এয়ারপোর্টের ওয়েটিং রুমে বসে আছি সেই দু ঘন্টা যাবত।আমার ফ্লাইট আরো পঁচিশ মিনিট পর।এত তাড়াতাড়ি হয়ত কেউ আসে না।কিন্তু আমি এসেছি যাতে মনে হঠাৎ আসা এই অনুভূতিটা স্থায়ী খুঁটি না গাড়তে পারে। দরদর করে মুখে ঘাম ঝরছে,এসি থাকা সত্বেও, মনে চলতে থাকা তুমুল আন্দোলন আর সাথে তাকে প্রতিহত করার আমার লড়াই তারই জানান দিচ্ছে। আচ্ছা,আমি কি সেই সারা চৌধুরী! তেইশ বছরের শক্ত তরুণী,যার একমাত্র লক্ষ্য ও উদেশ্য তার ক্যারিয়ার। লাইফকে যে সবসময় প্রাকটিক্যালি দেখে,যার সাকসেস পাওয়ার একটু বেশিই তাড়া।তাইতো কলেজ লাইফ থেকে শুরু করে ভার্সিটি পর্যন্ত সে শুধু এর পেছনেই ছুটে চলেছে।
হ্যাঁ,ক্যারিয়ার!আমার ওয়ান অ্যান্ড অনলি প্রায়োরিটি। লাইফের ডিকশনারিতে আমি এই একটা শব্দই রেখেছি,বাকি সব পিছনে।এতদিন ধরে আমি শুধু একে নিয়েই ভেবেছি।শুধু হঠাৎ ‘সারা জানিস,গত কয়েকদিন ধরে আমার পেছনে একটি কিলার লুকিং হ্যান্ডসাম ছেলে ঘুরে বেরাচ্ছে।ছেলেটাকে দেখতেও এত কিউট লাগে!তার ওপর এত ভদ্র!নিজের থেকে হয়ত কিছু বলতে পারছে না।একবার প্রপোজটা করে দিলেই আমি এক্সেপ্ট করে ফেলবো।কবে যে করবে?’ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তুলি,একদিন হঠাৎ আমার কাছে এসেই এক নিঃশ্বাসে হরবর করে কথা গুলো বলতে লাগলো।আমি ওঁকে থামিয়ে বললাম,’ওয়েট।কবে থেকে এসব চলছে?’
তুলি আমার প্রশ্নে আরো এক্সাইটেড হয়ে বলল, ‘আরে ঐ যে ঐ দিন..তোর মনে আছে না! ঐ যে একদিন তোর সাথে বাসে ভিডিওকলে কথা বললাম।তুই আমার পাশে বসা একটা পেট মোটা ভুঁড়িআলা লোককে দেখে আমাকে নিয়ে খিলখিল করে হেসে ক্ষ্যাপাতে থাকলি।’ আমি ওকে আবারো থামিয়ে ধমকের সুরে বললাম,’হ্যাঁ, যেদিন তুমি এয়ারফোন ছাড়াই বাসে বসে আমায় ভিডিওকল করে আমার কথা সবাইকে শুনিয়েছো তাই না?ভাগ্যিস তোর পাশের লোকটা ঘুমিয়ে ছিল!না হলে তোর ফোনটা ধরে একটা আছাড় মারত।গাধী!পাবলিক বাসে কেউ এয়ারফোন ছাড়া ফোন লাউডমোডে রেখে কথা বলে।’
তুলি বিরক্ত হয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল,’আরে সাথে এয়ারফোন ছিল না তো কি করবো!তুই আমার কথা শোন, ছেলেটা সেদিন বাস থেকে নামার পরই আমার পিছু নিয়েছে।এমনকি বাসার সামনেও দাঁড়িয়ে থাকে।তারপর থেকে যখনই বাসা থেকে বের হই তখনই কোথা থেকে যেন চলে আসে।আমারো একটা কপাল! তারপর থেকে যখনই বাসা থেকে বের হওয়া হয়েছে সাথে না হয় আপু,না হয় বাবা,না হয় মা,কেউ না কেউ ছিলোই।তাই তো ছেলেটা হয়ত কিছু বলতে পারে না।এমনকি আজকেও আব্বু দিয়ে গেছে। নয়ত দেখতি আমার পেছন পেছন ঠিক আসছে।’ আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে তুলির কথা শুনতে লাগলাম।বেশি কথা বলা ওর অভ্যাস।এটা নতুন কিছু না।কয়েকদিন পরপরই ওর নিত্যনতুন ছেলেকে ভালোলাগে।আর তারাই তখন ওর সিরিয়াস পছন্দ হয়।আমি এসব নিয়ে অত ভাবি না।একটু সুন্দর হওয়ায় আজ পর্যন্ত যত স্মার্ট,বড়লোক,সুন্দর ছেলেরই প্রপোজাল পেয়েছি সব রিজেক্ট করেছি।তুলি অনেকবার বলেছে রিয়েল লাভ না করলি টাইমপাস তো করতে পারোস?
আমি এক কথায় না বলেছি।এই টাইমপাস শব্দটা আমার কাছে অসহ্য লাগে।টাইম কি এতটাই ফালতু হয়ে গেছে যে তাকে এসব করে পাস করা লাগবে।আর একটা আছে লাভ! লাভ আবার কি!যত্তসব ফিল্মের রোমান্টিক লুতুপুতু কয়েকটা ডায়লগ।তা ছাড়া আর কিছুই না।এসব নব্বই দশকে বলা মানাতো,এই বিংশ শতাব্দীতে না।দেখি তো আশেপাশে,কত আছে দুজনের মধ্যে লাভ! তাই এই লাভ সাভের ওপরেও আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।আমার ইন্টারেস্ট তো শুধু ক্যারিয়ার। জোরে ফোনের রিংটনের শব্দে আমার চমক ভাঙলো।কখন যে ব্যাগটা হাত থেকে পরে এয়ারপোর্টের ফ্লোরে পরে রয়েছে খেয়াল করি নি।ব্যাগটা তুলে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা বের করলাম।সার্ভিস কল ছিল তাই কেটে দিলাম। আমি ভেবেছিলাম সে ফোন করেছে!
তুলির সেই অজ্ঞাত ছেলের কথা জানানোর দুই দিন পরই তুলি আবার আসে আমার সাথে একটা কফি শপে মিট করতে।আমি আগেই চলে এসেছিলাম,বসে বসে ফোনে টেম্পল রান গেমস খেলছিলাম।এমন সময় তুলি গোমড়া মুখে আমার সামনের চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়ে।আমি ওর দিকে না তাকিয়েই গেমস খেলা অবস্থায় বললাম,’কি হল ঐ ছেলের সাথে কি ব্রেকআপ হয়ে গেছে?’ তুলি বিরক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’উফ! প্রেম না হতেই ব্রেকআপ হয় কিভাবে।আর ঐ ছেলে আমাকে না তোকে পছন্দ করে।’ তুলির কথা শোনা মাত্রই আমি,মানে গেমসের আমি রাস্তা ছেড়ে খাদে টুপ করে পড়ে গেলাম।গেম ওভার! এই প্রথম কোনো ছেলের ব্যাপারে বেশ অবাক হলাম। তুলির দিকে অগ্রসর হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।কিন্তু তুলি মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়েই বলে যাচ্ছে, তোর সাথে দেখা হওয়ার পর দিনই আমি ছেলেটাকে নিজ থেকে গিয়ে বললাম,’আপনি কি আমায় কিছু বলতে চাচ্ছেন?সঙ্কোচ না করে বলে ফেলুন।আমি এখনও সিঙ্গেল।’
এত আশা করে বললাম কিন্তু ছেলেটা কি বলল জানিস! ‘আপনি সেদিন একটা মেয়ের সাথে বাসে ভিডিওকলে কথা বলছিলেন।ঐ মেয়েটি কে?’ আমার মুখ ইয়া বড় হা হয়ে গেল।এই ছেলে এতদিন তোর কথা জানার জন্য আমার পেছনে ঘুরেছে। সেদিন বাসে সে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।তোর সেই মুগ্ধকর খিলখিল হাসি শুনেই আমার ফোনের দিকে তাকায়।আর তারপর থেকেই চলছে। ছেলেরা মেয়েদের পছন্দ করে তাদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে পাগল হয়ে যায় শুনেছি,কিন্তু পছন্দের মেয়ের বান্ধবীর পেছনেও যে ঘুরে তা এই প্রথম দেখলাম!’ আমি এবার অবাক ভাব কাটিয়ে আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বললাম,’ধুর…!তোর সাথে মজা করেছে।’ তুলি গলায় চিমটি দিয়ে বলল,’সত্যি বলছি!
সে একদম সিরিয়াস হয়ে বলছিল।তাকে দেখলেই বোঝা যায় সে মজা করার ছেলে না।শেষমেশ কিনা তোকেই পছন্দ
করল!’ তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আফসোসের সুরে বলল,’বেচারা!’ ওর এমন ছেলেটার জন্য আফসোস করে বেচারা বলার কারণ আমি জানি।ওর মতে ছেলেটা আমাকে অনেক সিরিয়াস টাইপ পছন্দ করে।কিন্তু আমি যে রিজেক্ট করে দিবো সেটাও তুলি ভালো করে জানে।তাই নিয়ে ছেলেটার জন্য ম্যাডামের সিমপ্যাথি জাগছে। হঠাৎ তুলি টেবিলের ওপরে রাখা আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বাম হাত উঠিয়ে আমার পেছনে ইশারা করে জোরে বলল,’সারা,ঐ দেখ আয়ান।’ আমি কপাল ঈষৎ ভাঁজ করে বললাম,’আয়ান?’ তুলি অস্থির হয়ে বলল,’আরে ঐ ছেলেটা।’ আমি ওর হাত বরাবর পিছনে তাকালাম।
সামনে থাকা ওয়েটারটা একটু সরে যেতেই চোখে পড়ল আমাদের ডান সারির ঠিক চার টেবিল পর টেবিলে কফি কালার শার্ট গায়ে একটি ছেলে বসে আছে।হাতে ব্লাক ব্রান্ডেড ঘড়ি।সামনে চুলগুলো হালকা স্পাইক করা,একটু যেনো অগোছালো কিন্তু এতেই যেনো বেশি ভালোলাগছে।বাড়িয়ে বলা স্বভাবের তুলির বর্ণনার থেকেও ছেলেটা আরও বেশি সুন্দর।বয়স আমার থেকে এক বা দুই বছরের বেশি হতে পারে।তুলি ঠিকই বলেছে,ছেলেটাকে দেখলেই বোঝা যায় চুপচাপ,ভদ্র। এতক্ষণ আমাদের দিকেই তাকিয়ে ছিল কিন্তু আমি তাকাতেই মাথা নিচু করে ফেলে।মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু বিশেষ সুবিধা হচ্ছে না। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিরে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললাম,’ভালো!’ তুলি চোখ কপালে তুলে বলল,’শুধু ভালো?’
-‘তো আর কি বলব! আচ্ছা ফাইন,শুধু ভালো না অনেক ভালো।কিন্তু তুই আমার থেকে যেটা এক্সপেক্ট করছিস সেটা কখনোই সম্ভব না।কারণ তুই জানিস,ফাইনালি দুই বছর প্রাণপণ চেষ্টা করার পর আমি নিউজিল্যান্ডের একটি বড় কোম্পানিতে ভালো পোস্টে জব পেয়েছি।আর আড়াই মাস পরই আমি নিউজিল্যান্ড যাবো।তো এখন আমি এসব নিয়ে কেনো ভাববো?’
সত্যিই তো আমি এসব নিয়ে কেনো ভাববো!আমি যা চাই তাই তো হচ্ছে তবে এখন কেনো এয়ারপোর্টে বসে আমার এত অস্থির লাগছ। চারপাশে মানুষ গিজগিজ করছে।কেউ আসছে কেউ যাচ্ছে।আমার পাশে একটি আঠারো উনিশ বছরের মেয়ে ফিসফিস করে হেসে হেসে ফোনে কথা বলছে।নিশ্চয়ই মেয়েটির বয়ফ্রেন্ডের সাথে।ফিসফিস করে কথা বললেও মেয়েটির সব কথাই আমি বুঝতে পারছি,,,,, ‘আরে বাবা!আমি তো একমাসের জন্যই যাচ্ছি।সেখানে গিয়ে রোজ ফোন দিব।’ এই পর্যায়ে মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল,’এখন কি স্টকার হয়ে যাবে নাকি?’ স্টকার! কথাটা আমার কানে খুব বাজলো। সেদিন প্রথম আয়ানকে কফিশপে দেখার পর প্রতিদিনই সে আমার পিছু নিত।যেখানেই যেতাম সেখানেই সে থাকতো।
আমার রুটিনে এর একটা দৃশ্য ছেপে গেল।আমি রাস্তায় বেরোলাম মানেই আমার পিছনে ক্যাসুয়াল শার্ট,জিন্স গায়ে একটি ছেলে মাথা নিচু করে হাটঁতে থাকবে।শার্টের হাতা থাকবে কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করা।হাতে ব্রান্ডেড ঘড়ি।আর চুলগুলো সবসময়ের মতোই হালকা স্পাইক করা আর একেবারে একটু অগোছালো।এভাবেই একেক দিন একেক কালারের শার্ট গায়ে ভদ্র ছেলেটা স্টকারের মত আমার পিছু নিতে লাগল। কিন্তু নাহ্!আয়ানকে ঠিক স্টকার বলা যায় না। কারণ সে খুব দূরত্বে থেকেই আমার পিছনে আসত।কখনো উত্ত্যক্ত ফিল হয় নি।বরং আরো সেভ ফিল হতো।যখন রাত করে আমি রিকশায় চড়ে গার্লস হোস্টেলে ফিরতাম, পিছন পিছন সে তার বাইক নিয়ে আমার হোস্টেল পর্যন্ত আসত।ফলে আর নির্জন রাস্তাকে ভয়ানক লাগত না। আমি ভেবেছিলাম পাঁচ দিনের মধ্যেই আয়ান আমাকে প্রপোজ করে বসবে।কিন্তু সেই সংখ্যা যখন গড়িয়ে সতের দিনে পৌঁছালো তখন আমার কাছে বেশ অবাক লাগলো।এখন পর্যন্ত কথা বলারও চেষ্টা করেনি।ছেলেটা চায় টা কি!কিছু বলছেও না আবার পিছু পিছু ঘুরছে!শুধু শুধু,কেনো?
আয়ানকে প্রথম যেই কফিশপে দেখেছিলাম সেখানে আমি প্রায়ই যাই।বলতে গেলে সেটা আমার একটি ফেবারেট প্লেস।একদিন একা একাই সেখানে বসে কফি খাচ্ছিলাম।ঘাড় এদিক সেদিক ঘুরাতেই দেখলাম আয়ানও চলে এসেছে।এদিক সেদিক তাকিয়ে বসার জায়গা খুঁজছে।আজ সব সিটই বুকড হয়ে আছে।কোথাও জায়গা নেই।আমি হাত ইশারা করে তাকে ডেকে বসতে বললাম। আয়ান একটু ইতস্তত করে এসে বসে পড়ল। আমি একটু হেসে বললাম,’প্রতিদিন যেহেতু আমার পিছু নিবেই আর আমি যেখানে যাই সেখানেই চলে আসবে তাহলে আর আলাদা আলাদা বসার কি দরকার,একসাথেই তো বসে গল্প করতে পারি। আর বোরিং ও লাগবে না।দুজন একে অপরের কোম্পানিও পাবো।’ আয়ান চুপ করে মাথা নিচু করেছিল।আমার কথা শেষ হওয়ার পর আমার দিকে তাকালো।আমি ওর কোনো উত্তর না পেয়ে মুখে একটা হাসি নিয়ে ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করলাম ওর মত কি। কিন্তু আয়ান সেদিকে ভ্রক্ষেপ না করে একটু মুচকি হেসে লাজুক ভঙ্গিতে বলল,তুমি সেদিনও ঠিক এভাবেই ভ্রু নাচিয়ে হাসছিলে।’
-‘কোনদিন?’
-‘ঐ যে বাসে তুমি তোমার ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলে।’
আমি ওর কথা শুনে অবাক হলাম।ওঁকে বললাম,’আমি কিভাবে না কিভাবে হেসেছি সেটা তোমার এখনও মনে আছে?’ আয়ান হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে বলল,’আমি এটা কখনো ভুলতে পারবো না।’
আমি ওকে থামিয়ে বললাম,’লিসেন আমি কিন্তু আর দু মাস পরই ‘দু মাস পরই নিউজিল্যান্ড যাবে।সেখানে তুমি জব পেয়েছো।তারপর কবে দেশে আসবে না আসবে তার কোনো ঠিক নেই।’ আমি বললাম,’তাহলে যখন জানোই তাহলে শুধু শুধু কেনো সময় নষ্ট করছো?’ আয়ান খুব আবেগ স্বরে বলল,’এর থেকে বেশি সময়ের বেস্ট ব্যবহার নিজের জন্য আর কখনো করিনি।’ আয়ান! খুব অদ্ভুত লেগেছিল আমার ছেলেটিকে।একটা মেয়ের পেছনে শুধু শুধু ঘোরা মানে নিজের জন্য সময়কে বেস্ট কাজে লাগানো…মানে কি?প্রথমে মনে হয়েছিল মাথায় কোনো সমস্যা আছে।এত আবেগের কথা আজকাল কে বলে। পরে দেখি না,কথা বার্তায় তো ভালোই স্মার্ট। অপরিচিত মানুষের সাথে সহজেই মিশতে পারার গুন আমার মধ্যে আছে।আয়ানের সাথে কিছুদিনের মধ্যেই ভালো মিশে গেলাম।
এমন কিন্তু না,যে আয়ান আমাকে তার ফিলিংস বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে।সে এসব নিয়ে কিছুই বলতো না।এমনকি এখনো নিজের মুখে আমাকে পছন্দের কথাও বলেনি।কিন্তু যতটুকু সময় পেত খুব হাসি মুখে আমার সাথে থাকত।ওঁকে আমি খুব লাইটলি নিয়েছিলাম।ওর ইমোশনাল কথাগুলো আমার কাছে খুব ফানি লাগাত।সেসব কথা শুনে ওর সামনেই হাসতে থাকতাম।ওল্ড রোমান্টিক ফিল্মের ডায়লগের মত মনে হত।এসব আবার হয় নাকি!
এয়ারপোর্টের স্বচ্ছ গ্লাস দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে।আচ্ছা এমন ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতেও কি প্লেন চলে?ফ্লাইট আবার ক্যান্সেল হয়ে যাবে না তো! ক্যাফিটেরিয়াতে আমি আর আয়ান বসে ছিলাম। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে।এদিকে সন্ধ্যাও হয়ে যাচ্ছে।বৃষ্টির বেগ দেখার জন্য দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। আয়ান পাশ থেকে বলে উঠল,’সারা,আমার বাইক দু মিনিট হেঁটে চলা রাস্তার পরেই এক গ্যারেজে রাখা আছে।চলো,সেখান থেকে বাইক নিয়ে বাসায় যাই।এর ভেতর মনে হয় না গাড়ি পাওয়া যাবে।’
-‘আগে বৃষ্টি থামুক।দু মিনিট হেঁটে যেতে গেলে ভিজে যাবো।’
-‘তাছাড়া তো আর উপায় নেই।কেনো!তোমার বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে না?’
-‘লাগে,বাট এখন যদি বৃষ্টিতে ভিজি তবে রাতের মধ্যেই হালকা ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা হতে পারে।
আর তার জন্য আমাকে ঠান্ডার ঔষধ খেতে হবে।ঠান্ডার ঔষধের কারণে ঘুম বেড়ে যাবে।আর তার ফলে আমি বাই চান্স সকালে আমার এয়ারপোর্টে পাসপোর্ট করানোর কাজে যাওয়ায় লেট করে ফেলতে পারি।’ আমার কথায় আয়ান হেসে ফেলল।বলল,’এত চিন্তা করে কিছু করা যায় নাকি!যা ভালো লাগবে তা করে ফেলবে,জাস্ট ফ্লো উইথ ইট। পরের টা পরে দেখা যাবে।এত প্রাকটিক্যালি ভেবে কি হবে?’ ওর কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। আমি অবাক হয়ে বললাম,’প্রাকটিক্যালি ভেবে কি হবে মানে?সবকিছু তো প্রাকটিক্যালিই হয়।’ আয়ান ঈষৎ হেসে বলল,’সবকিছু প্রাকটিক্যালি হয় না।’
আমি এবার ফিক করে হেসে ফেলে বললাম,’মি. আমার ফরেইন যাওয়ার কথাটা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যাও তারপর ভেবে দেখ,আমাদের ভেতর এমনিতেও কিছু হতে পারবে না।তুমি আর আমি কম্পলিট লি ডিফারেন্ট। দুইটা বিপরীত মেরু।আমি যতটাই প্রাকটিক্যাল ভাবি তুমি ততটাই ভাবুক।’ আয়ান একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বৃষ্টিতে নেমে বলল,’চুম্বকের দুই বিপরীত মেরুই কিন্তু আকর্ষিত হয়।’ বৃষ্টি ভেজা ওর সেই মিষ্টি হাসি দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না।আমার আর কি করার আমাকেও বৃষ্টিতে নামতে হল।দুজনে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ছুটে গ্যারেজের দিকে যাচ্ছি।
দুষ্ট আকাশ যেনো আমাদের দেখে তার বৃষ্টি আরো বেশি করে ঝরিয়ে দিচ্ছে।তার সাথে গুরুম গুরুম শব্দ তো আছেই।গ্যারেজ থেকে ওর বাইকটা বের করলো।সেখান থেকে একটা ছাতাও জোগাড় করে নিয়েছে আমার জন্য।
আমি বাইকে ওর পেছনে বসে ছাতাটা শুধু আমার ওপরই না আয়ানের মাথায়ও ধরে রাখলাম। মিররে তাকিয়ে একটি মুচকি হাসি দিয়ে আয়ান আস্তে আস্তেই ফাঁকা রাস্তায় বাইক চালাতে লাগল।ছাতা উড়ে না যাওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা।আর তুমুল বৃষ্টি থামার যেন নামই নিচ্ছে না। আমার মনে আয়ানের চিত্র ছাপলো বোকা সোকা ছেলে হিসেবে।বোকা ছাড়া আর কি!ও খুব ভালো করেই জানে আমি এর থেকে বেশি আর কখনো আগাবো না,তবুও বেকুবের মত আমার জন্য সময় নষ্ট করছে।সময়ের যে খুব দাম ক্যারিয়ারের জন্য!
আমার বাবা বলে,জিবনে সবথেকে বড় ইম্পর্টেন্ট হল,ক্যারিয়ার।এর থেকে বড় কিছু নেই। রাস্তা পার হওয়ার সময় সোজা সামনে না তাকিয়ে যদি এদিক ওদিক বারবার দেখতে থাকে তাহলে যেমন সরাসরি অ্যাক্সিডেন্ট হয়,তেমনি জিবনেও ক্যারিয়ারের দিকে সোজা নজর রেখে চলতে হয়, আশেপাশে না তাকিয়ে।সেভাবে না চললে জিবনেও অ্যাক্সিডেন্ট।মা খুব আপত্তি করত বাবার এমন কথায়।বলত,’মেয়েটাকে আর ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করে পাথর বানিয়ো না।ক্যারিয়ার ছাড়াও জিবনে আরো অনেক কিছুর দিকে নজর দিতে হয়।’ বাবার আদর্শই আমি মাথা পেতে নিয়েছিলাম।মার কথায় কোনো কান দিতাম না। যেমনটি কান দেইনি সেদিন তুলির কথায়। আমার রায় জিবন সম্পর্কে এখনও এমন জেনে ও খুব বিরক্ত হয়ে বলেছিল,’এত ভালো ছেলে পেয়েও তুই হারিয়ে ফেলবি।আয়ান কতটা ভালোবাসে তোকে সেটা কি তুই একটুও বুঝিস না।ক্যারিয়ারই কি সব?’ আমি জবাব দিয়েছিলাম,’ হ্যাঁ,আমার কাছে ক্যারিয়ারই সব।’
কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে।গলায় পেচানো ওড়নাটা হাত দিয়ে আরো আলগা করে নিলাম। বোতলের অবশিষ্ট পানির সবটুকুই পান করলাম।এখন পর্যন্ত চার বোতল পানি খেয়েছি। আমার কিছুটা সামনেই একটি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে তার ফ্যামিলি কান্না করছে।তাদের পাশে একটি বেগুনি রংয়ের শাড়ি পরিহিতা মেয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হয়ত নতুন বউ,স্বামী বিদেশে চলে যাওয়ায় ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।পরিবারের সবার ভীড়ে একটু কাছেও যেতে পারছে না। ছেলেটিও বারবার মন খারাপ করে মেয়েটিকে দেখছে।অশ্রু না ঝরিয়েও যেনো মেয়েটির কষ্ট সেখানকার সবার থেকে বেশি ছাপিয়ে উঠছে।
এত কষ্ট লাগে আপনজনদের ছেড়ে যেতে! জানতাম না তো! আমার নিউজিল্যান্ড যাওয়ার পাসপোর্ট নিয়ে একটি ঝামেলা বেঁধে গিয়েছিল।মন ভীষণ খারাপ হয়েছিল।শেষমেশ পাসপোর্টের ঝামেলায় কোনো সমস্যা না হয়!আয়ান জানতে পেরে খুব ছোটাছুটি করে সেই সমস্যা নিয়ে। ছেলেটি আমাকে দিন দিন শুধু অবাকই করছিলো। সে যদি আমাকে সত্যিই পছন্দ করে থাকে তাহলে তো তার চাওয়ার কথা আমি যেন নিউজিল্যান্ডে না যেতে পারি।তা না করে আমার যাওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে এভাবে খেটেছে যেন আমার থেকে ওর বেশি চিন্তা।সমস্যাটা খুব সুন্দর ভাবেই মিটিয়ে ফেলে।
আয়ান রিটায়ার্ড জর্জের ছেলে,মা নেই।বাবা বেশিরভাগ সময় বিদেশেই থাকে এখন। বাড়ির কেয়ারটেকার করিম চাচার কাছেই সে বড় হয়েছে।ও নিজে একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। একদিন নিয়ে গিয়েছিল ওদের বাসায় পাসপোর্টের কাজেই।বিশাল বড় বাড়ি।আয়ানকে দেখলে বোঝা যায় না ওদের অবস্থা কেমন।খুব সিম্পল থাকে সে। কখনো গাড়ি বাড়ি নিয়ে আমাকে ইম্প্রেসও করতে আসে নি। নয়তো আজকালকার ছেলেরা একটু টাকাআলা হলেই যে ভাব দেখাতে থাকে মেয়েদের সামনে। এমনি একটি টাকাআলা ছেলে আমার পিছে লেগেছিল।উফ!গাড়ি নিয়ে এসে সামনে কি যে ভাব দেখাতো!দেখিয়ে দেখিয়ে গাঁদা গাঁদা টাকা খরচ করত। আমার পাত্তা না পেয়ে নয়দিনের মাথায় ফুট!
অথচ প্রথম দিন প্রপোজের সময় কত কথাই না বলেছিল,আমাকে ছাড়া বাঁচবে না,আমাকে একপলক না দেখলে ওর হার্টবিট থেমে যায়,,,ব্লাহ ব্লাহ… দশদিনের দিন দেখেছিলাম তো একটি নতুন মেয়ের সাথে।আর এটাকেই নাকি বলে ওদের সো কল্ড লাভ! একদিন আয়ানের বাসায় তার কম্পিউটারে আয়ানের থেকে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম নিয়ে শিখছিলাম।এমন সময় মার ফোন আসে।আমি রিসিভ করে কথা বলতে থাকি অন্য দিকে তাকিয়ে।হঠাৎ আয়ানের একটি ইমেইল আসে।আমিও আড়চোখে পড়ছিলাম।নিউইয়র্কের একটি ফেমাস কোম্পানি থেকে জব অফার।আয়ান সেখানে সিলেক্টেড হয়েছে।এই কোম্পানির নাম আমিও জানি।অনেক যোগ্যতা প্রয়োজন এখানে জব পাওয়ার জন্য।আমি নিজেও আরো তিনবছরের আগে এখানে জবের কথা ভাবতেও পারবো না।
তারা আর্জেন্ট লোক চায়।ডেট দেয়া আছে।আয়ান যদি যায় তাহলে আমার যাওয়ার আগেই ওর যাওয়া হবে।আয়ান একবার ইমেইল টা পরেই ডিলিট করে দিল।আমার চোখ ছানাবাড়া হয়ে গেল ওর কাজে। আমি ফোন কেটে বিস্মিত হয়ে চেঁচিয়ে বললাম,’এটা তুমি কি করলে?’ আয়ান আমার দিকে না তাকিয়েই অপ্রস্তুত হয়ে বলল,’আমার একটা কাজ আছে।আমি এখন যাই হ্যাঁ?তুমি বাসায় চলে যেয়ো।’ আমাকে আর কিছু না বলার সুযোগ দিয়েই সে চলে গেল।আমি শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার চলে যাওয়ার দিকে।মানুষটা কি সে? এক মিনিটও সে ভাবলো না ইমেইল ডিলিট করার আগে।এত বড় অফার কে মিস করে? ‘অ্যান্টি অ্যান্টি..আমার এই টেডি বিয়ারটা একটু কিছুক্ষণের জন্য তোমার কাছে রাখবে?’
একটি পাঁচ বছরের মিষ্টি মেয়ে আমাকে হাত ধরে ডেকে বলছে কথাগুলো।আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে রাখলাম তার মাঝারি সাইজের টেডি টা। পিছন থেকে তার মা বলছে,’হয়েছে এবার? এখন চলো ওয়াশরুমে।’ একটু পর ছোট্ট মেয়েটি ফিরে এসে আমার হাত থেকে টেডি টা নিয়ে নিল।তার মা শিখিয়ে দিল,’অ্যান্টিকে থ্যাংক ইউ বলো এবার।শুধু শুধু জ্বালালে।আমার কাছেও তো রাখতে পারতে।’ মেয়েটি প্রতিবাদের স্বরে বলল,’না।তোমার কাছে রাখলে তুমি ফেলে রেখে চলে যেতে।আমার টেডি টাকে বিদেশে তুমি নিতে চাওনি।’ তার মা তাকে বলল,’তো মামুনি আর কি বলবো! শুধু শুধু এত বড় টেডি হাতে করে বিদেশে নেওয়ার কি দরকার।আমরা সেখানে গিয়ে তো এর থেকেও বড় টেডি কিনতে পারতাম,তাই না?’ মেয়েটি জোরে বলল,’না আমার এই টেডিটাই চাই। আমার ফ্রেন্ড ও।আমি ওঁকে ভালোবাসি।’
তারপর আমার গালে তার নরম হাতটি আলতো করে ছুঁয়ে বলল,’বলো তো অ্যান্টি ভালোবাসার জিনিসকে কি ফেলে যাওয়া যায়?’ আমার গালে একটি চুমু দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘থ্যাংক ইউ।’ মেয়েটে এক হাতে মায়ের হাত আরেক হাতে তার টেডি বিয়ারটা নিজের সাথে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে হেঁটে যাচ্ছে।আমার চোখ ছলছল করে উঠল। আমার ইমোশন খুব কম।চোখে পানি খুব কমই আসে।আর আজ! সেদিনের পর আয়ানের সাথে আমার আর দেখা হয়নি।নিজের যাওয়া নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। নিউজিল্যান্ড যাওয়ার ঠিক তিন দিন আগে ওর সাথে দেখা করলাম সেই কফি শপে। আয়ান এসে বসতেই আমি তাকে আগে থ্যাংক ইউ বললাম।সত্যি, অনেক হেল্প করেছে! আয়ান মিষ্টি হেসে বলল,’থ্যাংকস বলার দরকার নেই।’
-‘তাহলে কি চাও?
-‘কিছু না।’
আমি অবাক হয়ে হেসে বললাম,’কিছুই চাও না।আমার কিন্তু যাওয়ার সময় এসে গেছে।এত দিন আমার পেছনে ঘুরেছো।এত হেল্প করেছো।কোনো কিছুর জন্যই নিশ্চয়ই?তোমার আমার থেকে কোনো চাওয়া নেই?’ সে আবারো হেসে বললো,’না।’ আমি সত্যিই এবার চরম অবাক হলাম।
শুধু শুধু কেউ কারো জন্য কিছু করে না।সূক্ষ্ম হলেও সম্পর্কে একটু না একটু চাওয়া সবারই থাকে। একবার একটি ছেলে আমাকে লিফ্ট দিয়েছিল তার গাড়িতে।গাড়ি থেকে নামার আগে ফোন নাম্বারটা ঠিকই চেয়ে নিল।আমি একটুও অবাক হই নি কারণ আমি জানতাম এমন কিছুই হবে।কোনো কিছু চাওয়ার পরিবর্তেই সে আমাকে এতটা রাস্তা নিয়ে এসেছে। আয়ান সম্পর্কেও ধারণা আমার এমনই ছিল। আমি ভেবেছিলাম সেও আমার কাছ থেকে লাস্ট মোমেন্টে কিছু চেয়ে বসবে।সবসময় কন্টাক্ট করতে চাইবে বা এর থেকেও বড় কোনো প্রতিশ্রুতি অথবা আমাকে না যাওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করবে। কিন্তু নাহ্!তার নাকি কিছুই চাই না।এতটা স্বার্থহীন হয়ে কেউ কারো জন্য কিছু করে? আমি বললাম,এত কিছু শুধু শুধু তাহলে কেনো করলে?কিছুই তো পেলে না। আয়ান মাথা নিচু করে হেসে বলল,পেয়েছি আর পাচ্ছি।’ আমি অবাক হয়ে বললাম,কি?
-‘তুমি বুঝবে না।’
আমি অস্ফুট স্বরে বললাম,ভালোবাসো আমাকে? আয়ান মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বলল, তোমাকে দেখার পর থেকে তোমাকে নিয়ে মাইন্ড এত ব্যস্ত হয়ে পরেছিল যে কখনো নিজেকে এটা প্রশ্ন করারও সময় পাই নি।এখন যেহেতু তুমি জিজ্ঞাসা করলে তাই ভেবে দেখলাম ভালোবাসা যদি এমন হয় তাহলে ভালোবাসাই।’ হঠাৎ আমার মনে পড়ল সেই ই-মেইলের কথা। আমি বললাম,’একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো? সত্যি বলবে কিন্তু।’
-‘আমি তোমাকে কখনো মিথ্যা বলি না।’
-‘সেদিন ই-মেইল টা তুমি ডিলেট করলে কেনো?এত বড় জবের অফার কেউ রিজেক্ট করে?’
-‘জবের জন্য জয়েন যদি আর চারদিন পর করা যেত তাহলে করতাম।
কিন্তু এখন যদি একসেপ্ট করতাম তাহলে আমাকে তোমার আগেই যেতে হতো।’ আমি চোখ কপালে তুলে বললাম,’তো? চারদিন,তিন দিনে কি হয়?এটা ভাবার জন্য তুমি এক মিনিটও সময় নিলে না!’ আয়ান মৃদু হেসে বলল,’এতে ভাবা ভাবির কি আছে,আমি শুধু এতটুকু জানি লেগেন্সের উপরে থ্রি কোয়ার্টার হাতার লং টপ আর গলায় দুই প্যাচ দিয়ে ওড়না জড়ানো হালকা কোকড়া চুলের একটি মেয়ে আছে যাকে একবার দেখার একটি সূক্ষ্ম সুযোগ থাকলেও তা মিস করার সাধ্য আয়ানের নেই।তিনদিন বেশি দেখতে পারবো এ তো অনেক!’ আয়ানের কথা শুনে কিছুক্ষণ হা হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে খিলখিল করে হেসে দিলাম।সিরিয়াসলি ওর এমন বোকা বোকা ইল-লজিক্যাল কথা শুনে আমার খুব হাসি পেয়েছিলো। তারপর হাসি থামিয়ে বললাম,’তাহলে আমি তো তিনদিন পর চলে যাবো তার পর কি করবে?’ আয়ান চুপ করে রইল। আমি বলতে থাকলাম,’ঠিকাছে আমাকে শুধু দেখলেই যদি তোমার এত বড় পাওয়া হয়ে যায় তাহলে আমি তোমাকে একটা ট্রিট দিচ্ছি।’
হাতঘড়ি দেখে বললাম,’তোমাকে সতের মিনিট সময় দিচ্ছি।এই সতের মিনিট আমি চুপ করে বসে থাকবো আর তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবো।তুমিও আমাকে চুপচাপ তাকিয়ে শুধু দেখে যাবে,স্টার্ট। আমি আয়ানের দিকে চুপ হয়ে তাকিয়ে আছি।মিটিমিটি হাসি পাচ্ছে বাট চেপে রেখেছি।আমি মজার ছলে নিলেও ও খুব সিরিয়াস ভাবেই আছ।পাগল ছেলে!একদৃষ্টিতেই আমার দিকে তাকিয়েই আছে। পলকও ফেলছে না। নয় মিনিট হয়ে গেছে।এবার আয়ানের চেহারায় আস্তে আস্তে একটা মলিন হাসি ভেসে উঠল।চোখে যেন কিছু চেপে রাখার ছাপ ফুটে উঠছে।চোখ হালকা ছলছল করছে।হঠাৎ আমার যেন কি হল।হাসি উধাও হয়ে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।এগার মিনিটের মাথায় আমি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ধপ করে দাঁড়িয়ে রুক্ষ হয়ে বললাম,’আর কক্ষনো আমার সামনে আসবে না।’ কথাটি বলে দ্রুত হনহনিয়ে চলে আসলাম।
আমার কথামত আয়ান আর আমার সামনে আসেনি।আর আমি এই তিন দিন দ্রুত কাটার অপেক্ষা করতে লাগলাম।জিবনের সত্য বিপরিত স্রোতে চলার তুমুল চেষ্টা করছে।আমি কঠোর শ্রমে তাকে ঠেকিয়ে রাখছি।
সেদিনের পর থেকে আমার এমন লাগছে কেনো? মনে হচ্ছে শ্বাস নিতেও পারছি না।কি যেনো নেই নেই।চরম অস্থির লাগছে। ‘ফ্লাইট নাম্বার BA2232 যাত্রীদের জানানো যাচ্ছে যে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্লাইট টেক ওফ করবে।’ আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।চারপাশে অসংখ্য মানুষ।সবার মাঝেই এক ব্যস্ততা।সেই ব্যস্ততার মাঝে আমি কিছু মুহূর্ত স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। আমার চারপাশটা যেনো ঘুরছে। লাগেজের হ্যান্ডেলটা শক্ত করে ধরে দ্রুত চলা শুরু করলাম।গেটে থাকা গার্ডরা আটকিয়ে বলল, ‘ম্যাম একবার বেরোলে কিন্তু আপনি আর ফেরত আসতে পারবেন না।’ আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। গার্ড আবার বলল,’আর ইউ সিওর?’
-‘এর থেকে বেশি সিওর আমি আর কখনো হই নি।’ নেমে এলাম রাস্তায়।ট্যাক্সি ধরে আয়ানের বাসার সামনে নামলাম।এয়ারপোর্টে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হলেও এখানে বেশ জোড়ে সোরে নেমেছে।আজ কোনো খারাপ লাগছে না কোনো চিন্তা হচ্ছে না জাস্ট ভিজে যাচ্ছি। করিম চাচার থেকে জানলাম আয়ান উপরে রুমে আছে।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে রুমে গিয়ে দেখলাম পুরো রুমে আামার ছবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা।রুমের ছাদে সেই ছাতাটা এখন সোপিজের ন্যায় ঝুলে আছে।সেভাবেই খোলা অবস্থায়।সেখানে নাকি আমার স্পর্শ আছে তাই আর সেটা ফেরত না দিয়ে নতুন ছাতা কিনে দিয়েছে তাদের।পাগল একটা! আয়ান রুমের বাইরে খোলা ছাদের কোনায় গুটিশুটি মেরে বৃষ্টিতে বসে কাঁদছে। আমি পেছনে গিয়ে ডাক দিলাম,আয়ান। আমার আওয়াজ শুনে সে অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে মুখে হাসি টানার চেষ্টা করল। বৃষ্টি হচ্ছে তবুও খুব অদ্ভুত ভাবে অশ্রু ঠিকই বোঝা যাচ্ছে। ও বলল,’সারা,আজকে না তোমার ফ্লাইট?তুমি এখানে এসেছো কেনো?আমাকে ফোন করতে আমি তোমার কাছে চলে যেতাম।’ আমি বৃষ্টিতে ঠায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ চুপ হয়ে তার কথা শুনছিলাম।বলা শেষ হলে তারপর বললাম,’এখনো মুখে হাসি এনে রেখেছো?তোমার কষ্ট হচ্ছে না? আমার কথায় সে আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,’তোমার খুশি তো তার মধ্যেই।’
আমি ফুফিয়ে কেঁদে উঠে বললাম,’না।আমার খুশি তার রাস্তা ঘুরিয়ে নিয়েছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে সেই পুরনো রাস্তায়।আমি বুঝে গেছি রাস্তা পার হওয়ার সময় সোজা সামনে না তাকিয়ে বারবার এদিক ওদিক দেখলে যেমন অ্যাক্সিডেন্ট হয় তেমনি আশেপাশে একেবারেই না দেখে শুধু সোজা তাকিয়ে থাকলেও অ্যাক্সিডেন্ট হয়।জানি না কেনো মানুষ ভালোবাসার সাথে ক্যারিয়ারের তুলনা করে!কেনো এই দুটোর মাঝে একটি চুজ করতে হিমশিম খায়! যেখানে সবকিছুই এত পরিষ্কার, ‘ক্যারিয়ার হলো জীবনে একটু ভালো ভাবে বেঁচে থাকার উপায়।আর ভালোবাসা হলো জীবন।আগে বেঁচে থেকে তারপর তো ভালো করে বাঁচার কথা চিন্তা করতে হবে তাই না!ভালোবাসার সাথে কোনো কিছুর তুলনা হয় না।ভালোবাসা তুলনাহীন।’আয়ান চোখের পানি আড়াল করে বলল,’কিন্তু তোমার এত বড় সুযোগ?’
আমি তাকে থামিয়ে রাগ করে বললাম,’আরে সুযোগের কি! আমি বাংলাদেশেই কোনো জবের জন্য ট্রাই করবো।হয়ত আমাকে এক বছর আরো বেশি অপেক্ষা করতে হবে, হয়ত এর থেকে ছোট জবই হবে! সুযোগ একটা গেছে আরেকটা আসবে,আমি চেষ্টা করবো।কিন্তু ভালোবাসা তো আর বারবার আসবে না!আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।আগে আমাকে বাঁচতে তো দাও তারপর না হয় ভালো করে বাঁচার কথা চিন্তা করবো।’ কথাটা বলেই আয়ানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম।এই তো আমার শান্তির নীড়।আমার খুশির আশ্রয়।নিঃশ্বাসের অবলম্বন। আয়ান কাঁদছে,খুব কাঁদছে আমাকে জড়িয়ে ধরে।সেও হয়ত তার সুখের আশ্রয় পেয়েছে। এর থেকে বেশি সুখ একটি মানুষের কাছে আর কি হতে পারে!এ যে ভালোবাসা,সর্ব সুখের অাধার।
গল্পের বিষয়:
গল্প