‘সত্যি করে ক দেখি বউ,তুই আর কোনো পুরুষের সাথে খারাপ কাজ করিস নাই তো? আমারে অপরাধী ভাবিস না।মন বড্ড কেমন জানি করে।সব যেন কেমন ঝাপসা দেখি’- মাটিতে পাতা বিছানার উপর কঙ্কালসার শরীর নিয়ে শুয়ে শুয়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছে ফয়েজ।
এই গরমেও সন্ধ্যায় ফয়েজের শরীরের অর্ধেক অংশ একটা কাঁথা দিয়ে ঢাকা।কি যেন একটা জটিল অসুখ করেছে তার।গত ছয় মাস ধরে জ্বর আসে। গ্রামের ডাক্তার বলেছে শহরের ভাল কোন ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু সেই সামর্থ্য গত ছয় মাসেও ফয়েজের হয়ে ওঠে নি। আর শাহিদার জন্য সে তো আরো এক ভয়াবহ ব্যাপার। তবু সেটাই করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ত্রিশ বছর বয়সী মেয়েটা। ঘরের দরজার পাশে দুই পা মেলে গালে হাত দিয়ে স্বামীর কথা নিশ্চুপ শুনছে সে। ওকে চুপ থাকতে দেখে ফয়েজ উঠে বসার চেষ্টা করল। মুহুর্তেই শাহিদা এগিয়ে এসে ওকে ধরে বসিয়ে বলে উঠল- আহা,করো কি! করো কি! তোমার শরীলটা যে বড্ড খারাপ।
উঠে বসে মাটির দেওয়ালে কোনরকমে হেলান দিয়ে ফয়েজ নিরস গলায় জবাব দেয়- যার মনেই বিবর্ণ খারাপের রঙ ধরে,তার শরীর খারাপে কিইবা আর হবে! শাহিদা ব্যথিত হয়।চোখজোড়ার পাতা ঝাপসা হয়ে আসে। কোথাও যেন একটা বোবা চিৎকার বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। তবু বড্ড শান্ত স্বরে সে জবাব দেয়- তোমার কথা আজকাল আমারে পীড়া দেয়। যেন আমারে শুনাইতেই ওই কথাগুলো দুনিয়ায় তৈরী হয়েছে। ফয়েজ হাসে। হাসিটা শাহিদার কথার জন্য নয়।নিজের ভাগ্যের জন্য। সে বলল- পুরুষ মানুষ শরীরের ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে তামাম দুনিয়ার সব কিছু থেকেই তার ক্ষমতা চলে যায়। তাই না রে বউ? শাহিদা ফয়েজের গালে হাত রেখে মুখ চেপে ধরে বলে উঠল- অমন কথা কয় না। তুমি আমার স্বামী।কও, কি কথা জানবার চাও?
– কিছুই জানতে চাই নে। কিন্তু রোজ রোজ তিনটে পেট চলছে কি করে! গত ছয়ডা মাস বসে বসে খাচ্ছি।দিনের বেলা তুই কিইবা কাজকাম করিস! আমি পবিত্র কিছু ভাবতে পারি না। না ভাবাই তো উচিত।
শাহিদা ফয়েজের একটা হাত শক্ত করে জাপ্টে ধরে। রোগা শীর্ণ দুটো হাত। দিনে দিনে আরো নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। সে ফয়েজের ডান হাতের কব্জিতে একবার চুমু খেয়ে মুখ তুলে তাকাল।তারপর বলল-দুনিয়াডাতেই পবিত্রতা নাই। তুমি একলা পবিত্র কিছু ভেবে কি করবা? তামাম দুনিয়া চলে এখন পাপকলের যাঁতায় পিষে। সেইখানে আমাদের মত গরীব নাহয় দুই একটা ছোটখাট পাপ করে বেঁচেই থাকলো। তাতে দুনিয়ার কি এমন ক্ষতি হচ্ছে শুনি? ফয়েজ বুঝতে পারে,শাহিদার কাছ থেকে যথাযথ উত্তর সে কোনদিনই পাবে না। মনের ভিতর একরাশ অভিমান জমা করে বালিশ নামিয়ে আবার সে শুয়ে পড়ে। পারার মধ্যে কেবল এই অকাজটুকুই এখন সে করতে জানে। বালিশ তুলে মাটির দেওয়ালে হেলান দেওয়া। আবার সেটা নামিয়ে শুয়ে পড়া। অনেকদিন বাইরের আলোটাও ভাল করে দেখা হয় না। তার কি যেন একটা কঠিন রোগ। সে রোগের নাম জানে না। কেবল ঘন্টায় ঘন্টায় জ্বর আসে। আবার ছাড়িয়েও যায়। পরিবর্তন যতটুকু দেখা যায়,তা কেবল শুষ্ক হয়ে ওঠা শরীরটা। শাহিদা বলেছে,শহরের বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে আর অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই।
ফয়েজকে খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে শাহিদা দরজাটা বাইরে থেকে টেনে দেয়। পাশেই দশ বছরের একমাত্র ছেলে সালাম শুয়ে আছে।ফয়েজের সাথে কথা হয় না তার।বছর চারেক আগে পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে গিয়ে কথা বলাটা বন্ধ হয়ে গেছে তার। কথা ঠিকই বলে সে।তবে কারো পক্ষেই সেই ভাষা বুঝে উঠা একরকম দুর্বোধ্য।ফয়েজের একটু পাশেই তার বিছানা।সেও তেমন জোর দিয়ে কথা বলতে পারে না আর।রোজ রাতে ছেলেটা একা একা শুতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে।ওপাশের জীর্ণ ঘরটায় শাহিদা একলা ঘুমায়। কিন্তু ফয়েজের কানে ঠিকই আরো অপরিচিত,পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে আসে। সে কেবল ঘুমাতে পারে না। শাহিদা মাথাটা আঁচড়ে সবে চিরুনীটা মাটির দেওয়ালের ফোঁকরে রেখেছে,তক্ষুণি হাজির হল গাজী মাতবরের সাতাশ বছর বয়সী ছেলে আরমান। শাহিদাকে দেখেই দুই ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বলে উঠল- দিনে দিনে তোর বয়স বাড়ছে। কিন্তু তার সাথে দেখছি রুপও কম যাচ্ছে না।অমন মরা খাটে পড়ে থাকা স্বামীর ভালবাসাও কি নিচ্ছিস নাকি?
কথাগুলো গায়ে কাঁটার মত বাঁধে শাহিদার। এর চেয়ে মরণও ভাল। কিন্তু ভাগ্য যখন বলে দিয়েছে-মৃত্যু কপালে নেই,তখন তা সহ্য করতেই হবে। কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাকে এ বাড়ি,ও বাড়ি। এই অভাবের দেশে কেইবা তাকে মাইনে দিয়ে কাজে রাখবে! সেবার সন্ধ্যায় দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে সামান্য ক’টা টাকা নিয়ে ঘরে ফিরছিলো সে। মাঝপথে পথ আটকায় আরমান।কয়েক টাকার লোভনীয় প্রস্তাব উপেক্ষা করতেই নিজের ব্যক্তিত্বটাকে আর শেষ রক্ষা করতে পারল না। কেবল আকাশ-বাতাশের পরিবেশটা ভারি হয়ে এসেছিল। হুতোম পেঁচা ভয়ে পাশের কোন জঙ্গলে পালিয়েছিল।পালাতে পারেনি কেবল শাহিদা। সে খুব ভাল করেই টের পেয়েছিল,কেবল তার পক্ষে কথা বলার জন্য পৃথিবীতে কোন আইন নেই।
কেবল ক্ষমতা আর টাকার গরমে আইনের বাচ্চা ফোটে।ফুটে বের হয়ে ক্ষমতাবানদের পায়ে কুর্ণিশ করে।সেই চরম অভিজ্ঞতা থেকে তার এই জঘন্য জীবন শুরু।এরপর গোপনে অনেক ভদ্রলোকই তাদের ভদ্রতা দেখিয়ে যাচ্ছে তার মুখের উপর কয়েকটা টাকা ছুঁড়ে। শাহিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- আমি আর এইসব খারাপ কাম করুম না। আমার স্বামী ভাল হোক আর না হোক, আমি করুম না। ওই মানুষটার সুস্থতার চেয়ে তার নিজের আত্মসম্মানডাই আমার কাছে বড়। আরমান কৈ মাছের মত তিড়িং করে লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে বলে উঠল- এত সতীত্ব দেখাইস না তো। না চাইলেও পার পাবি না,চাইলেও পার পাবি না। শেষমেস যে ক’টা টাকা পাস সেগুলোই হারাবি।
-আমি মরে গেলেও আর খারাপ কাম করাতে পারবা না। শাহিদা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ঘরে ঢুকেছে আরো একটা মানুষ। এর আগেও এই মানুষটা এই ঘরে ঢু্কেছে।তবে একা একা। গোপনে। সে হিসাব শাহিদা ছাড়া অন্ধকারও জানে না। তাকে দিনের আলোয় হজরত চাচা বলেই সম্বোধর করে সে। আরমানকে দেখে বলে উঠল- কি রে,আজ তুই এখানে কি করিস? আরমান পৈশাচিক হাসি দিয়ে জবাব দেয়- আইজকা আমার আসারই দিন ছিল।তুমি চাচা ভুল করে চইলে এসেছ। সে নাহয় পরে দেখা যাবে।এদিকে শাহিদা তো সতী সাবিত্রী হয়ে উঠেছে।আর নাকি বররে ঠকাবে না।
-অ্যাঁ! তা বললে হবে? পেট চলবে কি করে? শাহিদা প্রতিবাদ করে ওঠে- না চললে না চলবে। তোমরা বের হয়ে যাও এই ঘর থিকা।নয়ত নালিশ ডাকবো আমি।
-বেশ্যাদের আবার নালিশ! শ্যাষে তোরেই গেরাম ছাড়া করবো দেখিস। এখন সুবোধ মেয়ের মত আচরণ কর দেখি।
শাহিদা হজরতের গা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠল- সরে যাও। অনেক হয়েছে। নিজেরে টুকরো টুকরো করে গাঙে ভাসানোর ব্যবস্থা করে যাবো। আর না। অনেক হইছে এই পাপের জীবন। আরমানের মাথায় যেন রক্ত গরম হয়ে ওঠে। সে শাহিদার গলা চিপে ধরে। হজরতের মাথা থেকে অনেক বছর আগেই জ্ঞানবোধ হারিয়েছিল।এখন কেবল সেটুকুর অবশেষ প্রয়োগ করা বাকি ছিল। পাশেই একটা পিতলের জগ তুলে নিয়ে সে সজোরে আঘাত করে বসল শাহিদার মাথার মাঝ বরাবর। “মা গো” বলে চিৎকার দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে টের পাওয়ার আগেই মেয়েটা মাটিতে লুটিয়ে গেল। এতক্ষণে বাকি দুজনে ক্ষান্ত হয়েছে। তবে শাহিদার নিথর শরীরটা বুঝিয়ে দিচ্ছে অনেক কিছু। ওপাশের ঘর থেকে ফয়েজ ভাঙা গলায় চিৎকার করে চলেছে- ওরে ছাইড়া দেও। আল্লাহর দুহায় লাগি,ওরে ছাইড়া দেও।
হজরত আর আরমান ভয়ে পালিয়ে যায়। সারারাত ধরে চলে ফয়েজের ছটফটানি চিৎকার। ভোরের দিকে কিছু দূরে আজগর আলি অযু করতে উঠে ফয়েজের ভাঙা গলার স্বর শুনে ছুটে আসে। দেখতে পায় একটা কঙ্কালসার দেহ বুক চাপড়ে কেঁদে চলেছে। পাশের ঘরটাতে শাহিদার নিথর দেহ। সকাল হতেই উঠানে নানান লোক জড়ো হয়েছে। কেউ শাহিদার গুণকীর্তন করে,তো কেউ পাপের ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলে। শাহিদার লাশ উঠানে আনা হয়েছে। কেউ একজন ফয়েজকে টেনে বাইরে আনার চেষ্টা করলেও সে আসেনি। ঘরের ভিতর থেকেই সে মাটির দেওয়ালে হেলান দিয়ে চেয়ে আছে উঠানের দিকে। হজরত একবার শাহিদার দিকে উঁকি দিয়ে “আহা রে” বলে বিদায় নিলো।
একমাত্র ছেলে সালাম গুঙিয়ে যাচ্ছে অনবরত। কেবল ফয়েজ আর কাঁদছে না। সে উঠানের দিকে নির্বাক চেয়ে থেকে ভাবে- ” নিরুপায় মানুষের পাপগুলোর কি কঠিন সাজা হয়। অথচ বড় বড় মানুষগুলোর বড় বড় পাপগুলোর সাজা হয় না।রে শাহিদা,আমি তোর সবই জানতাম।শুধু অপেক্ষায় থাকতাম,তুই আমারে বাঁচানোর আগে নিজেরে বাঁচা। কিন্তু এমনে বেঁচে গেলি? আমি আর কার জন্য অপেক্ষা করবো।বরং তুই ওপারে অপেক্ষা কর। আমারও আর বেশি সময় নেই।”
গল্পের বিষয়:
গল্প