কবরস্থানের লেবুপাতাগুলো

খুপরি দোকানের কোণে বাঁশের খুঁটিতে বসানো হাত-আধেক লম্বা কুপিবাতিটার আউল-বাউল আলোর ছাইকালো ধোঁয়া বাতাসকে ঝামটা দিতে শুরু করলে লোকটা এবার সরে বসে। স্টেশনঘরের ঢালু পেরোনো সমতলে বেড়ে উঠেছে একটি ছাতিমগাছ। তার ডালপালা থেকে নেমে আসছে কবরস্থানের অন্ধকার। তারপর তা স্থির হচ্ছে লোকটার লালচে চিবুকজুড়ে, কী এক অদৃশ্য আকর্ষণে গালের দুধার থেকে জুলফি গিয়ে মিশেছে চিবুকের আঁধারে। চুল তার এত বিবর্ণ যে, তেমন কোনো তাৎপর্য আর স্পষ্ট হয়ে জাগতে পারছে না চোখ দুটোর বড় বড় মণি থেকে। তবে মোটা ঠোঁটটা তিরতিরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে কী এক ইঙ্গিত তৈরি করে চলেছে প্রতি মুহূর্তে। চিবুকের অন্ধকার লোকটার খরখরে গলা থেকে বেরোনো ঘরঘর শব্দে একটুও সরে না; কেবল বাধ্য হয় থুঁতনির নিচে জমা থমথমে ভাবটুকু ঝেড়ে ফেলতে। দোকান বন্ধ করার কথা ভাবতে ভাবতে কোরবান দোকানদার আবারো লোকটার দিকে ফিরে তাকায় সহানুভূতি নিয়ে।

সহানুভূতি, নাকি করুণা? হয়তো করুণাই হবে, কোনটা যে ঠিক, কোরবান অত তলিয়ে ভাবার চেষ্টাও করে না এখনো যে একটা কিছু জাগে, তাই তো অনেক! আকাশ দেখতে দেখতে গত পরশু নদীর জলে ভেসে এসেছে বুক চিতানো ২৫-৩০ জন, উপুড় হয়ে নদীর তলের কাদামাটি দেখতে দেখতে এসেছে আরো ১৫-২০ জন। তাদের শরীরে কোনো রক্তবিন্দু নেই, ক্ষতচিহ্নে জলের সন্তরণ, জলের সন্তরণে ফুলেফেঁপে উঠেছে সেসব জন, খসে খসে পড়ছে সেসব জন, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে জলের মধ্যে মাছদের সহানুভূতি ও করুণায় তাদের সংকীর্ণ পাকস্থলীতে ঘুমানোর মতো অন্ধকারময় খানিকটা জায়গা সংগ্রহের ক্লান্ত তাড়নায়। দেখতে দেখতে বারবার সে নিজের হাতের তালু শুঁকেছে, যেন সেখানে তখনো লেগে আছে লেবুপাতার ঘ্রাণ আর তা তাকে মুক্ত করবে বিবমিষার আতঙ্ক থেকে।

নিশ্চয়ই ভূত হতে পারেনি ওরা, ভূত হলে এভাবে নদীতে ভাসতে হতো না তাদের, ভূত হলে এসব সদ্যভূতের দাপটে নিঃসন্দেহে ছাতিমগাছের বুড়োহাবড়া ভূতগুলো ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলে যেত কামরূপ-কামাখ্যার জঙ্গলের দিকে। কিন্তু ছাতিমগাছের বুড়ো ভূতটা এখনো আছে, গতকালই নাকি শেষরাতের দিকে মাঠার দোকানের মাচায় শুয়ে থাকতে দেখা গেছে সেটাকে। গফুর কি এটা চাপা মেরেছে, নাকি সত্যিই বলেছে তাও তো আর বোঝার উপায় নেই। কিন্তু এতকিছুর পরও তার মনে সহানুভূতি আসে, অথবা করুণা আসে; কেননা, সে আবারো লোকটার সঙ্গে আফরোজার বিয়ের
সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে। এদের দুজনের ক্ষীণ হলেও আমৃত্যু বসবাসের যে- সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সে-খবর তাকে খুশি করে না, তার মনে আনন্দ জাগায় না। অথচ আফরোজা তো তার আত্মীয়ই লাগে বয়সে দু-এক বছর ছোট হতে পারে; কিন্তু জোড়াতালি দিলে সম্পর্কের দিক থেকে লুৎফর খলিফা তো তার চাচাতো ভাই-ই হবে, আর আফরোজা তো তারই বিধবা বোন। আজ জুমা বাদে সারাটা বিকেল ধরে লুৎফর তাকে এ-সম্ভাবনার কথা বুঝিয়েছে – লোকটাকে ভালোই মনে হতেছে, তুমি ভালো কইরা কথা বলো, দরকার হইলে এ-গাঁয়েই থাইকা যাক না আফরোজাকে বিয়া কইরা।

এ তল্লাটে লোকটা এসেছে মাসখানেক আগে। কোরবানের সাদার মধ্যে কালো ফুটকি তোলা গরুর খাঁটি ঘন দুধের মালাই খেয়ে দাম না দিয়ে মিলিটারিরা তখন কালিয়া-হরিপুর থেকে রওনা হয়েছে জামতৈল হয়ে উল্লাপাড়ার দিকে। তার আগে তারা চানতারা পতাকা উড়িয়েছে স্টেশনঘরে, স্টেশনের সবকটি দোকানে। আর পতাকাগুলো বানিয়েছে লুৎফর খলিফাকে দিয়ে। জয়বাংলার পতাকা বানাতে গাঁইগুঁই করলেও চানতারা বানাতে লুৎফর গাঁইগুঁই করেনি। খুশি-খুশি চোখে সে-কাপড়ের থানের দিকে তাকিয়ে কী যেন চিন্তা করেছিল; তারপর কী বলতে গিয়ে মিলিটারিদের বেয়নেটে চোখ পড়তেই মুখটা ঘোড়ার পাছা বানিয়ে মনোযোগ দিয়েছিল সেলাই মেশিনের দিকে। ‘শালার খলিফা, এবার দেখমুনি তুমি শালা পতাকা বানাইন্যার মজুরি কয় ট্যাকা চাও! শালার ব্যাটা, আমাগারে কাছে তুমি দুইগুণ দাম চাইছিলা, মজুরিও দুইগুণ কইছিলা’ – মনে মনে এসব বলছিল আর খলিফার দোকানের ঝাঁপঘেঁষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোরবান খুশিখুশি চোখে অবলোকন করছিল লুৎফরকে। কিন্তু শেষ দেখা হলো না, তার আগেই কোরবানকে উঠে যেতে হলো চা বানাতে। এই স্টেশনে চা চলে না, গাঁয়ের লোকজনের চাপাতি ভালো লাগে না। তারা ভালোবাসে মিক্সচার। তারপরও খানিকটা চা রাখে কোরবান।

স্টেশনমাস্টারের কাছে কোনদিন কে আসে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই, হুট করে কাজে লেগে যায়। এখন স্টেশনমাস্টার নেই, যুদ্ধ লাগতেই সে পালিয়ে গেছে। এই মাসদুয়েকে চায়ের গুঁড়োয় নিশ্চয়ই ভুখা জমেছে! তা জমুক, আরো জমুক – চা তো খাবে মিলিটারিরা মিলিটারিদেরও নাকি মাথা ধরে! খুশিমনেই কোরবান চা বানিয়েছিল। বুটপরা, রাইফেলওয়ালা পেটা শরীরের অতগুলো মিলিটারির সামনে দাঁড়িয়ে লুৎফরের ওই সার্কাস দেখার চেয়ে নিজের দোকানে বসে চা বানানো অনেক ভালো।

অতএব তার জানা হয়নি, চানতারা পতাকা বানাতে মিলিটারিরা লুৎফরকে কত টাকা দিয়েছে নাকি টাকা ছাড়াই বেগার খেটেছে সে, সঙ্গে মাগনা দিতে হয়েছে পতাকা বানানোর কাপড়টুকুও! খুব ফটর-ফটর করে লুৎফর – আট আনা কামাই করলে দেড় টাকার গপ্পো শোনায়। কিন্তু মিলিটারিকে দেখার পর থেকেই তার মুখে কোনো কথা নেই, আর পতাকা বানাতে শুরু করার পর থেকে মনে হচ্ছে খলিফার চেয়েও বড় কোনো খলিফা এসে লুৎফরের ঠোঁট সেলাই করে দিয়ে গেছে। তারপরও কোরবান তক্কে-তক্কে আছে, যুদ্ধ আর কয়দিন? পরের দেশের মাটিতে এসে খানসেনারা আর কদিন ফাল পারবে? মুখ পাতলা লুৎফর, একদিন না একদিন তোক কইতেই হইবো, খানসেনাগারে কাছ থেইকা কয় টাকা গুঁইজবার পারছিস তোর দাদ-বিখাউজে ভরা কোমরের ট্যাকে।

পতাকা বানানোর পর লুৎফর খলিফা স্টেশনের সবাইকে আবার এক জায়গায় জড়ো করেছিল। তখন আর তার মুখ অত শুকনা দেখাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, মিলিটারিরা খানিকটা পানি ঢেলে দিয়েছে চোখেমুখে, খানিকটা রোদও পড়েছে – সব মিলিয়ে মুখটা এখন চকচক করছে। তাদের বুক তখন ঢিপঢিপ করছে, আবার কেন ডাকে সবাইকে? আর খলিফা ব্যাটার সঙ্গেই বা এত দোস্তি কিসের খানসেনাদের? খলিফাই কি তাহলে খানসেনাদের খবর দিয়েছে টেলিগ্রাম অফিস থেকে? তখন অনেকদিন পরে তাদের মনে পড়েছিল, একটা টেলিগ্রামও আছে তাদের স্টেশনলাগোয়া ডাকঘরটায়।

কিন্তু এখন সেটা খাঁ খাঁ করছে – টেলিগ্রাফ অপারেটর পালিয়ে আছে, পোস্টমাস্টার পালিয়ে আছে, ডাকপিয়নগুলোর কোনো খবর নেই। ভয়ে তড়পাতে তড়পাতে তারা জড়ো হয় প্লাটফর্মে; কিন্তু কপাল ভালো, খানসেনারা তখন পতাকা ঝুলায় স্টেশনঘরে। তাদের তখন হাততালি দিতে হলো, তাদের ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবার’ শুনে স্টেশনঘর আর ওয়েটিং রুমের চালে বসে থাকা সবকটি কাক আকাশে উড়াল দিলো, গাছগাছালি থেকে শালিক, বুলবুলি, দোয়েলগুলো বেরিয়ে নিরুদ্দেশে গেল আর কোরবানের দোকানের পেছনে কলাগাছে বসে থাকা ফিঙেপাখিটা তার বিশাল লেজ তুলে নিঃসংকোচে খানিকটা হাগু করল। খানসেনারা তখন গুলি করল – মেশিনগানের গুলি ও চায়নিজ রাইফেলের গুলিতে আকাশ কেঁপে উঠল, নাকি পালটা একটা থাপ্পড় খেয়ে গুলির শব্দই ফিরে এলো তা ঠিক বোঝা গেল না। গ্রীষ্মের রোদে ফোটা কয়েকটি জারুল ফুল ঝরে পড়ল ঘাসের ওপর, পাখিদের মনে আবারো ত্রাস ছড়াল এবং দূরের কোনো গাঁয়ে চিৎকার ও কান্নাকাটির রোল পড়ল।

কিন্তু খানসেনারা অকম্পিত কড়া চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। লুৎফরকে ধমক দিয়ে কী যেন বলল উর্দু ভাষায় এবং পুরো স্টেশনে কেবল লুৎফরই উর্দু বোঝে বলে সে গর্বিত চোখেমুখে; কিন্তু খানিকটা কম্পিত নিচুকণ্ঠে তাদের সঙ্গে কথা বলতে লাগল থেমে থেমে। তারপর সে তাদের মুখোমুখি হলো, চড়া গলায় বলে উঠল, ‘আসেন, আমরা আমাগারে পাকিস্তানের জইন্যে আল্লার কাছে নমাজ পড়ি।’ এইভাবে তাদের সবাইকে নিয়ে লুৎফর প্লাটফর্মের ওপর পাকিস্তানের সমৃদ্ধি কামনা করে নফল নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে গেল। খানসেনারা লুৎফরদের নামাজ পড়া দেখল ‘প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বিশ্রামাগার’ লেখা লালঘরটায় বসে, দেখতে দেখতে তারা কোরবানের দোকানের মুড়ি খেলো গুড় দিয়ে; আর নফল নামাজ পড়া শেষ হলে ‘ইধার আও’ বলে ডাকল তাদের, এবং হাতের পাঞ্জা টিপে, পিঠে হাতের থাপ্পড় মেরে কয়েকজনকে তুলে দিলো স্টেশনঘরের কোণের নারকেল গাছটায়।

এক কুড়ি কচি ডাব পারা হলো, সেই ডাবের পানি খেয়ে জামতৈল নাকি উল্লাপাড়ার দিকে হাঁটতে শুরু করল খানসেনারা। কোনখানে তারা যাচ্ছে, কী কাজে যাচ্ছে, কে আর প্রশ্ন করে! এমনকি লুৎফর তো সেই শুরু থেকেই খানসেনাদের পিছে পিছে ঘুরছে, সে পর্যন্ত সাহস পেল না প্রশ্ন করার। খানসেনারা নিজেরাই কী দিয়ে কী বলল, আর লুৎফর মাথা নাড়তে নাড়তে, হাত কচলাতে কচলাতে বারবার ‘হাম দেখেঙ্গে, ছার’ বলতে বলতে সায় জানালো তাতে।

অন্য কোনো সময় হলে এরকম একটা ঘটনার পর জটলা হতো। ভাঙা মাজা নিয়ে রান্ধুনীবাড়ি থেকে হজরত চাচা পর্যন্ত চলে আসত। কিন্তু সময় খারাপ মিলিটারিরা চলে যাওয়ার পর প্লাটফর্ম ফের খাঁ খাঁ হয়ে গেল। ছাউনি নেই সেখানে। কিন্তু ছাউনির অভাব মিটিয়ে দিয়েছে সারবাঁধা সব গাছ। অথচ কাঁঠাল পাকার সময় এলেও কোনো মাছি নেই সেসব গাছের নিচে, মলম আর দাঁতের মাজন বিক্রির উচ্চকিত ক্যানভাস নাই কোনোখানে। করোগেট টিন দিয়ে ঘেরা একদিকে জেনানা আর আরেকদিকে পুরুষের ছবি আঁকা টয়লেটও কেউ ব্যবহার করে না কতদিন হয়। কেউই আর বোধহয় ট্রেনে চলাফেরা করে না। পৃথিবীর সব ট্রেন থেমে আছে, আকাশে আর কোনো কালো ধোঁয়া নেই। প্লাটফর্ম আর তার বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হাতেগোনা কয়টা দোকান একটা নাপিতঘর, একটা মাঠার দোকান, দর্জিঘরটা খলিফা লুৎফরের, মনোহারি দোকান আছে গফুরের, চা-বিড়ির দোকান কোরবানের। সকালের দিকে ছোটখাটো বাজার বসে; কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আর জমে না। মাছও পাওয়া যায় না আগের মতো। সকালে মোকতেল কয়েকটা খলিসা, ট্যাংরা আর পুঁটিমাছ নিয়ে বসেছিল কোরবান দোকান থেকে নেমে যেতে না যেতেই পরিষ্কার। এর বেশি আর কী পাবে মোকতেল গাঁ-গঞ্জের খাল আর পাগাড় থেকে? মাছ আসত ভোরের ট্রেনে – চাটমোহর, বড়াল ব্রিজ, দিলপাশার থেকে। আর খালি মাছ কেন, তার দোকানে নতুন মালপত্রও তো তোলা হয় না কয় সপ্তাহ গেল। কিন্তু ট্রেনের কোনো মা-বাবা নেই, মাছেরও কোনো খোঁজখবর নেই, নতুন মালপত্রও আনা হয় না, প্লাটফরমে মাছের ঝাঁকা নামার সেগুলো দেখতে দেখতে, আড়তে গিয়ে মালপত্র নেড়েচেড়ে জটলা পাকিয়ে যে একটু খোশগল্প করবে, তারও উপায় নেই। এমনিতেই কথাবার্তা বলার মানুষ কম, লুৎফরের সঙ্গে কি আর কথা বলা যায়? ইহকাল ও পরকালের একশ এক কোটি ধান্ধা নিয়ে সে দিনরাত পাক খায়, একবার আফরোজার বিয়ে দেওয়ার কথা বলে তো সঙ্গে সঙ্গে ইহকালে ঠিকমতো সংসারধর্ম পালন না করলে পরকালে কী হবে তার বয়ান দিতে থাকে – এরকম লোকের সঙ্গে কি আল্লার ত্রিশদিন বাস করা সম্ভব? ক্ষেতখোলার কামলাজামলারা পর্যন্ত আর ঠিকমতো কথা বলে না – ভয়ে সবাই চুপসে আছে। মনে হয় কবরস্থান – কবরস্থানে হেঁটে বেড়াচ্ছে একেকজন মূক ও বধির হয়ে। কে যে জয়বাংলার মানুষ আর কে যে চানতারার মানুষ, সহজে আর বোঝাই যাচ্ছে না। তবে কোরবান একটা সরলসোজা হিসাব বের করে নিয়েছে – যারা এখন একটু চুপচাপ হয়ে গেছে, তারাই আসলে জয়বাংলার লোক। যেমন, সে নিজেই তো এখন আর সাত চড়ে রা করে না। আবার আফরোজা আফরোজারও তো কথাবার্তা কমে গেছে। কিন্তু এতদিন যে-লোক মুখটা শেয়ালের মতো বানিয়ে চুপ করে বসে থাকত, জয়বাংলা শুনলেই যার সেলাই মেশিন চালানোর শব্দ হয় থেমে যেত না হয় খুব বেড়ে যেত, সেই লুৎফর খলিফার জবান এখন খুলে গেছে। এই স্টেশনের পরে, স্টেশন লাগোয়া গাঁয়ে সবচেয়ে বেশি কথা বলার মানুষ কোরবানই তো! জহির আর আফরোজারও ঠোঁটকাটা; কিন্তু আফরোজা তো মেয়েমানুষ, সে তো আর সাত গাঁ চষে বেড়ায় না তারপরও যুদ্ধ লাগার আগে তার মুখ যা চলেছে – আহ্, একেবারে মেশিনগান। মনেই হয়নি, ওই বাড়িতে লুৎফর খলিফা থাকে, কেবল ওই বাড়িটাই ইলেকশনের সময় সাজানো ছিল দাঁড়িপাল্লার পোস্টার দিয়ে। লালমনিরহাট থেকে পালিয়ে আসার পর এই দাঁড়িপাল্লার পোস্টার দিয়ে সাজানো বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আফরোজা বিহারিদের অত্যাচারের বয়ান দিচ্ছিল, কাঁদতে কাঁদতে বলছিল কীভাবে তার জামাইকে পিটিয়ে আধমরা করেছে বিহারিরা, তারপর আবার পুড়িয়েছে কেরোসিন তেল ঢেলে। কিন্তু ওই আফরোজাও এখন চুপ হয়ে গেছে, বারবার মুখ মোছে – চোখের পানি মোছে নাকি মুখে জমা ঘাম মোছে বোঝা যায় না। আর জহির – খানসেনাদের ট্রেন থেকে নামতে দেখেই সে কোনখানে যে কেটে পড়ল, মিলিটারিরা চলে যাওয়ার পরও তাকে আর খুঁজে পেল না কেউ। এভাবে খানসেনাদের আসার দিনটা জ্বলজ্বল হয়ে উঠল। সেদিন কোনো জটলা হলো না, খানসেনারা চলে যাওয়ার পর উৎফুল্ল লুৎফর গফুরকে দোকানে বসিয়ে বয়ান দিতে লাগল, যোদ্ধাদের সহযোগিতা করার জন্য তাদের ধর্মে কী কী নির্দেশ দেওয়া আছে, বলতে লাগল যোদ্ধারা যুদ্ধকালে কী কী করতে পারেন। মাসালা তো কোরবানও কম জানে না, নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করলে, ঘরবাড়িছাড়া করলে এবং নারীদের ধর্ষণ করলে খোদা তাদের কী শাস্তি দেবেন সেরকম পালটা মাসালা কোরবানেরও জানা আছে, তা ছাড়া লুৎফর তাকে কয়েকবার ডাকলও জোরে জোরে; কিন্তু কোরবান ততক্ষণে পুরোপুরি হুশিয়ার, শিয়ালমুখো লুৎফর খলিফা এখন গণ্ডারের মতো জাবর কাটতে শুরু করেছে – তার মানে ঘটনা খারাপ, এই এলাকার জয়বাংলার লোকজনকে এখন রয়েসয়ে চলতে হবে। অতএব লুৎফরের দোকানে গিয়ে গালগপ্পো করার ব্যাপারটা আরো ঘণ্টাতিনেকের জন্য মুলতবি করে নিজের খুপরিঘরে গিয়ে হিসাব কষতে বসল কয় টাকা লোকসান হয়েছে খানসেনাদের চা-মুড়ি-গুড় খেতে দিয়ে। এ টাকা যে করেই হোক লুৎফর খলিফার দোকান চিপে বের করে নিতে হবে। ঠিক তখনই দেখা গেল, উত্তরের সড়ক দিয়ে একটা লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রায় দৌড়ে এদিকেই আসছে। কিন্তু সড়ক বরাবর তাকিয়ে হঠাৎ সে বোধহয় দূরের মিলিটারিদের দেখল; তাই আবার দৌড়াতে শুরু করল উলটোদিকে। তা দেখে মেশিন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে একরাশ কৌতূহল নিয়ে লুৎফর খলিফা হইহই করে ডাকতে লাগল তাকে। এরকম কোনো ডাকের জন্যেই কি অপেক্ষা করছিল লোকটা? চাইছিল, কেউ হঠাৎ ডেকে উঠে থামিয়ে দিক ক্লান্ত তাকে? লুৎফর খলিফার ডাককে উপেক্ষা করে দৌড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার তীব্র কোনো আগ্রহ দেখা যায় না তার মধ্যে। সড়কের ধারে নতুন গজানো কৃষ্ণচূড়ার কাণ্ডের পাশে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। লুৎফর খলিফা দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায় লোকটার দিকে, মনেই হয় না কয়েকদিন আগে খারাপ বাতাস লেগে খলিফা কোঁকাচ্ছিল আর বলছিল, আমি কী এমন পাপ করছি গো আল্লাহ, তুমি আমাক মাইরা ফেইলবার চাও?!

কোরবান তখন একদিন লুৎফরকে দেখতে গিয়েছিল নাপিতঘরের হামিদের সঙ্গে। সেলুনের মালিক ভবতোষ উধাও হয়ে গেছে, কেউ বলে সে ভারত চলে গেছে, কেউ বলে ভারত যায় নাই – দেশের মধ্যেই ঘাপটি মেরে আছে, মুক্তিরা এলেই বের হবে ডেরা থেকে। ভবতোষের যাই হোক, হামিদের ভাব বেড়েছে। হামিদের হাত ভালো না, দাড়ি কাটা ছাড়া আর কোনো কাজ করতে পারে না সে – ভবতোষ তাকে চুল কাটানো শেখানোর কাজে নিয়েছিল মাসতিনেক আগে। তাছাড়া দৈনিক সাতসকালে সেলুন খুলত সে, দোকান ঝাড়– দিত আর ভবতোষের কাঁচির চাপে ঝরেপড়া ভালো চুল যতœ করে রেখে দিত একটা পোঁটলার মধ্যে। এখনো সে দৈনিক সেলুন খোলে, তবে এমনভাবে খোলে মনে হয় নিজের দোকান, ভবতোষ নামে কোনো লোক এ-সেলুনে কোনোদিন ছিল না। মালিক উধাও, স্টেশনে লোকজন কম, সেলুনের কাজকামও নেই, হামিদ তাই ফুরফুরে মেজাজে স্টেশনের সবার দেখভাল করে বেড়াচ্ছে।

লুৎফরের ওই কথা শুনে সেই হামিদও কেমন এলেবেলে একটা কথা বলে বসে, চাচা, আল্লায় কি খালি পাপ কইরলিই মারে? আপনে কী যে কন না –
তুমি কী বুইঝবা! জানো না, বোঝ না, খালি ফটর-ফটর কর! – খারাপ বাতাস লাগা লুৎফর রাগের দমকে কেঁপে কেঁপে ওঠে। বাঁশের বেড়ায় হেলান দিয়ে জোরে নিশ্বাস নিয়ে খারাপ বাতাস লাগার যাতনা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। বছর তিরিশের বিধবা আফরোজা তাকে দ্রুত বাতাস করতে থাকে, ফলে হাতপাখার সঙ্গে লাল-নীল অক্ষরে লেখা ‘ভুলো না আমায়’ আর বোঝা যায় না।
সেই লুৎফর খলিফা অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে লোকটার দিকে এগিয়ে যায় – সকালে খানসেনারা চানতারা পতাকা উড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে খারাপ বাতাস কেটে গেছে তার গতর থেকে। লোকটা ততক্ষণে গাছের গোড়ায় বসে পড়েছে, তার চোখেমুখে ক্ষুধার শিকড় গজাচ্ছে এবং ক্রমশ সে মাটির ওপর লুটিয়ে পড়ছে শঙ্খলাগা সাপের অসহ্য নিথরতা নিয়ে। অতএব লোকটার বাড়িঘর আর জানা হয় না, কেন সে দৌড়াতে দৌড়াতে এদিকে আসছিল, কেনই বা আবার উলটোদিকে দৌড় দিলো এসবের কোনোটাই জানা হয় না পাঁজা কোলে করে নিয়ে এসে তাকে শুইয়ে দেওয়া হয় হামিদের সেলুনের সামনে বাঁশের মাচাটার ওপরে। অসহ্য যন্ত্রণায় চোখ বুজে থাকা লোকটারও আর জানা হয় না, সেলুনের ভেতরের দিকে বেড়ার সঙ্গে লাগানো সিনেমা সাপ্তাহিকের পাতা ফুঁড়ে গভীর আগ্রহে তার দিকে শবনম আর ববিতা, জহির রায়হান আর সুচন্দাও তাকিয়ে আছেন। লেবুশরবত বানানোর জন্যে লাল কোয়ার্টারের দিকে দৌড়াতে গিয়েও হামিদ ফিরে আসে; কেননা তার মনে পড়ে যায়, যুদ্ধের আগেই ঈশ্বরদীতে চলে গেছে পরশের পরিবার। লাল কোয়ার্টারে এখন আর বাতি জ্বলে না সাঁঝের বেলা, ঘরের সামনে সামান্য একচিলতে জায়গায় লাগানো কাঁচামরিচ গাছগুলোর নীল-সাদা ফুলগুলো মরে গেছে রোদের তাপে। কোরবান লোকটার মাথায় পানি ঢালে আর ফুলগুলির মৃত্যুসংবাদ শোনে কি শোনে না, তাড়াতাড়ি হামিদকে তার দোকান থেকে দু-চার চামচ চিনি নিয়ে আসতে বলে। তারপর লোকটার মুখে চিনি দিতে দিতে সে টের পায়, লুৎফর খলিফা তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। এরকম ঝামেলার মধ্যেও কোরবানের পতাকার কথা মনে পড়ে; এক হাত দিয়ে পানি ঢালতে ঢালতে, আরেক হাত দিয়ে ভেজা চুল বিলি করতে করতে সে লুৎফর খলিফাকে প্রশ্ন না করে থাকতে পারে না, ট্যাকা দিছে আপনেক?

কিসের ট্যাকা? – লুৎফর খলিফা এমন বোকদা-বোকদা ভাষায় উত্তর দেয় যে, মনে হয় কোরবানের প্রশ্ন সে বুঝতেই পারেনি। মনে হয়, সে এতক্ষণ এ-জগতেই ছিল না, এখন হঠাৎ গরম বাতাস লাগায় সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।

ক্যান, এতগুলা পতাকা বানায়া দিলেন – টাকা দেয় নাই?
‘শালা জয়বাংলার দালাল, দাঁড়া, আর কয়দিন! আগে কমিটি বানায়া নেই!’ – মনে মনে কোরবানকে একটা গালি দেয় লুৎফর খলিফা। এখন অবশ্য গালিগালাজ জোরে দিলেও কোনো ক্ষতি নেই, খানসেনারা একটু আগেই মুখ দেখিয়ে গেছে, এই দুনিয়ায় এখন আর তার কোনো ভয় নেই – এই খানসেনাদের জন্যেই তো সে অপেক্ষা করছিল – যদিও ভয়ও ছিল একটু। ঝড় যখন ওঠে, তখন তো ভালো গাছ মন্দ গাছ বিচার করে না, সবকিছুতেই সে ঝাপটা দিতে থাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার, উড়িয়ে দেওয়ার দুর্মর বাসনাতে। মিলিটারিরা যদি সেরকম ঝড় তুলে মেরে কেটে বাড়িঘর পোড়াতে পোড়াতে আসতে থাকে, তাহলে তাকে কি আর মারার আগে জিজ্ঞেস করে মারবে? সে কি আর বলার সুযোগ পাবে? রেডিওতে সে শুনেছে শান্তি কমিটি তৈরি করার খবর এবং এখানেও সে চায় শান্তি কমিটি করতে? শান্তি চাই, আর শান্তির জন্যে চাই পাকিস্তানের দালাল – সে সেই পাকিস্তানের দালাল। ধর্মে গান গাওয়া নিষেধ হলে কী হবে, ‘পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ, পায়েন্দাবাদ…’ গাইতে তার ভীষণ ভালো লাগে, আরো ভালো লাগে নূরজাহানের গান শুনতে। কিন্তু এতকিছু বলার সুযোগ তো পাওয়া যাবে না। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। আগে নিজেকে বাঁচাতে হবে, বাঁচার জন্যে দৌড় দিতে হবে এই ৪৬-৪৭ বছর বয়সে সে কি আর পারবে আগের মতো দৌড় দিতে? ভাগ্য ভালো, তাকে দৌড়াতে হয়নি। তা ছাড়া তখন জোহরের ওয়াক্ত হয়ে এসেছে, সে নিয়ত করেছে বাড়ি গিয়ে জামাকাপড় পালটে অজু করে আজ মসজিদেই যাবে – জোহরের নামাজের বাড়তি কিছু সুবিধা আছে। এ নামাজের সময় আল্লাহর আরশের নিচের সবকিছু আল্লার গুণগানে মশগুল হয়ে পড়ে। এজন্যেই তো জোহরের নামাজ ওয়াজেব তাদের সকলের জন্যে। তাছাড়া মসজিদে এখনো দু-চারজন মানুষ আসে, আল্লাহর নামে তাদের অভয় দেওয়া যায়। ১০ বছর ধরে লুৎফর খলিফা চেষ্টা করছে লোকজন তার কথা শুনুক – এখনই সুযোগ তাদের কথা শোনানোর। বাড়ি যাওয়ার জন্যে সে এক পা এগিয়েছে – হঠাৎ মনে হয়েছিল, ঘোল নেওয়া দরকার। প্লাটফর্মের উলটোদিকে, রেললাইনের ওইপারে মাঠার দোকান – সেখান থেকে সেরদুয়েক ঘোল কিনে ফিরছিল সে; তখনই ট্রেন এসে থামল আর কোনো কিছু বোঝার আগেই ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে তার সামনে নামল কয়েক নওজোয়ান খানসেনা। তাদের কারো দাড়িগোঁফ নেই, তারপরও চোখমুখ দিয়ে নুরানি জ্যোতি বেরোচ্ছে। দৌড় দিয়ে কোনো লাভ নেই, পেছন থেকে গুলি মেরে কাত করে ফেলবে – মাঠার দোকানে গফুর আর তার ১০-১১ বছরের পোলাটাও মূর্তি হয়ে গেছে। বুক ঢিপ-ঢিপ করছে, তারপরও লুৎফর মনে মনে ওদের গালি দিলো কাফের, আস্ত দুইটা কাফের, নইলে কি মূর্তি হয়ে যায়? মূর্তি যে তাদের ধর্মে হারাম, সেটা ১০-১১ বছরের পোলাটা জানতে না পারে, গফুর কি জানে না? আর আরো মনে হলো, এটাই সুযোগ, এরকম একটা দিনের জন্যেই বোধহয় খোদাতায়ালা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ইমানের – তার ইমানের পরীক্ষা নিচ্ছে খোদা – দেখতে চাইছে, সত্যিই সে মুসলমান কি-না, মুসলমান ভাইকে দেখে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে শুকরিয়া আদায় করে কি-না। অতএব এগিয়ে গেল সে, সালাম দিলো লম্বা করে আর উত্তর না দিলেও খাকি পোশাকপরা খানসেনাদের ঠোঁট একটু হাসি-হাসি হলো। খারাপ ঘটনার মধ্যে এটুকুই যে, শালার মজুর ব্যাটা দৌড় দিয়ে পাটের ক্ষেতের মধ্যে পালানোর চেষ্টা করেছিল। তখন গলা থেকে ঝোলানো বাঁশি বাজিয়ে, বুটের আওয়াজ তুলে, ফুরুত-ফরুত কীসব উর্দু-ইংলিশ বলে মিলিটারিরা তাকে অনায়াসে ধরে ফেলে আর বেয়নেটের একটা ঘা বসিয়ে দেয় কাঁধ বরাবর। তা যেমন কর্ম, তেমন ফল – কী দরকার ছিল রে শালা তোর দৌড় দেওয়ার? মিলিটারিরা কি বাঘ নাকি ভালুক যে দৌড় দিতে হবে? মুসলমান – মুসলমান তারা, সেই সূত্রে ভাই-বেরাদার। দেশের খেদমতের জন্যে তারা যে কত কিছু করছে, এই নাদানগুলো তার কিছুই বুঝল না। ব্যাটারি খরচ হওয়ার দুঃখে তার কলজে ছিঁড়ে যায়, তারপরও দোকানে বসে সে রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে রাখে যাতে আশপাশের নাদানগুলো শুনতে পায় ইয়াহিয়া খানের ভাষণ, পাকিস্তানি বাহিনীর খবরাখবর। কিন্তু এগুলো তো খালি নাদান না, সবগুলো একেকটা জিন্দা ইবলিশ – শুনেও না শোনার ভান করে সেসব খবর। বিশ্বাস নেই, এক ছটাক বিশ্বাসও নেই তাদের ইয়াহিয়ার রেডিওর ওপরে।

এই যে এত বড় একটা ঘটনা ঘটল, খানসেনারা তাদের রেলস্টেশনে থেমে নেমে কী সুন্দর চানতারা উড়াল, তারপরও কেউ একটা ভালো কথা বলল না মিলিটারিদের নামে। উলটো আড়েঠাড়ে যে গীবত করছে, কোরবানের ওই খোঁচামারা কথা থেকেই তা টের পাওয়া যায়। যদিও চলে যাওয়ার আগে মিলিটারিরা কোরবানকে মালাই খাওয়ার দাম দিয়ে যায়নি, চায়ের দাম দিয়ে যায়নি, মুড়ি আর গুড়ের দামও দেয়নি, পতাকার কাপড় আর পতাকা বানানোর মজুরিও শোধ করেনি, তাই বলে কি মুসলমান হয়ে মুসলমানের গীবত করা উচিত? আর লুৎফরের ইমান কি এতই দুর্বল যে, সামান্য কয়েকটা পতাকার কাপড় আর তা বানানোর মজুরির জন্যে সে তার মুসলমান ভাইদের সম্মানে হাত দেবে? ধর্মে আছে, মানী লোকের মান রাখো – পাঞ্জাবিরা হলো মানী মানুষ, একেকজন কী সুন্দর লম্বাচওড়া, কত বড় একেকজনের বুকের ছাতি, চিন্তা করা যায়! আর এই মরার দেশের একেকটা বাঙালি মুসলমান, তাদের শরীরে কি ওই তাগদ আছে? পাঞ্জাবিদের পাশে এদের একেকজন তো হাঁটুর সমান! তাদের মতো চুনোপুঁটির উচিত কি ওই পাঞ্জাবিদের নিন্দা করা? সাচ্চা মুসলমানও কোনো কোনো সময় আমানত খেয়ানত করে বসে, হয়তো খানসেনারাও সেরকম দু-চারটা ঘটনা ঘটিয়েছে। ‘হারামজাদা’, ‘কুত্তাকি বাচ্চা’ এরকম দু-চারটা গালিই যদি সহ্য না করা যায়, তাহলে কি করে সম্ভব পুব-পশ্চিম মিলিয়ে এক জায়গায় থাকা? এই ভুল ইরাক আর ইরান করেছে, এই ভুল সিরিয়া আর জর্দান করেছে – লুৎফর খলিফা তার দাঁড়িপাল্লার নেতাদের দেওয়া বক্তৃতা আওড়াতে থাকে – এই ভুল কি তাহলে তারা সবাইও করবে? দু-চারজন মানুষ গুলি লেগে মারা গেছে অবশ্য, কিন্তু সেজন্যে কি আর মিলিটারি দায়ী? তার জন্যে তো দায়ী ভারতের দালালেরা – খালি খালি ‘জয়বাংলা’, ‘জয়বাংলা’ বলে লাফালাফি করছে, আবার রাস্তাঘাটে ব্যারিকেড দিচ্ছে, এত বিশৃঙ্খলা সহ্য করা যায়! তা ছাড়া ঝড় উঠলে তো সব আমই পড়ে, কাঁচা আমও পড়ে, পাকা আমও পড়ে – যুদ্ধ লাগলেও তাই, একজন খারাপ মানুষ মরে তো ১০ জন ভালো মানুষও মরে। খালি খালি মিলিটারিদের দোষ দিয়ে কী লাভ! মিলিটারিদের ওপর ইমান তাই একটুও নড়বড়ে হয়নি লুৎফর খলিফার। সাচ্চা মুসলমানও মাঝেমধ্যে আমানত খেয়ানত করে বসে, হয়তো তারাও ঠিক ওরকমভাবে তাকে পতাকার দাম দিতে ভুলে গেছে, এবং নেহায়েতই মনের ভুলে – এছাড়া পাঞ্জাবি সাচ্চা মুসলমানদের তো টাকা না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। সে নিজে চায়নি – তার না চাওয়ার অনেক কারণও আছে, লুৎফর মনে মনে যুক্তি খোঁজে। একজন মুসলমান হিসেবে মুসাফির আর সৈনিকদের কাছে তো সে নিজে থেকে কিছু চাইতে পারে না। মুসলমানদের ঘরে মুসাফির আর সৈনিক আসার মানে খোদার ফেরেশতা আসা – সে কেন সেই ফেরেশতাদের কাছে নিজে থেকে কোনো কিছুর হাদিয়া চাইতে যাবে। কিন্তু কোরবানও যে কেন টাকা-পয়সা চাইল না, তাও তো চিন্তা করার ব্যাপার। কোরবান তো আর তার মতো মনে করে না সৈনিক মানুষ ওরা, সৈনিক হওয়া মানে তো মুসাফিরও হয়ে যাওয়া, খোদার পথে হাঁটতে থাকে তারা – সবদিকে কি তাদের নজর থাকে তখন? পাঞ্জাবিরা নিশ্চয়ই শুধু পাওনা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্যেই আবার ফিরে আসবে এ-স্টেশনে। কিন্তু ভাববার সঙ্গে সঙ্গেই চিন্তাটা সে বাতিল করে – টাকা দিক বা না দিক, ফিরে আসুক বা না আসুক, চানতারা পতাকা উড়িয়ে দিয়ে গেছে – হেলাফেলার ব্যাপার না এইটা। কয়দিন আগেও স্টেশনের এই পাঁচ-সাতটা দোকানের মাথায় লাল আর হলুদ রঙের কী এক অদ্ভুত পতাকা উড়তে দেখা গেছে – এমনকি লুৎফর খলিফার দোকানও বাদ যায়নি সেই পতাকার তাফালিং থেকে। হামিদ কী সুন্দর কাঁচা আম কেটেছিল একদিন, তার সঙ্গে মিশিয়েছিল খানিকটা শুকনো মরিচ গুঁড়ো – কিন্তু কী যে হলো, বিবমিষা নিয়ে ওই পতাকার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খানিক বাদে লুৎফর ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, পুরো থালাই খালি। তারপর আরেকদিন কোরবানের দোকানের ওপর ওড়ানো পতাকাটা দেখতে গিয়ে তার এক ফতুয়ার মাপজোখে ভুল হয়ে গেল। সেই থেকেই নিশ্চিত লুৎফর, কুফায় ধরেছে তাদের – যতদিন না ওইসব পতাকা নামছে এ-স্টেশনের দোকানগুলো থেকে, এই ‘পুরব বাংলার শ্যামলিমা’ থেকে, ততদিন তার কোনো সুখ নেই। কিন্তু ওই পতাকা নামানো তখন অত সোজা না, জোয়ান পোলাপান সব বেহুদাই ঘুরে বেড়ায় আর ‘জয়বাংলা’ ‘জয়বাংলা’ বলে চেঁচামেচি করে বেড়ায় সারাপাড়ায় – জয় মোহামেডানের সঙ্গে কী সুন্দর মিল জয় বাংলার! কিন্তু তারপরও লুৎফর খলিফার ভালো লাগে না – জয় বাংলা শুনলেই তার শরীর কষাতে থাকে।

কিন্তু এখন খানসেনারা এসে গেছে। এখন আর কোনোদিনই পারবে না জয়বাংলার পতাকাটা তুলতে। এই যে কোরবান, ওই যে জহির, আবার ওই মাঠার দোকানের গফুর – বুক ওদের যতই পুড়–ক জয়বাংলার পতাকার জন্যে, চানতারার পতাকাই দৈনিক তুলতে হবে ওদের, খানসেনারা বলে গেছে, আবারো ফিরে আসবে তারা, দেখবে, পতাকা উড়ছে কি-না। আর এসব যে আলাপ হলো, সবই তো তার সঙ্গে। তবে সবুরে মেওয়া ফলে, তাই সে আনন্দ চেপে রাখে আর পালটা প্রশ্ন করে চেষ্টা চালায় কোরবানকে এড়িয়ে যাওয়ার – তোমাক দিছে চা-মালাই-গুড়মুড়ির দাম?

আমাক যে দেয় নাই, সেডো তো তুমি ভালো কইরাই জানোতোমার কতা কও।
বলতে বলতে কোরবান লোকটার মাথায় পানি ঢালে, চুলের মধ্যে বিলি কাটে, গামছা দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিতে থাকে। যেন লুৎফরের উত্তরটা জানার তেমন কোনো দরকার নাই তার, যেন তার ইচ্ছে আসলে উত্তর পাওয়া নয় – খালি একটু খোঁচাখুঁচি করা। কোরবানের এই পুরনো স্বভাব ভালো করেই জানে লুৎফর, অন্য কাউকে ও এরকম করে খোঁচালে লুৎফরের ভালোও লাগে। কিন্তু তার সঙ্গেও কোরবান এরকম করলে মেজাজ খিঁচড়ে যায়। তখন মনে হয়, কোরবান কি টাকার গরম দেখাচ্ছে? বোঝাতে চাচ্ছে, তোমার চেয়ে কম নাকি আমি? লোকটার কী হবে না হবে সেটার জন্যে আর অপেক্ষা না করে সে তাই রওনা হয় নিজের বাড়ির দিকে।

এভাবে লোকটা কোরবানের সঙ্গী হয়ে যায়। খালি লুৎফর না, একে একে সবাই চলে যায় কোন ফাঁকে কী সব অজুহাতে। আর কোরবান দেখতে পায়, হামিদ ছাড়া কেউ নাই আশপাশে। হামিদ আছে, কেননা, ভবতোষের সেলুনের সামনে বাঁশের খোলা মাচাতেই তো শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল লোকটাকে।

জ্ঞান ফিরেছে তার, গাছ থেকে দু-চারটা পাতা তার ওপর ঝরে পড়ছে, একবার একটা পাখিও পায়খানা করে দিয়েছে তার কান ঘেঁষে। হয়তো সে-কথাও বলতে পারে ইচ্ছা হলে, কিন্তু কেন যেন বলছে না সে। এখন লোকটাকে রেখে সে চলে যেতে পারে, যে-লোক কোনো কথাই বলে না মুখ খুলে, তার কি করার আছে সে চলে গেলে? কিন্তু সে তো আর লুৎফর না, এরকম শয়তানের শয়তান হয় দাঁড়িপাল্লার লোক, সে কি আর দাঁড়িপাল্লার লোক নাকি? দাঁড়িপাল্লার লোক কখন কী বলে তার ঠিক আছে নাকি? পাকিস্তানের দরকার নাই বলার পর এরাই তো আবার আগেভাগে চলে এসেছিল এখানে, এখন আবার সেই পাকিস্তানের সঙ্গে জোড়াতালি দিয়ে থাকার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে।

কোরবান তো আর একেবারে অশিক্ষিত নয় যে, এসব বুঝতে পারবে না; বুঝতে পারবে না কেন দিনরাত পাঞ্জাবিদের চড়-লাথি খাওয়ার পরও এসব লোক পাকিস্তানিদের চানতারা পতাকা নিয়েই লাফালাফি করে দুনিয়ায় কিছু মানুষ থাকে, যারা চড়-লাথি ছাড়া কিছু বোঝে না, মানুষকে মানুষের মতো সম্মান দিতে জানে না, তাই আগে মানুষটার ধর্ম খোঁজে। লুৎফর নিজেই তো তাই করল তখন।

লোকটাকে যখন অজ্ঞান অবস্থায় এনে শোয়ানো হলো, তখন আস্তে করে লুঙ্গিটা তুলে কী যেন দেখল। আর কেউ না বুঝুক, কোরবান ঠিকই বুঝেছে, লুৎফর দেখে নিল মুসলমানি করা আছে কিনা লোকটার। মুসলমানি করা না থাকলে এক মগ পানিও ঢালতে দিত না লুৎফর লোকটার মাথায়। কিন্তু সে তো আর লুৎফর নয়, মাচার ওপর শুয়ে থাকা লোকটাকে সে বাড়ি যাওয়ার আগে বলে, এইখানে কোনখানে থাকবেন? আমার সঙ্গে চলেন। লোকটা তখন তার সঙ্গে সঙ্গে আসে। আর একজন মানুষকে বাড়িতে এনে না খাইয়ে তো রাখা যায় না। তাই সে লোকটাকে খেতে দিতেও শুরু করে।

তারপর খাওয়ার পর লোকটা আর কোথায় যাবে! সে ঘরের ডোয়ায় বসে থাকে, গাছের নিচের ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে, বারান্দায় একটা পাটি বিছিয়ে লোকটাকে ডেকে এনে সে সেখানে শুতে বলে। এভাবে অজানা-অচেনা লোকটা তার বাড়ির একজন হয়ে ওঠে।আফরোজার সঙ্গে লোকটাকে কতটুকু মানাবে? রাতে খাওয়ার পর হুঁকা টানতে টানতে চোখ কুঁচকে লোকটাকে দেখতে দেখতে আবারো কোরবান হিসাব কষে। আফরোজা তো আর তার ভাই লুৎফর দর্জির মতো নয়। বিহারিরা পেটাতে পেটাতে আধমরা করে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মেরেছে খায়রুলকে নাহলে আফরোজাকে কি আর দেখা যায় এই গাঁয়ে? দিনাজপুর থেকে ফেরার পথে একবার লালমনিরহাটে গিয়েছিল কোরবান, দেখেছিল ছাপরাঘরের নিকানো ডোয়ায় পোলাকে কোলে নিয়ে বসে আছে আফরোজা। ঘিয়ে রঙের একটি ট্রানজিস্টার থেকে গান শুনছে আর মাথা নাড়ছে। গানের তালে তালে দুলছে তার চুলে গোঁজা ঝুমকোজবা। কোরবানের আর ইচ্ছে করছিল না এগিয়ে যাওয়ার, মনে হচ্ছিল দূর থেকে এভাবেই কিছুক্ষণ আফরোজাকে দেখে সে ফের চলে যাবে। কিন্তু স্টেশনে খায়রুলের সঙ্গে দেখা হয়েছে।

লালশার্ট পরা খায়রুল এগিয়ে এসে তার সঙ্গে কথা বলেছে, বাড়ির রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছে। এত কিছু ঘটার পর বাড়ি পর্যন্ত এসেও সে যদি অন্তত দু-তিন মিনিট না বসেই উলটো হাঁটতে থাকে, ব্যাপারটা তাহলে ভালো দেখায় না। সড়ক-লাগোয়া খায়রুলের ছোট্ট বাড়ি। যাওয়া-আসার পথে বিহারিরা কোনো কারণ ছাড়াই থুথু ফেলছে বাড়ির উঠানকে লক্ষ করে, কেউ আবার লাউয়ের জাংলাটার কাছে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছে। অথচ বাড়িটার সঙ্গেই একটা ফাঁকা ভিটা, ফাঁকা বলেই সেখানে গজিয়ে উঠেছে নানা গাছগাছালি। ওইদিনই তার প্রথম মনে হয়, দু-একজন ভালো থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু বিহারি জাতটা আসলে খুবই খুষ্টা। সে তার ধারণাকে নিজের মধ্যে মাথা ডুবিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করে, কিন্তু সাঁতারজানা মানুষের হাত-পাওয়ালা অবাধ্য ধারণাটা বারবার ভেসে ওঠে আরো বহুদিন। এখন সে জানে, ধারণাটা ভুল ছিল না, যুদ্ধ লাগার আগেই যুদ্ধ বাধিয়ে দিলো বিহারিরা লালমনিরহাটে মারতে মারতে সড়কের ওপর শুইয়ে ফেলল, তারপর কেরোসিন গায়ে ঢেলে পুড়িয়ে মারল খায়রুলকে।

মশালের মতো জ্বলতে জ্বলতে নিভে গেল খায়রুল আর আফরোজা ফিরে এলো তার দর্জি ভাইয়ের ঘরে, যেখানে পানের পিকে ঢেকে গেছে ঘরের ডোয়া, যেখানে উঠোনে ছাগলের নাদ ছড়িয়ে রয়েছে মার্বেলের মতো। বিহারিরা তার বোনের স্বামীকে পিটিয়ে মেরে আগুনে পুড়িয়েছে, দুই পোলা এক মেয়েকে এতিম করে ফেলেছে বিশ্বাস হয় এসব! লুৎফরের হাতের দোনা থেকে খানিকটা দুধ ছলকে পড়ে সবুজ ঘাসের ওপর। যেখান থেকেই আসুক, বিহারিরা মুসলিম – তারা কেন মারতে যাবে তার বোনের স্বামীকে?! মাঝেমধ্যে পায়ে পা লাগিয়ে মারামারি করে বটে বিহারিরা – জানা আছে তার; কিন্তু তাই বলে আস্ত মানুষ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারে? আফরোজা না বলে আর কেউ বললে খবর ছিল, গলা উঁচিয়ে সে ঝগড়াই বাধাত। কিন্তু রক্তের বোন, গলাটা তাই খানিকটা নিচু হয়ে আসে।

ইলেকশনের সময় এখানকার ভোটকেন্দ্রে একটাই মাত্র ভোট পড়েছে দাঁড়িপাল্লায়, সেই ভোট কে দিয়েছে সবাই জানে, সবাই তাকে সেই থেকে জব্দ করার নানা বাহানা খোঁজে, এখন তারই সংসারে এই ঘটনা! দু-তিন দিন মুখ আর তুলতে পারে না সে। তারপর থেকে আফরোজা এই গ্রামেই আছে, লুৎফরের বাড়িতেই আছে। চোখদুটো কটকটালেও লুৎফরের কোনো উপায় নেই। বাপের সম্পত্তি এখনো ভাগ হয়নি, আফরোজার সঙ্গেও বোঝাপড়া শেষ হয়নি। সে তাই ওপরে-ওপরে চেপে গিয়েছিল আর তার যত রাগ গিয়ে পড়েছিল অন্যখানে। চার ভাগের এক ভাগ হোক, আর একশ ভাগের এক ভাগ হোক, হাজার ভাগের এক ভাগ হোককী দরকার মেয়েমানুষকে জায়গাজমি দেওয়ার নিয়ম করার? তারা কি হাল-আবাদ করে, না ব্যবসা-বাণিজ্য করে? পুরুষ ছাড়া এসব কাজ কেউ করতে পারে! এ-ব্যাপারে হিন্দুরা অনেক ভালো হঠাৎ করে মনে হয় তার – একফোঁটা জায়গাজমিও দেয় না মেয়েমানুষদের। পুরুষমানুষ থাকতে মেয়েমানুষকে জায়গাজমি দেওয়ার কী দরকার? হিন্দুদের নিয়মকানুনের কাছে হেরে যাওয়ার গুপ্ত লজ্জা নিয়ে মাথার টুপিটা বারবার ভাঁজ করে আর খোলে লুৎফর। তিন-তিনটা বাচ্চাকাচ্চা, সঙ্গে আফরোজা নিজে, বয়স আবার তার ত্রিশের মতো সব মিলিয়ে ভালো থাকার তো কোনো রাস্তাই নেই লুৎফরের। এরকম পরিস্থিতিতে নিজের বোনকে না করা যায় হ্যাঁ, না করা যায় না। আকারে-ইঙ্গিতে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে সে, বিপদের সময় এরকম অনেকেই অনেকের বাড়িতে আশ্রয়-টাশ্রয় নেয়; কিন্তু থাকে আর কয়দিন, তারপর আবার ঠিক-ঠিকই চলে যায়। আর সবচেয়ে বড় কথা, চলে যাওয়াই তো উচিত। মরে গেছে বলে খায়রুল তো আর তার বাপের বাড়ি কব্বরে নিয়ে যায় নাই। আফরোজার কি উচিত নয় তার স্বামীর ভিটায় গিয়ে থাকা? চার-পাঁচ মাস পার হয়ে গেছে, কবরের কাঁচামাটিও তো শুকিয়ে গেছে – আফরোজার তো উচিত শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করা। সে-রাস্তায় না গিয়ে আফরোজা কিনা উঠল তারই সংসারে!
এটা অবশ্য গাঁয়ের লোকজন ঠিকই বলে, আফরোজা আসায় তার বাড়ির চেহারা খুলে গেছে, বাড়িটা নড়েচড়ে বসেছে – লুৎফরের বউ তো দুনিয়ার ম্লেচ্ছ, ঘরদোর ঠিকমতো লেপে না এসব ব্যাপারে হিন্দু মেয়েদের তুলনাই হয় না, সাতসকালে উঠে উঠান-ঘর সব ঝাড়– দিয়ে মাটি লেপে এটুকু ভেবে লুৎফর আবারো অপ্রস্তুত হয়, যারা মূর্তিপূজা করে তারা পরিষ্কার থাকলেই কি আর নোংরা থাকলেই কি! তবু তার চোখের সামনে ছেলেপেলের নোংরা কাপড়-চোপড় দুলতে থাকে। কোনোদিন এসব ঠিকমতো পরিষ্কার করে না আনিসা, আধাধোয়া অবস্থাতেই গুঁজে রাখে মাচার এক কোণে, না-হয় ঘরের বেড়ার বাতার সঙ্গে। দিনের পর দিন ওইভাবে সেগুলো ঝুলে থাকে, পড়ে থাকে – দেখে লুৎফরের বমি এসে যায়। বারবার তওবা পড়ে। কিন্তু আনিসা নির্বিকার, পোলাপানগুলোও নির্বিকার। অথচ দুনিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন মানুষের সূক্ষ্ম গর্ব দেখিয়ে আনিসা হেঁটে বেড়ায় তার সামনে দিয়ে। আফরোজা আসার পর থেকে এসব পালটে গেছে। একটু একটু করে বোধহয় আফরোজাও পালটাচ্ছে, শোক তার শুকিয়ে যাচ্ছে, দুঃখ তার কমে আসছে, পোলাপানদের জড়িয়ে ধরে সে কাঁদে না আর আগের মতো। আবারও বিয়ে করার ইচ্ছাই হয়তো জেগে উঠছে আফরোজার মধ্যে – আর ত্রিশের মতো বয়স – আরেকটা বিয়ে করায় তো কোনো দোষও দেখে না সে। নাকি শুধু লুৎফরই বোঝেনি – স্বামী হারানোর সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা বিয়ের চিন্তা ঢুকেছিল আফরোজার মাথায়? তাই তার মন নাই স্বামীর বাপের বাড়ির দিকে! মন থাকলে কি আর কোনো মেয়ে তিন সন্তান নিয়ে স্বামীর বাড়িতে গিয়ে না উঠে বাপের বাড়িতে চলে আসে! বাড়িতে আসার তিনদিন যায়নি – গোয়ালঘরটাও এখন এত বেশি পরিষ্কার যে, মেঝের ওপর শুয়ে পড়া যায়। পাশের বাড়িতে থাকলেও সবকিছু টের পায় কোরবান – আফরোজা আসার পর থেকেই আনিসা একটু একটু করে নবাবের বিটি হয়ে উঠছে। পারতপক্ষে যায় না রান্নাঘরে, লুৎফর থাকলে কথা বলে নিচু স্বরে, কিন্তু লুৎফর বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্টেশনে গিয়ে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই খবরদারি করে পুরো বাড়ি মাথায় তোলে আনিসা। এরকম চেঁচামেচি তো আর স্বামীর সামনে করা যায় না, এসব ব্যাপারে লুৎফর পুরো ধার্মিক, বউকে নোংরা কাপড়ে দেখে কোনোকিছু না বললেও গলা উঁচিয়ে কথা বলা দেখলে পিটিয়ে তক্তা বানায়। এটুকু বাদে লুৎফরের আর কোনো ঝামেলা আছে বলে আনিসার মনে হয় না। আর একেবারে খারাপ তো রাঁধে না আনিসা যার জন্যে তাকে মাঝেমধ্যে কিলচড়ের ওপর রাখতে হবে। তবে সে তো আর কোরবান নয় যে, খেতে ভালো লাগলেই প্রশংসা করে বউকে মাথায় তুলবে, আবার খেতে ভালো না লাগলেও আস্তে আস্তে হেসে হেসে বলবে, বউয়ের মনে হয় আইজ তাড়া আছিল? কোনো মানে হয় এসবের! তবে এটা ঠিক, বোনের হাতের রান্নায় মায়ের হাতের স্বাদ পাওয়ার ঝিমধরা নেশায় লুৎফরের চোখ এখন প্রতিদিনই বুজে আসে। কেবল আফরোজা কানের কাছে ট্রানজিস্টার লাগিয়ে আছে দেখলেই তার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। জামাইকে কবরে শুইয়ে চলে এসেছে, কিন্তু জামাইয়ের দেওয়া রেডিওটা নিয়ে আসতে একদম ভোলে নাই সময় পেলেই বসে পড়ে সেটা কানের কাছে চেপে ধরে আফরোজা। এমনকি লোকটা ধারেকাছে কোথাও আছে বোঝার পরও সে তাতে ভ্রুক্ষেপ করে না।
আর লোকটাও একটা লোকই বটে, মাসখানেক ধরে পড়ে আছে এই গ্রামে – কোনো বিকার নেই। তার কোনো অতীত নেই, ভবিষ্যতের জন্যে তার কোনো চিন্তাও নেই। নতুন একটা নামও দিতে হয়েছে তাকে। সেই নামে সে সাড়া দিতেও শিখেছে। যেন তার নাম যুগ-যুগান্তর ধরে এটাই ছিল, এই নামেই তার প্রাণ পাখি হয়ে যায়। আর পৃথিবীর প্রতিটি পশুপাখি যেমন তাদের রক্তে তুলে নিয়েছে জীবনযাপনের যাবতীয় প্রবণতা, সেও তেমনি তার রক্তের স্রোতে ধরে রেখেছে জীবনযাপন ও চাষাবাদের অভিজ্ঞতা। প্রতি বুধবার সে হাটে যাচ্ছে, কোরবানের জন্যে বাজারঘাট করে আনছে আর গরুগুলোরও দেখভাল করছে। আফরোজার বাচ্চাকাচ্চাগুলোকে বগলদাবা করে হা-হা করে হাসাহাসি করছে, খালের পানিতে তাদের সাঁতার শেখাচ্ছে। বয়স্কদের সামনে সে আনত ভীষণ, তার যত সখ্য শিশুদের সঙ্গে। লুৎফর দর্জি কিংবা কোরবান কেউই এখনো হাল ছাড়েনি, সুযোগ পেলেই তার কাছে জানতে চাইছে, বাড়ি কোনে তোমার? কিন্তু প্রশ্ন শুনে লোকটা বোকা-বোকা হয়ে পড়ছে। এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে, যেন উত্তরটা আশপাশে কোনোখানে পড়ে আছে। তবে কথাবার্তা তেমন না বললেও মাঝেমধ্যে লোকটা ঘুমের ঘোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে, মাইরেন না, মাইরেন না, আমিও মুসলমান…। দু-চারবার আফরোজার সামনেও পড়ে গেছে লোকটা – আর না পড়ে উপায় আছে? আকাশে চিল দেখার উত্তেজনা ও ভীতি নিয়ে আফরোজা চোখে চোখে রাখে তার ছেলেমেয়েদের। পয়লা পয়লা সে রাগী-রাগী চোখে তাকিয়ে দেখত, লোকটা তার ছেলেমেয়েকে বগলদাবা করে কীভাবে হাসাহাসি করছে। এখন তার চোখে আর সেই রাগ-রাগ ভাব নাই। তার বদলে খানিকটা সংশয়, দ্বিধা আর ভাবালুতা।
প্রথম প্রথম কোরবানের দোকানে লোকটাকে দেখার জন্যে কেউ কেউ আসত। বাতাসের আগে আগে ছুটছে এই গাঁয়ে আলাভোলা এক লোকের আসার খবর – খানসেনাদের আসার সংবাদও সে ম্লান করে দিয়েছে। নইলে কতভাবেই তো এই কয়দিন খানসেনাদের আসার কথা তুলেছে লুৎফর, কিন্তু তার সেসব কথা যেন কারও মৃত্যুর হাহাকার, যে হাহাকারের কোনো মা-বাবা নেই, কোনো সান্ত্বনা নই, কেবল চুপচাপ শুনে যাওয়ার মধ্যে দিয়েই যার দায় শেষ হয়ে যায়। স্টেশন এখনো ফাঁকা আগের মতোই। গরমের সময় বলে গফুরের মাঠার দোকানে তাও দু-চারজন এসে বসে, কোরবানের দোকানের অবস্থাও খারাপ নয় একেবারে – দুপুরে না হোক, সকাল-বিকাল লোকজন তার মিক্সচার খেতে আসে, এটা-সেটা কেনে – তাছাড়া জয়বাংলার লোকজন তো ওই দোকানেই সারাদিন ফুসুরফাসুর করে; কিন্তু লুৎফর বলা যায় পুরোপুরি বেকার – খানসেনারা আসার পর পতাকা বানানোর ব্যস্ততাই ছিল তার শেষ কাজ। সারাদিন উসখুস করে লুৎফর – লোকজন কি লুঙ্গি কেনাও বাদ দিয়েছে নাকি? লুঙ্গি সেলাইয়ের জন্যেও তো আর কেউ আসে না! স্টেশনঘরের মাথায় লাগানো পাকিস্তানের পতাকাটা উপহাসের স্রোতে দুলতে থাকে আর লুৎফরের ভালো লাগে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে। কোনো কোনো দিন, যেমন আজকের এই সন্ধ্যাতেও গলা চড়িয়ে কোরবানের উদ্দেশে না বলে থাকতে পারে না সে, কী রে কোরবান? তগারে জয়বাংলার খবরটবর কী?

বলে লুৎফর কুটকুট করে হাসে – করুণা আর ঘৃণার মিশেলে তৈরি করা হাসিটিতে বিধর্মী কাফেরের লাশপচা উল্লাস; সে-হাসি পেরিয়ে আসতে একগাদা থুথু জমে ওঠে কোরবানের গলার ভেতর, আর তার দোকানের সামনে বসে থাকা লোকটাও ঘন-ঘন রুক্ষতা ছুড়তে থাকে লুৎফরের দিকে মেলে ধরা চাউনি থেকে। সন্ধ্যা নেমেছে বটে, আর সামনে আষাঢ় মাসও আসি-আসি করছে, তবু সারাদিনে জমে ওঠা তাপ নিস্তব্ধে উঠে আসছে জ্যৈষ্ঠের সন্ধ্যার অন্ধকারের গভীর সখ্যে হারিয়ে যেতে। লুৎফরের চারপাশে যেন সেই তাপ নেই, কোরবানের নীরবতাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে সে, হাসছে কুটকুটিয়ে। আহ্, বাতাস পেলে সব পতাকাই দোলে, তা সে চানতারারই হোক আর জয়বাংলারই হোক। বাতাস পেয়েছিল, তাই জয়বাংলার জয়জয়া-কার ছিল কয়দিন। সারা প্লাটফর্মের লোকজন তার দোকানে এসে ভিড় জমিয়েছিল জয়বাংলার পতাকা বানিয়ে নিতে। প্রথমে সে তিন-চারগুণ দাম চেয়েছিল, ভেবেছিল বেশি দাম চাইলেই ফকিরের বাচ্চাগুলো চলে যাবে; কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় সরাসরি না করে দিয়েছিল লুৎফর। কোরবান তখন তার দুমড়ানো-মোচড়ানো বুকটা টান করতে করতে চড়া গলায় শাসিয়েছিল তাকে, ক্যান, বানাবি না ক্যান?
আমার ইচ্ছা। তর কাছে কৈফিয়ত দ্যাওয়া লাইগবো?
বলে নিজের ইমানের জোরে নিজেই বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল লুৎফর। খানিক আগেই কলেজের ছেলেরা ঘুরে গেছে স্টেশন থেকে, স্টেশনঘরের ওপর উড়িয়ে দিয়েছে জয়বাংলার পতাকা, সবুজের বুকে টকটকে লাল, তাকালেই লুৎফরের মনে হচ্ছে, কেউ তার বুকের মধ্যে হারান কামারের বানানো ফালা মেরেছে, ফিনিক দিয়ে রক্ত উঠছে তার বুকের ভেতর থেকে। জয়বাংলার পতাকা তুলতে তুলতে ছেলেগুলো সবাইকে বলে গেছে, ঘরে ঘরে দোকানে দোকানে জয়বাংলার পতাকা বানিয়ে ঝুলিয়ে দিতে। আর শালা বাঙালির চরিত্রের ঠিক আছে না কি? দুলাভাই বলেছে *** ভাই, আনন্দের আর সীমা নাই…*** ভাইরা সব পতাকা বানানোর জন্যে ভিড় করেছে তার দোকানের সামনে – তাদের চোখের চাউনিতে জ্বলজ্বল করছে ভোটের দিনের স্মৃতি, এখানকার ভোটকেন্দ্রে একটা মাত্র ভোট বাদে সব ভোট পড়েছিল নৌকার বাক্সে, দাঁড়িপাল্লার বাক্সে ওই একটা ভোট কে ফেলেছে তা বুঝতে কারো দেরি হয়নি। তার মানে তার বউও দাঁড়িপাল্লায় ভোট দেয়নি, এ-কথা যতবারই মনে হয় ততবার সে মনের মধ্যে জমিয়ে রাখে এবং রাতে বউকে নিক বা না নিক, হাত দিয়ে শক্ত করে মুখটা চেপে ধরে তার স্তনে সে কামড় বসাতে থাকে। ‘বউ তুই আমারে আর ভোট দিস না দাঁড়িপাল্লায়?’ আনিসা ছটফটাতে থাকে আর লুৎফর পা দিয়ে আনিসার পা দুটোকেও সাপের মতো পেঁচিয়ে রাখে, যাতে সে না পারে বলক দিয়ে উঠতে। আনিসার ওপর এভাবে শোধ নিতে পারে সে, কিন্তু আফরোজার ওপর শোধ নেয় কী করে? আশপাশের সাতগাঁয়ের ছাগলগুলোও জানে, বিহারিরা আফরোজার স্বামীকে মেরে ফেলেছে। তারপরও বিকার নেই লুৎফর খলিফার – ঝড় উঠলে দুই-চারটা ভালো গাছও পড়ে যায়, তাই বলে তো ঝড়কে সে দোষ দিতে পারে না। অতএব সে লোকজনের গালিগালাজ শুনেছে; কিন্তু জয়বাংলার একটা পতাকাও বানায়নি তার সেলাই মেশিন দিয়ে। নিজের ইমানে লুৎফর আবারো সন্তুষ্ট হয় – কোরবানের মতো তার ইমান তো অত পাতলা নয় যে সকালে এক পতাকা ওড়াবে, বিকেলে আবার সেটা নামিয়ে রাখবে। এখন, আজকের এই সন্ধ্যায়, তার ভালো লাগে একটু-আধটু উর্দু জানা আছে বলে। যদিও দর্জি দোকানে কোনো কাজ নেই, সকালে রোদহীন গুমোট বাতাস মুখভার করে রাখে আর দুপুরে জ্যৈষ্ঠের কাঁঠালপাকানো রোদ গলে গলে পড়ে গাছের পাতার ফাঁক গলিয়ে টিনের চালে। তার দোকানে তাও বাঁশের সিলিং আছে, শালার কোরবানের দোকানে তাও তো নেই। এভাবে আবারও সে কোরবানের সঙ্গে নিজের তুলনা করে। তুলনায় কোরবান হেরে গেলে আরাম লাগে। এই আরাম কেবল আজকের না, গতকালের না, গত দিনচারেকেরও না – ছোটবেলারও। এ-ঘাট ও-ঘাট ঘুরে জোড়াতালি দিলে কোরবান তার আত্মীয়ই লাগে, চাচাতো ভাইয়ের মতোই লাগে; কিন্তু পুরোপুরি কখনই মেলে না। আফরোজার সঙ্গে তো কোরবানেরও বিয়ে হতে পারত, কোরবান তো এককালে সারাদিন তাদের বাড়িতেই পড়ে থাকত। বোঝাও যেত, আধাআধি-সাধাসাধি করলেই বিয়ে করে বসবে সে আফরোজাকে। কিন্তু বিয়ে মানে তো খালি ভালো পাত্র জোটানো না – বাড়ির সঙ্গে বাড়ি – চোখের সামনে আফরোজা সারাদিন ট্রানজিস্টার শুনছে, গানের সঙ্গে গলা মেলানোর চেষ্টা করছে, এইটা তার সহ্য হতো না। তার চেয়ে বড় কথা হলো, গাঁয়ের মধ্যে বিয়ে দিয়ে জায়গাজমির ভাগাভাগি নিয়ে দিনরাত দৌড়াদৌড়ি করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না লুৎফরের। ট্রানজিস্টার শোনে – হ্যাঁ, সেটাও একটা ঘটনা অবশ্য, কোরবান তো তেমন পোলা না যে পিঠের ওপর দু-চার ঘা বসিয়ে আফরোজার মনটা নামাজ-কালামে ফিরিয়ে আনবে। তা না করে সে পালটা উস্কানি দেবে, হাত ছড়িয়ে ভাব দেখিয়ে বলবে আফরোজাকে, ‘কুছ আপনি কহিয়ে, কুছ মেরি শুনিয়ে…’। দূরে বিয়ে দিয়েও অবশ্য তাই হয়েছে, কিন্তু লুৎফরকে তো আর তা দিনরাত দেখতে হয় নাই। পুরুষমানুষ গানবাজনা শোনে, সেটা তাও মেনে নেওয়া যায় – পুরুষমানুষ তো আর ঘরে থাকে না, পুুরুষমানুষকে ১৪ জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করে বেড়াতে হয়, ১৪ রকম জায়গায় ৫১ রকম কাজকারবারে তার মনমেজাজও ৫৩-৫৪ রকম থাকে। মেয়েমানুষের নাচগান দেখলে আর চ্যাংড়া পোলাপানকে দিয়ে গা-হাত-পা খানিকটা টিপিয়ে নিতে পারলে তাদের ‘ইতস্তত বিক্ষিপ্ত’ মনটা শান্ত হয়। কিন্তু মেয়েমানুষ তো ঘরে থাকে, তাদের কী দরকার ওইসব গানবাজনা শোনার? পুরনো যুক্তি বারবার ঝালিয়ে নেয় লুৎফর, ঝালিয়ে নিতে ভালো লাগে; বিশেষ করে যাত্রার প্যান্ডেলে গিয়ে মাইকে শোনা ‘আপনারা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ঘোরাফেরা না করে মঞ্চের সামনে বসে পড়–ন’ বাক্য থেকে নেওয়া ‘ইতস্তত বিক্ষিপ্ত’ শব্দদুটি তার মনে ঈষদকালের আতর ছড়িয়ে দেয়। তবু তাকে আফরোজার চিন্তা অস্থির করে তোলে – ইবলিশই কি বলবে সে আফরোজাকে? মনে হয়, আফরোজা তার ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে মশকরা করছে, ভাইজান গো, হেই জইন্যেই তো গানবাজনা শুনি, আপনেরা ১৪ রকম জায়গায় যাইবেন, ৫১ পদের কাজকাম কইরবেন আর গায়ে-মুহে ৫৩-৫৪ জাতের গু-মোত লাগাইয়া শরীরমন নষ্ট কইরা ঘরে আইসবেন – তহন গানাবাজনা না কইলি কি আপনেগারে ভালো লাইগবো? অশরীরী সেই কথায় লুৎফর সজোরে ঘাড় সরায়, লাফিয়ে উঠতে উঠতে বলে – সর, হারামজাদি, সর, খালি ত্যাড়ছা কথা কস! কিন্তু ধারেকাছে আফরোজা নেই, দর্জি দোকান খাঁ খাঁ করছে দেখে তার স্বস্তি লাগে। শুধু আবুল কালাম দোকানের মাচায় বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চুলার দিকে।
আবুল কালাম – এভাবে খারাপ বাতাস লাগা লুৎফরের মনে লোকটির জন্যে একটি নাম গুনগুনিয়ে করে ওঠে। লোকটাকে তো এ-নামেই ডাকা যেতে পারে – নামের মধ্যে খোদার বরকতও আছে, হিন্দু-হিন্দু কোনো ঘ্রাণ নাই। আবুল কালামের কোনো পিছটান নাই, অনায়াসে একটা ষাঁড় মাথায় তুলে ঘূর্ণি দিতে পারে আর তা দেখে চিৎকার করে আনন্দে মেতে উঠতে পারে আফরোজার বাচ্চাকাচ্চাগুলো। এই লোকটার সঙ্গে না মানালে আর কার সঙ্গে ভালো মানাবে আফরোজাকে? তাছাড়া মনে হয়, এরকম একটা সব ভোলা লোকের সঙ্গে বিয়ে দিতে পারলে আফরোজার বড় একটা শান্তিও হবে; ট্রানজিস্টার শুনে খুশি-খুশি মনে আফরোজা ঘুমাতে যাবে, তারপর মাঝরাতে আবুল কালামের ‘মাইরেন না, মাইরেন না, আমিও মুসলমান’ চিৎকারে আবার জেগে উঠবে। কিন্তু কোরবান হারামজাদার ভাবচক্কর বোঝা খুব দায় – এখনো নাকি কিছুই বলে নাই না আফরোজাকে, না আবুল কালামকে। তবে কোরবান না বলুক, আফরোজা নিশ্চয়ই আড়েঠাড়ে শুনেছে কিছু। অথবা আনিসাই কি আফরোজাকে কিছু একটা বলেছে লুৎফরের ভাবসাব বুঝতে পেরে! সকালে বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে আজ লুৎফরের সেরকমই মনে হয়েছে; আফরোজার গলাই সে শুনতে পেয়েছে আজ। আফরোজা বলছে, এই রহম দামড়া জুয়ান পোলা, সব কিছু ভুইলা বইসা আছে –
আফরোজার মনে হয় খুবই দরদ লাগে। পুলকিত হয় লুৎফর। যত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া যায়, ততই ভালো – বাড়ির খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিতে হয়, তাতেও সই; আবারও লুৎফরের খারাপ লাগে – এদিক থেকে হিন্দু ধর্ম অনেক ভালো, মেয়েমানুষকে কোনো জায়গাজমি দেওয়ার বালাই নাই। অথচ তাদের জায়গাজমি ধরে রাখতে গেলে কত কায়দাকানুন করতে হয়, আদায় করতে গেলেও কত ঝামেলা পোহাতে হয়। ১১ বছর ধরে মাসে ৯-১০ বার বউ পিটিয়েও লুৎফর তো এখনও পারল না শ্বশুরবাড়ি থেকে জায়গাজমি বের করতে। আর আফরোজার জামাই চাইতেই পেয়ে যাবে? অতই সোজা? কোনোমতে বিয়ে দিতে পারলে বাঁচে লুৎফর – পরের দিনই বোনকে বের করে দেবে সে, তাতে তার ঘরদোর পরিষ্কার থাকুক বা না থাকুক, খাওয়ার সময় বউয়ের রান্না মায়ের মতো লাগুক বা না লাগুক। আর আফরোজার গলা থেকে যত দরদ উথলে উঠছে, তখন মনে হয় না খুব বেশি সময় লাগবে লোকটার সঙ্গে বিয়ে দিতে। সে কান খাড়া করে হাঁটার গতি শ্লথ করেছিল আরো কথা শোনার আশায়। আর শুনেছিল, আফরোজা আরো মায়াধরা কণ্ঠে বলছে, খানসেনাগারে খুনজখমে আতকা লাইগছে, তাই না ভাবি?
লুৎফরের মনে হয়, খারাপ বাতাস তার শরীর থেকে একেবারেই উড়ে গেছে – দ্রুত শরীর ঘুরিয়ে দাঁড়াতে পারছে সে, কোনোখানে কোনো জড়তা নেই – বিদ্যুৎগতিতে তার পৌঁছাতে ইচ্ছা করে চুলার ধারে, যেখানে তার বউ একটা টুলের ওপর বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস খাচ্ছে আর আফরোজা তার সামনে বসে বসে বটিতে ট্যাংরা মাছ কাটছে। ইচ্ছা করে বাঁ-হাতে আফরোজাকে চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে ডান হাত দিয়ে একনাগাড়ে থাপড়াতে থাপড়াতে গালিগালাজ করতে, খানসেনাগারে খুনজখম? হারামজাদি! দু-চারটা শয়তানের বাচ্চাক আল্লার ইচ্ছায় দুনিয়া থাইকা বিদায় কইরা দিছে, আর তুই কস খুন-জখম না? যা, আমার চোক্ষের সামনে থেকে দূর হইয়া যা –
এরকমই ইচ্ছা করে লুৎফরের সকাল-সকাল। কিন্তু সে কিছু না বলে হনহনিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে – ধৈর্য, ধৈর্য ধরতে হবে তাকে, এত উত্তেজিত হওয়ার কোনো মানে হয় না। কিন্তু তবু ভেতরে ভেতরে সে উত্তেজনা অনুভব করতে থাকে। তারপর অনেক কষ্টে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের দর্জি দোকানে আসতে আসতে নিজেকে শান্ত করে। কথা হলো, বাপের বাড়ি ঝিয়ে নষ্ট – আফরোজাকে তাড়াতাড়ি বিদায় করা দরকার। তাছাড়া, হোক বোন, সারাদিন শত্র“-শত্র“ মনে হয় তার আফরোজাকে, এতকিছু দেখেশুনে বিয়ে দেওয়া হলো, কিন্তু আল্লায় কী দিয়ে যে কী করল, কেন যে আফরোজার জামাই ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিতে গেল, তা তার মাথাতেই ঢোকে না। জয়বাংলার মানুষ দেখলেই তাদের কলজে তুলে নেওয়ার ইচ্ছা করে লুৎফরের; কিন্তু আশপাশ তো জয়বাংলায় ভরা, কয়জনের কলজে সে আর তুলতে পারে! তাও ভালো, খানসেনারা এসেছে, দৌড়ের ওপর রেখেছে, দু-চারটা মারছে – ভালোই তো করছে। লুৎফর তো খারাপ কিছু দেখে না এতে। এখানে অবশ্য কাউকে একেবারে মারে নাই – সেটাও একদিক থেকে ভালোই হবে, শান্তিকমিটি করা সহজ হবে। আরো একবার যদি খানসেনারা আসে, একদিন যদি আবার নামে ট্রেন থামিয়ে, তাহলেই এখানে কমিটি করা পানির মতো সহজ হয়ে যায়। তবে তার আগেই আফরোজাকে বিয়ে দেওয়া দরকার, আবারোও চিন্তাটা তার সামনে ইলিশপোকার মতো কামড়াকামড়ি করে – লালমনিরহাটে বিহারিরা খায়রুলকে মেরে ফেলায় সে বেকায়দায় রয়েছে, এর ওপর এখানে ক্যাম্প করার পর কোনো খানসেনা যদি আফরোজাকে মুতা বিয়ে করতে চায়, তাহলে তার ইজ্জত তো একেবারেই ফুটো হয়ে যাবে!
এসব নানা চিন্তা লুৎফরের ভেতর ক্লান্তি নামায়, ক্রোধও নামায়। সে তাড়াতাড়ি ঝাঁপ ফেলে দোকানের। আর তাকে ঝাঁপ ফেলতে দেখে কোরবানও দোকানের ঝাঁপ ফেলে। পাশাপাশি বাড়ি, সন্ধ্যার পর তারা তাই একসঙ্গেই বাড়ি ফেরে। যেতে যেতে ঝিঁঝির ডাক শোনে আর কখনো পায়ের ওপর দিয়ে দ্রুত বনবেড়াল অথবা খরগোশ চলে গেলে ভয়ে লাফিয়ে ওঠে। ঘাসে ঢাকা আলপথ পাড়ি দিতে দিতে লুৎফর খানিকক্ষণ উসখুস করে। তারপর শেষমেশ বলেই ফেলে, কী মিয়া, আলাপ কইরছো তুমি?
আলাপ? – যেন লুৎফরের কথা বুঝতেই পারেনি কোরবান। লুৎফরের শরীর রাগে খরখরায় আর কোরবানও যেন তা বুঝতে পারে, তাই সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে – ও, ওই ব্যাপার? করমু ধীরেসুস্থে। এত তাড়াতাড়ির কী আছে? যাইব কোনখানে?
বলতে বলতে কোরবান হিসাব করে, আরো কয়দিন এই আলাপ ঠেকিয়ে রাখতে হবে, আরো কয়দিন আলাপ না-করার অজুহাত দাঁড় করাতে হবে। হিসাব করে সে, হাতে আরো কয়দিন আছে যেদিন সকালে উঠে গ্রামের লোকজন দেখবে, লোকটা উধাও হয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে। তার সঙ্গে উধাও হয়েছে গাঁয়ের আরো সব যুবক পোলাপান। এখান থেকে বগুড়া পর্যন্ত তাদের পৌঁছে দেবে কাজল মাঝি, বগুড়া থেকে বর্ডারে তাদের পৌঁছে দেবে মমতাজ মাস্টার। বেতিল, বেলকুচি মিলিয়ে ২৫ জনের একটা দল নিয়ে গত সপ্তাহে রওনা হয়েছে কাজল মাঝি – সে ফিরে এলেই এ-দফায় পাঠাতে হবে লোকটার সঙ্গে এ-গ্রামের সব জয়বাংলার পোলাপানদের। খানসেনারা এসে স্টেশনটাতে ক্যাম্প করার আগেই এ-কাজ করতে হবে তাকে। আর কেউ না জানুক, কোরবান তো জানে, সবকিছুই মনে আছে লোকটার। জানা আছে, কীভাবে তার ঘর পুড়েছে, কীভাবে সেই ঘরের সঙ্গে পক্ষাঘাত হয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে থাকা তার মা পুড়ে পুড়ে মরেছে, বউ ধর্ষিত হয়েছে, ধর্ষণের পর কাতরাতে কাতরাতে মরেও গেছে।
নিজের আত্মাটা নিজের হাতের তালুতে তুলে সেখানে মিশে থাকা লেবুপাতার ঘ্রাণে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে করতে লোকটাকে নিয়ে কোরবান হাঁটতে থাকে লুৎফর খলিফার সঙ্গে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত