালাক। আমার ভাইরে পড়াইল ইংলিশ মিডিয়াম আর আমারে পাঠাইল সেই মাদ্রাসায়। ভাবল বহুৎ ভালা কাম করছে। মাদ্রাসায় মাইয়ারে পরহেজগার করতে পাঠাইছে। কিন্তুক কখনো ভাবে নাই মাদ্রাসাতেও নারী নির্যাতন হয়, শিশু নির্যাতন হয়। আমিও হেইখানে নির্যাতিত হইছি।
আমার কী ইতিহাস আপনেরা জানেন? আমার কচু ইতিহাস আপনেরা জানেন! আমার অতীত খুব খারাপ। মা পঙ্গু হইয়া বিছানায় পড়লে কে আছিল আমার দেখাশোনা করার? কেউ না। আমারে এহন যা দেখেন আমি কি তাই আছিলাম আগে? না। ট্যাকা কি সবকিছু ভোলাইয়া দিতে পারে, কন? আমি আবুধাবি যামু না। রেপ হইবার লাইগা আমি আবুধাবি যামু না! বিবাহিত এই জীবন আমি মানি না।
চিৎকার করে এবার কথা বলতে লাগল সাবিনা। ভুলে গেছে যে বাইরে আরো কিছু রোগী বসে আছে।
কয়েক সপ্তাহ বাদে সাবিনা আবার আমার কনসালটিং রুমে বসা।
আজ তার চেহারায় একটু অন্য ধরনের ভাব। শুধু তাই না, মুখে সে আজ প্রসাধনও করেছে একটু। সেই সামান্য প্রসাধনেই তার চেহারায় ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। কানে সে আজ পরেছে হীরের টব। ঘরের নিয়ন লাইটের আলোয় সে-টব ঝকঝক করে জ্বলছে।
মনে মনে ভাবলাম, সাবিনার চেহারা আজ দেখার মতো।
আজো নাসিম তাকে নিয়ে এসেছে চেম্বারে। এখন সে বসে আছে বাইরে। ধৈর্য ধরে বসে আছে। প্রতি সপ্তাহে সাবিনার মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে সে যেন একপ্রকার সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। কখনো সাবিনা তার থেরাপির সময় নাসিমকে কাছে রাখে। কখনো সে তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। তখন সে বসে থাকে থেরাপি রুমের বাইরে।
থেরাপি শেষ হলে সে ভেতরে আসে। বিগত কদিনের সাবিনার মানসিক অবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত বয়ান দেবার চেষ্টা করে। এই যুবকের ধৈর্য দেখে আমি মনে মনে অবাক হই। যেন সে যেভাবেই হোক সাবিনাকে সুস্থ করে তুলবেই। এতদিনে আমি নাসিমকেও বুঝতে পেরেছি। বস্তুত সাবিনার ভাইয়ের বদৌলতে নাসিমের মায়ের সংসার চলে। এখনো তার ভাইবোনগুলো ছোট। এখনো তারা নিজের নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। সবেমাত্র একজন বা দুজন ইউনিভার্সিটি ছেড়ে কাজের সন্ধান করছে। বোনদের এখনো কারো বিয়ে হয়নি। তবে প্রতিটি বোনকে সে স্কুল বা কলেজে পড়াচ্ছে। এসবের পেছনে যার একাগ্র সাধনা এবং পরিশ্রম কাজ করছে সে হলো নাসিম। নিজের সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে এই তরুণ তার পরিবারকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। নাসিম ছেলেটিকেও আমি মনে মনে বাহবা দিই আজকাল।
আজ সাবিনাকে দেখে আমি অনুভব করতে পারছি তার পরিবর্তন। তবে সেটা যে কোনদিকে মোড় নিয়েছে এখনো বুঝতে পারছিনে। সাবিনা আজ আমার চেম্বারে ঢোকার আগেই তার মুখের নেকাব খুলে ফেলেছে। হাসি-হাসি মুখে সে আমার বাঁদিকের থেরাপি চেয়ারে এসে বসেছে।
আমি তার দিকে স্মিত মুখে তাকিয়ে আছি। আমার ক্লায়েন্ট যদি খুশি থাকে তাহলে আমার খুশি থাকতে দোষ কী?
সাবিনা এবার আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তরুণী মেয়ের হাসি।
আমি বললাম, কেমন আছ সাবিনা?
ভালো, ম্যাডাম। পরিষ্কার স্বচ্ছ কণ্ঠে বলে উঠল সাবিনা। তারপর বলল, আমি যাচ্ছি সাজ্জাদের কাছে। বেচারা খুব মনমরা হয়ে পড়েছে। দেখেন গতকাল সে আমাকে কী এসএমএস করেছে। আপনাকে দেখাই।
কথা বলে আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করেই সাবিনা তার দামি মোবাইল সেটের ঝলকিত পর্দা আমার চোখের সামনে তুলে ধরল। সেখানে ইংরেজি শব্দে বাংলায় লেখা রয়েছে, প্রিয়তমা, আমার জান, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন। আমি মরে যাব। মরে যাব। আমি কোনো দোষ করলে আমাকে মাফ করে দাও, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ। আমি তোমাকে ভালোবাসি সিবু। ভালোবাসি, ভালোবাসি। প্লিজ, তুমি আমার কাছ থেকে আর দূরে সরে থেকো না। তোমার হতভাগ্য সাজ্জাদ।
মেসেজটা পড়ে আমি হাসি চেপে রেখে গম্ভীর হয়ে সাবিনার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার ডাকনাম বুঝি, সিবু?
না, সিবু না, আমার কোনো ডাকনাম নেই, তাই একেক সময় একেক নামে আমাকে সে ডাকে। দিনের ভেতরে কতবার যে এরকমের এসএমএস পাঠায়, কী বলব আপনাকে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু মনে হচ্ছে একটু রসিক টাইপের, তাই না ম্যাডাম?
আমি মাথা নেড়ে স্বাভাবিক স্বরে বললাম, তাই তো মনে হচ্ছে। এখন তুমি –
আমি ডিসিশন নিয়েছি ওর কাছে চলে যাবো। হাজার হোক আমার স্বামী তো বটে। কী বলেন?
আমি অল্প একটু মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, সেটা তো সত্যি কথাই।
বেশি মাথা নাড়তে ভয় হলো পাছে সাবিনা মনে করে আমিই আগ্রহ করে তার স্বামীর কাছে ঠেলে পাঠাচ্ছি!
আসলে এখন আমি অনেক কিছু বুঝতে পারছি, ম্যাডাম। আমাদের পরিবার, সমাজ, সংসার, দাম্পত্য জীবন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। গত সপ্তাহে আপনার কাছ থেকে যাবার পর থেকে আমি সুস্থ। আর একবারের জন্যেও আমার তোতলামি হয়নি। বলল সাবিনা।
তুমি যে তোমার স্বামীর কাছে চলে যেতে চাও, এ-কথাটা কি বাড়িতে কাউকে জানিয়েছ?
না, ম্যাডাম। ভাবলাম আগে আপনাকে জানাই। দেখি আপনি কি বলেন। বা এখন আমার তার কাছে ফিরে যাওয়া সম্ভব কি-না।
কেন নয়? সংস্কৃতে একটি কথা আছে, শুভস্য শীঘ্রম্। তোমার নাসিম ভাইকে তাহলে এখন খবরটা দেওয়া দরকার, কী বলো? বেচারা আজ কতদিন ধরে –
সত্যি, ম্যাডাম। আপনি যা বলেছেন। মাথা নেড়ে বলে উঠল সাবিনা।
তাহলে তুমিই তাকে সুখবরটা দাও, কী বলো? তোমার মুখ থেকেই ভদ্রলোক খবরটা প্রথম শুনুক।
আচ্ছা। বলল সাবিনা।
আমি বেল বাজালাম। বেশ জোরেই আজ বেলটা বাজল। নিজের কোনো সাকসেসের খবর হলে আমি একটু যেন উচ্চকিত হয়ে উঠি। জানি এটা খারাপ, তবু।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ঘরে ঢুকলে আমি বললাম, নাসিম সাহেবকে সালাম দাও। ভেতরে আসতে বলো।
নাসিম ভেতরে এলো। পরনে তার হালকা নীল শার্ট ও ঘিয়ে রঙের ট্রাউজার। দোহারা স্বাস্থ্য। ফর্সা মনকাড়া চেহারা। কিন্তু সেখানে যেন ব্যক্তিত্বের একটু অভাব। আজ অনেক আগেই ভেতরে এলো বলে যেন একটু বিস্মিত। অন্যদিন থেরাপি শেষ হবার পর সে ঘরে ঢোকে।
সাবিনা নাসিমকে ঘরে ঢুকতে দেখে উজ্জ্বল ঝকঝকে চোখ তুলে তার অপার্থিব সৌন্দর্যমণ্ডিত মুখখানা হাসিতে উদ্ভাসিত করে বলে উঠল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
কিসের জন্যে বলত? নাসিম একটু যেন বিস্মিত হলো।
আমি ভালো হয়ে গিয়েছি ভাইয়া। আমার আর কথা বলতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে না।
বাহ্ বেশ! বলে উঠল নাসিম। তারও মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে আবারো বলল, গত সপ্তাহ থেকেই তো তোমার ভেতরে আমরা পরিবর্তন লক্ষ করছি। যাক, আল্লাহ মেহেরবান।
ঠিক তাই, ভাইয়া। আল্লাহ মেহেরবান। এখন আমি সাজ্জাদের কাছে যেতে চাই। পারলে কালকের ফ্লাইটেই।
সাবিনার কথা শুনে নাসিম তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। যেন কথা বুঝতে তার কষ্ট হচ্ছে।
সাবিনা বলল, হ্যাঁ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর কাছে যেতে চাই। আমার আর এখানে এক মুহূর্ত মন টিকছে না। আপনি ভাইয়াকে আজই বলেন –
এ-ত-তা-ড়া-তা-ড়ি? য-দি-আ-বা-র-
আমার চোখের সামনে একটা ঘসা পর্দা যেন বাতাসে হাউইই হয়ে উড়ে চলে গেল। আরে, আমি কবে থেকে এতখানি ইডিয়েট হয়ে গেলাম? কবে থেকে এরকম একচোখো হরিণ হলাম? হায়, হায়, আবার তাহলে আমাকে থেরাপি করতে বসতে হবে? এবার যুবকটিকে নিয়ে? আবার? ইস্।