বেগম জাহানারার আব্র

শেষ পর্যন্ত সতর্ক পাহারা সত্ত্বেও বেগম জাহানারা যখন খানিকটা সন্তর্পণেই চোখ বন্ধ করলেন, তখন কেউ জানুক না জানুক, তিনি জানতেন এক নাছোড় লজ্জার জ্বালাপোড়া থেকে রেহাই পেলেন।

তখন সকাল। পর্দামোড়া জানালার কাচে কুয়াশাহীন শেষ ডিসেম্বরের কিছুটা স্থবির রোদ। পর্দার ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঘরের ভেতরেও খণ্ড-বিখণ্ড আলো। বিছানায় টানটান শুয়ে বেগম জাহানারার মনে হলো, এই ফর্সা-টাটকা আলোয় তার ঘরটা দুলে দুলে জেগে উঠছে। বিছানা-বালিশ জেগে উঠছে, টেবিলজুড়ে স্তূপাকার ওষুধপথ্য, মাথার ওপর পাহারারত স্যালাইনব্যাগ, নাক-মুখঘেরা অক্সিজেন মাস্ক, রাইস টিউব জেগে উঠছে; আর পাতলা কম্বলের নিচে, বেশ নিচে, বুকের হাড়-চামড়ার গভীরে চঞ্চল শিউরানিতে তিনি নিজেও এক ঘোর ঘোর আলস্য থেকে জেগে উঠছেন। তিনি সচকিত হলেন, চোখ দুটো বুজে ফেলতে চাইলেন। কিন্তু বিচিত্র রশ্মিময় আলোটা তাকে টানছে। চোখ খুলে পরিষ্কার অনুভব করলেন  আলোটা মোটেও মেকি নয়, কারসাজি তো নয়ই। এত টাটকা, যেন স্বাদ-গন্ধময়, আর… আশ্চর্য, এও মনে হলো, এত প্রাণময়! শিউরানিটা জাগছে আবার। বেগম জাহানারা ভাবলেন, কী করেন! পরপরই চুপিচুপি, যেন নিজেকেও জানতে না দিয়ে, ভাবলেন  আর কত!

এতদূর ভেবেছেন কী ভাবেননি, তার চোখে পড়ল জানালার রোদটা হঠাৎই ঝিমিয়ে পড়ছে, এদিকে ঘরের ভেতরে  ছায়া-ছায়া অন্ধকারে আলোর চিহ্ন-টিহ্নগুলো দ্রুত নিভে যাচ্ছে। ছায়া-অন্ধকারে একটা মৃদু ঠান্ডা সুবাস অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে ঘুমপাড়ানি মূর্ছনায় শরীরময় চরে বেড়াচ্ছে। তিনি পষ্ট টের পেলেন ঘুম আসছে এতদিনে লজ্জায় নিজেকে আড়াল করার মতো প্রবল-গহন ঘুম। বেগম জাহানারা নিশ্চিত হয়েই চোখ বন্ধ করলেন। আর খুলবেন না বলে চোয়ালে-চিবুকে অটল দৃঢ়তা নিয়ে শান্ত নিথর হলেন।

মাসপাঁচেক আগে হাসপাতাল থেকে শেষবারের মতো ছাড়া পাওয়ার দিন বেগম জাহানারার যা জানার জানা হয়ে গিয়েছিল। সময়টা সেদিনও সকাল। তার উপস্থিতিতেই চাপা গলায় কথাবার্তা চলছিল ডাক্তার ও তার তিন মেয়ে ফরিদা, সালমা, নাজমার মধ্যে। দরজা-জানালা বন্ধ! কেবিনের নরম আলোয় তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন। বাঁ-হাতে কব্জির নিচে ক্যানোলার ফুটো দিয়ে খুব ধীরে, যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও, বিন্দু বিন্দু ফোঁটায় স্যালাইন যাচ্ছিল শরীরে। নাকে নেবুলাইজারের নড়চড়ে মাস্ক দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাসের ঝাপটায় হেলেদুলে কাঁপছিল। চোখ বন্ধ, নাক-মুখ বন্ধ, কিন্তু কান যে খোলা  কেমোথেরাপির পর ন্যাড়া মাথা ঢাকতে আঁটসাঁট স্কার্ফ প্যাঁচানো সত্ত্বেও খোলা  এ-তথ্যটা কারো মাথায় খেলেনি। বড়-মেজ- ছোট তিন মেয়েকে নিয়ে তিন তিনজন বড়-মাঝারি-ছোট ডাক্তারের কানাকানি চলছিল। খোলা কানে তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন পরিষ্কার। রাখঢাক ছাড়া ডাক্তারদের মধ্যে যিনি বড়, বলছিলেন, আমরা তো সাধ্যমতো যা করার করলাম। আপনারাও কিছু বাকি রাখেননি, যা যা সম্ভব সবই করেছেন। আপনাদের মা বড় ভাগ্যবান, এত সেবা কজন মায়ের ভাগ্যে জোটে! মেয়ে বলেই আপনারা পেরেছেন, ছেলেরা পারে না দেখি তো আমরা। আর আপনি মিসেস ফরিদা, গত দুই বছর ধরে যা করেছেন তার তুলনা হয় না। আমার উচিত আপনাকে একটা সার্টিফিকেট দেওয়া। ট্রেইনড নার্সরাও আপনার ধারেকাছে আসতে পারবে না। দেশে স্পেশালাইজড ক্যান্সার হসপিটাল হচ্ছে, আপনাকে আমি রিকমেন্ড করব স্পেশাল কনসালট্যান্ট করার। ওষুধপথ্যে কি সব হয়! আপনি যা করতে পারবেন তা ওষুধপথ্যের চেয়ে বেশি।

কিসের মধ্যে কী! অন্য সময় হলে বেগম জাহানারা হয়তো বিরক্ত হতেন। নাক-মুখ ঢাকা অবস্থায় তখন বিরক্তি প্রকাশের সময় না; তিনি ভাবলেন, ডাক্তার ফরিদার গুণগান করে নিজের ডাক্তারিবিদ্যার খামতিটা পুষিয়ে দিতে চাচ্ছেন। তা দিন, তাই বলে ফরিদা না আবার ভেবে বসে চাইলেই সে ডাক্তারদের ওপর টেক্কা দিতে পারে।

দুই বছরের ওপর বড় মেয়ে ফরিদা তার সঙ্গে আছে, লেপটেই আছে। বলা যায় তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো আছে। ঝড়-ঝাপটাগুলো সজাগ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো ঠেকাতে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়েও হাল ছাড়েনি। বিশেষ করে কেমোর পর কিছুদিন আর রেডিয়েশনের পরপর শরীরে নানা উপসর্গ যেভাবে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় নেমেছিল, সেসব সামাল দিতে কী না ও করেছে! ঘুমাত কখন, খেত কখন, আদৌ খেত কি-না, তিনি বুঝতে পারতেন না। এই প্রেশার দেখছে, ব্লাড-সুগার টেস্ট করছে, ঘড়ি ধরে গাদা গাদা ওষুধ খাওয়াচ্ছে, এই বমি পরিষ্কার করছে, ডায়পার বদলে দিচ্ছে, আবার এসবের ফাঁকে হাসি-তামাশাও করছে, গল্প করছে নিজের ছোটবেলার! – কানের কাছে বালিশে নাক ঘষে বলতে বলতে বেখেয়ালে কেঁদেও ফেলছে। ডাক্তারের এত কিছু জানার কথা না। হাসপাতালে তিনি যে কবার ফরিদাকে দেখেছেন, তা থেকেই সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা বলছেন। পুরোটা দেখলে জানলে কী বলতেন!

এ-কথাটা যখন তিনি ভাবছেন, তখন সেই বড়জনের গলা আবার তার কানে। গলার নিচু স্বর আগের চেয়েও নিচু। আর তো কিছু করার নেই, আজই রিলিজ করে দিচ্ছি, ওনাকে বাসায় নিয়ে যান। পরিবারের মধ্যে থেকে তিনি যে কমফোর্ট পাবেন, তা তো আমরা এখানে দিতে পারব না। আত্মীয়স্বজনদের দেখতে পাবেন, আপনারা সবসময় কাছে থাকবেন, শেষ সময়ে এসবই দরকার।

কানের পর্দায় কথাগুলো আটকে স্থির হতে বেগম জাহানারা চমকে উঠলেন। সময় শেষ এজন্য না, ঘোষণা দিয়ে কথাটা মেয়েদের শোনানোর কী মানে! লোকটার কী মাথা খারাপ। একটু আগে ফরিদাকে সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা বলে এইমাত্র  যে-বোমাটা ফাটালেন, তাতে ফরিদা তো ফরিদা, মেজ ও ছোট সালমা, নাজমার ওপর কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা বোঝার শক্তি তো তার থাকা উচিত। নাকি ডাক্তার বলে এসবের ধার ধারতে নেই, সাফ সাফ  বলে ফেলায়ই সুবিধা? রোগীর বাঁচা-মরার ফয়সালাটা আগেভাগে হয়ে গেলে মিথ্যামিথ্যি আশায় বুক বাঁধার দরকার পড়ে না, আশাভঙ্গের ধাক্কাও খেতে হয় না। আর আজরাইল আসার খবরটা আগাম দেওয়ার মধ্যে বুঝি কৃতিত্বও রয়েছে! হ্যাঁ, বেগম জাহানারার মনে হলো কৃতিত্ব ফলাতেই ডাক্তার কায়দা করে কথাটা বললেন। মেয়েগুলো দুর্বল, তার মতো নয়, কঠিন অবস্থায় নিজেদের সামাল দেওয়া ওদের কাজ নয়। তার ভয় হলো, গায়ে গা-ঘেঁষে দাঁড়ানো তিন বোন জড়াজড়ি করে এখনি না ডুকরে ওঠে। চোখ বোজা বলে দেখতে পাচ্ছেন না, কান্নাও শুনতে পাচ্ছেন না, তবে আন্দাজ করলেন গায়ে গায়ে পিণ্ড পাকানো তিনজন দুঃসহ কান্নার দমকে থরথর করছে। তবে বাস্তবে যা শুনলেন তাতে দ্বিতীয়বারের মতো তাকে চমকে উঠতে হলো। ফরিদার, হ্যাঁ গলাটা ফরিদার শান্ত-সুস্থির ফিসফিসে গলায় জানতে চাইল, আম্মার আর কতদিন?

কান দুটো যে কেন হাট করে খোলা, চোখের মতো চাইলেই বুঝে ফেলা যায় না – এই যন্ত্রণা তখন তার মতো আর কে বুঝবে! খোলা বলেই কান যে তার ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল, তিনি পরিষ্কার টের পেলেন। ডাক্তার, সেই বড়জনই – আজরাইলের আগাম সংবাদ দিয়ে ফরিদার কৌতূহল বাড়িয়েছেন – খানিকটা তোতলাতে তোতলাতে বললেন, দিনক্ষণ তো আর বলা যায় না। আপনারা সবই জানেন-বোঝেন, ওনার মেলিগন্যান্সি ধরা পড়েছে লাস্ট স্টেজে – আমরা যাকে বলি প্রোগনোসিস ফোর।  কেমো-রেডিয়েশন দিয়ে কিছুদিন থামিয়ে রাখা গেছে। এখন তো মেটাসটাসিস, ছড়িয়ে পড়েছে। সবচেয়ে ডেলিকেট জায়গা ব্রেনেও ¯েপ্রড করে গেছে। এ-অবস্থায় বেশিদিন…
কতদিন? এবার গলাটা ছোট মেয়ে নাজমার।
ওভাবে কী বলা যায়?
দুই মাস, তিন মাস!
এরকমই।
তার মানে আরো কম – এক মাস, পনেরো দিন?
কী মুশকিল! আমার হাতে কী যন্ত্র-টন্ত্র আছে যে বলব! ওনার অবস্থার কথা তো আগেই বললাম, এখন দিনে দিনে খারাপের দিকে যাবে, দ্রুতই যাবে। সে হিসাবে চার থেকে ছয় সপ্তাহ।

জবাব পেয়ে ফরিদা, সালমা, নাজমারা কী ডাবল জানতে পারলেন না। তবে ডাক্তার চলে যেতে তিনজনই জোটবেঁধে যা শুরু করল, তাকে তিনি কী বলবেন ভেবে পেলেন না। শেষ সময় মানে চার-ছয় সপ্তাহ কথাটা তিনি নিজ কানে শুনেছেন, অথচ মেয়েরা কায়দা-টায়দা করে বোঝাতে লাগল তিনি সেরে উঠেছেন, হাসপাতাল থেকে আজই ছাড়া পাচ্ছেন। তাদের কথাবার্তায় সাড়া না দিয়ে তিনি একেকবার একেকজনকে দেখছিলেন। অনর্গল মিথ্যা বলে যাচ্ছে। ভাবভঙ্গি এত আন্তরিক, মিথ্যাচারের বিন্দুমাত্র  ছাপ-টাপ নেই। অবাক হচ্ছিলেন, এরা কারা?

বাসায় ফিরে অন্য সমস্যা। তিনি জানেন তার মেয়াদ চার, বড়জোর ছয় সপ্তাহ। বাসায় মেয়েরা ছাড়া আর যারা – প্যারালাইসিস-আক্রান্ত স্বামী, নিকট আত্মীয়স্বজন যারা তার অবস্থার অবনতির খবর পেয়ে প্রায় প্রতিদিন হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন – তারাও তাই জানেন। কিন্তু তিনি নিজেও যে জানেন, খুব ভালো করে জানেন, এ-খবর তাদের অজানা; শুধু অজানাই নয়, তার জেনে ফেলার ঘটনাটা তাদের কল্পনারও অতীত। মাঝেমধ্যে ভেবেছেন, মেয়েরা যে-উৎপাতটা চালাচ্ছে তা থামাতে ওদের মুখের ওপর ওদের মিথ্যাটাই ছুড়ে দেন, বুঝুক কী জঘন্য খেলা তারা খেলে যাচ্ছে! আবার এও ভেবেছেন, অভিনয় যখন চলছে, একতরফা কেন হবে, দুই পক্ষ থেকেই চলুক সামান্য কটা দিনই তো। ওরা ভাব দেখাবে তিনি সেরে উঠছেন, তিনিও মাথার যন্ত্রণায় অবশ ঘোর ঘোর আধখোলা চোখ মেলে সায় দেবেন, উঠছি তো বটেই।

দুই-চারদিন যেতে নিরুপায় বেগম জাহানারা নিজেকে বোঝালেন, মেয়েরা যে লুকোচুরিটা খেলছে, সঙ্গে অন্যরাও, এর হয়তো কোনো বিকল্প ছিল না। বিশেষ করে মেয়েদের পক্ষে তো নির্জলা সত্যটা তাকে জানানো সম্ভব ছিল না। তার বেঁচে থাকার মেয়াদ পূর্ণ হওয়া মানে তাদের মা-হারা হওয়া। যে-কারণে তারা যে শুধু তার সঙ্গে অভিনয় করছে তা নয়, নিজেদের সঙ্গেও করেছে। দুর্ভোগটা সেদিক থেকে বরং ওদেরই বেশি। হাসপাতাল ছেড়ে  যে তীব্র অভিমান নিয়ে তিনি বাসায় ফিরেছিলেন, দিনকয়েকে তা খানিকটা ফিকে হতে তিনি অন্য কথা ভাবলেন – বেশিদিন তো নয়, দাঁত কামড়ে পার করতে পারলেই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি – নিজের, আবার মেয়েদেরও। এই দুর্ভোগকেই কি ডাক্তার নাম দিয়েছিলেন কমফোর্ট – বাসায় আপনজনের সান্নিধ্যের কমফোর্ট! তো যেটুকু হচ্ছিল – যতক্ষণ একা থাকতেন, বা আশপাশে কেউ থাকলেও চোখ বুজে তখন একা হয়ে যেতেন। আধঘুমে আধ জাগরণে মেটাসটাসিস-আক্রান্ত মাথায় কত কী ভিড় করত। গোছগাছের কিছু নয়, এলোমেলো ছন্নছাড়া। নানা মানুষের মুখ, নানা জায়গার পরিষ্কার বা ঝাপসা ছবি। আর এসবের মধ্যে  যে-ছবিটা আলোবদল সত্ত্বেও নানা কায়দায় ঘুরেফিরে দেখা দিত, সেটা ক্লাসরুমের। ছোট-বড় হরেক রকমের ক্লাসরুম। কখনো ফাঁকা খাঁ-খাঁ, কখনো ছাত্রীদের হলরুমমুখর তিলধারণহীন। আশ্চর্য যা, ছাত্রীদের চোখ-মুখগুলো থোকায় থোকায় অবিচ্ছিন্ন দেখালেও নিজের চেহারাটা তিনি হুবহু আয়নায় যেমন তেমনি পরিষ্কার দেখতে পেতেন। পুরু চশমায় কঠোর মুখ। ক্লাসে কঠোর ছিলেন বরাবর, মেয়েদের স্কুল বলে পড়াশোনার বাইরেও অনেক কিছুতে চোখ রাখতে হতো। শুধু মেয়েদের বেলা নয়, অনেক সহকর্মীর প্রতিও তার কঠোরতা ছিল। হেডমিস্ট্রেস যখন হলেন, মেয়েদের চেয়ে সহকর্মীরাই তাঁকে নিয়ে বেশি তটস্থ থাকত। আড়ালে-আবডালে তাঁকে নিয়ে কথাবার্তা কম হতো না। তিনি হাসতে জানেন না, বিয়ের রাতে স্বামীর দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে কোন ক্লাস, রোল নম্বর জিগ্যেস করেছেন – এমনসব বলাবলি কানে আসতে মনে মনে বলেছেন, তোমাদের অসুবিধা কোথায়!
উড়ো কথা যে যেমনি ছড়াক, সেসবের কোনো ভিত্তিই ছিল না, বলা যাবে না। বেগম জাহানারা নিজেও তা জানতেন। স্কুলে যেমন সবাই তার ব্যাপারে সতর্ক থাকত, ঘরে ততটা না হলেও স্বামী তাকে যথেষ্ট সমঝে চলতেন। বিয়ের পরপর লাই পেয়ে স্বামী যেই তাকে আর পাঁচটা মেয়ের মতো গড়পড়তা সাধারণ বলে ধরে নিচ্ছেন, তখনি তাকে বোঝাতে ছাড়েননি তিনি আর যা-ই হোন ছাঁচে ঢালা সাধারণ নন। ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর রোজগারের পথটা সোজা না বাঁকা এ নিয়ে তার কৌতূহল ছিল, হয়তো সংশয়ও। সংশয় দূর করতে জবাবটা সরাসরি জানতে চেয়েছেন। আচমকা ঘায়ে স্বামী থতমত খেয়ে তাকিয়ে থাকলে তিনি মিটিমিটি হেসেছেন – হ্যাঁ, হেসেছেন। তবে চোখে চোখে তাকিয়ে তার মনে হয়েছিল হাসিটা স্বামীর প্রায় নিখুঁত চেহারায় এতটা ভাংচুর ঘটাবে তিনি ভাবেননি। এমনও মনে হচ্ছিল, তার অস্ফুট হাসিতে রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজের তরুণ এক্সিয়েন মাহতাবউদ্দিন এক অভাবনীয় আতঙ্কের উঁকিঝুঁকিও বুঝি দেখতে পাচ্ছেন। বেগম জাহানারা তখন অভয় দেওয়ার মতো করে আঁটো হাসিটাকে সারামুখে একটু একটু করে ছেড়ে দিতে দিতে যা বলার বলেছেন – স্বামীর আতঙ্ক তাতে বাড়লেও তার কিছু করার ছিল না। বলেছেন, বাঁকা পথের রুজি আমাকে খাওয়াবে না, কোনোদিন না। আমাকে ছুঁয়ে বলো।

ছোঁয়াছুঁয়ির মতো নাটুকে ব্যাপার কাকপক্ষীর জানার কথা না, তারপরও তাদের নিয়ে বাজারে যা রটেছে সেই যে পয়লা রাতে স্বামীকে কোন ক্লাস, রোল নম্বর জিগ্যেস করেছেন – তার ভিতটা কিন্তু খুব নড়বড়ে না। যদিও সবার জানা, বিয়ে যখন হয় তখন স্কুলের চাকরিতে ঢোকা দূরের, একুশ বছরের ছিপছিপে চশমাধারী তিনি তখন বেগম জাহানারাও হননি, শুধু জাহানারা, আর হিউম্যানিটিজ থেকে বিএ পরীক্ষায় বসা হয়ে যেতে পড়াশোনার পাট কি চুকে গেল – এ-প্রশ্নটা বা ভয়টা বিয়ের রাত থেকে তাকে নাজেহাল করে ছেড়েছে।
ভয়ের কারণ ছিল না। মাহতাবউদ্দিনের মনে যা-ই থাকুক, মুখে সায় দিয়েছেন। আর যখন স্ত্রীর পরিকল্পনার কথা শুনেছেন, মনে মনে নিশ্চয় হেসেছেন এই ভেবে, হ্যাঁ শিক্ষকতাই তোমাকে মানাবে, চেহারাটা এখনি হেডমিস্ট্রেসের জন্য মানানসই। মুখে বলেছেন, তোমাকে তাহলে বিএড করতে হয়, নাকি এমএটাও?

শুনতে ভালো লাগলেও বেগম জাহানারার – তখন শুধু জাহানারা – মনে হয়েছিল মুখে বলছেন ঠিকই, ভেতরে ভেতরে স্বামী চেয়েছেন তিনি ঘরেই থাকেন। ঘর মানে তো হাঁড়ি ঠেলা নয়, বরং কর্মহীন আলস্যে তার তেজ প্রশমিত হবে, তেলতেলে পলিমাটির পেলবতা খেলবে শরীর-মনে, শোবার ঘরে, ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিনে দিনে প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী হয়ে উঠবে, কাঁধছাঁটা চুল ঘোর কালো ও দিঘল হবে, আর এসবের সঙ্গে যা হওয়ার কথা – ছিপছিপে কাঠামোর অপূর্ণতা ঘোচাতে শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় পর্যাপ্ত বর্তুল মাংসের জোগান হবে।

দীর্ঘদিন পর ঘোর ঘোর আচ্ছন্ন মাথায় এসব যখন এসেই পড়েছে, বেগম জাহানারা ভেবেছেন, সারাজীবন তিনি নিজের কঠিন গোঁ ধরেই চলেছেন। কারো ওপর রাগ নেই, অভিমান নেই, তারপরও একা একা। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক আলগা হয়েছে, তিনি ভেবেছেন হওয়ারই কথা। মেয়েদের জন্ম হয়েছে, লালন-পালন করেছেন কঠোর কর্তব্যজ্ঞানে। হ-ভালোবাসা? প্রশ্নটা নিজেকে করার দরকার মনে করেননি কোনোদিন ভালোবাসার নামে আদিখ্যেতাকে সারাজীবন চোখের বিষ ভেবেছেন। কিন্তু মুশকিল দেখা দিলো যখন বছর দুই আগে এনড্রোমেট্রাল ক্যান্সারের দাপটে বিছানা নিতে বাধ্য হলেন। মেয়েরা, নিকটাত্মীয়রা যে তার চারপাশে বলতে গেলে আঠার মতো লেগে থাকল, তাকে কর্তব্যজ্ঞান বলবেন না আদিখ্যেতা, এ নিয়ে বেশ খটকা লাগল। প্রথম প্রথম বিরক্ত হয়েছেন। নিজের আশপাশে সারাক্ষণ মানুষ, শুশ্রষার নামে এটা- ওটা করে দিচ্ছে, ডুবুডুবু কাতর চোখে তাকাচ্ছে দেখে অসহ্য লেগেছে। তবে ভেবেছেন, কিছুদিন পর হাল ছেড়ে যে যার মতো কেটে পড়বে। কেটে যখন পড়ল না, বরং মেয়েরা এতদিনে একটা কাজের কাজ পেয়েছে বলে মহা তোড়জোড়ে এমনভাবে তাকে নিয়ে মেতে উঠল, তিনি বিস্মিত হলেন, এমনকি শঙ্কিতও হলেন এই ভেবে, ওরা নিজেরা যে তার কাছে কর্তব্যের অতিরিক্ত কিছু পায়নি তা বুঝিয়ে দিতেই কি হামলে পড়েছে?
কিন্তু পরিস্থিতিকে নিজের ব্যাখ্যায় দাঁড় করাতে গিয়ে তারপর হোঁচট খেলেন। একদিন দু-দিনের ব্যাপার তো নয়, দু-দুটো বছর! মেয়েরা যে শুধু লেগেই থাকল তা নয়, বলতে গেলে তাকে কোলে করেই রাখল। কোলে রাখার দরকার ছিল না, চব্বিশ ঘণ্টার নার্স রেখে দিলেই হতো। কথাটা তিনি বলেও ছিলেন, মেয়েরা কানে তোলেনি। ফরিদা তো যেন আঁতকে উঠেছে এমন উদ্ভট কথা শুনে। ফল হয়েছে, সে তার স্বামী-সংসার ছেড়ে-ছুড়ে তাকে নিয়ে আরো বেশি বেশি মেতে উঠেছে। দিনে কয়েকবার বমি পরিষ্কার করা, ডায়পার বদলানোর মতো কাজগুলো সে যখন হেসেখেলে করে গেছে, তিনি ভেবেছেন লজ্জায় মাথাকাটা আর কাকে বলে! সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে ঘাড়ে-মাথায় পাহাড়প্রমাণ অপরাধবোধ। চরম শারীরিক দুর্ভোগের মধ্যেও তিনি ভেবে ভেবে কূল পাননি, এর দাম কি আদিখ্যেতা, না পুরোটাই ভালোবাসা  কর্তব্যবোধ বলে সারাজীবন যা তিনি জেনে এসেছেন তার সঙ্গে এর বড় একটা যোগাযোগ নেই। সময়টা তখন গেছে খুবই মুশকিলে। চোখ খুলে মেয়েদের দিকে তাকাতে বাঁধো বাঁধো ঠেকেছে। এ-অবস্থায় যখন চার-ছয় সপ্তাহের নোটিশটা এলো, তখন একটা সান্ত্বনা অন্তত পাওয়া গেল; যাক, জোর করে চোখ বন্ধ রাখার কসরত তো বেশিদিন চালাতে হবে না।
কোথায় কী! চার-ছয়, সাত-আট এমনকি দশ সপ্তাহ পার হয়ে যেতে বেগম জাহানারার বুঝতে বাকি থাকল না লজ্জা-টজ্জা এবার কেলেঙ্কারির পথে হাঁটছে। দফায় দফায় আত্মীয়স্বজনরা এসেছেন শেষ দেখা দেখবেন বলে; দূর থেকে কুমিল্লা, সিলেট, চিটাগাং থেকে যারা এসেছেন তারা পড়েছেন দোটানায় থাকবেন না চলে যাবেন? চলে গেলে অবস্থা খারাপের খবর পাওয়ামাত্র কি আবার আসতে পারবেন? কী অশান্তি, বেগম জাহানারা শুয়ে শুয়ে চোখ বুজে হাঁসফাঁসই করে গেছেন। চিটাগাং থেকে বড় জা দুই দফা এসে অপেক্ষা করে ফিরে গেছেন। একমাত্র ছোটভাই ইংল্যান্ড থেকে এসে তিন-তিনবার ফিরতি টিকিট পিছিয়েও শেষ দেখতে না পারার আফসোস নিয়ে ফিরে গেছে। আফসোসের বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তিনবার টিকিট বদলানোই প্রমাণ। সে তো এসেই ছিল খাটিয়া বয়ে বোনকে কবরে শুইয়ে দোয়া-পড়া ভেজা নরম মুষ্ঠি-মুষ্ঠি মাটি ছিটিয়ে তবে যাবে। বলে গেছে, খবর পেলেই ছুটে আসবে। আসবে জানা কথা, কিন্তু তখনো যদি বেচারাকে টিকিট পেছাতে হয়!
এসবের মধ্যেও বাড়িতে মৃত্যু-প্রস্তুতির নানা তোড়জোড় নীরবে-সরবে চলতে থাকে। কবরের জায়গাজমি ঠিক, মরার পর গোসলটা কাকে দিয়ে করানো হবে, তাও। দূরসম্পর্কের এক ননদ, দীর্ঘদিন মুর্দা মহিলাদের শেষ গোসল করানোর অভিজ্ঞতায় পারদর্শী, ডাক পাওয়ার অপেক্ষায় তৈরি। এদিকে রোজ সন্ধ্যায় বসার ঘরে দুজন গাঢ় মেহেদি-রাঙানো মৌলভি দীর্ঘ তেলাওয়াত শেষে কাঁপা-কাঁপা কফ-জমা গলায় যে-মোনাজাতটা করেন, সেটা বেশ অভিনব। মূল কথাটা মৃত্যুর জন্য, কষ্টহীন মৃত্যুর জন্য পরোয়ারদিগারের কাছে কাকুতি-মিনতি। সরাসরি তো বলা যায় না, জান কবজের জন্য আজরাইল ফেরেশতার এত দেরি কেন, তাই ঘুরিয়ে কায়দা করে যন্ত্রণা-কষ্টহীন মৃত্যুর অপেক্ষায় মৃত্যুকেই নিয়ম করে চব্বিশ ঘণ্টায় একবার তাড়া দেওয়া। বেগম জাহানারার কানে প্রতিটি শব্দ একের পর এক ঝাপটা তোলে, গোটা ব্যাপারটা তার কাছে ইতরামির মতো ঠেকে। মারা যাবেন তিনি, তৈরি হয়েই আছেন। ঘটনাটা তার হাতে নেই, তারপরও বিষয়টা তার ব্যক্তিগত। অন্য কেউ তার হয়ে গলা ছেড়ে কাঁদুনি গাইবে,  সে- অধিকার তো তিনি দেননি। সব কলকাঠি মাহতাবউদ্দিন নাড়ছেন। বছরপাঁচেক আগে স্ট্রোকের পর প্যারালাইসিসে পা দুটো অচল, কিন্তু মাথা পরিষ্কার। হুইল চেয়ারে প্রায় সারাদিন পাথরের মতো এসে ঠোঁট ও জিভের জড়তা সত্ত্বেও আদেশ-নির্দেশ যা খুশি দিয়ে যাচ্ছেন। এই যে মৌলভিরা রোজ রোজ একই মোনাজাত করে যাচ্ছে, করতে গিয়ে বিশেষ বিশেষ জায়গায় ওদের গলাগুলো আচমকা থাপ্পড় খেয়ে কাতরে ওঠার মতো ভেউ ভেউ জুড়ে দিচ্ছে, এসবে বেগম জাহানারার মতামত তো কেউ জানতে চায়নি। যদি চাইত, তিনি মানা করতেন, অবশ্যই মানা করতেন। এত মাতামাতি কেন, মরবেন না তো বলেননি। নাকি ডাক্তারের চার-ছয় সপ্তাহের হিসাব ভণ্ডুল হয়ে যেতে খোদাতালার সরাসরি হস্তক্ষেপই জরুরি!  ফরিদা-সালমাদের মনোভাবও দিনে দিনে বেশ জটিল। এত করছে ওরা, পারে তো এক মুহূর্তও তাকে চোখের আড়াল করে না, আবার রোজ সন্ধ্যায় মৌলভিদের গলা সাধায়ও বাগড়া দিচ্ছে না। এ কি ওদের কর্তব্যের অংশ, যার সঙ্গে ভালোবাসা বা তিনি যাকে ভাবতেন আদিখ্যেতা তার কোনো সম্পর্ক নেই?
ভাবতে গিয়ে সবই জটিল-কুটিল, সরল-সহজ কিছু নেই। একটা ভাবনা মাথায় বুদ্বুদ তোলে তো পিছু পিছু আরো পাঁচটা। এমন নয় যে, একটা একটা করে তারা মগজে ঠোকরায়। আর মগজ চলতে এখন যা, খুলে দেখলে নিশ্চয় ঘায়ে-পুঁজে থকথকে কাদার পিণ্ড ছাড়া কিছু মনে হবে না। মেটাসটাসিস কথাটা শুনতে অবশ্য অতো ঘিনঘিনে শোনায় না। তো এই মেটাসটাসিসের কারণেই কী না, মাথায় ভাবনা-চিন্তা যা-ই আসে, স্থির হয়ে দম নিয়ে বসতে পারে না, নড়াচড়ায় অস্থির, সারাক্ষণ উলটেপালটে এ-ওর ঘাড়ে ডিগবাজি খায়। ঝামেলার যা, আজ যদি একটা কথা মাথায় একরকম, পরদিনই ডালপালা গজিয়ে অন্যরকম। মেয়েদের ব্যাপারটা যেমন। ওরা নিজেদের ঘর-সংসারের তোয়াক্কা না করে তার দেখাশোনা করে যাবে প্রথম প্রথম এ তো ছিল ধাক্কার মতো। কিছুদিন যেতে অভ্যাসে অভ্যাসে সয়ে এলেও মনে খটকা কেন করছে? সামাজিক রীতি মেনে কর্তব্য পালন? মেনে নিতে মন সায় দেয়নি। কর্তব্যের চেহারা এমন কেন হবে? ভালোবাসা? এখানেই যত জটিলতা। ভালোবাসা কতদূর যায় এ নিয়ে তার বরাবরের সংশয়। পরে যে-যুক্তিটা মোটামুটি স্থিতি পেল তিনি আর মেয়েরা তো এক নন। তার শক্তি ওদের নেই। বড় নড়বড়ে, দুর্বল, অল্পতে ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়া থেকেই এতকিছু। কিন্তু এতেও শেষ মিটমাট হলো না। ভেঙে পড়াই যদি হবে, তবে রোজ সন্ধ্যার মোনাজাতে ওদের সায়টা আসে কী করে? আত্মীয়স্বজনের কথা যদি ধরা যায়, ওরা এত কেন ভিড় করছে? মৃত্যুটা ঘোষণা দিয়ে ঘটবে ঘটবে করেও না ঘটায় বিড়ম্বনাটা তার নিজের না ওদের এমন প্রশ্নের মুখে নাজেহাল হয়ে ভেবেছেন বিড়ম্বনা-টিড়ম্বনা সব তার নিজেরটা তো বটেই, অন্যেরটাও। তিনিই যেখানে কারণ। তাই কি? চার-ছয় সপ্তাহের নোটিশটা তো তিনি দেননি। দশ-এগারো পাড়ি দিয়ে পঞ্চাশ-একশ সপ্তাহও যদি হয়ে যায়, তখন? চলতেই থাকবে শেষ দেখার আসা-যাওয়া। আসা-যাওয়ার খেলাটা দেখার জন্য তাহলে তো তাকে পঞ্চাশ-একশ পর্যন্ত টিকে থাকতে হয়।
খেলার শেষ নেই। হুইল চেয়ারে পাথর হয়ে থাকা মাহতাবউদ্দিনও কম যান না। সাড়া নেই শব্দ নেই, পাথরের অন্তরে আস্তে-ধীরে সংগোপনে একেকটা খেলা কুঁড়ি ফোটায়। এক রাতে হুইল চেয়ারের মৃদু ঘ্যাস্ ঘ্যাস্ শুনে চোখ ফাঁক করতে কিম্ভুত দৃশ্য। পাথরের মতো নয়, মনে হলো ভাঙাচোরা মস্তো উঁইয়ের ঢিবি দুই চাকায় চাপিয়ে ফরিদা ঠেলেঠুলে ঘরে ঢোকাচ্ছে। ঢিবিটা দুলে-দুলে এগোচ্ছে, বিছানার সমান্তরালে পা থেকে মাথার দিকে এগোচ্ছে, তারপর যে-ই মনে হলো মাথার ওপর হুড়মুড়িয়ে পড়বে, তখনি কানে মুখ ঠেকানো ফরিদার গলা, আম্মা, আব্বা কথা বলবেন, আম্মা… আব্বা। কাকে ডাকে ফরিদা  আম্মা আবার আব্বা। ফরিদা চলে যেতে খেয়াল হলো ঘুম কেটে গেছে, তবে ঘোরটা রয়ে গেছে, চোখ ছাড়িয়ে মাথা হয়ে যেন সারা শরীরে। রাত কি অনেক? আশপাশের কোন বাড়িতে কে যেন গেট ধাক্কাচ্ছে। ধাক্কাগুলো কাছের, কানের পর্দায় ধুকে ধুকে বসে যেতে ঘোরের খোলসটা ঝরে ঝরে পড়ছে। একটা খুক্ কাশি, পরপরই হাতে হাত। কব্জির ওপরে শিরা ফুটো করে বসানো ক্যানোলা ঘিরে হাতটা পড়তে ব্যথার অনুভূতির বদলে বেগম জাহানারার মনে হলো হাতটা ঠান্ডা। আবার খুক্ কাশি। ঘরের অল্প আলোয় ছায়া পড়ল মুখে, পুরো মুখে নয়, কপাল থেকে প্রায় আধাআধি একটা চোখে, গালে, নাক-ঠোঁটের মাঝামাঝি ছায়াটা স্থির হতে তিনি দেখলেন,  হুইল চেয়ার থেকে ছিটকে যেন আলগা হয়ে মাহতাবউদ্দিনের মাথাটা ঝুলে আছে তার আধাআধি মুখ বরাবর। খুব খারাপ লাগছে? প্রায় ফিসফিসে গলায় কথাটা মাহতাবউদ্দিন বলতে চাইলেও স্ট্রোকের পর থেকে ঠোঁট-জিভ বড় একটা নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই বলে বেগম জাহানারার কানে তা পৌঁছল ওই হুইলচেয়ারের ঘ্যাসঘ্যাসের মতো। আওয়াজটা ঠিকঠাক তৈরি হচ্ছে না বুঝে দ্বিতীয়বার মাহতাবউদ্দিন একই কথা বললেন, জোরের ওপর বললেন, আর ক্যানোলা-ঘেরা হাতটায় কথা বলার তোড়েই হয়তো হঠাৎ চাপ পড়তে উহ্ শব্দটা বেগম জাহানারার মুখ ছিটকে অক্সিজেন মাস্কে লুটোপুটি খেয়ে আটকে গেল। মাহতাবউদ্দিন কী বুঝলেন কে জানে, হাতটা সাবধানে সরিয়ে কোথায় রাখবেন ভেবে শেষমেশ যেখানে রাখলেন সেখানেই স্ত্রীর রোগটা হু-হু বাড়ছে। বেগম জাহানারা চোখ বুজলেন; স্কার্ফ-মোড়া ন্যাড়া মাথার পেছনে মাহতাবউদ্দিনের হাতের ছোঁয়ায় ঘোর-ঘোর অবস্থাটা আবার ফিরে আসছে।
দুই রাত যেতে একই ঘটনা আবার। তবে পাথর বা উঁইয়ের ঢিবির মতো নয়, কুঁজো হয়ে হুইল চেয়ারে বসা মাহতাবউদ্দিনকে দেখাল মাহতাবউদ্দিনেরই মতো। পেছন পেছন ফরিদা আর অবিকল সে-রাতের মতো কানে কানে, আম্মা… আব্বা। তবে মাহতাবউদ্দিন হাবভাবে সে-রাতের মতো নয় হাতে হাত নয়, মাথায়ও নয়। সিথানের পাশে হুইল চেয়ার স্থির হতে চোখ ঘুরিয়ে ঘরটা দেখলেন, তারপর স্যালাইন ব্যাগ, রাইস টিউব, অক্সিজেন মাস্ক এসবও খুঁটিয়ে দেখা হতে ঠোঁট-জিভকে যতদূর সম্ভব আয়ত্তে এনে টেনে টেনে যা উচ্চারণ করলেন, তাকে কী বলা যায়! তিনি বললেন, জাআহাআন … আরাআ। নাম কে বলবে? একটা কথা, পুরো বাক্য। জীবনে কবার এভাবে চমকেছেন বেগম জাহানারা বলতে পারবেন না। নাম ধরে মাহতাবউদ্দিন তাকে ডাকছেন, না না, ডাকছেন কোথায়? ঠোঁট-জিভের রাস টেনে কষ্টেসৃষ্টে একটা অক্ষর থেকে আরেকটা অক্ষরে পাড়ি দিতে দিতে টানা গোঙানির মতো  যে-আওয়াজটা কানে বাজল, তাতে বেগম জাহানারার মনে হলো এর বেশি বলার কী থাকতে পারে, শোনারই-বা কী! আশ্চর্য, তিনি তাই ভাবলেন; আর ভেবেছেন যে এ-কথা ভেবে নিজেও আশ্চর্য হলেন। তিনি মনে করতে পারলেন প্রথমবার স্কার্ফ-মোড়া মাথায় হাতের ছোঁয়ায় তার ঘোর-ঘোর লাগছিল; দ্বিতীয়বার নিজের কানে নিজের প্রায় অচেনা টানা-লম্বা নামটা শুনে কাঠ-কাঠ সজাগ হয়ে থাকলেন।

কিন্তু মাহতাবউদ্দিন বুঝি নাম ধরে ডাকতেই এসেছেন। টেনে টেনে ঠোঁট-জিভের স্বাদ মিটিয়ে। দুই রাত আগে নাম-টামের ধার ধারেননি। সোজা জানতে চেয়েছেন খারাপ লাগছে কিনা। এটা জানার মোটেও বিষয় না। শুধু তো খারাপ না, খারাপের খারাপ।

চোখ বুজে শুয়ে বেগম জাহানারা মাত্র হাতখানেক বা তারও কম দূরত্বের মাহতাবউদ্দিনের উপস্থিতি পষ্ট টের পাচ্ছিলেন। তার এমনও মনে হচ্ছিল, মাহতাবউদ্দিনের হয়তো মনে নেই তিনি নিজের ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে, স্ত্রীর ঘরে। কিংবা এও কি হতে পারে, তিনি যে তাকে জাহানারা বলে ডেকেছেন, শুনতে যেমনই লাগুক, গলা ছেড়ে যে ডেকেছেন, তাও ভুলে বসে আছেন? রাত তো বেড়েই যাচ্ছিল। ঝিঁঝিঁর ডাকের মতো একটানা আওয়াজ পাচ্ছিলেন দুই কানে। তবে সন্দেহ হচ্ছিল আওয়াজটা ঝিঁঝিঁর না-ও হতে পারে, হতে পারে নীরবতার।
সে-রাতে, মাহতাবউদ্দিন যখন আয় এ-ঘরে নেই, হুইল চেয়ার ঠেলে ফরিদাই তাকে নিয়ে গেছে, ঘুমঘোরে বেগম জাহানারা বারবার চমকে উঠেছেন এই বুঝি ডাকটা কানে এলো। বিকট ঝড়ঝঞ্ঝার কবলে আকুল তৃষ্ণায় টানা গোঙানির খোলস চিরে ভাঁজের পর ভাঁজ খুলে নিঃসঙ্গ অপরূপ নামটা তার। কিন্তু দিনের ঘোরহীন টাটকা আলোয় তার প্রথমেই মনে হলো, এও খেলা, মিথ্যামিথ্যি। রাতে মাহতাবউদ্দিনের আসাটাও মনে হলো মিথ্যা, আর নাম ধরে অকারণ ডাকটা মিথ্যা না হয়ে যায় কোথায়! যতই ভাবলেন তার খটকা লাগল, এবং এক পর্যায়ে বিস্ময় জাগল মাহতাবউদ্দিন কেন তার ঘরে আসতে যাবেন। তাও একবার নয়, দুই-দুইবার। পেছন পেছন আবার ফরিদাও। হুইল চেয়ার ঠেলতে না-হয় ফরিদার দরকার ছিল, কিন্তু ওই যে কানে কানে আম্মা… আব্বা ওর কী এই কাজ! দূতিয়াল হয়ে একজনের কথা অন্যজনকে বলা! রাতের ঘটনা সবই ভাঁওতা। গলে-পচে বিগড়ানো মগজের কারসাজি। এগারো-বারো সপ্তাহ পার বেগম জাহানারা নিশ্চিত, ডাক্তারের ধারণাও ছিল না গলা-পচা মগজ মাথায় করে এতটা পাড়ি দেবেন। আবার এও ভাবলেন, বেচারার কী দোষ, কী করে বুঝবে এসব ভাঁওতা দেখার লোভেই তিনি একটা নির্ঘাৎ ভবিষ্যদ্বাণী তুচ্ছ করে টিকে থাকবেন! কী অদ্ভুত কথা, মাহতাবউদ্দিন নাকি এ-ঘরে দুই রাত হানা দিয়ে গেছেন। তাও চুপেচাপে না, ঘটা করে। জিগ্যেস নাকি করেছেন, খুব কি খারাপ লাগছে, হাতে নাকি হাত রেখে, এমনকি মাথায়ও। আর শেষমেশ গলা ছেড়ে, অবিশ্বাস্য জাহানারা। আসলে ডাক্তারই হয়তো ঠিক, চার-ছয় সপ্তাহে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এরপর যা শুরু হয়েছে, সবই তালগোল পাকানো।

না হলে মাহতাবউদ্দিন কেন? কত বছর হবে দুজনের কথাবার্তা বন্ধ পাঁচ-ছয় না আরো? বেগম জাহানারার মনেও নেই। এদিকে ভাঁওতাটা কেমন প্রায় অচল-অসাড় ঠোঁট-জিভ নেড়ে মাহতাবউদ্দিন জানতে চাইছেন, খারাপ লাগছে কি-না? অকল্পনীয় দৃশ্য। বেগম জাহানারা ভাবেন জিগ্যেস করেন, কতটা খারাপ হলে তুমি খারাপ বলবে, বলো তো? তোমার তো ধারণাই নেই জগতে কোনটা খারাপ, কোনটা ভালো। আমার ভালো যেমন আমার, খারাপটাও আমার। তোমার ভালো, তোমার সাফল্য, তোমার টাকা-পয়সা, চাকরির চূড়ায় চড়ে দুপাশে পা ছড়িয়ে বসতে পারা। তোমার পক্ষে কী করে জানতে চাওয়া সম্ভব কতটা খারাপ আছি? আচ্ছা, ধরে নিলাম এসেছিলে, হুইল চেয়ার ঠেলে পিছু পিছু ফেউয়ের মতো ফরিদাও। কল্পনা করতে তো আপত্তি নেই, কল্পনা করলাম, কিন্তু মুখ ফুটে তোমার পক্ষে কি জিগ্যেস করা সম্ভব? বলো। এতদূর আসার কল্পনাও আমাকে নিয়ে যাবে না। সবই আমার পোকা-খাওয়া মাথার সারসাজি, কত কায়দাই না মাথাটা ফুসলায়। তোমাকে দেখায়, তোমাকে দিয়ে কথা বলায়, পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া আমার মাথায় পর্যন্ত তোমার হাতের ছোঁয়া পাই। তোমাকে দুষছি না, ষড়যন্ত্র যা করার নিজের মাথাটাই করে যায়। ভালো যে ধরতে পারছি।

মুশকিল হলো, বলছেন ধরতে পারছেন ফাঁকিটা চোখ এড়িয়ে গেলেও পরে মন পাকড়াও করে ফেলছে; কিন্তু ফাঁকিটাই যে ঘুরেফিরে নানাভাবে চড়াও হচ্ছে। রাত হলে তো কথা নেই। সামান্যতম খুটখাটে চোখ চলে যায় পায়ের দিকের দরজায়, বড় হাঁ মেলে দরজাটা ফাঁক হচ্ছে কি-না। বড় হাঁ না হলে চলবে না  গা-গতরে তো কম না, হুইল চেয়ার বলে কথা। কখনো কোনো রাতে চোরাগোপ্তা হাওয়ায় দরজার পর্দাটা প্রকাণ্ড ফুলে ওঠে, চঞ্চল খুটখুট, আওয়াজও ওঠে দরজায়। চঞ্চল বেগম জাহানারার চোখও; ফুলে ওঠা পর্দার সঙ্গে চোখের পাতাগুলোও খুলে বড় হতে থাকে, আবার দরজার বুকে পর্দাটা গুটিয়ে কুঁচকে বসে যেতে পাতাগুলোও নেতিয়ে চুপসে বুজে আসে।

খোলা আর বোজার ভেতর দিয়ে রাতের অনেকটা পার করে দিতে পারলেও দিনগুলো লম্বা, শেষ হতে চায় না। পর্দা-মোড়া ঘরেও দিনের আলো যেটুকু চোখে লাগে, তাতেই চোখ জ্বালা করে। বুজে থাকলে সুবিধা, অল্প সময়েই একটা আচ্ছন্নতা নামে। ঠিক ঘুম না, ঘুমের কাছাকাছি, তন্দ্রা ও ঘুমের মাঝামাঝি যদি কিছু থেকে থাকে সেরকম। কান দুটো আশপাশের মৃদুমন্দ সাড়া পায় এলোমেলো জটপাকানো কথাবার্তা, গাড়ির হর্ন, ফেরিওয়ালার হাঁক। কখনো আচমকা একটা-দুটো আলগা পরিপাটি আওয়াজ খোলা টেপ থেকে পানির শব্দ, একটা কাকের আলতো কা। সপ্তাহ-টপ্তাহ কত গেল, সে হিসাব আর নেই। পাড়াপড়শি, আত্মীয়রা আগের মতোই আসে-যায়, তার ঘরে বসেই গলা নামিয়ে কথাবার্তা চলে, বিস্কুট-শিঙাড়াও খাওয়া চলে। এছাড়া তাদের নিজেদের বয়ে আনা ফল-টল, হেলথ ড্রিংকস। যারা আসে তারা এতদিনে একটা শৃঙ্খলা রপ্ত করে ফেলেছে, বেশিরভাগই নিজেদের মধ্যে টুকটাক যা বলার বলে, তাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে না। মাঝেসাজে কেউ কেউ ব্যতিক্রম। একদিন দুপুরের দিকে ছোটখাটো একটা দঙ্গল এলো। চোখ বুজে ছিলেন, ফরিদা আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকল, আম্মা, দেখো দেখো। শুনে চমকে উঠলেন, দূতিয়ালি করতে গিয়ে দিনের বেলায় কী নিয়ে এলো। না, দুটো মেয়ে, ফরিদারই বয়সী, তিরিশ-পঁয়ত্রিশের এদিক-ওদিক হবে। একজন ফর্সা, এ-বয়সেই বেশ ঝলমলে। অন্যজন লম্বা, শ্যামলা মুখে চোখ দুটো দপদপ করছে। ওদের সঙ্গে দশ-বারো বছরের দুজন ছেলেমেয়ে, কার কোনটা বোঝা মুশকিল। ফর্সাজন বলল, আপা, আমি নাইনটি ব্যাচের, হিউম্যানিটিজ, রোল নম্বর সিক্সটি সেভেন। শ্যামলাজন আমি আপা সায়েন্সের, রোল নম্বর ওয়ান ওয়ান সেভেন, নাইনটি ওয়ান ব্যাচ, মর্নিং শিফট। দুজন অনর্গল কথা বলে চলে। মাত্র একদিন হলো দেশে ফিরেছে, দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড, আগে ছিল, এখনো আছে। দুজনই হোস্টেলে থাকে, খবর শুনে ইচ্ছা ছিল আগের দিনই দেখে যায়। নানা ঝামেলায় পেরে ওঠেনি। আপা কি আমাদের চিনতে পারছেন ফর্সাজন। আমি বুশরা, ও লতিফা। লতিফা ওর ক্লাসে ফার্স্ট গার্ল ছিল। মেয়েদের মধ্যে বোর্ডে সিক্সথ স্ট্যান্ড করেছিল। আপা, মনে পড়ছে? ওর পিএইচ-ডি ক্রিস্টালোগ্রাফির ওপর, এখন পড়ায় ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসে। আমি আপা একদম বরবাদ, কিছু করি না, হাউসওয়াইফ।

কত যে বকল মেয়ে দুটো। ফর্সাজনই বেশি, নাম যেন কী বলল! একপর্যায়ে তারা নিজেদের মধ্যে কথা জুড়ে দিলো। আন্দাজ করতে পারছিলেন তাকে নিয়েই বলছে। কী ভয় না তারা করত, আরো কী সব। বেশ খানিকক্ষণ বসে একসময় কম্বলের নিচ হাতড়ে তার পা ছুঁয়ে দুজন উঠে পড়তে তার ইচ্ছা হলো কিছু বলেন। কী বলেন কী বলেন, খুঁজে পেতে ভাবলেন বলেন খেয়ে যেতে। কিন্তু অক্সিজেন মাস্কে আটকানো নাক-মুখ কোনো কাজের না। হাত নেড়ে বোঝাতে চাইলেন, ওরা বুঝল বিদায় জানাতে হাত তুলেছেন।

দিন যখন এভাবে আর কাটে না, বরং মনে হয় দিনই কী রাতই কী, তখন এক সকালে বেগম জাহানারা আশ্চর্য হলেন জানালার নীলচে পর্দা কাঁপিয়ে একটা চৌচির ইতস্তত আলো ঘরে ঢুকবে ঢুকবে করে পর্দার এক ফালি ফাঁকায় আটকে আছে। এমন দৃশ্য কোনোদিন দেখেছেন তিনি, মনে করতে পারলেন না। আশপাশে কেউ নেই, যেন নিরিবিলিতে বিরল দৃশ্যটা শুধু তার চোখে ফুটবে বলেই অপলক তৈরি হয়ে আছে। বেগম জাহানারা অভিভূত হলেন। শরীরের জ্বালা-যন্ত্রণাও বুঝি মুহূর্তে উধাও। তাকিয়ে থেকে তিনি সচকিত হলেন, এমন হওয়ার কথা নয় আলোটা একটুও নড়ছে না, নড়বে বলে মনেও হচ্ছে না। নিজেকে অবাক করে ভাবলেন, কী সুন্দর। পরপরই চমকে উঠলেন, এ-কী ভাবলেন! আর তখনি ঘরে কেউ ঢুকছে মনে হতে তড়িঘড়ি চোখের ঝাঁপ ফেললেন।

এ কিসের হাতছানি? সারাদিন পারতপক্ষে চোখ খুললেন না। খোলামাত্র যেন নিজেকে সবার চোখে উদোম করে ফেলবেন। আশ্চর্য বটে আলোটা। কিন্তু চোখ বন্ধ না করে উপায় কী? লজ্জার জ্বালাপোড়া থেকে কিছুটা রেহাই যদি মেলে। এতদিন একেক জায়গা থেকে আত্মীয়রা এসেছে, কাছ থেকে দূর থেকে এসেছে, তারপর…। বিফল হয়ে ফিরে গেছে। শেষ দেখতে কেউ কেউ দফায় দফায় এসেও হার মেনেছে। কার কাছে আবার? রোজ সন্ধ্যার মোনাজাতে এত কাতর আকুতি, অনুনয়-বিনয় খোদাতালার দরবারে তো বটেই, কখনো কখনো মনে হয়েছে তার কাছেও, যেন দয়া করেন। শেষ গোসল করাবে বলে পাক-সাফ হয়ে তৈরি সেই দূরসম্পর্কের ননদেরই বা কী অবস্থা? এদিকে তিনি কিনা এক অনিন্দ্যসুন্দর আলোর রূপে বিভোর হয়ে আছেন।

সে-রাতে, বেশ রাতে সকালবেলার লজ্জাটা কুরে কুরে খেয়ে ততক্ষণে কিছুটা শান্ত, দরজার পাল্লাটা মস্ত হাঁ মেলে খুলে যেতে তিনি না তাকিয়ে পারলেন না। বুক দুরুদুরু কাঁপছে, যা দেখলেন তাকে কী করে অবিশ্বাস করেন। ঘটনা তবে সত্যি? মাহতাবউদ্দিন তাহলে এভাবে আগেও এসেছিলেন একবার, না দুবার। হুইল চেয়ারে পিণ্ডপাকানো হাত-পা-বুক-মাথা চাকার ওপরে নয়, হুইল চেয়ারটা যেন গড়িয়ে গড়িয়ে মৃদু ঘ্যাসঘ্যাস তুলে এগিয়ে আসছে, পেছনে ধীর সাবধান পায়ে, হ্যাঁ ফরিদাই। বেগম জাহানারা চোখ বুজলেন, এতো লোভ তার! প্রায়ান্ধকার ঘরে লজ্জায় মুখ লুকানোর প্রয়োজন নেই, তারপরও চোখ বন্ধ না করে কী করেন! সে-রাতে এরপর কী ঘটেছে বেগম জাহানারার মনে নেই। যেটুকু থাকার কথা, খাটের চারপাশ ঘিরে অবিরল ফিসফাস।

চোখ যখন খুললেন, টাটকা সকাল। প্রথমেই তার চোখ গেল পর্দা মোড়া জানালার চিলতে ফাঁকে, যেখানে গতদিনের সেই  চৌচির আলোটা; তবে আটকে স্থির হয়ে নেই। ঘরের ভিতরে, মেঝেতে- দেয়ালে আঁকাবাঁকা রেখায় খণ্ড-বিখণ্ড আলোর নকশা দুলে দুলে ফুল হয়ে, লতাপাতা হয়ে, বিড়ালছানার চকমকি চোখ হয়ে ফুটে উঠছে। তাজা-টাটকা আলো, গোটা ঘরটাই বুঝি জেগে উঠছে স্যালাইন ব্যাগ, অক্সিজেন মাস্ক, রাইস টিউবস জেগে উঠছে; আর বুকের অতল গভীর থেকে শিরশির দোলায় তিনি নিজেও। বেগম জাহানারা চোখ বুঝতে গিয়ে বাধা পেলেন। বিচিত্র নকশাপ্রবণ আলোটা তাকে টানছে। মোটেও মেকি নয়, ভাঁওতা তো নয়ই। এতো টাটকা, যেন স্বাদ-গন্ধময়। শরীরজুড়ে আবার শিরশির। ঘরে কি কেউ নেই। চোখ খুলে এ কী বিপদ। বুজে থেকে থেকে লোভে পড়েই চোখ দুটো খোলে দিনে খোলে, রাতে খোলে। এই যদি চলে, এর শেষ কোথায়? পঞ্চাশ-একশ সপ্তাহেও কী নিজেকে থামাতে পারবেন। তিনি আঁতকে উঠলেন, এ কী বেলেল্লাপনা। দুনিয়া গোল্লায় যায় যাক, তিনি এই চোখ বুজবেন, এই খুলবেন চুপিচুপি চোরের মতো খুলবেন, বুজবেন, ফের খুলবেন এতটা জোর তার ঘোর ঘোর চোখে আসে কোথা থেকে? জোর তো বটেই, সব হিসাব-নিকাশ তছনছ করে দিচ্ছে। তিনি ভাবলেন, কী করেন! পরপরই চুপিচুপি যেন নিজেকেও জানতে না দিয়ে ভাবলেন, আর কত? তখনি পরিবর্তনটা নজরে এলো। জানালার রোদটা দেখলেন ঝিমিয়ে পড়ছে। ঘরের ভেতরে আলোর নকশা-টকশা দ্রুত মুছে যাচ্ছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে মৃদু ঠান্ডা সুবাস ঘুমপাড়ানি মূর্ছনায় শরীরময় চরছে-ফিরছে। বেগম জাহানারা পষ্ট টের পেলেন আসছে এতদিনে লজ্জায় নিজেকে ঢেকেঢুকে আড়াল করার মতো, নিদ্র আব্র“র মতো প্রবল-গহন ঘুম।  আসুক।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত