কর্তব্য

কর্তব্য
বড় আপুকে দেখতে আসা পাত্র পক্ষ আমাকে দেখে পছন্দ করে। এটা যে বড় আপুর জন্য কতটা লজ্জার তা একটা মেয়েই বুঝতে পারে। বাবা-মা আর তিন বোন নিয়ে ছিল আমাদের সংসার। কখনো কোনো অভাব হয়নি কারন বাবার সামর্থ্যের বাহিরে কিছুই চাইতাম না। বড় আপুর থেকে মেজো আপু ২ বছরের ছোট হলেও আমি মেজো আপুর থেকে প্রায় ৪ বছরের ছোট। সবার ছোট ছিলাম বলে খুব আদরে বড় হয়েছি। মা আর মায়ের মতো দুটো বড় বোন সব সময় আগলে রাখতো।
টাকার অভাবে বড় বোনেদের পড়ার ততটা সুযোগ হয়নি তাই তাদের সবার স্বপ্ন আমার উপর ছিল। আমি জেনো একটা ভালো একটা চাকরি করতে পারি। মুরুব্বি বাবার উপর কতই বা চাপ দেওয়া যায় সে জন্য বড় আপু প্রায় সেলাই মেশিন চালিয়ে আমার লেখাপড়ার খরচ দিত।
পরিবারের কোনো কাজ করতে হয় নাই বলে আর কোনো কাজ শেখাও হয় নাই। রুপে, বিদ্যায় অতুলনীয় হলেও সংসারে কাজের কিছুই বুঝতাম না, তবে বড় আপু,মেজো আপু সুন্দরী না হলেও চেহারা যেমন মায়াবী ছিলো তেমনই সব কাজেও ছিলো গুনোবতী। অনেক কষ্টে বাবা বড় আপুর জন্য একটা বিয়ে ঠিক করেছিলো। শুনেছি পাত্র পক্ষের প্রচুর সম্পত্তি আছে। পাত্র বড় চাকরি করে। কিন্তু পাত্র পক্ষ দেখতে এসে আমাকে পছন্দ করে। বাবাও বড় লোক দেখে না করেননি। বড় বড় তিনটি মেয়ে যার ঘরে সে কি করে না করবে। মেয়েদের ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারলেই তো বাবার সব স্বপ্ন পূরন হয়।
সেদিন বাবার কথায় না করতে পারি নাই। দশম শ্রেনীতে বসেই মা বোনদের সবার স্বপ্ন ত্যাগ করে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছিল। সেদিন শুধু আমার বিয়ে হয় নাই, সব মানুষের সামনে আমার বোনকে অপমান করা হয়েছিল, হয়েছিল আমার সব স্বপ্নের বিসর্জন। শ্বশুর বাড়িতে এসে শাশুড়ি ননদের কাছে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কোনো কাজ জানতাম না তবুও চেষ্টা করছিলাম সব কাজ করার। শাশুড়ি কে মায়ের স্থানে বসিয়ে বলছিলাম- “মা! বাবার বাড়িতে লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুই শেখা হয় নাই তবে আপুরা বলত আমার নাকি মেধা আছে একটা জিনিস একবার দেখলেই পারি, আপনি শুধু আমাকে একবার দেখিয়ে দিয়েন আমি সব কাজ করে দিব।” তখন শাশুড়ি মা বলেছিলেন- “কাজ জানো না তো আমার ছেলের গলায় ঝুললে কেনো, তোমার এই রুপ ধুয়ে কি পানি খাবে আমার ছেলে।”
সেদিন খুব বলতে ইচ্ছা হয়েছিল- “আমি কই ঝুললাম,আপনারাই তো আমার স্বপ্ন গুলোকে ভেঙ্গে রুপ দেখে আপনার ছেলের গলায় ঝুলালেন।” তবে মনের কথা মনেই থেকে যেত। বাঙালি বউদের শাশুড়ি মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা যে ঘোর অন্যায়, সেখানে এসব বলা কি মানায়? নতুন বউ দেখতে যত মেহমান আসতো সবাই দেখে যখন বলত- বউ তো বেশ সুন্দরী। তখন আমার ননদ বলতো- “উপরের চামড়াটাই শুধু সাদা ভিতরে একটুও ম্যাচুউরিটি নেই।” সবার সামনে তখন খুব অপমান লাগতো, আড়ালে গিয়ে কাঁদার ও সুযোগ পাই নাই।
শ্বশুর বাড়িতে আসার তিন বছরের মাথায়ও বাবার বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয় নাই, বাবা কয়েক বার এসেছিলো কিন্তু তার সাথে ততটা ভালো ব্যবহার করেনি কৃষক বাবাকে কি এ ফেমেলীতে মানায়? বাবাকে নিজের কসম করে বলেছিলাম আর জেনো এখানে না আসে নিজের বাবাকে আর কতই বা অপমান হতে দেখবো সেদিন বাবা চলে যাওয়ার সময় খুব কেঁদে ছিলো। তখন বাবার থেকেই জানতে পাড়ি বড় আপু আমরিকা প্রবাসীর সাথে বিয়ে হয় আর সেখানে চলে গেছে। আর মেজো আপুও বিয়ে করে খুব সুখেই আছে। বিয়ের ৪ বছর পর গর্ভবতী হয়েছিলাম কিন্তু কাজের চাপে সে সন্তান নষ্ট হয়ে যায় নাই। তারপরের বছরই একটা মেয়ে হয়েছিলো।
তখন শাশুড়ি বলছিল আমি নাকি অলক্ষী, আর আমার ছোট মেয়েটা অপয়া। শাশুড়ির বলেছিল- “যে মেয়ের প্রথম সন্তান নষ্ট হয়, আবার দ্বিতীয় সন্তান ও যখন মেয়ে সে মেয়ে অলক্ষী ছাড়া আর কি হতে পারে।” সব কিছু করার পরেও এসব শুনে থাকতে হয়েছে এ বাড়িতে। যতই হোক কথায় আছে বাঙ্গালী মেয়েরা শশুর বাড়িতে লাল সাড়ি পড়ে ডুকতে হয় আর বেড়ায়ে যেতে হয় সাদা কাপড় পরে। আজ ছোট্ট সেই মেয়ে পূর্নতাকে বিয়ে দিলাম। পূর্নতাকে আমি আমার মতো হতে দেয় নাই, শিক্ষিত করে বিয়ে দিয়েছি। আমার মেয়ে আজ বড় ডাক্তার। এই তো আমার সব দুঃখ সহ্য করার ফসল।
শাশুড়ি মা মারা গেছে আজ এক বছর হলো, মৃত্যুর আগে দুই বছর বিছানায় পরে ছিল। ভেবেছিল হয়তো আমি তাকে দেখবো না তাই তার আদরের মেয়েকে খুব অনুরোধ করেছিলো তাকে দেখার জন্য। কিন্তু সেই দিন আমার ননদ তার আশে পাশেও আসে নাই। কোনো রকম কথা কাটিয়ে তার স্বামীর বাড়িতে চলে গেছে আর শাশুড়ির মৃত্যুতে আসছে। কিন্তু আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি, আমি চেষ্টা করলে আর একটু ভালো ভাবে লালন-পালন করতে পারতাম তবে বাবাকে অপমানের কথা মনে পরলে মন থেকে আর হয়ে ওঠে নাই।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত