বাসে উঠতেই আমার সিট খুঁজতে লাগলাম।পিছনের থেকে দু নাম্বার সিট টা আমার।সিটের কাছে যেতেই চমকে গেলাম।কেনোনা সেখানে আমার প্রাক্তন বসা।কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছে।চোখ বন্ধ করে আনমনে গুনগুন করছে। দীর্ঘ ৪ টে বছর পর তাকে দেখে ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে তা নিজেও বুঝে উঠতে পারছিনা।আমি শুকনো একটা কাশি দিলাম।কিন্তু না সে আমার দিকে তাকাচ্ছে না।সে তো তার জগতেই ব্যাস্ত। তাকে দেখে আবার সেই অভিমান গুলো জেগে উঠলো। তার পাশে বসতেও খুব অস্বস্তি লাগছে। তবুও কিছু করার নেই বসতে তো হবেই। তার পাশে বসতেই সে নড়েচড়ে উঠলো।আশ্চর্যের ব্যাপার সে আমার দিকে তাকিয়ে একটুও চমকালো না।কেমন যেনো শীতল চোখ। তার মনে কোনো অনুভুতি আদৌ আছে নাকি দেখে আমার সন্দেহ হচ্ছে।
সে আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার কানে হেডফোন গুজলো।এবার আর চোখ বন্ধ করলোনা।জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলো।আনমনে কি যেনো দেখছে।খুব অদ্ভুত লাগছে তাকে। কেমন যেনো ছন্নছাড়া।
আমাকে এমন ইগ্নোর করা আমার একদম ভালোলাগছে না।কেমন দেখেও না দেখার ভান করছে।আমি আর না পেরে তাকে ডেকে উঠলাম। “রূপ” এবার সে চমকে উঠলো।উঠে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। “রূপ বলার অধিকার তুমি অনেক আগেই হাড়িয়েছো।এই নামটা ডাকার অধিকার তোমার আর নেই।” রূপের কথা শুনে ক্ষানিকটা কষ্ট পেলাম।রূপের কথা গুলো যেনো বুকে তীরের মতো বিধলো।
“কেমন আছো তুমি?”
“যেমনটা তুমি দেখছো।” রূপ বললো।
তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে আমার সাথে কথা বলতে সে মোটেও আগ্রহি না।কিন্তু আমি যে তার সাথে কথা না বলে থাকতে পারছিনা।এমনটা কেন হচ্ছে আমার সাথে বুঝতে পারছিনা।তবুও আমি নিজেকে সামলে নিলাম।ব্যাগ থেকে হেডফোন বের করে গান শুনতে লাগলাম। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো সেই পুরনো স্মৃতি গুলো। আমি আর রূপ চিটাগং পাশাপাশি বিল্ডিংয়ে থাকতাম।আমরা সমবয়সী হওয়ায় বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিলো।একই স্কুলে পড়তাম।আমাদের পরিবারের মাঝেও বন্ডিং খুব ভালো ছিলো।খুব ভালো চলছিলো সব।
যখন আমরা ক্লাস ১০ এ উঠি।তখন হঠাৎ করেই কেমন যেনো অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতো ওর প্রতি।একদিন কিছু না বুঝেই ওকে প্রপোজ করে বসি। খুব ভালো চলতে থাকে আমাদের প্রেম।বাচ্চাকালের প্রেম বলে কথা।
এভাবেই কলেজও পার হয়।একজন আরেকজনকে ছাড়া যেনো চলতোই না। তারপর আসে ভার্সিটি সময়।আমি ঢাকাতে চান্স পাই।আর ও চিটাগাং। মেয়ে বলে ওর বাবা মা ওকে কাছ ছাড়া করবে না। আমি ঢাকায় চান্স পাই বিধায় আব্বুও জব ঢাকায় ট্রান্সফার করে নেয়।ফুল ফ্যামিলি ঢাকায় শিফট হয়ে যাই। যেদিন আসবো সে কি কান্না রূপের।পুরো পাঁচ ঘন্টা সে আমাকে ধরে কেঁদেছিলো।এখনো পরে সেই দিনটার কথা।পাগলিটাকে কিভাবে যে সামলিয়েছিলাম। শুনেছিলাম চোখের আড়াল হলে নাকি মনের আড়াল। কিন্তু তখন তা বিশ্বাস করিনি।প্রথম এক বছর খুব ভালোই যায়।আমি প্রতি মাসে একবার করে রুপের সাথে যেয়ে দেখা করে আসতাম।কিন্তু প্রথম বছর যখন শেষ হয় তারপর থেকেই আমার মধ্যে কেমন যেনো একটা পরিবর্তন আসে।
রূপকে ধীরে ধীরে খুব বিরক্ত লাগতে শুরু হয়।ওর ফোন দেওয়া ওর এতো কেয়ার কেমন যেনো ন্যাকামি লাগতে শুরু করে।ও ফোনের উপর ফোন দিতেই থাকতো আর এইদিকে আমি ফ্রেন্ডের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছ ফোন সাইলেন্ট করে। ধীরে ধীরে আমি ওর সাথে যোগাযোগ অফ করে দিতে থাকি।কিন্তু ওর পাগলামি কমে না।একবার তো ও আমার বাসায় অব্দি এসে পরেছিলো।অনেক কষ্ট করে ওকে চিটাগং পাঠিয়েছিলাম। আমার বিরক্তির লেভেল এতই বেড়ে যায় যে ওর কোনো কিছুই আমার টলারেট হতোনা। এভাবে দিনের পর দিন যেতে থাকে।দুটো বছর কেটে যায় ওকে অবহেলা করতে করতে।একটা সময় দেখি সে চুপ হয়ে যায়।সে আর আমাকে কল দেয় না।আমার জন্য পাগলামি করেনা।তখন তার এই ব্যাপারগুলোই বড্ড মিস করতে থাকি। কিন্তু আমি যে কতটা দেরি করে ফেলেছিলাম তা তখন বুঝতে পারিনি।
আমি তার কাছে যাই।অনেক মিনতি করি কিন্তু সে ফিরে আসেনি আমার কাছে।আমার হাজার কান্নাকাটিও তার মন গলাতে পারেনি।সে তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলো।আর যাইহোক সে আমার কাছে ফিরে আসবেনা। আমি তাকে কষ্টটা বড্ড বেশি দিয়ে ফেলেছিলাম।একটা সময় হাল ছেড়ে দেই।কেটে যায় ৪ টি বছর। এই সব কিছু ভাবতেই কেমন যেনো কষ্ট হচ্ছে।খুব বেশি কষ্ট।আমি আবার রূপকে ডাক দিলাম। রূপ এবারও আমার দিকে তাকালো। “আমাকে মাফ করা যায়না।”? আমার কথার পৃষ্টে রূপ শুধু একটু হাসলো। কোনো উত্তর দিলোনা। হাসছো যে! আমি কি মজার কিছু বলেছি? “আলবাদ মজার কথাই বলেছো।তোমার কথা শুনে আমার খুব হাসি পাচ্ছে।” আর কত শাস্তি দিবে আমাকে? “তুমি যে আমাকে বিনা দোষে শাস্তি দিয়েছিলে ঐটার কি হবে?আমার কি এটাই দোষ ছিলো যে আমি তোমাকে মনে প্রাণে ভালোবেসেছিলাম? তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম? ” রুপের কথা শুনে আমি আবারো চুপ হয়ে গেলাম।আসলেইতো তার কি দোষ ছিলো যে আমি তার সাথে এতো খারাপ করেছি!
“দেখো অনেকটা সময় চলে গিয়েছে।পুরনো কথা তুলে আর লাভ নেই।তুমি তোমার লাইফে মুভ অন করেছো আর আমি আমার লাইফে ” আমি যদি বলি আমি এখনো মুভ অন করতে পারিনি।আজও আমার তোমাকেই চাই। রুপ মুচকি হেসে, “এটা তোমার সমস্যা আমার না।আমি আমার লাইফে অনেক হ্যাপি আছি।দয়া করে তোমার বকবক অফ করো।আমার খুব বিরক্ত লাগছে।” আমি রুপের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকলাম।সে চোখ বন্ধ করে আছে।একটা মানুষের এতোটা পরিবর্তন।এতোটা কঠিন তো রূপ কখনোই ছিলোনা।আর আজ সে কঠিনের থেকেও কঠিন হয়েছে।আচ্ছা রূপ কি আর আমাকে ভালোবাসে না? আমার জন্য কি তার মনে কোনো অনুভুতি নেই? ভাবতেই বুকে চিন চিন ব্যাথা করছে।
পুরো জার্নিতে আর কোনো কথা হলোনা।বাস তার গন্তব্যে ছুটে চললো।পুরো রাস্তা আমি রূপের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।মন টা বড্ড বেহায়া হয়ে গিয়েছে।খুব ভোরে আমরা পৌছালাম। আমি বাস থেকে নামলাম।রূপও আমার পিছে পিছে নামলো।কিন্তু কি অদ্ভুত বাস থেকে নেমে সে সোজা হাটা শুরু করলো।বাই পর্যন্ত বললো না।আমি দৌড়ে তার কাছে গেলাম। রূপ আমার সাথে একটু নদীর পাড় টায় বসবে? আমি জানি তোমার ইচ্ছে নেই।তবুও প্লিজ লাস্ট বার তোমার কাছে কিছু চাচ্ছি। রুপ থেমে গেলো।আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। বুঝতে পারলাম তার সম্মতি আছে।আমি খুশি হয়ে গেলাম।রূপকে নদীর পাড়ে বসলাম। তোমার মনে আছে রুপ? এখানে আমরা আগে কত আসতাম।একসাথে বসে কত আড্ডা দিতাম? “মনে থাকার তো কিছু নেই।”
রূপের এরূপ কথা আমার বুকে তীরের মতো বিধছে।নিজেকে শান্ত করে রূপের এক হাত নিজের হাতে নিতেই রূপ এক ঝটকায় নিজের হাত সরিয়ে ফেললো। আমি হা করে চেয়ে রইলাম।আগে এই হাত ধরার জন্যই কত বাহানা করতো সে। “হাত ধরার মতো তুমি আর কেউ না।” আমরা কি আবার শুরু করতে পারিনা? “নাহ পারিনা।মনে আছে এমন হাজারো মিনতি আমি তোমার কাছে করেছিলাম? শুনেছিলে তুমি? শুনোনি।দিনের পর দিন তুমি আমাকে ইগ্নোর করে গিয়েছো।আমাকে কষ্ট দিয়েছো।তুমি জানতে না আমি তোমার জন্য পাগল ছিলাম? তুমি এর দাম আমকে খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছো। তুমি জানতে না আমি অবহেলা নিতে পারিনা।দুনিয়াতে এই একটা জিনিসই তো আমি সব থেকে বেশি হেইট করতাম।আর তুমি আমাকে অবহেলার সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছিলে।তোমার কোনো আইডিয়া আছে ঐদিন গুলো আমি কিভাবে পার করেছি?
আমি তোমাকে বলেছিলাম না আমার মন একবার উঠে গেলে দ্বিতীয়বার সেখানে মন বসে না।তোমাকে আমি হাজার বার বারণ করেছিলাম আমাকে এতো অবহেলা করোনা।যেদিন আমি মুখ ফিয়ে নিবো সেদিন সবটা শেষ হয়ে যাবে।তুমি তখন আমার কোনো কিছুর পাত্তাই দিলে না।আর দেখো যা হওয়ার তাই হলো।” আমি খুব মনোযোগ দিয়ে রূপের দিকে তাকিয়ে তার কথা গুলো শুনছিলাম। আর সে নদীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।একটা বার ও আমার দিকে তাকাচ্ছে না।তার কথা গুলো আমার কানে বাজছে।সে তো ভুল কিছু বলছেনা।আমি তো রূপকে ভালো করেই চিন্তাম তারপরও আমি ওর সাথে কত অন্যায়ই না করেছি। আমি সব কিছুর জন্য আবার তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমাকে আর একটাবার সুযোগ দাও।বিশ্বাস করো আমি তোমাকে পরতিনিয়ত খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। “তুমি জানোনা যে ইচ্ছে করে হারিয়ে যায় তাকে পাওয়া যায়না।আমি ও তোমার থেকে হাড়িয়ে যেতে চাই।তোমার আশেপাশে থাকতে চাইনা।”
আমি আর থাকতে না পেরে রূপকে জড়িয়ে ধরলাম।কিন্তু সে আমাকে ধরলোনা।আবার ছাড়ানোর চেষ্টাও করলোনা।কেটে গেলো বেশ কিছু সময়।একটা সময় আমি ই তাকে ছেড়ে দিলাম।তার চোখের দিকে তাকাতেই চমকে গেলাম।সে কাঁদছে।তার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরছে। “অনেকটা সময় পেড়িয়ে গেছে আমি এখন উঠি।” বলেই সে উঠে গেলো। সে উঠতেই আমি চিৎকার করে বললাম, “তুমি কিন্তু এখনো আমার উত্তর দিলেনা।” সে আমার দিকে তাকালো। “সামনের শুক্রবার বিয়ে।আশা করি তুমি তোমার উত্তর পেয়ে গিয়েছো।” রূপের কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।আমি নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিনা।এতো বছর পর তাকে পেয়ে আমি তাকে চিরতরে হাড়িয়ে ফেলবো।নাহ এটা কোনোভাবেই মানতে পারছিনা। তুমি আমাকে ভালোবাসোনা?
ভালোবাসতাম।খুব ভালোবাসতাম।কিন্তু তুমি তার মর্ম বুঝোনি।আর যে যেটার মর্ম বুঝে না তাকে সেটা পেতে নেই।এই যে এখন তুমি আমাকে ভালোবাসো।কিন্তু আমি যখন তোমার কাছে ছিলাম তুমি এই ভালোবাসাটাকেই দিনের পর দিন অপমান করে গিয়েছো।আমাদের ভালোবাসা স্বপ্নের সমাপ্তি তুমি ঘটিয়েছে তিলে তিলে।আমি শুধু ঐ সপাপ্তিতে একটা রেখা টেনেছি।” বলেই রুপ দ্রুত হাটা শুরু করলো। পিছে ফিরে তাকালোনা। আমি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে।যে আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলো আর আমি তার কাছ থেকে ভালোবাসাই কেড়ে নিয়েছি।উঠে দাড়াতে গিয়েও যেনো কোনো শক্তি পাচ্ছিনা।মাথা ঝিমঝিম করছে। তারপরও অনেক কষ্ট্ব উঠে দাড়ালাম।আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে ভালোবাসি বড্ড ভালোবাসি।
গল্পের বিষয়:
গল্প