ঘটনা এবং ঘটনা

ঘটনা এবং ঘটনা
বিশ্বাস করেন ভাইরা , আমি এই মাইয়ার শরীর ছুঁইয়াও দেখি নাই। এই মাইয়া মিথ্যা কথা কইতাছে। বাস থেকে নামতেই বাসস্টপের ঐ পাশের একটা জটলা থেকে এই মৃদু বাক্যটা কানে এসে পৌঁছলো। কৌতূহলী হয়ে সে দিকে পা বাড়ালাম। ভিড়ের কাছে গিয়ে যা শুনতে পেলাম তা শুনে আমার শরীরের শীতল রক্ত গরম হয়ে গেল , রাগে হয়তো আমার চোখগুলোও লাল হয়ে গিয়েছিল কিন্তু আয়নার অভাবে তা বুঝতে পারলাম না, নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পুরুষ সত্ত্বাটাও জেগে উঠলো। ঘটনাটা হলো, যেই লোকটাকে সকলে মিলে গণধোলাই দিচ্ছে সেই লোকটা একটা মলেস্টকারী।
বাসের মধ্যে একটা মেয়ের গায়ে খারাপ ভাবে হাত দেওয়ার অভিযোগে বাস থেকে নিচে নামানো হয় এবং এরপরেই এই গণধোলাই। লোকটা মধ্যবয়সী, বয়স আনুমানিক ৫০ এর বেশি। এই বয়সে, এই কাজ! আমাদের সমাজের এটা হলো কী ? মেয়েরা কী কোনো জায়গায় নিরাপদ না? মেয়েরা যেখানেই যাবে এমন দুই-একটা পুরুষ রূপী পশু তাদের পিছু নেবে। না! আর নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। এই পশুটাকে সবার সাথে দু-একটা চড়-ঘুষি না মারলে নিজের জাতটাই যাবে দেখছি। ভিড় ঠেলে, ধাক্কা-ধাক্কি করে অনেকক্ষণ চেষ্টা করলাম লোকটার নাগাল পেতে, অন্তত একটা থাপ্পড়তো মারতেই হবে। কিন্তু লোকটার নাগালতো পেলামইনা উল্টো কয়েকজন লোকের পায়ের পারায়, কনুইয়ের গুতায় আমার বেহাল অবস্থা হলো। হতাশ হয়েই জটলা থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ালাম।
এমন একটা ঘটনা, অথচ এতে আমার কোনোই ভূমিকা নেই ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। হ্যা, পুলিশ! যেই মেয়েটা মলেস্টের শিকার হয়েছে সেই মেয়েটা তখনও জটলার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরেও অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাকে সাহস, অনুপ্রেরণা দিচ্ছে, কেউ কেউ ঘটনাটা মেয়ের কাছ থেকে শুনে পুনরায় যাচাই করেও নিচ্ছে। আমি সেখানে গিয়ে উচ্চস্বরে বললাম, ভাইরা পুলিশরে একটা। আর কিছু বলতে পারলাম না। কারণ আমাকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না। এত মানুষের ভিড়ে আমি যেন কেউ না। অথচ অনেক মানুষই নানান কথা বলছে, তাদের কথা বাকি সবাই আগ্রহ ভরে শুনছে। আমি মানুষের আকর্ষণ কাড়তে ব্যর্থ। আর কী করার! ধীরও পায়ে উদাস হয়ে পাশের একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে চা দিতে বললাম। মামা, দুধ চা , নাকি রং চা দিমু? একটা দিলেই হইলো, চিনি বেশি করে দিয়েন।
দোকানদার মামা চা বানাতে বানাতে এক নজরে আমায় দেখলেন। চা খাওয়ার অভ্যাস আমার নেই। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে এক কাপ চা খেয়ে জিহ্বা পুড়িয়ে যদি একটু রাগটা কমে! ভদ্রলোক হওয়ায় সিগারেটটা এখনও শুরু করিনি। নাহয় সিগারেটের ধুঁয়া ফুকা হতো এই পরিস্থিতির সাথে সবচেয়ে মানানসই। মানুষের কতটা অধঃপতন ঘটেছে! ছি! ছি! ছি! জটলার দিকে তাকালাম, জটলা না কমলেও ওখানের উত্তেজনা আর চেঁচামেচি ধীরে ধীরে বেশ কমে এসেছে। লোকেরা কী আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে! সেই মলেস্ট করা লোকটা মলিন মুখে ওখানেই বসে মাথা নিচু করে আছেন। এখন অবশ্য এক পাশ দিয়ে গিয়ে লোকটাকে একটা চড়-থাপ্পড় মারার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু লোকের সাথে মারা আর একা একা মারার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। সাহসে ঠিক কুলিয়ে উঠছে না। হঠাৎই কিছুটা শান্ত পরিবেশ যেন আবার উত্তেজিত হয়ে উঠলো, চেঁচামেচির শব্দ বেড়ে গেছে। এবার চেঁচামেচি করছে সবাই মেয়েটাকে নিয়ে। সেই লোকটা করুন মুখে সেখানেই বসে আছে।
মানে কী , দোষ করলো পুরুষ আর বকা খাচ্ছে নারী? এবার কী মেয়েটার পোশাক নিয়ে সমস্যা দাড় করলো নাকি তারা! না, এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের দেশের মানুষের মন-মানসিকতা দেখছি কোনোদিন উন্নতি হবে না। এবার আমাকেই কিছু একটা করতে হয়। দ্রুত ছুটে গেলাম আবার জটলার দিকে। গিয়ে যা শুনলাম, এতো ঘটনার ভেতর আরেক ঘটনা! আসলে এখানে মলেস্টের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। যেই মেয়েটাকে মলেস্টের শিকার বলে এতক্ষন সবাই শান্তনা দিচ্ছিল আর যেই লোকটাকে এতক্ষণ এই মেয়েটাকে মলেস্ট করার অপরাধে গণধোলাই দেয়া হচ্ছিল তারা কোনো অপরিচিত নয়। তারা বাপ-মেয়ে। ঘটনা হচ্ছে তারা মানিকগঞ্জ এর একটা গ্রামের বাসিন্দা। মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছিল গত সপ্তাহে , কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই বিয়ে করতে চাচ্ছিলো না। তার বাবা বিয়ের জন্য তাকে চাপ দিতে থাকে।
এবং চাপ সহ্য না করতে পেরে সে পালিয়ে আসে শহরে। তার বাবাও তাকে খুঁজতে শহরে চলে আসেন। আর এরমধ্যেই এই বাসে লোকটার সঙ্গে তার মেয়ের দেখা হয়। লোকটা বকাবকি করে তার সঙ্গে গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা বলতেই , মেয়েটা নিজেকে বাঁচাতে চেঁচিয়ে উঠে এবং সবাইকে বলে এই লোকটা আগন্তুক এবং তার সঙ্গে খারাপ কাজ করার চেষ্টা করেছে। মেয়েটা হয়তো জানতো না এর ফল কী হতে পারে। পাবলিক পাবলিকের কাজ করা শুরু করে দিল, বাসস্টপে নামিয়ে। এরপরের ঘটনা আমরা সবাই জানি। এবার লোকের বিস্ময় একেবারে আকাশ ছুঁয়া। ছি! ছি! ছি! এত জঘন্য মেয়ে মানুষও এই পৃথিবীতে আছে! যে কি না নিজের জন্মদাতা পিতার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করে নিজের স্বার্থে , নিজের রাগ-ক্ষোভ ঝাড়তে। এইসব মেয়েদেরতো গলায় ফাঁস দিয়ে মরা উচিত। আমার মাথা পুরোই আগুন হয়ে গেলো।
মনে মনে বললাম, আজ মেয়ে বলে, নাইলে দেখে নিতাম এই খবিশটাকে। নিজেই নিজেকে সাবাশ দিলাম ওই নিরোপরাধ লোকটার গায়ে আমি হাত তুলিনি বলে। বড়ই বিচক্ষণ কাজ করেছি। মেয়ে বলেই কেউ হাত না তুললেও মুখের আঘাতেই মেয়েটাকে জর্জরিত করে তুলছে সবাই। কী করে পারলে তুমি এমন অসহায় একটা বুড়োবাপকে অমন করে মার খাওয়াতে! আমি অনেক রকম গালিগালাজ জানলেও জনসম্মুখে সেসব বলার অভ্যাস কিংবা সাহস কোনোটাই নেই। তারপরেও নিজের রাগের ওপর কী কারো নিয়ন্ত্রণ থাকে বলুন ? “শালীর ঘরের শালী” বলে একটা গালি দিয়েই ফেললাম। মনটা কিছুটা ঠান্ডা হলো। কিন্তু পুলিশের হাতে এদের সপে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমি তাদের কথাটা বলার চেষ্টা করলাম। এতগুলো লোকের কথার মাঝে আমার কণ্ঠ থেকে বেরুনো শব্দগুলো হাওয়ায় ভেসে গেল। হতাশ হয়ে চায়ের দোকানে ফিরে এলাম। মামা, চাতো ঠাণ্ডা হইয়া গেল। আরেক কাপ বানাইয়া দেই?
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে সেই ঠাণ্ডা চা ই মুখে ঢুকাতে লাগলাম। এখন জিহ্বা পুড়াতে আর ইচ্ছা করছে না।
এবার সেই জটলা কিছুটা কমতে লাগলো। বাবা-মেয়ের বোধহয় মিলমিশও হয়ে গেছে। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। মেয়েটা তার ভুল বুঝতে পেরেছে। মেয়েটা হয়তো গ্রামে গিয়ে এবার ঠান্ডা মাথায় বিয়ে করে ফেলবে বাবার পছন্দের পাত্রকে। কিন্তু গ্রাম পালানো মেয়েকে কে বিয়ে করবে? তাদের মিলনে দুঃখ আর আনন্দ দুই অনুভূতিই জেগে উঠলো আমার মনে। যাক সুন্দর সমাপ্তি। পাবলিকের অনুভূতি আমাকে ছুঁয়েছে মনে করার কারণ নেই। আমার অনুভূতিই যেন পাবলিককে ছুঁয়ে গেল। তারাও মুগ্ধ চোখে বাপ-মেয়ের মিলনে অভিভূত হলো। এবার চা টা শেষ করে বাড়িতে ফেরা যাক। এমন সময় লক্ষ করলাম জটলার জায়গায় আবার উত্তেজনা বিরাজ করছে। গম্ভীর, গভীর উত্তেজনা।
চায়ের কাপ রেখে সেখানে আবার গেলাম। গতবার ঘটনার ভেতরের ঘটনা শুনেছিলাম। এবার সেই ঘটনার ভেতর আরেক ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনার ভেতর ঘটনা, তার ভেতর আরেক ঘটনা! মেয়েটা একটা স্যুটকেস নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, তার বাবা গ্রামের মানুষকে কিছু না জানিয়েই নিজেও আরেকটা স্যুটকেস হাতে বেরিয়ে পড়েন শহরে। বাস থেকে যখন সবাই টেনে হিঁচড়ে সেই লোকটাকে নামাচ্ছিল তখন মেয়েটা বেশ বুদ্ধি করেই নিজের স্যুটকেস আর তার বাপের স্যুটকেস হাতে করেই গাড়ি থেকে নামে এবং সেগুলো রাস্তার পাশেই রাখে। এই জটলা আর এত কাণ্ডের ভেতরে সেদিকে আর নজর দিতে পারেনি মেয়েটা আর এই জটলার সুযোগে কেউ একজন সেগুলো বাগিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে । এই মেয়ে-বাপের সমস্ত অর্থ-কড়ি তাতেই ছিল। এবার তারা গ্রামে ফিরে যাবে কী করে? আমার বড়ই মায়া হলো। কিছু একটা করা দরকার।
কোনো একটা আইডিয়া যাতে তারা বাপ-মেয়ে এই বিপদ থেকে রক্ষা পায়। ভালোমতো গ্রামে পৌঁছতে পারে। আমি সবাইকে বলার চেষ্টা করলাম, পুলিশে একটা কল করা বড়ই জ। ধুর, ছাই ! আমার কথা কেউ কানেই তোলে না! সবার আগ্রহ হলো আরেক লোককে ঘিরে। সে সবার কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করছে এই বাপ-মেয়েকে গ্রামে ফিরে যেতে সাহায্য করার জন্য। বাহ! এই রকম একটা ঘটনায় আমার কোনো ভূমিকা থাকবে না , তা কী হয়? নিজের শার্টের পকেটে থাকা অবশিষ্ট কচকচা দশ টাকার নোটটা বাড়িয়ে দিলাম। এইতো দায়িত্ব চুকে গেল। টাকা তোলার এই আইডিয়াটা আমার মাথা থেকে বেরুনো উচিত ছিল। বাপ-মেয়েকে সব পাবলিক নিজ দায়িত্ব বোধ থেকে বাসে উঠিয়ে দিল। নিশ্চিন্ত এবার! চায়ের দোকানে চায়ের কাপের শেষটা শেষ করেই ঘটনা থেকে আমার বিদায়।
চায়ের দোকানটাতে বসে ঠান্ডা চায়ের কাপে আবার মুখ দিলাম। মামা, আপনি কী নতুন নতুন বাস-স্ট্যান্ডে আসলেন নাকি? এইরকম কেঁচাল দুই-একটা রোজই লাগে এইখানে। এইগুলাতে এত আগ্রহ দেখাই লাভ নাই। রোজরোজ কেঁচাল লাগলে কী , আমার সামনে তো এই প্রথম এমন কেঁচাল দেখলাম। একজন চা বিক্রেতা এমন একটা ঘটনায় আগ্রহ বোধ করবে না এটা ভাবতেই পারছিলাম না। কেঁচালের আগা-গোড়া সবটা শুনালাম মামাকে। মামার চোখটা এবার জ্বল-জ্বল করে উঠলো।
এত কাণ্ড ঘটলো, আর আমি কিছুই বুঝলাম না! এইরকম কাণ্ডতো রোজ রোজ ঘটে না মামা। আহা, সাক্ষী থাকতে পারলাম না শুইনাই শান্তি। কী নিমক-হারাম মাইয়া। কিয়ামতের দেখি আর দেরি নাই! কিছুটা গর্ব হলো নিজের মধ্যে এমন একটা ঘটনার সাক্ষী হতে পারে। অবশ্য ঘটনায় আমার ভূমিকা তেমন নেই দেখে কিছুটা হতাশও হলাম। সেই মেয়ে আর বাপ সেখানে না থাকলেও আবার উত্তেজনা শুরু হলো সেই জায়গাটিকে ঘিরে। ঘটনাতো শেষ। আবার কী হলো? আমার আর মামা দুজনের চোখই জ্বলজ্বল করে উঠলো কৌতূহলে। এবার আর ঘটনা জানতে আমাকে উঠে যেতে হলো না। একজন লোককে চেঁচিয়ে কথা বলতে শোনা গেল, এতক্ষন যা ঘটলো সবই নাটক আছিল।
ওরা বাপ-মাইয়া না। আমাগোরে বোকা বানাইয়া পকেট মাইর চক্র আমাগো পকেট কাটছে। পুলিশে খবর দেন কেউ। অনেক লোক আবার জড়ো হলো সেখানে। পকেট কাঁটা যাওয়া কয়েকজন ভদ্রলোক হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এতো দেখি ঘটনার ভেতর ঘটনা, তার ভেতর আরেক ঘটনা, সেই ঘটনার ভেতর আবার আরেক ঘটনা। টুইস্ট আর টুইস্ট। নিজেও আৎকে উঠে প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত দিলাম। আলহামদুলিল্লাহ , মানিব্যাগ ঠিক ঠাক আছে। হঠাৎ চাওয়ালা মামা চেচিয়ে উঠলো, আয়হায় মামা! আপনের পকেট কাটলো কে? নিচের দিকে তাকাতেই দেখলাম বা-পাশের পকেটটা ঝুলছে। আল্লাহ! আমার মোবাইল!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত