ইতু কোথায় যাচ্ছ? ঐদিকে তো ছাদ শেষ, ঐদিকে যেও না। আহা রাফি তুমি আমায় ছুঁয়ে দেখাও পারলে। তুমি আমাকে ভালোবেসে থাকলে দাঁড়িয়ে যাও ইতু! ইতু রাফির কথা শুনে পেছনে তাকালো, রাফি দেখলো তার চোখ ভর্তি পানি।
“রাফি তোমায় ছাড়া আমি খুব কষ্টে আছি। করুণ কণ্ঠে বললো ইতু। আমি তোমার কাছে থাকতে চাই রাফি”
আমি জানি ইতু তুমি আমায় ছাড়া ভালো নেই বিশ্বাস করো আমিও তোমায় ছাড়া আমি এক মুহূর্ত ভালো নেই। এবার তোমায় আর কোথাও যেতে দেবো না, তুমি আমার কাছেই থাকবে।” এই বলে রাফি আস্তে আস্তে সামনে এগোতে লাগলো আর ইতু আস্তে আস্তে পেছনে যেতে লাগলো। ইতু ওর হাত দুটি রাফির দিকে বাড়িয়ে দিল কিন্তু রাফি ওর হাত দুটো ধরার আগেই ইতু ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেল। রাফি ওকে ধরার জন্য ছাদ থেকে লাফ দিল তারপর সব অন্ধকার হয়ে গেল।
এই দুঃস্বপ্ন দেখে রাফি লাফ দিয়ে উঠলো, সে দেখলো সে তার রুমেই আছে আর তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। তারপর সে আস্তে আস্তে তার খাট থেকে নেমে টয়লেটে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসলো। রুমে এসে দেখলো রাত তিনটা বাজে। সে বুঝে গেল আজ রাতে তার আর ঘুম হবে না। সে খাটের সাথে হেলান দিয়ে ডুব দিল পুরোনো স্মৃতির মাঝে।
রাফি তুই কি পানির ফিল্টার টা নিতে পারবি? আহা আব্বু তুমি কি যে বলো না! এইটুকু একটা পানির ফিল্টার আমি আবার নিতে পারবো না, দাও এটা আমার কাছে দাও। সত্যি পারবি তো? আরে হ্যাঁ হ্যাঁ পারবো দাও। তারপর রাফি সাবধানে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলো। আর তখনই ইতুর সাথে চোখাচোখি হয়। সে ইতুর কাজল কালো চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে ভাবতে থাকে এই মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে হাজার বছর কাটিয়ে দেওয়া যাবে।
ইতু দেখলো অপরিচিত ছেলেটি তার চোখের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে, এটা দেখে তার খুব বিরক্ত লাগলো তাই সে আঙ্গুল দিয়ে চুটকি বাজিয়ে বললো, এই যে আপনি সরে দাঁড়ান আমি নিচে নামবো। ইতুর কথাটি শুনে রাফির হুশ ফেরে আর সে খুব লজ্জায় পরে যায়, সে ইতুকে সাইড দিয়ে দাঁড়ায়। ইতু বির বির করতে করতে নিচে নেমে যায়। তারপর নতুন বাসা গোছাতে গোছাতে রাফির সারাটাদিন পার হয়ে যায়। রাতে সব কাজ শেষ করে ঘুমাতে গেলে সেই অচেনা হরিণী চোখের মেয়েটিকে তার খুব মনে পড়ে। তার কাজল কালো চোখের কথা ভাবতেই তার মনে যেন খুব ভালোলাগা কাজ করে। এমনটা কেন হচ্ছে সে বুঝতে পারে না, সে ইউনিভার্সিটিতে অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছে কিন্তু এই মেয়েটার মত কাউকে তার মনে ধরেনি। সে ভাবতে লাগলো সেই মেয়েটি যদি এই বাড়িতেই থেকে থাকে তাহলে তার সাথে অবশ্যই পরিচিত হতে হবে।
এগুলো ভাবতে ভাবতেই তার চোখে রাজ্যের ঘুম ভর করলো। পরের দিন সে ইউনিভার্সিটিতে বসে তার বেস্ট ফ্রেন্ড নিলয় এর সাথে আড্ডা দিচ্ছিল তখন সে হুট করেই তার দেখা অপরিচিত মেয়েটির কথা নিলয়কে বলে। নিলয় সবটা শুনে বলে,” এইত মামা তোমার জীবনেও প্রেম এসেছে। আমি বলি কি শোন তুই ভালো ভেবে খোঁজ নে যে এই মেয়েটি তোর প্রতিবেশী কিনা। তারপর যদি সে তোর প্রতিবেশী হয়ে থাকে তাহলে তো তোমার পথ ক্লিয়ার।” আবির হতাশা ভরা কণ্ঠে বলে,” ধর মেনে নিলাম সে আমার প্রতিবেশী কিন্তু তারপর যদি শুনি তার প্রেমিক আছে তখন?” নিলয় রাফির কাঁধে হাত রেখে বললো,” আরে ভাই পরের টা পরে ভাবা যাবে আর আগেই এত হতাশ হয়ে পরলে কিভাবে হবে? বি কনফিডেন্ট।” রাফি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। আচ্ছা রাফি এখন ক্লাসে চল নাহলে দেরি হয়ে যাবে।
তারপর ক্লাস শেষ করে রাফি যখন বাসায় আসছিলো তখন তার নজর যায় তিনতলার বারান্দার দিকে সে দেখতে পায় সেই অপরিচিত রমণী কিছু লাভ বার্ডস দের খাবার খাওয়াচ্ছে। এটা দেখে তার খুবই ভালো লাগে যে মেয়েটি তার বাড়িতেই থাকে। সে খুশীতে গুণ গুণ করতে করতে বাসায় যায়। দুপুরে খাবার টেবিলে তার মা তাকে খুশি দেখে জিজ্ঞাসা করলো,” কিরে আজ এত খুশি কেন? ব্যাপার টা কি বলতো?” রাফি তার মায়ের কথায় থতমত খেয়ে বলে, কোথায় এত খুশি কিযে বলো না। বা’রে তুই দেখি মিটি মিটি হাসছিস আবার গুণ গুণ করে গান ও গাইছিস কোনো খুশির ব্যাপার তো অবশ্যই আছে, যদি আমাকে না বলতে চাস তাহলে থাক। রাফি কথা ঘুরানোর জন্য বললো,” মা অনেক ক্ষিদে পেয়েছে প্লিজ তাড়াতাড়ি ভাত দাও।” তার মা বুঝতে পারলো যে ব্যাপার টা কিছুটা গোপনীয় তাই সে বলতে চাচ্ছে না, তাই সে আর প্রশ্ন করলো না রাফিকে ভাত বেড়ে দিয়ে নিজেও খেতে লাগলো। ভাত খাবার পর সে রান্না ঘরে বসে থালা বাসন ধুতে ছিল তখন দেখলো রাফি তার পাশ থেকে ঘুর ঘুর করছে।
তাই সে রাফিকে প্রশ্ন করলো,” কিছু বলবি?” রাফি তার প্রশ্ন শুনে বোকা হাসি দিয়ে বললো,” কই না তো, কি বলবো আবার।” “কিছু যদি নাই বলিস তাহলে এভাবে পাশ দিয়ে ঘুর ঘুর করছিস কেন কিছু বলার থাকলে বল আর না বলার থাকলে নিজের রুমে যা আমাকে কাজ করতে দে।” তার কথা তার কথা শুনে রাফি কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে হনহনিয়ে তার রুমের দিকে চলে গেল। একটুপর সে আবার আসলো তারপর বলতে লাগলো, “আচ্ছা মা আমাদের তিনতলায় কারা থাকে তুমি কি জানো?” তার মা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলেন,”তিনতলায় কারা থাকে তা জেনে তোর লাভ কি?” রাফি মনে মনে ভাবলো এখন যদি কোনো ভালো বাহানা দিতে না পারে তাহলে সে ধরা খেয়ে যাবে তাই সে বোকা হাসি দিয়ে বললো,” আমার আবার কিসের লাভ! বাহির থেকে আসার সময় দেখলাম তিন তালার বারান্দা জুড়ে সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ আবার তিন চার জোড়া লাভ বার্ড। এগুলো দেখে মনে হলো তিন তালায় যারা থাকে তারা মনে হয় অনেক সৌখিন।
তাই কারা থাকে তা জানার জন্য একটু কৌতূহল জাগলো এই আর কি।” রাফির কথা শুনে তার মা বললেন,”সৌখিন তো বটেই, তিন তলায় আমাদের বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক তার পরিবার নিয়ে থাকেন। গাছ পালার প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে।” তার কথা শুনে রাফি মনে মনে ভাবতে লাগলো, মিস অপরিচিতা নিশ্চই বাড়িওয়ালার মেয়েই হবে। সে বড়লোকের মেয়ে আর আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সে কি আমায় পাত্তা দিবে।
রাফির মা আমেনা বেগম ছেলের ভাবান্তর চেহারা দেখে বললেন,কিরে এত কি ভাবছিস? রাফি মুখ ফসকে বলে ফেলল, ভাবছি সে কি আমায় পাত্তা দিবে? আমেনা বেগম ছেলের কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন, কিসের পাত্তা? রাফি এবার নিজের উপর প্রচুর রাগ হলো মুখ ফসকে কি না বলে ফেলল তারপর তার মাকে বলল,” না মা কিছু না আমি এখন যাই আমার একটু ঘুম প্রয়োজন।” এই বলে রাফি তার রুমের দিকে চলে গেল আর আমেনা বেগম বলতে লাগলেন, আজ কালকার ছেলে মেয়েরা যে কি করে নিজেও জানে না।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে রাফির মনে হলো একটু ছাদে যাওয়া উচিত কারণ একটু ঘুরেও আসা যাবে আর মিস অপরিচিতার দেখা পেলে তো সোনায় সোহাগা। রাফি ছাদে উঠে দেখে ছাদে কেউ নেই, তার মন টা একটু খারাপ হয়ে গেল কারণ তার চোখ জোড়া একজনকেই খুঁজছে। যাইহোক সে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির দেখা না পেয়ে ছাদ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। চারিদিকে বিভিন্ন রঙ বেরঙের ফুলের গাছ আর মাঝখানে একটি দোলনা। রাফি মনে মনে বলতে লাগলো, আসলেই বাড়িওয়ালা মশাই বেশ সৌখিন মানুষ। দোলনা রাফির খুবই পছন্দ। ছোট বেলায় তার স্কুল এ একটা দোলনা ছিল কিন্তু মেয়েদের কারণে সে দোলনায় চড়তেই পারতো না। যখনই সে দোলনায় চড়তে যেত তখনই দেখত কোনো না কোনো মেয়ে দুলছে। এই কারণে দোলনায় চড়ার একটা আক্ষেপ রয়েই গেল তার মনে কিন্তু এখন ছাদে দোলনা দেখে সে আর সুযোগ মিস করতে চাইলো না। দোলনায় উঠে চোখ বন্ধ করে পরম আনন্দে দুলতে লাগলো রাফি। রাফির মনে হতে লাগলো এর চেয়ে প্রশান্তির আর কিছু হতেই পারে না।
ইতু ছাদে উঠে দেখলো তার প্রিয় দোলনায় সেই দিনের অপরিচিত ছেলেটি পরম আনন্দে চোখ বন্ধ করে দুলছে। রাগে তার গা জ্বলে যায়। সে মনে মনে রাফির গুষ্টি উদ্ধার করতে থাকে। রাফি ইতুর রাগী কণ্ঠ শুনে চোখ মেলে তাকায় দেখে তার সেই কাঙ্খিত ব্যাক্তিটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেইদিন তার চোখ দুটি দেখায় রাফি এতটাই ব্যস্ত ছিল যে তার গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁটের নিচে ছোট্ট একটা তিল আছে সেটা সে লক্ষই করে নি। মেরুন সেলোয়ার কামিজে ইতুকে এতটাই সুন্দর লাগছিল যে রাফি মনে মনে বলতে লাগলো, এ যেন আল্লাহর এক অপরূপ সৃষ্টি। ইতু দেখলো ছেলেটি তার কথা শুনছেই না বরং সেইদিনকার মত এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইতু নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলো না একটু জোরেই বলে ফেলল, রাবিশ।
ইতুর এই কথাটি রাফির ঘোর কাটিয়ে দিল। সে দোলনা ছেড়ে উঠে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পরলো। আর ইতু রাগী কণ্ঠে বলতে লাগলো,” ছাদে উঠেছেন ভালো কথা কিন্তু আমার দোলনায় কেন বসেছেন? আর আমি এতক্ষন ধরে ডাকছি কিন্তু আপনি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ঠিক ঐদিনকার মত! ছেলেদের সমস্যা কি বলুনতো? মেয়েদের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে মন চায় কেন আপনাদের?” একনাগাড়ে কথাগুলো বলে ইতু একটু ঠাণ্ডা হলো। ইতুর কথা গুলো শুনে রাফি একটু কষ্ট পেল কারণ ইতু তাকে ছ্যাচড়া ছেলেদের লিস্টে ফেলে দিলো আর ফেলে দিবেনা ই বা কেন সে যেভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিল সেটা আসলেই ঠিক হয়নি। তার দিকেও যদি অচেনা কোনো মেয়ে এভাবে তাকিয়ে থাকতো তাহলে তারও ভালো লাগতো না।
তাই রাফি মাথা নিচু করেই বললো, দেখুন আমি এই বাসায় নতুন এসেছি, দোলনায় চড়তে ভালোলাগে তাই একটু বসেছিলাম। আমি যদি জানতাম দোলনায় উঠলে আপনি এতটা রেগে যাবেন তাহলে আমি কখনই উঠতাম না। আর দ্বিতীয় কথা এটা মানছি যে এভাবে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকা আমার উচিত হয় নি কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি কোনো খারাপ নজরে আপনার দিকে তাকাই নি। যাইহোক অনেক কথা বলে ফেললাম আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি মাফ করে দিবেন। ভালো থাকবেন। এই বলে রাফি ইতুর দিকে না তাকিয়েই বাসায় চলে গেল। এই দিকে রাফির কথাগুলো শুনে ইতুর মনে একটু অপরাধবোধ কাজ করলো। এই ঘটনার পর অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেল। ইতুর সাথে পরে যতবারই দেখা হয়েছে রাফি ততবারই তার মাথা নিচু করে চলে গিয়েছে। কখনো আর ইতুর চোখে চোখ রাখেনি রাফি। ইতুর ব্যাপারটি ভালোলাগার কথা ছিল কিন্তু তার কোথায় যেন অস্বস্তি হচ্ছিলো। আর ঐদিন কার পর থেকে রাফি কখনও ছাদে ওঠেনি।
একদিন ইতু বারান্দায় বসে তার পাখিদের খাবার দিচ্ছিল তখন তার চোখ যায় রাফির দিকে। সে দেখে রাফি তার হাটুর সমান বাচ্চাদের সাথে ক্রিকেট খেলছে। বাচ্চাদের সাথে রাফির খুনসুটি দেখে অজান্তে তার মুখে হাসি ফুটে। এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করতে থাকে তার মনে। ইতুর বিশ্বাস যে ব্যাক্তি বাচ্চাদের মাঝে এত সহজে মিশে যেতে পারে সে কখনোই খারাপ লোক হতে পারে না। বাচ্চাদের সাথে মিশতে হলে একটি কোমল হৃদয় প্রয়োজন যা সবার নেই। রাফিকে নিয়ে তার ভাবনা যেন আরো বেড়ে গেল। এ যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি। সময় অসময় তার রাফির কথা মনে পরত। মাঝে মাঝে তার নিজের উপর খুব রাগ হত যে এক অচেনা অজানা ছেলেকে নিয়ে তার কিসের এত ভাবনা! কিন্তু মাঝে মাঝে তার ভালো লাগতো ওকে নিয়ে ভাবতে। মুচকি মুচকি হেসে লজ্জা পেত ইতু। একদিন খুব বৃষ্টির মাঝে রাফি একটি চায়ের দোকানের ছাউনিতে আশ্রয় নিল। সঙ্গে কিছু গুরুত্ত্বপূর্ণ কাগজ আছে তাই সে আর বৃষ্টিতে ভেজার সাহস দেখলো না। কিছুক্ষণ পর পেছন থেকে একটি মেয়েলি আওয়াজ তার কানে আসলো। সে পেছন ফিরে দেখলো ইতু ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে আর মুখে তার মুচকি হাসি। আজ আর সে ইতুর দিকে তাকানোর ভুলটা করলো না।
সে কি বলবে ভেবে পেল না তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। তাকে চুপচাপ দেখে ইতু আবার বললো, কেমন আছেন? ইতুর কথা শুনে রাফি এবার অবাক। এই মেয়ে তার খোঁজ খবর নিচ্ছে এটা সে বিশ্বাস ই করতে পারছে না। রাফি কিছু বলছে না দেখে ইতু আবার বললো, কী উত্তর দিচ্ছেন না যে। রাফি বললো, আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আপনি কেমন আছেন? আমিও ভালো আছি মুচকি হেসে জবাব দিলো ইতু। তারপর বললো বৃষ্টি সবে মাত্র শুরু হলো মনে হচ্ছে না শীগ্রই থামবে আমার ছাতা টা বেশ বড় তাই চাইলে আমার সাথে বাসা পর্যন্ত যেতে পারেন। ইতুর কথাগুলো যেন রাফির মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। রাফি নরম কণ্ঠে বললো, সমস্যা নেই আমি একভাবে চলে যাবো আপনাকে শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না। ওর কথা শুনে ইতু বললো, এতে কষ্টের কিছু নেই আর যদি আপনি না আসেন তাহলে আমি ভেবে নিব আপনি আমার উপর রেগে আছেন।
– নাহ আমি আপনার উপর একটুও রেগে নেই বিশ্বাস করুন।
– তাহলে আসুন এক সাথে যাই।
রাফি আর কিছু না ভেবেই ইতুর সাথে এক ছাতার নিচে হাঁটতে শুরু করলো আর মনে মনে বলতে লাগলো, হে আল্লাহ্ এই সময়টা যেন কখনো না শেষ হয়।
রাফিকে চুপচাপ দেখে ইতুই আগে বলতে শুরু করলো,
– দেখুন আমি সেইদিনের ব্যাবহারের জন্য দুঃখিত। আমি অনেকবার আপনার কাছে মাফ চাওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারি নি। আজ সুযোগ পেলাম তাই চেয়ে নিলাম।
– না না আপনি মাফ চাইছেন কেন! ভুলটা তো আমার ছিল তাই না।
– তাও আমার ওরকম করে বলা উচিত হয় নি। আচ্ছা এগুলো বাদ দিন। আমরা কি একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারি।
– হ্যাঁ কেন নয়, এটা আমার সৌভাগ্য।
ইতু তার এক হাত রাফির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আমি ইতু। একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে সিএসই করছি। রাফি হালকা করে ইতুর সাথে হাত মিলালো আর বললো, আমি রাফি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশে অনার্স করছি।
এভাবেই শুরু হয়েছিল তাদের মিষ্টি প্রেমের সম্পর্ক। দেখতে দেখতে দুটি বছর পার হয়ে যায়। তাদের সম্পর্ক আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসে। তারা যেন একে অপরকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিল যে একে অপরকে ছাড়া একটি মুহুর্ত ভাবতে পারে না। কিন্তু কেউ কাউকে ভালোবাসার কথা বলতে পারেনি।
একদিন রাতে ইতুর বাবা তাকে ডেকে পাঠায়। ইতু রুমে এসে দেখে তার বাবা খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। ইতু নরম কণ্ঠে জানতে চাইলো, আমাকে ডেকেছ বাবা? তার বাবা চোখ মেলে দেখলো তার আদরের রাজকন্যা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে নরম কণ্ঠে বললো, কিরে মা দাঁড়িয়ে আছিস কেন! আমার পাশে এসে বোস। ইতু চুপটি করে তার বাবার পাশে বসে তার বুকে মাথা রাখলো। ইতুর বাবার মনটা আনন্দে ভরে গেল, তার মনে হতে লাগলো ইতু যখন ছোট ছিল তখন ঠিক এরকম চুপটি করে তার বুকে ঘুমিয়ে থাকত। ইতুর বাবা ইতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,” মা রে তুই আমার রাজকন্যা, তোকে যে আমি কতটা ভালোবাসি তা আমি প্রকাশ করতে পারব না। আমি সবসময় চাই তুই ভালো থাক। আজ তোকে কিছু কথা জিজ্ঞাসা করার জন্য ডেকেছিলাম আশা করি সব সত্য বলবি।” ইতু তার কথা শুনে বললো,” আমি জানি বাবা তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো। তুমি আমাকে যাই জিজ্ঞাসা করো না কেন আমি তোমায় ছুঁয়ে বলছি যে যা বলবো সত্য বলবো।” তারপর ইতুর বাবা আফজাল হোসেন বলতে শুরু করলেন,
– মা আমার কানে কিছু কথা এসেছে আমি জানিনা সেগুলো সত্যি না মিথ্যা। তুই নাকি আমাদের বাসার চার তালার ভাড়াটিয়া রাফির সাথে প্রেম করছিস? আফজাল হোসেনের কথা শুনে ইতুর বুক ধুকপুক শুরু করলো কিন্তু সে জানে যে তার বাবা খুবই ভালো তাই যদি সে তার বাবাকে বুঝিয়ে বলতে পারে তাহলে তার বাবা সবটা বুঝবে আর এখন তাকে ভয় পেলে চলবে না, সাহস নিয়ে সবটা বুঝিয়ে বলতে হবে। ইতু বলতে শুরু করলো,
– বাবা তুমি যা শুনেছ সব সত্য। কিন্তু বিশ্বাস করো রাফি ছেলেটা খুব ভালো। আমি শুধু শুধু তার প্রেমে পড়িনি। সে এমন একজন মানুষ বাবা তোমার পরে আমায় যদি কেউ আগলে রাখতে পারে সেটা হলো রাফি।
– এতটা বিশ্বাস কি ভালো রে মা!
এবার ইতু তার বাবার হাত জড়িয়ে ধরে বললো,সে এমন একজন মানুষ বাবা যাকে অনায়াসে বিশ্বাস করা যায়। তুমি আমাকে একটুখানি ভরসা করো প্লিজ বাবা। আমি মানুষ চিনতে ভুল করিনি বাবা। আফজাল হোসেন ইতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,
– আমি জানি রে মা তুই অনেক বুদ্ধিমতী। জীবনে কোন সিদ্ধান্ত তোকে নিতে হবে সেটা তুই ভালো ভাবেই বুঝিস। আর তুই যে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিবি না সেটা আমি জানি। তাই আমি রাফির পিছনে লোক লাগিয়েছিলাম কারণ কোনো খোঁজ খবর না নিয়ে আমি আমার রাজকন্যাকে কারো হতে ছেড়ে দিতে পারি না। আমি যা জানতে পেরেছি ছেলে হিসেবে ও খুবই ভালো সে পড়ালেখার দিক দিয়ে হোক বা চরিত্রের দিক দিয়ে। আশা করি ও তোকে ভালো রাখবে মা। ওকে বলিস পড়াশুনা ঠিকভাবে শেষ করে একটা ভালো চাকরিতে ঢুকলেই তোকে ওর হাতে তুলে দিব। আর এখনকার জন্য এইটুকুই বলছি যে বিয়ের আগে কোনো ভুল কাজ করিস না মা যাতে আমার সন্মান নষ্ট হয় মা।”
আফজাল হোসেনের কথা শুনে ইতুর চোখে পানি চলে আসলো সে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,” বাবা তুমি এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। আমি বলত আগেই তুমি আমার সকল ইচ্ছা কিভাবে পূরণ করে ফেল বাবা, আমি জানিনা। আমি তোমার মাথায় হাত রেখে ওয়াদা করলাম যে এমন কোনো কাজ করবো না যাতে তোমার সন্মান নষ্ট হয়।”
এদিকে ইতুর সাথে পরিচয়ের দুটি বছর পেরিয়ে গেলেও রাফি ওকে সাহস করে প্রোপোজ করতে পারলো না। রাগে দুঃখে নিজের চুল ছিঁড়তে মন চাচ্ছে। সে আর পারছে না নিজের মনের মাঝে ইতু কে ভালোবাসার কথাটা আটকে রাখতে। ওকে যেভাবেই হোক জানিয়ে দিতে হবে যে ওকে ছাড়া রাফির জীবন অচল। তাই রাফি চিন্তা করেই ফেলল ইতু কে আজ এই মুহূর্তে প্রোপোজ করবে সে। কিন্তু রাত তো প্রায় ১ টা বাজে এখন ইতু সজাগ আছে কি না তা জানার জন্য ইতু কে সে কল দিল,
– হ্যালো ইতু, তুমি সজাগ আছো?
– রাফি এত রাতে ফোন দিয়ে কিসব আবোলতাবোল বলছো আমি যদি সজাগ নাই থাকি তাহলে কথা কে বলছে।
– আসলেই তো আমি কিসব উল্টাপাল্টা বকছি বলোতো। আমার মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাবো।
– রাফি তুমি শান্ত হও তোমার কি হয়েছে খুলে বলো।
– ইতু আমার যা হয়েছে তা ফোনে বলা যাবে না, তুমি একটু ছাদে আসতে পারবে? রাফির কথা শুনে ইতু অবাক হয়ে বললো,
– রাফি তোমার মাথা ঠিক আছে!! এখন রাত বাজে কয়টা তুমি দেখেছ?
– প্লিজ ইতু আমার জন্য একটু কষ্ট করে হলেও এসো।
– আহা রাফি তুমি আমায় চিন্তায় ফেলে দিলে। আচ্ছা দাঁড়াও বাবা আজ বাসায় নেই একটু ঢাকার বাহিরে গেছে। মা ঘুমিয়ে গেছে নাকি দেখে নি অপেক্ষা করো। ইতু একদম আস্তে আস্তে করে পা ফেলে তার মায়ের রুমে উকি মেরে দেখলো তার মা গভীর ঘুমে মগ্ন। তাই সে রুমে এসে রাফিকে বললো,
– হ্যাঁ মা ঘুমুচ্ছে তুমি যাও ছাদে আমি আসছি।
ইতুর কথা শুনে রাফি পারলে লুঙ্গি ড্যান্স দেয় কিন্তু এখন তার সময় নেই। ইতুকে তার সুন্দর করে প্রপোজ করতে হবে কিন্তু ভাববার বিষয় হলো সে এখন গোলাপ কই পাবে। হুট করে তার মাথায় আসলো তার মায়ের একজোড়া সুন্দর কাগজের গোলাপ আছে সেটা দিয়েই কাজ চালাতে হবে। তাই সে ডাইনিং রুমে গিয়ে চুপচাপ গোলাপটি চুরি করে ছাদে উঠে পরে। ছাদে উঠে সে দেখে আগে থেকেই ইতু ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে ইতুর পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে এবং আস্তে ডাক দেয় ইতু বলে। ইতু পেছন ফিরে তাকায় চাঁদের আলোতে ইতুর চেহারা এতটাই মায়াবী লাগছিল যে রাফি একটা ঘোরের মধ্যে পরে যায়। ইতু রাফিকে ডাক দেয়, এই রাফি আর কতক্ষন তাকিয়ে থাকবে এবার বলো তাড়াতাড়ি কি বলবে আমার সময় কম। রাফি নিজের একটি আঙ্গুল ইতুর ঠোঁটের উপর রাখে আর বলে আর কোনো কথা না এখন আমি বলবো তুমি শুনবে। রাফির এরকম আচরণ দেখে ইতু অবাক হয়। তারপর রাফি বলতে শুরু করে,
– ইতু তোমায় যেদিন আমি প্রথম দেখেছিলাম সেইদিন থেকেই তোমার চোখের মায়ার মাঝে আমি ডুব দিয়েছিলাম। তোমার মাঝে এমন কিছু আছে যা আর কারো মাঝে নেই। আমি শুধু এইটুকুই জানি যে আমার বেঁচে থাকতে হলে তোমায় খুব দরকার। তোমায় ছাড়া আমার একটি মুহূর্ত যেন ভালো লাগে না। মনের আয়নায় শুধু তোমার ছবি ভাসে। চোখ বুঝলেই তোমার হাস্যজ্জ্বল চেহারা আমায় শান্তি দেয়। আমার জীবনে প্রশান্তির আরেক নাম তুমি ইতু। আমি তোমায় নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি ইতু। জীবনে যতদিন বেঁচে আছি তোমার এই হাত ধরে কাধে কাধ রেখে সকল সুখ দুঃখ ভাগ করতে চাই। তুমি কি আমার সাথে বুড়ি হবে ইতু? হাটুগেড়ে বসে গোলাপ হতে প্রোপোজ করলো রাফি। প্রোপোজ করার পর রাফির মনে হলো অনেক বড় পাথর তার বুকের উপর থেকে নেমে গেল। ইতু রাফির কোথায় আবেগপ্রবণ হয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আর বলতে শুরু করলো,
– রাফি তুমি জাননা এই মুহূর্তটার জন্য আমি কত অপেক্ষা করেছি। আজ আমি খুব খুশি রাফি খুব খুশি। আমার হৃদয়ের কতটা জুড়ে তোমার বসবাস তা তুমি জানোনা রাফি। আমার টাকা পয়সা গাড়ী বাড়ী কিচ্ছু চাই না শুধু তোমাকে চাই রাফি। আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার পাশে থাকতে চাই। অনেক ভালোবাসি তোমায়।
রাফি তার ঠোঁট জোড়া ইতুর কপালে ছোঁয়ালো। তারা পরম ভালোবাসায় একে অপরকে জড়িয়ে রাখলো দীর্ঘক্ষণ। তারপর ইতু তার বাবার কথাগুলো রাফিকে বললো। রাফি সবটা শুনে যেন আনন্দে আত্নহারা হয়ে গেল আর ইতুকে পাঁজকোলে নিয়ে বলতে লাগলো, আজ আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ নেই ইতু, আর কেউ নেই। রাফির হাস্যজ্বল চেহারা দেখে ইতুও হাসতে শুরু করলো আর পরম ভালোবাসায় নিজের মাথা এলিয়ে দিল রাফির বুকে।
তাদের আনন্দটা ছিল প্রিয় মানুষকে পাওয়ার আনন্দ যা আর সকল আনন্দের চেয়ে আলাদা। তারপরের দিনগুলো রাফির ও ইতুর কাছে স্বপ্নের মত লাগতে শুরু করলো। দুইজনের পরিবারই তাদের সম্পর্কটাকে মেনে নেয়। রাফি শুধু একটি ভালো চাকরির অপেক্ষা করছিল যাতে ইতুকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের করে নিতে পারে কিন্তু তার এই স্বপ্ন যে স্বপ্নই রয়ে যাবে এটা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
একদিন ইতু রাস্তা পার হচ্ছিল তখন একটি লোকাল বাস তাকে সজোরে ধাক্কা মারে। ইতু দূরে ছিটকে পরে তারপর আশপাশের লোকজন তাকে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যায়। রাফি তখন এক জায়গায় ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল কিন্তু এই খবর শোনা মাত্র তার দুনিয়া উলোপালোট হয়ে যায় সে নিজেকে অনেক কষ্টে হাসপাতালে নিয়ে যায় সেখানে গিয়ে দেখে তার মা বাবা আর ইতুর মা বাবা সবাই কান্না করছে। সে তাদের কি বলে সান্তনা দিবে সেটাই ভেবে পায় না কারণ সে নিজেই ভেঙে পড়ে, তাকে আকরে ধরে প্রিয় মানুষটাকে হারানোর ভয়। ডাক্তার যখন বলে ইতু বেঁচে আছে তখন সবাই একটু শান্ত হয় কিন্তু ডাক্তার এও বলে ইতুর অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল আর তার বাঁচার চান্স খুবই কম। রাফি আল্লাহর নিকট দোয়া চাইতে থাকে যেন তিনি ইতুকে তার কাছে ফিরিয়ে দেন। রাত সাড়ে বারোটায় ইতুর জ্ঞান ফেরে ইতুর জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত রাফি তার পাশে বসে থাকে আর চোখের জল ফেলতে থাকে।
ইতুর জ্ঞান যখন ফেরে তখন সে হাতের ইশারায় তার অক্সিজেন মাস্ক টা খুলতে বলে কিন্তু রাফি নিষেধ করে তাও সে একা একাই নিজের মাস্ক টা খোলার চেষ্টা করে কিন্তু সে ব্যার্থ হয় তাই রাফি হালকা করে মাস্ক টা খুলে ইতুর মুখের কাছে কান নেয়। তখন ইতু খুব কষ্ট বলতে শুরু করলো, রাফি আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রাফি। আমি বুঝতে পারছি যে আমার হাতে আর বেশি সময় নেই। আমি মরে যাবার পর আমার মা বাবার খেয়াল রেখো আর যদি কখনো আমার কথা মনে পরে তোমার মন কাঁদে তাহলে একগুচ্ছ কদম হাতে ছুটে এসো আমার কবর পানে। ভালোবাসি। এইটুকু বলতে ইতুর অনেক কষ্ট হলো, তার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। জীবনের শেষ কথাগুলো অনেক কষ্ট হলেও সে রাফিকে বলতে পেরেছে এতেই সে খুশি।
কথা গুলো বলার পর তার শ্বাস কষ্ট শুরু হলো তাই রাফি তাড়াতাড়ি ইতুর মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিলো। ইতুর কথা গুলো রাফিকে আবেগপ্রবণ করে তোলে সে ইতুর সামনে কাঁদতে চায় না যদি ইতু কষ্ট পায়। তাই বাথরুমে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পরে। সে অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে চোখ মুখে পানি দিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে। এখন তার প্রত্যেকটি মুহুর্ত ইতুর পাশে থাকতে হবে, ইতুর যে তাকে খুব প্রয়োজন। সে বেরিয়ে দেখে ইতুর মা বাবা ইতুর পায়ের কাছে মাথা রেখে নিঃশব্দে কেদেই চলেছে। তারপর ইতুর এক হাতে আলতো করে হাত রেখে রাফি বসে থাকলো কিন্তু গভীর রাতে তার চোখে হালকা ঘুম নেমে আসে। ভোরের দিকে ইতুর ছট্ফট্ করার শব্দে রাফির ঘুম ভেঙে যায় সে দ্রুত ডাক্তার ডাক দেয়। ডাক্তার এসে দেখে ইতুর পালস খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে তাই সে নার্স কে তাড়াতাড়ি ঘুমের ইনজেকশন পুশ করতে বলে কিন্তু ইনজেকশন পুশ করার আগেই ইতু পারি জমায় পরপারে। ইতুর বাবা মা স্বজোরে কাঁদতে থাকে কিন্তু রাফি যে নির্বাক।
সে ভাবতে থাকে তার প্রিয় মানুষটি আর কখনো তাকে ডাকবে না, আর কখনো কোনো আবদার করবে না, আর কখনোই বলবে না আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি রাফি, অনেক ভালোবাসি। কাটানো হবে না তার সাথে আর একটি মুহুর্ত। নাহ রাফি আর কিছুই ভাবতে পারছে না, তার মাঝে শূন্যতা ভর করেছে। তার মাথা খুব ভারী ভারী লাগছে, চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেল। নিজের চোখের সামনে নিজের প্রিয় মানুষটির এরকম অকাল মৃত্যু রাফি সহ্য করতে না পেরে নিজের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রাফির জ্ঞান ফেরে ইতুকে কবর দেওয়ার অনেক পরে। প্রিয় মানুষটিকে শেষ বারের মত দেখতে না পারার আক্ষেপ কখনো দূর হবার নয়। ফজরের আজানের সুরেলা ধ্বনি রাফির কানে ভেসে আসলো। রাফি পুরোনো স্মৃতির মাঝ থেকে বের হয়ে ওজু করে নামাজ আদায় করে নিল।
কিরে বাবা এত সকালে কোথায় যাচ্ছিস? রাফির কাছে জানতে চাইলেন আমেনা বেগম। রাফি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, কোথায় যাচ্ছি তা তুমি জানো মা তাই শুধু শুধু প্রশ্ন করো না। তারপর আমেনা বেগম বলতে লাগলেন,” ইতু মা মারা গেছে দশ বছর হতে চললো বাবা। আমি মানছি তুই ইতু কে অনেক ভালবাসিস কিন্তু তোর একটা জীবন আছে বাবা। সারা জীবন তুই একা একা কিভাবে পার করবি বাবা তাই বলি কি এবার একটা বিয়ে করে ফেল।” “মা তোমায় আগেও বলেছি এখন আবার বলছি ইতু ছিল ইতু আছে এবং ইতু থাকবে। আমার স্মৃতির মাঝে ইতু আজীবন জীবিত থাকবে। আর সেই স্মৃতির জন্যই আমি বেঁচে আছি মা।”
আমেনা বেগম আবার বলতে শুরু করলেন আর এর মধ্যেই রাফির বাবা বললেন, আহ্ আমেনা! ও যেমন আছে ভালো আছে তুমি ওর ভালোর জন্য জোর করছো ঠিকই কিন্তু এতে ওর ভালো হবে না বরং খারাপ হবে। তাই রাফি যেভাবে চায় ওকে সেভাবে থাকতে দাও।” তারপর রাফির বাবা রাফিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুই যা বাবা ইতু মায়ের কবর জিয়ারত শেষে তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস। রাফি একগুচ্ছ কদম হতে নির্বাক হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো। আজ খুব বৃষ্টি হবে, হলে হোক না এতে তার চোখের জল ধুয়ে যাবে ঠিকই কিন্তু তার চোখের সাথে তার মন ও যে কাঁদছে। বৃষ্টির ফোটাগুলো কি তার মন কে ঠান্ডা করতে পারবে? নাহ তার মন কাঁদবেই কেউ থামাতে পারবে না এই কান্না।
রাফি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো,” আজ আমার মন খুব কাঁদছে, তুমি কি তা দেখতে পাচ্ছ ইতু? আমি জানি শুধু তুমিই দেখতে পাচ্ছ এই নিরব কান্না। আমি আসছি তোমার কবর পানে একগুচ্ছ কদম হাতে।”
রাফির কানের কাছে ইতু যেন তার সুরেলা কন্ঠে গান গাইছে, যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায় যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়…এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে জল ভরা দৃষ্টিতে এসো কোমল শ্যামল ছায় । যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরি কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি ।। উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আরো তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়…
গল্পের বিষয়:
গল্প