এলোমেলো ইটসুরকি। বিস্তৃত বাঁকাচোরা প্রান্তরজুড়ে শহীদ মিনারের প্রচুর জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা, আর এক মামুলি কবরের ওপর মাজারের কাজ চলছে। মাথার ওপর সন্ধ্যা পেরোনো ফাল্গুনের ছিমছিমে হাওয়ার দিকে যেতে থাকা কুয়াশার ধুলো সরাচ্ছে।
মৌজ করে একটি ভাঙা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছে চার বন্ধু। আজ এসব ব্যাপারে শিমুলের পয়লা দিন। অন্য তিন দক্ষ বন্ধুর আজ মহাফুর্তির দিন। মা-নানির অাঁচলের মধ্যে গুটিয়ে থাকা ছেলেটা আজ মরদের মতো এসে দাঁড়িয়েছে ওদের সামনে, চলো আজ থেকে তোমাদের দলে যোগ দিলাম; কিন্তু সিরিয়াসলি প্রমিজ করো – এসব খেলে, তোমাদের সঙ্গে চললে আমার ভেতর সত্যিই ডর জাতীয় কিছু থাকবে না?
না। থাকবো না। প্রমিজ?
ভীষণ নিরিবিলি এ-জায়গাটা। মদ-গাঁজা সবই এনেছে ওরা। ওদের পাড়ারই এই ছেলেদের সঙ্গে ন্যাংটাকালে বড্ড দোস্তি ছিল। কিন্তু শিমুল যত বড় হতে থাকল, মা-নানির কড়া অনুশাসনে ওদেরকে এড়াতে থাকল যত, ভালো রেজাল্ট করে করে নাম করল যত, তত সে বাইরের পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটাতে থাকল। স্বপন, মন্টু, ইমতিয়াজরা তাকে নিজেদের বাগে আনতে কম চেষ্টা করেনি, প্রথমে তোয়াজ-অনুনয়… তাতেও যখন শিমুল গা না করে উত্তরহীন, ওদের দেখলে রীতিমতো দৌড় দেয়, তখন ওরা শুরু করল ওর সঙ্গে অমানবিক ইভজিটিং, কী রে? মা-নানি নিজেরা বাইরে আন্দোলন করে, রাজনীতি করে তোর বাল কাইটা তোরে মুরগা বানাইছে? বাইরে তো দেখতে মুরগাই লাগে… ফুলপ্যান্ট খোল… দেখি ভেতরে তুই এখন লেডিস…।
কখনো রীতিমতো চোখে জল এলে ওদের সে-কী অট্টহাসি, ওরে আমার লক্ষ্মীসোনা ময়না, বাজে ছেলেদের কথায় ক্যান যে মেয়েরা এত কান্দে। অ্যাই অ্যাই, কখনো আবার আমাগোর জ্বালায় গলায় দড়ি দিস না যেন। ছোটবেলার খাতির, মনে বড় কষ্ট হইবো।
গাঁজাতে টান দিয়ে যখন শিমুল কাশতে কাশতে অস্থির, তখন তিনজন দুর্দান্ত সহানুভূতি নিয়ে ওর পিঠে থাপ্পড় দেয়, আজ গাঁজা থাক, নাকে হাত দিয়ে গেলাসে টান দিতে থাক… পরে দেখিস, তোর দুনিয়া কেমন জান্নাত হয়া গেছে।
গলায় যেনবা বিষাক্ত ঢেঁকুর… কিন্তু পুরো অবয়বের ঝিমঝিমে মুডে নিজের ভেতর থেকে শিমুল কখনো বিযুক্ত হয়, কখনো ঠা-ঠা শব্দে হাসে, কখনো অনর্গল কথায় মাকে-নানিকে অভিসম্পাত করে, যা এর আগে কোনোদিন কল্পনায়ও করেনি।
চোখ যায় ছিন্নভিন্ন তারের পেছনের খাড়া শহীদ মিনারের দিকে, শৈশব থেকে এই অব্দি প্রতি ভোরে যেখানে ফুল দিতে আসে সে মা-নানির সঙ্গে। এই নাগরিক ইটপাথরের হুজ্জোতেও বসন্তের মিষ্টি হিমেল বাতাস এসে ভেতরটা কেমন যেন উড়ালিয়া করে… সেই বাতাস বাতাসিয়া গ্রাম থেকে ধেয়ে ধেয়ে একটি ধ্বনির নিক্কণ তোলে সোনা মিয়া… আ আ…।
ভেতরে আচমকা মৃদু কাঁপন অনুভব করে শিমুল। সে-ই কত বছর আগে বাতাসিয়া গ্রামের ধনাঢ্য পরিবার থেকে আসা নানা ম্যাট্রিক পাশ নানিকে বিয়ে করে, যখন তিনি ফাইনাল ইয়ার, নানিকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করিয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। তুখোড় রাজনীতির সঙ্গে সোনা মিয়া তখন জড়িত। নানি সুরাইয়ার কাছে সে একজন হিরো। শৈশব থেকে কত-কতবার সে শুনেছে নানির কাছে নানার বীরত্বের গল্প।
পরিবারের মত অগ্রাহ্য করে সোনা মিয়া বিয়ের দুদিন পরেই হোস্টেলে গিয়ে ওঠে। এরপর বাবার সঙ্গে, দস্ত্তর মতো বলা যায়, সম্পর্ক ত্যাগ করেই সুরাইয়াকে তার বন্ধুর প্রেমিকার হোস্টেলে রেখে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করায়।
বিয়ের পরও দুজন দু-হোস্টেলে… কেমন জানি অদ্ভুত একটা অবিবাহিত… প্রেম প্রেম অবস্থা যাচ্ছিল দুজনের। এর মধ্যে সোনা মিয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুরাইয়াও যোগ দিয়েছে ছাত্ররাজনীতিতে। পূর্ববাংলার প্রতি পশ্চিম বাংলার অবহেলা-আগ্রাসন ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে।
যখন শিমুলকে ক্রমের পর ক্রমে কথাগুলো বলত নানি, তখন শৈশবে শিমুল দেখত, সুরাইয়ার চোখেমুখে রহস্য… কৈশোরে সেই একই বর্ণনার সঙ্গে যুক্ত হতো হঠাৎ মনে পড়া অন্য কোনো না বলা কথন… তখন তার মুখে এমনই রক্তাভা, যেন সোনা মিয়া তার সত্তায় হাত রেখে চলছে… যৌবনে সেসব কথনে শিমুল ক্লান্তিবোধ করলে এক দুঃসহ পীড়নে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়িত অনুভবে পড়ত – কী করে একজনকে হারানোর গল্পে জীবনের এই প্রান্তে এসেও নানির চোখমুখে উদ্ভাসন ঝলক দেয়? এই মহিলা কি আদৌ রক্ত-মাংস অনুভবসম্পন্ন কোনো মানবী? তাঁর প্রভাবে পড়াশোনার পাশাপাশি মা-ও রাজনীতিতে যোগ দিলে বাবার সঙ্গে চূড়ান্ত মতবিরোধে মাকে ত্যাগ করে বাবা বিয়ে করে আলাদা এক সংসার পাতে। মায়ের মুখে জীবনের নানা পর্যায়ে শিমুল অনেক বেদনা দেখেছে। বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদের পরই মায়ের মধ্যে শিমুলকে নিয়ে ভয়ের সৃষ্টি হয়। শিমুল যাতে বাজে সঙ্গে না পড়ে, পলিটিক্স না করে, ভালো স্টুডেন্ট হয়, এ নিয়ে মায়ের মধ্যে ছিল কড়াকড়ি রকমের নজরদারি।
নানি বিরক্ত হতেন – ছেলেটার সঙ্গে এসব কী শুরু করলি?
ভয় করে মা, ওর নানা, আপনি… আমার রক্ত ওর শরীরে। সব বাদ দিলাম, সেই রক্তের ধারায় ও যেন পলিটিক্সে না ঢোকে…। আপনাদের মতো বিশুদ্ধতা নেই এখন। পলিটিক্সে পোলিউশন ঢুকে গেছে, নানারকম নোংরামি আর আপস দেখে আমারই হাঁপ ধরে গেছে।
মন্টু চিল্লায়, ঝিম মারলি ক্যান দোস্ত? একটা কথা শোন – যা বলবি, করবি একদম সিনাটান দিয়া, এক ফোঁটাও আফসোস না, আমার বাপেও মুক্তিযোদ্ধা হয়া একটা সার্টিফিকেটের লাইগ্যা যখন ধরনা দিত, নিজেরে মিসকিনের বাচ্চা মনে হইত।
হামাগুড়ি দিয়ে, যেন চতুষ্পদ, এইভাবে এগিয়ে মুখ বাড়ায় ইমতিয়াজ, আমার বাপ তো যুদ্ধের পক্ষেই ছিল না। দুইটা দেশরে জোড়া লাগানোর জন্যি কম কষ্ট করছে? যাউক এখন হাওয়া খারাপ… বসে টলতে টলতে একটা ছুরি দেয় শিমুলের হাতে… এইটা রাখ। বুকে সাহস থাকবো। আরো কয়দিন আমাগো সঙ্গে চল। আজ তো বাকি দোস্তজনরে পাইলাম না। তোর সাহস বাড়লে ওগোর সঙ্গে পরিচয় করায়া একটা পিস্তল দিমু তরে… তখন এইসবের নেশাফেশা থাগবো না… পিস্তল সঙ্গে থাকলে চলাফেরা করার মধ্যে যে সাহসের নেশা… শিমুল রে… বলেই থুঃ থুঃ করতে থাকে, এই নামটা তোর নানি রাখছে, না? ধুর! এইসব পলাশ-শিমুল এসবের লগে এমন কইরা লেপটায়া গেছে শালার একুশে ফেব্রুয়ারি… জঘন্য… দোস্ত আমরা গরু কাইট্যা আবার তর আকিকা করামু।
কথাগুলি ছিন্নভিন্ন হয়ে হাওয়ায় ওড়ে। আবছা আলো-অাঁধারির মধ্যে ছুরিটা শিমুলের টলমলে হাতে সাপের ফনার মতো এদিক-ওদিক দোল খায়, জড়ানো জিহবা উদ্ভাসিত হয়। নানি বলে – শিমুল, তোর মধ্যে আমার, তোর নানার রক্ত… তোর মা-র রক্ত – তুই কোনোদিন খারাপ কিছুকে সহ্য করবি না, প্রতিবাদে সোচ্চার হবি।
মুহূর্তে সমস্ত নীরবতা ভেঙে খিকখিক হাসির ঢেউ ওঠে। ওরে ভাওরা, ওরা কেমনে তোর বংশের হয়? তোর বাপ-দাদারা তো এর ধারেকাছেও ছিল না, তোর বাপ তো এজন্য তোর মারে…।
অতল কষ্টে কলজেটা ছায়াচ্ছন্ন হতে থাকলে শিমুলের বলতে ইচ্ছে করে, নানি তো ইন্দিরা গান্ধীর উদাহরণ দেন। নেহরুর কন্যা হয়েও ইন্দিরা তারই রক্তের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী প্রজন্মকে চালিয়ে গেছেন। ন-মাস মায়ের গর্ভে থাকা সন্তান কী করে শুধু তার পিতার হয়?
না। সে এখন এসব বলে এদের হাসির অগ্নিতে আর ঘি ঢালবে না…।
জানিস শিমুল, আমার বাবা-মা বলত, মেয়ে পরের ধন, অন্যের আমানত… একই গর্ভের সন্তান হয়ে আমি আমার ভাইয়ের দিকে ঈর্ষার চোখে তাকাতাম – বিয়ের সময় যেন স্বামীর বাড়ি নয়, কবরের দিকে যাচ্ছি, এ নিয়ে সে-কী কান্না আমার – নানির চোখে গভীরতা নামে, তোর নানা সেই মাঝরাতে আমাকে আমার বাবার বাড়ি নিয়ে গিয়ে বলেছিল, বাকি অর্ধেক রাত তোমার বাড়ি কাটাব। আমার বাবা-মা এসব দেখে তো রীতিমতো এমন হতভম্ব যে -।
নানার নাম সোনা মিয়া শুধু? আর কোনো ভালো নাম ছিল না? শিমুলের এ-প্রশ্নে হাসে অস্ফুটে নানি, সালাম-রহিম-বরকতদের মতো ভালো নাম ছিল ওর। কিন্তু আমার শাশুড়ি এ-নামেই তাকে ডাকলে এর আড়ালে অন্য নাম ঢেকে যায়। আমার শ্বশুরের পাশাপাশি শাশুড়িও ছেলেকে শিক্ষিত দেখতে চাইত, এক সময় আমার পড়াশোনাকেও তারা সম্ভ্রমের চোখে দেখলেও উর্দুভাষীদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই নিয়ে খুব ভীত থাকত।
এমন পরিবারের একজন মানুষের স্ত্রী হয়েছিলাম আমি – নানির কণ্ঠের অহংকারে থরথরে রোমাঞ্চ, যে বাংলার অশুদ্ধ উচ্চারণ সহ্যই করতে পারত না। আমার ভাইয়েরা উর্দুর মিশেলে কথা বলত। ধীরে ধীরে সোনা মিয়ার সান্নিধ্যে আমরা আমার বাবা-মা-ভাইয়েরা স্পষ্ট শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে শিখলাম। এরপর আমরা দুজন মিলে এই পূর্ব বাংলাতেই দেখতাম সিলেট থেকে চিটাগাং; নোয়াখালী থেকে আসা বাংলা ভাষাভাষীদের কথাই একে অন্যেরা বুঝছে না। তাদের ভাষা যাতে সবাই বুঝতে পারে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা নিজ উদ্যোগে তাদের স্পষ্ট বাংলা শেখাতে শুরু করি।
উর্দুর চাপ ছিল সর্বত্রই, সিনেমায়, নাটকে, সেমিনারে, আমরা সেগুলো ডানা থেকে জল ঝাড়ার মতো ঝেড়ে কবে নিজের মতো একটা পথ বানিয়ে চলছিলাম।
এর মধ্যে মাথার মধ্যে যেন বল্লমের ঘা, এমনভাবে জারি হলো বাংলা নয়, উর্দুই হবে এদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা…। কী রে শিমুল? ঘুমায়া পড়লি নাকি? ইমতিয়াজ খেচখেচানো কণ্ঠে প্রশ্ন করে, মাইকে কী বাজছে রে? আমার ভাইয়ের…? ধুর। এইসব টিকবো না – দুই বড় দলে যে কামড়াকামড়ি লাগছে, আবার আমরা আমাগোর পূর্বপুরুষদের সঙ্গে এক হবো।
হেঃ হেঃ হেঃ স্বপন হাসে, খুব রগরগ করতাছ দেখছি, পঁচাত্তরের পরে তোমাগোর বাপদের জেল থাইক্যা বের কইরা আমার বাবারা ক্ষমা না করলে -?
চুউপ! ইমতিয়াজের প্রায় হুঙ্কারে চারপাশের স্থাপনা, অর্ধনির্মিত মাজারসহ পুরো পরিবেশটা কেঁপে ওঠে, কী দোষ আছিল আমাগোর যে ওরা বন্দি করব, তোরা ক্ষমা করবি? গন্ডগোল, অশান্তি সব করেছিল ওই একুশের গুন্ডাগুলা, একাত্তুরের দস্যুগুলা…।
ফের ঢেঁকুর উঠছে শিমুলের, তেতো, এদের সামনে সে বমি করবে না, নিজের কোনো দুর্বলতা, ভয় দেখাবে না, শুরু থেকেই নিজেকে এ-বিষয়ে কষে বেঁধেছিল সে। ফের স্মরণ হওয়ার গলায় স্বস্তি টেনে বলে, না, ঘুমাইনি। তোদের কথা মন দিয়ে শুনছিলাম। ফের ওরা উর্দু আর পাকিস্তানের সাফাই গপ্পে মেতে ওঠে। শিমুল জানে, শহীদ মিনারের পাশে এখানে আদৌ কোনো পিরের কবর নেই। পত্রিকায় পড়েছে সে, এ নিয়ে এই স্বাধীন দেশে ফেব্রুয়ারি মাসে এত সোচ্চার প্রতিবাদের পরও কী করে কিছুই হচ্ছে না? তবে কি মন্টু-ইমতিয়াজের কথাই ঠিক? আবার উর্দু… পাকিস্তান…।
কানের কাছে হাওয়া থেকে উড়ে আসা ষাট বছর আগের এক হুংকার মুহূর্তে তাকে কাঁপিয়ে দেয়। খাড়া রোদ্দুরের ঝকঝকে আলোয় দন্ডায়মান সোনা মিয়ার মাথা… চোখ থেকে ধিকধিক করে বেরোচ্ছে অগ্নি। হিমহিমে ভয়ে এগিয়ে যায় সুরাইয়া, শান্ত হও, ক্রুদ্ধ হয়ে, ক্ষিপ্ত হয়ে কিচ্ছু ভালো হয় না, মাথা ঠান্ডা করো।
শান্ত হয়ে, মাথা ঠান্ডা করে কোনো যুদ্ধ হয় না।সোনা মিয়ার এ-কথার মাঝখানে ঝাঁপ দেয় অনেক ছাত্রছাত্রী। রাত জেগে তারা পোস্টার লেখে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই… যেটার মধ্যে আঠা লাগায় কেউ… এরপর দেয়ালে দেয়ালে, লাঠির মাথায় সেসব পোস্টার, যেখানে উর্দুর বিরুদ্ধে নানা কথা লেখা ছিল… সেসব নিয়ে সবাই সিদ্ধান্ত নেয়, নিজেরা তো মিছিলে বের হবেই, সঙ্গে সারাদেশে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে এ-মিছিলের ভাষা ছড়িয়ে দিতে হবে।
ফিসফিস করত শিমুল। নানুমা, আপনার ভয় লাগত না?
না! সোনা মিয়া যেন ছিল এক দুর্মর সাহসের প্রতীক… তার সামনে ভয় যেন লজ্জা পেত।
তারপর?
এইবার নানির চোখের দিকে বরাবরের মতোই তাকায় শিমুল। বরাবর একই দৃশ্য দেখে, ধীরে ধীরে নানির চোখ প্রস্ফুটিত হচ্ছে… আমরা মিছিল নিয়ে যাচ্ছি… না, আমরা তাদের ধন-সম্পদ চাইনি, তাদের রাজ্য চাইনি, স্রেফ আমাদের বাংলা ভাষাটা আমরা বলব, তাতেও তাদের গায়ে ফোড়ন লাগে? শিমুল, একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল ক্রমশ এগোচ্ছে… আমি কল্পনাও করিনি এমন একটি আন্দোলনের বিরুদ্ধে বন্দুক তো দূরের কথা, লাঠি নিয়েও কেউ সামনে এসে দাঁড়াবে…। কিন্তু আমরা যত এগোচ্ছি, দেখি শত শত উর্দু ভাষাভাষী খাকি উর্দি পরে আমাদের সামনে বন্দুক তাক করে হুংকার করছে – এক পা এগোলে -। শিমুল সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু আর উর্দুকণ্ঠের পিশাচীয় চিৎকার শুনে আমাদের রক্তে যেন দাবাগ্নি লাগল, মৃত্যু কে, তুচ্ছ। সোনা মিয়ার হাত শক্ত করে ধরে আমরা এগোতে থাকলাম -। মুহূর্তে কান ফাটানো গুলির শব্দ। নানির চোখে ঘৃণার ছায়া কাঁপতে কাঁপতে উদ্ভাসিত এক রূপ নেয়। ঝাঁ করে একটা গুলি আমার কানের পাশ দিয়ে গেলে আমি প্রায় লাফিয়ে উঠে দেখি, চারপাশে আরো কিছু রক্তাক্ত মানুষের পাশে আমার শাড়ি রক্তে লেপটে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে সোনা মিয়া।
কেন এমন একটা বর্ণনাতেও নানির চোখে উদ্ভাসন? ‘তোর নানা শহীদ হলো’ এটা বলতে কেন তার চোখে এমন অহংকার, যেন নানা মারা যায়নি, তার গর্ভ থেকে জ্যান্ত ভূমিষ্ঠ হয়েছে? ধিক এই নারীকে ধিক! এ মানুষ না… ভেতরে ভেতরে একটা ডাইনি… ক্রোধে কম্পিত শিমুল বোতল টেনে সাই করে গলায় ঢাললে পাশের তিনজন হাততালি দেয়… সাবাস।
আজ বিকেলেও, আচমকা নানার প্রসঙ্গ উঠল, তখন শিমুল অনেকটাই চলে গেছে মন্টুদের দখলে, নানি যখন বলল, তোর মধ্যে আমি সোনা মিয়াকে দেখি…। সেই মুখ, সেই চোখ, কেবল হাতড়াই, সাহসটা দেখি না।
পঁচাশি বছরের বুড়ির কম্পিত মুখে এমন আফসোস দেখে ঘৃণায় রি-রি করে শিমুলের সত্তা, কী চায় ডাইনিটা? সোনা মিয়ার মতো তার মৃত্যু? আজ ওর মুখে মদের বমি উগড়ে দিয়ে শিমুল সাহস দেখাবে।রে বইমেলার সামনে এত রাতেও হুজ্জোত। রাত বারোটায় শহীদ মিনারে আসার প্রস্ত্ততি চলছে। সোচ্চার হচ্ছে ভাষাগানের কোরাস, তাতেই যেন পিত্তি জ্বলে যায় ইমতিয়াজের। সে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে শহীদ মিনারকে উদ্দেশ করে লম্বা হিসু ছাড়তে ছাড়তে চিল্লায় – ও রে শিমুল দেখ, আমি তগোর সোনা মিয়ার মুখে পেচ্ছাপ ছুড়তাছি…। আচমকা শিমুলের নিজের অস্তিত্বে অদ্ভুত এক বিস্ফোরণ উঠে মুহূর্তে সব নেশা ছুটে যায়। এইবার দেহের গড়নে শিমুলের অস্তিত্বে ভর করে দুর্দান্ত সোনা মিয়া। সামনে উর্দুভাষী মুখগুলোকে হায়নার মতো হাসতে দেখে সে অদ্ভুত জোর নিয়ে দাঁড়ায়… যেন অজগরের হিসহিস এই ধ্বনিতে মুহূর্তে ইমতিয়াজকে তাজ্জব করে দিয়ে সাইসাই দৌড়ে সে ছুরি বসিয়ে দেয় ইমতিয়াজের পেটে – কুত্তার বাচ্চা, আমার মুখে পেচ্ছাব করিস তুই? সোনা মিয়ার মুখে? এতো সাহস তোর? সেইদিন আমার বুকে গুলি চালিয়েছিলি… আজ আমার পালা…। গনগনে দেহটা বাঁক নিতেই ঝাঁপসা চোখে শিমুল দেখে, প্রতিশোধকাতর শিমুলের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে ইমতিয়াজ আর পরমুহূর্তেই স্বপনের হাতে বন্দুক। হাসপাতালের ওপর সাদা সাদা কদিন টানা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে শিমুল যখন দেখছে ক্রমশ তা ঝাপসা হয়ে আসছে, যখন শহীদ মিনারের পাশের অবৈধ স্থাপনা আর কথিত মাজারের ভাঙার কাজ চলছে। আচমকা কানে আছড়ে পড়ে মায়ের বিলাপ ছাপিয়ে নানির রোদন, তুমি মৃত্যুর সময় আমাকে দিব্যি দিয়ে গিয়েছিলে, তোমার মৃত্যুতে যেন আমি না কাঁদি, অহংকার করি… সোনা মিয়া এই দেখো, আমি তোমার জন্য কাঁদছি। আমি তোমার কথা রাখতে পারলাম না…।