বিকেলে বাড়ির উঠানে পা দিয়ে নাজিয়া বুঝতে পারল আজ বাড়ির আবহাওয়া তার জন্য অনুকূল নেই সবকিছু থমথমে হয়ে আছে।নাজিয়া বাড়িতে ঢুকতেই দেখল আসিফ বারান্দায় একটা মোড়ার উপর বসে আছে আর পাশে চৌকিতে তার শ্বাশুড়ী জবেদা বানু মুখে রাগ নিয়ে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।নাজিয়া স্বামী আর শ্বাশুড়ী কে উপেক্ষা করে জল খাওয়ার জন্য রান্নাঘরের দিকে যেতেই আসিফ চেঁচিয়ে বলল দাঁড়াও নাজিয়া বলল আমার জল তেষ্টা পেয়েছে জল খেয়ে তোমার সাথে কথা বলব।
নাজিয়া জল খেয়ে আসিফের সামনে দাঁড়িয়ে বলল বলো কি বলতে চাও? আসিফ বলল তুমি সকালে মাকে কি বলেছো সফুরার বিয়ের ব্যাপারে।নাজিয়ার মনে পড়ল সকালে যখন সফুরা নাস্তা বানাচ্ছিল তখন সে বলেছিল আগামীকাল তাকে পাএপক্ষ দেখতে আসবে ।পাশে শ্বাশুড়ী জবেদা বানু বসে জাঁতি দিয়ে সুপারি কাটছিল ছেলেটা কে জিজ্ঞেস করতে নাজিয়া পাশের গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব মনসুর আলমের কথা বলেছিল। নাজিয়া মনে করে “ওহ “এই কথা বলে একটু হেসে পাশে থাকা চেয়ারে বসে পড়ল।আসিফের বোন সফুরা এসে দাঁড়াল দরজার একপাশে।নাজিয়া বলল তোমার মা যা বলেছে সেটা তুমি শুনেছো নিশ্চয় আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেনো?
আসিফ রেগে মোড়া থেকে উঠে এসে নাজিয়ার সামনে দাঁড়াল চেঁচিয়ে বলল তোমার সাহস কি করে হয় একটা বুড়োর সাথে আমার বোনের সম্বন্ধ ঠিক করো।পাশ থেকে জবেদা বানু চেঁচিয়ে বলে উঠল তোমার বাবার খায় আমার মেয়ে সে তার ভাইয়ের খায় তোমার এতো সমস্যা কেনো।আমার সাদাসিধে মেয়েটা সংসারে কত খাটে সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধী আর তুমি তো ঘুরে ঘুরে সময় কাটাও তবুও তোমার শান্তি নেই। নাজিয়া শ্বাশুড়ীর কথার কোনো উওর না দিয়ে আসিফ কে বলল তোমারদের সমস্যা কোথায় সফুরার বিয়ে ঠিক করেছি না কোনো বুড়োর সাথে ঠিক করেছি আগে সেটা বলো। জবেদা বানু রাগে হিসহিস করে বলল এই তুই এর কথা একদম শুনবি না ।আসিফ তুমি শান্ত হয়ে নিজের জায়গায় বসো তোমার মা কি বলেছে আমার জানা নেই আমি আমার মতো করে চিন্তা করেছি সফুরার জন্য।
আসিফ বলল আগে তুমি আমার কথার উওর দাও আর সফুরার দাদা এখনো বেঁচে আছে তার ভবিষ্যৎ ভাবার জন্য তোমাকে কে বলেছে তার জন্য পাএ দেখতে।নাজিয়া এবার আসিফের সামনে দাঁড়িয়ে বলল তোমার বোন যে তালাক প্রাপ্ত সাথে তার যে বছর তিনেকের একটা ছেলে আছে সেটা তোমরা ভুলে যাওনি নিশ্চয়? আজ দুইবছর সফুরা এখানে আছে কোথায় তো দেখলাম না তার মা আর দাদার চিন্তা মেয়ের বিয়ের জন্য।সফুরা আড়াল থেকে বলে উঠল আজ আমার এই অবস্থা তাই এতো অপমান হচ্ছে যদি ভাল অবস্থা থাকত তাহলে এখানে থুথু ফেলতে আসতাম না।
জবেদা বানু বলে উঠল তার মা আর দাদার বদলে তোমার দরদ এতো কেনো উৎলিয়ে উঠছে আর তুই এখনো এর কথা শুনছিস গালে একটা চড় মেরে ঘর থেকে বের কর তাড়াতাড়ি।নাজিয়া এবার রেগে উঠে বলল আর সেইসব দিন নেই যখন আপনার ভুলভাল কথা শুনে আপনার ছেলে আমার গায়ে হাত তুলবে ,হ্যাঁ আমি ওপাড়ার মনসুর আলমের সাথে বিয়ে ঠিক করেছি সফুরার তো কি হয়েছে? নাজিয়া এবার আসিফের দিকে ঘুরে বলল তুমি কি কাজ করো একটা ফ্যাক্টরিতে সামান্য বেতনে ম্যানেজারের বেতন কত সেটা আর বলার দরকার নেই নিশ্চয়। কোনোরকম সংসারটা চলে সাথে পেট ৬টা সেইসব খেয়াল আছে কারোর।
নাজিয়া জবেদা বানুর দিকে তাকিয়ে বলল ,আপনার সাদাসিধে মেয়ে যে কত বড় গুণের অধিকারীনি সেটা আমার জানা আছে আর সংসারে থাকতে গেলে কাজ করে খেতে হয়।আমি যে একটা কে.জি স্কুলে পড়াই সেটা নিশ্চয় ভুলে যাননি আপনার ছেলের একার টাকায় এতো জনের পেটে ভাত পড়ে না।আমি বিয়ের পর এই বাড়িতে মুখ বুজে গাধার খাটুনি খাটতাম ঠিক সময়ে খেতে পেতাম না সেটা তো কোনোদিন বলেন নি ।
আর যেদিন সফুরা আসত তার বরের সেবা করতে গিয়ে যা রান্না হতো সেগুলি ঠিক মতো আমার পেটে পড়ত না অথচ আপনার এই সাদাসিধে মেয়ে রান্নাঘরে ভুলেও ঢুকত না আর একটু যদি তরকারি খারাপ হতো আমার বাবার বংশ উদ্ধার করতেন মা মেয়ে মিলে আর সাথে আমার স্বামীকেও আমার বিপক্ষে করতেন আর ও না বুঝে আমার গায়ে হাত তুলত।সব কিছু ঠিক হয় সফুরা যখন এই বাড়ি থেকে একদমের মতো চলে যায় আর আমি স্কুলে পড়াতে যাই সেই সব কষ্টের দিন আমি ভুলিনি। সফুরা যখন পালিয়ে বিয়ে করে তখন বাবা আর দাদা নিতে গেলে কি রকম গালাগাল করেছিল আমার তা মনে আছে।এবার সফুরার দিকে তাকিয়ে নাজিয়া বলল ,আর শোনো সফুরা থুতু টা মাটিতে ফেলো না কারন পরে তোমাকে সেটা চাটতে হবে।পালিয়ে বিয়ে করেও পণ স্বরূপ তিনলক্ষ টাকা দিতে হয়েছিল সাথে গহনা আর বাকি সব ঘরয়ালি জিনিস।
আসিফ তোমার বাবা মেয়ের বিয়ে দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিল যা জমি ছিল সব সফুরার পেছনে খরচ হয়ে গেছে।বাকি আমাকে তখন তুমি আর তোমার মা চাপ দাও আরো টাকার জন্য আমার বাবা শেষ স্বম্বল ধানি জমি বিক্রি করে মেয়ের সংসার বাঁচাতে।আমার বাবা একবেলা এসে এই বাড়িতে শান্তি পায়নি তোমার মা বোনের কটূ কথা আর আমার সম্বন্ধে বাজে কথা শুনে কিছু না খেয়ে চোখে জল নিয়ে যেত। তাও যদি তোমার বোনের মন ভরত আমার তো এও মনে আছে বিয়ের পর সফুরা নিজের বাড়ি কম এই বাড়িতে বেশি পড়ে থাকত আর সারাদিন তোমার মায়ের কানে আমার নামে কূটনামী ভরত।
বিয়ের তিনবছর পরও যখন আমার কোনো বাচ্চা হয়নি তখন সফুরা আর তোমার মা মিলে তোমার দ্বিতীয় বিয়ের জন্য চুপি চুপি মেয়ে দেখে আসে।তোমার মা সবসময় মেয়েকে উসকানি দিত তার শ্বশুর বাড়ির সবার জন্য মনে বিষ ঢুকিয়ে যার ফল স্বরূপ ছেলে বিদেশে গিয়ে তোমার বোনকে তালাক দেয়।তোমার বোনের মুখরা স্বভাব আর এই বড় বড় কথার জন্য তার সংসার আর হলো না।তাও যদি একটু চেতনা হতো বিয়ের আগে বলে গিয়েছিল এই বাড়িতে আর থুতু ফেলতে আসবে না আবার সেই একই কথা নির্লজ্জের মতো ছিঃ তুমি কি এখনো মানুষ হলে না সফুরা ভালবেসে যাকে বিয়ে করলে সেই তোমার মুখে থুতু ফেলে গেছে তাও তোমার একটুও অনুশোচনা বোধ নেই। কারোর সাথে খারাপ করলে তোমার কাছে কিন্তু সেটা ফিরে আসবে মারাত্মক ভাবে মনে রেখো কিন্তু এটা সফুরা মুখ নিচু করল নাজিয়ার কথায়।
ভাল থাকুক আমার শ্বশুর তোমার বাবা যার জন্য তোমার দ্বিতীয় বিয়েটা আর হয়নি। আমার শ্বশুর মশাইকে আমি কোনোদিন অবহেলা করব না উনি যতই অসুস্থ হোন না কেনো। আজ তোমার বাবা কেনো অসুস্থ সেটা নিশ্চয় জানো? সফুরার স্বামীর বিদেশ যাওয়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে বেচারা স্ট্রোক করে প্যারলাইজসড।জবেদা বানু বলে উঠল তাই আজ তুমি তোমার বদলা নিচ্ছো আমাদের উপর থেকে? নাজিয়া বলল বদলা নেওয়ার থাকলে কবেই নিতাম যেদিন সফুরা হাতে করে তালাকের কাগজ নিয়ে আর ছোট্ট বাসিত কে নিয়ে খালি হাতে এক কাপড়ে এই ঘরে আসে তখন তাকে দুর দুর করে তাড়িয়ে না দিয়ে ঘরে তুলেছি এটাই বড় বুঝলেন।আর আপনার গুনধর জামাই বিদেশ যাওয়ার আগে আপনার মেয়ের সব গহণা বিক্রি করে চলে যায় কিছু আছে ওর জন্য। আজ সংসারের সমস্ত ভার আসিফের কাঁধে আপনার ,বাবার মাসের ওষুধ কিনতে টাকা অর্ধেক শেষ।যেদিন থেকে আপনার মেয়ে এসেছে মাছ মাংস ছাড়া নিরামিষ তার মুখে রোচে না।
তারপর আমাদের নিজের একটা পরিবার আছে আমাদের ছেলের কি কোনো ভবিষ্যৎ নেই সে কি আসিফের কেউ নয়? আর বছর খানেক পর সফুরার ছেলে স্কুলে যাবে তার খরচ কে বহন করবে আর সফুরার বয়স কত মাএ ৩০ তার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে নাকি? হ্যাঁ হয়তো পাএ বয়েসে অনেক বড়। আসিফ একবার ভেবে দেখো একটা নিরাপওা পাওয়া যাবে তুমিও নিশ্চিত হতে পারবে। আমাদের এতো আয় নেই যে দুহাত দিয়ে খরচ করব।আর আসিফ তুমি বলতো এখন কেউ যদি তোমার বোনকে বিয়ে করে তাহলে কি তার ছেলের সব ভার নেবে ছেলে কে এখানেই ছেড়ে যাবে তার খরচ কে দেবে? কিন্তু মনসুর আলম নেবে বাসিতের পড়ার খরচ এমন কি সফুরার নামে একবিঘে জমিও লিখবে দুজনরে ভবিষ্যৎ এর জন্য আর এটা বিয়ে হওয়ার আগেই হবে।মনসুর আলমের ছেলে মেয়েদের এই বিয়েতে কোনো আপওি নেই তাদের সময় নেই বাবার সেবা করার তাই তারাই উদ্যোগী হয়ে এই বিয়েটা দিতে চাচ্ছে।
মানুষ হিসেবে মনসুর আলম যথেষ্ট ভাল এটা দুই পাড়ার সকলেই জানে আর যদি এই বিয়েতে তোমার মত না থাকে তাহলে একমাসের মধ্যে ওর জন্য ভাল ছেলে খুঁজে বিয়ে দাও।আমি আর এই বাড়িতে সফুরার ভাত রাখতে চাচ্ছি না।জবেদা বানু বলে উঠল আমার মেয়ে এইখানে থাকবে তোমার নয় ওর মায়ের পেটের দাদার টাকায় খাবে তোমার বোনের সাথে এটা হলে করতে পারতে এইরকম ?আসিফ তখন রেগে উঠে বলল আহ!! মা থামো নাজিয়া যা বলেছে আমি এতে রাজি।আমার মন বলে সফুরার আরও একটা সংসার হোক সফুরা চমকে উঠল আসিফের কথা শুনে বলল কিন্তু দাদা ।আসিফ বলল কোনো কিন্তু নয় তুই বিয়ের জন্য তৈরি হ যদি সেইরকম হয় তাহলে কালকে বিয়ে দিয়ে দেবো।আমিও আর তোদের খরচ নিতে পারছি না আমার চাকরির হাল সেইরকম নয় যে আরো কয়েক বছর এইভাবে চলতে পারব আর দয়া করে মন দিয়ে সংসার টা করিস।জবেদা বানু থম মেরে গেলেন ছেলের কথা শুনে আর নাজিয়া হাসতে হাসতে রুমে ঢুকে গেল।
গল্পের বিষয়:
গল্প