নবম শ্রেনীর ফাইনাল পরিক্ষায় প্রথম হয়ে দৌড়ে রেজাল্ট কার্ডটা মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময়, ভাইয়ার রুম থেকে ভাবির কথাগুলো কানে আসছিলো। ভাবি ভাইয়াকে বলছে- “অনেক তো নিজের ছোট বোন কে দেখছো, এখন না হয় নিজের ছেলেমেয়ে গুলো নিয়ে একটু ভাবো। টানাটানির সংসারে এত লেখাপড়া না করিয়ে একটা ভলো ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে দাও। নয়ত এ নিত্য অভাবের সংসারে আমি থাকতে পারবো না, ছেলেমেয়ে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো।” উওরে ভাইয়া শুধু বলছিল- “হুমমম দাড়াও ব্যবস্থা করতেছি একটা।” নবম শ্রেণিতে ফাইনাল পরিক্ষায় প্রথম হয়ে স্কুল থেকে ফিরে মা কে বলল ঠিক তখনই এমন কথার শুনতে হলো। বাবা মারা গেছে আজ দু-বছর, এই দুবছরে শুনতে হয়েছে কত রকমের কথা।
ছোট বেলা থেকেই আমার মেধা দেখে বাবা ইচ্ছা ছিলো বড় কোনো ডাক্তার বানাবে, সামর্থ্য না থাকলেও বাবার ইচ্ছা ছিলো অনেক বড়। সেই থেকেই নিজেকে ডাক্তার ভেবে আসছি, স্বপ্ন ছিলো একদিন বড় ডাক্তার হবো। কিন্তু অভাবের সংসারে অভাব আর মিটলো না। বাবা মারা যাওয়ার পর, দিন দিন অভাব বাড়তেই থাকলো। যখন বুঝলাম আমার স্বপ্ন গুলোকে হারাতে হবে তখন ভাইয়ার হাত-পা ধরে বলেছিলাম – “আমাকে একটু লেখা পড়ার সুযোগ দিও আমি তোমার সব কাজ করে দিবো।” তাদের আর দোষ দিয়ে লাভ কি, মা আর আমি না থাকলে, আজ ভাই ভাবি আর তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ সুখে শান্তিতে থাকতে পারতো। ভাইয়া ছোটো খাটো একটা মুদি দোকান চালায় তা দিয়ে আর কতই বা করবে।
সেবছর খুব কষ্ট করে SSC পরিক্ষা দিতে পারলেও,কলেজ থেকেই শুরু হয়েছিলো আমার জীবন যুদ্ধ, স্বপ্ন পূরণের যুদ্ধ। ভাই ভাবির হাত-পা ধরে কোনো রকমে কলেজ এ ভর্তি হলেও ক্লাস করা আর হয়ে ওঠেনি। ইন্টার ফাইনাল পরিক্ষার কিছুমাস আগে ভাবি আমার বিয়ে ঠিক করে তার চাচাচো ভাইয়ের ছেলের সাথে। লোকটা ছিলো বড়লোক বাবার নেশাখোর ছেলে। ভাবি এ কথা খুব ভালো করে জানলেও বিয়েতে রাজী হয়েছে। আর বিয়েতে না করবেই বা কেনো, তার যে বড় বোঝা আমিই। ভাবি বিয়ের বিষয়ে না নিছে আমার অনুমতি না নিয়েছে আমার মায়ের। সেইদিন স্বপ্নগুলোকে ভেঙ্গে যেতে দেখে খুব কেঁদেছিলাম ভাই ভাবির কাছে কতই না অনুরোধ করেছি বিয়াটা থামাতে কিন্তু তারা সেদিন আমার কথা শুনে নি। কেনোই বা শুনতে ভাবি তো অন্য রক্তের আর ভাই তো অন্য রক্তের ঘ্রাণে বদলে গেছে।
সে সময় আমার মাথায় সব সময় একটা কথায় ঘুরত এখন যদি বিয়ে হয় তাহলে সামনে না দেওয়া হবে পরিক্ষা আর না করতে পারবো স্বপ্ন পূরন। খুব চেয়েছিলাম পালিয়ে যেতে কিন্তু তা কি করে সম্ভব মাকে এখানে একা রেখে চলে যেতে। বিয়ের আগের দিন রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে ছিলো তখন আমি বালিশে মুখ ঢেকে কাঁদছিলাম, নিজেকে শেষ করার কথাও ভেবেছি কিন্তু অতটা সাহস আমার ছিলো না। হঠাৎ পিছন থেকে কারো হাতের স্পর্শে ভাইয়াকে দেখে চমকে ওঠে। ভাইয়া সেদিন হাতে কিছু টাকা আর বিয়ের একটা চেইন ধরিয়ে দিয়ে বলছিলো- “এ বাড়ি থেকে চলে যা পিচ্চি। তুই এ বাড়িতে থাকলে তোর স্বপ্ন পূরন করতে পারবিনা। বাবার শেষ ইচ্ছাটাও আর পূরণ হবেনা।
শহরে গিয়ে এই টাকা দিয়ে একটা থাকার ব্যবস্থা করিস, আমি কিছুদিন পর তোর ভাবির কাছে মিথ্যে কিছু বলে তোর বইগুলো তোকে দিয়ে যাবো। তোর এই হতভাগা ভাইকে ক্ষমা করে দিস।” আমি তখন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাইয়াকে কিছু বলতে নিবো। ভাইয়া কিভাবে যেনো আমার মুখের কথা পড়ে নিলো তখন আস্থা দিয়ে বলল চিন্তা করিস না মাকে আমি দেখে রাখব এখন তুই যা, সকালের আর মাএ তিন ঘন্টা বাকি। সেদিন কিছুটাকা আর একটা চেইন নিয়েই বাড়ি ছেড়ে ছিলাম। শহরে এসে এক আপুর পায়ে ধরে একটা থাকার আর একটা কাজের ব্যবস্থা করি। পাশাপাশি লেখাপড় চালিয়ে যায়। ভাই মাঝে মাঝে ভাবিকে নানা অজুহাত দেখিয়ে আমাকে দেখতে আসতো। সে বছর ইন্টার পরিক্ষা বেশ ভালোই হয়েছিলো। বাড়াতে থাকি কাজের সংখ্যা সেই সাথে বাড়িয়ে দেয় লেখাপড়া।
হঠাৎ করেই কার কাছে যেনো খবর পেয়েছিলাম শহরে আসতে গিয়ে ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে। ছুটে চলে গেছিলাম বাড়িতে, জমানো যত টাকা ছিলো সব টাকা দিয়ে ভাইয়ের চিকিৎসা করি তবুও শেষ রক্ষা আর হয় নাই। ভাইয়ের পা টা আর রাখা যায় নি কেটে ফেলতে হয়েছিলো। আজ ১২ বছর পর শহরের নাম করা ডাক্তারদের ভিতর আমি অন্যতম। একদিন অভাবে পরে টাকার জন্য লেখাপড়া ছাড়তে চেয়েছিলাম আজ সেই টাকাই আমার পাশে পাশে ঘুরে বেরায়। তবে আমি বদলে যায় নাই, ভাইয়া সেদিন অন্য রক্তের ঘ্রাণে বদলাই নাই তাহলে আমি কেনো টাকার ঘ্রাণে বদলাবো। আজ ভাইয়ার পরিবারের সব খরচ আমি নিয়েছি, তার ছেলে মেয়ে মানুষ করার দায়িত্ব আমার। এখন আর ভাবির কাছে বোঝা নেয়, ভাবির চোখের মনি।
বুঝলে সুরাইয়া সফলতা এমনি এমনি আসে না চেষ্টা ও কষ্ট করেই আনতে হয়। এতোখন ধরে আফসানা আপুর কথা শুনছিলাম। সে আমাদের ফেমেলী ডাক্তার। পরিক্ষা রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় আব্বু আম্মু বকছিলো আর বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়ার কারনে রাগ করে কিছু ঘুমের ঔষুধ খেয়েছিলাম। আর সেই কারনেই আজ আফসানা আপুর এখানে আসা। আপু কথা গুলো বলে চলে যেতেই, রুমে এসে সুইসাইড নোট টা ছিড়ে ফেললাম। যেখানে মানুষ স্বপ্ন পূরনে এতো পরিশ্রম করে সেখানে কেনো আমি তারাতারি জীবনটা শেষ করবো।
গল্পের বিষয়:
গল্প