জ্যোতির্ময় কিছু

দিনের এখন বেশ কিছুটা। সূর্য গনগন করছে রাগে। সেই রাগের ফসল ফলছে মইনুল শেখের শরীরে। গা ঘেমে যাচ্ছে তার। দরদর করে ঘাম পড়ছে; কপাল বেয়ে, গলা বেয়ে, বুক বেয়ে, পা বেয়ে মাটির শরীরে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম; তিরতির করে ঘাম পড়ছে। একটু দূরে ছিদাম আলি বিড়ি ফুঁকছে আপনমনে। সাধারণত বিড়ি ফোঁকার সময় সে লুঙ্গির কোঁচা ঝুলিয়ে দেয় বাতাসে, সময়টা যে বিশ্রামের এই বোধ মাথায় ধরে রেখে। কিন্তু মইনুল শেখের এখন বিশ্রাম করার সময় নেই। সে কোদাল চালিয়ে যাচ্ছে একভাবে। দুই হাতের শক্ত মুঠিতে ধরে রেখেছে সে কোদাল। একবার মাথার ওপরে কোদাল উঠছে আবার প্রচন্ড বেগে নেমে আসছে। মাটির ওপর।

এই মাটিটা শক্ত। যেন অনাদিকাল ধরে এর বুকে কেউ আঘাত করে খোঁড়েনি কোনো
ভবিষ্যতের স্বপ্ন। এত বছর বাদে সিকদার ব্যাপারীর গোডাউন তৈরির লক্ষ্যে এখানে জঙ্গল সাফ করে খোঁড়া হচ্ছে পুরনো দালানের ভাঙাচোরা ভিত।

এলাকাটি বেশ দ্রুতই একটা গঞ্জের রূপ ধারণ করছে। ক্রমশ জমজমাট হয়ে উঠছে চারপাশ। কামলাখাটা মইনুল ইদানীং তাই ব্যস্ত খুব। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো কাজ জুটে যাচ্ছে তার। আর সেজন্যে কি না জানে না, আকিজ বিড়ি এখন আর তার জিভে স্বাদ আনে না, ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকানো সিগারেট খেতেই তার এখন বেশি ভালো লাগে। মাথার ভেতরে সিগারেটের ধোঁয়া নড়েচড়ে বেড়ায়। ফুসফুসের ভেতরটা আনন্দে সংকুচিত-প্রসারিত হয়, আর মইনুলের মনের ভেতরে অজানা এক স্ফূর্তি যেন ঝাঁপ খুলে বেরিয়ে আসে। কিন্তু এখন মইনুল কাজে ব্যস্ত। সিকদার ব্যাপারীর গোডাউন তৈরি হবে। এই এলাকায় আলুর ফলন বেশি। আলু রাখার জন্যে কোল্ডস্টোরেজ তৈরি হবে এখানে। ছিদাম শেখের সহকারী হিসেবে কাজ পেয়েছে মইনুল। পাকা একজন যোগালে সে এখন এই এলাকার। কাজে ফাঁকি দেয় না বলে কদর বেশি। কোদাল চালাতে চালাতে মইনুলের এখন নেশা লেগে গেছে। সে সহজে ক্লান্ত হয় না; বরং এভাবে গায়ের ঘাম ঝরিয়ে পুরনো বাড়ির ভিত সরিয়ে নতুন ভিত গড়ার স্বপ্ন তার মনের ভেতরে। হোক সে কামলাখাটা মানুষ, কিন্তু তারও কিছু স্বপ্ন থাকে মনের গভীরে।

এবার তার কোদালের আঘাত মাটিতে পড়তেই হঠাৎ একটা শব্দ উঠল, ঠং। শব্দটা মৃদু। এত মৃদু যে কান খুব খাড়া না হলে সহসা শোনা যায় না। কিন্তু মইনুলের কানে শব্দটা গেল। শব্দ শুনে ঘর্মাক্ত মইনুল তাকিয়ে দেখল মাথা নিচু করে। তখনো সে ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেনি। আবারো কোদালের আরেক আঘাতে বেরিয়ে এলো জিনিসটা। কালো রঙের একটা চৌকো বাক্স। হতভম্ব মইনুল মাটিতে বসে পড়ে ঝুঁকে তাকিয়ে দেখল। দেখতে দেখতে শরীরে কাঁপন উঠল তার। শীত-শীত করতে লাগল। একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখল। ওই দূরে পশ্চিমদিকে ছিদাম মিস্ত্রি আপনমনে বিড়ি ফুঁকছে। চারপাশের জঙ্গলে, গাছগাছালির শাখায়-পাতায় অযথা একটা বাতাসের দাপাদাপি যেন শুরু হয়েছে।
মইনুল এখন কী করে?

দুই
কামলাখাটা মইনুল মিয়ার কোনো দুঃখ নেই। মাকে সঙ্গে নিয়ে তার সুখের সংসার। মইনুলের বয়স একুশ। তেরো বছর থেকে কামলা খাটে সে। শরীরের গড়ন বেশ মজবুত। বয়স অনুপাতে মনের ভেতরে সে একটু বেশি ভাবুক। একটু বেশি অন্যমনস্ক। তবে কাজে ফাঁকি সে দেয় না; বরং একটু অন্যমনস্ক বলে কাজ শেষ হলেও সে কাজ করতেই থাকে। কেউ বললে তবে সে কাজ থামায়।

মইনুল দেখতে লম্বা, কালো রং, মাথায় একমাথা সোজাসাপ্টা চুল, লেখাপড়া গ্রামের মক্তবে, তারপর প্রকৃতি। সে থাকে এই উপজেলার একটা স্কুলঘরের পেছনে গোলপাতার ছাপরা বেঁধে। তার মা মদিনা বিবি স্কুলের দাই। দুপুরবেলা টিউবওয়েল টিপে বাচ্চাদের পানি খাওয়ায়। আর নিজে বসে বসে পান খায়। সে রাতকানা। রাতের বেলা চোখে দেখে না। তবে তাতে তার অসুবিধে নেই। দিনের বেলাতেই তার যতসব কাজকর্ম। রাতের বেলা নির্জন স্কুলের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের দিকে তাকিয়ে সে কল্পনায় অনেক কিছু দেখতে পায়। তার ভেতরে বেশিরভাগ জুড়ে থাকে এক কাল্পনিক সুখ, তা হলো ছেলে মইনুল শেখের বিয়ের পর তার একজন নাতি, যার কাছে সে বলে যাবে নিজের জীবনের ইতিবৃত্ত। বিত্তহীনের জীবনেও খুব বিস্তৃত একটা ইতিবৃত্ত থাকে, যার গোড়ায় থাকে বৈভব ও সমৃদ্ধির একটি ইতিহাস। সে বহু যুগ আগের কথা, যেন লৌহযুগের পরপরই এই ইতিহাসের শুরু। হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া। তারপর ধীরে ধীরে ঘোড়সওয়ারের আবির্ভাব। লুটপাট, অরাজকতা, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় – একের পর এক, একের পর এক।

মইনুল শেখ অবশ্য মায়ের সঙ্গে কথা বলে কম। দুবেলা একরকম মুখ বুজেই সে খেয়ে ওঠে।
রাতের বেলা খাওয়ার পর মা তাকে পান সেজে দেয়। তারপর মইনুল মিয়ার চৌকির নিচে পাটি পেতে ঘুমিয়ে পড়ে। তেল-চিটচিটে শক্ত একটা তুলোর বালিশ মইনুলের মায়ের রাতের সঙ্গী। এ-বালিশ ছাড়া তার রাতের ঘুম অসম্ভব। পায়ের দিকে খোলা জানালায় তার দৃষ্টি থাকে স্থির। সেদিকে স্কুলের মাঠ। মাঠের চারপাশ ঘিরে শিরীষ আর মান্দার গাছ। ঋতু পরিবর্তন হলে মান্দার ফুল ফোটে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে মদিনা বিবি মাঝেমধ্যে সেই ফুলের শোভা তাকিয়ে দেখে। কারণ, স্কুল ছুটির পর তার আর কাজ কী। সামান্য রান্না আর ঘর নিকোনোর কাজ তো সে ভোরেই সেরে রাখে। তারপর সন্ধেয় মইনুল ফিরলে সামান্য কথাবার্তা। তা-ও সব দিন হয়ে ওঠে না। কারণ, ছেলে তার গম্ভীর প্রকৃতির।

আজ সন্ধে ঘোর হয়ে এলেও মইনুল বাড়ি ফিরল না। মদিনা বিবি চিন্তায় ঘরবার করতে লাগল। একবার মাঠের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখে দেখতে পায় না, তবু কাল্পনিক অবয়বের ভেতরে মইনুল শেখের উপস্থিতি দেখার চেষ্টা করে। স্কুলমাঠের ওপর দিয়ে গঞ্জের রাস্তা দেখা যায়। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা। কিন্তু সারাদিন গাড়ি, ভ্যান আর নছিমন চলার বিরাম নেই।
রাত যখন প্রায় নটা, বাড়ি ফিরল মইনুল। মদিনা বিবি বলল, এতো রাত করলি ক্যান, বাজান?
উত্তরে শুধু মাথা নাড়ল মইনুল। মদিনা রাতে চোখে দেখে না, নইলে মইনুলের চেহারা দেখে সে চমকে উঠত। শীতের দিন বলে মইনুলের গায়ে একটা খদ্দরের চাদর। বাড়ি এসে সাধারণত সে স্কুলের টিউবওয়েলের পানিতে গোসল সারে। কিন্তু আজ আর গোসলের কথা তুলল না। ঘরে ঢুকে সে চৌকির ওপরে এসে বসল। বসে গম্ভীর স্বরে ডাকল, মা?
ডাক শুনে মা কাছে এসে দাঁড়াল।

মইনুল বলল, আপনি খাটে বসেন। বুড়ি থতমত খেয়ে খাটে বসল। মইনুল এবার তার খদ্দরের চাদরের আড়াল থেকে বের করে আনল বাক্সটা। কালো হয়ে যাওয়া, কিন্তু ভারী পিতলের একটা বাক্স। আট আঙুল লম্বা আর চার আঙুল চওড়া বাক্সটা। উচ্চতাও চার আঙুলের মতো।

বাক্সটা খোলার আগে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মইনুল বলল, মা, আজ আমি সিকদারবাড়ির পোড়ো জমিতে যুগালে খাটতি গিইলাম।
কথা শুনে মদিনা বিবি চুপ থাকল। এটা তো নতুন কোনো কথা নয়।
পোড়ো জমির ভিত খুঁড়তি যেইয়ে এই বাক্সোখান পাইছি।
এইবার বুড়ির টনক নড়ল। থতমত খেয়ে বলল, কী আছে বাক্সোর মধ্যি?
বলি শোনেন, আমি যখন কাজ করতিছিলাম, তখন ছিদাম কাকু বিড়ি খাবার জন্যি এট্টু দূরে দাঁড়ায়ে ছিল। আজ আমরা মাত্তর দুইজন যুগালে ছিলাম।

বুড়ি উত্তেজনা ও আগ্রহে টগমগ করে ছেলের মুখের দিকে তাকাল। ঘরে টিমটিম করে বাতি জ্বলছে। তবু তার মনে হলো, সে মইনুল মিয়ার মুখখানা দিব্যি চোখে দেখতে পাচ্ছে।
মইনুল এবার জামার পকেট থেকে ফস করে একটা দেশলাই বের করে কাঠি জ্বালালো। তারপর বাক্সর ডালা খুলে ভেতরে আলো ফেলল। মদিনা বিবি চোখ নিচু করে তাকিয়ে দেখে অবাক। মুহূর্তে বাক্সের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। গোল গোল তামার পয়সার মতো কী সব। সেই ছেলেবেলায় এরকম কোনো পয়সা সে দেখে থাকবে। কিন্তু এটা ঠিক পয়সাও যেন নয়, এটা অন্য কিছু।

বাজান, এগুলোন কি সোনার মোহর? কথা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল বুড়ির।
না মা, মোহর না। ছিদাম কাকুরে দেখাইলাম, সে বলল, এগুলো মোহর না, সোনাও না।
তা’লি? বুড়ি উদগ্রীব হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
এগুলোন যে কী, তা বুঝতি পারলাম না। দিনের আলোয় তাকায়ে দেখলি বোঝবেন, এগুলোনের ভিতরে কী যেন চমকায়।
চমকায়? মদিনা বিবি অবাক।
হ্যাঁ, মা।
কী চমকায় বাজান?
গম্ভীর স্বরে মইনুল এবার বলল, এ যে কী চমকায়, সে-ও ঠিক জানে না। তবে কাউরে বলতি মানা করল। বলল, এ তুমার ভাগ্যে উঠিছে, তুমার থাকবে। এ তুমার হক। অন্য কাউরে বললি পরে তুমার ক্ষেতি হবে।
ছিদাম যদি কাউরে বইলে দেয়? ওরে বিশ্বেস কী? উদ্বিগ্ন হয়ে বলল মদিনা।
না। ছিদাম কাকু কাউরে বলবে না। সে খুব ভালো মানুষ। দুনিয়াতে তার আপন বলতি কেউ নেই।
তা’লি এগুলোন এখুন রাখবোনে কুথায়? ব্যাকুল হয়ে উঠল মদিনা।
ঘুরের কুনায় মাটি খুঁইড়ে রাখতি হবেনে। খুন্তা আছে ঘরে?
খোন্তা ঘরে ছিল না। ভাঙা একটা দা ঘরে ছিল। সেটা এনে ছেলের হাতে দিলো মদিনা বিবি।
মা ও ছেলে এবার ঘরের পশ্চিম কোণের মাটি খুঁড়ে গর্ত করে ফেলল। মা গেজবাতি হাতে দাঁড়িয়ে থাকল। মইনুল একটা ছেঁড়া সিলোফেনের কাগজে পুরো বাক্সটা মুড়িয়ে মাটির গর্তে রেখে আবার মাটিচাপা দিলো। সমান করে রাখল মাটি।
কাজ শেষ করে হাত-মুখ ধুয়ে ভাত খেতে বসল মইনুল।
কিন্তু ভাতে হাত রেখে সে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল।
মদিনা বিবি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ভাত খা, বাজান।
ঈষদুষ্ণ ভাতের ভেতরে হাতের আঙুল ডুবিয়ে রেখে মইনুল ফিসফিস করে বলে উঠল, মা?
বল্ বাজান।
আমার মন ক’তিছে এগুলোন খুব দামি জিনিস।
তা হ’তি পারে।
যদি দামি হয়, তা’লি এগুলোনরে নিয়ে কী করবোনে?
ছেলের কথা শুনে মদিনা ভাবতে লাগল। রাতকানা হলেও তার শরীরে বার্ধক্যের ছাপ কম। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে সে হঠাৎ উদ্দীপ্ত হয়ে বলে উঠল, আমাদের তো কুনো অভাই নেই, বাজান। তা ছাড়া আমরা দুনিয়ার ধুলোকণার মানুষ। আমাগের কি এসব সাজে?
মইনুল মায়ের কথা শুনে মাথা নাড়ল। সত্যি তো, তাদের তো কোনো অভাব নেই। তার চারখানা লুঙ্গি, চার-পাঁচখানা গেঞ্জি, পায়ে দুজোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল, দু-তিনবেলা ভাত, বিড়ি বা সিগারেট খাওয়ার পয়সা সবই তো আছে। তার মা স্কুলের ছেলেমেয়েদের টিউবওয়েল চেপে পানি খাওয়ায়, ঘণ্টা বাজায়, স্কুলের ঘর ঝাড়ু দেয়, মাঠের একধারে মা ও ছেলে ছাপরা তুলে থাকে, যে-ছাপরা তোলার জন্যে ভাড়া দিতে হয় না কাউকে।

ভাবতে গিয়ে বাইরে থেকে ফুলের সুবাস যেন ছুটে এলো ঘরে। খোলা জানালা দিয়ে আকাশের পূর্ণিমার চাঁদ ফকফকা করে তুলল ঘর। মক্তবের মৌলবি আহসানউল্লাহ হুজুরের কথা মনে পড়ল, এ দুনিয়ার কোনো কিছু তাঁর এক্তিয়ারের বাইরে নেই রে, মইনুল। জীবনের সুখ-দুঃখ, ব্যাধি-ব্যারাম, আরাম-আয়েশ সবই তাঁর হুকুমে চলে।

খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল মইনুল। চোখের সামনে তার অবারিত মাঠ, গাছপালা, পাখির ডাক, সকালবেলা স্কুলের ছেলেমেয়েদের কলকাকলি – সত্যি তো মইনুল আর তার মায়ের কিসের অভাব?

মইনুল মায়ের কথা শুনে ভেবে নিয়ে বলল, তা’লি এইভাবেই থাকুক। তবে আমার মনে কয় এইগুলোন দামি, খুবই দামি। আমি মূর্খ মানুষ, বুঝতি পারতিছিনে। এই প্রথম যেন নিজের শিক্ষার ঘাটতি নিয়ে আক্ষেপ করল মইনুল শেখ।

তিন
মক্তবে পড়ার সময় মইনুলের মনে আছে, সেকেন্ড হুজুর খুব সুন্দর করে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। একদিন মাঠের মাঝখানে হুজুর যখন আপনমনে কোরআন তেলাওয়াত করছেন, তখন বাচ্চা মইনুল তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে হুজুর বললেন, আল্লাহর দেয়া কোরআনের ভিতরেই সব জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁইজে পাবা, বুঝলে মিয়া?
জিজ্ঞাসা কী? অবাক হয়ে বলেছিল মইনুল।
আরে বেতমিজ, জিজ্ঞাসা মানে জানো না? সওয়াল, সওয়াল।
কিন্তু সওয়াল কাকে বলে তা-ও সে জানত না তখন। তার কাছে কোরআন শরিফ ছিল একটা সুর মাত্র। সুললিত কণ্ঠের সুর। আর ওই মহান গ্রন্থও তার জীবনে পড়া হয়ে ওঠেনি। কোনো অর্বাচীন জিজ্ঞাসাও তার মনকে পীড়িত করেনি কোনোদিন। হাতের লেখা শিখতে না শিখতে সে ত্যাগ করেছে মক্তব। এরপর রাস্তায় ডাংগুলি খেলে বেড়িয়েছে। মানুষের খেতে রবিশস্য বুনতে সাহায্য করেছে, গঞ্জে মহাজনের গদিতে চালের বস্তা টেনে নিয়ে যেতে শিখেছে, তারপর বড় হয়ে সে কামলা হয়েছে। পরিশ্রমে সে ভয় পায় না; বরং পরিশ্রমের পর যে-অর্থ তার হাতে আসে, তা-ই নিয়ে পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে সে কাটিয়ে দেয় জীবন। একরকমের বিলাসিতার জীবন, বিড়ি থেকে সিগারেটে উত্তরণ।

কিন্তু এখন রাত যখন গভীর, মা খাটের নিচে পাটি পেতে ঘুমিয়ে আছে, আর খাটে শুয়ে মইনুল একটার পর একটা খেয়ে চলেছে সিগারেট। তখন তার মনে অসংখ্য সব সওয়ালের সৃষ্টি হচ্ছে। কোরআনও সে ভালো করে পড়তে শেখেনি, যদি পারতও তবে তার অর্থ বুঝতে পারত কি না সন্দেহ। কিন্তু এখন তার মনের ভেতরে কিছু জটিল ও কুটিল সওয়ালের সৃষ্টি হচ্ছে। আর এসবের খুব লম্বা লম্বা যে উত্তর আছে তা-ও সে বুঝতে পারছে। তার প্রথম সওয়াল, দুনিয়াতে এত মানুষ থাকতে তার কোদালের আঘাতে অদ্ভুত সেই বাক্সটা ঠং করে উঠল কেন? দ্বিতীয় সওয়াল, বাক্সর ঢাকনি খুলে গোল গোল চাকতিগুলো দেখে তার মনে ভয় ধরে গেল কেন? কেন তার মনে হলো, এই জিনিস তার হাতে এসে পড়ল কীভাবে, যদি না এর পেছনে কোনো বিশাল শক্তির ইঙ্গিত বা ইশারা থাকে?

ঘুমিয়ে থাকা মইনুলের পক্ষে এখন কঠিন। ভীষণ কঠিন একটা কাজ হয়ে গেল এখন। সে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে লাগল। অথচ তার বুড়ি মা সেই কখন থেকে গভীর নিদ্রায় বিভোর। তার নিশ্বাসের ওঠানামা মইনুলের কানে এসে লাগছে। এত শান্তি মায়ের মনে আসে কোত্থেকে? ভেবে পেল না মইনুল। ভাবতে ভাবতে সে উঠে বসল চৌকির ওপর। টিপিটিপি পায়ে নিচে নামল। ঘরের পশ্চিম কোণে গিয়ে উবু হয়ে মাটিতে বসল। ঘুমোবার আগে জানালায় পর্দা টেনে দিয়েছে। সেই পর্দা সরিয়ে সে ঘরে চাঁদের আলো নিয়ে এলো। তারপর দুহাতে মাটি খুঁড়ে বের করে আনলো বাক্সটা। ডালা খুলে চোখ নিচু করে তাকিয়ে দেখতে লাগল ভেতরে। তার বুকের ভেতরে এখন ঝাউপাতার গোঁ-গোঁ শব্দ। এ কিসের শব্দ? এরকম কোনো শব্দ তো মইনুলের বুকের ভেতরে এতদিন ছিল না? হাত মুঠি করে মইনুল ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে।

এখন রাত গভীর। গভীর এবং মইনুলের চোখে অচেনা। এখন মইনুলের চারদিকে অবারিত আলোর জোছনা। মইনুল এখন স্কুলের মাঠের ভেতরে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। তার পায়ে পায়ে মাঠের আগাছারা ঘুরছে। বড়চুচা, উলু, কুনিঘাস, আংটা, আঙুলিঘাস ঘুরছে। মইনুলের খালি পায়ে এরা মাঝেমধ্যেই জড়িয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে মইনুল তাকিয়ে দেখছে আকাশ, তাকিয়ে দেখছে নীল আকাশের গায়ে ক্ষীর হয়ে জমে থাকা জোছনা, আবার চোখ নামিয়ে নিজের হাতের মুঠি খুলে দেখছে। সেখানে মুদ্রার মতো গোল একটি চাকতি। কিন্তু এটি এখন শুধু একটি চাকতি নয়, সেখানে একখন্ড ঝলকিত হীরক যেন তার দ্যুতি ঢেলে দিয়েছে।

ভয় পেয়ে হাত আবার মুঠি করে ফেলছে মইনুল। এ তার কিসের প্রাপ্তি? এ প্রাপ্তির জন্যে কি যোগ্য আছে মইনুল শেখ? কিন্তু তার বদ্ধ হাতের মুঠির ভেতর থেকেও জ্যোতির্ময় কিছু গলে যেন বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। মূর্খ মইনুল কতক্ষণ একে ধরে রাখবে। তার হাতের পাঁচটি আঙুল তো এত শক্তিশালী নয়।

ঘোরলাগা মানুষের মতো মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরতে লাগল মইনুল। তার পুরো শরীর এখন জ্যোতির্ময়। সে এখন আর এ-পৃথিবীর ধূলিকণা নয়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত