আমার বয়স যখন চার তখন আমাদের চার বোনের পর অবশেষে একটা ভাইয়ের জন্ম হলো।দাদি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,ওফ্ফ, আমার ছেলেটার তাহলে বৃদ্ধ বয়সে একটা উপায় হলো।দাদির কথায় আমি বললাম, দাদি,আমিও কি বাবার উপায় হতে পারি না?
–মেয়েদের দিয়ে বৃদ্ধ বয়সে উপায় হয় না,আর মেয়েরা কখনো বংশ রক্ষা করতে পারেনা। ওরা তো পরের বাড়ি চলে যাবে।বৃদ্ধ বয়সে বাবা মাকে দেখবে ছেলে,তাই ছেলে দরকার।
দাদির কথাই সেদিন আমারো ঠিক মনে হয়েছিল, তবে বড় হওয়ার সাথে সাথে ধারণা টা পাল্টাতে শুরু করলো।
বাবাও ভাইয়ের জন্মে সে কি খুশি!উনার ভবিষ্যৎ এসে গেছে।বাবাকে এর আগে আমি এতো হাসতে দেখিনি। উনার মুখের চওড়া হাসিটা সেদিন মন ভরে উপভোগ করেছিলাম।সেদিন বাবা খুশি হয়ে ছেলের জন্মের খবর জানাতে পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করে খাওয়াই ছিলেন । ভাইকে নিয়ে পুরো পরিবার খুশিতে আত্মহারা।দাদা-দাদির সারাক্ষণ ওকে নিয়ে মাতামাতি।ওর একটু কিছু হলেই পুরো পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। ওর জন্মের পর থেকে আমার বাবা-মা ওকে আলাদা কেয়ার করা শুরু করলেন আর আমার দিক থেকে সরে যেতে থাকলেন।
ভাইয়ের বয়স বাড়তে লাগল।আমার জিনিসেও তার ভাগ বসা শুরু হলো।ছোট ভাই হিসেবে তাঁকে আমিও একটু বেশি ভালোবাসতাম।তবে ঝগড়াঝাটি তে দোষ যতো ওর হোক মা আমার উপর চড়াও হতেন।তা নিয়ে খুব রাগ হতো। ভাই যতো বড় হতে লাগলো তাতোই ছেলে আর মেয়ের মধ্যে তফাৎ বোঝা শুরু করলাম। বুঝলাম আদর আর অবহেলার তফাৎ।ছেলে না হয়ে মেয়ে কেন হয়েছি খুব আফসোস করতাম, ছেলে হলে নিশ্চয় বাবার আদর আমিও পেতাম এমনটাই ছিলো ভাবনায়। ভাই এক সময় অনেক বড় হয়ে গেলো।বাবা নিজের সম্পত্তি বিক্রি করে ভাই কে পড়াশোনা করিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন মানুষ করাতে। আমার বড় তিন বোনকে এসএসসি পাস করায়ে করায়ে বিয়ে দিয়ে দিলেন।আমাকে পারলেন না শুধু আপুদের কারণে।
এসএসসির পর বাবা বিয়ে দিতে চাইলে তিন বোন এক হয়ে বাবার সাথে অমত পোষণ করেন বলে বাবা আমার বিয়ে দিতে পারলেন না। তবে পড়াশোনার খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেবে হুমকি দিলেন। বড় আপু সে দায়িত্ব টা নিয়েছিলো সেদিন। একই ঘরে থেকে তখন দেখেছিলাম শুধু মেয়ে হওয়ার অপরাধে কতো অবহেলায় নিজেকে পুড়াতে হয়।ভাই য়ের জন্য সপ্তাহে একজোড়া কাপড় আনলে আমি মাসে চাইলেও বাবার কড়া জবাব ছিলো,মেয়েদের এতো পোষাকের কি দরকার? ছেলে রাতো ঘরের বাইরে যায় তাদের তাই দরকার আর তুমি মেয়ে ঘরের বাইরে বেরোতে হয় না তোমার এতো কাপড় দরকার কিসে?
কলেজ থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে ভাইয়ের পিকনিকে যাওয়ার অনুমতি থাকলেও এক হাজার টাকা খরচ করে আমার ক্লাস পার্টি কিংবা র্যাগ ডেতে যাওয়ার অনুমতি ছিলোনা।তখন ইগো টা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিল,একদিন বাবাকে ঠিক এর জবাব দেব।বুঝিয়ে দেব,বংশরক্ষা বলে কোন কথা নেই।কথা নেই ছেলে বৃদ্ধ বয়সে বাবার উপায় হবে বলে,মেয়েরাও চাইলে সব করতে পারে।আর ছেলে হোক মেয়ে হোক মানুষের মতো মানুষ না হলে ছেলেও বাবার হয়না মেয়েও না।
জায়গা হয় বৃদ্ধাশ্রম নাহয় দিন কাটে খুব কষ্টে। যাইহোক সেসব পুরোনো কথা।বাবার অবাধ্য মেয়ে হয়ে বোনদের ভরসায় ভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বিয়ে করেছি তিন বছর হলো।চাকরিও করি ভালো,মাইনে পঞ্চাশ হাজার।বিয়ের পর থেকে এখন আমি তিনটি পরিবার সামলায়।বাবা-মার পরিবার,শ্বশুর বাড়ির পরিবার আর আমার বড় বোনটা।যে বোনটা স্বামীর মৃত্যুর পরে গার্মেন্টসে কাজ করে আমার পড়াশোনার দায়িত্বটা নিয়েছিল। এখন তার দুটো মেয়ের পড়াশোনার দায়িত্বটা আমার।শ্বশুর বাড়ির একমাত্র ছেলের বউ বলে শ্বশুর-শ্বাশুড়িকেউ দায়িত্ব নিয়ে সামলাতে হয়।
ঐ দিকে বাবার বাড়িতে ভাই কে যে বাবা সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে স্কলারশিপ নিয়ে দিয়ে আমেরিকা মানুষ হতে পাঠিয়েছিলেন আর ফিরলে দেশে ছেলের বিয়ে দিয়ে বংশরক্ষা করবে ভেবেছিলেন সে ভাই আর ফেরেনি।ওখানে নাকি বিয়ে করে ওদেশে স্থায়ী হয়েগেছো। যে বাবা বলেছিল, মেয়েদের এতো পড়াশোনা করিয়ে কি লাভ?সে তো পরের বাড়িতে চলে যাবে, তার এতো পড়াশোনা করা কেন দরকার। সে বাবা আমাকে রোজ বলে,তুই যদি পড়াশোনা টা না করতিস, তাহলে আমাদের কি হাল হতো বলতো।
সেদিন আমার প্র্যাগনেন্টের খবর জানতে বাবা দোয়া করলেন, যেন আমার একটা ছেলে হয়।তখন মন থেকে বলেছি,এরকম কেন বলেছ বাবা,এখন তো প্রমাণ হলো ছেলেদের মতো করে মেয়েরাও বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে জানে।ঘরের বাইরে গিয়ে চাকরি করে ঘরে ফিরে আবার চুল বেঁধে সংসার সামলাতে জানে।তাও ছেলে মেয়ের বৈষম্য কেন দেখছ বাবা,তুমি আমার অনাগতের জন্য এমন দোয়া করো ছেলে হোক মেয়ে হোক আমি যেন তার ন্যায্য অধিকার টা দিয়ে কোন অবহেলা না করে মানুষের মতো মানুষ করতে পারি।
গল্পের বিষয়:
গল্প