বেডরুমের খাটের এক কোনায় বসে আছে সালমা। মুখটা কাঠিন্যের মুখোশে আটকে ফেলেছে সে। এতে করে তার অসচেতন অনিচ্ছায় যা ঘটেছে, তা হলো তার স্বাভাবিক সৌন্দর্যের বলতে গেলে পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেছে। যদি সে এখন আয়নায় তার আচমকা বদলে যাওয়া মুখের অাঁকাবাঁকা রেখাচিত্র দেখতে পেত, ঠিকঠিক সে নিজেই লজ্জা পেয়ে কাউকে কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়ে সামলে নিত। কিন্তু অবিবেচকের মতো একেবারে কোনো কিছু না জেনে তাকে দোষ দেওয়াও বোধহয় ঠিক হবে না। হঠাৎ করে চরম অনাকাঙ্ক্ষিত, যাকে অন্যরা বলবে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অস্বাভাবিকতায়, এক ঘটনার মুখোমুখি হয়ে পড়ায় বেচারি বেশ কিছুটা হতচকিত। সে নিজেকে সহজে সহজ করতে পারছে না। এটা তার বসে থাকার ভঙ্গি থেকে শুধু অনুমান করা যেতে পারে। আরো যেটা অনুমান করা যাচ্ছে, তার চরিত্রের স্বভাবগত দৃঢ়তার কারণে সে এখনো প্রাণপণে বাহ্যত নিজেকে শক্ত রাখার সবরকম চেষ্টা করছে। মনে মনে, নিজের সঙ্গে। হতাশায় সে অনেকটা বিমর্ষ, কিন্তু ভেঙে পড়া কাতর নয়।
ঘরের আরেক দিকে ড্রেসিং টেবিলটার পাশ ঘেঁষে একটা প্লাস্টিকের মোড়া। সেটার ওপর বসা তার স্বামী আশরাফ সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে। তার অবনত দৃষ্টি মেঝের কালো-সাদা মোজাইকের ভেতর গণিতের কোনো সূত্র সমাধানের নিমগ্নতায় আচ্ছন্ন। সাত বছরের একটানা নির্বিঘ্ন দাম্পত্য জীবনের এক জটিল মুহূর্তে তারা স্বামী-স্ত্রী দুজন উপনীত হয়েছে। ব্যাপারটার কারণ ঘটেছে আশরাফকে কেন্দ্র করে। সালমার নিদারুণ সব প্রশ্নের মুখোমুখি সে এখন। কোনোটার উত্তর আছে; কোনোটা সাড়াশব্দহীন। কিন্তু সালমা কনভিন্সড নয় কোনো ব্যাখ্যাতেই। কোনো উত্তরেই তাকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। কী করেই বা হবে! এরকম অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি বেচারি তো আগে কখনো হয়নি। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে সে খানিকটা দ্বিধান্বিতও বটে। হুঁ, সালমা সত্যি সত্যি দ্বিধার চোরাবালিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। বেচারি!
‘তুমি বলতে চাচ্ছ, গত তিন মাসে তার সঙ্গে তোমার কেবল বারকয়েক দেখা হয়েছে? আমাকে এটা বিশ্বাস করতে হবে? তুমি যা বলছ আমাকে তা মেনে নিতে হবে? বেশ কিছুদিন ধরে তোমাকে যে উদাসীন খেয়াল করছি, কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে কিছু না বলে এড়িয়ে যাচ্ছো, সবই কি একই কারণে ঘটেনি? তাহলে তুমি আমার কাছে সবকিছু গোপন করেছিলে কেন? তোমার ভেতরে যদি অন্য কোনো চিন্তা না থাকে, তোমার মনে যদি দোষ না থাকে, তাহলে তো আমাকে তোমার সব কথা অকপটে খুলে বলা উচিত ছিল। যেমনটা আগে সবসময় করেছ। হঠাৎ কী এমন হলো যে, আমার কাছে তোমাকে সব কথা গোপন রাখতে হলো? হাতেনাতে ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত তুমি আমাকে কিছুই বললে না কেন? আমার সঙ্গে এ-রহস্য করলে কেন? আমি পরিষ্কার জানতে চাই, আমার সঙ্গে তোমার এ অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা কেন, এই ছলচাতুরী কেন? সাত বছর ধরে তোমার সঙ্গে সংসার করছি, তুমি একটা উদাহরণ দিতে পারবে যে, কোনো একটা বিশেষ ঘটনা আমি তোমার কাছ থেকে কখনো লুকিয়ে রেখেছি? আর তুমিও তো আগে কখনোই এরকমটা করোনি। আমরা আমাদের সমস্ত কথা শেয়ার করেছি। দরকারি কথা, অদরকারি কথা, কোনো কিছু বলতে কেউ বাদ রাখিনি। আমাদের কথার বিষয় শুনে অনেকে হাসাহাসি পর্যন্ত করেছে। কিন্তু ওটাই ছিল আমাদের জন্য স্বাভাবিক। তবে আজ কেন এ-ঘটনা নিয়ে তোমার এত গোপনীয়তা? কেন? কেন?’ সালমার এতক্ষণ পর্যন্ত বহু কষ্টের সঙ্গে ধরে রাখা কাঠিন্যের আবরণটি চোখের পানিতে গড়িয়ে পড়ে। নিজের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে আসে। কিছুটা দমবন্ধ অনুভূতিতে সে-মুখটা দেয়ালের দিকে ঘুরিয়ে রাখে। তার ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
আশরাফ এবার উঠে দাঁড়ায়। অনেক, অনেকগুলো প্রশ্নের তীরে সে বিদ্ধ হয়েছে। নিজেকে রক্ষা করার আরেকটা চেষ্টা হিসেবে তার এখন অবশ্যই কিছু বলা উচিত। কিন্তু কী বলবে, আর কীভাবেই বা বলবে ভেবে কোনো কূল-কিনারা পায় না সে। সত্যিই তো, তার আর কিইবা বলার আছে। খোলা চোখে দেখলে তার দোষটাই সবার আগে ধরা পড়বে। তবে যুক্তি দিয়ে বিচার করতে গেলে তাকে সবটুকু দায়ী নাও মনে হতে পারে। এমন হয় না যে, মানুষ মাঝে মাঝে তার নিজের অজান্তে বা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই পরিস্থিতির শিকার হয়? তার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তো সেরকমই। কিন্তু এই খোঁড়া যুক্তি দিয়ে তো সে সালমাকে বুঝ দিতে পারছে না। সালমা বোকা মেয়ে নয়। নিজের মতো করে কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা সে নিজেই দাঁড় করাতে পারে। এ ধরনের সেনসিটিভ একটা বিষয়ের বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য যতখানি সাধারণ বুদ্ধি থাকা দরকার তার পুরোটাই তার আছে। আর মেয়েরা এসব ব্যাপারে আরো তাড়াতাড়ি বুঝতে পারে। এ সময় ওদের সিক্সথ সেন্স বা তৃতীয় নয়ন অন্য যে-কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি তৎপর হয়ে ওঠে। শুধু অনুমানের ওপর নির্ভর করেও তারা অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত ঘটনা ধরে ফেলতে পারে অনায়াসে। কাজেই তার এরকম অযৌক্তিক যুক্তি যে সালমা কিছুতেই মেনে নিবে না এটা আশরাফ এতক্ষণে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। বেচারা!
সালমার সামনে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে আশরাফ। তাকে গভীর স্বরে মনি বলে ডেকে কথা শুরু করে সে। দ্রষ্টব্য বিশেষ, সালমাকে বিয়ের পর থেকে সে এ-নামেই ডাকে, কখনো কখনো এরকম ডাকে বউ তার আশ্চর্যজনকরকম নরম হয়ে যায়, বিশেষ মুহূর্তগুলোতে এ-ডাক বিশেষরকম কাজ দেয়; আশরাফ এখনকার অসহায় অবস্থা্য় এক ধরনের চতুরতার আশ্রয় নিতে চাইল সালমাকে এই নামে ডেকে, কারণ অন্য সময়ের মতো স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণে সে তাকে মনি বলে ডাকেনি। আর এটা ধরে ফেলা সালমার জন্য তেমন কঠিন হবে না জেনেও আশরাফ তাই-ই করে। সে যে আর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না নিজেকে যে-কোনো উপায়ে রক্ষা করার যুক্তিতর্ক আরম্ভের।
‘মনি, তোমাকে আমার সব কথা শুনতে হবে। তারপর বিচার করে দেখো, আসলেই আমার দোষ কতটুকু। পুরোটা না শুনে আমার ব্যাপারে তুমি কোনো সিদ্ধান্ত নিও না, প্লিজ। এরপর তুমি আমাকে যে-শাস্তি দেবে, যেভাবে বলবে আমি সেটাই মাথা পেতে নিবো। আমার সোনামনি, দয়া করে আমাকে একটাবার সব কথা খুলে বলার সুযোগ দাও। তুমি আমাকে এতদিন ধরে দেখছো, আজ এই সামান্য ঘটনায় তোমার সব বিশ্বাস উঠে গেলো? আমাদের সম্পর্ক কি এতই ঠুনকো?’
‘তুমি এটাকে সামান্য বলছো? একজন বিবাহিত মহিলার সাথে তুমি দিনের পর দিন কথা বলছো, বাইরে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছো, দেখা করছো, আর এটাকে তোমার সামান্য কিছু বলে মনে হচ্ছে? একই ব্যাপার আমার ক্ষেত্রে ঘটলেও তুমি এটাকে সামান্য বলেই মেনে নিতে? আচ্ছা, বুঝলাম, মহিলা তোমার ভার্সিটি জীবনের প্রথম প্রেমিকা। যৌবনের শুরুতে যার সাথে তোমার অন্তরঙ্গতা খুব বেশি দূর গড়ায়নি। ভদ্র প্রেমিক-প্রেমিকার মতো পাশাপাশি বসে শুধু বাদাম খেয়েছো আর গল্প করেছো। কিন্তু এখন তো তুমি আর তার প্রেমিক নও। তোমার স্ত্রী-সন্তান আছে। তারও স্বামী-সংসার আছে বলে তুমি নিজেই বলছো। কোন যুক্তিতে তুমি আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছো যে, এটা নিছকই এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক? এর বেশি কিছু নয়।’ সালমার কণ্ঠস্বর কিছুটা চড়তে থাকে। তার কথার খোঁচা তীব্র মনে হয়।
আশরাফ এ মুহূর্তে আর বেশি কিছু বলা নিরর্থক মনে করে। দেখা যাবে, নিজের সপক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে সে বেফাঁস এমন কিছু বলে ফেলেছে যাতে পরিস্থিতি পুরোটাই অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। ঠিক জায়গায় জুতসই কথাটি বলার কৌশল সে তো কোনোকালেই তেমন রপ্ত করতে পারেনি। অনেক ভেবেচিন্তে রেখেও শেষমেশ কিছুই বলে উঠতে পারে না সে। হয় বোকার মতো তাকিয়ে থাকে, নয়তো এলোমেলো কথা শুরু করে মাঝপথে থেমে যায়। যা বলবে বলে অনেক প্রস্ত্ততি নিয়ে রেখেছিল, তার পুরাটাই মাটি হয়ে যায়। এখনো তেমন একটা সুবিধা করতে না পেরে বেডরুম থেকে বের হয়ে আসে সে। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি আর মেঘের গর্জনও শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টিজাত বিবিধ শব্দের কারণেই তাদের কিছুটা উচ্চৈঃস্বরে বলা কথাবার্তা পাশের ঘর পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ওখানে তাদের পাঁচ বছরের ছেলেটি দাদির পাশে বসে থেকে ছবি অাঁকছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে ড্রইংরুমের জানালার পাশের সোফা বেশ কিছুটা ভিজিয়ে ফেলেছে। আশরাফ খোলা জানালাগুলো বন্ধ করতে থাকে একটার পর একটা। হঠাৎ কাছে কোথাও বজ্রপাতের শব্দ শোনা যায়। কিছুক্ষণ পর নিয়ম মেনে ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়াতে চারপাশে ঘন অাঁধার নেমে আসে। মনে হচ্ছে রাতটা এরকম অন্ধকারেই কেটে যাবে। খুব সহজে বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
রাত পোনে বারোটার দিকে ইলেকট্রিসিটি ফিরে আসে। এর মধ্যে মোমের মিটমিটে আলোতে রাতের খাওয়া সেরে নিতে হয়েছে। সালমা ছেলেকে খাইয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছে। আশরাফ অনেক অনুরোধ, অনেক অনুনয়-বিনয় করেও তাকে কিছুতেই খেতে রাজি করাতে পারল না। ‘একরাত না খেলে এমন কিছু হয় না’ বলে খাবার টেবিলের সামনে থেকে সরে এসেছে। শাশুড়ির সামনে এর চেয়ে বেশি কিছু বলেনি সে।
আর বেশি চাপাচাপি করাও ঠিক হবে না ভেবে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে আশরাফ বেডরুমে এসে ঢোকে। দরজা বন্ধ করে বিছানার ওপর সালমার পাশে বসে। সালমা পেছন ফিরে দেয়ালের দিকে মুখ রেখে শুয়ে আছে। ওর পিঠে হাত রাখে আশরাফ। সালমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ঘুমায়নি সে, শুধু চোখজোড়া বন্ধ করে আছে। আশরাফ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। ভালোবাসার দৃশ্যমান কঠিন বাঁধনে বেঁধে ফেলে। আর মুখ দিয়ে আদরের সবরকম শব্দ করতে থাকে। সালমার মধ্যে এখনো কোনো ভাবান্তর দেখা যায় না। আর কিছুই বলবে না বলে ঠিক করেছে সে। কোনো আদরেও আজ সে গলবে না। যতসব ভন্ডামি! এত বড় প্রতারণা কীভাবে করতে পারল এ-প্রশ্ন যতবার সালমার মনের মধ্যে চক্রাকারে ঘুরপাক খাচ্ছে, ততবারই সে নিজের ভেতরে এক অসীম শূন্যতার খাদে পড়ে গেছে বলে অনুভব করছে। এ বড় লজ্জার! বড় যন্ত্রণার! এ কষ্ট ভাগ করে নেওয়ার কেউ নেই। শুধু নিজের সঙ্গে অহর্নিশ অন্তহীন যুক্তিহীন যুদ্ধ। ভালোবাসার অভাব মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু ভালোবাসার অভিনয় দিয়ে প্রতারণা? তা তো সহ্য করার নয়। কিছুতেই নয়। আর কেউ পারলেও সে কিছুতেই পারবে না।
‘সালমা, আমার লক্ষ্মীসোনা, আমাকে একটু বুঝতে চেষ্টা করো তুমি। আমি স্বীকার করছি, আমি ভুল করেছি। একশবার ভুল করেছি। কিন্তু তুমি ছাড়া আর কাউকেও আমি ভালোবাসি না। ভালোবাসবও না। তুমি কি এতদিনেও এটা বুঝতে পারোনি? আমি মানছি, আমার মধ্যে কিছুটা দুর্বলতা কাজ করেছিল। ওর হাজব্যান্ড যে আমাদের কোম্পানির একজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যানেজার এটা আমি জানতে পেরেছি মাস চারেক আগে। অফিসের টাকা আত্মসাতের মামলায় এখন সাসপেনশনে আছে। দুই বাচ্চা নিয়ে সে হেড অফিসে এসেছিল ব্যাপারটার একটা ফয়সালা করতে। তখনই আবার তার সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা। কয়েকদিন সামান্য কথা হয়েছে। ব্যস, এতটুকুই। এর বেশি আর কিছু না। মনি, আমাকে তুমি বিশ্বাস করো। এর বেশি আর কিছু হয়নি আমাদের মধ্যে।’ আশরাফ সালমার বাঁকানের নিচে একটা চুমু দেয় আলতো করে। ওর ঘাড়ের ওপর মুখ রেখে চুপ হয়ে যায় সে কিছুক্ষণের জন্য।
পাশ ফিরে সালমা এবার সোজা হয়। ওর মুখের অভিব্যক্তিতে এখনো সেই পাথুরে কাঠিন্য হাল্কা আবছায়ার মতো লেপ্টে আছে। ওর ভেতরে যে একটা ভীষণ উথাল-পাথাল চলছে তা অস্পষ্ট হলেও বোঝা যায়। ‘আরো বেশি কিছু হলো না বলে মনে হচ্ছে অনেক কষ্ট পেয়েছো। তো যাও না। সে বিপদে পড়েছে, স্বামীর চাকরি নাই। তাকে উদ্ধার করে আসো। লোকলজ্জার তোয়াক্কা না করে, নিজের সম্মানের কথা চিন্তা না করে একটা চোরের বউকে বীর প্রেমিকের বেশে রক্ষা করো না, কে তোমাকে বাধা দিয়েছে? হাতেনাতে ধরা পড়ার পর এখন তো ভালোই সব কথা বলছো। এসব কথা চার মাস আগে বললে তোমার কী ক্ষতিটা হতো সেটাই না হয় এখন আমাকে বলো! হ্যাঁ, ক্ষতি তো তোমাদের দুজনের অবশ্যই হতো। পুরনো প্রেমিকা হঠাৎ করে এত বড় একটা বিপদ নিয়ে সামনে এসে পড়েছে, তাকে সাহায্য করতে গেলে একটা রাখঢাকের তো অবশ্যই প্রয়োজন আছে। তা না হলে প্রেমিকার সম্মান থাকে না যে। ঘরের বউয়ের এত কথা জানার দরকারটা কী? আর সে কিছু না জানলেই বা কী? সে তো আর চলে যাচ্ছে না, ঘরেই আছে, ঘরেই থাকবে। তার তো কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই।’
সালমার কথাগুলো ক্রমশ তিক্ত হতে থাকে। ওকে এখন কোনোভাবেই থামানো যাবে না, আর এ-পরিস্থিতিতে তেমন কিছু করারও নেই বুঝতে পেরে হাতের বাঁধন আলগা করে আশরাফ একপাশে সরে আসে। দুজনে পাশাপাশি শুয়ে ছাদের দিকে মুখ করে আস্তে আস্তে ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝখানে এক হাত ব্যবধান। কিন্তু এ-মুহূর্তে সেটা যোজন যোজন দূরত্বের সীমানা নির্দেশ করে দেয়। কিছুই আর বলার নেই কারো। দুজনের মনেই এখন এক সীমাহীন শূন্যতার নিঃশব্দ অনুভূতি।
‘তোমাকে আমার যা যা বলার ছিল আমি তার সবই খুলে বললাম। যা ঘটেছে, যতটুকু ঘটেছে সবটাই বলেছি। এখন বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। আর ওর হাজব্যান্ডকে এখনও দোষী বলা যাচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটার তদন্ত চলছে। এখনই ওরকম কিছু না বলাই উচিত।’ আশরাফ আবার সালমার দিকে পাশ ফিরে শোয়।
‘ওববাবা, শুধু প্রেমিকা না, প্রেমিকার স্বামীর জন্যও দেখি দরদ উথলে পড়ছে।’ সালমা ফোঁস করে ওঠে। ‘চোরকে চোর বলবো না তো কী বলবো? চুরি করে ধরা পড়েছে, আর এখন বউকে পাঠিয়েছে বড় সাহেবের মন ভজানোর জন্য।’
সালমার কথার মাঝখানেই আশরাফ তড়াক করে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে ওঠে। ‘সালমা, দিস ইজ টু মাচ। তুমি যা খুশি তাই বলতে পারো না।’ বলে সে রুমের দরজা খুলে বাইরে চলে যায়। সালমা জানে, আশরাফের দৌড় কতদূর। সাত বছর ধরে ওর সঙ্গে আছে তো! বড়জোড় ড্রইংরুমের সোফা পর্যন্ত। ‘ভন্ড’, মনে মনে গালি দেয় সে আর ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেলে ঠিক-পুরোটা-ঘৃণা-নয়, আবার-অনেকখানি-ঘৃণা-মিশে-আছে এরকম এক অসম্ভব বিরক্তিমিশ্রিত অভিব্যক্তির ছায়ায়, ‘যাক, যেখানে খুশি যাক। বয়স বাড়ছে, তবু প্রেম করার শখ মিটছে না। প্রেমের রস একেবারে উপচে পড়ছে!’
দুই
‘রিতা,এভাবে বোধহয় আর দেখা করা ঠিক হবে না। সালমা বিষয়টাকে ভালভাবে নিচ্ছে না। অন্ততপক্ষে কিছুদিনের জন্য হলেও আমাদের দুজনকে টেলিফোনে যোগাযোগ রাখতে হবে। আমি কি বলছি তুমি বুঝতে পারছো?’ আশরাফ রিতার মুখের দিকে না তাকিয়ে গুছিয়ে রাখা কথাগুলো এক নিশ্বাসে আওড়ে ফেলে। তারপর বুঝতে কিছুটা সময় নেয়, আরো কিছু যোগ করতে হবে কিনা। রিতা সেই আগের মতোই অভিমানী রয়ে গেছে। বয়স হলেও কথার অর্থ না বুঝেই রাগ-অনুরাগের অভিনয়ে তার এখনো জুড়ি মিলবে না।
ওরা দুজন এখন শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে সবুজ গাছপালায় মোড়ানো একটা রিসোর্টে। এটা গত চার মাস ধরে চলা নিয়মিত অভিসারের অংশ বিশেষ। জায়গাটা ওদের খুব পছন্দ হয়েছে। দোতলা যে-রেস্টহাউসে ওরা উঠেছে, তার পেছন দিকের ব্যালকনিটা দেখে ভালো লাগার আনন্দে রিতা হাত তালি দিয়ে ওঠে। যেন ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান! তা না হোক, এই ঝুলবারান্দায় এসে সে তার সব কষ্ট আর অপ্রাপ্তির আফসোস নিমেষে বাতাসে উড়িয়ে দিতে চাইল। অনেক কিছু ভুলে যেতে যেতে এখন যে-কাদায় সে পড়েছে তার কথাও আর মনে আনতে সে নারাজ। শুধু এ-মুহূর্তটাই সত্যি আর জীবন্ত বলে ভাবতে ভালো লাগছে তার। আর সবকিছু যেন দূর-অতীতে ফেলে আসা কোনো ধূলি-ওড়া অস্পষ্ট ক্ষণ! মাঝে মাঝে চোখের সামনে কিছু একটা ভেসে উঠলেও তা বড়ই ঝাপসা লাগে তার কাছে। দুহাতে চোখ কচলে নিয়ে সে এখন এই স্বপ্ন-স্বপ্ন খেলায় মেতে উঠতে চায় শিশুর চঞ্চলতায়। এরকম একটা অদ্ভুত মায়াবী সময়ের জন্য কতদিন সে ঘুমের মাঝে ডুকরে কেঁদে উঠেছে!
ব্যালকনিতে আশরাফ-রিতা মুখোমুখি বসে আছে। ওদের মাঝখানে ছোট একটা বেতের চায়ের টেবিল। দুজনের পায়ের সঙ্গে পা লেগে আছে। যেন ঠিক ভার্সিটির ফেলে আসা দিনগুলিকে ওরা আরেকবার নিজেদের মতো করে উপভোগ করে নিতে চাইছে। গরম সমুচা-শিঙাড়া আর দু’মগ কফি এর মধ্যে শেষ করেছে। আবার কফি আর স্ন্যাকসের অর্ডার দিয়ে হিসাব-নিকাশের খাতা খুলে বসেছে হঠাৎ নিজেদের নতুন করে খুঁজে পাওয়া এই দুই পুরনো প্রেমিক-প্রেমিকা। ছকটা তাদের কাটতে হবে আগামী দিনগুলির পরিকল্পনা নিয়ে। সেটা অবশ্য আশরাফকে যতটা ভাবিয়ে তুলেছে রিতাকে আপাতদৃষ্টিতে মোটেও ততটা নয়। সত্যি কথা বলতে কী, রিতা এ-সময়ে এসব নিয়ে মোটেই ভাবতে চাইছে না। যেমন যাচ্ছে যাক না আরো কিছুদিন এই তার অভিমত। শুধু আশরাফের পীড়াপীড়িতে সে তাদের ভবিষ্যৎ-আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে। অবশ্য আশরাফও ঠেলায় না পড়লে এভাবেই হয়তো আরো কিছুটা সময় হালকা চালে কাটিয়ে দিতে চাইত। কিন্তু তা আর হলো কই!
ফাগুনের দখিনা মাতাল হাওয়া ওদের দুজনের মনকেই দারুণ রকম উতলা করে দিয়েছে। রিতা আজ ভীষণভাবে উদগ্রীব। মনে হচ্ছে, গত কয় মাসে যে কদিন তারা দেখা করেছে আজকের দিনটা যেন কেমন কেমন আলাদা! আশরাফের সঙ্গে কিছু সুন্দর প্রেমময় সময় কাটানোর জন্য কত ঝুট-ঝামেলা করেই না এতদূর পর্যন্ত আসা! ঢাকায় হাতে গোনা কয়েকটা নির্দিষ্ট স্থানে তারা ঘুরেফিরে দেখা করেছে। সে-কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই রিতা এরকম একটা জায়গায় আসার স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু উপযুক্ত সময় বের করতে তাদের ম্যালা ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত অফিস সামলে ঘণ্টা কয়েকের জন্য আশরাফ এখানে আসতে রাজি হয়েছে। অন্য শহরে থাকায় ঢাকার আশেপাশে এসব ঘোরাঘুরির জায়গা সম্পর্কে রিতার বলতে গেলে কোনো ধারণাই নেই। আর আশরাফ যদিওবা কিছু জেনে থাকে, কিন্তু ঢাকার বাইরে কোথাও দেখা করার ব্যাপারে ও কিছুতেই সাহস করে উঠতে পারছিল না। এমন বউভীতু হয়েছে সে! মনে মনে হাসি পায় রিতার। অথচ আশরাফের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই ওর শুধু ইচ্ছা হয়েছে, একবার যদি ওকে নিয়ে দূরে-বহুদূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া যেত! ভার্সিটিতে বাদাম খাওয়া, এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো সেই পুরনো দিনগুলির মতো শুধু দুজনে মিলে যদি একবার কোথাও হারিয়ে যেতে পারত! আশরাফের সবকিছুতেই তখন একটা ড্যাম-কেয়ারিং ভাব! কে কী চিন্তা করল আর বলল একদম তোয়াক্কা করত না। বরং, এসব নিয়ে রিতা কিছু বলতে গেলে ওর থুতনিতে আঙুল ছুঁয়ে বলত, আমি আমার বউয়ের সঙ্গে ঘুরব। এতে বাপু লোকজনের মাথাব্যথা হবে কেন? বউ! অজান্তে রিতার ভেতর থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাসের ঝাপটা বাইরের পাগল-করা বসন্ত-বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়। সেই আশরাফ আর এখনকার আশরাফ যেন দুজন সম্পূর্ণ বিপরীত মানুষ! না, ঠিক বিপরীত নয়। এখনো সে কথায় কথায় শুধু বউ-বউ করে বটে। তবে সে-বউটা রিতা নয়। প্রেমিকা হিসেবে প্রেমিকের মুখ থেকে ওই মিষ্টি ডাক শুনলে কী যে শিহরণ খেলে যেত সারা শরীরে! আর যখন কিনা সে একজন বিবাহিত পুরুষ, তখন তার মুখে ওই একই শব্দ তাকে কীরকম লজ্জাহীনভাবে স্ত্রীর ন্যাওটা করে তুলছে!
রিতার মনে হতে থাকে, একটা সময় তাকে একাকী কাছে পাওয়ার জন্য আশরাফের সেই উন্মুখ অপেক্ষা! আর আজ সে নিজে থেকে সব দিতে চাইলেও তা এড়িয়ে যাওয়ার কতরকম অজুহাত! না, সব সময় নয়। এই ঢাকার বাইরে আসার কথা বলতেই আশরাফের যত পিছুটান শুরু হয়েছে। অনেক মধুর প্রতিশ্রুতি এজন্য তাকে খরচ করতে হয়েছে। ঢাকায় এর মধ্যেই ওরা বেশ কয়েকবার কাছাকাছি এসেছে। রিতার এক বান্ধবীর বাসায় ওদের নিয়মিত দেখা হচ্ছে। কিন্তু ওই বিরক্তিকর ঢাকাইয়া হট্টগোল আর পরিচিত মন্ডল ছেড়ে একটু নির্জনতা, একটু শুধু নিজেদের মতো করে সময় কাটানোর বাসনা আশরাফের মনে সত্যি সত্যি একবারও উঁকি দেয়নি এটা ভাবতে রিতার কষ্ট হয়। মনে হয়, ও ভান করছে। নিজেকে পুরোটা ধরা দিতে চাচ্ছে না। আর দিতে চাইবেই বা কেন? সমাজে তার এখন একটা বিশেষ স্থান আছে। বউ-বাচ্চা নিয়ে নিশ্চিন্ত সুখের জীবন। শুধু শুধু উটকো ঝামেলায় কোনো বুদ্ধিমান মানুষই জড়াতে চাইবে না। সে-কারণেই হয়তো ওর এত বাহানা। আবার কে জানে, সে তো তাকে পুরোটা পাশ কাটিয়েও যায়নি। মুখে হাজারটা অসুবিধার কথা বললেও রিতা যখনই দেখা করতে চেয়েছে, প্রতিবারই সে সময় বের করে নিয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে রিতার মাথাটা কেমন ঝিম-ঝিম করে ওঠে। সে খানিকটা আনমনা হয়ে পড়ে।
‘এই রিতা, কী ভাবছো? তুমি তো আমার কথার কোনো উত্তর দিলে না’। আশরাফের প্রশ্নে রিতার ঘোর কেটে যায়।
‘তুমি যেন কি বলছিলে?’ রিতা জানতে চায়।
‘আমার কথা তাহলে শোননি?’ আশরাফের কণ্ঠে উষ্মা, চোখে প্রচ্ছন্ন বিরক্তি।
‘স্যরি, আশরাফ, একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। বাচ্চাদের কথা ভাবছিলাম। কিছু মনে করো না, লক্ষ্মীটি আমার। প্লিজ, আরেকবার বলো।’
‘আমি বলছিলাম, কিছুদিনের জন্য আমাদের দেখা-সাক্ষাৎটা বন্ধ রাখতে হবে। সেদিনের পর থেকে সালমা আর বিষয়টাকে একদমই সহজভাবে নিচ্ছে না। ও সন্দেহ করতে শুরু করেছে। আর একবার যেহেতু সন্দেহ ওর মনে বাসা বেঁধেছে, তার মানে এখন থেকে ও আমার সব মুভমেন্ট খেয়াল করবে। কোথায় যাই, কখন যাই, কার সঙ্গে কথা বলি সব লক্ষ করবে। আমার স্বাভাবিক চলাফেরাই অসম্ভব হয়ে যাবে। বোঝোই তো, ওকে নিয়ে আমার সংসার করতে হয়। একবার বিগড়ে গেলে আমার জন্য সমস্যা, আমার ছেলেটার জন্য সমস্যা। আর আমার বুড়া মা তো বউমা ছাড়া কিছুই বোঝে না।’
‘আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে তুমি আগেও পড়েছো। পড়েছো নাকি?’ আশরাফের বউ কী করবে আর কী করবে না সেটা শুনতে রিতার একেবারেই ভালো লাগছিল না। তাই সে খোঁচা মারার সুযোগটা হাতছাড়া করল না। ‘তাহলে আমরা আর দেখা করতে পারবো না সেটাই তুমি বলতে চাইছো?’ রিতা পরিষ্কার করে জেনে নিতে চায়।
‘না, সেরকম কিছু বলছি না। আমি বলতে চাচ্ছি, আপাতত কিছুদিন দেখা না করাই ভালো। তাতে দুজনেরই মঙ্গল। তাছাড়া, ফোনে তো যোগাযোগ থাকছেই। সালমাকে এখন বোঝানো দরকার যে, ব্যাপারটা সে যেরকম ভাবছে আসলে এটা তেমন সিরিয়াস কিছু নয়। ও যদি একবার আমাদের বর্তমান মেলামেশার বিষয়টা জেনে যায়, তাহলে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে ফেলবে। হয়তো অফিসে এসে ঝামেলা করবে, যেটা আমাদের দুজনের কারো জন্যই ভালো হবে না। আবার এমনও হতে পারে, রাগ করে বাসা থেকে চলে যেতে পারে। এরকম কিছু ঘটুক আমি তা চাচ্ছি না। আর সেজন্যই বলছিলাম, কিছু সময়ের জন্য আমাদের মিট না করাই ভালো হবে।’
আশরাফের কথাগুলো রিতা খানিকটা মন দিয়েই শুনল, কিন্তু তার কোনো মাথামুন্ডু বুঝতে পারল না। তারা যেদিন শেষ দেখা করেছিল, সেদিন নাকি তার বউ তাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখেছে। এরপর থেকেই বাসায় অশান্তি শুরু হয়েছে। কিন্তু আশরাফের কথা রিতার পুরোটা বিশ্বাস হয় না। সে মনে করে, আশরাফের কাছে ওর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। পুরনো প্রেমিকাকে অনেকদিন পর কাছে পেয়ে কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল,তার চোখে ঘোর লেগেছিল। সেই ঘোর কেটে যাওয়ার পর এখন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যেতে চাইছে। বউয়ের অাঁচলের তলে, ছেলের আদরের কাছে। আর ওর হাজব্যান্ড যে-সমস্যায় পড়েছে সেটা থেকেও তাকে বের করে আনতে পারবে বলে মনে হয় না। এসব চিন্তা করেই আশরাফ সরে পড়তে চাইছে। তাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত যুক্তিটাই সে কাজে লাগাতে চাইছে। ঠিক আছে, আশরাফ না চাইলে সে নিজে থেকে আর দেখা করবে না। কঠিন বিপদের এ-দিনগুলিতে মানুষের চরিত্র খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেল। এটাই বা কম কিসে!
‘ওকে, আশরাফ, তুমি যদি মনে করো, কিছুদিন দেখা না করাটাই আমাদের জন্য ভালো হবে, তবে তাই হোক। আমার ভালো না হলেও তোমার যেন ভালো হয়। অ্যাট লিস্ট, তোমার কোনো ক্ষতি হোক, এটা তো আমি চাই না। সেটা তোমার সংসারে বা অফিসে কোনোখানেই নয়। আমার বিপদের সময় তোমার সাহায্য চেয়েছিলাম। তা যদি তুমি করতে পারো, ভালো, আর না পারলেও সরাসরি বলে দিও। আমার হাজব্যান্ড অন্যায় করে থাকলে তার পানিশমেন্ট হওয়া উচিত।’
কোনোরকম প্রস্ত্ততি ছাড়াই রিতা কথাগুলো বলে ফেলে । এতে সে নিজেই মনে মনে খানিকটা অবাক হয়ে যায়। এভাবে বলতে চেয়েছিল সে, কিন্তু সেটা যে এত সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারবে এরকমটা আশা করেনি। একদম নির্লিপ্ত স্বরে আবেগহীন মেজাজে কথাগুলো বলতে পেরে তার এক ধরনের হাল্কা অনুভূতি হয়। বুকের্ওপর চেপে বসে থাকা পাথরটা হঠাৎই মনে হয় সরে গেছে। সে আরো কিছু বলতে প্রলুব্ধ অনুভব করলেও নিজেকে সংবরণ করে। ভাবে, এ মুহূর্তে যা বলেছে সেটাই যথেষ্ট। একবারে এর চেয়ে বেশি বলা ঠিক হবে না ভেবে চুপ হয়ে যায়।
তিন
আজ দুদিন হলো সালমা ছেলেটাকে নিয়ে ওর বাবার বাসায় চলে গেছে। যাওয়ার আগে থেকেই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল সে। আশরাফ কয়েকবার চেষ্টা করেও মুখ খোলাতে পারেনি। যখন ব্যাগে কাপড় ভরছিল, আশরাফ কারণ জানতে চাইলে নিচুস্বরে বলল,
‘কাল বাবার ওখানে যাব। অনেক দিন যাই না।’
‘কতদিন থাকবে?’
‘জানি না।’ লক্ষণ ভালো না বুঝতে পেরে আশরাফ সামান্য আবেগপ্রবণ হওয়ার চেষ্টা করে।
‘বেশিদিন থেকো না, লক্ষ্মীটি। তুমি জানো, তুমি না থাকলে, বাবুনকে না দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়।’
সালমার ঠোঁটের কোনে এক চিলতে উপেক্ষার হাসি চট করে এসে মিলিয়ে যায়। কথার কোনো জবাব না দিয়ে সে তার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আশরাফ বুঝতে পারে, এবার সত্যি সত্যি তার কপালে দুর্ভোগ আছে। সালমা চলে গেলে বৃদ্ধা মাকে বাসায় একা রেখে অফিস করা তার জন্য রীতিমতো অস্বস্তির ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। উদ্বেগের কারণ ঘটবে তো বটেই। দু-চারদিন হয়তো ছুটিছাটা নিয়ে চালিয়ে দেওয়া যাবে; কিন্তু এর বেশি হলেই তার জন্য সমূহ বিপদ। নিশ্চয় মাকে এ-ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না। সালমাও যে এতদিনে কিছু বলেনি বোঝা যায়। এখন সে যদি বেশিদিন থাকার পরিকল্পনা করে ফেলে, মাকে কী জবাব দেবে চিন্তা করে আশরাফের মাথা ঘুরতে শুরু করে। একবার ভাবল, জোর করে যেতে বাধা দিবে। তাতে হিতে বিপরীত হয় কিনা ভেবে সে-চিন্তা নাকচ করে দিলো। সেটা করতে গেলে ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না। সালমা এখনো মুখ বন্ধ করে রেখেছে বলে রক্ষা। যদি মুখ খোলে, তো মায়ের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস থাকবে না তার। যদিও মার বয়স হয়েছে, এখন আর আগের মতো ওরকম মেজাজ করেন না। কিন্তু যেহেতু তিনি সালমাকে অসম্ভব ভালোবাসেন, কাজেই ছেলের রিতা-সংক্রান্ত জটিলতা তিনি মোটেও সহজভাবে নেবেন না। এটা পুরোটাই নিশ্চিত যে, তিনি সালমার পক্ষ হয়ে কথা বলবেন। অবশ্য এখানে পক্ষ-বিপক্ষের কথা কেন আসছে সেটাও তৎক্ষণাৎ আশরাফের বোধগম্য হয় না। তার মাথায় কেবল একটা দুশ্চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে, সালমা যেন কোনোভাবেই তার বাবার বাড়ির অবস্থানকালটা দীর্ঘায়িত না করে। করলেই তার জন্য অশনি সংকেত। অনিবার্যভাবে মায়ের জেরার মুখে পড়তে হবে। শেষে নিজের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি। তাকে নিয়ে মায়ের এত গর্ব একেবারে ধুলিসাৎ হয়ে যাবে। আচ্ছা ভালো কথা, এত মানসম্মান বোধ, তাকে নিয়ে মায়ের অহঙ্কার – বড় বড় কথাগুলো যদি কয়েক মাস আগে সে চিন্তা করতে পারত, তাহলে আজ তাকে এই গ্যাঁড়াকলে পড়তে হতো না। নিজের ওপর হঠাৎ ভীষণ রাগ হয় আশরাফের। একটা অজানা আশঙ্কায় সে ভেতরে কুঁকড়ে যেতে থাকে।
কিন্তু সে কীভাবে জানবে যে, রিতাকে দেখে তার ভেতরে এমন ওলট-পালট ঝড় বয়ে যাবে। আত্মবিশ্বাস নিয়ে তার কখনো তেমন কোনো সংশয় ছিল না। মোটামুটিভাবে নিজের ওপর ভালোই নিয়ন্ত্রণ ছিল। এর আগেও একবার পা পিছলানোর উপক্রম হয়েছিল। অফিসে নতুন যোগ দেওয়া এক তরুণী সহকর্মীর ব্যাপারে তার মনে ঈষৎ তারল্য তৈরি হলে সে কিছুদিনের জন্য উদাসীন হয়ে পড়েছিল। তবে ভালোয় ভালোয় সে-যাত্রায় নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিল। তখন তার ছেলেটার বয়স মাত্র দেড় বা দুই বছর হবে। রক্ষাকবচ হিসেবে ছেলের বাবা ডাকটাকে সব সময় মাথার মধ্যে নিয়ে ঘোরার চেষ্টা করত যাতে কোনোভাবেই মায়াজালে আটকে না পড়ে। এর মধ্যে মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাওয়াতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সে। সালমা কিছুই টের পায়নি সেবার।
এখন এসব ভাবতে গিয়ে নিজের ওপর এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করছে সে। ক্ষণিকের আনন্দলাভের জন্য এ-ধরনের ঠুনকো সম্পর্কে না জড়ালে কী এমন কম-বেশি হয়, সে-প্রশ্ন আশরাফ এখন অনায়াসে নিজেকে করতে পারছে। অথচ, রিতা যখন দারুণ উদ্ভিন্ন যৌনাবেদন নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল, তখন কী এক খেয়ালি কালবোশেখির আঘাতে তার আশপাশের সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল! কিসের সালমা, কিসের ছেলের মুখের নিষ্পাপ হাসি! বরং এতদিন পরে রিতাকে এভাবে ফিরে পাওয়ার মওকা মেলাতে সে তখন আনন্দে দিশাহারা। তার সমস্ত হৃদয় জুড়ে তখন রিতার শরীরী সৌন্দর্যের উন্মাতাল আহবান। নিজের এই আকম্মিক উথাল-পাতাল মানসিক পরিবর্তনে আশরাফ নিজেও কিছুটা হকচকিত হয়ে পড়েছিল; কিন্তু তা সামলে নেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় মনের জোর সে তাৎক্ষণিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। অবশ্যম্ভাবী পরিণতি তার দুঃখজনক পতন।
এমন নয় যে, রিতার বর্তমান দুরবস্থায় আশরাফ খুবই দুঃখ বোধ করেছে। বরং তার এ-দুর্ভোগের সুযোগে তাকে অনেকদিন পর কাছে পাওয়া গেল ভেবে মনে মনে উৎফুল্ল বোধ করেছে। হায় প্রেম! ফাঁকা বাতাসে উড়ে যাওয়া যৌবনের পলকা প্রেম! পড়ে থাকে কেবল ধূলিকণার মতো কিছু স্পর্শের হাহাকার। আশরাফের মনে এরকম হতাশাজনক মুহূর্তেও কেন যেন কবিতার চরণ ঘুরপাক খেতে থাকে। সত্যি কথা বলতে কী, সালমার কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার পর তার চিন্তাভাবনা অনেকটাই এলোমেলো হয়ে গেছে। অফিসের কাজে এমন সব ভুল হয়ে যাচ্ছে, যেটা আগে কখনই তার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ছিল না। নিজেকে খানিকটা বেকুবের মতো লাগছে।
রিতাকে দেখে সে কেন এতটা ভাবাবেগে আপ্লুত হলো সেটা তার কাছে এতদিন পর এক বিরাট রহস্যের মতো মনে হয়। এমন হতে পারে যে, রিতার বহু আগের স্নিগ্ধ-কমনীয়তার পরিণত সৌন্দর্যকে অবলীলায় উপেক্ষা করার মতো যথেষ্ট মানসিক শক্তি তার ছিল না। অথবা এও হতে পারে যে, সে কিছুটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিল গৎবাঁধা জীবনের ঘূর্ণিপাকে পড়ে। এখন নিজের প্রতিবিম্বের সামনে দাঁড়িয়ে নানারকম জিজ্ঞাসার জালে জড়িয়ে যাচ্ছে সে, চটজলদি মিলছে না কোনো সন্তোষজনক উত্তর। সে এখন কী করবে, কী করলে তার উভয়কূল রক্ষা পাবে – এটাই সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হয়ে তাকে ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে। কোনো সন্দেহ নেই যে, সে রিতার দুর্বলতার,তার অসহায় অবস্থার পরিপূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছে। পনেরো বছর আগে যা পায়নি, সেই না-পাওয়াটাকে আজ মিটিয়ে নিয়েছে। রিতাকে সে সবটুকু ভোগ করেছে উপভোগময় সময় কাটানোর মুখোশ পরে। তার সঙ্গে কাটানো সময়গুলো সে তাড়িয়ে তাড়িয়ে পান করেছে। কিন্তু এখন তো তাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
আশরাফ বুঝতে পারছে, রিতার সঙ্গে গোপনে চালিয়ে যাওয়া গত চার মাসের সম্পর্কের ইতি টানার সময় হয়ে এসেছে। সালমার চোখকে আর ফাঁকি দেওয়া যাবে না। রিতাও তার অবস্থান পরিষ্কার করে ফেলেছে। হয়তো ও বুঝে ফেলেছে, তার স্বামীর ব্যাপারে আশরাফের আন্তরিকতাহীন চেষ্টার বিষয়টি। বেচারিকে নিয়ে তার এই প্রেম-প্রেম খেলা আর উচিত হবে না। সালমার মনেও এমন কঠিন অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে যে, সহজে তা দূর হবে বলে মনে হয় না। আশরাফ জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এটা কি তবে তার ক্ষণিকের মোহভঙ্গ? কিন্তু রিতাকে নিয়ে কেন তার এই স্থহূল মোহ তৈরি হলো সেটা ভেবে সে নিজের মাঝে সংকুচিত হয়ে পড়ছে। রিতা তো প্রকৃত অর্থে তার প্রথম নির্ভেজাল ছিল। রিতাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা ভুলতে তাকে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। আজ এত বছর পর জীবনের প্রায় সব কিছুকে যখন সে নিয়মের একটা নির্দিষ্ট ছকে বেঁধে ফেলতে পেরেছিল, তখনই এমন কিছু করল যাতে পুরো ছকটাই হিজিবিজি অাঁকিবুকিতে ভরে গেল। রিতাকে তো সাহায্য করতে পারলই না, উপরন্তু সালমার কাছেও তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল। নিজের দোষ, নিজের পদস্খলন, নিজের সাময়িক মোহকেই শুধু এ মুহূর্তে দায়ী করা যায়। অকাট্য যুক্তি দূরে থাক, আত্মরক্ষার কোনো একটা নড়বড়ে প্রতিরোধও সে নিজের পক্ষে খুঁজে পেল না। দুহাতে খাটের সামনের কোনটা শক্ত করে ধরে আশরাফ বিছানার ওপর বসে পড়ল। বুকের বাঁপাশটা অসহ্য ব্যথায় চিনচিন করছে। গলা শুকিয়ে কেমন কাঠ হয়ে যাচ্ছে! জিব দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিতেও একরাশ ক্লান্তি তাকে কাবু করে ফেলে। একটু পানি পেলে আরাম হতো। উফ্, মা গো, এমন হচ্ছে কেন? আশরাফ বিছানার এক পাশে উপুর হয়ে নেতিয়ে পড়ে। পাশের বাসার কলেজ-পড়ুয়া ছেলেটা তখন ফুল ভলিউমে কম্পিউটারে গান ছেড়েছে – ‘এমন তো হবার কথা ছিল না, প্রিয়!!!’