সেদিন কেমন করে সকালের সূর্যটা উঠেছিল – মনে নেই। তার কারণ আমার গ্রামের বাড়িতে সূর্য ওঠার আগে যেসব শব্দ শুনতে আমি অভ্যস্ত
আজকে তার একটিও ছিল না। তাই ঘুম ভাঙার পরই আমার কেমন যেন একটা বোধ হয় যা শুধু অপরিচিতই নয়, তার সঙ্গে আন্কা একটা অস্বস্তিও বটে। অপরিচিতিরও একটা বাতাস, গন্ধ,
অবলোকনে কিছু অস্পষ্টতা থাকে যা ধীরে ধীরে একটু পরে কেটে যায় বা সহজ হয়ে যায়।কিন্তু আজ তা হলো না। গ্রামের মানুষ আমি, আজও সেখানে থাকি বটে কিন্তু জীবনে কম
শহর-নগর তো দেখিনি! পৃথিবীর অনেক নগরে সূর্য ওঠা আমি দেখেছি। আজ যেখানে ঘুম ভাঙলো, এই শহরেও তো লেখাপড়ার কালে অনেকদিনই থেকেছি। তখন পাখি ডাকতো আমাদের হোস্টেলের
চারিপাশের বৃক্ষরাজির পাতার ফাঁকে ফাঁকে –
‘বউ কথা কও’ও শুনেছি
কতোদিন। অবশ্য আজ ভোরে একটাও পাখির শিস শুনিনি এমন নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কি
জানেন, পাখির ডাকটা শোনাচ্ছিল – ‘ভিডিও গেম, ভিডিও গেম।’ কী পাখি ওটা? কী জানি,
আমিই কি ভুল শুনলাম? সবমিলে কেমন একটা বিহবলতা, অস্বস্তি; প্রচ্ছন্ন একটা আবছা
শঙ্কা – এই আছে, এই নেই। অতি চেনা জিনিসগুলোও যেন ভয় মেশানো ছায়ার আবরণে রহস্যময়।
গতকাল সন্ধ্যায় এসেছি আমার আত্মীয়ের এই বাসাতে। রাতে ঝকঝকে বাতির আলোয় সবাই
মিলে গল্পও করেছি। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে একটা জিনিস আমার চোখ এড়ায়নি – দেয়াল
জোড়া টেলিভিশনের পেছন দিকটা গভীর অন্ধকার
তারপর ডিপফ্রিজের একপাশ যেটা আর একটা ফ্রিজের পাশে বসানো সেখানেও কালো অন্ধকার।
ঘরের কোনা কালিতে – ঠাস বুনুনি ছবির ফ্রেমে ছবি, ফুলদানিতে কাগজের ফুল। তারপর পাশে
বসানো দারুণ সুন্দর একটা সবুজ গাছ, তাতে বেশ কটা কদমফুল ফুটে আছে – সবাই মোহময়
কিন্তু তাদের ফাঁকে-ফোকরে সবই কেমন আনন্দহীন অন্ধকারের বিস্তারে আচ্ছন্ন –
প্রাণহীন। সেখানেও কেমন ভয়- মেশানো আবরণ। কারণ এই সবুজ গাছ বা ফুলগুলো সবই কৃত্রিম
– প্লাস্টিক বা ওই ধরনের উপাদানে তৈরি।
এসব কী ভাবছি? দূর! গা ঝাড়া দিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম – শুনেছি শহরটায়
অনেক পরিবর্তন হয়েছে, আজ ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে। প্রাতরাশের পর বাড়ি থেকে বেরোলাম।
একি! গলিতেও হাঁটবার উপায় নেই, রিকশার জড়াজড়িতে রাস্তায় লোহালক্কড়ের জঙ্গল, তার
মধ্যে মোটরচালিত হিউম্যান হলারও ঢুকে পড়েছে, বেশ কটা দামি কার ঝকঝক করছে – কোনো
পথিকের রাস্তায় ভেতরে ঢোকবার প্রয়াস মানেই হচ্ছে নির্ঘাত হাত, পা বা পাঁজরের হাড়
ভাঙার প্রতিশ্রুতি দেওয়া। ‘বাপরে’ – উচ্চারণ করতে হলো বাড়ির ভিটের ওপরে দাঁড়িয়েই।
অবাক হয়ে ভ্রু তুলে রিকশাওলাকে জিগ্গেস করলাম – ‘এ কি ভাই?’ নির্বিকার জবাব,
‘অফিস, স্কুলটাইম তো!’ শেষ পর্যন্ত জঙ্গলের কাফেলা সচল হলে আমি কোনোরকমে গা
বাঁচিয়ে দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে – (দেয়ালের পাশেই কিন্তু থকথকে কালো পানিভরা আবর্জনায়
আবদ্ধ ড্রেন চললো আমার সাথে সাথে। একটু এদিক-ওদিক হলেই পচা দুর্গন্ধভরা বুদ্বুদ
ভাসা ড্রেনে পা মুচড়ে পড়তে হবে) – গলি পার হয়ে বড় রাস্তায় পড়তেই আমার দমও বন্ধ
হলো। কোথায় দাঁড়িয়ে আমি – এ তো আজব পুরী! শয়ে শয়ে, বিশাল বিশাল ঝক্ঝকে তকতকে
ব্যক্তিগত রকমারি রঙের বাড়ির প্রদর্শনী! না, প্রদর্শনী নয়। রাস্তায় লালচক্ষুর
নির্দেশনায় অপেক্ষমাণ গাড়ির শ্রেণি। নীল ধোঁয়ার পাতলা আবরণে রাস্তার আকাশ খোলা।
কতোক্ষণ নিশ্চল রাজপথ। আমি বিস্মিত, অপেক্ষায় থাকি যেহেতু দুই গাড়ির ফাঁকে এমন
একটু ফাঁক নেই যার মধ্যে দিয়ে আমি রাস্তা পার হতে পারি। দরকারইবা কি পার হবার, আমি
যাই না কেন ফুটপাত ধরে বাঁ দিকে ডান দিকে? তাও হওয়ার নয় – ফুটপাতজুড়ে নানান
কিসিমের পণ্যের সম্ভারে পায়ে চলার রাস্তা নিজেই নাস্তানাবুদ – সে আর মানুষের
চলাচলের জায়গা কোথা থেকে দেবে? আমি দাঁড়িয়ে রাস্তা খুঁজি। রাস্তাটা নড়ে উঠলো
বাহারি গাড়িরা দুলে উঠে সচল হলো। পাশে একটু জায়গা খালি হলে আমি সেই পাশ ধরে একটু
পা ফেলি, কখনো বাঁ পাশে, কখনো একটু ডানে হেলে ধীরে ধীরে চলতে থাকি কিন্তু কোথায়
চলেছি দিশে করতে পারছি না। পাশে বিশাল ট্রেনের মতো চলমান গাড়ির স্রোত, তার লেজ
মাথা টের পাই না – ক্রমশ কেমন লাল লাল অাঁধার, কাঁচা মাংসের কেমন একটা মৃদুমন্দ
গন্ধ, আশেপাশে মাংসের দোকান তো দেখছি না। এপাশে-ওপাশে তাকালে শুধু লালচে
আলো-অাঁধারি – কোনো গলি বা রাস্তা নেই। বুঝতে পারছি ধীরে ধীরে রাস্তা অপরিসর হয়ে
আসছে, আমার পায়ের তলায় নরম তুলোর মতো রাখা, দুপাশে হাত বাড়িয়ে কেমন নরম নরম পিছল
স্পর্শ পেলাম – কোথায় এলাম? আমি ফিরতে শুরু করলাম। অনেক অনেক রাস্তা হাঁটলাম – লাল
লাল অন্ধকার, কাঁচা কাঁচা মাংসের গন্ধ! মনে হচ্ছে আমি যেন একটা সুড়ঙ্গে ঢুকে
পড়েছি। আমি বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় চলতেই থাকলাম। একসময় একটা হাই তোলার শব্দ
পেলাম এবং সুড়ুঙ্গের কপাট খুলে গেল – চকিত, ভীত আমি বুঝলাম ওটা একটা অজগরের মুখ আর
আমি সেই মুখের পেছনে গলার ভিতরে দাঁড়িয়ে। কখন আমি এই অজগরের মুখের মধ্যে ঢুকে
পড়েছি আমি জানি না। আমি বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবার আগেই খপাট শব্দ করে হাঁ মুখটা
বন্ধ হয়ে গেল। আমি শ্বাস পাচ্ছি কী করে – লাল লাল আলোর ছটা আসছে কোথা থেকে? আমি
নিশ্বাস পাচিছ কী করে? যদিও নিশ্বাসের বাতাস বেশ ভারি তবু তো পাচ্ছি! নিশ্চয়ই কোনো
ছাকনির ভিতর আলো- বাতাস আসছে। আর একটা ব্যাপার আমার মাথার মধ্যে চিৎকার করছে – আমি
হাঁটতে হাঁটতে কী করে অজগরের পেটের মধ্যে ঢুকলাম? কই, কোনো অজগর তো উবুউবু গিলে
ফেলেনি আমাকে আর গিললোই যদি, কখন গিললো? অজগর তো হাঁ করে শনশন করে আসেনি আমার
সামনে! কিন্তু আশ্চর্য কী জানেন। আমি কিন্তু হতভম্ব হই না, ক্ষুধায় বা তৃষ্ণায়
কাতরও হই না। অজগর বেশ চলছে ফিরছে, বেশ স্বচ্ছন্দ সে, মাঝে মাঝে খাচ্ছে, উদ্গার
তুলছে, বিশ্রাম নিচ্ছে। কিন্তু তার খাদ্যদ্রব্য
কোথায় ঢুকছে তা আমি জানি না বা আমি জানতে পারছি না – কই আমার গায়ে তো তেমন
কিছুই পড়ছে না। তাহলে এর পেটে কি অনেক কুঠুরি আছে? – কোনোটায় সে খাবার রাখছে,
কোনোটায় পানি রাখছে, কোনোটায় বাতাস রাখছে, আলো ভরে রাখছে? আবার একবার তার হাঁয়ের
কাছাকাছি গেলাম – ও বাবা, চোয়ালের পেছনে সারি সারি গলিপথ। আমি খুব ধীরে ধীরে একটা
গলিতে ঢুকে পড়লাম – দুপাশে রাশি রাশি মণিমুক্তার দোকান, আলিবাবার গুপ্তধনও কী ছাড়
এর কাছে! ওই তো সিনড্রেলার হীরে দিয়ে সাজানো রথ আর ওই তো কোহিনূর খচিত জাহাঙ্গীর
বাদশার সোনার মুকুট আর ওই
যে, কেষ্ট ঠাকুরের বুকের ওপর জ্বলজ্বল করছে নীল কৌস্তভ! এ আমি কোথায় এলাম? এখানকার
আলো-অাঁধারিত একটা রুদ্ধ শক্তির প্রচন্ড আস্ফালন নিরীহ বাতাসে ঘুড়ির মতো উড়ে
বেড়াচ্ছে –
ঘুড়ি একটা নয়, রংবেরঙের অনেক ঘুড়ি, কিন্তু লাটাই হাতে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না – ঘুড়িগুলোর মালিক কে? হঠাৎ
আমার খুব খারাপ লেগে ওঠে, আমি বেরোবার পথ খুঁজি, কিন্তু ওই গলির ভেতরে আরো অনেক
গলিতে আমি আটকে যাই এবং এদিক-ওদিক যেতে যেতে দেখি আমি এক বিশাল প্রান্তরজোড়া
ভোজনদ্রব্যের গিজগিজে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। মানুষের আর ভোজনদ্রব্যের নিবিড়
ভিড়। কিন্তু সেখানে আমাদের সুপরিচিত খই মুড়ি বাতাসা, কদমা গুড় বা পান্তা ভাতের
ঘুমঘুম স্বস্তির আয়াস নেই – কই কোথায় পাটশাকের সবুজ, কান্তিমান ঝিঙে
পুরুলের তোরণে লাউপাতার ডগডগে উন্মেষ? না, তাল, বেল, ডউয়া, বাংলা কলার হলুদ পাখি,
নোনা আতার নবীনা তরুণীর লাল কপোল, তরমুজ বাঙ্গির হলুদে-সবুজের ফুলকারিতে সাজানো
হাটের ময়দান? না, এসব কিছুই নেই। আছে, ওই যে রুপালি পাতের ওপর জানা-অজানা বিদেশি
ফলের নানান সম্ভার স্তরে স্তরে থরে-বিথরে সাজানো, রূপকথার আলিম্পনের মতো সুসজ্জিত
কত বাহারের মিষ্টান্ন। কত রকমের ঘৃতান্ন, পলান্ন, বিরিয়ানি – সুগন্ধে বাতাস টইটম্বুর।
বড় বড় বাক্সের মধ্যে শূলবিদ্ধ ঝলসানো মাংসের প্রকান্ড প্রকান্ড হাত-পা, গোবদা
গোবদা মুরগি ঘুরে ঘুরে পুড়ছে – হাঁসফাঁস খাওয়ার শব্দ, আয়েসী উদ্গারের শব্দ;
কিন্তু কারা খাচ্ছে? আবছা লালচে আলোয় তাদের ঠিক চেনা যাচ্ছে না; কিন্তু ওই আধো
অন্ধকারে তাদের অবয়বের স্তূপ জানাচ্ছে তারা স্বাস্থ্যবান, পেটঝোলানো ভুঁড়িদার
জাঁদরেল – পাশে সারি সারি বিশাল বিশাল রকমারি শকট। আমার এখন ক্ষিধে জানান দিচ্ছে –
গন্ধে এবং শব্দে আমি এখন ভরপুর হয়ে উঠি, পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করি – এ খানা
আমার ব্যাগের রসদে কুলোবে না। এদের জৌলুসেরই দাম হবে হাজার টাকা। তাহলে এখন
পালানোই খুন্নিবৃত্তির একমাত্র উপায়। আমি দ্রুত ফিরতি পথে হাঁটি এবং পাশে তাকিয়ে
দেখি সারি সারি সরু সরু গলিপথ। আমি ওইরকম একটা গলিপথে ঢুকে পড়ি। আলোটা বেশ কম এবং
বাতাসও ভারি – হাঁপ ধরানোর মতো। কিন্তু একি! দুপাশে ত্যানা কালি ঝোলানো, – ছেঁড়া
কাঁথা, ছেঁড়া- ফেঁড়া কম্বলের টুকরো – মনে হচ্ছে ছেলেবেলাকার পড়া ভূতের বাড়িতে
ঢোকবার পথের মতো। কালো কালো ছায়া ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে – ছোট ছায়া বড় ছায়া মাঝারি
ছায়া। ভালো করে ঠাহর করি, চোখ বিস্ফারিত করি, দেখি ছায়া নয়, ছায়াগুলো মানুষ।
প্লাস্টিকের মতো কীসে যেন জড়ানো মানুষ, না মানুষ নয়, মানুষের ছোবড়া, মানুষের খোলস।
যতোই অগ্রসর হই অগণিত গিজগিজ করছে ছোট-বড় লাখ লাখ মানুষের ছোবড়া। বাতাস দুর্গন্ধে
ভরা, পায়ের তলায় প্যাচপেচে পচা কাদার ক্লেদ। কেউ কেউ কোটরের মধ্যের চোখ ঠিকরিয়ে
আমাকে দেখছে, আমাকে দেখে ভেংচি কাটছে, দাঁত খিঁচিয়ে বলছে, ‘সাদা পোশাকে কাদা
ছিটিয়ে দে।’ আশপাশে ছেঁড়া-খোঁড়া ঘোলাটে প্লাস্টিক-মোড়া কিমাকার ঝুপড়ি, তার পাশে
পচা জঞ্জালের স্তূপ, দুর্গন্ধে ভারি বাতাস, আমি হাঁপ নিতে পারি না – এরা কারা?
কোথায় সেই মণিমুক্তার জৌলুসে ভরা বিপণি বিতান, হীরে ঝলমল সিনড্রেলার পার্টিতে
যাবার দুর্মূল্য শকট, জাহাঙ্গীর বাদশার ময়ূর সিংহাসন, তাজমহলের শ্বেতবৈভব,
হীরে-জহরতের গাছ, ভোজনের বাহারি সুগন্ধি বিরিয়ানি, পলান্ন, ফলের আলপনা – রাশি রাশি
গাদা গাদা। বিশাল শকটের পেট ঝোলানো মালিক, হরেক পোশাকের জারদৌসির সোনা-জরি ঝলসানো
চমক, জরি ঝলমলানো দোকানের বাতায়ন-ঝালর। এ আমি কোথায় এসে পড়লাম! দম বন্ধ করে ছুটতে
চাই। আমার দুই পা অজগরের পেটের মধ্যে গেঁথে বসে গেছে। আমি দুবাহু হাতড়িয়ে বাতাস
খুঁজি, আমার চারপাশে ঘনিয়ে আসে ছোট-বড় মানুষের ছোবড়াগুলো, মানুষের খোলসগুলো। তাদের
গায়ের শুকনো মাংসের গন্ধ বাতাসকে আরো ভারি করে তোলে। নিশ্বাস সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে
যাওয়ার আগে আমি মরণপণ শক্তিতে গা ঝাড়া দিয়ে পা দুটোকে মুক্ত করে দৌড়ুতে থাকি –
কোনদিকে তা জানি না। দম বন্ধ হয়ে আসে কিন্তু আমি জানি বাতাসের আসা-যাওয়ার পথ তো
একটা আছে। বাতাস বইতে বইতে ক্রমশ তা উন্মুক্ত হবেই হবে …।