মেঘের গায়ে গভীর কালো, রাগী বুনো মোষ ভীরু শুয়োরের মতো ঝোপ খুঁজে মাথা নামায়। কালো জমছে মেঘের শরীরে, কয়লা খনির অন্ধকার তার কাছে ফিকে। ছুটে আসছে আকাশ গিলে, গিলতে গিলতে, হিরে জ্বলল। সেই হিরে কালো চিরে ছুটল এদিক-ওদিক। পাখিরা দিশেহারা হয়ে নেমে পড়েছে ঘাসে ঘাসে, নীড় খোঁজার সময় নেই আর। ফড়িংগুলো বোকার মতো উড়ছিল এতক্ষণ, কাঁপন লাগল তাদের ডানায়, ঝটপট নেমে পড়ল ঘাসে ঘাসে। পাখিদের মুখের কাছে। আশ্চর্য, পাখিরা হাঁমুখ নামাল না। মাথার ওপর হিরে-জ্বলা গভীর কালো তখন তাদের শরীরকে সিক্ত করতে শুরু করেছে। আত্মরক্ষার তাগিদ আহার গ্রহণ করার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি।
তারপরেই গাছেরা বেয়াড়া হলো। তাদের ঝুঁটি ধরে প্রবল হচ্ছে ঝড়ো বাতাস।
তারা মদৎ পাচ্ছে মেঘেদের কাছ থেকে। যে-গাছ দুর্বল হলো সে সশব্দে ধরায় ধরা দিলো।
এই ভয়ংকর সুন্দর পৃথিবীতে উঠে এলো যে তার দুটো হাত দুদিকে বাড়ানো, পাখি যেভাবে ডানা ছড়ায়। মেঘ ঝাঁপিয়ে পড়ল তারও শরীরে, জল তার সর্বাঙ্গ ধুইয়ে দিলো।
তারপর সেই মেঘ, সেই বাতাস যখন অন্য মেরুতে হানা দিতে চলে গেল তখন চাঁদ উঠল। ভেজা পৃথিবীতে জ্যোৎস্না সাঁতার দিতে লাগল অবলীলায়। পাখিরা ফিরে গেল রাতনীড়ে। লোকটি পকেট থেকে হুইস্ল বের করে তীব্র শব্দ ছড়াতেই নড়েচড়ে উঠল জ্যোৎস্নায় বুনো ঝোপ। এতক্ষণ যারা মাটিতে মুখ গুঁজে শবের মতো পড়েছিল তারাই পায়ে দ্রুততার শক্তি পেয়ে গেল। ডজনখানেক বুনো সারমেয় লোকটির সামনে পৌঁছে দাঁত দেখালো, গলার শব্দে অনেক জিজ্ঞাসা। লোকটি গুনল, এক দুই তিন, বাহ্, বারোটাই ঠিকঠাক।
ঠিক তখনই বুনো মোষ তার স্বভাবে ফিরতে চাইল। শিং নেড়ে ঝোপ সরিয়ে ভারিক্কি চালে জ্যোৎস্না মাখতে বেরিয়ে এলো খোলা জমিতে। তৎক্ষণাৎ সজাগ হলো সারমেয়রা। বিদ্যুতের ছোঁয়া লাগল তাদের শরীরে। দুজন নিহত হলেও বাকি দশজনে বুনো মোষকে নিথর করতে অক্ষমতা দেখাল না। কাজ শেষ হতেই ওরা লোকটিকে এগিয়ে আসতে দেখে সরে দাঁড়াল দর্শকের চেহারায়। লোকটির হাতের ছুরিতে তখন জ্যোৎস্নার ঝলসানি। দ্রুত হাতে সবচেয়ে নরম মাংস কেটে নিল বুনো মোষের শরীর থেকে। বেশ ভার সেই মাংসের। লোকটি পিছু ফিরতেই সারমেয়রা ঝাঁপিয়ে পড়ল রাতের আহারের জন্যে।
লোকটি গম্ভীর পায়ে নেমে গেল মাটির গভীরে। সরু পথ, পায়ে পায়ে সতর্কতা সাজানো রয়েছে সেই সুড়ঙ্গে। যেকোনো মুহূর্তে সুড়ঙ্গপথ বন্ধ করে অনাহূতের আগমন থামিয়ে দেওয়া সম্ভব। একটা থেকে একাধিক সুড়ঙ্গ যা ঘরের মতো ঘর দিয়ে চলে গিয়ে ঘুলঘুলাইয়ার আদল নিয়েছে তা সাবলীলভাবে অতিক্রম করল লোকটি। আর সেই সময় আগলগুলো বন্ধ করে করে গিয়েছে দক্ষ হাতে।
একটি সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আকাশ, নিচে অতলান্ত খাদ। ওপর থেকে যে ঝরনা তিরতিরিয়ে ঝরত আজ মেঘের আশীর্বাদে তা প্রবল। শেষ মুখেই রন্ধনের সরঞ্জাম। লোকটি বুনো মোষের শরীরের নরম অংশকে টুকরো টুকরো করে কাঠের আগুনে জলপাত্র চড়িয়ে একটু অপেক্ষা করল। বাষ্প ঊর্ধ্বমুখী হলে মাংসের টুকরোগুলো তপ্ত জলে ভাসিয়ে দিয়ে উঠে গেল পাশের সুড়ঙ্গে। সেখানে দুটো হাঁটু বুকে চেপে শুয়ে আছেন যিনি তাঁর মুখে প্রাগৈতিহাসিক দাড়ি, যা অযত্নে জটিল। মানুষটি যৌবনের শেষ ধাপে অথচ শরীর সেই বার্তা বহন করছে না। তার দুটো পায়ে যে লোহার শেকল জড়ানো, তার প্রান্ত একটি আংটায় বাঁধা।
লোকটি এসে তার পাশে বসল। হেসে বলল, ‘আজ আপনাকে মাংস খাওয়াবো।’ মানুষটির কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না।
লোকটি বলল, ‘কদিন থেকে সেদ্ধ শাক খাচ্ছিলেন, আমারই ভালো লাগছিল না। আজ একটা বুনো মোষ মারল আমার কুকুরগুলো। খুব ভালো শিকারি ওরা। আপনি খাবেন বলে আমি মোষটার শরীরের সবচেয়ে নরম মাংস কেটে এনেছি। বুঝলেন?’
মানুষটি এবার চোখ খুললেন, ‘আমার জন্যে আপনাকে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে।’
‘হে হে। এ কী বলছেন। আমি তো শুধু কর্তব্য করছি। এই যে মাটির নিচে আমি আছি, যার খবর পৃথিবীর কোনো মানুষ জানে না, এখানে তো একা থাকতে সবসময় ভালো লাগে না। তাই ওরা যখন আপনার মতো মানুষদের ধরার পর রাখার জায়গা পায় না তখন আমার কাছে সাহায্য চায়। চাইলে কেন দেব না বলুন! এক নম্বর, আমি কথা বলার সঙ্গী পেয়ে যাই। দুই, ওরা আপনাদের থাকা-খাওয়ার জন্যে ভালো টাকা দেয়। তাই আমার একটুও কষ্ট হয় না।’
‘এই জায়গাটা কোথায়?’ মানুষটি উঠে বসলেন।
‘অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছেন। জানেন, উত্তর আপনাকে তখনই দেব যখন বুঝব আপনাকে আর ফিরিয়ে দিতে হবে না।’ লোকটি হাসল।
‘এই সুড়ঙ্গ, মাটির নিচে এই ঘর কে করল?’
‘আমার ঠাকুরদা। তিনি ভেবেছিলেন পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাবে আণবিক বোমায়। মাটির ওপরে কোনো প্রাণ থাকবে না। কিন্তু মাটির নিচে দিব্যি থাকা যাবে। আমরা অবশ্য এখানে থাকতাম না। বাবার আমলেও এখানে এক বছরের খাবার জমানো থাকতো। জল তো ঝরনা থেকেই পাওয়া যায়। সব ছেড়েছুড়ে, আমি এখানে চলে এলাম বছর ছয়েক আগে।’ লোকটা উঠে দাঁড়াল, ‘যাই, মাংসটা দেখে আসি।’
সে চোখের আড়ালে চলে গেলে মানুষটি তাঁর পা দেখলেন। শেকলের ঘষায় সেখানে ক্ষত হয়ে যাচ্ছে। শ্বাস ফেললেন তিনি।
লোকটি ফিরে এলো, ‘আপনাকে একটা খবর দিচ্ছি। আজ পৃথিবীতে তুমুল ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। উঃ, কী কালো মেঘ, ঝড়ো বাতাস, খুব আফসোস, আপনি সেসব দেখতে পেলেন না। অবশ্য জীবনভর তো অনেক দেখেছেন। তবে, যাই বলুন, হাজারবার দেখলেও দেখার সাধটা ফুরিয়ে যায় না। খিদে পেলে বলবেন। মাংস সেদ্ধ হয়ে গিয়েছে। ’
মানুষটি উঠলেন।
‘কী ব্যাপার? হালকা হতে চাইছেন নাকি?’ লোকটি জিজ্ঞাসা করলেন।
মানুষটি মাথা নাড়তেই লোকটি চেইনের প্রান্ত হুক থেকে খুলে নিল। তারপর রাখালের মতো মানুষ চরাতে গেল। সুড়ঙ্গের সেই প্রান্ত, যেখানে ঝরনার জল নেমে আসছে ওপর থেকে, পৌঁছে মানুষটি জলবিয়োগ যখন করছেন তখন চেনের প্রান্ত মুঠোয় ধরে থাকা লোকটা বলল, ‘আপনার আগে আরো কয়েকজনকে তো রাখলাম, তারা কাঁদতো কিন্তু কথা বলতো। আপনার মতো বোবা হয়ে থাকতো না কেউ। মাংস-টাংস খাওয়াচ্ছি, এবার দয়া করে মুখ খুলুন। না, না, অত ঝুঁকবেন না, খাদে পড়লে খুঁজে বের করার আগেই হায়েনাদের খাবার হয়ে যাবেন। আসুন।’ চেইন ধরে টানল লোকটা।
মানুষটিকে রান্নার জায়গায় নিয়ে এসে বসতে বলল লোকটা। তিনি বসলে একটা পাত্রে লবণে সেদ্ধ মাংসের কয়েকটা টুকরো তুলে এগিয়ে দিলো, ‘যা পারি তাই রাঁধি, তবে এই রান্না খেলে পেটের অসুখ হবে না।’
নিজে আর একটা প্লেটে মাংস নিয়ে পরম তৃপ্তিতে চিবুতে চিবুতে লোকটা বলল, ‘আঃ।’
মানুষটি বসেছিলেন। চুপচাপ।
‘কী হলো? হাত চালান!’ লোকটা মাংস গিলে ফেলে বলল।
‘আমি মোষের মাংস খাই না।’
‘কী করে বুঝলেন এটা মোষের মাংস?’
‘তুমিই বলেছ!’
‘অ। কেন?’
‘সত্যি কথা হলো, গত পাঁচ বছরে আমি কোনো পশুর মাংস খাইনি।’
‘খাবেন কী করে? সাধুদের আখড়ায় থাকতেন আর আদিবাসীদের ভদ্রলোক করার চেষ্টা করতেন। ভালো খাবার পাবেন কী করে?’ লোকটি খেয়ে যাচ্ছিল।
‘আমাকে তোমরা ছাড়ছ কবে?’
‘আরে! আমি জানব কী করে? যদ্দিন আপনি এখানে থাকবেন তদ্দিন আমার লাভ। দৈনিক আড়াইশো দেবে ওরা। কিছু অ্যাডভান্সও দিয়ে গেছে।’ লোকটা উদাস গলায় বলল, ‘নিশ্চয়ই মোটা টাকা চেয়েছে আপনার আশ্রমের কাছে। পেলেই ছেড়ে দেবে।’
‘আশ্রমের ক্ষমতা নেই টাকা দেওয়ার।’
‘দূর। আশ্রম দেবে কেন? নিশ্চয়ই কাগজে লেখা হয়ে গেছে, টিভিতে বলাবলি। সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। খোঁজাখুঁজি করে তো হদিস পায়নি আপনার। এবার সরকারই গোপনে টাকাটা দিয়ে দেবে ওদের।’ মাংস শেষ করে লোকটা বলল, ‘তাহলে আপনি খাবেন না? আজ রাত্রে তাহলে হরিমটর।’
মানুষটিকে লোকটি আবার আগের সুড়ঙ্গে নিয়ে এলো। আংটার মধ্যে চেইনের প্রান্ত ঢুকিয়ে তালা মেরে দিলো। তারপর বলর, ‘এই লোকগুলো অদ্ভুত। বুঝলেন! শুধু একটার পর একটা ব্যাটাছেলে ধরে আনছে। আমার কথা ভেবে একটা মেয়েমানুষ তো আনতে পারত। হে-হে-হে। এই পাহাড়ি জঙ্গলে হাজার খুঁজলেও একটা মেয়েমানুষ পাবেন না। কপাল!’ লোকটি ফিরে গেল কাজ সারতে।
মানুষটি বসলেন। পায়ের ক্ষত দেখলেন। তারপর পায়ের বেড়িটাকে গুহার মেঝের পাথরে ঘষতে লাগলেন। এই পনেরো দিনের পরিশ্রম একেবারে বৃথা যায়নি। কিন্তু ঘষার সময় ক্ষত আরো যন্ত্রণা তৈরি করছে। কিন্তু ঘষতে হচ্ছে প্রায় নিঃশব্দে। লোকটি যখন থাকে না সামনে তখনই হাত চালান তিনি।
শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লেন মানুষটি। ক্লান্তির ঘুমে জঠরও নিষ্ক্রিয় থাকে।
এখন শুকতারার চোখ জ্বলছে। আকাশ মায়াবী নীলে মাখামাখি। কিন্তু পূর্বদিক নয় মাসের গর্ভবতী রমণীর গালের মতো কমলা। বাতাস মৃদুমন্দ। ঈষৎ শীতল। দূরে শৃগালেরা শেষ কথা বলে নিচ্ছে এ-রাতের মতো। লোকটি বেরিয়ে এলো সুড়ঙ্গপথ দিয়ে। দিনরাতের এ-সময়টা তাকে খুব টানে। মশালের আলো-সওয়া চোখ আরাম খোঁজে বাইরে এসে।
তার পক্ষে আর বাইরে যাওয়া সহজ নয়। মেয়েটা তার কাছে প্রেম চেয়েছিল? কিন্তু শরীর ছাড়া কি প্রেম জমে? মেয়েটি বলেছিল শরীরের গলিঘুঁজিতে তার স্বামী এতো হেঁটেছে যে ভাবলেই শরীর শুকিয়ে যায়। তার চাই প্রেম। হৃদয়-টিদয় নিয়ে কেউ ওর জীবনে আসুক – এই আশায় বসেছিল, তাকে পেয়ে অাঁকড়ে ধরেছিল। ফ্যাসাদে পড়েছিল সে, কিন্তু মেয়েটির শরীর ছিল ঘাই হরিণীর মতো। তার টান যখন প্রবল হলো তখন দুরন্ত আপত্তি জানাল মেয়েটি। শেষ পর্যন্ত যখন চিৎকার করল প্রতিবাদে তখন আত্মরক্ষা করতে ওর মুখ বন্ধ করতেই হলো। প্রাণ না থাকলে শরীর আর শরীর থাকে না। লাশের কাছ থেকে পালিয়েছিল সে। পালাতে পালাতে মনে পড়ল পিতামহের তৈরি সুড়ঙ্গের কথা। দিব্যি আছে এখানে।
শেষ পর্যন্ত খুলে গেল বাঁধন। লোহার শেকলটাকে পা থেকে সরিয়ে উঠে দাঁড়াতেই মনে হলো পালাতে হবে। খুঁড়িয়ে হেঁটে পাশের সুড়ঙ্গে পড়ে থাকা কাঠের আগুন খোঁচানোর লোহার রড তুলে নিয়ে হাঁটতে লাগলেন মানুষটা। অনেকক্ষণ সেই পাতলা অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে যখন বাইরে বেরোনোর হদিস পাচ্ছেন না তখন শরীর আর বইছিল না। হঠাৎ কানে হুইস্লের শব্দ বাজল। শব্দটা অনুসরণ করে করে আকাশ দেখতে পেলেন তিনি। তারপরেই লোকটাকে। তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে হুইস্ল বাজাচ্ছে। খানিকটা দূরের ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসছে একট দুটো-দশটা সারমেয়।
লোকটার শরীরের শক্তি তাঁর চেয়ে অনেক বেশি। আত্মরক্ষা করা অসম্ভব জেনে আক্রমণ করতে চাইলেন তিনি। শেষ শক্তি একত্রিত করে লোহার রড লোকটির মাথায় নামিয়ে দিতেই দেখলেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল শরীর। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। কোনোদিন সুযোগের সঠিক ব্যবহার করেননি মানুষটি, আজ করলেন। যতটা সম্ভব দ্রুত হাঁটতে চেষ্টা করে সম্মিলিত গর্জন কানে আসতেই পেছনে ফিরে তাকালেন। লোকটিকে এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না। তার শরীর ছিঁড়ছে দশটি সারমেয়। পশু অথবা মানুষের রক্ত যাদের উন্মাদ করে তোলে।
তবু খারাপ লাগল মানুষটির। লোহার রড উঁচিয়ে ফিরে এলেন তিনি। তাঁর মুখের শব্দাবলি, আক্রমণের ভঙ্গি দেখে সারমেয়রা ভয় পেল। দ্রুত চোখের আড়ালে চলে গেল তারা। ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত লোকটির শরীর আগলে বসেছিলেন তিনি।
পৃথিবীর সমস্ত ঘাতকের শবেরও তো শেষকৃত্য হয়ে থাকে!