আমি যখন অনার্স শেষ বর্ষে । মুন তখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী। মেয়েটার পোশাক, কথা বার্তায় গ্রাম্য টান বিরাজমান। শুক্রবার দুপুরে যদি মাথায় শ্যাম্পু দেয় তো সন্ধ্যায় তেল । সপ্তাহে ছয় দিনই মাথায় তেল দিয়ে লম্বা বিনুনি করে, সস্তায় কেনা পোশাকে আসে ভার্সিটিতে। এই নিতান্ত সাধারণ মেয়েটাই অসাধারণ হয়ে উঠলো আমার ব্যাচের রবিন নামক ছেলেটার কাছে। রবিন আর আমি খুব ভালো বন্ধু হওয়ার কারণে ওর মোটামুটি সব কথাই আমার জানা ছিল।
একদিন ক্লাস শেষে আড্ডায় রবিন আমাকে হুট করে সবার থেকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বল্ল,জেসমিন আমার নতুন বর্ষের মুন নামের মেয়েটিকে ভালো লেগেছে।ফাহিম কে বলেছিলাম ও বল্ল তোর সাথে নাকি মেয়েটিকে দুই দিন দেখেছে। তোর কি পরিচিত? আমি তখন চরম বিস্ময় নিয়ে রবিনের দিকে তাকালাম, ভার্সিটিতে প্লেবয় নামেই রবিন পরিচিত।এই চার বছরে অজস্র মেয়ের সাথেই প্রেম করেছে সে, দেখতে স্মার্ট, বাবার অনেক টাকা, হাতে দামি সিগারেট, কাঁধে গিটার তার কি না ভালো লেগেছে ঐ তেলকণ্যাকে। আমি তখন রবিন কে বল্লাম, ভালো লেগেছে না বলে, বল যে টাইমপাস করতে চাস। রবিন মাথা নিচু করে শুধু বলেছিল “আই এম সিরিয়াস” সেদিন আমি রবিনের চোখে অন্য কিছু দেখেছিলাম। একটা মেয়েকে সারা জীবনের জন্য নিজের করে পাওয়ার আকুলতা।
আমি হলে আসার পুরোটা সময় ধরে রবিনের বলা কথাটা ভাবতে ছিলাম৷ মুনের সাথে আমার পরিচয় হয় গত দুই সপ্তাহ আগে।প্রতিদিনের মত সেদিন ও বিকেলের আড্ডা দিয়ে হলে ফিরছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করে দেখি একটি মেয়ে খুড়িয়ে, খুড়িয়ে হলের গেটের দিকে এগিয়ে আসছে। মানবিকতার খাতিরে ই জানতে চাইলাম কি হয়েছে??
তেমন কিছু নয় আপু, টিউশনি থেকে ফেরার সময় স্যান্ডেলটা ছিড়ে গেছে। ভার্সিটিতে পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা সব সময় একটু ভাব নিয়েই চলে সাধারণত। তাদের মতে স্যান্ডেল ছিড়ে গেছে এই কথাটা বলা মানে লজ্জা। তারা মনে করে স্যান্ডেল ছিড়ে গেছে এই কথাটা বল্লে হয়তো মানুষ ভাববে কেমন স্যান্ডেল কেনে যে ছিড়ে যায়। ভালো ব্রান্ডের কিনলে তো ছেড়ার কথা নয়। কিন্তুু ভালো ব্রান্ডের জিনিস ও যে ছিড়তে পারে সেটা তাদের মাথায় আসে না।তাদের মাথায় শুধু থাকে সস্তায় কেনা জিনিস নষ্ট হয়। আর ব্রান্ডের জিনিস কখনই নষ্ট হয় না।
কিন্তুু মুন নামের মেয়েটা এক গাল প্রসস্ত ভাবে হেসে উত্তর দিয়েছিল। তারপরই তার সাথে টুকটাক কথার মধ্যে তাকে চেনা জানা । ওই দিনের পর, দ্বিতীয় বার মুনের সাথে আমার দেখা হয় লাইব্রেরীতে । কিছুদিন পর আমরা সবাই খেয়াল করলাম রবিনের মধ্যে অনেক চেন্জ। ঠোঁটের মাঝে সিগারেট নেই,হাতে ব্রেসলেট নেই, চুল কাটার স্টাইল চেন্জ । খুব প্রয়োজন ছাড়া গান টাও গায় না। বন্ধুদের আড্ডায় উপস্থিতি কম। ফাহিম তো একবার মজা করে বলেই ফেল্ল, রবিন তুই তো “প্রেমে সব সম্ভব ” এই বিখ্যাত উক্তি টা সঠিক প্রমাণ করে ফেল্লি। তোকে দেখেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। তোর তো রাস্তার মোড়ে দাড়ানো আশিকদের মতো অবস্থা। প্রেমে পড়ে পুরো গেটআপ টাই পাল্টে ফেলেছিস।
আমি টিপ্পনী কেটে বল্লাম, এগুলো ছাড় রবিন,এমন তো নয় যে তুই পাল্টে গেছিস।শুনেছি এখন ক্যাম্পাসে সিগারেট খাস না কিন্তুু বাইরে তো ঠিকই খাস। রবিন আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বল্ল কি করবো বল , মুন সিগারেট খাওয়া পছন্দ করে না। ওমন ভাবে চলা ফেরা টাও পছন্দ করে না। এরপর কেটে গেছে বেশ কয় বছর। সবাই সবার মত সেটেল হয়েছি।প্রথম দিকে সবার সাথে যোগাযোগ থাকলেও পরে ব্যাস্ততার কারণে কারও খোজ তেমন ভাবে আর নেওয়া হয়নি। এই এত বছর পর সেদিন রবিনের সাথে দেখা সুপার শপে। ভার্সিটির সবচেয়ে স্মার্ট বয় যে কিনা নিজে খাওয়ার সিগারেট টা নিজে কোনোদিন কিনেছে কিনা সন্দেহ । সে কি না পরিবারের সবার খাওয়ার জন্য চাল,ডাল কিনছে..? আমার এমন কথায় কিছুটা বিস্ময় নিয়ে পেছনে তাকালো রবিন। কিছু সময় কুশলাদি বিনিময় করার পর রবিন কে বল্লাম, সিগারেট খাওয়া কি বাদ দিয়েছিস না কি এখনও মুনের থেকে লুকিয়ে খাস।
রবিন একটু লজ্জিত হয়ে বল্ল, বিয়ের পর ও প্রতিদিন একটা করে খেতাম। ও বুঝতো কিন্তুু কিছু বলতো না।কিন্তুু আমার মেয়েটা পুরো হয়েছে ওর মায়ের মত। তিন বছরের মেয়ে অথচ আমি সিগারেট খেলে ও ঠিক বুঝতে পারে।সেই দিন আর আমার কাছে আসে না।মেয়েকে বড্ড ভালোবাসি বুঝলি ওর থেকে তো আর সিগারেট বড় নয়।তাই একেবারে বাদ দিয়ে দিছি। মুনের সাথে দেখা হওয়ার আগের রবিন আর আজকের রবিন এর মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। এত সেক্রিফাইস করে কি তুই ভালো আছিস রবিন ..? ব্যাপারটাকে সেক্রিফাইস না ভেবে কম্প্রোমাইজ ভাবে দেখ, মুন ও তো কখনও চায়নি আমার মত এত্ত বড় একজন বড়লোক কে বিয়ে করতে।মুনের অনেক ইচ্ছা ছিলো ওর বর প্রতিদিন বাড়ি ফেরার সময় দু হাতে সবজির ব্যগ নিয়ে ফিরবে , আর ও অপেক্ষা করবে সেই বাজারের জন্য। কিন্তুু আমার সাথে বিয়ে হওয়ার পর সেটা তো আর হয়ে ওঠে না তাই মাসে এই একটা দিনই আসি আমি বাজার করতে। ও তো আমার জন্য অনেক কিছু সেক্রিফাইস করে।
আমরা দুজনে যেখানে সেক্রিফাইস করি। সেখানে ব্যাপার টা সেক্রিফাইস না হয়ে কম্প্রোমাইজ হয়ে যায়।
একটু দম নিয়ে আবার রবিন বল্ল,জেসমিন আমার কাছে কম্প্রোমাইজ মানে, নিজেকে হারিয়ে ফেলা নয়।বরং অন্যের সাথে সুখী হওয়া।শুধু একা তো বাঁচা যায় না।একজন সঙ্গী প্রয়োজন । আর সেই মানুষটার একশো ভাগ ই যে আমার ভালো লাগবে এমটা তো নয়। ভালো খারাপ নিয়েই থাকবে। দুজনের ে তখন বহু দিন আগের সেই ফাহিমের বলা কথাটা মনে পড়ে গেলো ” ভালোবাসলে সব সম্ভব”
গল্পের বিষয়:
গল্প