রাফিক ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মেয়েটা তোমাকে পছন্দ করে । এতো রুড না হলেও পারো ! আমি জানি গতকাল অরুপার প্রতি আমি একটু বেশি কঠিন আচরন করেছি । বাসায় গিয়ে আমার নিজের কাছেই খারাপ লাগছিলো । বারবার মনে হচ্ছিলো যে কাজটা আমার মোটেই ঠিক হয় নি । শুরুতে সবার কাজ শিখতে সময় লাগে । কাজে ভুল হয় । আমার নিজেরও এক সময় কত ভুল হয়েছে । এমন কি আমার নিজে যে মানুষগুলো কাজ করে তাদেরও ভুল হয় । তাদেরকে তো এতো কঠিন কন্ঠে বকা দেই না । তাহলে অরুপাকে কেন দিলাম ? এতো কেন বিরক্ত মেয়েটার উপরে আমি ?
নিলিমার জন্য ? হয়তো এটাই সব থেকে বড় কারণ । সম্ভবত রফিক ভাইও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন । তিনি বললেন, দেখো একজন মেয়ে তোমার সাথে খারাপ কিছু করেছে তার মানে এই না যে সব মেয়েই তেমন হবে ! আমি বললাম, আমি বুঝতে পারছি । আমার আসলেই ব্যক্তিগত কারণে অরুপার উপরে চিৎকার করা ঠিক হয় নি । রফিক ভাই বললেন, অরুপার সাথে একটু কথা বল । তাহলেই সে খুশি হবে । তুমি হয়তো খেয়াল কর নি কিন্তু সে তোমার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকায় সেটা সাধারন কোন দৃষ্টি নয় ! ওর ব্যাপারে ভেবে দেখতে পারো !
আমি হাত সামনের দিকে নিয়ে বললাম, মাফ চাই ভাই ! ঐ পথে আর যাচ্ছি না ! তবে অরুপাকে সরি বলবো । আর সামনে এমনটা আর হবে না ! আমি রফিক ভাইয়ের রুম থেকে বের হয়েই অরুপার ডেস্কার সামনে গিয়ে হাজির হলাম । ও মাথা নিচু করে কাজ করছিলো । আমি সামনে গিয়ে দাড়াতেই আমার দিকে তাকালো চোখ তুলে । ওর চোখের দিকে তাকিয়েই মনে হল মেয়েটা রাতে অনেক বেশি কান্নাকাটি করেছে । চোখ কেমন ফোলাফোলা । নিজেকে আরও বেশি অপরাধী মনে হল । মেয়েটাকে ওভাবে না বকলেও হত । আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম । তারপর বলল, কালকের ব্যবহারের জন্য আমি সরি ! অরুপা মাথা ঝাকালো । তারপর বলল, ইটস ওকে !
-নো ইটস নট ওকে । আমি সত্যিই সরি ! অফিসের পরে আজকে ডিনার আমার পক্ষ থেকে । কেমন ! এই কথাটা বলতেই দেখলাম অরুপার মুখটা ১০০ ওয়াট বাতির মত জ্বলে উঠলো । একটু আগে যে মন খারাপের ব্যাপার ছিল সেটা মুহুর্তেই গায়েব হয়ে গেল ! আমি সত্যিই খানিকটা অবাক না হয়ে পারলাম না । আমি ভেবেছিলাম অরুপা আমার সাথে মুখ গোমড়া করেই কথা বলে যাবে। কিন্তু এতো জলদি ওর মুড বদলে যাবে আমি ভাবতেই পারি নি ।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে আমরা এক সাথেই বের হলাম । অরুপা অবশ্য সরাসরিই রেস্টুরেন্টে ঢুকলো না । আগে একটা শপিং সেন্টারে ঢুকলো । আমিও ওর সাথেই ঢুকলাম । কি সব কেনা কাটা নিজের জন্য । তারপর আমাকে অবাক করে দিয়েই আমার জন্য একটা শার্ট কিনলো । আমি মানা করলাম বটে তবে ও মোটেই শুনলো না । আমি খুব বেশি জোর করতে পারলাম না । বিশেষ করে ওর চোখে আনন্দ দেখে সেটা নষ্ট করতে ইচ্ছে করলো না । পুরো সময় ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো যে মেয়েটা আমার সাথে কথা বলতে পেরে আমার সাথে গল্প করতে পেরে আমার এই উপহার দিতে পেরে অনেক বেশি আনন্দ অনুভব করছে ।
ডিনার শেষ করতে করতে রাত দশটা বেজে গেল । পুরোটা সময় অরুপা কত যে কথা বলল আমি বলে বোঝাতে পারবো না । স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির কথা সব । রিক্সা করে ওকে পৌছে দিতে গেলাম । যদিও প্রথমে ক্যাব নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হল না । বলল যে রিক্সাই নিতে হবে । বাচ্চা মেয়ের মত জেদ করলো । আমি সেটা মেনেও নিলাম । রিক্সা করে যাওয়ার সময় হঠাৎ আমি বললাম, তুমি কত কথা বললে কিন্তু স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমি কোন প্রেম কর নি? অরুপা আমার দিকে একবার চট করে তাকিয়েই অন্য দিকে তাকালো । তারপর বলল, আমি জীবনে একজনকে কেবল ভালোবেসেছি। আমার খুব ইচ্ছে করলো প্রশ্নটা করতে যে কে সে? কিন্তু নিজেকে আটকালাম । সব কিছু জানতে চাইতে নেই। ওদের বাসার সামনে রিক্সা আসতেই অরুপা বলল, আসবেন আমাদের বাসায় একটু?
-এখন?
-হ্যা । বাসায় আম্মু ছাড়া আর কেউ নেই । আমি আর আম্মু থাকি । আসুন না প্লিজ । আম্মুর সাথে একটু দেখা করে যান।
এমন ভাবে অনুরোধ করলো যে আম মানা করতে পারলাম না । নিজের পরিবার সম্পর্কে অরুপা আমাকে আজই
বলতে গেলে সব কথা বলেছে । অনেক ছোট বেলায় অরুপার বাবা মারা যায় । অরুপার মা চাইলেই আরেকটা বিয়ে করতেন পারতো কিন্তু করেন নি । নিজে চাকরি করেছে আর অরুপাকে মানুষ করেছে । এখনও সে কলেজের শিক্ষিকা । অবসর নিতে বেশ বাকি আছে । অরুপার মা আমার সাথে খুব স্বাভাবিক আচরন করলো । এটা আমাকে একটু অবাকই করলো বটে । এমন একটা ভাব যেন তিনি আমাকে খুব ভাল করেই চেনেন । এক মাত্র কারণ হতে পারে যে অরুপা আমার কথা তার মায়ের কাছে বলেছে । খুব ভাল করেই বলেছে ।
ঐদিন অরুপাদের বাসা থেকে চলে আসার পর মনের ভেতরে একটা স্বাভাবিক কৌতুহল খেলা করতে লাগলো । অরুপা বলেছিলো সে সারা জীবন কেবল একটা মানুষকে ভালবেসেছে । আর এখন আমার দিকে ও যেভাবে তাকায়, কথা বলে আমার স্পষ্টই মনে হয় সে আমাকে পছন্দ করে । কিন্তু এই মেয়েটাকে আমি আমাদের অফিসে জয়েন করার আগে দেখেছি বলে মনে করতে পারি না । তবে ওর একাডেমিক ইতিহাস দেখে এটা জানতে পেরেছি যে আমার বিশ্ববিদ্যালয় এমন কি আমার ডিপার্টমেন্ট থেকেই ওর পাশ করেছে । যদিও আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার বেশ পরেই ও ভর্তি হয়েছে । আমার সাথে দেখা হওয়ার সম্ভবনা ছিল না । তাহলে ?
এই প্রশ্নটার উত্তর পেলাম আরও মাস খানেক পরে । অচেনা একটা নাম্বার থেকে ফোন এল আমার নাম্বারে । রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জানালো যে সে অরুপার মা । আমার সাথে কয়েকটা কথা বলতে চায় । আমার অফিসের পাশের আছে সে যদি সম্ভব হয় একবার যেন দেখা করি । এবং সাথে সাথে এও জানালো যে অরুপাকে যেন না বলি এই সাক্ষাতের কথা । কিছু সময় পরেই আমি গিয়ে হাজির হলাম মহিলার সামনে । কোন রকম ভনিতা না করেই বললেন, আমার মেয়ে যে তোমাকে ভালোবাসে তুমি এটা টের পেয়েছো কি? আমি মিথ্যা বললাম না । বললাম, হ্যা । টের পেয়েছি ।
-তোমার কি আমার মেয়েকে একদমই ভাল লাগে না? দেখো মা হিসাবে আমি আমার মেয়েকে ভালবাসি । চাই যেন ও নিজের ভালবাসার মানুষটার সাথে জীবন পার করুক। আমি একটু দম নিয়ে বললাম, আপনি জানেন আমার আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো । অরুপার মা বললেন, তোমার ব্যাপারে আমি সব জানি । কবে বিয়ে হয়ে কবে ডিভোর্স । কেন তুমি আর ঐদিকে যেতে চাও না। সব !
-সব জানেন?
-হ্যা ।
-অরুপা চমৎকার একজন মেয়ে । ওর ভাগ্য চমৎকার কেউ আছে । আমার থেকে ও সাত আট বছরের ছোট । আমি আসলে ….
-দেখো অপু আমার মেয়ে কিন্তু তোমাকে আজ থেকে পছন্দ করে না ।
-মানে?
-সে তোমাকে কম করে হলেও দশ বছর ধরে চেনে ।
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না । অরুপাকে আমাদের অফিসে জয়েন করার পরেই আমাদের দেখা হয়েছে । এর আগে ওকে আমি দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না । আমার মুখের ভাব দেখেই মহিলা বললেন, তোমার হয়তো মনে নেই তবে অনেক বছর আগে তুমি আমার মেয়ের খুব বড় একটা উপকার করেছিলে !
-কি রকম?
-মেয়েদের প্রথম পিরিয়ডের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে নিশ্চয়ই তুমি খুব ভাল করে জানো ! মেয়েরা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সে কি করবে না করবে । ঘটনা এমন এক দিনের । অরুপার যখন প্রথম পিরিয়ড হয় তখন সে বাইরে ছিল । তখন ওর বয়স কত হবে, এই ধর ১৩ । হঠাৎ সেটা শুরু হয় এবং পোশাকের পেছন দিকটা অনেকটা রক্তে লাল হয়ে যায়। আর আমাদের দেশের মানুষ জন কেমন তো জানোই । এই ব্যাপারটা নিয়ে কেমন হাসিঠাট্টা করে। ব্যাপারটা কয়েকজন ছেলে খেয়াল করে এবং ওকে টিজ করতে শুরু করে ।
আমার ছোট্ট মেয়েটা অনেকটা দিশেহারা বোধ করে । ঠিক তখনই একজন তার সামনে এসে হাজির হয় । নিজের শরীরের শার্ট খুলে তার কোমরে জড়িয়ে নেয় । ওর হাত ধরে বলে, ভয় পেও না । এটা স্বাভাবিক ব্যাপার । আমার ভাসা ভাসা ঘটনাটা মনে পড়লো হয়তো । অরুপার মা বললেন, তুমি নিশ্চয়ই জানো আমাদের এই সমাজে দুটো মেয়ের একা টিকে থাকা খানিকটা কষ্টকর । অরুপা সব সময় পুরুষের কুৎসীত দিকটাই দেখেছে । এই প্রথম ভাল কিছু তার সামনে এল । একটু চুপ করে আবাার বললেন, সাধারনত মেয়েরা প্রথম তার বাবাকে ভালোবাসে । তাদের বাবারা হয় তাদের প্রথম হিরো । সব মেয়েই তার প্রেমিক স্বামীর ভেতরে তার বাবার ছায়া দেখতে চায় । কিন্তু আমার মেয়ের প্রথম হিরো ছিলে তুমি ! আমি বললাম, আমাকে ও কিভাবে খুজে পেল ?
-খুলে পেলো? ও কোন দিন তোমাকে চোখের আড়ালই করে নি ।
-মানে?
-মানে হচ্ছে সেদিন তুমিই ওকে বাসায় পৌছে দিয়েছিলে । মনে আছে ?
-সম্ভবত ।
-যখন মানিব্যাগ বের করে তুমি রিক্সা ভাড়া দিচ্ছিলে তখন সে তোমার মানিব্যাগের ভেতরে তোমার আই কার্ড দেখে । তারপর আস্তে ধীরে তোমার খোজ বের করে। কোন ভার্সিটি কোন অফিস সব । এমন কি ওখানে ভর্তি হয়েছিলো কেবল তুমি ওখানে পড়তে বলে।
-অফিস?
-হ্যা । তুমি ওখানে চাকরি কর বলেই …
আমি কি বলবো খুজেই পেলাম না । অরুপার মা বললেন, দেখো তোমার প্রথম বিয়েটা সুখের হয় নি আমি জানি । তবে আমার মেয়েকে কি একটা বার সুযোগ দেওয়া যায়? ও কোন দিন তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালই বাসতে পারবে না আমি জানি । আমার মতই হয়েছে । আমি যেমন ওর বাবাকে ছাড়া অন্য কোন পুরুষকে মনেই আনতে পারি নি ও ঠিক তাই ! আমি বলছি না নিজের উপর জোর করে কিছু কর। কিন্তু নিজের মেয়ে তো । ওকে এভাবে একা একা থাকতে দেখে কষ্ট হয় আমার । আমার কিছু হয়ে গেলে মেয়েটা একদম একা হয়ে যাবে । আমি আবার অফিসে ফিরে এলাম । অরুপা আমাকে দেখলো আসলো । প্রতি উত্তরে আমিও হাসলাম । অফিসের বাকিটা সময় চুপ করে বসে রইলাম কেবল । একটু যে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি সেটা নিশ্চিত কিন্তু অরুপার মায়ের কথা গুলো কিছুতেই মন থেকে বের করতে পারছি না । এমন ভাবে কি কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে? অফিস ছুটির পরে অরুপা শেষ বার আমার ডেস্কে এল চলে যাচ্ছি বলার জন্য । হঠাৎ আমি বললাম, বাসায় যাওয়া জরূরী এখন?
-কেন?
-না মানে আজকেও ডিনার করতে আমার সাথে ।
অরুপা খানিকটা অবিশ্বাস্য আনন্দ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, চলুন । ফুটপাঠ ধরে আমরা বেশ কিছু সময় হাটলাম । অরুপা এক মনে কথা বলেই যাচ্ছে । হঠাৎ আমি বললাম, আমার যেদিন বিয়ে হয় সেদিন কি খুব কেঁদেছিলে? আমার প্রশ্ন শুনে অরুপা প্রথমে একটু থমকে গেল । ওর মুখে একটা অন্য রকম প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম । আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো সে । কি বলবে যেন বুঝতে পারছে না । আমি আবার বললাম, কেঁদেছিলে? অরুপার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো । মৃদু ভাবে কেবল মাথা ঝাকালো ।
-নিলিমার সাথে আমার বনিবনা কেন হয় নি জানো?
অরুপা কোন কথা বলল না । আমি বললাম, কারণ আমার ভাগ্য অন্য কারো সাথে লেখা ছিল । লেখা রয়েছে। আই থিংক অনেক বেশি অপেক্ষা করেছো তুমি ! তারপর একদম ফুটপাথের মাঝেই আমি হাটু গেড়ে বসে বললাম, মিস অরুপা হাসান, উইল ইউ ম্যারি মি? রাস্তা শুদ্ধ মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অরুপাকে দেখলাম তীব্রভাবে কান্না শুরু করলো । তারপর আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ।
কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ডাক দিলাম । ওরা যেন আকাশ থেকে পড়লো যখন বললাম যে আমি আবার বিয়ে করছি । তবে রাত দশটার মাঝে হাজির হল মগবাজার কাজী অফিসের সামনে । ঐদিক দিয়ে অরুপার মা সহ ওর কয়েকজন বন্ধুবান্ধন এসে হাজির হল । রাত এগারোটার মধ্যে বিয়ে শেষ করে আমরা কাজী অফিস থেকে বের হলাম । এতো তাড়াহুড়া কেন করলাম আমি জানি না । তবে আমার কেবল মনে হল এইমেয়েটা অনেক লম্বা সময় আমার জন্য অপেক্ষা করেছে । ওকে আর অপেক্ষা করানো ঠিক হবে না । এখান থেকেই আমাদের নতুন জীবন শুরু হল।
গল্পের বিষয়:
গল্প