কোলেটারাল

আপনার বাবা কী করেন?
আমার বাবা নেই।
আপনার মা কী চাকরি করেন?
আমার মা নেই। আমি যাঁকে মা বলে ডাকি বা জানি তিনি আমার মা নন। তিনি আমাকে পালন করেছেন।
আমার এই কটি কথায় ম্যানেজার আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, আমাকে পাশের একটা চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করে অন্যদের অ্যাটেন্ড করতে লাগলেন।
একঝাঁক তরুণ-তরুণী ও তাদের অভিভাবকরা ম্যানেজারকে ঘিরে রেখেছিল।
আপনি কি চাকরি করেন?
হ্যাঁ।
তাহলে আপনার স্যালারি সার্টিফিকেটটা লাগবে।
অন্য আর কিছু?
বাড়ি বা জমি থাকলে দলিলটা আনবেন। আগের স্যালারি সার্টিফিকেটটা দেখি।
আপনি কে হন?
আমি মা।
ওর বাবা আসেননি?
না, তিনি মারা গেছেন।
আপনি কি চাকরি করেন?
না।
তবে? আপনার নিশ্চয় কিছু আয় আছে।
হ্যাঁ, আয় তো আছে। আমার মান্থলি আয় তিরিশ হাজার।
আয়টা কোথা থেকে হয়?
ভদ্রমহিলা হাসেন। মিষ্টি করে হেসে ম্যানেজারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ব্যাংকে আমার পঞ্চাশ লাখ টাকা আছে। তাছাড়া পনেরো লাখ টাকা পোস্টাপিসে আছে। এতে হবে না।

ম্যানেজার এবার সাবধানী ও সতর্ক হয়ে হাসেন এবং সেটা সম্ভ্রমের হাসি। হাসতে হাসতে বলেন, আপনার তো আর আলাদা কোলেটারাল লাগবে না। ব্যাংকের ও অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে একদিন আসুন।

ম্যানেজার ঘামছিলেন। আজকে একসঙ্গে প্রচুর ছাত্রছাত্রী চলে এসেছে। সঙ্গে তাদের অভিভাবকরা। খুব সম্ভবত আমিই নিজে একা, কেউ নেই। কোনো গার্ডিয়ান বা অন্য কেউ। এর মধ্যেই ম্যানেজার অপাঙ্গে আমার দিকে বেশ কয়েকবার দেখে নিচ্ছেন। যদিও জায়গার টানাটানি, তবু আমি চেয়ার ছেড়ে উঠছি না।

আপনার কে হয়?
ও আমার ভাইঝি।
আপনি কি ওর লিগ্যাল গার্ডিয়ান?
হ্যাঁ, ঠিক তাই।
ওর বাবা আসেননি?
না। আমার দাদা অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। তবে মেয়ের নামে আপনার ব্যাংকে দশ লাখ টাকার এফডি আছে।
আমার ব্যাংকে?
হ্যাঁ, আপনার ব্যাংকেই। এছাড়া ওর মা মাসে দশ হাজার টাকার পেনশন পান। তাছাড়া আমি একটি সরকারি সংস্থায় অফিসার গ্রেডে আছি। ইনফ্যাক্ট আমিই ওর গ্যারান্টার।

ম্যানেজারের মুখ আলোয় উদ্ভাসিত হয়, একটা ঝকঝকে আলো খেলতে থাকে, ওনার মুখের পেশিসমূহে একটা তৃপ্তির ও স্বস্তির হাসি ফুটে ওঠে – ওর তো অনেক কোলেটারাল। কোনো সমস্যাই নয়। শিক্ষার জন্য সরকার উদারহস্তে ঋণ দিচ্ছে। ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা বা বিশেষ কোনো পড়ায় যা খরচ – সেজন্যই তো ব্যাংকগুলো এগিয়ে এসেছে। রাষ্ট্রের পলিসিই তো তাই। সামনের সপ্তাহে চলে আসুন।

আমি বুঝতে পারছি আমাকে অনেকক্ষণ বসতে হবে। আর অবশ্য বেশি ক্যান্ডিডেট নেই। দুই-তিনটি পার্টি আছে। অবশ্য এ-ধরনের ইন্টারভিউ আরো দুটি ঘরে চলছে। সেখানে ব্যাংকেরই অন্য সিনিয়র অফিসাররা কাজটি সারছেন। এখানে বসে থাকার ফলে বুঝতে পারছি কারা পড়তে যাচ্ছে। ম্যানেজার আমার মধ্যে বোধহয় খানিকটা অস্থিরতা লক্ষ করে বললেন – এদেরটা শেষ করেই আপনারটা ধরব। কথাটা বলে আবারো অপাঙ্গে করুণামিশ্রিত দৃষ্টি হানলেন। আমি ভাবলাম – অপেক্ষা করতে আমার বিন্দুমাত্র ক্লান্তি নেই। কিন্তু –
আপনি কল লেটার পেয়েছেন?
আমি না, ছেলেটি, আমার ভাই পেয়েছে।
আচ্ছা, আচ্ছা আপনার ভাই। আপনারা পুরোটাই লোন চাইছেন।
হ্যাঁ, নিশ্চয়, কেন ব্যাংক পুরোটা দিচ্ছে না?
না না, তা নয়, ব্যাংক পুরোটাই দেওয়ার জন্য দরজা খুলে বসে রয়েছে। ওর বাবা কী করেন?
আমার বাবা, রিজার্ভ ব্যাংকের অফিসার ছিলেন। আমার মা এখনো চাকরি করেন আয়কর বিভাগে। আমি একটা সফটওয়্যার কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার।
ওনার গ্যারান্টার কে হবেন? মা, না আপনি।
যে কেউ হতে পারি। আপনার তো কোলেটারালের চিন্তা।
ম্যানেজার হেসে ফেলেন – ঠিক ধরেছেন।
আমিই ওনার গ্যারান্টার হবো। কী কোলেটারাল লাগবে বলুন।
আপনার মান্থলি আয়ের একটা সার্টিফিকেট আর তার সঙ্গে ব্যাংকের যদি কোনো কাগজপত্র থাকে সেটা দিলে ভালো হবে।
স্যালারি সার্টিফিকেট আমার সঙ্গেই আছে। আর যে লোন নেবে তার নিজেরই তো ব্যাংকে চার লাখের একটা এফডি আছে।

না, আজ নয়। আমি আপনাদের ডাকব। কাগজপত্রগুলো, এরপর যেদিন আসবেন সেদিন লাগবে। আপনি নিজেই যখন গ্যারান্টার – বাই দ্য বাই, আপনি কাদের সঙ্গে আছেন?
আমি আইবিএমের সঙ্গে আছি। আমাকে আগামী মাসের শেষ দুমাসের জন্য ইউএসএ যেতে হবে। কাজগুলো আপনাদের যা দরকার আগামীদিনেই শেষ করে ফেললে ভালো হয়।
না না, আপনি চিন্তা করবেন না। আপনি বাইরে যাবার আগেই সব চুকে যাবে।

এবার যে-ছেলেটি এসে বসল – সে একাই। ঘর এবার খালি হয়ে এসেছে। এরপরই ম্যানেজার আমার সঙ্গে কথা বলবেন। ছেলেটাকে তুলনামূলক অনেক ম্লান ও অপ্রতিভ লাগছিল।
আপনি –
হ্যাঁ আমিই ক্যান্ডিডেট। আমিই লোন নেব। এই যে অ্যাডমিশন কল লেটার।
ম্যানেজার ছেলেটিকে নিরীক্ষণ করতে করতে কল লেটারটা হাতে নিলেন।
আপনি কম্পিউটার ইঞ্জিয়ারিং পড়বেন?
হ্যাঁ, তাই তো ইচ্ছে – যদি আপনারা লোনটা দেন।
ম্যানেজার আবারো চোখ তুলে ছেলেটিকে মাপলেন। আগের পার্টির লোকগুলোর মতন ঝকঝক, ধারালো নয়। জামা-কাপড়েও সাধারণের চিহ্ন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এ শালা ব্যাংকের এক নতুন কায়দা হয়েছে, এডুকেশন লোন! এদিকে প্রতিদিনই লোক কমিয়ে দিচ্ছে। আবারো ভিআরএস আসছে!
আচ্ছা ভাই আপনার বাবা কী করেন?
আমার বাবা কিছুই করেন না।
মানে রিটায়ার্ড?
না রিটায়ার্ড নন, তিনি একটি কোম্পানিতে কাজ করতেন, সেটা ১০ বছর হলো বন্ধ হয়ে গেছে। এখন পাড়ায় ছোটখাটো চায়ের দোকান চালান।
ম্যানেজার একটু যেন ধাক্কা খেলেন।
তো আপনাদের চলে কী করে – আই মিন, অন্য কোনো আয় আছে?
মা একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন।
আপনাদের বাড়িঘর কি নিজেদের?
আমরা ভাড়াবাড়িতে থাকি।
তো ভাই – আপনার কোলেটারাল কী দেবেন? ব্যাংকে ভালো এফডি আছে?
না, ব্যাংকে এক পয়সাও নেই। কেন, কোলেটারাল ছাড়া আপনারা লোন দেবেন না।
কোলেটারাল ছাড়া লোন দেওয়া তো যায় না। কিছু দেখাতেই হবে, যেটাতে ব্যাংক আশ্বস্ত থাকবে।
কেন, আমার মা তো চাকরি করছেন।
না, সেটা তো ঠিকই। তবে আপনার মায়ের স্যালারি সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে হবে এবং তাতে ব্যাংক আশ্বস্ত হলে। তা আপনার মা কোথায় চাকরি করেন?
বললাম তো একটা প্রাইভেট ফার্মে।
তা ওদের ব্যবসাটা কিসের?
ঠিক আছে, আমি মায়ের স্যালারি সার্টিফিকেট এনে দেব।
ভাই, স্যালারি সার্টিফিকেট আনলেই হবে না। দেখতে হবে আপনার অবর্তমানে আপনার মায়ের এই লোন পরিশোধের ক্ষমতা আছে কি-না।
লোন তো আমাকে দিচ্ছেন – তো এতো কিছু চাইলে ছাত্ররা লোন পাবে কী করে?
ভাই, আপনি রেগে যাচ্ছেন। আপনি তো বোঝেন আমি খালি ব্যাংকের নিয়মাবলি সংক্রান্ত কথাই বলছি। আমিও তো এখানে চাকরি করি। নিয়মাবলির মধ্যে সব ব্যাপার ঠিকঠাক থাকলে আমার তো আপত্তির প্রশ্নই ওঠে না। আপনি চতুর্থ সপ্তাহে মায়ের স্যালারি সার্টিফিকেটটা নিয়ে আসুন। তারপর কথা বলা যাবে।

ছেলেটা বিরক্ত, হতাশ ও ক্রোধী হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আমার ভেতরে একসঙ্গে অনেকগুলো ঢাক বেজে উঠল। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম – আমি কে? কী আমার কোলেটারাল? আমার বাবা কে ও কী? মা কে ও কী? কোনো এফডি – নইলে নিজেদের বাড়ির দলিল। আমার এনটিটি কী? আমি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইছি, এটা কি আমার পক্ষে বাড়াবাড়ি হচ্ছে না? আমার সমস্ত রাগ কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল ওই বুড়ি, আমার পালিতা মায়ের বিরুদ্ধে। কী দরকার ছিল ডাস্টবিনের পাশ থেকে আমাকে কুড়িয়ে নিয়ে এসে তিলতিল করে পৃথিবীর আলো, বাতাস, আকাশ, নদ-নদী, সমুদ্র – এই সমস্ত কিছুর মধ্যে আমাকে এক অক্টোপাসে আবদ্ধ করে আর তার জন্য নিজের মেরুদন্ড বেঁকিয়ে ফেলে আমাকে প্রস্ফুটিত করার। এই পৃথিবী বড়ই মনোরম, বড়ই সুন্দর, কিন্তু এই জীবন, এ তো ক্রমাগতই এক ঘৃণার ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করছে। কী কোলেটারাল আছে তোমার? যে তুমি, লোকের বাড়ি খাটো, একবেলা সন্ধ্যাবাজারে তরকারি বিক্রি করো, সে কিনা এক পরিত্যক্ত মানবশিশুর জন্য নিজেকে উজাড় করে দিলো; অথচ এক ঘৃণার ঘূর্ণন – যার মধ্যে শুকনো হাসি হেসে পড়াকে ভালোবাসলাম আর পড়াশোনাকে ভালোবেসে আমি আমার বোধহয় সর্বনাশ করলাম। দারিদ্রে্যর সেই উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে আমার সে-আমাকে নিয়ে ভেসে চলল। তার কী এক ইচ্ছা, আমাকে লেখাপড়া শেখাবে। আর আমিও অদ্ভুত এক পরিস্থিতির জীবনে, যেখানে খাদ্য, আলো, বাতাস ছিল একেবারেই মার্জিনাল, সেইখানেই দাঁড়িয়ে পড়াশোনা শুধু ভালোই বাসলাম না, তরতর করে অঙ্কে অনার্স নিয়ে বিএসসি পাশ করে বসলাম। অঙ্কের প্রেমে পড়লাম। মাধ্যমিক পাশ করার পর থেকে চাকরির চেষ্টা চালিয়ে বিফল হতে হতে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বসলাম। বইয়ের অঙ্ক যতই সমাধান করতে পারঙ্গম বনছিলাম, জীবনের নানাবিধ অঙ্ক আমার চৈতন্যে এক গভীর কৃষ্ণবর্ণ মেঘের মতো ভেসে বেড়াতে লাগল। মাঝে মাঝেই মনে হতো, এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে যদি আস্তানা নিতে পারতাম। ভাবতাম, এখনও ভাবি, কল্পনা চাওলার মতো নাসা আমাকে কি রিক্রুট করতে পারে না! আমি হবো সেই প্রথম অ্যাস্ট্রোনট, যাকে মহাকাশভেলা ছেড়ে আসবে অন্য কোনো গ্রহে, আর সেই গ্রহের আমি হবো আদি মানুষ।

কী ভাবছেন এতো? আসুন এবার আপনার সঙ্গে কথা বলা যাক। লক্ষ করে দেখি, ঘরে আমি আর ম্যানেজার। সেই হতাশাগ্রস্ত ছেলেটি ঘর ত্যাগ করেছে, এখন আমার পালা।
তো আপনার মা-বাবা কেউ নেই, আপনাকে যিনি পালন করেছেন সেই একজন পালিতা মা বা তিনিই আসল মা, আছেন তো। আপনি কিসে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন?
সায়েন্স, অঙ্কে অনার্স ছিল।
আপনি কোথা থেকে কল পেয়েছেন, আপনার কল লেটারটা দেখান।
আমি ব্যাগ থেকে অ্যাডমিশনের কল লেটারটা ওনার টেবিলে রাখি।
বাহ্! আপনি তো দারুণ জায়গা থেকে কল পেয়েছেন। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং। আপনি কি ওদের ওখানে পরীক্ষা দিয়েছিলেন? কিন্তু খরচ খুবই বেশি – পাঁচ লাখ টাকা। তিন বছরের কোর্স। বাহ্! খুব ভালো। আপনার মা কী করেন?
আমার মা লোকের বাড়ি কাজ করেন। সন্ধেবেলায় এলাকার একটি বাজারে তরকারি নিয়ে বসেন। এর সঙ্গে আমি টিউশনি করি।
এছাড়া আপনাদের আর কোনো আয় আছে?
নেই, আমাদের আর কোনো আয় নেই।
আপনারা থাকেন কোথায়? নিজেদের কোনো বাড়ি বা জমি –
আমরা এলাকারই একটা বস্তিতে বাস করি। সেটাও ভাড়া। এছাড়া জমি, ঘর, বাড়ি, এসবের কোনো কিছুই নেই।
কোনো টাকা-পয়সা ব্যাংক বা অন্য কোথাও আছে কি?
না। বললাম তো আমাদের আর কোনো কিছুই নেই।

ম্যানেজার আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। বোঝা যায় এক বিস্ময়ের ছবি ফুটে উঠলেও উনি যেন ওটা অাঁচ করতে পেরেছিলেন। ম্যানেজারের চোখেমুখে একটা হতাশা ও সহানুভূতির ছবি ফুটে উঠতে চাইছে।

তার মানে কোনোরকম কোলেটারাল নেই, যা দিয়ে আপনাকে আমি সহযোগিতা করতে পারি। আপনার নাম কী?
রজনী নস্কর।
শিডিউল কাস্ট, দলিত! তো মাধ্যমিকের পরই আপনি চাকরির চেষ্টা করতে পারতেন।
করিনি কে বলল। আসলে এগুলো সবই এক একটা দুর্গ।
দুর্গ মানে?
আমার মনে হয় তাই।
আপনি তো কোটার অ্যাডভানটেজ পেতে পারতেন।
সেটাও একটা দুর্গ। ওখানেও অনেক ভাগ আছে। যে-ভাগে পৌঁছালে ওখানের ভাগ পাওয়া যায় – আমি সেখানে পৌঁছাইনি।
মানে আপনাদের আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাবই নেই – মানে নন এনটিটি। কোলেটারাল ছাড়া ব্যাংক কোনোভাবেই লোন দেবে না।
এখানে কোনো কোটা নেই।
ম্যানেজার এবার হেসে ফেলেন। না, এখানে লোন বা অ্যাডভান্সের কোনো কোটা নেই।
তাহলে গরিবরা এডুকেশন লোন নেবে কী করে?

রজনী দেবী, আমার বলতে সত্যি খারাপ লাগছে, কোলেটারাল বা গ্যারান্টার ছাড়া লোন দেওয়ার কোনো প্রভিশন নেই। আপনি এত ভালো একটা সুযোগ পেয়েছেন। আপনাদের কোনো বড়লোক আত্মীয়-টাত্মীয় নেই, যারা কেউ আপনার গ্যারান্টার হতে পারেন।
আপনিই তো বললেন নন এনটিটি। আমার পালিত মা বিশ্বসংসারে একা, আমি ছাড়া ওঁর আর কেউ আছে দেখিনি। আর আমি তো একা, একেবারেই একা।

না না, সেটা আর বলতে হবে না। আপনি তো প্রথমেই সেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আপনার জন্য সত্যি খারাপ লাগছে।
আমি, চাকরি পেলে সব শোধ দিয়ে দেবো – সেই অঙ্গীকার তো থাকছেই।
ব্যাংক তাতে সন্তুষ্ট নয়। ব্যাংক আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে কোলেটারালের সুতোয়। আপনার তো কোনোই কোলেটারাল নেই।
আমি বুঝে যাই, এই দুর্গে কোলেটারাল ছাড়া কিছুই হবে না। আমি বুঝে যাই, কল লেটারটা এখানে থেকে বেরিয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে হবে। তবু শেষ চেষ্টা হিসেবে ম্যানেজারের কাছে মিনতি করি – কোনোভাবেই কিছু করা যায় না।

ম্যানেজার আমার মিনতিভরা আবেদনে একটু নড়েচড়ে বসেন। আমাকে দেখার ভঙ্গিটার মধ্যে নানারকম আলোর ঝলকানি দেখতে পাই। উনি অবিচল দেখতে থাকেন আর এমন একটা ভাব করতে থাকেন – যদি কোনো একটা রাস্তা বের করতে পারেন। আমি কল লেটারটা চেয়ে নিই, অন্যান্য কাগজ ব্যাগে ঢোকাই। আমি বুঝে যাই আমার ভবিষ্যৎ, এই দুর্গের বাইরে যাওয়ার পাসপোর্ট নেই। আমি উঠে দাঁড়াই।

রজনী দেবী আপনার জন্য খুবই খারাপ লাগছে। তবে আপনাকে নিয়ে ভাবছি, দেখি যদি কিছু করা যায়। আমার কার্ডটা রাখুন। এখানে মোবাইল নাম্বারটা আছে। একদিন সন্ধের পর আমার বাড়ি আসুন। ফোন করে আসবেন আমি ডিরেকশন দিয়ে দেবো। আমার বাড়িতে আমি একাই থাকি, ভয়ের কিছু নেই। দেখি যদি কোনো রাস্তা বের করা যায়, যদি কোনো কোলেটারাল আপনার জন্য পাওয়া যায়।

আমি তো দাঁড়াতেই চাই। আমি এই বস্তির গলিটা থেকে পালাতে চাই। ওই যে বুড়ো মানুষটি আমাকে এভাবে পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ উপভোগ করার জন্য যে প্রাণপণ আয়োজন করল সে তো বুঝল না কত বিষও তার মধ্যে আছে। আমি অবিরত সেই জ্বালা নিয়ে ঘুরে বেড়াই। সত্যকামের তবু জাবালি ছিল। আমার তো কেউ নেই। আমি পরিচিত এলাকা, পরিচিত মানবগোষ্ঠীর বহুদূরে নতুন করে নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই। আর আমার পিঠে থাকবে ওই বুড়ো। আমৃত্যু আমি ওর সেবা করব। কিন্তু কোলেটারাল না হলে সব আটকে যাবে। এখান থেকে পালিয়ে আমার নতুন ভুবন গড়া হবে না। যে ভীতু মানব-মানবী আমাকে হত্যার জন্য ডাস্টবিনে ফেলে রেখে গেল, যারা এইটুকু মানবিক দায়িত্ব – আমাকে মেরে রেখে যাবার সাহসটুকু পর্যন্ত করতে পারল না – তাদের জন্য আমার অবিমিশ্র ঘৃণা হয়, যুগপৎ দয়াও জাগে। আমি তাদের জানতে চাই না, তাদের খুঁজতে চাই না। জীবন যখন পেয়েছি তখন নিজেকেই খুঁজে বেড়াব। কিন্তু কোলেটারাল জোগাড় করতে হবে। ম্যানেজার ইচ্ছা করলেই পারে। ওর চোখে রামধনুর রঙের খেলা আমি দেখতে পাচ্ছি। আমার শরীর উদ্ধত কিন্তু লাস্য নেই। ম্যানেজারের চোখে দয়াময়ের শরীর ভেসে উঠছে। মুখমন্ডল দয়ার্দ্র হয়ে উঠছে। খনি খননকারীর মাথার ওপরে হেডলাইটের আলো আমার শরীর খনন করে চলেছে, আর আমি যেন দয়াময়ের হাতে কোলেটারালের চাবির গোছাটি দেখতে পাচ্ছি। আমাকে একটু সাহসী হতে হবে। ওই ভীত মানব-মানবীর মতো নয়। আমাকে সাহসী হতে হবে। এত কষ্ট, এত পড়াশোনা, অঙ্কে পারঙ্গম হয়েও আসল অঙ্কে সিলি মিসটেক করলে, আমার নয়া ভুবন হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাবে। না না কোনোমতেই তা হতে দেব না।

ম্যানেজারের দরদমাখা দৃষ্টির মধ্যে আমি কেলেটারালের ছায়া যেন দেখতে পাই। ওনার কার্ডটা হাতে নিয়ে মোবাইল নম্বরটা দেখতে থাকি। এক দুর্গ থেকে অন্য দুর্গ ঢোকার নম্বর। ওর চোখেমুখে দয়া, মায়া, কোলেটারাল ও কাম সব একসঙ্গে মাখামাখি হয়ে আমাকে খননকারীর সার্চলাইটের আলোতে ফালাফালা করতে থাকে। আমি বুঝে যাই আমি কোলেটারাল পেয়ে যাবো। ওকেই গ্যারান্টার করব, তাতে কোলেটারাল ক্ষতি তো ঘটবেই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত