বিয়ের আসর থেকে কনে গোপনে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছে। এদিকে মুখে রুমাল দিয়ে বর বসে আছে কবুল বলার জন্য। কনের এজিনরের জন্য গিয়ে কনেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলনা। কনের পিতা এই কথা শুনে যেমন রাগান্বিত হলেন তেমনি মর্মাহত হল। ভেবে পেলেন কেমন করে পাত্র পক্ষের সামনে এই মুখ দেখাবেন? তার মনের সব রাগ গিয়ে পড়লো কনের মায়ের উপর। কনের মা পড়লেন মহাবিপদে! চৌদ্দ গুষ্টির সবাই মিলে কনের মায়ের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে শুরু করলো! কনের মা একদিকে মেয়ের চিন্তা অন্য দিকে সবার মর্মান্তিক রুক্ষ কথায় চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বললেন, আমার কি দোষ?
সবাই সমস্বরে চিত্কার করে উঠলো, তোমার আশকারা পেয়ে মেয়ে এমন কাজ করার সাহস পেয়েছে। কনের মায়ের পক্ষে কেউ নেই তাই সে অসহায়ার মতো চুপ করে খাটের কোনা ধরে বসে কাঁদতে লাগলো। এদিকে বরপক্ষ তাগাদা দিচ্ছে তারাতাড়ি করার জন্য। তারাতাড়ি বিয়ে পড়িয়ে তাদের অনেক দূর যেতে হবে। সকাল সকাল তারা এখান থেকে বউ নিয়ে বিদায় হতে চায়। এই কথা শুনে কনে পক্ষের লোকজন এর মুখ চুপসে গেল। বিয়ে কেমন করে পড়াবে কনেই তো গায়েব। কিন্তু এই কথা কেমন করে বর পক্ষকে বলবে। তাই কনের চাচা বরের বাবার হাত ধরে বলে, মেয়ে গেছে সাজতে আসতে একটু দেরি হবে। আপনারা দয়া করে আর একটু অপেক্ষা করুন। বরের বাবা রাগ দেখিয়ে বলে, আমাদের তো ভাই দূরে যেতে হবে। আপনাদের দেখি কোন কমন সেন্স নেই। যান গিয়ে তারাতাড়ি করুন। মেয়েকে ফোন করে আসতে বলুন।
রাগারাগি করেও তিনি অপেক্ষা করতে বসে পড়লেন। আর কনের বাবা চাচা সবাই ছুটলো মেয়েকে খুঁজে আনতে। কিন্তু কোথায় খুঁজে পাবে? ওরা তো আর এই শহরেই নেই। ঘন্টা তিনেক খোজাখুজি করে তারা জানতে পারলো। ছেলেমেয়ে একবারে দেশান্তরী হয়েছে। তাদের দেখা আদৌও পাবে কিনা সন্দেহ আছে। কনের বাবা এই কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে রাস্তায়। তার ছোট ভাই অনেক করে বুঝিয়ে বড় ভাই কে শান্ত করে। সবাই তখন রণে ভঙ্গ দিয়ে লজ্জিত মুখে বরের বাবার সামনে এসে নত মুখে বললো, একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে। বরের বাবা চমকিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, কোথায় এক্সিডেন্ট করেছে? এখন কোথায় বউ মা?
তখন কনের চাচা বরের বাবার হাত ধরে কাছে গিয়ে বলে, ভাই আমাদের মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!
এই কথা শুনে বরের বাবা ছিটকে পড়েন। চমকে উঠে জিজ্ঞেস করে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, মানে কি? মেয়ে পালিয়েছে! ছি! ছি! এমন খানদান আপনাদের! যে মেয়ে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যায় অন্যের হাত ধরে। সে মেয়ে যে আমার ঘরের বউ হয়নি তা আমার ভাগ্য বলতে হবে। কিন্তু এই যে এতো খরচ পাতি করে আমরা এলাম তার কি হবে? আমাদেরও ইজ্জত বলে একটা কথা আছে। লোকে যখন দেখবে বউ না নিয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছি তখন কি জবাব দেবো? আপনাদের না হয় সম্মান বলে কিছু নেই। আমার তো আছে।
কনে পক্ষের লোকজন এর শরীরে এমনিতেই রাগ উঠে ছিলো তার উপর বরের বাবার এমন কথা শুনে তা চরমে উঠলো। আস্তে আস্তে বর পক্ষের সবার কানেই কথাটা পৌঁছে গেল। বর এই কথা শুনে মুখের উপর থেকে রুমাল সরিয়ে বলে, আমার এই বিয়েটাও ভেঙে গেল! তখন অনেকেই তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বলে কি? বরের এর আগের বিয়েটাও ঠিক হয়ে ভেঙে যায়। সেই মেয়েটাও পালিয়েছিলো তার প্রেমিকের হাত ধরে! তফাত শুধু এই এটা বিয়ের আসর থেকে আর ওটা বিয়ের কয়েক দিন আগে। তাই প্রথম বিয়ে নিয়ে এতো হইচই হয়নি কিন্তু বরের অন্তরে তা দাগ কেটেছিলো।
এদিকে বরপক্ষ ও কনে পক্ষ চরম উত্তেজিত হয়ে মারমুখী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। বরের চাচা ও কনের চাচা তো প্রায় হাতাহাতি শুরু করতে চায়। শুধু তাদের দুজনকে দু’পক্ষের লোক আঁটকে রেখেছে। কনের চাচা চেঁচিয়ে বলছে বংশ মর্যাদা নিয়ে কথা কয়। কতবড় সাহস! মেহমান না হলে আজ এরজন্য চরম মূল্য দিতে হতো। বরের চাচা মুখ ভেঙচিয়ে চোখ রাঙিয়ে জবাব দেয়, আহা! আমার বংশের মর্যাদা কতো। একটা মেয়ে মানুষ করতে পারে না। তাদের আবার বংশের মর্যাদা! বর তা দেখে কাছে গিয়ে বলে বাবা! চাচা! চলেন আমার কপালটাই খারাপ! নয়তো আমার পছন্দ করা মেয়েরাই কেন প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যায়? আর এখানে মারামারি করে কি লাভ! মাঝে থেকে লোক হাসাহাসি করবে। আর ক্ষতি গ্রস্ত হবো আমরা।
বরের চাচা তখন বিয়ের ঘটক সাহেবের উপর গিয়ে পড়ে সব রাগ! কলার চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে, তোমাকে বলেছিলাম ভালে বংশের ভালো একটা মেয়ে দেখতে। আর তুমি কি না আমাদের সাথে দুই নাম্বারি করেছো। তখন তো বলেছিলে এমন বংশ মর্যাদা সম্পন্ন মেয়ে আর দ্বিতীয়টি নেই! মেয়ে সর্ব গুণে গুণান্বিতা! এই তোমার উচ্চ বংশের সর্ব গুণে গুণান্বিতা মেয়ে? ঘটক নিজেকে বাঁচাতে নানান কথা বলতে লাগলো। আমি তো অনেক খুঁজেই বের করে ছিলাম। কিন্তু তলে তলে মেয়ে যে এমন কান্ড করে রেখেছে তা আমি কি করে জানবো বলুন? সেটা তো মেয়ের বাবা-মা,ই জানে না। আমাকে আপনারা মাফ করুন। এই বলে পকেট থেকে টাকা বের করে বলে, এই নিন আপনাদের টাকা! আমার টাকা চাই না। খাটাখাটুনি আমার বৃথাই যাক তবুও জীবনটা বাঁচুক।
বরের বাবা কাছে এসে বলে, টাকা না হয় ফিরিয়ে দিলে কিন্তু আমাদের মান সম্মান কে ফিরিয়ে দেবে? এখন খালি হাতে কেমন করে বাড়ি যাবো। কেমন করে এই মুখ লোকের সামনে দেখাবো বল? ঘটক তখন বলে, যদি অভয় দেন তবে একটা কথা বলতে চাই। কি কথা বলে ফেলো? জ্বি আমার কাছে আর একটি মেয়ে আছে খুবই ভালো! কিন্তু একটু গরীব। এদের মতো তাদের এতো টাকা পয়সা নেই। মেয়েকে তারা খুব বেশি একটা কিছু দিতে পারবেনা। কিন্তু মেয়ে একেবারে শান্ত শিষ্ট তার সাথে সব কাজে পটু সুন্দরী। বরের বাবা রেগেমেগে বলেন তুমি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও! তোমার সর্ব গুণে গুণান্বিতা মেয়ে আমার দেখা আছে। শেষে গুনহীনা লজ্জা হীনা মেয়ের দেখা মেলা।
বর পক্ষ চলে যাচ্ছে। ঘটক পিছনে গিয়ে বলে, একবার দেখতে কি দোষ! চলুন না একবার গিয়ে। বরের চাচা বরের বাবার কাছে গিয়ে বলে, ভাইজান! আমাদের মান সম্মান টাকা পয়সা যা যাবার তো গেছেই। চলেন গিয়ে একবার দেখে আসি? বরের বাবা কতক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর বলে, চল গিয়ে দেখে আসি। ছেলেকে তো আর বিয়ে না দিয়ে রাখা যাবেনা। মিতার সৎ মা মিতাকে আজ একেবারে ধুয়ে কেটে ফেলছে। অলক্ষ্মী! অপয়া মেয়ে! জন্মের পর মাকে খেয়েছিস। আর এখন খাচ্ছিস আমার সংসার! আমার হাড় মাংস! তোর জন্য আমার মেয়ের বিয়ে আঁটকে আছে। শুয়ে বসে খেয়ে দিন দিন আইবুড়ো হচ্ছিস। একটা পাত্রও যদি তোকে পছন্দ করতো! তাহলেও মনটাকে শান্তনা দিতে পারতাম।
কম করে হলেও একশো জন এখন পর্যন্ত দেখে গেছে। কেউ তোরে পছন্দ করে নাই। তোর মনে ঘেন্নাপিত্তি বলে কিছু নেই রে? এমন হলে অন্য মেয়েরা গলায় দড়ি দিতো। তোর চোখে সেই রাস্তা পড়ে না! তাহলে তো আমার মেয়ের রাস্তাটা পরিস্কার হয়ে যায়। মিতা চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বলে, কেমন করে পছন্দ করবে? মা! তোমরা তো টাকার বেলায় পিছিয়ে আসো মা! এবার সৎ মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে, হুম! তোর বাবা তো তোর জন্য টাকার বস্তা রেখে দিয়েছেন যে, আমি সেখান থেকে খরচ করবো। কেন টাকা পয়সা ছাড়া কি বিয়ে হয়না? মিতা বলে, কেন বাবার রিটায়ারমেন্টের টাকা আছে না? এবার সৎ মা মিতার চুলের মুঠি ধরে বলে, তা সেই টাকা যদি তোমার বিয়েতে খরচ করি আমরা কি খেয়ে বাঁচবো? কেন টাকা পয়সা ছাড়া কি বিয়ে হয়না! মিতা ককিয়ে উঠে বলে, ছাড়ো মা! ভীষণ লাগছে! সৎ মা হেঁসে বলে তুই আবার ব্যাথাও পাস?
মিতার বাবা বাজার থেকে এসে দেখে বলে, কি করছো মিতার মা? স্বামীর কথায় রেগে উঠে তিনি বলেন, এমন অপয়া মেয়ের মা আমি নই! আচ্ছা ঠিক আছে না হলে তুমি ওর মা। বলে মিতার বাবা! তার যোগ্যও হয়তো তুমি নও।
টাকা পয়সা ছাড়া আজকাল কি সমন্ধ হয়? কেউ যদি টাকার জন্য ওকে বিয়ে না করে এতে ওর কি দোষ? এদিকে আয় মা! তুই আমার কাছে আয়! বাবার জন্যই মিতা এখনো এই সংসারে টিকে আছে। সৎ মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে আবারও। হ্যা গো আহ্লাদ দেখে বাচিনা! টাকা পয়সা দিয়ে বিয়ে দিয়ে নিজেরা না খেয়ে থাকি।আর আমারও তো একটা মেয়ে আছে। তার বিয়েতে টাকা লাগবে না? মিতার বাবা আক্ষেপ করে বলে, সত্যি মেয়েটা আমার অপয়া নয়তো নিজের মা হারিয়ে তোমার মতো সৎ মা কেন তার কপালে এসে জুটলো! সত্যি ও পোড়াকপালি।
এমন সময় ঘটক বাড়িতে প্রবেশ করে বলে, তারাতাড়ি ঘর দুয়ার পরিষ্কার করুন। কেন কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করে মিতার বাবা। আরে একেবারে পুরো বর যাত্রী নিয়ে এসেছি! মানে? ঘটক বলে মানেটা না হয় পরে বুঝতে পারবেন। আগে যা বলছি তাই করুন। কিন্তু এতো লোকের সমাদর আমি এখন কেমন করে করবো? কোন প্রস্তুতি নেই।
ঘটক হেঁসে বলে, তারা আপনার বাড়ির জলও স্পর্শ করবে না। তাদের পেটে আর জায়গা নেই। এখন মহান আল্লাহর কাছে পার্থনা করুন। যাতে আমার মিতা মাকে পছন্দ করে। এই মিতা মেয়েটার জন্য ঘটক অন্তরে কেমন মায়া অনুভব করে। কোন সময় টাকা পয়সা নেয় না। আর পায়ও না! তবুও সে মেয়েটির জন্য একের পর এক পাত্র এনে হাজির করে। পাত্র পক্ষের লোকজন এসে বাড়ি ভরে গেল। বর ও বরের বাবার মিতাকে দেখেই পছন্দ হয়ে গেল। তিনি বললেন মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে! মিতার বাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার আপত্তি না থাকলে এখনই আমরা বিয়ে পড়াতে চাই? দেরি করে কি লাভ?
মিতার বাবাকে ঘটক কিছুটা আগেই বলেছিলো বরপক্ষ সমন্ধে। তাতে তিনি বুঝতে পারলেন এরা অনেক বড়লোক! কিন্তু তিনি তো তাদের সমতুল্য নন! এদের চাহিদা তিনি কি মিটাতে পারবেন? তাই বললেন, আমি গরীব মানুষ আপনারা যা চাইবেন তা তো আমি দিতে পারবোনা। বরের বাবা বললেন, তাহলে কেমন করে আর বিয়ে হবে বলুন ?আমি যা চাইবো তাই যদি আপনি দিতে না পারেন! মিতার বাবার মুখটা ছোট হয়ে গেল। বরের বাবা বরকে বললো, চলে আয়! বর জিজ্ঞেস করে কেন বাবা? শুনলি না আমি যা চাইবো তিনি তা দিতে পারবেনা। তাহলে কেমন করে বিয়ে হবে? যারা এই সামান্য চাওয়া পূরণ করতে পারবেনা। তাদের সাথে কেমন করে সমন্ধ হয়।
বর একটু মন খারাপ করে জিজ্ঞেস করে কি তোমার চাওয়া বাবা? আমাদের তো টাকা পয়সার অভাব নেই বাবা! বরের বাবা হেঁসে বলে, আমি তো টাকা চায়নি। বর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে তবে কি তো তোমার চাওয়া? তিনি মিটিমিটি হেঁসে বলেন, মিতা মা কে আমার পুত্রের বউ করে পেতে চাই। তাই তো তিনি দিতে পারবেনা বলে দিলেন। এই কথা শুনে মিতার বাবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো, আমি সে কথা বলিনি। টাকা পয়সার কথা বলছিলাম। মেয়েকে দেবোনা তো কি দেবো বেয়াই সাহেব। বরের বাবা হাহা করে হেঁসে বলে, টাকা পয়সা তো আমার আছেই। শুধু ঘরে একটা পয়মন্ত বউ নেই! তবে হ্যা টাকা পয়সা না দিলেও কথা নেই কিন্তু মেয়েকে কিন্তু ঘনঘন নাইয়োর দিতে পারবোনা। আমার ঘরের বউ পরের বাড়ি এসে পড়ে থাকুক তা কিন্তু আমি মানবোনা।
মিতার বাবা মিতার সৎ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, নিয়ে যান। মেয়েটা আমার এখান থেকে গেলে বেঁচে যায়।আর ওর জন্য কাঁদার মতো কেউ নেই। এই অধম ছাড়া কেউ ওর আপন কেউ নেই। আমি না হয় মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসবো। বরের বাবা বলে সেই ভালো কথা। সেই রাতেই মিতার বিয়ে হয়ে গেল। বরপক্ষ তারাতাড়ি বেড়িয়ে পড়লো মিতাকে নিয়ে। মেয়ের চলে যাওয়া দেখে বাবা শুধু কয়েক ফোঁটা আনন্দের অশ্রু বিসর্জন করলেন।
গল্পের বিষয়:
গল্প