বউ হারালে বউ পাওয়া যায়, কিন্তু মা হারালে মা পাওয়া যায় না রে পাগলা’
-আরে চিরঞ্জিতের বিখ্যাত সে ডায়লক শুনিস নি রে তুই? এই বলে অনেক মজার কিছু বলে ফেললেন এই ধরনা করে উচ্চস্বরে হেসে উঠল মামা। আমি মোবাইলের স্কিন থেকে চোখ সরিয়ে মামার দিকে তাকালাম। এই কথাটা অনেক বার শুনলেও আমার কাছে সবচেয়ে নিম্ন মানের জগন্য কথা লাগে এইটা। মামা আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমার কোন উত্তরের আশায়।
– মামা, ধরো তিন্নির জামাই শিমুল কে নীলার বাবা এই কথাটা বলছে। তোমার কেমন লাগবে বলো তো? নীলা বউ হয়েছে বলে ভুলে যাও কেন ও কারো মেয়ে? তুমি আমায় নীলাকে ছেড়ে দিতে পরার্মশ দিচ্ছো? মামা আরো কিছু বলবে আমি জানি। কিন্তু আমি সে সুযোগ দিলাম না। উঠে গেলাম। বাসায় আজ থমথমে পরিবেশ। এমন পরিবেশ বেশ কিছু দিন ধরে হচ্ছে বাসায়। কিন্তু আজ ভয়াবহ রূপ নিলো।
আমি উকি মেরে দেখলাম। নীলা রান্না ঘরে আনমনে সবজির তরকারীটা নেড়ে যাচ্ছে। আমি গেলাম ও বুঝল কিন্তু ফিরে তাকাল না। শুভ্র গোলাপী গালটা তামাটে হয়ে গেছে। আর কেউ না বুঝুক আমি জানি শুকানো কান্নার দাগ এমন হয়। আমি মায়ের রুমের দিকে গেলাম। মা পা লম্বা করে খাটে হেলান দিয়ে মাথায় এক হাত দিয়ে শুয়ে আছে। আমি গেলাম বুঝতে পারলো কিন্তু কিছু বলল না। আমি চুপচাপ পকেটে হাত দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। অফিসের আকাশী কালার শার্ট আর এশ কালারের ফরমাল প্যান্টটা এখনো গায়ে৷ কিছু দূরে একটা পার্ক আছে৷ সেখানে বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস নেই তাও আজ নিলাম হাতে৷
আমি পলাশ। আমার কোন ভাই বোন নেই। আমি মায়ের অনেক আশার ফল। আমাকে হাই স্কুল পর্যন্ত মা স্কুলে দিয়ে আসতো। কোচিং গেলে দুই ঘন্টা বাইরে ফুতপাতে পেপার বিছিয়ে গরমে পাখা করে করে বসে থাকতো। আমি মানা করতাম। মা শুনতো না। কারণ বড় রাস্তা পাড় হতে হতো স্কুল কোচিং এ যেতে গেলে। যেখানে সারাক্ষন গাড়ি চলত। আমিও খুব মা ভক্ত ছেলে ছিলাম। পড়ালেখায় ভীষণ ভালো ছিলাম তেমনি শান্ত৷ তাই যখন কেউ আমার প্রশংসা করতো মায়ের চোখে মুখের যে হাসির আভা ছড়াতো তা যেন মায়ের নিজের প্রশংসার মতো৷ গর্বে মায়ের মাথা উচু হয়ে যেত। কলেজ ভার্সিটি শেষ করে ভালো কোম্পানিতে জবে ডুকলাম। এরপর শুরু হলো সবার নানা কথা৷ আমাকে এখনো কেন বিয়ে দিচ্ছে না মা? আচঁলে আর কত দিন? মা বলতো –
-আমার সোনার টুকরো ছেলের জন্য তেমন সোনার প্রতিমা মেয়েও লাগবে তো৷ আমার কোন পছন্দ ছিলো না৷ তাই মা তার পছন্দ মতো, সুন্দরী, শিক্ষিত, ভদ্র পরিবারের ভালো মেয়েটা বেছে নিয়ে এলো তার ছেলের জন্য। আমি বলেছিলাম – ছোট মেয়ে তো, মা বলেছিল – খারাপ কিসে মেয়ে? আমি যখন প্রথম দিন নীলাকে দেখেছিলাম। হলুদ জামায় শুভ্র চেহেরায় যেন এক শিউলি ফুল লেগেছিল। মায়ের পছন্দে চিরকালেই ভরসা কিন্তু এই যেন ভাগ্য আমার। যখন ওকে দেখলাম মনে হলো একে ছাড়া আর কেউ আমার জন্য জম্মই নেয় নি।
যখন ওর হাত আমার হাতে দেওয়া হলো বিয়ের আসরে তখন ভাবলাম ওর সব সুখের অনুভূতি গুলো এখন আমার দায়িত্ব। প্রথম রাতে যখন ওকে বুকে নিয়েছিলাম মনে হলো আমায় ভেদ করে কোন দুঃখ ওকে ছুতে পারবে না। প্রমিজ। কিন্তু সংসার চক্র বড় ভিন্ন। কোন প্রতিজ্ঞা আমি রাখতে পারি নি। সর্বগুন সম্পন্ন মেয়েটা, বউ হতে হতে অর্কমা আর তর্ক করা বেয়াদবে পরিণত হয়ে গেলো। প্রথম প্রথম কেউ কিছু বললে বুকে আছরে পড়ে কান্না করতো । আমি বুকে টেনে নিলেও কখনো জানতে চাইলাম না, কি হয়েছিল? কার দোষ? কখনো বলে দিই নি কি করলে আর শুনতে হবে না সে কথা। অফিস শেষে স্বাভাবিক ভাবে রুমে গিয়ে ফ্রেস হতাম। মায়ের ধারণা আগে আমি নীলার কথা শুনে আসি তাই মা যখন নীলার অর্কম্ম হওয়ার গল্প শোনায় আমি নির্বিকার থাকি।
আমার আর নীলার পরিবার একই লেভেলের হলেও আমাদের দুইজনের বেড়ে উঠা সম্পূর্ণ ভিন্ন। নীলার বাবার বদলীর চাকরী। তাই একা একা থাকতে হয়েছে ওনাকে অনেক বছর। নিজের কাজ আর ঘরের কাজ করার অভ্যাস ওনার। বিয়ের পর ওদের বাসায় যখন গিয়েছিলাম তখন দেখলাম নীলার বাবা বিকেল বেলা ছাদ থেকে সবার কাপড় এনে ভাজ করে রাখতো। এমনকি নীলার আর্ন্ডার গার্মেন্টস গুলোও। আমি দেখে লজ্জা পেয়েছিলাম। নীলা নির্বিকার ছিলো। কারণ ওদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। নীলার মা এককালে চাকরী করতেন। পরে ছেড়ে দিয়েছেন। নীলার মায়ের ধারনা গেস্ট আসলে ভালো করে দুই তিন পদের রান্না করলে সব টেস্ট করে, ভালো করে খেতে পারবে। কিন্তু আমাদের বাসায় গেস্ট এলে খাওয়া হোক না হোক টেবিল ভরে যেতে হবে নানা পদের বাটিতে। তাই রান্না করতেই যায় সারাদিন তার উপর খাওয়া শেষের ক্লান্তি। এই নিয়ে ও মায়ের সমস্যা। নীলাকে সুযোগ পেলে কথা শুনিয়ে দেয়। নীলার ভাই সৌরভ ও কাজ করে। সবার খাওয়া শেষে রাতের থালা বাসান হাড়ি ও পরিস্কার করে। আমি নীলাকে বলেছিলাম –
-তুমি বসে আছো আর সৌরভ এইসব করছে? নীলা স্বাভাবিক গলায় বলেছিলো- এইটা ওর ডিউটি। তাই নীলা একদিন চুলায় রান্না বসিয়ে স্নান করতে গেল। বাবা ওখানেই ছিলো। নীলা বাবাকে বলে গেল –
-বাবা আর দুই মিনিট পর চুলা টা অফ করে দিয়েন। বাবা হ্যাঁ না কোন উত্তর দিলো না। ইচ্ছে করেই চুলা অফ করল না কারণ এইটা বেয়াদপির সামিল। নীলা যখন পোড়া গন্ধ পেল দ্রুত এসে চুলা বন্ধ করল। বাবা তখন পিছন দিকে হাত দিয়ে উঠে চলে গেল। নীলার সে দৃষ্টি নিজেকে এই পরিবারের আপণ করতে না পারার চরম সাক্ষী ছিলো। তাই নীলাও কখনো কোন সুযোগ ছাড়তো না মা কে কথা শুনাতে। নীলার এক্সাম ছিলো তাই আমাকে ওর এপ্রোন আর দুইটা থ্রিপিচ আয়রনে দেওয়ার জন্য দিলো আমার শার্টের সাথে দোকানে দেওয়ার জন্য। আমি দরজায় গিয়ে আবার চেক করায় নীলার একটা আন্ডার গার্মেন্টস পেলাম। দরজা থেকে চিৎকার করে বললাম-
– কি রে তোমার এইটা সহ চলে এলো তো। নিয়ে যাও। নীলা হাতে কলম নিয়ে দ্রুত এসে আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে লুকিয়ে ফেলল উড়নার নিচে। আর কঠিন চোখে তাকাল আমার দিকে। আমি বুঝলাম না কেন, তখন মা সিরিয়েল দেখতে দেখতে নড়েচড়ে বসে বলল-
– বাসায় সব নিলর্জ্জ এনে তুলেছি। অন্যদের ও বানাচ্ছে।
বাবা পায়ের নক কি যেন করতে করতে একটা তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে সায় দিলো। নীলার চোখ রক্ত বর্ণ হয়ে গেল। আমি কিছু না বলে বেড়িয়ে এলাম। দোষটা আমার ছিলো। কিছু না বলে আমি তো রেখে আসতে পারতাম। কিন্তু আমি বুঝালাম নিজেকে দোষটা নীলার। ও কেন দেখে দিলো না। অফিসের পিকনিক। আমি মাকে বললাম -পরশু পিকনিক। সকাল ৯ টায় বের হবো। নীলার সেদিন সকালে উঠে সব নাস্তা দুপুরের ভাত রেডি করে স্নান করে নীল শাড়ি পড়ে ভেজা চুলে ছোট ক্লিপ লাগিয়ে কাজল পড়ে রেডি হয়ে নিলো। মাকে বললাম- আমরা বের হচ্ছি। মা বলল- যা না তো, পারমিশন তো নিচ্ছিস না বউ নিয়ে বের হচ্ছিস। জানাতে এসেছিস।
– ওমা এই আবার কেমন কথা? সেদিন তো বললাম। আর বিয়ের পর পিকনিকে বৌ সহ যাবে এইটা তো স্বাভাবিক।
-তো আমি মানা করছি না কি? যা তো, আমি রুমে এসে দেখলাম নীলার ভাজ ভাঙ্গা শাড়ি খাটের উপর। ক্লিপ খুলে গেছে ভেজা চুল লেপ্টে আছে কাজল ছড়িয়ে গেছে গালে।আমি বললাম- কিরে তুমি সব খুলে ফেললে কেন? দেরী হচ্ছে তো। নীলার চোখ আবার রক্ত বর্ণ। দাঁত খিঁচিয়ে বলল-
– সকাল থেকে যখন সব রেডি করে দিচ্ছিলাম তখন মুখে কুলু এটে ছিলো কেন? এখন মানা করছে? মা শুনে ফেলল- আমি মানা কখন করলাম? দুইজনের কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। আমি বিরক্তি হয়ে বললাম
– তোমাদের জন্য কোন কিছু শান্তি মতো করা যাই না। মা তোমার এখন এইটা বলার কি দরকার ছিলো? আর নীলা মা তো মানা করে নি তোমার এত রাগ করার কি আছে? দূর আর ভালো লাগে না। এই বলে অন্য রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। এক শুক্রবারে বাসায় ভালোমন্দ রান্না হলো। নীলার ভাই সৌরভ ও এসেছিলো। দুপুরে খাওয়া শেষে আমি তো রুমে ঘুমাতে গেলাম। নীলার ক্লান্ত লাগছিলো। তাই সৌরভ থাল ধুয়ে দিচ্ছিলো। এই দেখে মায়ের হুংকার।
-তুমি না পারলে আমায় বলতে, ভাই কি দিয়ে কাজ করিয়ে কি বুঝাতে চাও আমরা সব অর্কম্মা? সৌরভ বলে যাচ্ছে,
-মাসি দিদি বলে নি, ওর খারাপ লাগছে তাই আমিই করে দিচ্ছিলাম দিদিকে। এইটা কোন ব্যাপার না। মা আরো জোরে চিৎকার।
-খারাপ লাগছে তো আমায় বলতে পারতো। নীলা আবার চুপাচাপ এসে সব ধুতে লাগল। মা বলছে- সর, আমি ধুয়ে দিচ্ছি।
নীলা সরচ্ছে না৷ এইটা ওর বেয়াদপি মেনে নিলো মা। আমি একটু কান উচু করে শুনে আবার শুয়ে পড়লাম। দুপুরের ঘুম কে নষ্ট করে? আমার ছেলে হলো তুলতুল। তার নাম রাখা নিয়েও দুই পরিবারের মন কষাকষি। নীলাদের বাড়ি থেকে দেওয়া নাম গুলো অর্থ হীন আর মা বাবার দেওয়া নাম গুলো বড্ড সেকেলে। মূল ঘটনা হলো আজ দুপুরে। মামা এসেছিলো। নীলা কাজে ব্যস্ত। আমি অফিসে। বাচ্চা মা সামলাচ্ছে তাও ওকেও তো খাওয়াতে হচ্ছে। কাল ওর ঘুম হয় নি৷ আজ গেস্ট আসায় ভীষণ বিরক্ত নীলা। ভালো করে নমস্কার ও করল না মামাকে। একবার নাস্তা দিলো নীলা। রান্না করতে গেলো আবার৷ আবার চা-নাস্তা চাওয়াই তারাতারি প্লেট পরিস্কার করতে পাকা কলার খোসা গুলো সেখানের ফ্লোরে পড়ে রইলো। বাবা কিছুক্ষন পর ওখান দিয়ে যাওয়ার সময় তা দেখে বলল-
-কাজের কোন সুন্দর নেই। এইখানে খোসা ফেলেছে ইচ্ছে করে যাতে আমরা কেউ পড়ি। নীলার চুলায় মরিচের ঝাল উঠছিল। তা ফেলে এসে বাবাকে বলল-
– বাবা আপনি চাইলে তো নিজে নিয়ে একটু ফেলে দিতে পারতেন। এত কথার কি আছে? মামা বলে উঠল – বাড়ির ছেলেদের কাজ করাতে চাও? তার উপর শশুড়ের মুখে তর্ক করো? মা বলে উঠল – ওর মায়ের মতো উড়ে বেড়াতে চায় আর কি, জামাই আর ছেলেকে দিয়ে বাড়ির কাজ করায়। আমার ঘরে ওসব হবে না। নীলা আরো ফেঁপে উঠল।
– আমার মা বেড়ায় না। ঘরের ছেলেদের শুধু পুরুষ না বানিয়ে মানুষ বানায়। আপনার মতো না, হীনমনের মহিলা কোথেকার। এরপর কেউ কারো কথা ফেলতে দিচ্ছে না। সমান তালে তিন জনে কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছে নীলা। এক পর্যায়ে মা বলে-
– বের হয়ে যাও আমার ঘর থেকে।
– আমি নিজে থেকে আসি নি এই ঘরে, সমাজের পাঁচ
জন নিয়ে বিয়ে করে এসেছি। যেতে হলে পাঁচ জন ডেকে জামাই নিয়ে বের হবো। তখন আমাকে জরুরী তলব। আমি অফিসের কাজ ফেলে দিলাম দৌড়। আমাকে বলা হলো আমি কি চাই? মা নাকি বউ? বিকেল হয়ে আসছে। গাছের পাতা গুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নীলাও ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছে৷ এখন আমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। আমি হ্যাঁ বললে সাথে যেতে হবে, না বললে ও তুলতুলকে নিয়ে বের হয়ে যাবে। বসার রুমে সবাই আছে। মা খাটে বসে আছে৷ বাবা আর মামা সোফায়, নীলা রুমের পর্দার পাশে দাঁড়ানো। ওর চোখ মুখ নির্বিকার। আমি অপরাধীর ভঙ্গিতে সবার মাঝে দাঁড়ালাম। কেউ কোন কথা বলছে না। আমি একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলাম-
– মা, নীলা, তোমাদের দুইজনের থেকে কোন একজন কে বেছে নেওয়ার অধিকার আমার নেই, সে অধিকার আমি হারিয়ে ফেলেছি। কিভাবে তা বলছি। এখন সে অধিকার তোমাদের কে আমায় বেছে নিবে? তার আগে আমার কিছু কথা আছে। মা প্রথমে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তুমি ঘরে একটা মেয়ে চেয়েছিলে। কিন্তু তাকে ঘরের বউ থেকে মেয়ে বানিয়ে তোমায় দিতে পারলাম না।
আমি নীলাকে সাহায্য করে নি তোমায় বুঝার জন্য। আমি ওকে বলি নি, তুমি যখন বলো সন্ধ্যায় চুল খোলা রেখো না, তুমি ওকে খোটা নয়, তুমি ওকে শেখাচ্ছো। আমি ওকে বুঝায় নি, মা তুমি চেষ্টা করেছিলে কিন্তু বাবা কোন কাজে তোমায় সাহায্য করে নি। আমি তোমার সাত রাজার ধন তাই তুমি এসব আমায় করানো নি। এইটা আমাদের নিয়ম। তার মানে এই না যে বাবা কখনো তার দায়িত্ব অবহেলা করেছে। তুমি যখন সেদিন নীলা মাছের পেটি নিয়েছিল তখন তুমি বললে পলাশ তো পেটি খায়। নীলা আবার রাখতে গেলে বলেছিলে, খাও খাও, এটো হাতে আর রেখো না৷ সেদিন নীলার কান্নাটা বুঝে আমি ওকে বুঝাই নি তুমি কত বার আমায় মেরেছিলে এটো হাতে কিছু রাখতে গেলে।
সারাদিন শেষে বাসায় এলে তখন যে তুমিই ছিলে আমার সকল কথার ঝুরি, সব ছিলো তোমার জানা। আমিই ছিলাম তোমার একমাত্র জানালা৷ সরি মা। আমি তা করি নি। নীলা আমি তোমার কাছে অপরাধী। তুমি আমায় ক্ষমা করো কারণ আমি তোমার প্রথমে ছোট ছোট মন খারাপ গুলো শুনি নি। শিখিয়ে দিই নি কিভাবে তোমাকে আর এইসব কথা শুনতে হবে না। কি করলে মা উচ্চস্বরে হেসে উঠে। কোন খাবার টা খেয়ে বাবা পুরানোর কথার বাক্স খুলে। তোমার ছোট ছোট ভুল গুলো অপরাধ হওয়ার আগে নিজের বলে তোমাকে বাঁচিয়ে দিই নি। আমি তোমার আর মায়ের সর্ম্পক টা কখনো স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি নি। যেখানে তোমার খারাপ লাগলে তুমি মাকে বলতে পারো নি,
– মা আমার শরীর টা খারাপ লাগছে, আপনি এইটা করেন তো প্লিজ৷ কি সহজ ব্যাপারটা তোমাদের মনের দূরত্ব এত জটিল করে তুলেছে যে, সেদিনের সৌরভের থালা ধোয়াতে মায়ের চিৎকার করাটা কত স্বাভাবিক ছিলো আর তোমার চুপ থেকে আবার তা করতে থাকার নীরবতায় কত রাগ অভিমানের গভীরতা ছিলো আমি বুঝতেই পারি নি। তাই আমি তোমাদের অপরাধী। এখন মা তুমি যদি বলো আমি তোর জন্য সব বির্সজন দিয়ে এত বড় করেছি, তুই বউ ছেড়ে দেয়, আমি ছেড়ে দিবো মা। কিন্তু আমাকে তুমি আর সংসারী করতে পারবে না। কারণ তোমার পছন্দের সর্বগুনে সম্পন্ন মেয়ে যখন এই সংসার ছাড়তে হবে তখন আমি আবার কোন সর্বগুন সম্পন্ন নীলা এনে অর্কম্মা বানাতে পারবো না। আমাকে দিয়ে হবে না।
নীলা তুমি যদি বলো তুমি আমার বিয়ে করা বউ। আমাদের বাচ্চা আছে। তোমার আইনি অধিকার আছে আমার উপর। আমাকে তোমার সাথে যেতে হবে। আমি বাধ্য। কিন্তু আমার কাছ থেকে তুমি কোন দায়িত্বের আশা রাখতে পারবে না। কারণ যে ছেলে মা বাবা একা ফেলে যাবে তার কাছে তুমি কোন মূল্যবোধ আশা রাখতে পারো না।
এখন তোমরা বলো আমাকে কিভাবে ভাগ করতে চাও? আমার মুখের হাসি বুকের শান্তি টা নীলার সাথে বিদায় করে আমায় রাখতে চাও? নাকি নীলা আমায় সারাজীবনের আত্মগ্লানি নিয়ে মাথা নুয়ে জীবন্ত মূর্তি বানিয়ে নিয়ে যেতে চাও। কেন আমাকে বলা হচ্ছে মা নাকি বউ? কেন মা আর বউয়ের মাঝে অপশন থাকবে? যখন মা আর বউ ছাড়া অপূর্ণ সব। কেন ওদের মাঝে নাকি শব্দ টা আসবে? তোমরা বলো কিভাবে ভাগ করবো এই ভগ্নাংশ? একটানা কথা গুলো বলে আমি ক্লান্ত হয়ে গেলাম। অনেক ক্ষন নীরবতা। সবার চোখে জল গড়িয়ে একাকার। কোথায় যেন সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলেছে ধুপের সুভাস আসছে। কিছুক্ষন পর মা গলা খেকিয়ে বলল-
-তোমার মামা চলে যাবে তো, একটু আদা চা কর আর ময়দা বেলে কিছু লুচি বানাও। পারবে তো? নীলা চোখের পানি মুছতে মুছতে হেসে বলল-
– এখন করে আনছি মা, উড়ন্ত বেলুন কে হঠাৎ ফুটো করে দিলে যেমন টা করে ফুস করে মাটিতে পড়বে, আমি তেমন করে বসে পড়লাম মায়ের পায়ের কাছে। মায়ের কোলে মাথা রেখে এতক্ষনে টালমাতাল শরীরটা সামলাচ্ছি। মা চুলে হাত বুলিয়ে বলছে, যা অফিসের কাপড় ছেড়ে আয়। আমি রান্না ঘরে গেলাম। নীলা লুচি বেলছে। আমি গিয়ে ঝাপটে ধরলাম ওকে বুকে। কারো মুখে কথা নেই। কিন্তু আমার বুক টা, যেন গরম কোন তাওয়ায় এক টুকরো বরফ ছাড়লো কেউ, ছেত ছেত আওয়াজ করে গলে যাচ্ছে সবটা। আর একটু পরে সব গলে পানি হয়ে গেল সব জমানো কষ্ট গুলো। এখন যেন অনেক দিনের অব্যবহৃত পুকুরের শান্ত জল কোন।
গল্পের বিষয়:
গল্প