পাশের বাড়ির আন্টিকে যে আমার পছন্দ হয় এমন না। কিন্তু উনার একটা শান্তশিষ্ট মেয়ে আছে দেখলাম। ছবির মতো হাসে। সেজন্য আন্টিকে খুশি করার জন্য নানান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মা গোরুর গোশত রান্না করেছে। বড়ো বড়ো আলুর টুকরা দিয়ে। এক বাটি গোশত নিয়ে আমি আন্টির দরজায় হাজির। দরজা খুললো আন্টির লক্ষ্মী মেয়েটা।
মেয়েদের দেখে ছেলেরা সর্বপ্রথম চুলে হাত দিয়ে দেখে চুল ঠিক আছে কি না। পরনে জামা কাপড় না থাকলেও চলবে। চুল ঠিক থাকা চাই। আমিও চুলে হাত দিয়ে বললাম— কেমন আছ নায়লা? মেয়েটার নাম কিন্তু আমি জানি না। মেয়েদের অন্য নামে সম্বোধন করে আসল নাম বের করাটা ছেলেদের পুরনো পন্থা। আমার এই পন্থায় মেয়েটা পড়ল না। কোনো কিছু বলল না। শুধু মিষ্টি হাসল। দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। আন্টি সোফাতেই বসে আছেন। আমাকে দেখে বললেন— আরে তুমি? জি আন্টি। মা গোরুর গোশত রান্না করেছে। ভালোমন্দ প্রতিবেশীদের সাথে ভাগাভাগি করে খেতে হয়। তাই আপনার জন্য আনলাম। ‘ আন্টি পান খাওয়া মহিলা।
সারাক্ষণ মুখে পান থাকবেই। আমার কথা শুনে মনে হলো সামান্য আহত হয়েছেন! ‘ গোরুর গোশত? গোরুর গোশত তোমার আঙ্কেলও খান না। রুপালি খায় না। শুধু আমি খাই। ‘ ‘ জি, আপনিই খান। এই বয়সে ভালোমন্দ না খেলে নানান রোগ ধরা দেয়। ‘ আন্টি আমার হাত থেকে বাটিটা রেখে ভদ্রতাসূচক বললেন— বসো তুমি। চা দেই। কিন্তু আমি বসিনি। কেউ একবার বললেই বসতে হয় না। তাহলে ভাবে ছেঁচড়া! ‘ না আন্টি, আরেকদিন বসব। বাড়িতে আমার অনেক কাজ আছে। ‘ ইচ্ছে হচ্ছিল আন্টিকে জিজ্ঞেস করি— এত শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে আপনার মতো বকবক করা মহিলার পেট থেকে কীভাবে বের হলো? এটাও অভদ্রতা হয়ে যেত। তাই জিজ্ঞেস করিনি। শত যাই হোক, আমার ভদ্রতা মেনে চলতে হবে। আন্টিরা ভদ্র ছেলেদের ভালো চোখে দেখেন। ভদ্র ছেলেদের প্রতি আন্টিদের অন্তরের অন্তস্তল থেকে দরদ গজায়।
কোনো এক বিচিত্র কারণে মার রান্নাপ্রেম আছে। তিনি সারাক্ষণই রান্না ঘরে থাকেন। বাবা মস্ত বড়ো এক টিভি এনে বললেন— তুমি এবার রান্নাঘর থেকে বের হও। টিভির সামনে বসো। কত সিরিয়াল অন্য বাড়ির মহিলারা দেখে। তুমিও একটা সিরিয়াল দেখা আরম্ভ করে দাও। দেখবে তোমার জীবন সমাপ্ত হয়ে গেছে। সিরিয়াল শেষ হবে না। মা তবু রান্নাঘর থেকে বের হোন না। সারাদিন রান্নার বই দেখে দেখে একেকটা নতুন রেসিপি রান্না করেন। আর আমাকে সেগুলো খেতে হয়। মজা না লাগলেও বলতে হয়— দারুণ! আহ কী স্বাদ। ইদানীং মার বেশি প্রশংসা করতে হচ্ছে। পছন্দের মেয়ে বিয়ে করতে চাইলে মেয়ের মার চাইতে নিজের মাকে হাত করা বেশি জরুরী।
‘ খোকন, এদিকে আয় তো একটু। ‘ রান্নাঘর থেকে মা ডাকলেন। আমি গেলাম।
‘ এই কসটা খেয়ে বলতো কেমন হয়েছে? ‘
এক গ্লাসের মধ্যে কালো পানি। দেখেই বুঝা যাচ্ছে তেতো কিছু হবে।
‘ কস আবার কী মা? ‘
‘ টম্যাটোর রস দিয়ে হয় সস। করলার রস দিয়ে কস। খেতে দারুণ। শরীরের জন্যও ভালো। তুই তো দিনদিন রোগা হয়ে যাচ্ছিস। তোর জন্য বানালাম। ‘ সর্বনাশ! করলা ভাজি করলে আমি খাই। চেটেপুটেই খাই। কিন্তু করলার রস! ভাবতেই কেমন লাগছে। অসহায়ের মতো এক চুমুক দিয়ে বললাম— বাহ! মা কী সুস্বাদু বানালে। সত্যিই তোমার তুলনা হয় না। মা কী যে খুশি হলো বলে বুঝানো যাবে না।
‘ সত্যিই? আরেক গ্লাস বানিয়ে দেই রাখ। আজ থেকে প্রতিদিন কস খাবি। শরীরের রক্ত পরিষ্কার থাকবে। ‘
‘ অবশ্যই খাব। আমার রক্তে ঝামেলা আছে। রক্ত পরিষ্কার করা অতি জরুরী। ‘ মা অবাক হয়ে বলল— তুই দিনদিন বুদ্ধিমান হয়ে যাচ্ছিস রে খোকন। আমার যে কী ভালো লাগছে। ‘ সবই তো তোমার রেসিপির ফল মা। ‘ মা ফুলে ফুলে আকাশে উঠে গেলেন। এখনই মাকে রুপালির কথা বলতে হবে।
‘ মা। পাশের বাড়িতে একটা মেয়ে আছে। ওর রক্তেও ঝামেলা আছে। তোমার কাছে নিয়ে আসব? ‘ মার মন নিতান্তই রান্নায়। এবার কী বান্নাছেন আল্লাহ পাকই জানেন। আমার কথা মনে হয় কানে ঢুকেনি। ‘ আচ্ছা খোকন, আমার ফোনে কি ইউটিউব না কী যেন, ওটা কি চলবে? ওখানে না কি ভালো ভালো রেসিপি পাওয়া যায়? ‘ আমি সরাসরি না করে দিলাম। চলবে না। মার একটা অভ্যাস। কেউ একটা পরমার্শ দিলে তা মা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন। সে দিন দেখলাম জাপানি রকমের একটা ছেলে কান্না করার টিউটোরিয়াল দিচ্ছে। কীভাবে কান্না করতে হয় তা বলে দিচ্ছে। চোখের পাতা, মুখ ঠোঁটের ভাবভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত কান্নার সময় তা দেখিয়ে দিচ্ছে। আজকে ইউটিউবের কথা বললে কালকে মা এরকমই একটা চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। আয়নার সামনে বসে কান্না করে দেখবেন নিজেকে কেমন লাগছে। কান্না ঠিক আছে কি না!
‘ কী বলিস? চলবে না কেন? তোর বাবা বলে আমার ফোনটা অনেক দামি। দামি ফোনে ইউটিউব চলবে না? ‘
‘ না মা। সব মোবাইলে ইউটিউব চলে না। ‘
‘ তাহলে তোর বাবাকে বলব আজকে ইউটিউবওয়ালা একটা মোবাইল এনে দিতে।
মা তাই করল। বাবা ভাবলেন ইউটিউব পেলে মা রান্নাঘর থেকে বুঝি বের হবে। কিন্তু ইউটিউব পেয়ে মা আরো বেশি রান্নাঘরবাসী হয়ে গেলেন! সারাক্ষণ কী দেখে হাসেন আর রান্না করেন। রুপালিকে সকালে দেখলাম শাড়ি পরে কোথাও গেল। অল্প বয়েসী মেয়েরা এমনি এমনিই শাড়ি পরে না। কেউ তাঁদের দেখে চমকে যাবে। মুগ্ধ হয়ে দেখবে। এই আশা। রুপালি আবার কাকে মুগ্ধ করতে চাইছে? মনটা কুটকুট করছে। আন্টিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম— আন্টি, আপনার মেয়ে শাড়ি পরে কার বিয়েতে গেল?
‘ কারো বিয়েতে যায়নি তো! ওর বান্ধবীর জন্মদিন। ওখানে গেছে। ‘ ‘ বান্ধবীর জন্মদিনে শাড়ি পরার কী আছে বুঝলাম না। একটা গিফট নিয়ে বান্ধবীর হাতে দিয়ে শুভ জন্মদিন বলে চলে আসবে। এজন্য শাড়ি পরা লাগে? ‘ আন্টি একটু ঝুঁকে বসে বললেন— ওর শাড়ি পরাতে তোমার এত সমস্যা কী বলো তো?
‘ সমস্যা হলো আমি ভদ্র ছেলে। অভদ্র হলে আর কী সমস্যা তা বলেই দিতাম। ‘
‘ কিছুক্ষণের জন্য অভদ্র হয়ে যাও। ‘
‘ অনুমতি দিচ্ছেন? ‘
‘ দিচ্ছি। ‘
‘ আপনার মেয়েকে আমার ভালো লাগে। কী শান্ত মেয়ে! এত শান্ত মেয়ে আজকাল দেখা যায় না! ‘ আন্টি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন— ওর সাথে তোমার কথা হয়েছে?
‘ না। ‘
‘ কথা না বলেই ভালো লেগেছে? ‘
‘ হুঁ। ‘
‘ আগে একবার কথা বলো। তারপর আর তুমি এই বাড়িতে আসবে না। আমাকে খুশি করার চেষ্টা করবে না। আমি জানি। ‘ আন্টি এই কথা বলে আঁচলে মুখ ঢাকলেন। আশ্চর্য! একটা শান্ত মেয়ের সাথে কথা বললে কী এমন হয়ে যাবে? যে আমি আর এই বাসায় আসব না! সেটা জানার জন্য আগে রুপালির সাথে কথা বলতে হবে। বাড়ির বাইরে সকাল থেকে বসে আছি। রুপালির আসার অপেক্ষা। দুপুর পেরিয়ে বিকেলও পেরিয়ে গেল। তবু রুপালির আসার নাম নেই। সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব যখন। তখন রুপালি এল। রিকশা থেকে নেমে রিকশাওয়ালাকে টাকা দিল। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম— রুপালি, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। মেয়েটা মনে হয় ভূত দেখছে। এমনভাবে তাকাল।
‘ আমি যে তোমাকে পছন্দ করি। সে বিষয়ে তুমি ওয়াকিবহাল আছ আমি জানি। প্রেম-টেম করে সময় নষ্ট করে কোনো লাভ নাই। যায় দিন আর আসে না। আমি তোমাকে সরাসরি বিয়ে করতে চাই। এই বিষয়ে তোমার মতামত কী? ‘ বিয়ের মতামত জানাটা বোকামি হলো না? রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনো মেয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে বিয়ে করবে কি করবে না? বোকামিই হয়েছে। ‘ আচ্ছা, আমাকে না বললেও চলবে। তোমার মাকে জানিয়ে দিয়ো। ‘ রুপালি চলে গেল। পরদিন থেকে রুপালিকে আর দেখতে পাচ্ছি না। ছাদে উঠছে না। কলেজে যাচ্ছে না। কিছু আনতে দোকানে যাচ্ছে না। ব্যাপারটা কী? তা জানতে আন্টির বাড়িতে আবার হাজির হলাম।
আজ দেখি বাড়ির সদর দরজায় তালা ঝুলছে। তালার উপরে একটা কাগজ। কাগজটা খুললাম। লেখা আছে— আরমান, আমি জানি আমরা চলে আসার পর তুমিই প্রথম ব্যক্তি যে আমাদের দরজায় কড়া নাড়বে। আমার মেয়ে রুপালি গত চারদিন ধরে কান্নায় বুক ভাসিয়েছে। সে এতদিন মামার বাড়িতে থেকেছে। এখানে আসার পর তুমি ওর পেছনে লেগেছ। সেও তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছে। কিছুদিন আগে বোধহয় তুমি ওকে বিয়ের কথা বলেছ। তারপর থেকে সে কান্না করে যাচ্ছে। এই বাসা ছেড়ে দিতে বলছে। বলছে মানে লিখে জানিয়েছে। রুপালি কথা বলতে পারে না! এর আগেও অনেকে রুপালিকে পছন্দ করেছে। কিন্তু সে বোবা জানার পরে সবাই পিছিয়ে গেছে। তুমিও পিছিয়ে যাবে। এতে তোমার দোষ দিচ্ছি না। আমার ছেলে থাকলে। তাঁর বিয়ের জন্য কোনো বোবা মেয়ে প্রথম পছন্দ হতো না। ভালো থেকো।
ইতি
শারমিন জাহান চিঠিটা পড়ে আমার মনে হচ্ছে বন্যার জলে ভেসে যাচ্ছি।
এরকম খারাপ আমার আরেকবার লেগেছিল। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক সিটিতে আমি বসে আছি। একটা নাইট ক্লাবের পেছনে সুন্দরী একটা মেয়েকে কয়েকজন মিলে ধর্ষণ করছে। মেয়েটা চিৎকার দিচ্ছে কিন্তু কোনো শব্দ হচ্ছে না।
আমি পুলিশে ফোন করলাম। পুলিশ এল। ততক্ষণে মেয়েটাকে ধর্ষণ করে মেরেও ফেলেছে! পুলিশ ইনস্পেকটর মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে এত কান্না করছিলেন। আমি অবাক হলাম। আমেরিকায় ধর্ষণ হলো দুধভাতের মতো। প্রতি মিনিটে কেউ না কেউ ধর্ষিত হচ্ছে। এতে পুলিশের চোখে পানি আসবে দূরের কথা। মনটাও খারাপ হয় না। কিন্তু এই পুলিশ অফিসার কাঁদছে কেন? আমি জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন— ওর নাম লানা। আমার মেয়ে। মেয়েটা কথা বলতে পারে না! যদি কথা বলতে পারত। তাহলে হয়তো তোমার আগে অন্য কেউ ওর চিৎকার শুনত। আর বেঁচে যেত! কখনো ভাবিনি আমি কোনো বোবা মেয়েকে ভালোবেসে ফেলব। আমি বড়ো কঠিন মনের মানুষ। মানুষের প্রতি দরদ আসে না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে। এখন যদি আমি রুপালিকে খুঁজে বের করে বিয়ে না করি। তাহলে ওকে খুন করা হবে। খুনের আসামি হয়ে সারাজীবন বাঁচতে চাই না।
মা যথারীতি রান্নায় ব্যস্ত। বাবাকে পুরো ঘটনা খুলে বলার পরে তিনি বললেন— ওই মেয়ে আমার গল্প শুনবে তো? যদি শুনে তাহলে বিয়ে কর। বাবা গল্প বলতে ভালোবাসেন। কিন্তু বাবার গল্প কেউ শোনে না! মাকে দেখেছিলেন তিনি এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। সব মেয়ে সাজগোজ করে, দৌড়াদৌড়ি করছে। খিলখিল করে হাসছে। এর সাথে ওর সাথে কথা বলছে। ওখানে একটা মেয়ে নীরব হয়ে শুধু দাঁড়িয়ে আছে। যেন এটা বিয়ে বাড়ি না। থিয়েটার হচ্ছে। সে থিয়েটার দেখছে চুপ করে। বাবা ভাবলেন এই মেয়ে নীরব শ্রোতা হবে। কত কাহিনী করে তারপর ওই মেয়েকে বিয়ে করলেন। কিন্তু বিয়ের পরদিন থেকে মেয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয় না! ঘুম পেলে শুধু শোবার ঘরে এসে ঘুমায়। সে না কি রান্না করারই সময় পাচ্ছে না আবার গল্প শুনবে কখন? আমি বললাম— শুনবে, বোবা মেয়ে। ইচ্ছে করলেও কিছু বলতে পারবে না। শুধু শুনেই যাবে।
‘ গল্প ভালো লাগল না খারাপ লাগল। ওটা বলতে পারলে ভালো হতো। ‘
‘ লিখে জানাবে, সমস্যা কী? ‘
‘ তোর মাকে বল। আমার সমস্যা নাই। ‘
মাকে বলার পরে তিনি বললেন— মেয়েটাকে দয়া করে বিয়ে করতে চাচ্ছিস না তো? যদি দয়া হয় তাহলে অন্য মেয়ে দেখ। দয়া চিরদিন থাকে না। ভালোবাসা থাকে। ‘ দয়া করেই হোক আর ভালোবেসে। আমি রুপালিকে বিয়ে করতে চাই। বাকিটা আল্লাহর হাতে। রুপালির খোঁজ লাগালাম। খুব বেশি কষ্ট হয়নি রুপালিকে খুঁজে পেতে। নতুন বাসা খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত রুপালি নানুর বাড়িতে উঠেছে সবাই। দূর থেকে রুপালিকে একবার দেখেছি। কাছে যাইনি। পরদিন বাবাকে পাঠালাম। বাবা মুখ গোমড়া করে ফিরে এলেন।
‘ কী হলো বাবা? মুখটা এমন কেন তোমার ‘
‘ খোকন! একটা ঝামেলা হয়ে গেছে! ‘
‘ কী ঝামেলা? ‘
‘ ওরা বলছে বিয়ে হবে ঘরোয়াভাবে। দুপরিবারের লোকজন উপস্থিত থাকবে শুধু। আমার এত বন্ধুবান্ধব। আমার বিয়েতে ওরা আসতে পারেনি। ভাবলাম তোর বিয়েতে আসবে। তাছাড়া তোর খালারা তোর বিয়ে নিয়ে কত প্লান করে রেখেছে! হলুদ মেন্দি-টেন্দি আর কতকিছু। ‘ কদিন পরপর খালারা আসবে মেয়েদের ছবি নিয়ে। মার কাউকেই পছন্দ হয় না। নাহলে আমার বিয়ে কবেই হয়ে যেত। ‘ একটা বুদ্ধি আছে বাবা। আগে বিয়েটা করে ফেলি ঘরোয়াভাবে। তারপর মেয়ে থাকবে নিজের বাড়ি। তুমি তোমার বন্ধুবান্ধবকে দাওয়াত করবে। খালারাও আসবে। তখন অনুষ্ঠান হবে। শুধু আমাদের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। ওটা গোপন রাখতে হবে। ‘ বাবা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন— বুদ্ধি খারাপ না। কিন্তু!
‘ কিন্তু কী? ‘
‘ মেয়েদের পেটে যে কথা থাকে না! তোর মা তো সারা দুনিয়া বলে বেড়াবে। আমার খোকন বিয়ে করেছে! ‘
‘ মাকে ততদিন রান্নার স্কুলে রেখে আসব! কিচেন হাউস বলে একটা রান্নার স্কুল আছে না? ওখানে ভালো থাকার ব্যবস্থা আছে। তিন মাসের প্রশিক্ষণ। মাকে বললে ছমাসও থেকে যাবে! ‘
‘ ওয়াও! কী বুদ্ধি তোর মাথায়! ‘
‘ দেখতে হবে না কার ছেলে? ‘
বাবা মাথা ঝুঁকলেন। বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। শব্দহীন বিয়ে যাকে বলে। বাবা মা আমি আর দুজন সাক্ষী নিয়ে রুপালির নানুর বাড়িতে গেলাম। দুঘন্টার মধ্যেই বিয়ে হলো। খাওয়াদাওয়া হলো। এত সুন্দর করে রুপালিকে সাজানো হয়েছে। কিন্তু কোনো ছবি-টবি তুলল না। বিয়ের কবছর পর নিশ্চিত সে আফসোস করবে। মেয়েদের বর পছন্দ হোক আর না হোক। বিয়ের ছবি মনমতো হওয়া চাই। ওই ছবিগুলো নিয়ে সারাজীবন থাকবে আর ভাববে, ইশ আমি কত সুন্দরী ছিলাম! এখন কী হয়েছি! বাড়িতে নতুন বউ রেখে চা খেতে গেছি।
চায়ের দোকানে বসে ভুলেই গেলাম আজকে আমার বাসর রাত। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়া উচিত। চায়ের দোকান আমার এই জন্যই ভালো লাগে। দুনিয়ার যত ফালতু আলাপ আছে। কিছু লোক তা মহা উৎসাহের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা চালিয়ে যান। রাজনীতি, কাজনীতি আর লাজনীতির আলাপে আমিও তাঁদের একজন হয়ে গেলাম। হঠাৎ মনে হলো রাত এগারোটা বেজে গেছে। এবার যাওয়া উচিত। বাড়িতে গিয়ে দেখি মা বাবা আর রুপালি তিনজন খেতে বসেছে। আমাকে দেখে মা বললেন— সবাই কি তোর মতো রাত বারোটায় নাশতা করে? মানুষের খিদে লাগে না? মেয়েটা তো বলতেও পারবে না আমার খিদে লেগেছে। পুরনো হলে না নিজে নিজে খেয়ে নিতে পারত। আজ পারবে? এই বিষয়টা মাথায় রাখবি না? বাবাও সায় দিলেন মায়ের কথা। ‘ কথা ভুল বলেনি কিছু। ‘
আমিও টেবিলে বসলাম। রুপালি আমার দিকে তাকাচ্ছে না। কিন্তু সে যে রেগে ফুলে আছে তা বুঝতে পারছি। এত রাগ কেন? বিয়ের প্রথম দিনই মেয়েদের রাগ দেখাতে হয় না। প্রথম দিন শুধু লজ্জা পাবে। আর কিছু না।
খাওয়াদাওয়ার পরেও আমাদের বাসর হচ্ছে না। বাবা গল্প বলে যাচ্ছেন। এদিকে রুপালি ঘুমে এলিয়ে যাচ্ছে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন— ঘুম পেয়েছ রে মা? রুপালি না সূচক মাথা নাড়ায়। বাবা আবার গল্প শুরু করেন। মাঝপথে মা বললেন— এবার আপনি থামেন। আপনাকে দেখলে মনে হয় দুনিয়ার সবাই আপনার গল্প শুনতে জন্ম নিয়েছে। বাবা মুখ কালো করে বললেন— তোমরা যাও। রুমে ঢুকে ভাবলাম রুপালি ঘুমিয়ে পড়বে। না। তাঁর রাগ এখনো আছে। জিজ্ঞেস করলাম— এত রাগ কেন প্রথম দিনই? উত্তর তো দিতে পারবে না। কিন্তু সে বলল— আপনি ছাগল না কি? বিয়ের দিন কেউ শেভ করে? আমার মনে হলো কবুল বলে আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করলাম! রুপালির কথা শুনে আমার বোবা হওয়ার উপক্রম।
‘ কথাটা তুমি বললে রুপালি? তুমি বোবা না? ‘
‘ জি না। আপনাকে দিয়ে রিয়ালিটি চেক করালাম। মা এর আগে যে কয়জন ছেলের এই পরীক্ষা চালিয়েছেন। সবাই ফেল করেছে। মা বলে যেই ছেলে জেনেশুনে একটা বোবা মেয়েকে বিয়ে করবে। স্বামী হিসেবে ওই ছেলের চেয়ে উত্তম আর কেউ হতে পারে না। আর বিয়ে হচ্ছে দুটি মনের সন্ধি। ঢাকঢোল পিটিয়ে শয়তানকে খুশি করে সেই কাজটি করা উচিত না। এজন্যই ঘরোয়াভাবে বিয়ে। এসব কথা বাদ। এখন বলেন আপনাকে শেভ করার কুবুদ্ধিটা দিল কে? ‘
‘ দাঁড়াও, এক গ্লাস পানি খেয়ে নেই। তারপর বলি। ‘ আমি পানি খেতে খেতে বললাম। বিয়ের আগে রিয়েলিটি চেক দিতে হয়েছে। বিয়ের পরে না জানি শ্বাশুড়ি মা আর কী কী চেক করান! ‘ কী হলো, বলছেন না কেন? কে আপনাকে এই বুদ্ধি দিয়েছে? ‘ ‘ কেউ দেয়নি, নিজের ইচ্ছায় শেভ করেছি! ‘ রুপালির গলা শুকিয়ে গেল। মাথায় হাত দিয়ে বলল— এখন তো আপনাকে মেয়ে মেয়ে লাগছে! একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সাথে, ওয়াক! ‘ এরকম ওয়াক ওয়াক করার কী আছে বুঝলাম না! মানুষ কি শেভ করে না? আমার চুল দাড়ি খুব তাড়াতাড়ি ওঠে। চিন্তা করো না। তাছাড়া সমস্যা তো কিছু নাই। তোমার বান্ধবীরা তো আমাকে দেখছে না। ‘
চোখটা যথাসম্ভব লাল করে সে বলল— বান্ধবীদের দেখানোর জন্য তো বিয়ে করি নাই! আর আপনার দাড়ি উঠার আগ পর্যন্ত আমি মার সাথে থাকব। রাতে মনে হয়েছিল রুপালি বোধহয় এমনি এমনি বলেছে। কিন্তু বাস্তবে সে তাই করল। মার কাছে গিয়ে বসে আছে। পাশাপাশি আমাদের বাসা। হাতের কাছে বউ। কিন্তু কাছে যেতে পারছি না। এই দুঃখে হুমায়ূন স্যারের কথা মনে পড়ে গেল। ‘ আমি ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া জোছনা ধরিতে যাই হাত ভর্তি চাঁদের আলো, ধরতে গেলে নাই ‘
গল্পের বিষয়:
গল্প