তরুরাগ
শেষ চৈত্রের হাওয়া তখন সামান্য গোলমেলে হতে শুরু করেছে। আর এই গোলমেলে হাওয়া হঠাৎ হঠাৎ ঝাপটা মেরে বৃক্ষরাজির মরাধরা-শুকনা পত্রশাখাকে লোপাট করে দিতে চাইছে। রোদ্দুরের ভয়ানক তেজে মাটি ফেটে চৌচির। ওই ফাটন্ত মাটিতে খালি পা ফেললে আর রক্ষা নাই। তক্ষুনি ছ্যাঁকা লেগে পায়ে ফোস্কা পড়ো-পড়ো ভাব। মাটির এমন রকমসকম আর অদ্ভুতুড়ে বাউকুড়ানির ঝাপটায় দক্ষিণের মস্তপানা শিমুলেরও কীরকম কীরকম যেন দশা! যদিও দুই-চারটা ফুল তখনো তাদের পুরু পাপড়িতে টকটকে লোহু মেখে তাকিয়ে আছে। আর প্রায় ন্যাড়া ডালপালার তুলাবীজ ফটাশ-ফটাশ করে ফেটে চলেছে। মহব্বত ভালো করে খেয়াল করেছে এই লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া বাউকুড়ানি আর ফটাশ-ফটাশ তুলাবীজ ফাটার যেন অদ্ভুত বনিবনা। অবশ্য এই বনিবনার দিকে মহব্বতের যতটুকু মনোযোগ তার চাইতে বেশি মনোযোগ দুই-চারটা উড়ন্ত তুলাপাখির দিকে, যাদের মধ্যিখানে একরত্তি বাদামি বীজ আর চৌপাশে ফুরফুরে তুলা বৃত্তাকারে সন্নিবেশিত। এটা যে তুলাবীজ তাও সহসা ধরা যায় না। বরং ইষৎ বেখেয়াল হলে মনে হয় কোনো পাখি বা প্রজাপতি তার গোলাকৃতি দেহ নিয়ে বাতাসে হাবুডুবু খেতে-খেতে উড়ে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে বহুদূর। হয়তোবা চোখের আড়ালে। মহব্বতের দৃষ্টি অবশ্য এই দূর বা নিকট ভেবে আবর্তিত হয় না। তার দৃষ্টি তখন শিমুলের তুলাফাটার দৃশ্য টপকে অনতিদূর ক্যাচার ঘরে, যেখানে আট-দশদিনের একটা শিশু প্রায়ই ট্যাঁ-ট্যাঁ করে কেঁদে উঠছে এবং এ-শিশুটি জন্ম নেওয়ার আগেভাগে বাড়ির দক্ষিণে বেশ কিছু উলটাপালটা ঘটেছিল। যেমন প্রায় ন্যাড়া, মরো-মরো শিমুলের হঠাৎ করেই যেন ফুলে ফুলময় হয়ে ওঠা। অগণন ফুল দেখে প্রায়ই বিভ্রম হতো Ñ জ্বলন্ত আগুনে বুঝি কোনো গাছ ঢাকা পড়ে গেছে! শিমুল ফুলের এই চড়া রঙে না তার মধুলোভে অথবা অন্য কোনো কারণে কিনা কে জানে বেশুমার কাক হঠাৎ উড়ে এলো। উড়ে এসে তারা আস্তানা গাড়ল এই দক্ষিণেই। অগণন কাক শিমুলের ডাল-পাতা-ফুলে মুখর থেকে ক্রমে পাশের জামগাছেও চড়াও হলো। কাকদের ক্রমাগত কা-কা রবের মাঝেই জন্ম নিল এ-শিশুটি। এবং আশ্চর্য কাণ্ড! শিশুটি জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় তুলা ফাটার মরশুম। যদিও অন্যান্য বছর এ-সময়টা পিছিয়ে আরো ১৫-২০ দিন পরে শুরু হয়। তুলা ফাটার মরশুম শুরু হয়, তুলাপাখিরা ওড়াউড়ি করা শুরু করে আর মহব্বত শোনে এই বাড়িতে আরেকটি শিশু জন্ম নিয়েছে এবং এই শিশুটি তার আব্বাজান মীর হাকিমুল হকের।
মহব্বতের আব্বাজান গত বসন্তের সামান্য পূর্বে মমতাজ খাতুনকে ঘরে তুলেছিলের। এবং অবিশ্বাসযোগ্য হলেও সত্য, সে-বছর এই শিমুলগাছ ছিল পুষ্পশূন্য। এমনকি একটা মরাধরা ফুলও নজরে পড়েনি। এমনকি জামগাছও ছিল ফলশূন্য। বিপুল পরিমাণে বোল আসা সত্ত্বেও আমের ফলনের দেখা নেই। এসব অবস্থা মহব্বতের আব্বাজানের গোচরীভূত ছিল কিনা বোঝা যায়নি। মমতাজ বেগমকে নিয়ে তিনি ঘরের ভেতরই বেশি সময় ক্ষেপণ করলেন। এবং তুলাফাটার মরশুমে কন্যা জন্মানোকেও তিনি ভালোভাবে নিলেন না। তবু তুলার উড়ন্ত রূপ কল্পনা করে কন্যার নাম রাখলেন ফুরফুরি বেগম। এই ফুরফুরি বেগমের কান্নাই শোনা যায় দক্ষিণের দিক থেকে। ফুরফুরি বেগম পেটের বিষ না বেদনা না অন্য কোনো কারণে সারাক্ষণ ট্যাঁ-ট্যাঁ করে কাঁদে কে জানে! মহব্বতেরও এসব নিয়া মাথাব্যথা নেই। তবে সে এই দক্ষিণ দিক থেকে নড়ে না। হয়তো তার নিজের জন্মের কথা মনে পড়ে। ছোট বোন মল্লিকা বানুর কথা মনে পড়ে। অথবা মা গুলনাহারের কথা মনে পড়ে। মহব্বত আদতে বোঝার চেষ্টা করে তার জন্মের সময়ও এইরূপ তুলা-ফাটাকাল শুরু হয়েছিল কিনা। অজস্র তুলাপাখি হাওয়ার টানে এইরূপ গোত্তা খেয়েছিল কিনা। মনে মনে ভাবে মা গুলনাহারকে সে জিজ্ঞাসা করবে
‘মা আমিও কি এ দক্ষিণের ঘরটাতেই জন্মাইছিলাম?’
অথবা,
‘মা, আমার জন্মের সমুয়ও কি তুলাগাছে এমনতর জাউরা পক্ষীর উপদ্রব আছিল?’
অথবা,
‘মা তুমারে বিয়া করনের আগে আমাগো আব্বাজানের কি আরেকটা বিবি আছিল?’
অথবা,
‘মা, আব্বাজান যে নয়াবিবি বাড়িত আনছে তুমার কি কুনু দুষ আছিল? নাকি আমাগো?’
মহব্বত দিবারাত্রিই এমন ভেবে চলে; কিন্তু নিদারুণ সংকোচে গুলনাহারকে এসব জিজ্ঞাসা করতে পারে না। আর তার এত্তসব ভাবনার ভেতরই ফুরফুরি বেগম ক্রমাগত ট্যাঁ-ট্যাঁ করে কেঁদে ওঠে। ফুরফুরি কাঁদলেই মমতাজ বেগমের আহ্লাদিত কণ্ঠ ভেসে আসে –
‘ওলো ওলো সুনা, কান্দে না, কান্দে না, কান্দে না সুনা।’
মমতাজ বেগম এমন বলে কিন্তু ফুরফুরির ত্রাহি চিৎকার থামে না।
বরং আরো জোরে গলা ফাটিয়ে সে কাঁদতে থাকে। ফুরফুরির মায়ের বুকে কি দুধ নাই? মহব্বতের বছর চারেকের ছোট বোন মল্লিকা তো মায়ের কোলে উঠলেই কান্না থামিয়ে দিত। মীর হাকিমুল হক তার প্রথম পক্ষের মেয়ের নাম রেখেছে মল্লিকা বানু। তবে গুলনাহার এবং মহব্বত তাকে ওই নামে ডাকে না তারা তাকে ডাকে পুঁটি। গুলনাহার সর্বদাই ডাকে –
‘পুঁটি, ও পুঁটি। পুঁটি…।’
বানের নতুন জলে তড়পানো পুঁটি মাছের মতোই এখন মল্লিকা বানু। তবে সৎবোন ফুরফুরি জন্মানোর পর তার তড়পানো কেমন যেন স্থির হয়ে গেছে। মা গুলনাহারের সব কথাই সে শোনে। শুধু ফাঁক পেলেই মমতাজ বেগমের ঘরে গিয়ে ঢোকে। এজন্যে গুলনাহারের বকাবাহ্যি-চড়থাপ্পড়ও কম খায় না। কিন্তু ফুরফুরি বেগমের ছোট্ট রাঙা মুখটি দেখার লোভ সে সামলাতে পারে না।
মীর হাকিমুল হক হঠাৎ করেই কেন গুলনাহারকে ত্যাগ করেছে তা জানা যায়নি। তবে একই বাড়িতে মমতাজ বেগমের আগমন গুলনাহার ভালোভাবে নেয়নি।
গুলনাহারও খেয়াল করেছিল বাড়ির দক্ষিণ দিকে বদল। এই যেমন বিস্তার শিমুল ফোটা, তুলা ওড়া, রোদ্দুরের গরম চক্ষু, তার তীব্রতাপে অঙ্গার হতে থাকা গুল্মরাজি। এসবের ভেতরই একদিন ফুরফুরি বেগম জন্ম নিল। আর মীর হাকিমুল হক সরে যেতে থাকল তার দৃষ্টির সামনে থেকে। সরতে সরতে একেবারে আড়াল হয়ে গেল। কীভাবে সে আড়াল হলো গুলনাহারের স্মরণে থাকল না। শুধু মহব্বতের সব স্মরণে থাকল। ফুরফুরির জন্ম, বাড়ির দক্ষিণ দিকের বদল। এই বিস্তর বদলে বাউকুড়ানিও তীব্র ঘুরপাক খেল। বাউকুড়ানির ঝাপটায় যেন সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে লাগল।
পুষ্পককাল
এতদিনে শিমুল আরো বেশি প্রাচীন হয়েছে। অতিপ্রাচীন বৃক্ষের খোড়ল ও দৃশ্যমান ছাল-ওঠা নিয়ে নীরব নির্জনে দাঁড়িয়ে আছে। শিমুলের পাশে সেই জামগাছের অর্ধেক ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। জামের পাশে আম, যা গুলনাহার বেগমের লাগানো, তাও ফলন্ত হয়েছে প্রায় বছর দশেক হলো। আমের পাশে নোনা ফল মমতাজ বেগম রুয়েছিল ফুরফুরির জন্মের দিনকয়েক বাদে। সে-নোনাও এখন জেঁকে আসে। সবই মোটামুটি ছন্দের ভেতর শুধু এই দক্ষিণের হাওয়ার মতি ফেরে নাই। ক্ষণেক ঢিমেতেতালা যাকে বলে মৃদুমন্দ। মুহূর্তে বাউকুড়ানি উড়িয়ে চৌদিকে একেবারে ধুলায় ধুলাকার করে দিলো। হাওয়ার এই অস্থির-বিস্থারের কারণেই হয়তো দক্ষিণ দিকটা ফুরফুরিরও প্রিয় হয়ে উঠল।
প্রায় চৈত্রেই তুলা ফাটার কাল শুরু হয়েছে। এবং এই চৈত্রেই আমের গুটি বেঁধেছে। গুটি বেঁধেছে ফুরফুরির স্তনদুটোও। গুটিবেঁধে ফ্রকের ওপর দিয়ে ছলকে পড়েছে। যেন কোনো সবুজ টিলা। সমতল ভূমির ওপর চলতে চলতে হঠাৎ উঁচু হয়ে ফের পিছলে গেছে। পিছলে সামান্য চলেই ফের আরেকটি টিলা হয়ে উঠেছে। এবং ফুরফুরির পরনের ফ্রক ছিঁড়েফুঁড়ে বেরিয়ে পড়তে চাইছে। তাদের গন্তব্য কোনো ছড়া। ছড়ার টলটলে জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলেই যেন তাদের মুক্তি।
ওই অস্থিরমতি হাওয়া ক্রমে ফুরফুরিকেও বেদিশা করে দিলো। শিমুলতলা তখন তুলাকার। বেশুমার কাক কর্কশ ডাকছে। ওই হাওয়া ঘূর্ণি কলেজ-পড়–য়া মহব্বতের শরীরের গন্ধ টেনে এনে ফেলল ফুরফুরির নাকে। দুপুরের তাপ তখন ক্ষীণ হয়ে বিকেলে নেমে গেছে। দক্ষিণের বাউকুড়ানি কিছুটা শান্ত। ফিকে হয়ে যাওয়া তাপের ভেতর মহব্বত চুপচাপ বসেছিল। আর ফুরফুরি দেখছিল মহব্বতের তর্জনী ও মধ্যমার ডগায় পোড়ানো হলদেটে দাগ। বিড়ি বা সিগারেট টানার ফলে আঙুল দুটোতে এমন অদ্ভুত দাগ পড়েছে। মহব্বতের ঘামের তীব্র গন্ধের সঙ্গে সিগারেট না বিড়ি না অন্যকিছু মিলেছে কিনা কে জানে? তবে ফুরফুরি এই প্রথম কোনো যুবকের এত কাছাকাছি ছিল। ফলে খুব দ্রুতই ওই ঘাম, সিগারেট, বিড়ি এবং গড়ানো বিকেল মাখামাখি হয়ে বিভ্রমে মেতে উঠল। ফুরফুরির শরীরে কী যেন এক ঢেউ, যা তাকে ক্রমাগত ঠেলে দিচ্ছিল মহব্বতের পাশে। ফুরফুরির মনে হলো তার বুকের ওপর সদ্য গজানো টিলা দুটি মহব্বত যদি ডলে-পিষে সমতল করে দিতে চায় তো সে মানা করতে পারবে না। তার এই তীব্র ইচ্ছার আগেই শিমুলের পাপড়ি ঢুকে পড়েছিল যোনিকন্দরে। এবং টপটপ করে অবিরাম লহু ঝরিয়ে কচি কলাগাছের মতো মসৃণ পা দুটো ভিজিয়ে দিয়েছিল। ফুরফুরির দেহের ভেতর থেকে নেমে আসা এই রক্ত সিক্ত করে দিয়েছিল রুখু মাটি। আর তারপরই কিনা নেমেছিল ধুরমার বৃষ্টি। মমতাজ বেগম বলেছিল –
‘এইবার এও হব্বরে হব্বরে বাইস্যা নাইমা পড়লো!’
পুরানা কাপড়ের নরম ত্যানা ভাঁজ করে ফুরফুরির ঊরুসন্ধিতে বেঁধে দিতে দিতে মমতাজ বেগম ভ্রু বাঁকা করে বলেছিল –
‘আদাড়ে-বাদাড়ে আর ঘুইরো না। সাবধানে চইলো।
ব্যাটা গো বিশ্বাস নাই – হেরা সব্বোনাশেরই তাল করে। নিজেরে আগলাইয়া রাইখো।’
এই যে বাউকুড়ানি কেমন এক উথাল-পাথাল হাওয়া ফুরফুরির নাকে ঢুকিয়ে দিলো। হাওয়ার ভেতর মহব্বতের ঘামের নোনাগন্ধ। সিগারেট না বিড়ি, না অন্যকিছুর ঘোর আর এক্কেবারে মগজ গলিয়ে দেওয়া রোদ্দুর – এসবের মাঝে নিজের স্তনকুড়ি দুটো চটকে নেবার আকাক্সক্ষা! ওদিকে মমতাজ বেগমের সতর্কবাণী – ফুরফুরি বেদিশা হয়ে যায় –
এরেই কি তবে বলে সব্বোনাশ! ফুরফুরি এত কাছ থেকে আর কোনো পুরুষ দেখে নাই। মহব্বতই তার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে রইল।
ফুরফুরির ধন্ধ লাগে। কিন্তু ভেতর থেকে কী যেন এক নিষেধ তাকে স্থবির করে দেয়। একেবারে উদরের গভীর থেকে উঠে আসা ডুকরানো কান্না গিলে ফেলে সে ভাবে –
মহব্বতের সঙ্গে কোনো সব্বোনাশ সম্ভব নয়।
সব্বোনাশ হওয়া উচিত নয়। ফুরফুরির ধর্মশিক্ষা নাই। ধর্মের শিক্ষা কেউ তাকে দেয় নাই। সে নামাজ-কোরান জানে না। অক্ষর চেনে না। বিদ্যা তার আয়ত্তে নেই। তবু তার এরকম মনে হয়। তবু প্রতিদিন দুপুর ঘনালে এক তীব্র ইচ্ছা তাকে প্রায় পাগল করে তোলে – মহব্বতের ওই বিড়ির রংধরা পোড়া হলুদের দাগমাখা আঙুল দুটো যদি সে নাকের কাছে ধরতে পারত। মহব্বত যদি তাকে একবার জড়িয়ে ধরে পিষে মেরে ফেলত। সে হয়তো তখন মরার আগেই মরে যেত।
মীর হাকিমুল হক মা মততাজ বেগমকে নিয়ে আলাদা বিছানায় ঘুমায়। কোনো কোনো দিন ভোর না ফোটা অস্পষ্ট আলোতে ফুরফুরি অন্য দৃশ্যও দেখেছে। আব্বাজানকে সে গুলনাহারের ঘর থেকে বেরোতে দেখেছে। আব্বাজান কি মসজিদমুখো হতে হতে ভুল করে ওই ঘরে ঢুকেছে? অথবা নামাজ সেরে কুশলাদি জানার জন্যই হয়তো গেছে। ফুরফুরি সঠিক জানে না, চোরের মতো আব্বাজান কেন ওই ঘরে ঢোকে অথবা বেরোয়? মা মমতাজ বেগম তখন ক্লান্তিতে ঘুমের মরায় মগ্ন। এতগুলান এন্দা-গেন্দা সামলে সে ঘুমে মরবে না তো কী? ফলে ফুরফুরি ছাড়া আব্বাজানের চুরির হদিস কেই-বা আর জানে? কিন্তু ফুরফুরি মাকে এসব বলে নাই।
মহব্বতের কালো চেহারা, একহারা গড়ন, ঘামের নোনাগন্ধ ইত্যাদি মিলিয়ে ফুরফুরির মাথায় যে ঝামেলা পাকালো, তা অন্য কোথাও বিস্তৃত হলো না। অথচ হওয়ার কথা ছিল। মহব্বত দুষ্টুমির ছলে বেণি ধরে টান মারলে ভেতরের ভূমিকম্প কেবল ফুরফুরিই টের পেয়েছে। যদিও সে জানে না, এমন কম্পনের মানে কী? এতসব না জানার ভেতরই তার বিয়ের পয়গাম আসে। ফুরফুরির চেয়ে উনিশ বছরের বড়, হ্যাংলা-পাতলা এক লোকের সঙ্গে তার বিবাহও ঘটে যায়।
বিহঙ্গম
ফার্মগেটের এই ওভারব্রিজের গোড়ায় সারাক্ষণ হাট লেগে থাকে। কয়েকটা হাইরাইজ বিল্ডিং যদিও এই কোলাহল ছাড়িয়ে আকাশমুখী হওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওই চেষ্টা পর্যন্তই। এমন প্রচণ্ড চিৎকার, চেঁচামেচি, হাঁকডাক, গণ্ডগোল পেরিয়ে নিজেকে একলা রাখা মুশকিল। রাস্তার ওপরেই কাঁচাবাজার, যেখানে মিষ্টি কুমড়ার কমলারঙা ফুল থেকে কুঁচো চিংড়ির শুঁটকি পর্যন্ত দেদার বিক্রিবাট্টা হতে থাকে। ফলে এখানকার বাসিন্দাদের বিপত্তি যেমন আছে, সুবিধাও কিছু কম নেই। বিপত্তি ও সুবিধা ভোগকারীদের মাঝে ফুরফুরি বেগমও আছে। ওভারব্রিজের আশপাশের সুউচ্চ দালানগুলির একটিতে থাকে সে। তার ফ্ল্যাটে আড়াইখানা কামরা, স্বামী লালমিয়া বর্তমান। এর মাঝে তাদের দুইটা মেয়ে জন্মেছে এবং এই মেয়েদ্বয়ের পিতৃত্ব নিয়ে কানাঘুষাও কম উঠে নাই। এই কানাঘুষার উৎস ফুরফুরির স্বামী লালমিয়ার অধিক বয়স। ফুরফুরি অবশ্য শক্ত মুখেই এসবের মোকাবেলা করেছে। যদিও সে লালমিয়াকে নিয়া কোনো কথাই কাউকে বলে নাই। ফলে ধরে নেওয়া যায় স্বামীর ঘরে সে সুখেই আছে। অথবা সুখে নাই। কেউ মুখ ফুটে কিছু না বললে কোনোকিছু আন্দাজ করা দুষ্কর।
রাস্তার কাঁচাবাজার থেকে আমরুল শাক, মিষ্টি কুমড়ার কমলারঙা ফুলের আঁটি বা কচিডগা দরদাম করতে করতে ফুরফুরি কোনো কোনোদিন থমকেছে। শাকওয়ালার একহারা গড়ন, তেলাকুচের পাতার মতো গায়ের রং, মাথাভর্তি মেঘকালো চুল থেকে ওঠা গন্ধ তাকে বিভ্রান্ত করেছে। ফুরফুরির মন যেন পাখি হয়ে উড়ে গেছে। কিন্তু তা মুহূর্তমাত্র সময়। নাগরিক বাতাস সে-গন্ধ ভাসিয়ে নিয়ে ফেলে গেছে কুঁচো চিংড়ির ঝাঁকায়।
ফুরফুরি সংসার ব্যস্ততায় ফের ডুবে গেছে। মহব্বতের সঙ্গে তার যে একেবারেই দেখা-সাক্ষাৎ হয় নাই তেমন নয়। কালেভদ্রে বিপদে-আপদের সেসব সাক্ষাতে ফুরফুরি একেবারে গুটিয়ে থেকেছে। যেন ভয় পাওয়া কোনো পাখির ছানা। যার ভালো করে তাকানোর ক্ষমতাও লুপ্ত হয়েছে। এতদিনে মহব্বতেরও সংসার বৃদ্ধি পেয়েছে। তিন সন্তানের জনক সে। শোনা যায়, তার স্ত্রী জাঁহাবাজ মহিলা, যার কব্জির শক্ত বাঁধন থেকে মহব্বতের আর পরিত্রাণ নেই।
ফুলফুরির দুই মেয়েরই বিয়েথা হয়েছে। এবং তারাও যথারীতি বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। আড়াইখানা রুম আর হাড়-জিরজিরে লালমিয়ার ক্ষয়কাশ নিয়ে ফুরফুরির অবস্থা বেহাল। একাকী মেয়েমানুষ কীভাবে কী সামলায় সে! মহব্বত দুই-চারদিন ফল-পাকুড় কিনে দেখে গেছে। মহব্বত এলেই ফুরফুরি ফের ভয় পাওয়া পক্ষীর দশায় ফিরে যায়। ফুরফুরি জানে না তার কেন এমন লাগে!
তবে ফুরফুরি যত পক্ষীরূপ পায়, লালমিয়ার ক্ষয়কাশ তত বাড়ে। তার হাড়-জিরজিরে শরীর আরো পলকা হয়। পলকা হতে হতে লালমিয়া একদিন নাই হয়ে যায়। আর ফুরফুরি আছাড়ি-বিছাড়ি করে কাঁদে। চোখের জল ফেলতে ফেলতে নাক-মুখ ফুলিয়ে ফেলে। শোকগ্রস্ত হয়ে তিনদিন দানাপানি স্পর্শ করে না। আমেরিকা আর লন্ডন থেকে দুই মেয়ে ঘনঘন ফোন করে মাকে সান্ত্বনা জানায়। কিন্তু ফুরফুরির কান্না তাতে কমে না। সে এত কাঁদে যে, মরাবাড়িতে আসা সকলে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরে যায়। ফেরার সময় কেউ কেউ মিষ্টি কুমড়ার কমলারং ফুল কিনে নিয়ে যায়। অথবা কুঁচো চিংড়ির শুঁটকি। মহব্বতও এসব কিনে ফুরফুরির ফ্ল্যাটে আসে এবং সেও চোখ মোছে। মহব্বতের মনে পড়ে ফুরফুরির জন্মের সময় তার মা গুলনাহার এমনই অঝোরে কেঁদেছিল। ওই বয়সে সে মায়ের কান্নার অর্থ ধরতে পারে নাই। কিন্তু বড় হয়ে বুঝেছিল মীর হাকিমুল হকের চোট্টামিতে মা মনে শক্ত আঘাত পেয়েছিল। লালমিয়া মারা যাওয়ার সপ্তম দিনের মাথায় ফুরফুরিকে নিচের কাঁচাবাজারে দেখা যায়। সে মসুরের ডাল কিনতে নামে। ভেজানো ডালবাটা দিয়ে কুমড়া ফুলের বড়া খেতে মহব্বত ভারি পছন্দ করে।
ফুরফুরির আড়াই রুমের ফ্ল্যাটে ক্রমে খা-খা বাড়ে। লালমিয়ার মৃত্যুসংবাদে যারা শোক জানাতে এসেছিল তারা একে একে চলে যায়। ফলে ফুরফুরিকে ফের কান্না ব্যারামে ধরে। আর মহব্বতকে বারবার সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আসতে হয়। ফুরফুরি ফের ফুলে ফুলে কাঁদে। মহব্বত দেখে ফুরফুরির দুই চোখে কালো দাগ পড়ে। রুক্ষ চুলে তেল-পানি পড়ে না। পরনের কাপড়-চোপড় ন্যাতানো। শ্রীহীন। কান্নার অজস্র জলকণা যেন ফুরফুরিকে পেঁচিয়ে রাখে, যার ভেতর দিয়ে তাকালে ফুরফুরিকে কাচের মতো স্বচ্ছ অথচ ভঙ্গুর মনে হয়।
রাত ঘন হলে ফুরফুরির কান্না আড়াইখানা রুম থেকে বেরিয়ে অন্যান্য ফ্ল্যাটেও পৌঁছে যায়। ফার্মগেটের সুউচ্চ দালানকোঠা আর ওভারব্রিজজুড়ে শুধু কান্নার শব্দ থইথই করে।
ঢাকা শহরের বাসিন্দারাও রাতভর কান্নার শব্দ শোনে। এবং তারা প্রায় সারারাত্রিই জেগে থাকে। ভোরের দিকে রাতজাগা লাল লাল চক্ষুতে ঘুম ঢুকে পড়ে।
তখন কি চৈত্র মাসের শেষপ্রান্ত কিনা কেউ ভেবে দেখে না। ঢাকা শহর বা বাংলাদেশের মফস্বল শহরগুলোতে বিস্তর শিমুল ফুটে কিনা কেউ সে খবর রাখে না। শিমুল ফুটে ফুটে রক্ত নদী বইয়ে দিচ্ছে কিনা তাও কেউ মনে করতে পারে না।
তবে কালো বিড়ালরঙা অন্ধকারে ফুরফুরিও কিছু মনে করতে চায়নি। মনে করতে না চাইলেও বিড়ি না সিগারেটের তীব্র গন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। জীবদ্দশায় লালমিয়া কোনোদিন বিড়ির পাছা শুঁকেও দেখেনি Ñ তবু তাকে ক্ষয়কাশে ধরেছিল। মহব্বতের দুই হাতের মুঠোতেও তুলাপাখি ধরা দিয়েছিল। আর মহব্বত ফিরে গিয়েছিল বাড়ির দক্ষিণ দিকে।
মহব্বতের তেলাকুচের পাতার মতো গাত্রবর্ণে মুখ ঘষতেই ফুরফুরির ফের কান্না এসেছিল। কিন্তু সে কাঁদেনি। কারণ ঘুম তাকে এমনই তাড়া করে ফিরছিল যে কান্নার অবকাশ পায়নি। খুব নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ার আগে ফুরফুরির মনে সন্দেহের কাঁটা বিঁধেছিল –
‘মাইনষের ঘামের গন্ধে এমুন ঘুম নামে কেমনে?’
অথবা,
‘ঘুমগন্ধা ঘাম শরীলে নিয়া সে নিজে জাইগা থাকে কেমনে?’
ঢাকা শহরের বাসিন্দারা এই সন্দেহের কাঁটা সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। তারাও তখন শ্রান্তি নাকি ক্লান্তিতে ঘুমঘোরে ছিল। ফলে তাদের পক্ষেও কিছুই জানা প্রায় অসম্ভব ছিল। শুধু ঘামগন্ধী হাওয়া উড়ে গিয়েছিল বহুদূর। ফুরফুরির গভীর নিদ্রার সংবাদ সে সঙ্গে নিয়েছিল। হাওয়া উড়তে উড়তে পৌঁছেছিল প্রায় ন্যাড়া হয়ে যাওয়া শিমুলের বৃক্ষে।
শুধু ওই হাওয়াই জেনেছিল তখন শিমুলের শুরু হয়েছে তুলাফাটার উর্বরাকাল…