প্রেমিকা

প্রেমিকা
আমার প্রেমিকা কখনোই ফুটবল খেলা দেখে না। সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেছে বেচারির। ফোন করে বলল, কী করছ?
‘ খেলা দেখি। দেড়টা বাজে তো। ‘
তাঁর মনে পড়ল একটা থেকে খেলা শুরু হওয়ার কথা। বছরের সেরা ম্যাচটা সেদিন হচ্ছে। বায়ার্ন মিউনিখ বনাম বার্সেলোনা। সে বুঝতে পারল আমি এখন আর কথা বলব না। রাতে খেলা দেখে ঘুমিয়েছি। সকালে উঠতে হবে। ওয়াচম্যানের চাকরি করলে যা হয়। নো লেট, নো এক্সকিউজ। ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে প্রেমিকাকে ফোন দিলাম। সে হতাশার সাথে বলল, এসব খেলা তুমি দেখো?
‘ এসব খেলা মানে? কীসব খেলার কথা বলছ? ‘
‘ ফুটবলের কথাই বলছি! ‘
‘ পুট সাম রেসপেক্ট অন ফুটবল। ফুটবল কোনো এসব খেলা নয়। ফুটবল মানে জীবনের একটা অংশ। ‘
‘ ইংলিশ বলবে না। ইংরেজিতে তিনবার ফেল করেছিলে স্কুলে মনে নেই? যাক এসব কথা। এখন বলো কালকে কার কার খেলা হয়েছিল? সাদা কে? আর লাল কে? ‘
‘ সাদা বার্সেলোনা, লাল বায়ার্ন। হয়েছে কী? তুমি খেলা দেখেছিলে না কি? ‘
‘ ঘুম আসছিল না তাই দেখছিলাম। আচ্ছা তুমি কার সাপোর্ট করেছিলে কালকে? তোমার দল কোনটা ছিল? ‘
আমি বার্সেলোনার সাপোর্টার না। কিন্তু তাঁদের যে লজ্জা দিয়েছে বায়ার্ন। রাইভাল হিসেবে খারাপ লেগেছে। কিন্তু প্রেমিকার কাছে বড়ো হয়ে কোনো লাভ নেই। জীবনের প্রথম খেলা দেখেছে সে। তাঁকে জিতিয়ে দেয়াটাই একজন আদর্শ প্রেমিক হিসেবে আমার দায়িত্ব।
‘ বার্সেলোনা। কেন? ‘
‘ তোমার চয়েস এত খারাপ না জানতাম। কালকে তোমার টিম কি ফুটবল খেলতে নামছিল না কুতকুত খেলতে? ‘
‘ এটা আবার কী অপমান! কুতকুত খেলতে নামবে কেন? মধ্যবয়েসি কয়েকজনকে নিয়ে যে লড়াই করতে পেরেছি ওটাই অনেক। তাছাড়া তুমি ফুটবলের কিছু বুঝো না। তুমি এটা নিয়ে কথা বলো না। ‘
‘ কথা সত্য। আমি ফুটবলের কিছু বুঝি না। কিন্তু তোমার টিমের বদলে যদি আমার ভাইয়েরা নামত, তাহলে কমপক্ষে আটটার বদলে চারটা দিত। ‘
‘ তোমার ভাইয়েরা তো সব পুচকে পুচকে! ‘
‘ তাও দিত! কিন্তু এখন ব্যাপারটা কী হয়েছে জানো। আমি কাল রাত থেকে ভাবছি তোমার পছন্দ যদি এমন হয়। তাহলে বিয়ের পরে দেখব কুতকুত খেলা দেখে রাত জাগবে আর সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারবে না। শ্বাশুড়ি মা এর জন্য আমাকে দায়ী করবেন। যা টোটালি আনফেয়ার! ‘
‘ সুযোগ পেয়ে যা তা বলে দিচ্ছ! ‘
‘ যা তা হবে কেন! আচ্ছা তোমার টিমের পরে আবার কবে খেলা? আমাকে বলো তো। কদিন ধরে হাসার খুব চেষ্টা করছি। পারছি না। তোমার টিমের খেলা দেখলে অন্তর থেকে হাসি আসে। ‘
‘ তারমানে এমনিতে নকল হাসি হাসো? ‘
‘ নকল হাসি না জানলে সমাজে চলা যাবে না। দাঁত মাজা শেষ হয়েছে বোধহয়। ফোন রাখলাম। ‘
প্রেমিকার গলার আওয়াজ শুনে বুঝলাম সে খুব মজা পেয়েছে! তবে আমি আশ্চর্য হলাম অন্য কারণে। সে আমাকে বলল না, ইশ লিওয়ান্ডোস্কি কী কিউট না! কী চোখ, হায় আমি শেষ! এই প্রথমবার আমার প্রেমিকার প্রতি সন্দেহ হলো, সে মেয়ে তো? একজন ভদ্রলোক মুখ কালো করে এসে বলল, ভাই একটা কথা বলি?
‘ বলেন ভাই। ‘
‘ আপনার কাছে কিছু টাকা থাকলে দেন না। নাশতা করব। ভাবছেন অফিসার হয়ে কেন আপনার কাছে টাকা চাচ্ছি। ছেঁচড়াও ভাবতে পারেন। তার আগে ঘটনাটা বলে নেই। কাল রাতে আপনার ভাবির জন্মদিন ছিল। সন্ধ্যায় বের হয়ে গেলাম আমি এক বন্ধুর মেসে। বেচারির যে জন্মদিন ভুলেই গেছি। বাসায় খেলা দেখা যায় না তাঁর জন্য। সে নীরবাসি মানুষ। হৈ চৈ ভালো পায় না। খেলা দেখা শেষে বাসায় গেলাম। রাতে তো কিছু বলেনি। সকালে উঠে সামান্য মারধর করেছে এবং খেতে দেয়নি! কোনোরকম জান বাঁচিয়ে অফিসে এসেছি! আমি না পারলাম হাসতে না পারলাম কাঁদতে। হাসতে পারলাম না কারণ ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে যায়। কাঁদতে পারলাম না কারণ একটু পরেই লোকটার স্ত্রী অফিসে আসবেন। দুজনেই এখানে চাকরি করেন! আবার না উনাকে সামান্য মারধর খেতে হয়! বলতে না বলতে ভদ্রমহিলা মিষ্টি হাসি মুখে নিয়ে অফিসে ঢুকলেন। সবার নজর ভদ্রমহিলার দিকে চলে গেল। না না, ভদ্রমহিলা বিশ্ব সুন্দরী নন। সবাই তাঁর দিকে নজর দিয়েছে কারণ উনার দুহাতে চারটি করে আটটি মুরগী এনেছেন! মুরগীগুলো নিয়ে নিজের সহকর্মী এবং স্বামীর চেয়ারে রেখে নিজের কাজ করতে লাগলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আপনি কি বার্সা?
‘ আরে মিঁয়া বুঝতে পারো নাই কেন আটটা মুরগী এনেছে? ‘
‘ না, বুঝতে পারলাম না তো! ‘
‘ তোমার বুঝার দরকারও নাই। টাকা থাকলে দাও। না থাকলে বকবক করো না। ‘
‘ ভাই, মাত্র আট টাকা আছে! সমস্যা হলো আমি নিজের কাছে মানিব্যাগ রাখি না। দশ টাকা ছিল বুক পকেটে। আসার সময় দুই টাকা একজনকে ভিক্ষা দিয়েছি। বাকি আছে আট টাকা! ‘
‘ ওই মিঁয়া মশকরা করো আমার লগে? তুমি আমার বউ লাগো না বেয়াই? ‘
সমস্ত রাগ আমার উপরে ঝেড়ে লোকটা চলে গেলেন! কিছুক্ষণ পর বস এসে দেখলেন জুনায়েদ সাহেবের টেবিলে আটটা মুরগী! জিজ্ঞেস করলেন শাহনাজকে, জুনায়েদ সাহেবের টেবিলে আটটা মুরগী কেন? কে রেখেছে? শাহনাজ হচ্ছে জুনায়েদ সাহেবের স্ত্রী। তিনি আমতাআমতা করে উত্তর দিলেন, স্যার মুরগীগুলো পরিষ্কার আছে!
‘ মুরগীগুলো পরিষ্কার তাতে কী? আপনি অফিসে মুরগী আনবেন কেন? তাও আটটা! ‘
‘ আটটা গোল খেয়েছে কালকে বার্সা এজন্য! এসব জুনায়েদের উপহার! ‘
‘ জাস্ট স্টপিট! আটটা আটটা করবেন না! আর আপনি এখন আপনার মুরগীগুলো নিয়ে আসুন! ‘
ভদ্রমহিলা আর কিছু না বলে মুরগীগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। রাস্তায় বের হয়ে দেখলেন জুনায়েদ সাহেব দাঁড়িয়ে আছে।
‘ তুমি কি বোকা শাহনাজ? অফিসে কেউ মুরগী নিয়ে আসে? ‘
‘ না, কিন্তু আমি নিয়ে আসলাম। এসব মুরগীর নাম কি জানো? স্টক মুরগী, দামও কম। মাংসও খেতে ভালো না। এদের আক্কেলও কম। একদম তোমার মতো! ‘
‘ আমরা এসব নিয়ে বাসায় কথা বলতে পারি! রাস্তাঘাট এসব সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জায়গা না! ‘
তাঁদের কথাবার্তা শুনে ভালোই লাগছিল। কিন্তু আবার খারাপও লাগছে। কারণ চাকরি থেকে নট আউট করে দিলেন তাঁদের বস! উল্লেখ্য বসও বার্সেলোনার সাপোর্টার! আটটা মুরগী তাঁর অফিস দর্শন করেছে ব্যাপারটা তিনি সহ্য করতে পারেননি! রাত্রিবেলা প্রেমিকার ফোন আসে। সাধারণত দশটার পরে। আজকে সন্ধ্যা বেলায়ই ফোন এলো। ‘ তুমি কই? ‘
‘ গোসল করব। ‘
‘ আমি কি জিজ্ঞেস করেছি তুমি কী করবে এখন? জিজ্ঞেস করলাম তুমি কই। একটা কথার জবাব সোজাসুজি দিতে পারো না? ‘
‘ আরে বাপ গোসল তো মানুষ বাড়িতেই করে। এত রেগে যাওয়ার কী আছে? ব্যাপারটা কী? ‘
‘ আরে আমার এক বান্ধবীর বড়ো আপুর চাকরি চলে গেছে। উনার স্বামীরও! ‘
‘ কেন? ‘
‘ অফিসে নাকি আটটা মুরগী নিয়ে গিয়েছিল! এসব কুতকুত খেলা মানুষ কেন যে সিরিয়াসলি নেয়! ‘
‘ তা ঠিক আছে, ঘটনা খুবই মর্মান্তিক! কিন্তু এতে আমার কী দোষ? আমাকে ঝাড়ছ কেন? ‘
‘ কারণ তোমার আর ওর দুলাভাইয়ের মাঝে কোনো ফারাক নাই! তুমিও বিয়ের পর এইসব কুতকুত খেলা দেখার
জন্য রাত জাগবে। আর আমাদের এমন ঝগড়া হবে! তোমার চাকরি চলে যাবে আর এজন্য শ্বাশুড়ি দায়ী করবেন আমাকে। যা টোটালি আনফেয়ার! ‘
‘ বিয়ের পরের বিষয় বিয়ের পরে দেখা যাবে। তুমি বারবার কুতকুত কুতকুত করছ কেন? কুতকুত খেলা আর ফুটবল খেলা এক না কি? ‘
‘ এক না। কিন্তু তোমার টিম তো কুতকুত খেলে! আর তুমি তোমার টিমের খেলা দেখো। তারমানে কুতকুত খেলা দেখো! ‘
‘ হ্যাঁ, ভালো হইছে আমি কুতকুত খেলা দেখি। এটলিস্ট কুতকুত খেলা তোমার চেয়ে ভালো। এত বকবক করে না! ‘
কথাটা আমি একটু রাগ দেখিয়েই বললাম।
‘ হ্যালো! কুতকুত খেলার জন্য তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না! ‘
‘ কেন তুমি এমন কে যে তোমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারব না? ‘
‘ আমি কে? কুতকুত খেলার জন্য অবশেষে শুনতে হলো আমি কে? থাক তুই তোর কুতকুত নিয়া! আর ফোন করবি না! ‘ সমস্ত প্রেমিকাদের মতো সেও এই বলে ফোন রেখে দিল! বার্সার সাপোর্টার না হয়েও, প্রেমিকার ঝাড়ি শুনে যে ব্যথা বুকে অনুভব করলাম। বার্সার সাপোর্টার হলে নিশ্চিত ডিপ্রেশনে চলে যেতাম! ভাগ্য ভালো!
সামান্য হাসলাম মনে মনে। কিন্তু প্রেমিকার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি তিন দিন হয়ে গেল। চারদিনের মাথায় প্রেমিকার মেসেজ, তুমি কি কুতকুত খেলাটাকেই সিরিয়াসলি নিয়ে নিছো? আমি বড়ো আবেগের সাথে বললাম, হ্যাঁ। কুতকুত খেলাটাকেই সিরিয়াসলি নিয়ে নিছি! ‘ এভাবে কেন কথা বলছ, ফুটবল খেলা সিরিয়াসলি নিয়ে নিলে তুমি তো বিয়ে করতে পারবে না। বিয়ে করতে না পারলে তুমি বাবা হতে পারবে না! তাঁর জন্য শ্বাশুড়ি মা দায়ী করবেন আমাকে! যা টোটালি আনফেয়ার!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত