আয়েশার নামটা কবে যেন মেঘলা হয়ে গিয়েছিল। শাদির পরে পরেই কি! সেই সোহাগের রাতে চিরাগের আলোতে মুখটা দেখে সিরাজ বলেছিল, তোমার মুখে যে বর্ষণের আগের ধারা দেখি বিবি। তোমারে কী তয় মেঘলা বইলাই ডাকি না ক্যান? মরণ, যেন নতুন বিবি পেয়েছ। রীতিমতো ফুঁসে ওঠে আয়েশা। সাত বছর প্রেম করার পর এই তোমার রোমান্টিক ভাষা! কেন, কলকাতার ভাষায় প্রেম হয় না? সিরাজ ভেলভেটের পাশবালিশটা নিজের কব্জায় আনতে আনতে বলেছিল, ওয়াপস, আ মরি বাংলা ভাষা। আ মরি বাঙ্গাল ভাষা তো কেউ কয় নাই। তা হলেও মাটির গন্ধ – সে কি তুমি অস্বীকার করতে পারো? কেমন মনে হয় না, খড়ের চালের নিচে মাটির দাওয়ায় বসে মিয়া-বিবি, প্রেম-দরিয়ায় হাবুডুবু।হলাম না হয় মেঘ, তুমি তাহলে আকাশ। আয়েশার মুখের ঘোর কেটে এখন লালচে একটা আভা ফুটে উঠছে। আরে, তুমি কি গিরগিটি? সিরাজ পাশবালিশ ছেড়ে মাথার বালিশে মাথা দিয়ে এলিয়ে পড়েছে।
ছিঃ, কী বলছ তুমি? আমি গিরগিটি?
তা নয়তো কী। কথায় কথায় মুখের রং বদল করে ফেললে। তুমি তো বহুরূপী। কৃষ্ণবরণ থেকে লোহিত। আহা, কী রঙের খেলা!
আয়েশা ঠিক উলটোদিকে বালিশটা গুছিয়ে নিয়ে শুতে শুতে বলল, বি পোয়েটিক সিরাজ। পুবের কালো ঘুচেই রক্তিম আলো ছড়িয়ে পড়ে। সিরাজ ধড়মড় করে উঠে বলল, অবজেকশন ইয়োর অনার। নো সিরাজ, আই অ্যাম আকাশ। আয়েশাও উঠে পড়েছে, অ্যান্ড আই অ্যাম মেঘ। এবার দুজনেই হেসে উঠেছিল।
আকাশ বলল, চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, মেঘ। লক্ষ্মীটি, একটু গরম করে দাও না। রান্নাঘর থেকে গরম জবাব এলো, আহ্, বিরক্ত করো না, এখন সময় হবে না। আকাশ চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল, হয়ে গেছে।
কী?
গরম চা। তোমার কথার অাঁচেই আমার চা গরম হয়ে গেছে। একটু পরেই গরম এক কাপ ধূমায়িত চা নিয়ে হাজির মেঘ। খবরের কাগজের শেষ পাতায় খেলার খবর পড়তে পড়তে আকাশ বলল, সময় তাহলে হলো।
মেঘ ঝাঁজিয়ে উঠল, তার মানে! আমি কি…!
আহা, গোসা করো না বিবি। সময় তো হওয়ার জন্যই। সময় তো করা যায় না, সে তো কেবল হয় আর হয়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আহা তোফা হয়েছে – বলে মেঘের দিকে চাইল আকাশ। মেঘ হঠাৎ কপাল চাপড়ে করুণ স্বরে ইনিয়ে-বিনিয়ে উঠল, হায় হায়, কী হবে গো। আমরা না খেয়ে মারা যাব গো।
মানে! এর মানে কী?
মানে বোঝো না? তোমার কলেজ কটায় শুরু? ছাত্র আর বিশেষ করে ছাত্রীরা যে তোমার অপেক্ষায় পল গুনছে – সে-খেয়াল আছে তোমার? তা ছাড়া আমাকেও তো স্কুলে যেতে হবে। খাতায় একবার ঢ্যাঁড়া পড়ে গেলে চাকরি আর থাকবে? শরীরে মাটির গন্ধ মেখে এইমাত্র যেন মেঘ উঠে এলো। চোখে তার সুরমা। পট্টাবাসে গোধূলির রং। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা…। আকাশের গলায় মডিলিউশন।মেঘলা যেন অনেক দূর হাতড়ে হাতড়ে মুঠোয় ধরা ঝিনুক তুলে বলল, এই শহরে আববাজানের আসার কথা মনে আছে? সেই ঈদের সকালে এন্টালির পিরবাবার দরগায় হাজির। কইতে পারেন, আমার মাইয়া আয়েশার বাড়ি কোনখানে? হাঁটুর ওপর লুঙ্গিখানা গুছাইয়া আববাজান এরে-ওরে শোধান। বেবাক চাইয়া থাকে মানুষগুলো। রাজাবাজার থেকে এন্টালি, হাজারজন আয়েশা আছে। কাকে খুঁজছেন? বাড়ির নম্বর কত?
ছিল গো। একখান চিরকুটে সব ল্যাখা ছিল। আইতে আইতে হারাইয়া গেল যে। এই শহরে চিরকুট হারালে যে মানুষও হারিয়ে যায়, সে-খবর আববাজানের জানা ছিল না। পায়ে ধুলো হাঁটু অবধি, ক্যাম্বিসের জুতোর সামনেটা ফাঁকা। গায়ে একটা জোববা। যেন সেই পাগলটার মতো পরশপাথর খুঁজছে। শহরে এত এত লোক, তার মধ্যে…! আর ঠিক সেই সময় তুমি হাজির। গিয়েছিলে এন্টালি মার্কেটে বাজার করতে। পিরবাবার দরগার কাছে কিছু মানুষের ভিড় দেখে কৌতূহলী হয়ে তুমি কাছে যেতেই…!
আকাশ যেন খেই ধরল। তোমার আববাজানের সেই ‘ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে’ গোছের চাহনির সামনে দাঁড়িয়ে আমি বলে উঠেছিলাম, আইছি আববাজান। আমিই ধরেন ক্যানে আপনার চিরকুটখান।
কও কি! আয়েশা কনে? আববাজানের চোখেমুখে স্বস্তি। আমি বলেছিলাম, আয়েন আববাজান, আয়েশা ঘরেই আছে।
মেঘলা যেন স্মৃতির সুতো বুনতে বুনতে বলল, অথচ এই আববাজান শাদির আগে ফরমান জারি করেছিলেন, হবে না। বাউন্ডুলে, বাপ নাই, মা নাই, অমন মানুষের লগে আমার কন্যার শাদি হইব না। চাল নাই, চুলা নাই। আজ ঢাকা তো কাল কলকেতা। অরে করুম জামাই! ভাবো কেমনে! আম্মার ছবির সামনে দাঁড়িয়েই আববাজান কথাগুলো বলেছিলেন। আম্মার মুখে বোধহয় কোনো অদৃশ্য হাসি ছিল। আববাজান হয়তো তা দ্যাখেন নাই।
আকাশ ঠান্ডা গলায় বলল, সেই তো হইল। তোমার লগেই শাদি হইল। কারো অঙ্গুলির ওঠানামায় সংসার থাইম্যা থাকে না। এক লগে এক কাপড়ে তুমি-আমি নামছিলাম হাওড়া রেলস্টেশনে। কে যেন কইছিল আববাজানরে, উয়ারা পলাইয়া কলকেতায় আছে। এই লও হদিস।
কাজটা বোধহয় বসির মিয়ার। ঢাকা থেকে কলকাতায় সে প্রায়ই আসত। কী সব যেন ব্যবসা করত।
সেই প্রথম আববাজানের কলকাতা দেখা। আর যেদিন আববাজান ঢাকায় ফিরে যাবেন বলে সকাল থেকে এন্টালির বাসায় সাজসাজ রব, সেদিন আকাশ হঠাৎই বলেছিল, এই শহরে কিছু দ্যাখলেন, আববাজান?
আববাজান হাসলেন। তারপর গভীর দৃষ্টিতে আকাশকে দেখে নিয়ে বললেন, তোমাগো ভালো বাসাখান দেইখ্যা গেলাম।
ভালোবাসা না ছাই। এমন খারাপ বাসায় থাকা যায়! কথাটা বিমলেন্দুদাও বলেছিল। একটা বেটার কিছু দ্যাখ। বিমলেন্দুদাই একরকম জোর করে নিয়ে গিয়েছিল ভবানীপুরে একটা ঘর দেখাতে। গৃহকর্তা কিছু একটা বুঝে বললেন, বেশ বেশ, আপনি তো বামুন। বিমলেন্দুদা বিনয়ের সঙ্গে মাথা নিচু করে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
আপনি আর আপনার ওয়াইফ। তাই তো? না না, আমার এই বন্ধু কাম ভাই আর তার ওয়াইফ।
ওনার নামটা কী?
সিরাজুল হক।
ভদ্রলোক যেন হঠাৎ সাপের মাথায় পা দিয়ে ফেলেছেন এমনভাবে অাঁতকে উঠে বললেন, সে কি! আমাদের বাড়িতে ঠাকুরের ভোগ হয়?
বিমলেন্দুদা তাড়াতাড়ি বলেছিল, সে তো আমার এই বোনটিও। ঠাকুরে ওর দারুণ বিশ্বাস। ভদ্রলোক প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, ওদের ঠাকুর মানে?
বিমলেন্দুদা সহজ গলায় বলেছিল, ঠাকুর মানে ঠাকুর। ভগবান।
ভদ্রলোক এবার প্রায় গর্জে উঠলেন, ওদের আবার ভগবান কি! ওদের তো আল্লা-খোদা আরো কী সব। বিমলেন্দুদা প্রত্যুত্তরে কিছু বলার আগেই আকাশ দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আর দাঁড়ায়নি।
হবে না বিমলেন্দুদা। এখনো আমরা সেই প্রিমিটিভ যুগেই আছি। আমাদের ঠাকুর আর তোমাদের ঠাকুর আলাদা।
বিমলেন্দুদার কপালে চিন্তার ভাঁজ। হঠাৎ যেন সমাধান পেয়েছে এমনভাবে একটু হেসে বলল, চল, আমার বাড়ির দোতলাতেই থাকবি। ওপরটা তো ফাঁকাই আছে। মা মারা যাওয়ার পর বাবাকে নিয়ে আমি তো নিচের তলাতেই থাকি। বিয়ে-থা করিনি, বুঝতেই তো পারিস। একা একা কেমন বোকা বোকা লাগে। তোরা এলে বেশ জমিয়ে থাকা যাবে।
আকাশ তাড়াতাড়ি বলেছিল, সে কি! তোমরা তো চাটুজ্যে বামুন। আমাদের মতো ম্লেচ্ছকে মেনে নেবেন কেন তোমার বাবা – আই মিন মেসোমশাই।
নাহ্, কোনো বাধাই আসেনি। মেসোমশাই শুধু বলেছিলেন, জাতের নামে বজ্জাতি – সে তো অনেক হলো। এখন বরং এসো হে, মিলেমিশে থকি কটা দিন। সেই থেকে মিলেমিশেই থাকা।
তারপর এক ভরা শ্রাবণে বৃষ্টির রাতে দরজায় শব্দ শুনে বিমলেন্দুদা বাইরে এসে শুধিয়েছিল, কী হয়েছে? বাইরে অঝোরে বৃষ্টি। আকাশের গলায় কাতর স্বর, মেঘের…!
কী হয়েছে মেঘলার? তারপর নিজেই বুঝে নিয়ে বিমলেন্দুদা বলল, ও বুঝেছি। চল, একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সেই বৃষ্টির রাতে…!
মেঘলার চোখে এখন দুষ্টুমির হাসি, ওহ্, কী ঘাবড়ান না ঘাবড়ে গিয়েছিলে। সে-ই তো বৃষ্টি হলো। লেবার রুমের বাইরে বেঞ্চিতে বসে রাত জেগেছিলে তোমরা। ভোরের একটু আগে, সবে বিহান ফুটেছে, নার্স বাইরে এসে বলেছিল, মেয়ে হয়েছে।
আকাশ বলল, কেউ যেন উলুধ্বনি দিয়ে উঠল, শাঁখে ফুঁ পড়ল। অবশ্য সবটাই আমার মনের ভেতর। বিমলেন্দুদা বেশ মজা করে বলেছিল, ঠাকুরকে থ্যাংকস দে। আমি বললাম, কোন ঠাকুর? বিমলেন্দুদা আমার থুতনিটা আলতো নেড়ে দিয়ে বলেছিল, ঠাকুরেরও জাত! তোর কী হবে র্যা ! হয় জাহান্নামে
যাবি, নয় নরকে যাবি।
মেঘলা গম্ভীর হয়ে বলল, শেষ পর্যন্ত কোনটায় গেলে? আই মিন নরকে, না জাহান্নামে? আকাশ হা-হা করে উঠল, রোস রোস, আগে মেয়ের মুখ দেখি তো। বেহেশতের পর্দাখানা খুলি। এবার দুজনেই হেসে উঠল কোরাসে।
কী নাম দেবে মেয়ের? মুখ টিপে হাসছিল মেঘলা। আকাশ ছোট্ট শিশুর মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বলেছিল, বড় সহজ অঙ্ক হে। ঠিক যেন জিজ্ঞাসা করছ, দুই আর দুইয়ে কত হয়। মেঘলা হাসি ছড়িয়ে বলল, বৃষ্টি-ই তো হবে। এত বৃষ্টি! আকাশ ভেঙে মেঘ চিরে এত বৃষ্টি!
এখনো মাটিতে সোঁদা গন্ধ। শুকনো ধুলোর ওপর মোটা মোটা বৃষ্টির ফোঁটা। একটু আগে ঝড় উঠেছিল। দুই হাতে যেন সেই ঝড় সামাল দিতে দিতে মেঘলা বলেছিল, এত সহজে মেঘ উড়ে যাবে না, দেখে নিও। চারপাশ ধোঁয়া করে বৃষ্টি নামল। গ্রিলের ওপর ঝুঁকে আকাশ দেখছিল সেই বৃষ্টি। পাশে এসে দাঁড়াল মেঘলা, কী ভাবছো?
ভাবছি, মেঘমেদুর বরষায় কোথায় তুমি।
এই তো আমি। ছুঁয়ে দেখো। মেঘলা আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে কাছে সরে আসে।
তোমার শরীর ছুঁয়ে তো অনেক কাল গেল। এখন ছুঁতে চাই তোমাকে। তোমার ভেতরে নিভৃতে অনন্ত জেগে থাকা সেই তোমাকে।
বুঝেছি, তোমার অন্ত হয়েছে।
মানে?
বেদান্ত। তৎ ত্বম অসি। এসব তত্ত্বকথা রাখো। বরং এসো আমরা বৃষ্টির ফোঁটা গুনি।
সে কেমন করে?
ঠিক যেমন করে বৃষ্টির ফোঁটা গোনা যায়।
এ বড় কঠিন কাজ। তার চেয়ে এসো বরং রবিঠাকুরের কথায় ফিরি – আকাশের গলায় সুর বাজে, আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে আমার মনে।/ আমার ভাবনা যত উতল হলো অকারণে।
মেঘলা অমনি বলে উঠল, অকারণে নয় হে। লড়াইটা বেধেছিল হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে। লড়াইটা উসকে দিয়েছিল লেড়ে আর নেড়ে। দাঙ্গা। শহরের রূপ বদলে গেছে। ঢাকায় আল্লাহু আকবর আর কলকাতায় হর হর বোম বোম জয় কালী। মানুষ খুন হচ্ছে, জাত খুন হচ্ছে, একসময় একটা গোটা দেশ খুন হয়ে গেল। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ ঘটে গেল একসভা বয়োজ্যেষ্ঠ গুণীজনের সামনে।
সূর্য অস্ত যেতেই অন্ধকার হামলে পড়েছে সামনের রাস্তার ওপর। সেই অন্ধকারেই ছায়া ছায়া একদল লোক জড়ো হয়েছে দরজার সামনে। প্রথমে টের পেয়েছিল মেঘলা। দোতলা থেকে নেমে সোজা হাজির বিমলেন্দুদার ঘরে।
বিমলেন্দুদা তখন খবরের কাগজের হেডলাইন দেখছিল। মেঘলা চাপা গলায় বলল, দাদা, কারা যেন…!
বিমলেন্দুদা সন্ত্রস্ত গলায় বলল, আকাশ আর বৃষ্টি কোথায়?
ওদের বাইরে থেকে ছিটকিনি দিয়ে এসেছি।
বেশ করেছিস। তুই-ও ভেতরে যা। আমি দেখছি।
বাইরে বের হতেই লোকগুলো হইহই করে উঠল। শালা মোল্লা পুষছেন হিঁদুপাড়ায়?
বিমলেন্দুদা কিছু বলার আগেই অশীতিপর বৃদ্ধ মেসোমশাই একরকম বিমলেন্দুদাকে ঠেলে সামনে দাঁড়ালেন। তারপর প্রায় হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, আমার ছোট ছেলে তার বউ আর বাচ্চা।
ওদের কিছু করার আগে আমি এই পইতে ধরে দুয়োরে দাঁড়ালুম। পারো তো আমাকে…। বৃদ্ধ থরথর করে কাঁপছেন। কী জানি ব্রহ্মশাপের ভয়েই কি না লোকগুলো হটে গেল।
আকাশ কেমন উদাস গলায় বলল, মানুষের হৃদয় ভেঙে যারা দুটো দেশ গড়ল, তারা কি অহিংসার রাজনীতি করেছিল সেই সময়! কে জানে, তোমার আববাজান তো চিরকুট হারিয়ে একটা মানুষকে হারিয়ে ফেলেছিলেন, আর শুধু কটা মানুষের ক্ষমতালিপ্সায় একটা গোটা দেশ যে হারিয়ে গেল – তার বেলা! স্বাধীনতার যুদ্ধটা ছিল একসঙ্গে একটা পতাকা নিয়ে, অথচ স্বাধীনতা পাওয়ার পর পতাকা উড়ল দুটো দেশের দুই রকম। দেশ মানে তো শুধু মাটি নয়…!
মেঘলা জানে, আকাশ এখন নস্টালজিয়ার সাগরে কখনো ভাসছে, কখনো ডুবে যাচ্ছে। মেঘলা কেমন ঘনিষ্ঠ গলায় বলল, দেশটা যা-ই হোক, আমরা তো আছি। আকাশ মেঘলার দিকে চাইল।
মেঘলার চোখে কৌতুক, পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,/ মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব – তুমি আছ, আমি আছি \
স্বাধীনতার পরে পরেই একদিন ভোরবেলা বৃদ্ধ মানুষটি তখন মৃত্যুশয্যায়। মেঘলা নিচু গলায় বৃদ্ধের কানের কাছে প্রায় মুখটা নিয়ে বলেছিল, কেমন বোধ করছেন মেসোমশাই?
বৃদ্ধ চোখ না খুলে বিড়বিড় করলেন, দেখো তো বউমা, আমাদের বাড়ির ছাদে তেরঙ্গা উড়ছে কি না। কী জানি হঠাৎ যেন মনে হলো, এক অদৃশ্য শক্তিতে কেউ যেন ঠেলে দিলো মেঘলাকে।
দুদ্দাড় ছাদে উঠে দেখল, বাতাসে পতপত তেরঙ্গা উড়ছে। মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে আছে আকাশ আর বিমলেন্দুদা। আকাশ মুখ না ফিরিয়েই বলল, দেখো, কেমন উড়ছে! আমাদের দেশ। মুক্তপক্ষ বিহঙ্গ যেন।
নিচে ফিরে এসে মেঘলা দেখেছিল, বৃদ্ধের চোখ দুটো তেমনি বোজা। মুখে তৃপ্তির হাসি। হিম শরীর। বিমলেন্দুদা আর আকাশ ঘরে ঢুকে অবাক চোখে তাকাল মেঘলার দিকে। মেঘলা ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ইশারায় বুঝিয়েছিল, উনি ঘুমোচ্ছেন।
সে ঘুম আর ভাঙেনি বৃদ্ধের। সে যেন অলীক মানুষ। মুক্তপক্ষ বিহঙ্গ যেন।
আবার কী চেপে বৃষ্টি এলো! মাঠঘাট ধোয়া হয়ে গেছে। অদূরে বাবলাগাছের কাঁটায় কি ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো! মাটির ঢিবির ওপর থেকে জল কেটে কেটে গড়িয়ে পড়ছে। আকাশের বুকের কাছে মেঘ সড়সড় সরে এসে বলল, একবার মনে আছে আকাশ, ঘাটশিলার ফুলডুংরিতে দাঁড়িয়ে…? সে কী কান্ড! মেঘলার চোখে বৃষ্টির হাসি, আমি বললাম, সাবধান আকাশ! পড়ে যাবে! পিছল মাটি। তুমি হাত দুটো মুঠো করে আমার দিকে ছুড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেছিলে, লুফে নাও মেঘ।
কী?
ভা-লো-বা-সা।
বৃষ্টি বোধহয় ধরল। সাময়িক বিরাম। একটু একটু করে মাঠঘাট, গাছ, অদূরে মসজিদ – সব হয়তো জেগে উঠছে। কিন্তু ঘন অন্ধকারে কিছুই ঠাওর হয় না। কিচ্ছু না।
এখনো তুমি অপেক্ষা করো মেঘ। আজ তো সেই দিন। ঘন শ্রাবণ। সেদিনও এ রকমই চারধারা অন্ধকার। পাথরে গড়িয়ে পড়তে পড়তে তুমি বলেছিলে, আমাকে ধরো আকাশ। গাড়ির জ্বলন্ত পিন্ডটা খাদে পড়ে তখনো ধোঁয়া উগরে যাচ্ছে। তারপর… নিঃসীম অন্ধকার। তারপর প্রতি বছর এই দিনটাতেই তো সে আসে। কত দশক ধরে শুধু অপেক্ষা!
মেঘলা হঠাৎ কেমন ঋজু গলায় বলল, শুনতে পাচ্ছ না?
কী?
পায়ের শব্দ।
কার?
ওই তো বৃষ্টি। আমাদের সন্তান। দেখো দেখো, ওর মাথার চুলে পাক ধরেছে। মুখের বলিরেখাগুলো হাতে ধরা মোমবাতির আলোতে তিরতির কাঁপছে। শ্লথ-পায়ে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে বৃষ্টি। আমাদের সন্তান। আয় মা আয়…।
আলোর বিন্দু একটু একটু করে যেন চারপাশ ছড়িয়ে যাচ্ছে। কাছের মসজিদ থেকে আজানের সুর, আল্লাহতায়ালা ইনশাআল্লাহ…।
অন্ধকার কবরের ভেতর কি মোমের আলো পৌঁছায়! কে জানে! আকাশ আর মেঘ অনন্ত জেগে থাকে সেই অন্ধকারে।