নিঃসঙ্গ একজন

আজও কলেজে গেল না অনুপ। যাবে না সেটা বোধহয় রাতেই ভেবে রেখেছিল। আর সেজন্যই দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছে। সাড়ে পাঁচটার দিকে একবার ঘুম ভেঙেছিল। টয়লেট থেকে এসে আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। কনা অনেকদিন ধরে কাজ করে অনুপের বাসায়। মেয়েটা বেশ ইনটেলিজেন্ট। অনুপের মনোভাব মোটামুটি বুঝতে শিখেছে। অনুপ পরপর দুদিন কলেজে গেলে তার পরদিন যে যাবে না, সেটা তাকে না বললেও বুঝে নেয় এবং সেদিন সেও দেরি করে কাজে আসে।

দাদা, নাস্তা দিয়েছি টেবিলে। ঠান্ডা হইয়ে যাওয়ার আগে খেইয়ে লেন।
অনুপ বলে, শোন, খাবারটা ঢেকে রাখ। একটু পরে খাব। কনা তরকারি কাটতে রান্নাঘরে ঢোকে। তার আগে নাস্তা ঢেকে রাখে প্লেট দিয়ে।

দাঁত ব্রাশ করে এসে অনুপ এখন, ওমা! ডাইনিং টেবিলে না গিয়ে বসে আছে খাটের কোনায়, স্ট্যান্ডের গা-ঘেঁষে। রাজ্যের কথা এসে ভিড় করছে মাথায়। মামুনের কথা মনে পড়ল। কাল-পরশু নাগাদ তো ওর রাজশাহী আসার কথা। ও যা ক্রেজি, এখনো! শালা ঠিকই এসে পড়বে। তারপর দেখা যাবে সঙ্গে একজনকে জুটিয়ে এনেছে। তা আনুক, অসুবিধা কী? অনুপ মনে মনে হাসে, আর মনে মনে বলে, আয়, মামুন, তুই আয়রে! তুই এলে আমাদের মরা নদীতে জোয়ার আসে। দু-তিনটা দিন খুব ভালো কাটে। তুই বারবার রাজশাহী আয়।

নাস্তা খেতে খেতে দশটার ওপর বাজল। তারপর আজ ফের পেপারটা চোখের সামনে মেলে ধরে চায়ে প্রথম চুমুক দেয়। দৈনিক পত্রিকা সে কখনই দীর্ঘসময় ধরে পড়ে না; পড়ার দরকার মনে করে না। বিদেশিদের মতো প্রধান নিউজসহ অন্য হেডলাইনগুলোতে চোখ বুলায়। খুব ইন্টারেস্টিং কিছু থাকলে তখন খবরের ভেতরে ঢোকে। মহাদেবপুর কলেজে মহাগোলমাল। কীসব দাবি-দাওয়াকে কেন্দ্র করে দুর্নীতিবাজ প্রিন্সিপালকে ছাত্ররা তালাবদ্ধ করে রেখেছিল কয়েক ঘণ্টা। নিউজটা শেষ পৃষ্ঠায় বড় করে ছাপা হয়েছে। অনুপের মনে পড়ে নিজের কলেজের কথা। আমাদের প্রিন্সিপালও তো একটা ফাউল। লেখাপড়া তো জানেনই না, মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেও শেখেননি। হারামজাদা কলেজের কতো টাকা যে মেরে খেয়েছেন তার হিসাব নেই। তবে ওই ফাউল লোকটা অনুপের সঙ্গে লাগতে আসেন না। বরং একটু তোয়াজের সুরেই কথা বলে। অনুপ ইংরেজির অধ্যাপক। বেসরকারি কলেজে ইংরেজির টিচাররা বেশিদিন থাকতে চান না, কারণ সুযোগ-সুবিধা কম। তারা জয়েন করার কিছুদিন পরেই বেটার চান্স খোঁজেন; পেয়েও যান। তার ওপর অনুপ কুমার সরকার লেখাপড়াজানা লোক, পড়ায়ও ভালো। কাজেই অনুপ কোনো কোনো সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস করলেও প্রিন্সিপাল উচ্চবাচ্য করেন না। বোঝেন, এ-লোকটা না থাকলে ছাত্ররা তার মাথা খেয়ে ফেলবে। চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরায় সে। শেষবারের মতো পত্রিকাটা উল্টেপাল্টে দ্যাখে, তারপর ‘কাচকলা’ বলে ছুড়ে ফেলে দেয় ঘরের এক কোণে।
এগারোটার দিকে অনুপ বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় নেমে চিন্তা করল, অনেকদিন ভার্সিটির দিকে যাইনি, যাওয়া যেতে পারে। অসীম থাকতে পারে ডিপার্টমেন্টে। আড্ডা ঠোকা যাবে। ইউনিভার্সিটিতে এতো মেয়ে, এতো হাসি-মশকরা, কল-কাকলি। আজকাল এসবও তার ভালো লাগে না। কী যে হয়েছে অনুপের! একা থাকতে থাকতে মনে চড়া পড়ে গেছে কি? ইদানীং তাকে হাসতেও দেখা যায় খুব কম। নিউমার্কেটের সামনে এসে একটাও খালি রিকশা না পেয়ে মেজাজ বিগড়ে গেল অনুপের। শূন্যদৃষ্টিতে রাস্তার ওপাশে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ মনে পড়ল, অসীম তো আজ ভার্সিটিতে যায়নি। পীযূষের চাকরির পোস্টিংয়ের ব্যাপারে তাকে নিয়ে ওর আজ উপশহর যাওয়ার কথা। গত সন্ধ্যায় আড্ডার এক ফাঁকে কথাটা অসীম বলেছিল। অনুপের একদম মনে ছিল না। ‘ধুউউস্’! নিজের ওপর খানিকটা বিরক্ত হলো সে। তাহলে কোথায় যাই! কার কাছে? দুলাল অবশ্য শহরেই আছে। কিন্তু ও তো আবার বিসিএস পরীক্ষা দেবে। শেষবারের মতো। সেজন্য ডেসপারেট হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যাবেলা ছাড়া ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। অনুপ ভাবল, আচ্ছা থাক। ওকে ডাকার দরকার নেই। আজ একা একাই ঘুরবে সে। হাঁটতে হাঁটতে সে সাহেববাজার পর্যন্ত এলো। এটা-সেটা ভাববার কিংবা কল্পনা করার জন্যও তো একটা পরিবেশ চাই, অবলম্বন চাই, অন্তত টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে বসার মতো একটু জায়গা চাই। অনুপ, অতএব, একটা মোটামুটি নিরিবিলি রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ল।

টেবিলে ঝুঁকে বসে দুটো শিঙাড়ার অর্ডার দেয়। তারপর সাত-পাঁচ ভাবতে থাকে। মামুন আসছে। মামুনটা সত্যিই রসিক জন। ৩৫ পেরিয়েও মনে ওর স্ফূর্তির অভাব নেই। মানুষের জন্য ওর ভালোবাসাও চোখে পড়ার মতো। কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলা – সেটা তার কাজ নয়। এমন একটি মানুষকে ফেলে তার স্ত্রী চলে গেছে! মদের অভ্যাসটা কি সে ওই ঘটনার পর রপ্ত করেছে? অ্যালকোহলপ্রীতি ওর আগে ছিল বলে তো জানতাম না! আজকাল অনেক বেশি খায় ও। বিপজ্জনক মাত্রায়। লাইফটাকে কি ও ফুঁকিয়ে দিতে চাচ্ছে? সাত-আট মাস আগে মামুন যখন এলো, এই লাইফ ফোঁকাফুঁকি নিয়ে মেলা কথা হয়েছিল দুজনের। কারো যুক্তি কারো চেয়ে কম নয়। মামুন হারতে রাজি নয়। অনুপ সে-কথা মনে করে নিঃশব্দে হাসে। মানুষ আসলে নিজের জীবনটাকে শেষ পর্যন্ত ফুঁকিয়ে দেয় না, অন্তত দিতে চায় না। তারপরও কেউ দেয়। হ্যাঁ, যখন তার পায়ের তলা থেকে ভালোবাসার মাটি সরে যায়, যখন সত্যিই আশা-ভরসার আর কোনো জায়গা থাকে না। কাদাপানির মতো ঘোলা চা খেতে খেতে অনুপের মনে পড়ে কনার কথা। কনা এর চেয়ে অনেক ভালো চা বানায়। এটা কোনো চা-ই হয়নি, ধুস্! কনা মেয়েটা ভালোই। গরিব ঘরের মেয়ে। ব্যবহার-ট্যবহার ভালো। গায়ে-গতরেও মানানসই। ভালো জামা-কাপড় পরলে ওকে ঠিক মেইড সারভেন্টের মতো লাগে না। ক্লাস ফাইভে উঠে পড়া বাদ দিয়েছিল। গতবার এসে মামুন খেয়াল করেছিল মেয়েটাকে। অনুপ ভাবল, মামুনকে নিয়ে মাঝে মাঝে প্রোব্লেম। ভয়ই লাগে। ওর নারীপ্রীতিটা এমন যে, একটু সুদর্শন মেয়েমানুষ দেখলে ভেতরে-ভেতরে চুলবুল করে ওঠে। মেয়েটা আমাকে বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করে। আমিও স্নেহ-অভয় দিয়ে ওকে আগলে রাখি, যতটা পারি; আর শালা কিনা প্রথমবার দেখেই বলে উঠল, অ্যালিউরিং, না রে অনুপ? অ্যান্ড ফাকাবল অ্যাট দ্য সেম টাইম! আড্ডায় অনুপের মুখে কথাটা শুনে অসীম মামুনের গলা-কাঁধ ধরে আনন্দে ‘ইলি-ইলি’ করে উঠেছিল। আর চোখ বড়-বড় হয়ে উঠেছিল কামালের। অসন্তুষ্টি নয়, একধরনের কৌতুক মেশানো ছিল সে-দৃষ্টিতে। ইয়ার্কিসুলভ কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে কামাল বলেছিল, কেলেঙ্কারি করে বসবে। এটাকে যত তাড়াতাড়ি পারো ঢাকা পাঠিয়ে দাও। মামুন অবশ্য তাতে অনেক মজাই পেয়েছিল।

আর কোথাও যায়নি অনুপ। আকাশ মেঘলা থাকায় রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে লালকুঠির দিকে মানে পদ্মার ধারে গিয়েছিল। সিমেন্টের বেঞ্চে মিনিট চল্লিশেক বসে থেকে সোজা বাসায় ফিরে এসেছে। বাসা মানে দুরুমের ছোট্ট ফ্ল্যাট। একটাতে সে নিজে থাকে। অন্যটাতে ভাগ্নে শিশির। লাঞ্চের পর অনুপ সাধারণত ঘুমায় না। ঘণ্টাদেড়েক গড়াগড়ি দেয়। ম্যাগাজিন-বই পড়ে। পড়তে ইচ্ছা না করলে শিশিরকে ডাকে। ওর সঙ্গে গল্পগুজব করে। কলেজে যায়নি বলে আজ বিকেলটা দীর্ঘতর মনে হচ্ছে অনুপের। ম্যাগাজিন-বই পড়তে ইচ্ছা করেনি। শিশিরও নেই, নওগাঁ গেছে – বাড়িতে। সুতরাং লাঞ্চের পর চেয়েছিল একটু ঘুমুবে। ঘুম আসেনি। চেষ্টা করে ঘুমানো যায় না। সূক্ষ রুচিসম্পন্ন, ৩৮ প্লাস, বিবেকী, ভাবুকস্বভাবী একা অনুপ অনন্যোপায় এ-মুহূর্তে শূন্যদৃষ্টি মেলে দিয়েছে সিলিংয়ের দিকে। একটা ছোট্ট, সাদা মাকড়শা দেয়ালের ওপরের কোণে উঠতে গিয়ে বারবার পড়ে যাচ্ছে। বারবারই প্রাণীটা চেষ্টা করছে ওপরে উঠতে। অনুপের মন চলে গেছে ইতিহাসের পাতায়। সে-মন এখন নিঃশব্দে বলে, রবার্ট ব্রুস!

সকালের দিকের মেঘলা ভাবটা কেটে গিয়ে দুপুরের পর ঝলমলে রোদে ভরে গেছে আকাশ। নিউমার্কেটের পেছনটা ঠিক আবাসিক এলাকা নয়। দালান-কোঠাও কম। গরমের দিন। বিশেষ কাজ না থাকলে মানুষ ছটা-সাড়ে ছটার আগে বেরোয় না। শুয়ে-শুয়ে অনুপ খেয়াল করল, বেশ কিছুক্ষণ, বাইরে অবিশ্বাস্য নিস্তব্ধতা। একটা কাকাও ডাকছে না কোথাও! ফুটপাত নিশ্চয়ই গরম হয়ে উঠেছে। রাস্তার পিচ নরম হয়ে গেছে কি? হঠাৎ তার মনে হলো, শহরে একটা মানুষও নেই, সব মরে গেছে। আবার মাকড়শাটার দিকে চোখ গেল তার। প্রাণীটা ঠিকই সিলিংয়ে উঠে গেছে। তার চেষ্টা সার্থক হয়েছে। সে নাছোড়বান্দা। আর সেজন্যই পেরেছে।

মাকড়সাটার দিকে অপলক তাকিয়ে নিজের ভেতর সেঁধিয়ে যায় অনুপের। আমি পারিনি ওর মতো ওপরে উঠতে। পারিনি কেন? ট্রাই তো আমিও করেছি বেশ কয়েকবার। তাহলে হলো না কেন? হয়নি, তার কারণ আমি ঠিক নাছোড়বান্দা টাইপের মানুষ নই। তাছাড়া বারবার চেষ্টা করলেই যে হবে তার গ্যারান্টি কে দিয়েছে? ভাগ্য প্রসন্ন না হলে হয় না। ৩০-৩২ বছর পর্যন্ত অনুপ ক্যারিয়ার নিয়ে কত কিছু ভাবত! ডিস্টেম্পার করা বড় চেম্বার। সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপারে কুশন-লাগানো রিভলভিং চেয়ারে সম্রাটের মতো বসে আছে সে। হালফ্যাশনের ফ্যান ঘুরছে মাথার ওপর। হাতের নাগালে একজোড়া টেলিফোন। কার্পেট-ঢাকা মেঝে। মোটা প্রিন্টেড কাপড়ের পর্দা ঝুলছে জানালায়। দরজার বাইরে টুলে বসা ব্যক্তিগত পিয়ন। দরজার ওপর বড় বড় অক্ষরে লেখা অনুপ কুমার সরকার। তার নিচে পদবি। কত ইমপরট্যান্ট লোক ঢুকছে-বেরোচ্ছে। তিন-চার বছর ধরে এমন দিবাস্বপ্নে আর বিভোর হয় না সে। বরং সে-কথা মনে হলে মন খারাপ হয়ে যায়। দারুণ অস্বস্তিতে ভোগে। ভোগে আর ভাবে, আফসোস করব কেন? লাভ কী? এ আধা গরিব জীবন তো আমি নিজেই বেছে নিয়েছি। খেয়ালখুশির অবকাশ এবং আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য একসঙ্গে থাকে না।

মাঝে মাঝে অনুপের মনে পড়ে কৃষি ব্যাংকের ছেড়ে দেওয়া চাকরিটার কথা। পদটা ছিল জুনিয়র অফিসারের। লেগে থাকলে গত ছয়-সাত বছরে অন্তত দুটো ধাপে প্রমোশন হতো। বছর পনেরো চাকরি করলে, সে যেহেতু ইংরেজিতে অনার্স-মাস্টার্স, রিজিওনাল ম্যানেজার বা সমপর্যায়ের কোনো পদে উন্নীত হতো, তাতে সন্দেহ কী? কিন্তু ওই লেগে থাকাটাই ছিল তার জন্য কঠিন। কৃষি ব্যাংকের লালমনিরহাট প্রধান অফিসে পোস্টিং হয়েছিল অনুপের। অফিসের কাজকর্ম দ্রুতগতিতে শিখছিল সে। সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। প্রায়ই আউডডোর ওয়ার্ক করতে তাকে যেতে হতো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে সেসব এলাকায়, যেখানে গরিব মানুষের বসবাস। অনুপ একঝলক দেখতে পেল, মোটরসাইকেলে চেপে, ধুলার সমুদ্র সাঁতরে চলেছে অাঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে। উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য, যারা কৃষিঋণ নিয়েছে এবং অনেকদিন যাবৎ লোনের টাকার কিস্তি পরিশোধ করছে না, তাদের ঋণ শোধের তাগাদা দেওয়া। হ্যাঁ, ওই তো, আবদুল হক ড্রাইভ করছে; তার পেছনে বসে আছে অনুপ। উটকো ধূলি-বাতাসের ভেতর খর রোদ আর ঘাসে একাকার হয়ে ফিরে আসছে ব্যাংকার দুজন। ঘরে ফিরে আয়নায় তাকালে নিজেকে চেনাই কঠিন হবে তাদের! কালোমাথা পাথারের ধুলা লেগে প্রায় সাদা। রোদে-ঘামে-ধুলায় সারা শরীর চিটচিটে! উফ্ ইনটলার্যা বল! ভালোই করেছি চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে। অনুপ নিজেকে প্রবোধ দেয়। কিন্তু নস্টালজিয়া এমন জিনিস যে, মানুষ না চাইলেও তাকে ভর করবে। অনুপের বেলায়ও তাই হয়েছে। ‘ভালোই করেছি’ বললেও তার মন অন্য সময়ে অন্য কথা বলে। কেননা, ব্যাংকে জব করার সময়ের সোশ্যাল আইডেনটিটি ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের স্মৃতি মাঝেমধ্যে যে হানা দেয় না, তা তো নয়। তবু অনুপ নির্বিকার থাকতে পারে। ভাবতে পারে, বউ-বাচ্চা নেই, সংসার নেই। যে-টাকা পায় তাতে চার-পাঁচজন মানুষ কষ্ট না করেও দিব্যি চলতে পারে, আর সে তো একা। খুব খারাপ আছে কি? অনুপের লালমনিরহাট চ্যাপ্টারটার কথা মনে হলে আরো অনেক কিছু মনে পড়ে। ধুলোর সমুদ্র পেরিয়ে রোদের প্রান্তর ছাড়িয়ে কাজে যাওয়া, ঋণগ্রস্ত নিরুপায় আমজনতার সঙ্গে বকবক করা আর ডগডায়ার্ড হয়ে সন্ধ্যার মুখে ঘরে ফেরা… এই একঘেয়েমি আর নিরানন্দ অনুভবের ভেতরেও, সূর্যাস্ত-পরবর্তী অবসরে, মুক্তার মুখটা ভেসে আসে। মুক্তা পালের হাসি-হাসি মুখ, অন্যমনস্ক মুখ, কপট রাগ বা অনুরাগ ফুটে-ওঠা অদ্ভুত আকর্ষণীয় মুখ! লালমনিরহাট ছেড়ে আসার পরপর কিছুদিন যোগাযোগ ছিল। তারপর দুজনের কেউই আর যোগাযোগ করেনি। এতদিনে মুক্তা এক বা একাধিক বাচ্চার মা হয়ে গেছে বোধহয়। অনুপ ভাবে, তবে কি ওই হেমন্ত নামের লোকটার সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত…! হেমন্ত মুক্তার কাজিন – একটু দূরসম্পর্কের। মামুনের স্পষ্ট মনে আছে, হেমন্ত সেদিন বিকেলে মুক্তাদের বাড়িতে এসেছিল, যেদিন অনুপ আর মামুনকে লাঞ্চের দাওয়াত দিয়েছিল মুক্তা। সাড়ে চারটার দিকে দুবন্ধু রওনা হওয়ার জন্য মুক্তার ঘর থেকে বেরোয়। তার কিছুক্ষণ আগে ওই লোক এসে হাজির। মুক্তাদের বাড়ি থেকে চওড়া আলপথ ধরে কিছুদূর গেলে পাকা রাস্তা পাওয়া যায়। কাঁচা রাস্তাটুকু এবড়ো-খেবড়ো। মোটরবাইকে চড়ে যাওয়া আরামদায়ক নয়। অনুপ তাই বাইকটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। পেছনে, একটু দূরে হেঁটে যাচ্ছিল মামুন ও হেমন্ত। কথাবার্তা কী হয়েছিল অতো মনে নেই। শুধু মনে আছে, লোকটা অনুপ সম্বন্ধে খোঁচামারা কথা বলেছিল দু-চারটি। তাকে মামুনের মোটেই সরল লোক মনে হয়নি। মুক্তাদের বাড়িতে এদের আসাটাকেই সে ভালোভাবে নেয়নি। মামুনের অবশ্য অন্য কিছু বিষয় বেশি মনে আছে। তরকারির চোদ্দোটি আইটেম দিয়ে ভাত খেয়েছিল ওরা। মুক্তা বারবার ‘সাগাই’ শব্দটি উচ্চারণ করছিল। জেলা সদরের ভিড় পার হয়ে, সেদিন, ওরা যখন সাপটানা গ্রামের পাকা রাস্তায় উঠল, বাইকের স্পিডও বেড়ে গেল। অনুপ মোটরবাইক চালাতে শিখেছে অল্পদিন আগে। তাই জোসই আলাদা। একটু পরপর স্পিড বাড়াচ্ছিল আর বলছিল – এখন পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার পার আওয়ার, এখন চল্লিশ কিলোমিটার বেগে যাচ্ছি…। মামুন মোটরবাইকে খুব কমই চড়েছে। বেশি স্পিডে তার ভয় করে। সে বন্ধুর পিঠে টোকা মেরে বলে, স্পিড কমা, স্পিড কমা দোস্ত, আমার আনইজি লাগছে। সরল হাসি হেসে উঠেছে অনুপ। তারপর গিয়ার নামিয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো নিঃসঙ্গ দুপুরে বা নির্ঘুম রাতে মুক্তার ছবি দেখতে পায় অনুপ, এখনো। কে জানে মেয়েটা কোথায় আছে, কেমন আছে, আদৌ আছে কি-না! মেয়েটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি সে। পারেনি বলে সিদ্ধান্তও নিতে পারেনি। কেমন যেন অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ! পরিষ্কার করে কিছু বলতেই পারল না, অথচ সুযোগ এসেছিল অনেকবার। শুধু শুধু সাফার করল। সাফার করাল আমাকেও। অনুপ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, এ-ই হয়। জীবন এমনই!

চৈত্রের ভরা দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। সাড়ে পাঁচটার আগে রোদের তেজ কমবে না। চারদিক নিঃশব্দ। মোড়ের দিকে শুধু দু-একটা রিকশার বেল শোনা গেল। বাসায় অনুপ একা। শিশির ইউনিভার্সিটিতে। চারটার আগে ফিরবে না। অনুপ গ্রাহাম গ্রিনের হার্ট অব দ্য ম্যাটার উপন্যাসটি বালিশের তলা থেকে টেনে চোখের সামনে মেলে ধরে। সাতদিনে মাত্র একশ পৃষ্ঠা পড়েছে। কী যে আলস্য আর অবসাদ। অবসর মুহূর্তগুলো আজকাল ঝিম মেরে থাকে। এক চ্যাপ্টার শেষ করে আরেকটা শুরু করবে, তখন দরজা খোলার শব্দ। ছিটকিনি আলগা করা ছিল। কেউ এলো? শিশির? না, দরজায় কনা দাঁড়িয়ে।
কিছু বলবি?
থালাবাসনগুলো ধুইয়ে রাইখবো দাদা।
অনুপ আর কিছু বলে না। কনা নিঃশব্দে কিচেনে ঢোকে। অনুপ ঠোঁটে আঙুল রেখে নিজের ভেতর ডুব দেয়। বাসায় আমি একা, এদিকে জোয়ান মেয়েটা আমার ঘরে। এ-সময় তো কনা আসে না। শিশির কোনো কারণে এসে পড়তে পারে। ওকে নিয়ে সমস্যা নেই। পরিচিত অন্য কেউ যদি এসে পড়ে, অন্যকিছু ভাবতে পারে। অনুপ, অতএব, মিথ্যে কথা বলে – কনা শোন, আমি এক্ষুনি বাইরে যাব; জরুরি কাজ আছে। এসব ধুতে সময় লাগবে। তুই বরং বিকেলে ওগুলো ধুয়ে একেবারে রান্নার কাজটা সেরেই যাস।
আইচ্ছা।
কনা বেরিয়ে যাচ্ছিল। অনুপ ওকে থামায়, আর শোন, তুই যে পাঁচশো টাকা চেয়েছিলি সেটা তোকে দেব। তিন-চারটা দিন যাক। হাতে এখন বেশি টাকা নেই।
আইচ্ছা, দিয়েন।

অনুপ এ-বাসায় উঠেছে বছরখানেক হলো। কনা কাজ করছে সাত-আট মাস ধরে। মেয়েটা এক মাসে এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, অনুপ ভদ্রলোক। সে অন্তত এমন কিছু করবে না যাতে তার কচি মনটা বিষিয়ে ওঠে। ঠিক আছে, কিন্তু মানুষের মন স্তূপ করা মেঘের আকাশ। তার রং পাল্টাতে কতক্ষণ? তাছাড়া কে খুঁজে দেখেছে কার মনে কী? কাজেই নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। আপাতদৃষ্টে আলাভোলা, সুবোধ-সুবোধ স্বাস্থ্যবতী কনা ভেতরে-ভেতরে যে পেকে যায়নি তাই-বা কে জানে? মেয়েটা অবশ্য কখনো অশোভন ইঙ্গিত দেয়নি। তবু ইদানীং তার যখন-তখন ঘরে ঢোকার ব্যাপারটা অনুপের মনে খটকা জাগায়।

গ্রীষ্মের বিকেল। কনার আসতে দেরি হচ্ছে। অনুপ অগত্যা নিজেই এক কাপ চা বানিয়ে দোতলার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। শিরশির হাওয়া দিচ্ছে। গণকপাড়া মসজিদের সামনের সুপারিগাছ দুটো একটু একটু মাথা দোলাচ্ছে। বিকেলের আয়োজনে শহরের ব্যস্ততা আবার স্পষ্ট হতে থাকে। গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সম্ভবত ‘অলকা’ সিনেমার সামনে কিছু লোক হইহই করে উঠল। অনুপের মাথায় আবার ঢুকে পড়ল কনা। মেয়েটা আগে কখনো বেতনের অতিরিক্ত টাকা চায়নি তো! ওদের অভাবের সংসার; বাবা নেই। টাকা চাইতে ওর লজ্জা করল না? টাকা চাওয়ার পর সেদিন কনা যখন চোখ পায়ের পাতায় রেখে শব্দহীন দাঁড়িয়ে ছিল, অনুপ লক্ষ করেছে, খুব আলতো ভঙিতে দাঁড়িয়ে মেয়েটি, যেন সামান্য টোকায় পড়ে যাবে। পরনে হালকা খয়েরি শাড়ি, কালো ব্লাউজ। জোড়া বেণি স্তনের দুদিকে ছড়ানো। অাঁচলটা কোমরে প্যাঁচানো। মুখ তুলে তাকাতেই অনুপ দেখতে পেল তার চোখে লজ্জা, সঙ্কোচ আর শঙ্কার মিশ্রিত আলো-ছায়া। সত্যিই অনেক সুন্দর লাগছে কনাকে। একেবারেই মনে হচ্ছে না, সে মেইড সারভেন্ট। চায়ে চুমুক দিতে দিতে অনুপ ভাবল, বিয়ে না করে কী ভুল করলাম! অবশ্য চাইলে এখনো তা করতে পারি। কিন্তু ইচ্ছেটাই যে উবে গেছে! বাড়ি গেলে মা এখনো বলে, জেবনটা একলা একলাই পার কইরে দিবি বাবা? তোর বাবা তো আমার কথা ভাবতে-ভাবতে মরেই গেল! একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাসের ভেতর অমলেশ সরকারের সুরা-প্রভাবিত প্রায় দন্তহীন হাসিমুখ ওঠা-নামা করে, তারপর ঢুকে যায় অনুপের মাথার ভেতর। তিন বছর আগের কথা। দুর্গাপূজা উপলক্ষে অনুপ বদলগাছী গেছে। পূজা তাদের বাড়িতেই। অনুপের অবশ্য ধর্মকর্মে উৎসাহ ছিল না কখনো, এখনো নেই। সন্ধ্যার পর বাজারে গিয়ে স্থানীয় দু-চারজন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মেরে নটার পর বাড়ি ফিরেছিল সে। তারপর রাত দশটার দিকে ভাত খেয়ে বিছানায় সটান। অনুপের একটা আট ব্যান্ডের বিদেশি রেডিও আছে। কানের পাশে সেটা রেখে সম্ভবত নিউজ-টিউজ শুনছিল। তারপর ঘুম-ঘুম ভাব হলে যন্ত্রটা অফ করে বালিশের একপাশে রেখেছে মাত্র, ঠিক তখনই, তখন এগারোটার মতো বাজে বোধহয়, অমলেশ সরকারের জিহবাজড়ানো গলা, অ-নু-প, অ-নু-প! অনুপ উঠে বসে। লাইটের সুইচ অন করে। তারপর বলে, হ্যাঁ, বলো বাবা। কী বলবে বলো।
প্রথমে দারুর গন্ধটা না পেলেও হাতলঅলা চেয়ারে তার ধপাস করে বসে পড়া আর চোখের উজ্জ্বলতা দেখে অনুপের বুঝতে দেরি হয়নি, পিতা তার মাল টেনে এসেছে। টোকা দিতে ভুলে যাওয়ায় আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগারেটের ছাই লম্বা হয়ে আছে। ঘাড় কাত করে অমলেশ সরকার বলে, এবার আর মিস করা যাবে না,… উ-চি-ত হবে না… বুঝলি অ-নু-প! এবার দারুর গন্ধটা পরিষ্কার নাকে এসে ঝাপটা দিলে অনুপ বলে, কী মিস করা যাবে না বাবা? কিসের কথা বলছ? কিসের কথা আর, তার কণ্ঠ যেন আরো জড়িয়ে আসছে, বু-ঝি-স না? তো-র বি-য়ে-র কথা, বি-য়ে-র কথা রে… দৃশ্যবিহবল, ভাববিমূঢ় অনুপ এখন কী করবে বুঝতে পাচ্ছে না। পিতার পেটে তরল আগুন। তাকে ‘না’ বললে এই এতো রাতে বাড়ি মাথায় তুলবে। আবার ‘হ্যাঁ’ বলতেও পারছে না। অনুপ অগত্যা খুব নরম গলায় বলে, এ-আলাপটা আমরা দিনের বেলা করি বাবা? আজ তোমার শরীরটা ক্লান্ত। রাতও হয়েছে বেশ।

নড়বড়ে পায়ে উঠে দাঁড়ায় অমলেশ। আজ প্রচুর মাল টেনেছে লোকটা। দরজার দিকে যেতে যেতে বলে, তাহলে ওই কথাই ফাইনাল! এবার তোর বিয়ের সানাই বাজবে রে! তুই আর অমত ক-রি-স না…। মসৃণ সিঁড়ির ধাপ মাত্র তিনটি এবং উঠোনে পর্যাপ্ত আলোও আছে। তবু, পিতা বলে কথা। একমুহূর্তে অনুপের মনে হয়, বাবা পড়ে যাবে না তো! সে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

সন্ধ্যাবেলা অনুপ বাসায় থাকে না, কিন্তু আজ আছে। কোথাও যেতে ইচ্ছে করল না। শরীরটা কদিন ধরে ভালো না; মন তার চেয়েও খারাপ। কারেন্ট নেই। ঘরে মোমের আলো জ্বলছে। সোফায় অনেকখানি হেলান দিয়ে বসে পা দুটো সামনে লম্বা করে দিয়েছে অনুপ। সে এখন শামুকের খোলের ভেতর ঢুকে গেছে। শুধু যে নিজে সাফার করলাম বা করছি তা তো না, সবাইকে কষ্ট দিলাম। বাবা-মা, দিদি, দাদা-বউদি… সবাইকে। আমি যে কি! আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড মাইসেল্ফ! আই ডোন্ট নো, হোয়াট আই ওয়ান্ট অ্যাকচুয়ালি! তবু বেঁচে আছি, বেঁচে থাকার লোভেই। নইলে এ-জীবনের কোনো মানে নেই। বেঁচে না থাকলে কী ক্ষতি আমার মতো মানুষের, দেশ বা সমাজকে দেওয়ার মতো যার তেমন কিছু নেই? তাহলে কেন এখনো সুইসাইড করিনি? কাঙালের মতো জীবনটাকে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছি কেন এখনো, কিসের আশায়…!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত