একদিন মেয়ের বাবা রাতের ১১টায় বাসায় ফিরলেন হাতে করে দুটো বার্গার নিয়ে। এসেই হাসিমুখে জানান দিলেন রাতে ভাত খাবেন না। তিনি রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়েই এসেছেন। আসার সময় বাচ্চাদের জন্য বার্গার নিয়ে এলেন। আমি কোনো মতামত বা আনন্দ উচ্ছাস কিছুই ব্যক্ত না করে নির্বিকার ভঙ্গিতে প্যাকেট খুলে একটা বার্গার নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। যদিও বার্গার খাবারটা আমার বাচ্চাদের যতটা পছন্দ আমার ততটা নয়।
তারপরও আমি খাচ্ছিলাম। কারণ আমি চাইনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক। খুব ছোটবেলায় দেখতাম আমার আব্বা কোনো খাবার কোনো উপহার বা যে কোনো জিনিস আমাদের চার ভাই বোনদের জন্য কিনতেন। আমার মায়ের জন্য কিনতেন না। যেমন তিনি দোকান থেকে চারটা আইসক্রিম, চার প্যাকেট চিপস আমাদের চার ভাই -বোনের জন্য কিনতেন। অথচ বাসায় আমরা পাঁচজন মানুষ থাকতাম। আমার মা হাসি মুখে চিপসের প্যাকেট খুলে আমাদের হাতে দিতেন। আইসক্রিম হাত থেকে পড়ে নস্ট হয়ে যাবার ভয়ে আমাদের গাইড করতেন পিছন থেকে খাও, সামনে থেকে খাও! জানি না আমার মায়ের খেতে ইচ্ছে করত কি-না! না করার তো কথা নয়। তিনি গৃহবধূ। সারাক্ষণ আমাদের সাথে ঘরেই থাকতেন। নিজের হাতে বানানো খাবারই খেতেন। কখনো তো একা একা বাইরে যাননি বা নিজের ইচ্ছের প্রতিফলন করেননি।
আপনি যখন চারটা কিনতে পেরেছেন, তখন পাঁচটাও কিনতে পারতেন। তার মানে স্বদিচ্ছার অভাব ছিল। পুরুষ জাতি ধরেই নিয়েছে, মেয়েদের খেতে হয় না। আমার সংসারে কিন্তু আমি এটা হতে দেইনি। মেয়ের বাবা দুইটা ওয়েফার আনলে তার সামনে একটা খুলে আমি খাওয়া শুরু করতাম। যদিও খেতাম না। তাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি। বাসায় আমরা তিনজন থাকি যে কোনো খাবার তিনটাই আনবা। ঐ জিনিস আমি না খেলে বিকল্প আরেকটা আনবা যেটা আমি খাই। কারণ আমিও মানুষ। আমারও পছন্দ আছে, ইচ্ছে আছে, অনুভুতি আছে। বছরের পর বছর তোমার সংসারে গাছের গুঁড়ি হয়ে পড়ে থাকব? তুমি যদি আমাকে না বুঝ তাহলে তো কেউই বুঝবে না। একটা মেয়ের বিয়ের আগের সকল আবদার থাকে বাবা মার কাছে। বিয়ের পরে থাকে স্বামীর কাছে। বাবা- মার কাছে যতটা প্রাণ খুলে আবেগ প্রকাশ করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বামীর কাছে যায় না। স্বামী নামক প্রিয়জনকেই সেটা বুঝে নিতে হয়।
আমার আব্বা কারো বাড়ি গিয়ে এককাপ চাও খেতেন না আমাদেরকে ছাড়া। তিনি ভীষণভাবে চাইতেন তিনি যেখানেই দাওয়াত খেতে যান যেন আমরা চার ভাই-বোনও সেখানে যেতে পারি। কোনো কারণে আমাদেরকে ছাড়া যেতে হলে, তিনি বাড়ি ফিরেই আমাদেরকে নিয়ে হোটেলে চলে যেতেন। সেইম খাবার আমাদের খাইয়ে আনতেন। অথচ আমার মাকে নিয়ে তাঁর তেমন কোনো ভাবনা ছিল না। আমাদের যৌথ পরিবার ছিল। আব্বা শাড়ি কিনলে পাঁচটা কিনতেন। তিন ফুফুর জন্য তিনটা, মায়ের জন্য একটা, দাদীর জন্য একটা। দাদীকে দেয়ার জন্য তাঁর আরও সন্তান ছিলেন। ফুফিদের স্বামী ছিলেন। কিন্তু আমার মায়ের স্বামী ছাড়া আর কেউ ছিল না। দিন শেষে আমার মাই ঠকত।
অথচ আমিও যৌথ পরিবারে থাকি। কন্যার বাবাও সেইম কাজ করেন। একদিন ড্রেস আনার পর আমি পাঁচটাই রেখে দিয়েছি। তাকে বললাম ‘ ভাবীদেরকে কাল এনে দিও। আমার পাঁচটাই পছন্দ হয়েছে।’ সে চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি মনেমনে বলছি, ইচ্ছে হলে চোখ বের করে ফেল। আমি তোমার স্ত্রী। তোমার উচিত কিছু পোষাক সবাইকে গিফট করা ছাড়াও আমার জন্য কেনা। তুমি যখন সেটা বুঝতে পারনি। আমিই চোখ গেলে বুঝিয়ে দিলাম। বাচ্চার বাবা কখনো ওদেরকে নিয়ে কোথাও যায় না। কখনো যাবেও না। প্রতি সপ্তাহে দুটো- চারটা দাওয়াত থাকে। দুপুরবেলা বেশির ভাগ সময় বাইরেই খান।
একদিন এত মেজাজ খারাপ হলো। যখন শুনলাম একটা দাওয়াতে সবার পরিবার ছিল। শুধু তিনি একা ছিলেন। ঐ দিনই আমি কারো অনুমতি না নিয়েই রেডি হয়েই বাচ্চাদেরকে নিয়ে বাইর থেকে ঘুরে এলাম। বাচ্চাদেরকে রেস্টুরেন্ট থেকে খাইয়ে আনলাম। নারীদের জীবন কখনো মসৃন হয় না। এ জীবনের পরতে পরতে বন্ধুরতা। কেউ আপনার ইচ্ছে, অনিচ্ছের মূল্য দিবে না। আপনার জায়গা আপনাকেই করে নিতে হবে। হয় বুদ্ধি দিয়ে না হয় বিচক্ষণতা দিয়ে। কারণ অধিকাংশ পুরুষ তো নারীদের মানুষই মনে করে না।
গল্পের বিষয়:
গল্প