মা মারা যাওয়ার আজ তিন বছর হল।আর বাবা নতুন করে বিয়ে করার বছর ছুঁই ছুঁই। বাবার বিয়ের পর আর একটি দিনের জন্যও বাপের বাড়িতে থাকা হয়নি। গিয়েছি দিনের বেলা থেকে রাতে বাড়ি ফিরেছি।আমার ছোট ভাই তপু বাবার সাথেই থাকে। তপুর আসল নাম তপন।মা ওকে তপু বলে ডাকত,সেই সুত্রে আমিও তপু বলেই ডাকি। তপু এবার এসএসসি দিবে।খুব ইচ্ছা ছিল ওকে নিজের কাছে রাখার কিন্তু শশুড় বাড়িতে তো নিজের কথা খাটে না।যেখানে বাপের বাড়িতেই আজ আমার কথার কোন দাম নেই।
ভাগ্যিস মা মারা যাওয়ার আগে আমার বিয়ে টা হয়ে গিয়েছিল,না হলে আমাকে আজ বাবার দ্বিতীয় বউ এর খোটা শুনতে হত উঠতে বসতে।মাঝে মাঝে তপুর জন্য খারাপ লাগে।কিন্তু আমি এক অভাগা বোন যে তার ভাই এর জন্য কিছুই করতে পারছি না।মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়।তপু এলে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদি।ও শুধু বলে,”আপা,তুমি বাবা এমন হয়ে গেল কেন?”ওর প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।রাতের বেলা যখন আমার স্বামী আর সন্তান ঘুমায় আমি তখন জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকি আর মা এর কথা ভাবি।ছোট থাকলে না হয় মা মারা গিয়ে তারা হয়েছে বলে নিজেকে সান্তনা দিতাম। কিন্তু এখন?খুব আশ্চর্যের ব্যাপার,মারা যাওয়ার পর আর প্রিয় মানুষটিকে একটিবারের জন্যও দেখা যায় না।
আবার ঘুমিয়ে পড়ি। এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিনকাল আমার মা খুব মহিয়সী মহিলা ছিলেন।তার সাহস, মেধা আর মনবলের দিক থেকে তিনিই মামা খালাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন।কখনও কোন বিপদে ভয় পেতেন না,মনবল হারাতেন না।নিজের রোগ ব্যাধিও কখনও বুঝতে দেন নি।যেখানে সামান্য জ্বর হলেই আমরা নেতিয়ে যেতাম সেখানে মা কিডনি ড্যামেজ নিয়েও হালকা কাজ কর্ম করেছে।বিয়ের পরে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে পারলেও মাস্টার্স টা করা হয়ে উঠেনি অবশ্য কারণ ছিলাম আমি।
আমার প্রতি যাতে অবহেলা না হয় সে জন্য মা কে পড়ালেখা বিসর্জন দিতে হয়েছে সেই সাথে চাকুরি ও করতে পারেন নি তিনি।বাবা করতে দেয় নি।বাবাই আবার পরে এসে চাকুরির জন্য খোটা দিয়েছে মা কে।মা ছিলেন প্রচন্ড ধার্মিক একজন মহিলা।নামাজ, পর্দা থেকে শুরু করে বাকি সব কিছুই তিনি মানার চেষ্টা করতেন।এইদিকে আমি আর বাবা তার উল্টো। অবশ্য তপু একদম মা এর মত হয়েছে এজন্য আমি এখন আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি।মা অনেক বার আমাকে আর বাবা কে বুঝিয়েছে কিন্তু আমি আর বাবা কেউ ই তার কথা আমলে নেই নি।আজ বুঝছি,মানুষ দাঁত থাকতে কখনও দাঁতের মর্যাদা বুঝে না।আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।কলেজ এ পড়াকালীন এক ছেলের সাথে রিলেশনে জড়িয়ে ছিলাম।
মা অনেক বার নিষেধ করে ছিল কিন্তু আমি কখনোই মা এর মূল্যায়ন করিনি।ফলস্বরূপ এইচএসসি এর রেজাল্ট খুব ই খারাপ হয়।আর তাই আমাকে এইচএসসি পাশের পর পর ই বিয়ে দেয়া হয়। আমার বিদায় এর সময় মা বলেছিল,”বিয়ের পরের জীবনে সুখি হওয়ার মূল মন্ত্র কি জানিস?”আমি উত্তরে এক প্রকার অবজ্ঞা করেই বলেছিলাম,”জানি না আর জানতে চাই ও না।”মা মন খারাপ করে বলেছিলেন,”ধৈর্য,এর বিকল্প কোন কিছুই নেই।বিয়ের পরের আর আগের জীবন কখনও এক করতে যাস না।”আমি তখন মা এর কথায় পাত্তাই দেই নি।কিন্তু আজ বুঝছি মা এর একটা কথায় ও ভুল নেই।ভুল শুধু আমাদেরই ছিল।স্কুলের স্পোর্টস এ দেখতাম অন্যদের মা কত সুন্দর করে সেজে আসত কেউ বা আমাদের মত ওয়েস্টার্ন পড়ত আর অন্যদিকে আমার মা নেকাবে মুড়িয়ে রাখত নিজেকে।
ভাবতাম মা ব্যাকডেটেড। মা কে বলেছিলাম এই ব্যাপারে তখন মা আমাকে বলত, ”তুইও বোরকা পড়া শুরু করে দে।দেখবি অনেক ভাললাগবে।এই জীবন তো ক্ষনস্থায়ী আসল জীবনের জন্য প্রস্তুত হতে পারবি?” এই কথা শুনে বাবা এক প্রকার ধমক দিয়েই মা কে বলত,”তোমার মত কি আমার মেয়েকেও আমি এমন খ্যাত বানাব নাকি।” মা কখনোই নিজের অপমান কে গায়ে মাখে নি। উত্তরে শুধু হেসেই গেছেন।বাবা আমাকে ভালোবাসতেন তবে মা তার থেকে অনেক গুণ বেশিই ভালোবেসে গেছেন। আর আমরা তার বিনিময়ে কি করেছি!তবে তপু একদম মা এর ভক্ত।মায়ের কোন কথাই সে ফেলত না।আসলে ছেলেরা মায়ের মত আর মেয়েরা তার বাবার মতই হয়।হয়ত এজন্য মা এর থেকে বাবা কে বেশি ভালবাসতাম।আর আজ সেই মা এর জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে গিয়েছি।
মার মারা একবছর পর যখন আমার মেয়ের জন্ম হয় তখন থেকে ধরেই নিয়েছি যে আমার মা হয়ত ফিরে এসেছেন।তাই মা এর নামেই মেয়ের নাম রেখেছি।রোকেয়া বেগম।এতে আমার শাশুড়ী আর অতি আধুনিক ননদ নাক ছিটকে বলেছিল,”ন্যাকামি! আজকালকার দিনে কেউ এত পুরানা নাম রাখে নাকি?”অবশ্য আমার স্বামী এই নামেই খুশি।আমার মেয়ে জন্ম দেয়া নিয়েও তাদের অভিযোগের শেষ নেই।তারা চেয়েছিলেন বংশের প্রথম সন্তান ছেলে হবে।রাকিব বলেছে,”প্রথম কেন শেষ সন্তান ও যদি মেয়ে হয় তারপরও আফসোস নেই।আমরা আমাদের মেয়ে তেই খুশি।” আমি আমার মেয়ে কে পেয়ে যেন জান্নাত পেয়ে গিয়েছি,এতটা খুশি।বাবাও খুশি হয়েছিলেন অবশ্য।কিন্তু সে খুশি আজ আমার কাছে কোন মূল্য নেই।
বাবার বিয়েতে যে আমার অমত ছিল এমন না।আমিও চেয়েছিলাম বিয়ে করুক সারাজীবন সঙ্গী ছাড়া থাকা যায় না।মেয়েরা পারলেও ছেলেদের বেলায় এটা খুবই বিরল।ফুপিরা মিলে মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের আগে সবাই মেয়ে দেখতে গিয়েছিল কিন্তু আমায় জানায়নি।আমি তো মানা করতাম না।আমাকে জানিয়েছে তপু।ও আমাকে বলেছিল”আপা, আর কয়েক দিনের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যাবে।আমি এই বিয়েতে থাকব না। আমার বন্ধু আবিরের বাড়ি যাব। তুই ও আসিস না কিন্তু বলে দিলাম।
“আমি ওকে বলেছিলাম যে কেন যাব না?ও শুধু বলেছিল,”আমি বলেছি তাই।”আমি হেসে বলেছিলাম এখন দেখছি তুই আমার বড় ভাই হয়ে গিয়েছিস।আমি ভেবেছিলাম যাব।বাবা বলার সাথেই চলে যাব কিন্তু বাবা আমাকে তার বিয়েতে ডাকেও নি। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।আমার সুখ দুখের অবিচল সঙ্গী আমার স্বামী আর মেয়ে রোকেয়া।সবসময় পাশে থেকেছে।তাই হয়ত আজও আমি বেচে থাকার আশা পাই নতুন করে।রাতে যখন ডিম লাইটের আলোয় বাবা আর মেয়েকে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে দেখি তখন সব দূঃখ ভুলে যাই আর মনে হয়, এরাই তো সব আমার।মন তখন তৃপ্তি তে ভরে উঠে।হয়ত রাকিবের জন্যই শাশুড়ী ননদের শত খোটা সহ্য করেও এই সংসারে থাকতে ইচ্ছে করে।
বাবার বিয়ের দুই মাস পরে বাবা কে দেখতে গিয়েছিলাম।বুকে যেন একটা পাথর চেপেই দেখতে গিয়েছিলাম।সেদিন অবশ্য বাবা বিয়ে করে আনা বউ আমাদের সাথে ভাল ব্যাবহার করেছিল।রাকিব আমাকে রেখেই চলে এসেছে।আমার আর রোকেয়ার থাকার কথা।আমার মা এর গায়ের রঙ খুব একটা উজ্জ্বল ছিল না এই নিয়ে ফুপি আর দাদির আক্ষেপ ও অনেক ছিল।কিন্তু বাবার নতুন বউ ভালই উজ্জ্বল।রাতে আমি আর রোকেয়া তপুর ঘরে। তপু ওর সাথে খেলছে।রাতের খাবার হয়ত এতক্ষনে হয়ে গেছে।রোকেয়ার খাওয়ার জন্য কিছু করতে হবে। ও সবেই দুধের পাশাপাশি পাতলা করে সুজি খেতে শিখেছে।আমি রান্না ঘরে যাব তখনই কানে আসে বাবা আর তার নতুন বউ এর কথপোকথন।
—আমি তোমার মেয়ে আর নাতনির জন্য রান্না করতে পারব না।তোমার দরদ উথলে পড়লে নিজে কিচেনে গিয়ে রাধতে বস।কে জানে কতদিনের জন্য এসেছে।সাথে একটা বাচ্চা কেও এনেছে।একটু পর পর কেঁদেই যাচ্ছে ওর কান্নার শব্দে আমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে।
—তুমি এভাবে বলছো কেন?একটু রান্নাই তো করতে হবে।আর ও তো আমার মেয়ে।কাল না হয় পড়শু ঠিক ই চলে যাবে। এ কথা শুনার পর বাবার নতুন বউ আসল রূপ দেখাতে শুরু করল।ক্রমশ ই তার মুখের ভাষাও খারাপ হচ্ছিল।
—তোর ছেলে কে খাওয়াই এতে তোর হয় না?এখন মেয়েকেও জুটিয়েছিস দেখছি,এসব চলবে না কিন্তু বলে রাখলাম।
বাবা হঠাৎ একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন।আর ওমনি শুরু হয়ে গেল জোড়ে জোড়ে কান্না।এরই মধ্যে তপুও এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে।রোকেয়া ঘুমিয়ে পড়েছে।কান্নার শব্দে আমার ছোট দাদু আর দাদি ছুটে এসেছে।বাবাও অবাক হয়ে গিয়েছিল।তারপর উনার বউ কে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন একটু পর বেরুলেন।আমি বাবা কে বললাম বাবা আমি আজকে থাকব না।বাবা একদম নরম কণ্ঠে বলল,”কেন থাকবি না?থাক আজকে।” কিন্তু বাবার কথায় শক্তি ছিল না।আমি চলে গেলেই হয়ত ভাল হবে।তপুর জন্য খারাপ লাগছে।ওর জীবন টা তাহলে বিষিয়ে গিয়েছে আর আমি বোন হয়ে বুঝতেই পারি নি।
সেদিন এর পর আর যাই নি ওই বাড়িতে।রাকিব কে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছি আর বলেছি আমার মৃত্যু যদি আগে হয় তাহলে তুমি বিয়ে করবে?ও বলেছিল,না করব না।আমি বলেছিলাম, করলেও যেন আমার সন্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কোরো।তপু প্রায়ই আসে।এসে কিছুক্ষণ থাকে রোকেয়ার সাথে খেলে।ছেলে মানুষ তো তাই নিজের ভিতর এর কষ্ট গুলো সহজে বুঝতে দেয় না।কিন্তু ওর মুখ দেখলেই স্পষ্ট বুঝা যায় ও কি অবস্থায় আছে।শুনলাম বাবার নাকি আরেকটা সন্তান ও হবে।আচ্ছা তারপর কি তপুর অবস্থান টা আরও খারাপ হবে?কে জানে আল্লাহ কি লিখে রেখেছে।এখন যতই দিন যাচ্ছে মায়ের মর্ম বুঝতে পারছি।খুব ইচ্ছা করে শীতের দুপুরে লেপ গায়ে জড়িয়ে মা এর সাথে ঘুমুতে।মায়েদের উষ্ণতা অন্যরকম একটা অনুভূতি।
এই অনুভূতি হয়ত মানুষ মৃত্যুর আগ অব্দি ভুলতে পারেনা।মাঝে মাঝে ভয় হয় আমার মেয়েও যদি আমার পথেই হাঁটে? আমি আগে যেমন ছিলাম তেমন যদি হয়।আবার পরক্ষণেই মনে পড়ে আমাকে আমার মা যথেষ্ট শাসন করলেও বাবার কাছে ঠিক শিক্ষা টা পাইনি কিন্তু আমার স্বামী নিশ্চয় রোকেয়া কে সঠিক শিক্ষায় বড় করবে।মা সে তো পবিত্র এক সুখের নাম।কালো বা ফর্সা, শিক্ষিত বা মূর্খ,মা যেমন ই হোক মা তো মা ই। মায়ের বিকল্প কেউ হতে পারেনা।বাবা ও না।সুখে থাকুক এই দুনিয়া আর ওপারের সকল মা।আমার মত কেউ যেন মা এর মর্যাদা দিতে দেরী না করে ফেলে।
গল্পের বিষয়:
গল্প