ইবাদুরের যতদূর মনে পড়ে, তিনি অমার্জিত ও অশোভনভাবে, অসুন্দর ইঙ্গিত-তাড়িত হয়েই কথাগুলো বলে ফেলেছিলেন সুখনকে। আজ প্রায় ১০-১৫ বছর পর, সেই মুহূর্তকে চোখের সামনে তুলে ধরতে গেলে ইবাদুর নিশ্চিতভাবে দেখেন যে, তিনি ক্রুর-নিষ্ঠুর আক্রমণ করার জন্যই এভাবে কথাগুলো বলেছিলেন তাঁকে। তিনি বলেছিলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা ছোট-বড় প্রতিটি প্রাণীর দেহাঙ্গিকের প্রতিটি অংশ, প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশেষ প্রয়োজনে, বিশেষ ব্যবহারের জন্য তৈরি করেছেন। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। তোমার ক্ষেত্রে তা হয়ে রইল এক ব্যতিক্রম।’
সুখন তাঁর স্বভাবজাত অন্যমনস্কতা নিয়ে তাঁর নেশাগ্রস্ত কিঞ্চিৎ রক্তিম, হালকা বাষ্পাচ্ছন্ন চোখ তুলে কৌতূহলী হয়েছিলেন।
‘কী রকম?’
‘তুমি তো জাতে মাতাল, তালে ঠিক… তোমার সুবিধামতো তুমি বোঝ বা বুঝতে চাও। অন্যথায় তুমি না বোঝার ভান করো।’
তিনি যে-অজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন, তাতে নেহায়েত নির্ভেজাল কৌতূহল ছাড়া অন্য কিছু ছিল না, তা ইবাদুর বুঝলেও তা তিনি আমলে নেননি সেদিন। কারণ, সুখনকে ইবাদুর সেদিন আক্রমণ করে কষ্ট দিতে চেয়েছিলেন। সত্যিকার অর্থেই।
ইবাদুরের আজকালকার পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে, সুখন জাগতিক দুঃখ-কষ্ট, বেদনা, পাওয়া-না-পাওয়া… এসবের ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। তিনি এখন অচেতন, বিস্তৃত। মুক্ত এক মানুষ।
বর্তমান সময়ের অস্থিরতা, জটিলতা, ঘুণে ধরা অবস্থার বেড়াজাল ডিঙিয়ে বুদ্ধদেবের সেই প্রশান্ত ‘নির্বানার’ বিশাল বিস্তৃতিতে যে মানুষ একাত্ম হয়ে যেতে পারে সুখন তারই এক বিরল দৃষ্টান্ত। ইবাদুর সেদিন কিছুটা উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন তাঁর পূর্বপরিকল্পনার জের ধরেই।
‘মানে… মানে… তোমার কিছু কিছু জিনিস বা দেহাংশের তো ব্যবহার হলো না এই ইহজগতে… পরকালে হয়তো হবে। তুমি তো সন্ন্যাসী… পাপ করোনি। তুমি হুরপরি পাবে।’
‘…আমি সন্ন্যাসী হলাম কেমনে? গাঞ্জা খাই বলে…।’
‘সেটা খাও… কিন্তু সন্ন্যাসীদের যে শয্যাসঙ্গিনী-ফকিরিনী থাকে, ঠাকুর-পুরোহিতদের দেবদাসী থাকে… তোমার তো সেসব কিছু নাই। বিয়ে-শাদিও তো করলে না। নারীসঙ্গ… নারীদেহ… সেসব তো জীবনে পেলে না।’
সুখন এবার যেন ধরতে পারেন ইবাদুরের কথার দিকনির্দেশনা। মাঝে মাঝে সুখনের চিন্তাশক্তি যে অত্যন্ত প্রখর হয়ে ওঠে তা তাঁর জানা ছিল। সুখন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে অট্টহাসিতে ভরে তোলেন সারাঘর।
‘তার মানে তুই বলতে চাস, আমার ধোনের (পুরুষাঙ্গ) যথাযথ ব্যবহার হয়নি?’
সুখন একটু থেমে বলে যান, ‘প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা আমরা একত্রে থাকি বলে তুই আমার সব জানবি বা আমি তোকে জানাবো, তা হতে যাবে কেন?’
ততক্ষণে ছন্দা সুচারুভাবে সাজিয়ে ঘরে তৈরি মোগলাই পরোটা, কাঁটাচামচ দুজনের সামনে গুছিয়ে রেখে যান।
‘সুখন ভাই, চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, আপনি সারাদিন খাননি কিছু… মুখে দিন।’
সুখনও আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে কাঁটাচামচ হাতে নেন। ক্ষুধার্থের মতোই খেতে শুরু করেন। তবে তাঁকে তখন কিছুটা বিপন্ন দেখাচ্ছিল।
খেতে খেতে ইবাদুর বিস্মিত না হয়ে পারে না।
‘তাই বলে তুই পুরুষাঙ্গের এমন একটা আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করলি। এর আর কোনো শব্দ পেলি না।’
‘তোর প্রসঙ্গের এই উত্থাপনটাও তো সভ্য পরিবেশে চলে না। তবে তুই আমার একান্ত কাছের বা একমাত্র চব্বিশ ঘণ্টার বন্ধু বলে তোর কথা আমি আমার মেমোরি থেকে মুছে ফেললাম। কষ্ট হলেও।’
ইবাদুর সেদিন লক্ষ করেছিলেন, ছন্দার তৈরি পরোটা তাঁর পছন্দ হয়েছে। তা না হলে সাধারণত তিনি খাবার এমন চেটেপুটে খান না। তাঁর খাবার খুব সীমিত। সামান্য একটুখানি মুখে দিয়েই তিনি খাবারের ক্ষান্তি টানেন। তবে চা বা কফির প্রতি দুর্বলতা তাঁর সহজাত। সামনে পেলেই খান। ইদানীং তাঁর ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। তিনি বলেন, বর্ডার লাইন। সুতরাং চিনি খাওয়া যায়।
সেদিন সুখন, ছন্দার কাছে কফি চেয়েছিলেন। কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ান। তেমন কোনো ভূমিকা না করে চলে যান।
‘আবার দেখা হবে। ভাবি আসি।’
সুখন এলো দিন সাতেক পরে। হাতে তাঁর একটা সেলফ পোর্ট্রেট। পেন অ্যান্ড ইঙ্কের কাজ।
‘ছবিটা ঝুলিয়ে রাখো কোথাও। এর মধ্যে আরো কয়েকটি অয়েল পেইন্টিং করেছি।’
ইবাদুর পোর্ট্রেটটা পরখ করেন।
‘কই সই করিসনি… সন তারিখ…?’
‘আঁকিয়ে ছবির পেছনে থাকে। ছবিটাই তো তার পরিচয়। তার স্বাক্ষর। আর সনের কথা বলছিস… ছবির কি সন হয়? এ যে অনন্তকালের। এককাল ছাড়িয়ে অন্যকালের।’
দুই
সুখন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছেন। তাঁর গাঞ্জা সেবনের মাত্রা আজ একটু বেশি হয়ে গেছে। ভরদুপুর। সুখনের মা বাড়িতে নেই। এই সুযোগে বহুদিনের কাজের দুই বুড়ি বুয়া কিচেনের মেঝেতে পড়ে পুরোদস্তুর ঘুম। দুইজন দুই সুরে বা বেসুরো নাক ডাকিয়ে বাড়ি আঙ্গিয়ে তুলেছে। রুবা কলিংবেল বাজিয়ে চলে একটানা। প্রায় ১৫-২০ মিনিট ধরে। হঠাৎ করে তুলনামূলক কমবয়সী বুয়ার জ্ঞান ফিরে এলে ধড়ফড়িয়ে উঠে ছুটে যায় দরজার দিকে। – আম্মাজান বুঝি আইয়া পড়ছে?
দরজা খুলে সে দেখে, রুবা।
‘ও… আপা আপনে। আমি বাথরুমে আছিলাম।’ ভয়ে ভয়ে কৈফিয়ত সাজায় বুয়া।
‘ঠিক আছে… সুখন বাসায়?’
‘দেখি।’
দরজা ঠেলে এসে ঘুরে দাঁড়ায় বুয়া।
‘সুখন ভাই ঘুমে।’
‘কখন ঘুমিয়েছে?’
‘এই তো… কিছুক্ষণ আগেও তো দেখলাম। ছবি আঁকতাছে।’ এবার রুবা এগিয়ে যায়। দরজায় জোরে জোরে আঘাত করে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সুখন নেশার ঘোরে দরজা খুলে দাঁড়ায়।
‘ও রুবা… তুমি। আই অ্যাম সরি… সো সরি…।’
‘আসো।’
সুখনের ঘরে ঢুকে রুবা রুখে দাঁড়ান।
‘আমি তাহলে যাই।’
‘কেন?’
‘কেন… তুমি না প্রমিজ করেছ এসব ছাইভস্ম আর খাবে না।’
‘এই সামান্য…।’ আমতা আমতা করে সুখন। মুখ নামিয়ে মাটির দিকে চেয়ে থাকেন। ঘরের সারা মোঝতে রং-তুলি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একেবারে অগোছালো।
রুবা বুয়াকে ডাকেন। ‘ঘরের মেঝেটা একটু মুছে দাও তো। কী অবস্থা!’
বুয়া ভয় পায়।
‘মিয়া ভাই যে রাগ করে।’
‘না রাগ করবে না। ঝাড়– আর ভিজা কাপড় নিয়ে আসো।’
‘দেখো রুবা আমার ছবি যেন নষ্ট না হয়।’
‘ঘর মুছবে… ছবিতে যাবে কেন?’
‘মেঝেতেও তো ছবি আছে।’
‘না ওসব ধরবে না। আমি দেখছি…।’
বুয়া চলে গেলে রুবা সুখনের ছবি, ঘর, টেবিল একটু গোছগাছ করে আবার আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন।
‘তুমি তো প্রমিজ করেছো… এসব আর খাবে না।’
‘আমি খেতে চাইনি। কিন্তু ওই ইবাদুর… আমাকে নির্লজ্জভাবে আঘাত করলো। অপমান করার তো একটা সীমা আছে। আমি মরমে মরে গেছি একেবারে। আমার দুর্বলতম স্থানে সে হিট করলো…। মনটা আমার খুব খারাপ হয়েছিল বলে…।’
এবার রুবা নিবিষ্ট হয়ে তাঁর সামনে মোড়া নিয়ে বসেন। তাঁর রাগ মিইয়ে আসে খানিকটা।
‘ঠিক বুঝলাম না… তুমি কি বলতে চাচ্ছো?’
‘দেখো সেটা বলার মতো কোনো কথা নয়।’
রুবা কিছুটা সময় চুপচাপ বসে থাকেন। তিনিও বিভ্রান্তিতে পড়ে যান। এ অবস্থায় আর কী বলা যায় ভেবে পান না সহসা।
সুখন অসহায়ের মতো রুবার দিকে চেয়ে থাকেন। রুবা এবার আক্রমণাত্মক না হয়ে সমবেদনশীল হয়ে পড়েন। নরম বিনীত সুরে আবার প্রসঙ্গটা ওঠান।
‘একটু খুলে বলোই-না ব্যাপারটা কী।’
‘এসব তো আমি ছেড়েই দিয়েছিলাম। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর খাবো না এসব; কিন্তু সে যে আমাকে অপমান করেছে… চরম অপমান…।’
নিদারুণ চাপা কষ্ট থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আজ আমি …।’
‘দেখো ব্যাপারটা খুলে না বললে আমি কীভাবে বুঝবো? কী হয়েছে তোমার? এত ভেঙে পড়লে কেন?’
‘দেখো রুবা এ কথা বলা যায় না।’
‘তুমি যদি না-ই বলো তাহলে আমি চলে যাই। আমার বসে থেকে আর লাভ কি?’
‘না বসো। বলছি…’
আমতা আমতা করে সুখন।
ইবাদুল বলে, ‘আমার পুরুষ মানুষ হয়ে জন্মানোর কোনো অর্থ হয় না। কারণ একজন পুুরুষ, পরিপূর্ণ পুরুষ মানুষ জীবনে যা যা করে থাকে তা নাকি আমার জীবনে হয়ে ওঠেনি। একান্ত নারীসঙ্গ আমি পাইনি কোনোদিন।’
রুবা স্নিগ্ধ-শান্ত হেসে উঠে দাঁড়ান।
‘আমার মনে হয়, এটা পৃথিবীর সহজতম কাজের একটি। এ নিয়ে…।’
রুবা দরজা লক করে দেন। সুখনের সামনে এসে দাঁড়ান। সহজ ভঙ্গিমায় একে একে তাঁর দেহের সব কাপড় খুলে ফেলেন।
সুখন চোখ নামিয়ে নেন। রুবা থুতনি ধরে তাঁর মুখ নিজের দিকে তুলে ধরেন। সুন্দর করে হাসেন।
‘দেখো… না দেখলে… ছবি আঁকবে কেমনে?’
সুখন দেখেন নিরাভরণ রুবাকে। দেখেন, যৌবনের মাধুর্যে প্রস্ফুটিত ভরাদেহী এক নারীর অপরূপ সৌন্দর্য-রহস্য। সলজ্জ চোখ আবার অবনমিত হয় তাঁর।
রুবা আরো এগিয়ে আসেন। তাঁর সাগ্রহ ভালোবাসার উষ্ণতামাখা চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেন সুখনের দেহ, তাঁর পুরো চেতনা-সত্তা। অন্তরের অন্তস্তল।
সুখন অনাবিল সুখের অন্ধ-আবেশে জড়িয়ে ধরে রুবাকে।
তিন
সুখনের মা ইবাদুরকে ডেকে পাঠান। সন্ধ্যার পরপর ইবাদুর তাঁদের বাসায় যান। সুখন বাসায়ই ছিলেন। তিনি একটা নতুন ক্যানভাস বসিয়েছেন ইজেলে। তিনি প্যালেটে অয়েল রং মেশাচ্ছেন মনোযোগী হয়ে।
ইবাদুরকে দেখে সুখন হাসেন।
‘শালার পুত এতদিন পরে!’
‘তোরও তো দেখা নেই কয়েকদিন।’
‘হ্যাঁ… ছবি নিয়ে একটু ব্যস্ত…।’
‘খালাম্মার সঙ্গে দেখা করে আসি।’
সুখনের মা ইবাদুরকে নিয়ে দরজা টেনে বসেন।
‘দেখো বাবা আমি এক মহাবিপদে পড়েছি। তুমি কি রুবাকে চেনো?’
‘না।’
‘কেন সুখন তোমাকে কিছু বলেনি?’
‘না তো!’
‘সেই এক সংকট। মেয়েটি কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। যখন-তখন চলে আসে বাসায়। বলা নাই কওয়া নাই। নির্লজ্জ মেয়েমানুষ…’
‘কই সুখন তো আমাকে কিছু বলেনি।’
‘মেয়ের নাম রুবাবা তাহসীন কবীর। মায়ের নাম তাহসীন, বাবার নাম কি কবীর না জানি। রুবার মতে, তার নামের সঙ্গে মাও থাকবে, বাবাও থাকবে। কিন্তু মা-বাবার খবর নাই, ঠিকানাও নাই। সুখনের ছোট খালার কাছে প্রস্তাব দিয়েছে, সে সুখনের টেক কেয়ার করবে। প্রয়োজনে তাকে সে জীবনসঙ্গী করতেও প্রস্তুত।… দেখো তো বাবা কি অলক্ষুণে কথা!’
একটু থেমে তিনি বুয়াকে চা বানাতে বলেন।
‘দেখো তো বাবা কি নির্লজ্জ মেয়ে… মেয়ে কোনোদিন এমনি সরাসরি বলে। জাত-পাতের কোনো খবর নেই। অথচ সুখনের মা-বাবা দুপক্ষই তো জমিদার… একজন মঠবাড়িয়ার জমিদার…। সুখনের বাবা ছিলেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার। অকালে মারা গেছেন।’
‘এই মেয়ে এখানে এসে ঢুকলো কোন সূত্রে?’
‘ওই এয়ারপোর্ট। তার ছোট মামা মারা গেল না সিঙ্গাপুরে… মাসখানিক হয়। তার কফিন আনতে আমরা গিয়েছিলাম। সঙ্গে সুখনও ছিল। রুবা মরদেহ, এর কাগজপত্র, ফর্মালিটিস সারতে সাহায্য করছিল নিপুণতার সঙ্গে। এখন গ্রাউন্ড ম্যানেজমেন্টে কাজ করে সে। আগে বিমানবালা হিসেবে আন্তর্জাতিক রুটে যাওয়া-আসা করতো।’
একটু থেমে আবার বলে যান খালাম্মা।
‘আমারই ভুল হয়েছিল, আমার ভাইয়ের চল্লিশাতে রুবাকে ডেকেছিলাম। সেও সাগ্রহে এসেছিল। মিলাদ শেষে সুখনের ঘরে সে ছবি দেখতে যায়। আর এই যে ছবি দেখা শুরু হলো… তা আর শেষ হয় না। যখন-তখন তার আসা-যাওয়া… আর আসা-যাওয়া থেকে এ বাড়ি দখলের চেষ্টা। একমাত্র ছেলে আমার. অগাধ সম্পত্তির মালিক।’
ইবাদুর চা খেতে খেতে সব শোনেন। তিনি ছোট ঘর থেকে বড় হয়েছেন। শহরে শিকড় গেড়েছেন অনেক কষ্টে। তাঁর জীবনের একের পর এক উতরানো পরিচ্ছেদগুলো সহজ ছিল না কখনো। সুতরাং তাঁর বাস্তব দৃষ্টিতে রুবা-সুখনের ব্যাপারটা খুব একটা অশুভ মনে হয়নি। সুখন বড়লোকের ছেলে, হেঁয়ালি-খেয়ালি মানুষ। তাঁর সাংসারিক হওয়া বা নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কোনো লক্ষণ নেই। তাঁর ওপর শখের আঁকিয়ে। গাঁজা-ভাং-ড্রাগের অভ্যাস…। ইবাদুর ভাবে, সনাতনী প্রথায় তাকে তো বিয়ে দেওয়াও যাবে না। সমাজের চোখে কি সে স্বাভাবিক? আর যেখানে মেয়েটি চাকরিজীবী… বিমানবন্দরের চাকরি, সে সাবলম্বী। নিশ্চয়ই ভালো বেতন পায়। সেখানে সব দেখেশুনে মেয়েটি এগিয়ে এসেছে। এমন করে খুব কম মেয়েই আসবে। পুরো ইস্যুটা তিনি ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেন। খালাম্মা মেয়েটি সম্বন্ধে সব নেতিবাচক কথা বলে গেলেও সুখনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হিসেবে, তাঁর শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে ইবাদুর কিছু বলার চেষ্টা করেন,
‘দেখেন খালাম্মা, মেয়েটিকে আমি দেখিনি। সুখনও আমাকে কিছু বলেনি। যদিও রুবার পারিবারিক মান-মর্যাদা আপনাদের সমকক্ষ নয়, তা আমি জানি।… তারপরও তো সে সাবলম্বী, ভালো একটা চাকরি করছে।’
খালাম্মা প্রায় লাফিয়ে ওঠেন।
‘ভালো চাকরি? বিমানবালা। জাত বেশ্সা…।’ তিনি রাগে কাঁপতে থাকেন।
‘খালাম্মা বসেন। শান্ত হন। সুখন আমার বন্ধু হলেও সত্য হলো, তাঁর জীবনধারা তো স্বাভাবিক নয়। আপনি যেখানেই মেয়ের খোঁজে যাবেন তাঁরাও খোঁজখবর নেবে। সুখনের ঘর-সংসারী হওয়ার বয়স হয়েছে।’
খালাম্মা ধমকে ওঠেন।
‘ইবাদুর থামো। তোমরা সব এক জোট হয়েছো। আমার সর্বনাশ করার জন্য সবাই উঠেপড়ে লেগেছ।’
খালাম্মা ইবাদুরকে ছেড়ে অন্য ঘরে চলে যান। যেতে যেতে কান্না জুড়ে দেন।
চার
মাস কয়েক পরের ঘটনা। দুপুর গড়িয়ে গেলেও সুখনের ঘরের দরজা বন্ধ। এটা এমন অস্বাভাবিকও নয় এ-বাড়ির লোকজনের কাছে। সুখন প্রায় সারারাত জাগে, ছবি আঁকে আর দুপুর পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমায়। তারপরও বুড়ি বুয়া অভ্যাসবশত তাঁর বন্ধ দরজায় দু’একবার ঘা দিয়ে গেছে। সুখন দরজা খোলেননি।
রুবা এসে বিস্ময় প্রকাশ করেন। সামনে পাওয়া বুয়াদেরকে কিছুটা তিরস্কারের ছলে বলে যেতে থাকেন,
‘এটা কেমন করে হয়। বেলা দুটো বাজতে চললো…।’
সুখনের মা খাওয়ার পর বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।
‘তুমি আবার কোত্থেকে? মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি। আমি তো মরে যাইনি…।’
তারপরও কটূক্তির অপমান সয়ে সুখনের বন্ধ দরজায় দু’চারবার আঘাত করেন রুবা। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই।
নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করেন রুবা। একটু সরে গিয়ে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে গিয়ে বসে থাকেন। পুরো মুখমণ্ডলই নয় শুধু, তাঁর পুরো দেহরেখায় উৎকণ্ঠা ও অনাদরের প্রচ্ছন্ন কালিমায় লেপ্টে তাঁকে অসহায়, বিব্রত দেখায়।
পার হয় আরো ঘণ্টাখানেক। বসার ঘরের পশ্চিমের জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে তেজি নয়, মিইয়ে আসা কোমল রোদ ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। সেই আলোতে রুবা দেখেন ফ্যানের বাতাসে পাক খেতে থাকা ধুলোর কুণ্ডুলী। আর সেই আলোয় কিঞ্চিৎ আলোকিত ঘরে দেখে তিনটি ছবি। একটি ফুটফুটে হলদে শর্ষে ক্ষেতে ফিঙে, এর বিভক্ত লেজ উঁচিয়ে রেখেছে। আর দ্বিতীয়টি ভৌতিক একটি গলাকাটা মুখমণ্ডল। মুখে ছড়ানো অয়েল রঙের নানামুখী প্রলেপ। অনেকটা বিমূর্ত ভয়াল কার্টুনের মতো। আর শেষেরটি একটি প্রায় বিবস্ত্র নারীদেহ। এই দেহের সর্বাঙ্গে, পরতে পরতে দুর্লভ বর্ণচ্ছটার অপূর্ব বিচ্ছুরণ। সারাদেহে স্নিগ্ধ-কোমল মোমের আলো-আঁধারি স্বপ্নীল আবেশের গভীরতম সৌন্দর্য প্রকাশের আদি রহস্যে ঘেরা। দরদ মিশিয়ে প্রাণ দিয়ে আঁকা এক ছবি।
হঠাৎ করে রুবা সলজ্জ এক অনুভূতি নিয়ে যেন বিভ্রমে পড়ে যান। রুবার মনে হতে থাকে, এ-নারীদেহ কল্পনার সময় সুখনের মাথায় ছিল তাঁরই প্রতিকৃতি, তাঁরই উন্মুক্ত দেহ। এর প্রমাণস্বরূপ তিনি দেখেন, নারীদেহের স্তন দুটি বেশি দৃশ্যমান, উদ্বেলিত। আর এর বোঁটা কালো জামের মতো তেলতেলে উজ্জ্বল।
রুবার মনে পড়ে, যা সুখনকে খুব আকর্ষণ করেছিল।
দূরে আসরের আজান ধ্বনিত হতে থাকে। সুখনের মা দরজা খোলেন। বেরিয়ে আসেন। বিরক্ত হয়েই বলেন, ‘রুবা তুমি এখনো বসে আছে! আশ্চর্য…। ওর ওঠা সে উঠবে। তুমি যাও।’
রুবা উঠে গিয়ে আবার দরজায় আঘাত করেন। কোনো সাড়াশব্দ নেই।
রুবা এবার সুখনের মার সামনে এসে দাঁড়ান।
‘আমি দরজা ভাঙবো। বুয়াদের ডাকেন। শাবল এনে দেন।’
‘কি বলে?’ এবার মাও যেন ঘাবড়ে যান।
‘চারটা বেজে গেল।’ বুয়াদের ডাকেন তিনি।
দরজা ভাঙা পর্বে একটু হই-হট্টগোল, ধুম-ধারাম শব্দ হলেও দরজা খুলে গেল একসময়। আর উপস্থিত সবাই দেখে, সুখন উপুড় হয়ে পড়ে আছেন মেঝেতে।
রুবা দৌড়ে গিয়ে সুখনের হাত তুলে পালস দেখেন। সুখন সম্পূর্ণ অজ্ঞান। অনড় তাঁর দেহ।
রুবার সঙ্গে বিমান সংস্থার মাইক্রোবাস ছিল। ফোনে তিনি ড্রাইভারকে ডাকেন।
রুবা, ড্রাইভার, বুয়ারা সবাই মিলে সুখনকে উঠিয়ে হাসপাতাল অভিমুখে রওনা দেন।
‘খালাম্মা সবাইকে ফোনে ডাকেন। সুখনের অবস্থা খারাপ… আপনারা আসেন। সবাই…’
ডাক্তারদের অক্লান্ত চেষ্টায়, সুখনের নাড়ি সচল হলো, কিন্তু জ্ঞান ফিরলো না। আইসিইউ-তে তাঁর অবস্থান। ডাক্তারদের অভিমত : এ যাত্রায় রোগী বেঁচে গেলেও বড় ধরনের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেছে হয়তো। সে তো ডায়াবেটিক ছিল… সুগার লেভেল নেমে গিয়েছিল একেবারে। ডায়াবেটিক কোমা…। দেখা যাক কতদূর কী করা যায়?
সুখন মাসেক তিনেক পরে বাড়ি ফেরেন। হুইল চেয়ারে। তবে একেবারে চৈতন্যহীন। ব্রেইন-ডেড…। চার-চারটা শক্ত সমর্থ ছোকরা চাকরের তত্ত্বাবধানে সুখন বেঁচে থাকেন। পাকস্থলী ফুটো করে খাবার সাপ্লাই হতে থাকে। মা চেয়ে চেয়ে দেখেন, সুখন হুইলে চলছে-ফিরছে। চারপাশের সব দেখছে।
ইবাদুর এলে সুখনের মা অভিযোগ করেন, ‘দেখো তো বাবা, চেয়ে চেয়ে সব সে দেখে। চলাফেরা করে। কিন্তু কথা বলে না কেন?’
ইবাদুর টের পায়, মারও সময় ঘনিয়ে এসেছে।
রুবা একদিন এসে বেশিক্ষণ থাকেননি। সুখনের হুইল চেয়ার বরাবর দাঁড়িয়ে তাঁর চোখে চোখ রেখে কেঁদে ফেলেছিলেন।
‘আমি তাঁকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। ভালোবাসা দিয়ে। পারলাম না…’
সুখনের মা উঠে দাঁড়ান।
‘মা বসো। একটু বসো। তুমি কাছে-কিনারে থাকলেও মনে হয়, সুখন এই বুঝি কথা বলে উঠবে। হাসবে…।’
রুবা ঘুরে দাঁড়ায়।
‘আমি আসি। এ দৃশ্য দেখতে আমি আর কোনোদিন আসবো না। এ-বাড়িতে…।’
রুবা চলে যায়। আঁচলে চোখ চেপে। সুখনের মা দিশেহারা হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পেছন থেকে রুবাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেন। ততক্ষণে বিমানের মাইক্রোবাস অনেকদূর চলে গেছে।
এরপরের ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটে গিয়েছিল। সুখন মারা যাওয়ার এক মাসের মধ্যে মাও চলে যান। ইহলোক ছেড়ে।
পাঁচ
এমন সিদ্ধান্ত জীবনে কমই নিয়েছে ইবাদুর। নিজেকে তিনি সামান্য চিন্তাভাবনা বা প্রস্তুতির সময় দেয়নি। সকালে পত্রিকার পাতায় অ্যাডটা দেখে তিনি টেলিফোন রিসিভার তুলে নেন হাতে। কথাও বেশি বাড়াননি। বুকিং দিয়ে দেন। আগামীকাল রাত এগারোটায় এসি কোচ ছাড়বে। পান্থপথ থেকে। পরদিন সকালে নাস্তা খুলনা থেকে সুন্দরবনগামী স্টিমার ‘বৈকালী বিলাসে’। সেটাতে সব আয়োজন থাকবে। চারদিন, তিন রাতের জন্য বরাদ্দ রয়েছে নিজস্ব কেবিন, থাকা-খাওয়া-নাওয়ার পুরো আয়েশি বন্দোবস্ত।
এই ঈদের ছুটিতে ইবাদুর ঢাকা থাকতে চাননি। ঢাকা ছেড়ে তিনি অন্যত্র কোথাও যেতে চেয়েছিলেন। একাকী, নিরিবিলি। সেই সুযোগ পেয়ে গিয়ে ভারমুক্ত মনে রোমাঞ্চিত বোধ করেন তিনি। ইবাদুর যেন কল্পলোকে চলন্ত স্টিমারে বসে দেখতে থাকেন, গোলপাতা আর সুন্দরী বনভূমির গভীর বিস্তার। সবুজের সীমাহীন সমারোহ। বনাঞ্চলের মাথা ছোঁয়া রোদে ভরা নীলাকাশে দু-একটা সাদা গলার চিল-পক্ষির স্থির ভাসমান অস্তিত্ব। মোহনা সাগরজলের জোয়ার, না হয় ভাটির টান। চলমান স্রোতের নেশা ধরা লোনা জলের উথালি-পাথালি। হঠাৎ হঠাৎ ঘোলাটে জলে ছুটে যাওয়া দু-এক গোছা কচুরিপানা। সুতাকাটা ঘুড়ির মতো।
তখন তাঁর মনে হয়, অনেক কিছু থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন বেশ কিছুদিন। গ্রামগঞ্জে শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে বড় হলে বোধকরি, সময়-অসময়ে গাছগাছালি, বনজঙ্গল, নদীনালা কাছে যেতে টানে। ছুটে যেতে ইচ্ছে করে সেইসব গহিন দূরদূরান্তে, বিলঝিলের ধারেকাছে।
আবার এর সঙ্গে দু-একজন অতিকাছের বন্ধু-বান্ধব, আপনজনের কথাও খুব মনে পড়ে। যাদের উপস্থিতি এসব, এমন কল্পনাবিলাস নয়তো কোনো অজানা যাত্রার সঙ্গী হলে পুরোটা আরো উপভোগ্য হতে পারতো।
কিন্তু সে যে যুগ হবে হয়তো, হারিয়ে গেল চিরদিনের মতো। আজ তাঁর সুখনের কথা মনে পড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁরা তো প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই একসঙ্গে থাকতো। গল্পে-আড্ডায়, কখনো তাঁরা রবীন্দ্রনাথের পুনশ্চের কবিতা আউড়িয়ে, কিংবা দু-এক লাইন গান গেয়ে কাটিয়ে দিতো সময়। তাঁর প্রিয় উদ্বৃতি ছিল, ‘তুমি তো কৃপণ নও বিধাতার মতো…।’
সুখনের আকস্মিক মৃত্যু তিনি এখনো সহজভাবে নিতে পারেননি। পাশ দিয়ে ইবাদুরকে ব্যাংকে চাকরি নিতে হয়। সুখন বনেদি ঘরের অবস্থাপন্ন ছেলে। তিনি কোনো কাজ নিলেন না। এতে তাঁর ইচ্ছা বা প্রয়োজন কোনোটাই ছিল না। তিনি গোঁ ধরলেন, ছবি আঁকবেন। বড় শিল্পী হবেন। তাঁর বক্তব্য : পৃথিবীর তাবৎ বড় শিল্পী নিজে শিখে কাজ করেছেন। গতানুগতিক স্কুল করেননি। সুতরাং তাঁর দরজাও খোলা। তাঁর মা-বোনেরা অবশ্য এমন সিদ্ধান্তে বাদ না সাধলেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। মার একটাই তো ছেলে। বাবা প্রয়াত। তাঁর ইচ্ছে ছিল একমাত্র ছেলে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে।
সুখনের এই নির্মোহ হেঁয়ালি সিদ্ধান্তে একসময় ইবাদুর টের পেলেন তিনি তাঁকে হিংসা করেন। বিশেষ করে, দিনে দশ-বারো ঘণ্টা পাঁচ-দশ টাকার হিসাব মিলিয়ে তাতেও প্রিন্সিপাল অফিসারকে খুশি করতে না পেরে তেতো মন-মানসিকতা নিয়ে ঘরে ফিরে, তাঁর মনে হতো, এ কেমনতর জীবন। অন্যদিকে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা সুখন কেমন মুক্তজীবন… পাখা মেলা বিহঙ্গের মতো স্বাধীন… উড়ে বেড়ায় যেথা যখন ইচ্ছা…!
এটা হাল আমলের বিশেষ করে ঢাকাবাসীর একটা ফ্যাশনে দাঁড়িয়ে গেছে। ঈদ পরবে ছুটিছাটা হলে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যায় অনেকে। তারা চলে যায় মালয়েশীয় দ্বীপপুঞ্জে, সিঙ্গাপুর, ব্যাংককে। কমপক্ষে গোয়া-দিল্লি-কলকাতা তো আছেই। যারা বেশি নাড়াচাড়া করতে চায় না, তারা ঢাকার পাঁচতারা, নিদেনপক্ষে কোনো তিনতারা হোটেলে আশ্রয় নেয়। কোলের শিশু থাকলে বুয়া-আয়াও তাদের সঙ্গী হয়। এসব হোটেলের সুইমিংপুল-জিম, উৎসবমুখর ডাইনং হলের বৈচিত্র্যে ভরা বুকে মেন্যুর অগণিত আইটেম… আনন্দ অনুষ্ঠানে সময় মন্দ কাটে না তাদের।
ওপরতলার এই ফ্যাশনদার, কেতাদুরস্ত অভিজাত প্রতিনিধিদের সংগত অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো : কোরবানির ঈদের পরবর্তী কয়েকটা দিন ঢাকা শহর বসবাসের যোগ্য থাকে না। রাস্তাঘাটে বের হওয়া যায় না। পচা রক্ত আর গরু-ছাগলের নাড়িভুঁড়ির গন্ধে টেকা এক দুরূহ ব্যাপার।
ইবাদুর এদের কোনো দলেরই প্রতিনিধিত্ব করেন না। তাঁর সেই সব অভিযোগের কোনোটাই নেই।
ছন্দা দেড় বছর হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৃত্তি নিয়ে নরওয়ে গেছেন। ইবাদুর তাঁর মাকে নিয়ে মোটামুটি চলছিলেন একরকম। বাবা নেই অনেকদিন হয়। মাস তিনেক আগে হঠাৎ মা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া গেলো না বয়োজনিত কারণে। দিন-তিনেক আইসিইউ-তে থেকে বিদায় নিলেন মা। ছন্দা তখন চলে আসতে চেয়েছিলেন। ইবাদুর বাধা দেন, ‘এমএস-টা অন্তত শেষ করে আসো। বছরখানেকের ব্যাপার। টিচিংয়ে থাকতে হলে…।’
বেশ পুরানো এক বুড়ি বুয়াকে নিয়ে ইবাদুর চলছিলেন কোনোমতে। তাঁর ব্যাংকের চাকরি। রাত করে ঘরে ফেরা, সকাল সকাল আবার বেরিয়ে যাওয়া। দূরের পথ ভাঙতে হয়। শুক্র-শনি অবশ্য তাঁর একান্ত অবসর। পড়ে পড়ে ঘুমানো আর সপ্তাহান্তে সামান্য বাজার-সওদা করা… এই তো…। না হয় পত্রিকা পড়া।
ছয়
সময়মতো বাস ছেড়ে দেয়। ঢাকায় যতটা না, চলতি বাস ঢাকা শহর-গণ্ডি ছাড়িয়ে গেলে ইবাদুর একটু একটু শীত অনুভব করেন। অক্টোবরের শেষাশেষি, তা তো হওয়ারও কথা। তিনি আয়েশি হয়ে, দুই ঢোক পানি গিলে তাঁর বাসের সিটটি পেছনের দিকে হেলিয়ে দেন। কম্বল টেনে সটান শুয়ে পড়েন। সবকিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে দুচোখ বন্ধ করেন। ঘুমিয়ে, ভেঙে যাওয়া ঘুম আবার জোড়া লাগিয়ে, এ-কাত সে-কাত করে রাত কাবার করেন তিনি।
ভোর ৭টা ৩০ মিনিটে বাস এসে থামে খুলনার স্টিমার ঘাটে। একে একে যাত্রীরা নামে। তেমন তাড়াহুড়া নেই কারোর। ইবাদুর নামেন সবার শেষে। তাঁর সঙ্গে লাগেজপত্র তেমন নেই। শুধু একটা ব্যাকপ্যাক।
ইবাদুর এদিক-সেদিক তাকান। ভৈরব নদীতে নোঙর করা স্টিমার ঘাটায় তাঁদের স্টিমার ‘বৈকালী বিলাস’ সহজেই তাঁর দৃষ্টির সীমানায় এসে যায়। নানা নামের নানা ধরনের ছোট-বড় স্টিমারের মধ্যে তাঁদের জলযানটি বিশিষ্ট বলেই মনে হলো ইবাদুরের।
ভ্রমণ কোম্পানির লোকজন এগিয়ে এসে যাত্রীদের বৈকালী বিলাসে নিয়ে যার যার কেবিন-চাবি বুঝিয়ে দিয়ে নাস্তা খাওয়ার বিনীত আমন্ত্রণ জানায়।
হাত-মুখ ধুয়ে ইবাদুর ডাইনিং টেবিলের এক কোনায় জুতসই বসে যান। সেখান থেকে অন্যান্য স্টিমার লঞ্চের ফাঁক দিয়ে দেখেন, আসন্ন শীতের ভোরের ধোঁয়াটে আকাশ, অশান্ত ভৈরব নদীর জল। ছোট-বড় ডিঙি নৌকার যাত্রী ওঠানো-নামানো, পারাপারের ব্যস্ততা। শোনেন মাঝিদের হাঁকডাক।
লোকে বলে নদীর ওপরকার খাবার নাকি সুস্বাদু হয়। মুখে লেগে থাকে। গরম-গরম ময়দার পরোটা ও সযতনে পরিবেশিত লাব্রা গোছের নিরামিষ, সাথে ডিম অমলেট খেতে খেতে তাঁরও তাই মনে হলো। ভদ্রগোছের শার্ট-প্যান্ট পরা খাদ্য পরিবেশক জানিয়ে গেল, কোনার টেবিলে চা-কফির আয়োজন রয়েছে।
কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে পরিতৃপ্ত হন ইবাদুর। ধীরেসুস্থে ওপরে উঠে যান। কেবিনে না গিয়ে তিনি পুরো স্টিমারটা ঘুরেফিরে দেখেন। তিনি নিচের তলা থেকে তেতলার খোলা ডেক পর্যন্ত ধীরে ধীরে হেঁটে বেড়ান। তিনতলার ডেকের একটা অংশের ওপরে তার্পুলিন-চাঁদোয়া টাঙানা। নিচে প্লাস্টিকের শোভন চেয়ার-টেবিল। এছাড়া গোটা দুই-তিন সোফা ডিভানও রয়েছে। যাত্রীদের আরামের উপকরণ হিসেবে।
আচমকা তীক্ষ্ণ সিটি বাজিয়ে স্টিমার ছেড়ে দেয়। ইবাদুর দোতলার দক্ষিণ বারান্দার পশ্চিম দিকে চেয়ার টেনে বসেন। ভোরের সূর্যের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে ধীরে ধীরে। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপ্টা তাঁর চোখেমুখে লুটোপুটি খায়। তাঁর শরীরে নেশাধরা ঘুমের আমেজ এসে ভর করে। গত রাতের অপূর্ণ ঘুম। বসে থাকতে পারেন না। স্বল্প পরিসরের কেবিনের বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েন ইবাদুর।
দুপুরের দিকে উঠে ইবাদুরের মনে হলো, খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর এও মনে হলো, একটা গোসল দিয়ে নিতে পারলে শরীরটা ঝরঝরে লাগবে। বাথরুম মোটামুটি গোছানো, আধুনিক বলা চলে। শাওয়ার ছেড়ে তিনি আরো উৎফুল্ল হলেন। ট্যাপের পানি ঠাণ্ডা নয়, বরং ঈষদুষ্ণ। তিনি ঠোঁটে-মুখে লোনা পানির অভিনব স্বাদ অনুভব করেন। হালকা গরম লোনা জলে আরামদায়ক স্নান। তিনি ধরে নেন, দুপুরের সূর্যতাপে সাগর জলের উপরের স্তর গরম হয়ে উঠেছে। ইবাদুর উৎফুল্ল হয়ে অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে শাওয়ারের জলে মেলে ধরে রাখেন। এতে তাঁর শরীরে এক ধরনের আরাম বোধ জেগে থাকে।
মধ্যাহ্ন ভোজনের আয়োজনও চমৎকার। বেশির ভাগ যাত্রী খেয়ে গেছে। নাস্তার আসরেই সুপারভাইজার জানিয়ে দিয়েছিলেন, আজকের মেন্যু। দুপুরে ডুবো তেলে চান্দা মাছ ভাজা, রাতে মুরগি কারি। সঙ্গে তো ভর্তা-সবজি-ডাল থাকবেই।
তৃপ্তি সহকারে নিয়মের চেয়ে একটু বেশি খেয়ে ইবাদুর দোতলার ডেকের পাশে চেয়ার টেনে বসেন। দুপাশের সাগরজলের সীমানা-পরিসর যথেষ্ট বেড়েছে। বোঝা যায়, ভৈরব-রূপসা নদী পেরিয়ে তাঁরা সাগরের বিস্তারের দিকে এগিয়ে চলেছেন। গোলপাতা আর সুন্দরী বনাঞ্চল ঝাপসা হয়ে আসছে। সূর্য পশ্চিমে ঢুলতে শুরু করেছে। সাগরের উত্তল-অবতল জোয়ারি জলের ঘোলাটে ঢেউয়ে সূর্যরশ্মির তেজি বিচ্ছুরণ খেলা করে চলেছে। প্রকৃতির নিজস্ব খেয়ালখুশিমতো। স্বচ্ছ নীলাকাশে ভেসে আছে সাদা-গলার চিল। দু-একটা কাকও।
যাত্রীদের অনেকে বাইনোকুলার ক্যামেরা নিয়ে তৈরি। কেউ কেউ হল্লা করে উঠছে… ওই যে হরিণ… ওই যে পাড়ে নেমে পানি খাচ্ছে।
রাতে ইবাদুর লঞ্চের তিনতালার ডেকে গিয়ে বসেন। ওপরে ছাদ নেই। বাতাসের তোড় প্রচণ্ড তেজি। যেন ছিটকে ফেলে দেবে নিচে, সাগরজলে। ডেকের মাঝখানে চেয়ার টেনে সাবধানী হয়ে বসেন তিনি। নিচে সাগরজলের উথালি-পাথালি ঢেউ। মাঝি-সারেঙের হল্লা। শোনা যায়, জোয়ার ও হালকা ঝড়ের সম্ভাবনার কথাবার্তা। চারিদিক অন্ধকার। চতুষ্পার্শ্বে কোনো আলোবাতির দৃশ্য চোখে পড়ে না। অর্থাৎ এ অঞ্চলে কোনো বসতভিটা নেই। লোকালয় ছাড়িয়ে এ-যাত্রা। ইবাদুর ওপরে চেয়ে বিস্ময়াভিভূত হয়ে থাকেন। আকাশে পূর্ণ চাঁদ আর লক্ষ তারার মেলা। এত তারা একসঙ্গে তিনি কোনোদিন দেখেননি। চাঁদ-তারার এই সীমাহীন বিস্তরণের মাঝখানে বসে থেকে তাঁর মনে হতে থাকে, মানুষের জীবন বিশাল আর এই অনুভূতি-জগতের পরিব্যাপ্তি অসীম। ইবাদুরের শহুরে সংকীর্ণ ছাপোষা জীবনের পরিমণ্ডল বিস্তৃত হয়ে যেতে থাকে তাঁর অগোচরে। জীবন হয়ে উঠতে থাকে সুখানুভূতির সীমানায় অর্থবহ। হঠাৎ করেই তখন সুখনের কথা মনে হয় এবং তখন নিদারুণ কষ্টে তাঁর বুক চিনচিনিয়ে উঠে। তাঁর মনে হতে থাকে, সুখন নিশ্চয়ই এমন রাতের পরিবেশে আউড়ে যেত,
‘হঠাৎ খবর পাই মনে,
আকবর বাদশার সঙ্গে
হরিপদ কেরানির কোন ভেদ নেই।’
আজ দিনভর পথে যাত্রীরা নৌকা ভিড়িয়ে এ ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য এলাকা কটকা, করমজল, কচিখালী ঘুরে দেখেন। নৌকাযোগে যাত্রীরা সবাই না হলেও অনেকে ছড়ার ভেতরের বনজঙ্গলে ঢুকে পড়েন। ইবাদুরও নৌকায় পার্শ্বভ্রমণে শরিক হয়ে বনজঙ্গলের ভেতরের খানিকটা দেখে এসেছেন।
পরদিন খুলনা ফেরার পালা। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে কেবিনে একটু গড়াগড়ি দিয়ে দোতলার ডেকে এসে বসেন ইবাদুর। চোখ মেলে তিনি সাগরজল, গোলপাতা, সুন্দরী বনের বিস্তার দেখতে থাকেন শেষবারের মতো। তখন চেয়ার টেনে এক সুশ্রী ভদ্রমহিলা তাঁর সামনে এসে বসেন।
‘আমি রুবা। আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। ইচ্ছাও হয়নি। একবার রাস্তায় সুখনের সঙ্গে আপনাকে দেখেছি। আপনি ইবাদুর না।’
ঘটনার আকস্মিকতায় তাঁর স্বর ক্ষীণ হয়ে আসে।
‘জি।’
কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ভাব নিয়ে ইবাদুর উঠে দাঁড়াবে না বসে থাকবে ভাবতে গেলে রুবাই সমাধান দেন।
‘উঠতে হবে না। বসেন…। আপনি সুখনের অতি নিকটজন হয়েও তাঁকে নির্মমভাবে আক্রমণ করেছিলেন একদিন। তাঁর ব্যক্তিসত্তা, তাঁর জীবনের এক অসফল অধ্যায় নিয়ে যে অশোভন কটূক্তি করেছিলেন তাতে সুখন খুব সাফার করেছিলেন। তিনি নেই, তাঁর সেই কষ্টের বোঝা কিছুটা হলেও আমাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এবং বয়ে বেড়াবোও। নিরীহ মানুষটিকে আমি ভালোবেসেছিলাম…।’
রুবা চলে যান চেয়ার ছেড়ে। ইবাদুর এগিয়ে গিয়ে রুবাকে থামাতে ব্যর্থ হন।
ইবাদুরের মাথায় যেন সাগরজলের ওপরকার পুরো ফিকে আকাশটা ভেঙে পড়ে। তাঁর মনে হতে থাকে, হ্যাঁ ঠিকই তো কোনো এক অসতর্ক নয়, সতর্ক মুহূর্তে হয়তো বা স্বভাবসিদ্ধ সাধারণ মানুষের প্রবৃত্তি নিয়ে, তাঁর মুক্ত সুন্দর সৃজনশীল জীবনের প্রতি সংকীর্ন হিংসার বশবর্তী হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাঁর একান্ত ব্যক্তিজীবন নিয়ে অসুন্দর রসিকতা করেছিলেন। করেছিলেন নিষ্ঠুর কটূক্তি।
ইবাদুর ভাবতে থাকেন, এই মুহূর্তে রুবার কাছে তাঁর ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প খোলা নেই। তিনি রুবাকে খুঁজে ফিরতে থাকেন লঞ্চজুড়ে। কিন্তু ইবাদুর তাঁকে কোথাও খুঁজে পেলেন না।
অপরাধবোধ ও রুবাকে না-পাওয়ার হতাশা নিয়ে অনেকটা রাত পার করেন ইবাদুর। একপর্যায়ে তিনি স্টিমার সুপারভাইজারের সাহায্য কামনা করেন।
সুপারভাইজার তাঁকে জানান, তিনি ভিআইপি কেবিনে আছেন। মা অসুস্থ। তাঁকে ডাকা যাবে না।
স্টিমার খুলনার পথে মংলা বন্দরে ভিড়ে গেলে দোতলা থেকে ইবাদুর দেখেন, রুবা বৃদ্ধ মায়ের হাত ধরে স্টিমারের বাঁশ ধরা তক্তা-সিঁড়ি বেয়ে পাড়ে নেমে যান। স্টিমার ছেড়ে দেয়।