জ্যামে আটকে পড়া বাস থেকে নেমে পড়লেন ব্রজনাথ। আরেকটু হলেই বাসটা চলতে শুরু করতে। গুঁতিয়ে-গাঁতিয়ে রিস্ক নিয়ে নামলেন। বাবুঘাট থেকে বসেই আসছিলেন। হেড অফিসে কয়েকদিন যাতায়াত করতে গিয়ে এই পথের পথিক। রোজই ভাবেন ব্রিজের ওপর গাড়ি স্লো হলে নেমে যাবেন। আজ করেই ফেললেন।
সামনের গেট দিয়ে নামা ঠিক হয়নি – ভাবলেন তিনি। পেছনের চাকায় জড়িয়ে গিয়েছিল সৌমেন। কবিতা লিখত, বই বেরোনোর কথা ছিল কবিতা-উৎসবে, তার দিন দুই আগেই, ব্রজনাথের চোখের সামনে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাথাটা ঝন ঝন করে একটু ঘুরে গেল। রাস্তা পেরোলেই সারি সারি সাজানো-গোছানো শরীর। এই অবেলায় শিকারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছে তারা, রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে। চোখেমুখে অভিনয়, নিশিডাকের মতো মায়াজড়ানো ঠার-ঠোর। এসব পুস্তকে ঢের পড়েছেন ব্রজনাথ। হয়তো কোথাও না জেনেবুঝে লিখেওছেন এঁদের কথা। কিন্তু কখনো মিট করেননি। যাঁরা এঁদের অন্দরমহলের কথা লেখেন, এই যেমন কদিন আগে একটা ধারাবাহিক লেখায় দেখা গেল – তিনিও কি সঙ্গ পেয়েছেন এঁদের? লেখার জন্যে মিট করা আর সাধারণ মানুষ যে-কারণে আসে, দুটো কি এক!
ব্রজনাথ এবার চমকে উঠলেন। তিনি একজন খদ্দের সেজে এলেন! না, শুধু সেজে নয়, রীতিমতো খদ্দের হয়েই। পারবেন তিনি ওই নোংরা পরিবেশে সস্তার একজন খেলুড়ের সঙ্গে মেতে উঠতে? যদি বয়েস কম হতো, তাহলে এই পতনের – কিংবা পতন না ভাবলেও, অ্যাডভেঞ্চার করা সংগত হতো। দেহ বিক্রি করলেও তাদেরও তো সামান্যতম রুচিবোধ থাকবে – এটা ব্রজনাথের মতো লেখকের বোঝা উচিত। দু-মলাটের মাঝে এঁদের মহান করে অাঁকার চেষ্টা হয়। তাদের দারিদ্র্য, অসহায়তা, নির্যাতনের ছবি নিয়ে কত আলোড়ন। সেসব সময় ফুরোলে হারিয়েও যায়। ব্রজনাথ তেমন ভাসাগলা কোনো বিশ্বাসের কাছে নত হন না।
তবু ব্রজনাথ বহুবার কোনো এক দেহপোজীবিনীকে নিয়ে মনে মনে তাঁর ডেরায় ঢুকেছেন। অপরিসর অন্ধকার গলি, অশ্লল, মন্তব্য, সস্তা পারফিউম আর ফুলের মিশ্র গন্ধ, হালকা লিকারের বাঁজ, তেলচিটে বিছানা…। এরপরই থমকে গেছেন ব্রজনাথ। কল্পনার রঙে রাঙানো ছবিটা বাস্তবে এতোটাই ঘিনঘিনে, এতোই বৈপরীত্যে ভরা!
– কী হলো তোমার? ফুটপাথের উঁচু ধাপে উঠতে গিয়ে প্রায় ঢলে পড়লেন একজনের গায়ে? প্রশ্নটা কি সেখান থেকেই এলো?
খপ করে একটা হাত ধরে ফেলল তাঁর বাহু। মুখে অদ্ভুত হাসি। গাঢ় এক গন্ধ নিঃশ্বাসে। খসখসে আঙুলে কতটুকু ভালোবাসা বোঝা শক্ত।
– কেন তুমি এলে এখানে? প্রশ্নটা এবার নিজেরই, বুঝতে পারেন ব্রজনাথ।
– বেশ করেছি। একজন নিরুপায় মানুষই তো আসে এখানে। আশ্রয় চায়। প্রেম…
– কীসের আশ্রয়? শরীরের? তোমার স্ত্রী এখনো সুন্দরী, তাঁর যৌবনে এখন ভাটা পড়েনি। তাহলে…?
– ইয়েস, তার এখনো সামর্থ্য আছে। এবং শুধুই শরীরসর্বস্বতা! আমি হাঁসফাঁস করি ওই একই ডোবায় ডুব দিতে দিতে। ওই জল আমাকে শীতল করে না। একটা, ধরো – একটা ঝোরার স্বাদ আমি কি চাইতে পারি না?
– সে তো অসাধ্য কিছু না। আজকাল পয়সা ছড়ালে; ঝোরা কেন, গোটা নদীও পেতে পারো।
– না, নদী নয়। ওই পবিত্র-পবিত্র ভাবটাকে আমার মনে হয় মুখোশ। ওই জগৎটাই আমাকে শুষে নিয়েছে। আমাকে নির্ভেজাল রূঢ় কর্দমাক্ত বাস্তবের সঙ্গে কাটাতে দাও।
– তা এভাবে হয় না, তাছাড়া একবারও তোমার মনে হলো না নিজের মানসম্মানের কথা।
– না। আরেকটু হলেই তো সৌমেনের মতো – এখন কোথায় থাকত আমার সম্মান? এখনো প্রায়ই মনে হয় এই চলমান গতির নিচে, মেট্রোরেলের তীব্র বেগের সামনে ঝাঁপ দিই। এই ব্রিজ থেকে নিজেকে ভাসিয়ে দিলেই তো –
– না ব্রজ, তা হয় না। তোমার সামনে দীর্ঘ সময় পড়ে রয়েছে। কত কী করার রয়েছে।
– না না না। তুমি জানো না আমার দিন কীভাবে কাটে। -নীচতার কথা শুনলে তুমি কানে আঙুল দেবে। আমার আচার-আচরণ, দিনযাপনে ভীষণ কাদা মিশে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
– নীচতার বোধ থাকা সত্ত্বেও তুমি নামছ?
– হ্যাঁ। জানছি, বুঝছি, তবু তা থেকে রেহাই মিলছে না। পকেটে রাখা মোবাইলটা হঠাৎ বেজে ওঠে। ফুটপাথ থেকে কোনদিকে যাবেন ঠিক করতে পারেন না। এই গলিটাই কি নরকে গিয়ে মিশেছে? পেছন থেকে মন্তব্য কানে এলো, মরণ! ম্যাশিনটা বাজার আর টাইম পেলে না!
বিরক্ত কণ্ঠে ব্রজনাথ বললেন, হ্যাঁ ব্রজনাথ বলছি – কে?
– আমি রূপেশ বলছি…। রূপেশ। আপনি কোথায়?
– একটা বাজে জায়গায়।
– লেখার রসদ? তা কী ধরনের বাজে? হালকা হাসি ভেসে এলো। মনে হলো রূপেশ বিদ্রূপ করছে। তা তো করবেই। সারা পৃথিবীর কাছে ব্রজনাথ দাস এখন বিদ্রূপের পাত্র। একটা ফুরিয়ে যাওয়া ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠা। কী চাইবে রূপেশ? একটা লেখা, তাই তো? আমি লিখব না। লিখতে চাই না। কিচ্ছু হয় না লিখে, যদি না তোমার নামযশ আর পুরস্কারের লোভ থাকে। কেউ পড়ে না। পড়ে উদ্দীপিত হয় না। কোনো রিপার্কেশন নেই এই প্রগতিবাদী সমাজের। আফিস সুড়সুড়ি ছাড়া কোনো কিছুতে স্পার্ক নেই পাঠকের।
– হ্যালো ব্রজদা, কিছু বলছেন না? ব্যস্ত নাকি! তাহলে পরে না হয় করি?
– না। কী বলবে বলো –
– বলছি -, লেখালিখির কী খবর? একদমই চোখে পড়ছে না।
রূপেশের কণ্ঠে কী এক আবেদন ছিল, ব্রজনাথ সংযত হলেন, শান্তভাবে বললেন, ভালো না। লিখতে পারছি না।
– কী হয়েছে বলুন তো? এতো পাওয়ারফুল হাত আপনার। এভাবে যদি… না। রূপেশ তাকে ইমপ্রেস করছে না। বয়েস তার নিতান্তই অল্প, একজন সিনিয়র লেখককে তোষামোদ করার ধৃষ্টতা হবে না। আর লাভই বা কী! রূপেশের নিজের কোনো ম্যাগাজিন নেই যে, লেখা চাইতে হবে। ব্রজনাথ কাউকে কিছু পাইয়ে দেবেন না। যে-যে সংযোগ থাকলে এসব করে নাম কেনা যায় – সে- অবস্থান থেকে তিনি যোজন দূরে।
– লেখার পরিবেশটাই হারিয়ে গেছে রূপেশ।
– তা কেন? আপনার লেখা তো পাঠক নিয়েছে। বড় বড় কাগজে ছাপা হয়েছে। জায়গার তো অসুবিধে নেই।
– জায়গা পেলেই তো ফরাস পাতা চলে না রূপেশ। ব্যবসায়ী কাগজ দেখে লেখার বাণিজ্যিক গুণ আর অ-ব্যবসায়ী ম্যাগাজিনগুলো হাঁকপাক করে লাইনে ভেড়ার চেষ্টায়। যাই বলো রূপেশ সিরিয়াসনেসের অভাব, অশ্রদ্ধা কোনো সংস্কৃতির গুণ হতে পারে না। শুধু শুধু পাঠক নেই বলে চিৎকার করা মূর্খামি।
– কী বললেন? হ্যালো, শোনা যাচ্ছে না – হ্যালো ব্রজদা – কেটে গেল লাইনটা। এক-পা দু-পা হেঁটে যেখানে এসে দাঁড়ালেন ব্রজনাথ ফোনের খেয়ালে, সেটা অন্য এক গলি। দুপাশে পুরনো বাড়ি, রাস্তায় লোকজন কম। ঠং ঠং ঠন ঠন একটা শব্দ কানে ভেসে আসতে বুঝলেন, কোথাও শিল কোটানো হচ্ছে। বয়স্কা মহিলাটি, যিনি একদা বহু বাবুর মন মজিয়েছেন – তাঁর পানরাঙা ঠোঁট নিয়ে, ব্লিচ করা চুল নিয়ে ঝুঁকে দেখছেন। এঁরই শিল হয়তো। ছেলেটি অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় আর ছন্দে শিলের বুকে এঁকে চলেছে সুখী সংসারের চিহ্ন। এই ছন্দ সে শিখেছে তার পিতার কাছ থেকে। পিতা শিখেছে তার পিতার কাছে…। মালকিনের সুগন্ধিত শরীর, শিথিল অাঁচল কিছুই তাকে আকর্ষণ করছে না। শিলের শব্দে, চরাচরের নৈঃশব্দ্যে যেন এক নরম আবহ, মগ্ন করে দেয় ব্রজনাথকে। দূর থেকে কয়েকজোড়া চোখ এবার শিলের দিক থেকে ব্রজনাথের ওপর গিয়ে পড়ল। হাসাহাসির ঢেউ উঠল। সংবিৎ ফিরে পেয়ে সরে আসে ব্রজনাথ। শহরে কখন সন্ধ্যা নামে বোঝার উপায় নেই। শুধু নানা ধরনের আলো জ্বলে ওঠে। তাদের সম্মিলিত রোশনাইয়ে কিছু একটা ঘটে যায় নগরের মনে। ব্রজনাথ হেড অফিসের ডিসিশন নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাঁকে বলতে হবে, কেন তিনি তাঁর লেখায় রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারকে উৎসাহ দিয়েছেন। লেখাটা বেরোনোর পর শুধু অফিস-কলিগ নয়, তাঁর সমসাময়িক, সিনিয়র লেখকদের কাছে ধিকৃত হয়েছেন। ধিক্কারের ভাষা কখনো নীরবতা, কখনো-বা এড়িয়ে যাওয়া। এসব ঘটেছে অসম্ভব দ্রুততায়, যেন রাতারাতি। তাঁর লেখা যখন পাঠকের মন জয় করছিল, তার প্রভাব এতো দ্রুত ছিল না। সামনে পাঁচতলা বাড়িটার ওপর গত পুজোসংখ্যার এক বিশাল হোর্ডিং। ওখানে সমসাময়িক নামের পাশে ব্রজনাথের নাম থাকার কথা ছিল। প্রায় দুবছর উপন্যাসটা জমা থাকার পর সিলেক্টেড হয়েও ফেরত আসে। সরকার-প্রতিপালিত কাগজ, ব্রজনাথের ঠাঁই হবে না আর।
চলতে চলতে ফাঁকা ফুটপাথ ছেড়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে যান। ইচ্ছে করে নিজেকে ভাসিয়ে দেন পথচারীদের মাঝে। যেন নিজের জন্যে হাঁটছেন না। সকলে মিলে যেখানে, যেদিকটায় পৌঁছে দেবেন – সেটাই তার গন্তব্য। অদ্ভুতভাবে ব্রজনাথের বাহু টার্গেট করছে নারীশরীরের নরম অঙ্গ। প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন মেয়ে পথচারীর বুকে। যেন শ্লীলতাহানির দায়ে কেউ তাঁকে চড়থাপ্পড় কষালেও কিছু যায় আসে না।
– এ কী! এ-লাম্পট্য কেন তোমার ব্রজনাথ! এই নীচতার কথাই কি বলতে চাইছিলে? আবার শুনতে পেলেন নিজের স্বর ব্রজনাথ দাস।
– শুধু আমাকে কেন দুষছ বন্ধু? কে লম্পট নয়! সুযোগ পেলেই তৎক্ষণাৎ সদ্ব্যবহার করে ফেলে যে, সে কি কম লম্পট! আমাকে যে-সমস্ত পজিশন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, সেগুলোতে কামড়াকামড়ি করে কেউ হোল্ড করেনি? তারা তো বড় বড় মানুষ। সাধারণের মতো তারা যদি লোভ-লালসায় কাতর হয় – আমি কোথাকার হরিদাস!
– তাই বলে মেয়েদের শরীরে হাত দেবে?
– মেয়েদের শরীর বলা যায়? ওটা হলো গ্লোবালাইজেশনের কমোডিটি। ইয়েস। দেয়ার ড্রেসকোড, দেয়ার একসপোস্ড্ বিহেভ কলড এভরিবডি টু ইউস ইট। টু গ্ল্যাব ইট অ্যান্ড ক্যাপচার ইট ব্রুটালি!
– কিন্তু তুমি সাধারণ মানুষ নও, তুমি একজন লেখক। সবাই মন্দ বলে তুমিও মন্দ হয়ে যাবে? তোমার একটা সামাজিক দায়বোধ থাকবে না?
– দায়বোধ, দায়বদ্ধতা, হাঃ। ওই শব্দটা কেমন যেন পচা দুর্গন্ধময় মনে হয়। যারা কোনোদিনই দায়বদ্ধ ছিলেন না তারা আজ কেমন রাষ্ট্রযন্ত্রের তাঁবেদার হয়ে নিরীহ মানুষ খুনের সাফাই গাইছেন! দেখছ না? আর যারা দায়বদ্ধতার কথা শিরা ফুলিয়ে বলতেন, তাদের কুম্ভীরাশ্রু এবং মিউ মিউ কম ইন্টারেস্টিং নয়। আমার সব কেমন গুলিয়ে যায় বন্ধু – সব ভদ্রপনার মুখোশ এখন উন্মোচিত! নিজেরটা টান মেরে দেখি – দেখতে চাই – হাঁপাতে থাকেন ব্রজনাথ। শরীর এলিয়ে পড়ে -। একটা দোকানের ফাঁকা টুল দেখে বললেন, একটু বসা যাবে?
– হ্যাঁ, বসুন না।
তারপর লোকটি ঘন ঘন জরিপ করতে থাকলেন ব্রজনাথকে। সাধারণ একটা ট্রাউজার, ময়লামতো হাফ শার্ট, ধুলোমাখা চম্পল, উস্কোখুস্কো চুল, উদ্ভ্রান্ত চাহনি। এমনকি চশমাটাও যেন বহুদিন না- মোছা। কোথায় যেন দেখেছি দেখেছি -। লিটল-ম্যাগের স্টলে, নাকি সাহিত্যসভায়, সিরিয়াল করেন? জিজ্ঞাসা করেই ফেললেন, আপনাকে চেনা চেনা লাগছে, কোথায় দেখেছি বলুন তো দাদা?
– আমাকে একটু জল দেবেন?
– সিওর। এই নিন।
জল খাওয়া শেষ হলে লোকটির তাগদা, কই বললেন না তো? মলিন হাসলেন ব্রজনাথ – আমার মতো দেখতে একজন লেখক আছেন, আপনি তাঁর সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন। তাঁর নাম ব্রজনাথ দাস। আর আমি একজন চাকুরে, জাস্ট মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ।
দুই
বাজার থেকে ফিরে একটা চিঠি টেবিলে পড়ে থাকতে দেখলেন ব্রজনাথ। সম্ভ্রান্ত চিঠি। অল ইন্ডিয়া ল্যাংগুয়েজ সোসাইটি অ্যান্ড মাস কালচার থেকে। খুলে ফেলে চিঠিটি পড়বার পর ছিঁড়তে থাকলেন কুচি কুচি করে।
আরতি কাছে এসে একমুখ প্রশ্ন করবেন কী – হতবাক হয়ে গেলেন – ছিঁড়লে কেন চিঠিটা?
– কোথায় ছিল এটা?
– মানে? কালই তো এলো –
– প্রোগ্রাম হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর চিঠি হাতে পাচ্ছি?
– তা আমি কী করব? কালই তো এলো। খামটা হাতে নিয়ে বললেন আরতি, এই যে, কালকের তারিখ –
চিৎকার করে উঠলেন ব্রজনাথ – নোংরা, নোংরা, সব পচে গেছে। পুরো সিস্টেমটাই পচে গেছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাইরে মনোরম পরিবেশ। মনে মনে বললেন, এসব ক্রমশ মানুষ ধ্বংস করে দেবে! দিচ্ছে! পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন আরতি, এ কী তোমাকে কিমার মাংস আনতে বললাম না। মেয়েটা খেতে চাইল, তাকে রেঁধে পাঠাব কোথায় – ব্রজনাথ আবার চিৎকার করে উঠতে পারতেন। করলেন না। মাথা নিচু করে বসে রইলেন। নিত্যদিনের এই চাহিদা আর ততোধিক ভুলে যাওয়া। কীভাবে ব্যালান্স হবে এসব? আরতি এমন শান্ত পরিবেশে ঝড়ের আভাস দেখতে পেয়ে বললেন, হাতমুখ ধুয়ে এসো, খেতে দিচ্ছি।
খানিক পরে যে-মেয়েটির সঙ্গে ব্রজনাথের নমস্কার বিনিময় হলো, তাকে আগে কখনো দেখেননি। স্মার্ট, দেখতে মন্দ নয়।
– স্যার, আমাকে রূপেশদা পাঠিয়েছে, এই কার্ডটা দিতে বলেছে –
– বুঝলাম না। আমাকে রূপেশ তো কিছু জানায়নি। পরে ফোন করবে বলে – সে তো প্রায় এক সপ্তাহ হতে চলল -। না না, আমি কোনো আসরে যেতে পারব না। নিজেরটুকু কীভাবে জাহির করা যাবে, তা নিয়ে সবাই ব্যস্ত, অপরেরটা দেখার বা শোনার ইচ্ছে শেষ – না -।
– প্লিজ স্যার, আমার কথাটুকু শুনুন। রূপেশ নিজেই আসত, কিন্তু ও এখন পুলিশি হেফাজতে। সেদিন মিটিং থেকে ওকে অ্যারেস্ট করা হয়।
বলতে বলতে মেয়েটির চোখ ভিজে ওঠে। সামলে নেয়।
ব্রজনাথ এবার নরম গলায় জিজ্ঞেস করেন, রূপেশের সঙ্গে তোমার কোনো রিলেশন?
– একসঙ্গে পড়ি। এর বাইরে রিলেশন দিয়ে কী হবে? আমিও কোনোদিন হয়তো পুলিশের হাতে – মানুষের লড়াইয়ের সঙ্গী হিসেবে থাকতে গেলে এসব তো ঘটতেই থাকবে! তাই না? যাই হোক, আপনি কার্ডটা পড়ে দেখবেন, এটা মামুলি গল্প পাঠের আসর নয়। আর পলিটিক্যাল কোনো কর্মকান্ড তো নয়ই। আপনাকে সসম্মানে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে একটা কমপিটিশনের জাজ হিসেবে।
– জাজ! মানে, আমাকে আরো বৃদ্ধ বানিয়ে দিচ্ছ তোমরা? মৃদু হাসলেন।
– কী বলছেন স্যার! ইউনিভার্সিটি লেবেলের ছাত্রছাত্রীদের সাহিত্য প্রতিযোগিতার জাজ হিসেবে আপনাকে ছাড়া আমরা কাউকে ভাবিইনি। যে-কোনো মূল্যে আপনাকে চাই, বলেছে রূপেশ সে-কথা।
ব্রজনাথ কার্ডখানা পড়লেন। দুবার পড়লেন। তাঁর মনে হলো, এই অগোছালো ঘরখানিতে মেয়েটিকে বসানো ঠিক হয়নি। একটা বড় ডাইনিং বানিয়েছিলেন খরচ করে। সাহিত্যের আসর বসবে, জ্ঞানীগুণীর সমাবেশ ঘটবে, আড্ডা হবে। সেটি বহুদিন কাজে লাগেনি। ধুলোধূসর পড়ে রয়েছে। ওটাকেই সাফসুফ করে যদি বসানো যেত।
ব্রজনাথ লম্বা শ্বাস নিলেন, তারপর সম্মতি জানালেন। মেয়েটি বলল, গাড়িতে যাবেন স্যার, আমরা ভাড়াটা পে করব। চলি। দুদিন আগে একটা রিমাইন্ডার দিয়ে রাখব। আপনি ব্যস্ত মানুষ, প্লিজ যদি ছ’তারিখটা একটু নোট করে রাখেন।
উঠে পড়ল মেয়েটি। মেয়েটি নয়, ওর নাম অপরা। ব্রজনাথের মনে শ্রদ্ধা জাগল ঘরটা শূন্য হওয়ার পর। মেয়েটির অনুপস্থিতির শূন্যতা ভরে গেল যেন তার ফেলে যাওয়া সম্মাননায়।
হলভর্তি ঝাঁ-চকচকে ছেলেমেয়ে। ব্রজনাথ ঢুকতে সকলে উঠে দাঁড়াল। আরো দুজন অতিথি আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। সবাইকে বরণ করা হলো পুষ্পস্তবক দিয়ে। ব্রজনাথ এতদিন এঁদের সাহিত্যকৃতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এখন মুখোমুখি পরিচয় হতেই চমকে উঠলেন। একাসনে তারা বসলেন যেমন, তারা ব্রজনাথকে ডেকে হাত ধরে বললেনও, আপনার লেখা একেবারে অন্যরকম। এভাবেই লিখে যান -।
ব্রজনাথের ঠোঁট কাঁপে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। এসব কী শুনছেন! বেশিক্ষণ শোনা যায় নাকি।
একে একে প্রতিযোগীরা পাঠ করতে লাগল। ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীদের অংশগ্রহণই বেশি। ব্রজনাথ স্কোরিং শিটে নম্বর দিতে দিতে আশ্চর্য হয়ে প্রতিটি টেক্সটের নতুনত্বে মুগ্ধ হচ্ছিলেন। নতুন প্রজন্ম, তাদের নিত্যনতুন ভাবনার প্রতিফলন – । কে বলে আগামী দিনে সাহিত্যের ক্ষেত্র মরে আসছে! শুধু নতুনত্বে নয়, এদের লেখায় যেন মনে হয়, বাংলা ভাষার মাইলস্টোন লেখাগুলো হজম করে তারপর কলম ধরেছে।
ব্রজনাথের আশপাশ ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে। কানে কেবল শুদ্ধ পবিত্র কিছু শব্দের উচ্চারণ। অদৃশ্য হতে থাকে যাবতীয় শরীরী উপস্থিতি। তারপরও সংগতের মতো ভেসে আসে এক মগ্ন শিল্পীর কাজ। আপন মনে সে গেঁথে চলেছে চিরায়ত এক সংসারজগৎ। ঠকঠক ঠং ঠং ঠন ঠন…। যেখানে পাওয়ার আশঙ্কা অর্থহীন। শুধুই গেঁথে যাওয়া, রচনা করে যাওয়া, সম্পর্কের ভিত মজবুত করা! সেইসঙ্গে নিজেকে সম্মানিত করে তোলাও।
ব্রজনাথ সেই তুচ্ছ শব্দের সঙ্গে জড়াতে জড়াতে নিজেকে কখন যেন কোটাই হতে দেখতে লাগলেন।