প্রতিদিনের মতো আজও সন্ধ্যায় নিউজফিড স্ক্রল করতে ছিলাম। এমন সময় একটা আইডি থেকে রিকুয়েস্ট আসলো। আমি সাধারণত বাইরের কাউরে এড দেই না।
কিন্তু কেনো জানি এই আইডিটা ঘুরে দেখলাম। ছেলেটার নাম আবির, ঢাকা ভার্সিটি থেকে বিবিএ এমবিএ শেষ করে এখন ডাচ বাংলা ব্যাংকে জব করে। এসব আইডিতে লিখা ছিলো আর কি, তাই রিয়েল আইডি দেখে রিকু একসেপ্ট করলাম। একসেপ্ট করার কিছুক্ষণ পর ছেলেটি থ্যাংকস লিখে মেসেজ দিলো। যেহেতু ছেলেটির বাড়ি ছিলো ফেনী আর আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা, প্রতিবেশী হিসাবে আমিও টুকটাক কথা বলা শুরু করলাম। শুরুতে অতটা কথা হতো না, হাই-হ্যালো, কেমন আছি এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। আস্তে আস্তে কথার মাত্রা বাড়তে লাগলো। কেমন জানি একটা ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করলো। একদিন সে আমার ফোন নাম্বার চাইলো। এরপর আমি বললাম-
–দেখেন আমি তো অপরিচিত কারো সাথে ফোনে কথা বলিনা, মেসেজিং তো করতেই আছি ফোনে কথা বলার কি দরকার।
–তুমি আমাকে ট্রাস্ট করো না তাই না? আচ্ছা সমস্যা নেই, তুমি যখন আমাকে নাম্বারটা দিবেই না তাহলে আমার নাম্বারটা দিয়ে রাখলাম। যদি কখনও ইচ্ছে হয় ফোন দিও।
এভাবেই আরো কয়েকদিন কেটে গেলো। একদিন সে বলতেছে তুমি এমন কেনো, আমি তোমাকে কতদিন হলো নাম্বারটা দিয়ে রেখেছি একবারও কল দিলে না। তাই নিজের দোষ খন্ডাতে মেসেঞ্জারেই কল দিলাম। সে আমাদের গ্রামের বাড়ির সব চিনে। এমনকি তার বোনকে আমাদের পাশের গ্রামে বিয়ে দিয়েছে। ও যা যা বর্ণনা দিয়েছে তা কৌশলে বড় মামাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মামা বলছে সব সত্যি। এরপর একদিন সে বললো ব্যাংকের কাজের জন্য বসুন্ধরা আসবে, আমি উনার সাথে দেখা করবো কিনা। আমার বাসা টঙ্গীতে, তাই ঠিক করলাম হাউজবিল্ডিং দেখা করবো। সে যথারীতি এসে ফোন দিয়ে বললো যে, সে এসে পড়ছে। হাউজবিল্ডিং পৌঁছে দেখি সে নর্থ টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই। প্রথমবার সামনে থেকে দেখলাম তাকে।
–আপনি নিশ্চয় আবির? আমি মায়া।
–জ্বী, কেমন আছেন আপনি।
–আলহামদুলিল্লাহ্, আপনি?
–আমিও। আচ্ছা কোথায় বসবেন বলুন।
–এইখানে তো বসার মতন তেমন প্লেস নাই, কোনো রেস্টুরেন্ট বা সিপিতে বসতে হবে।
–চলুন সমস্যা নেই। আমি নির্জন জায়গা পছন্দ করি না। এখনকার মানুষের মনোভাব তেমন ভালো না। আমাদের দেখলে নেগেটিভ ভাববে।
তার এই কথা শুনে আমি পুরা ফিদা হয়ে গেলাম। এখনকার ছেলেদের চিন্তাভাবনা অন্যরকম, কিন্তু তার চিন্তাভাবনা এতো ভালো হবে সেটা ভাবতেও পারিনি। মাসকট প্লাজার ফুডকোর্ডে বসলাম, টুকটাক অনেক কথাই হলো। চলে আসার সময় আমাকে বললো যে,
–মায়া আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তোমাকে কথাটা সরাসরিই বললাম, কারণ এখন আমার লুকিয়ে প্রেম করার বয়স নাই। যেহেতু ভার্সিটিতে পড়ো সো তুমিও ম্যাচিউরড।
— দেখুন আমারও এখন প্রেম করার মত সময় বা ইচ্ছা কোনোটাই নাই। আপনি যদি পারেন আমার ফ্যামিলিতে যোগাযোগ করুন, আমি অনুমতি দিলাম।
–আচ্ছা আর মাস দুয়েক সময় দেও আমাকে, সব কিছু গুছিয়ে তোমার পরিবারের সাথে কথা বলবো ইনশাআল্লাহ্। এর আগে তুমি পরিবারকে কিছু জানিয়ো না।
–আচ্ছা আজ তাহলে উঠি, অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাসায় টেনশন করবে।
–আরেকটু থাকলে হয় না?
–এমনিতেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আজ আর না প্লিজ।
–আচ্ছা, তুমি যদি কিছু না মনে করো তাহলে আমি আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে চাই।
–আচ্ছা চলুন।
নর্থ টাওয়ারের সামনে থেকে রিক্সা নিলাম,সে রিক্সায় আমার থেকে দূরে এতোটা চেপে বসেছিলো তা দেখে আরেকবার মুগ্ধ হলাম। এখন আমি শিউর যে তার মনে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নাই। আব্দুল্লাহপুর এসে তাকে বললাম,এখন আমি রিক্সা নিয়ে চলে যেতে পারবো। সে আমাকে একটা সিগ্ধ হাসি দিয়ে বিদায় দিলো। আজকে আমি অনেক খুশি, হয়তো মনের মত কাউকে পেয়ে গেছি এজন্য। আমার কোনো বোন নেই, তাই বাসায় ফিরে ভাবিকে সব বললাম। আমার বাবা নেই, আমার বড় মামাই আমার গার্ডিয়ান। মামাকে আবিরের নাম্বারটা মেসেজ করে দিয়ে বললাম, মামা এর সাথে একটু কথা বলে দেখেন চিনেন কিনা। আবির সবকিছুর এতো সূক্ষ্ম বর্ণনা দিয়েছে মামাও ওকে অনেক বিশ্বাস করে ফেলছে। পরে মামা আম্মুকে ফোন দিলো, আম্মু বললো ওর জীবন ও যা ভালো মনে করে তাই হবে। তখন আবির বললো আসলে সামনে আমার বিসিএস পরীক্ষা আর এইবারই লাস্ট চান্স, এরজন্য একটু সময় চাইছি। যেহেতু ডিসেম্বরে আমারও সেমিস্টার ফাইনাল তাই সবাই এটাই মেনে নিলো।
এরপর থেকে শুরু হলো রেগুলার ফোনে কথা বলা। প্রতি ঘন্টায় ১০ বারের বেশি ফোন করতো। আমার উপর একটা
অধিকার খাটানো শুর করে। কোথায় যাই কি করি সব বলতে হতো। আমাকে আমার ফ্রেন্ড সার্কেল থেকে পুরো আলাদা করে দিয়েছিলো। সেও অনেক সেলফি দিতো, কোথায় যায় বা না যায় সব পিক তুলে আমাকে দেখাতো। ভিডিও কলে ওর পুরো বাড়ি দেখাতো। একদিন সে মন খারাপ করে বলতেছে এর আগের বার বিসিএসে মেডিক্যালের জন্য টিকে নাই। যদি কিছু টাকা ঘুষ দিতো তাহলে সব ওকে হয়ে যেতো। আমিও বললাম, দেখো যদি লোক থাকে তাহলে টাকা দিয়ে হলেও ট্রাই করো। সে বললো, এইবার তাই করতে হবে। হুট করেই তার আচরণে খানিকটা পরিবর্তনের সুর পেলাম। কথাগুলো কেমন জানি চেঞ্জ হতে শুরু করলো। এরপর যতবার ওর সাথে কথা হতো ও শুধু টাকার জন্য আপসোস করতো
– টাকা জোগাড় হচ্ছে না আর এইবারই শেষ চান্স, কি করবো বুঝতেছি না।
–দেখো আল্লাহর উপর ভরসা রাখো সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্। আর তোমার ভাই+বোনের হাজবেন্ডরা সবাই তো অনেক ভালো পজিশনে আছে, তাদের থেকে ধার নেও।
–আমি চাইনা আমার ভাইদের কাছে ছোটো হতে।
–আচ্ছা তোমাদের তো অনেক জমিজমা আছে, আর যা ফসল হয় সেটা বিক্রি করে তো অনেক টাকাই পাও। তোমার আম্মুর কাছে কিছু চাও।
–আম্মু ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে। পাঁচ লাখের মধ্যে সাড়ে চার লাখ জোগাড় হয়েছে আরও ৫০ হাজার লাগবে।
–তোমার স্যালারি তো আলহামদুলিল্লাহ্ ভালোই, এখন তো মাসের শুরু তো স্যালারি তুলো। এতো টেনশন নিও না কেমন।
তো একদিন সে বলেই ফেললো যে তুমি যেভাবে পারো আমাকে ২০ হাজার টাকা ম্যানেজ করে দাও,কিন্তু তোমার পরিবারকে বলো না। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম, আমি এতো টাকা কোথায় পাবো। সে বললো আমি জানি না, যদি ভালোবেসে থাকো তাহলে আমাকে টাকাটা যেভাবে হোক ম্যানেজ করে দিবা। আমি আবারও বললাম দেখো আমার বাবা নাই, আমি নিজেই ভাইয়ের সংসারে থাকি আর আমি জবও করি না। তাহলে এতোগুলো টাকা কোথা থেকে দেই তুমিই বলো। সে বললো তোমার বন্ধুদের কাছে থেকে ধার করে হলেও দেও না হলে তোমার সাথে আর কথা বলবো না। এই কথা শুনে আমি আমার ফ্রেন্ডদের কাছে টাকা চাইতে শুরু করলাম। কিন্তু ওরা সবাই স্টুডেন্ট, তাই কারো কাছে পেলাম না। যাই হোক তার ফোনে একটা টেক্সট করলাম, দেখুন আপনার সাথে হয়তো আমার বিয়েটা লিখা নাই, ভালো থাকবেন। আর কখনও যোগাযোগ না করলে খুশি হবো। এর কিছুক্ষণ পরেই সে ফোন দেয়-
–হ্যালো মায়া, কি করো?
–আমি যে মেসেজ দিয়েছি সেটা পান নাই?
— না তো, ঐ ফোন তো বাসায়।
–আচ্ছা, বাসায় গিয়ে মেসেজটা দেখে নিয়েন। এই বলে কল কেটে দিলাম। ঠিক আধা ঘন্টা পরে সে আবার কল দিলো-
–এমন করে কেউ বলে নাকি, আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম তুমি জানো। বাসা থেকে বাজার ৪ কিলোমিটার দূরে। পুরোটা রাস্তা আমি দৌড়ায় বাসায় আসছি আর এসে দেখি এই মেসেজ। লাগবে না আমার টাকা পয়সা, আমার তোমাকেই চাই। তারপর আর কি, এই কথাগুলো শুনে আমি আবার আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যাই। পরে আমি নিজের ভালোর কথা ভেবেই ঠিক করি যে ওকে টাকাটা দিবো। আমার এক ফ্রেন্ড আইটি ফার্মে জব করে,ওর সাথে আমি ডিপ্লোমা কম্পলিট করেছি। শেষ ভরসা হিসাবে ওরেই কল দিলাম। ও আমাকে জানালো যে ২০ হাজার দিতে পারবে না, তবে ১০ হাজার ম্যানেজ করে দিতে পারবে। আমি তখন আবিরকে ফোন দিলাম-
–আচ্ছা ১০ হাজার টাকা দিলে হবে?
–হ্যাঁ হবে, আমি এখন অডিটের কাজে গ্রামের বাড়িতে আছি। এক সপ্তাহ পরে ঢাকা ব্যাক করবো, দেন সেলারি তুলে তোমার টাকাটা ব্যাক দিয়ে দিবো।
তখন আমি আমার ফ্রেন্ডকে আবিরের বিকাশ নাম্বার দিলাম। আমি বোকামো করে আর বাড়িতে কিছু জানালাম না।
এইদিকে ও এক সপ্তাহের নাম করে ১০ দিন পর বাড়ি থেকে আসলো। আমি পরে বললাম আমার ফ্রেন্ডের টাকাটা কবে দিবেন। ও বললো যে বিকাশে দিবো নাকি? এই শুনে আমি আবার আমার ফ্রেন্ডকে কল দিলাম।ও বললো যে বিকাশে দেওয়ার দরকার নাই, আমার ব্যাংক একাউন্ট আছে সেখানে দিলেই হবে। আমি একথা আবিরকে বললাম, পরে আবির বললো যে টাকা যাইতে দুই দিন সময় লাগবে। এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে টাকা যাইতে ২ দিন সময় লাগে, এইটা আমি জানতাম তাই আর কথা বাড়ালাম না। তারপর ৪/৫ দিন পর আমি নিজেই ফ্রেন্ডকে।ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম টাকা পাইছে কিনা। ও বললো চেক করে জানাচ্ছি, ২ দিন পর বলে যে টাকা আসেনি। পরে আমি আবিরকে ফোন দিয়ে বললাম যে-
–টাকাটা এখনও দাওনি কেনো।
–কি বলো টাকা এখনও যায়নি?
–না তো।
–আচ্ছা আমি চেক করে জানাচ্ছি।
–ওকে তাড়াতাড়ি জানাও।
–সরি আসলে আমার কলিগ টাকাটা পাঠাতে ভুলে গিয়েছিলো, আমি আজকেই পাঠাচ্ছি।
আমি আবার তাকে বিশ্বাস করলাম। তারপর আমার ফ্রেন্ডকে এই কথা জানালাম, ও বললো সমস্যা নাই।
এরপর আমার ফ্রেন্ড এই নিয়ে আর কোনো ফোন দেয়নি, আর ও টাকা পেয়েছে ভেবে আমিও ফোন করিনি। এইভাবে কিছুদিন কেটে গেলো। জানুয়ারিতে আমার সেমিস্টার শুরু হয়ে গেলো, আমিও স্টাডি নিয়ে বিজি হয়ে পড়লাম। আমি টাকার ব্যপারটা ভুলেই গিয়েছিলাম। এভাবেই দিন যেতে লাগলো, ও আমাকে পুরো হিপনোটাইজ করে নিয়েছিলো। আমার সকাল শুরু হতো ওর সাথে কথা বলে, রাতে ঘুমাতে যেতাম ওর সাথে কথা বলে। এরই মধ্যে ও একদিন বলতেছিলো-
–আমি যদি তোমাকে কষ্ট দেই প্রতারণা করি তাহলে আমারও মা-বোন আছে, তাদের সাথেও এমনটা হবে। আমি আমার মৃত বাবার নামে বলছি তোমাকে কষ্ট দিবো না। জানো আমার ছোটো ভাইটা বিয়ে করতে চায়। কিন্তু আমার জন্য করতে পারছে না আর এই জন্য রাগ করে বাড়িতে আসে না।
–কি বলেন, আচ্ছা ওর আইডি দেন আমি ওকে দেখবো।(ও শুধু নাম বললো, আর কিছু না)
— আচ্ছা তোমার কোনো পরিচিত মেয়ে আছে? থাকলে দুই ভাই একসাথে বিয়ে করতাম।
–আছে কিন্তু তাকে তো এখন বিয়ে দিবে না।
–কেনো? কে ও? আর কিসে পড়ে?
–ভাবির বোন। মিরপুর বাংলা কলেজে এইবার অনার্সে এডমিশন নিছে।
–বাসা কোথায় ওর?
–আজিমপুর।
–তাহলে ইডেনে কেন ভর্তি হলো না।
–ঐখানে ওয়েটিং লিস্টে আছে।
–আচ্ছা আমার পরিচিত এক লোক আছে, তাকে বললে ইডেনে ট্রান্সফার করে দিতে পারবে।
–আচ্ছা আমি ভাবির সাথে কথা বলে জানাচ্ছি।
পরের দিন ভাবিকে জানালাম, ভাবি বললো টাকা ছাড়া করে দিতে পারলে তো অনেক ভালো হয়। এইদিকে আমার ভাবি আর মামা আমাদের এক রিলেটিভকে বললো আবিরের অফিসে খোঁজ নিতে। ঐ ভাইয়াটাও ডাচ বাংলা আরেকটা শাখায় জব করে।
আবির যে শাখার কথা বলেছিলো সেই শাখায় ভাইয়া এই নামের কাউকে পেলেন না। পরে তিনি ভাবিকে জানালেন। ভাবি আমাকে এই কথা বলার পর আবিরকে জানালাম। আবির বললো আমি তো আগে রাজনীতি করতাম, যেহেতু আমার বস দলের লোক তাই আমার রিয়েল নামটা হাইড রাখছে। এইসব শুনে আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম, পরে ভাবিকেও জানালাম। ভাবি বললো আচ্ছা তুমি এক কাজ করো ছেলের ফোন নাম্বার তাকে মেসেজ করে দাও, তিনি কথা বলে পরিচিত হবেন। আমি পরে তার নাম্বার, ব্রাঞ্চ এর নাম, পোস্টের নাম ইত্যাদি মেসেজ করলাম। এসবের কিছুই আবিরকে বললাম না। এরপর একদিন আননোন একটা মেয়ের আইডি থেকে একটা পিক আসলো। অথচ সেই পিকটাই আবির কিছুক্ষণ আগে আমাকে দিয়েছিলো, ওর ভাতিজা-ভাতিজীর ছবি। তো পিকটা দেখে আমি অবাক হলাম আর মনে সন্দেহও জাগলো। সাথে সাথে মেয়েটাকে রিপ্লাই দিলাম-
— কে আপনি? আর এই পিক আপনি কই পেলেন আর আমাকেই বা কেনো দিলেন?
–ও সরি সরি,আসলে আপনাকে দিতে চাইনি। কিভাবে যে কি হলো, আর আপনার কাছেই বা কিভাবে গেলো বুঝলাম না।
কথাগুলো শুনে আমি অনেক অবাক হইলাম, কি ভূতুরে ব্যপার। আবির নামাজ পড়বে বলে অফলাইনে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মেয়েটার আইডি থেকে মেসেজটা আসছে। তারপর মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম –
–এই পিক আপনি কোথায় পেয়েছেন?
–আমার ফ্রেন্ড লিস্টের একজন দিয়েছে।
–তার আইডির লিংকটা আমাকে দিতে পারবেন?
তারপর সে একটা লিংক দিলো। আমিও সেই লিংকে গেলাম, গিয়ে দেখি এইটা আবিরের বড় ভাইয়ের আইডি। এরপর আমি আবিরকে ফোন দিলাম। সে জানালো এমন কাউকে তো চিনতে পারছি না, আইডি লিংকটা দেও তো দেখি। পরে আমি মেয়েটার আইডির লিংক দিলাম। আবির আইডিটা চেক করে জানালো এইটা তার ভার্সিটির এক বড় ভাইয়ের বউয়ের আইডি। ভাইয়াটা নাকি এনএসআই এর ডিএসপি। আবির আরো বললো যে ভাবির সাথে কথা বইলো, ভাবি অনেক ভালো। পরে আমি আবার সাবরিনাকে মেসেজ দিলাম, ওহ মেয়েটার নাম সাবরিনা। আবিরের সব ডিটেইলস বলে জিজ্ঞেস করলাম চিনে নাকি। সে বললো-
–ওকে তো চিনি। খুব ভালো ছেলে, ভার্সিটিতে ওর জন্য অনেক মেয়েই পাগল ছিলো। কিন্তু ও পাত্তা দিতো না, রাজনীতি নিয়ে বিজি থাকতো তো।
–কি বলেন!কিন্তু এখন যে আমার সাথে প্রেম করতেছে।
–সত্যিই? তুমি মিথ্যা বলছো না তো?
–আমার কথা বিশ্বাস না হলে ওকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।
এইভাবে অনেক কথা হলো, উনি উনার হাজবেন্ড+পরিবার সম্পর্কে অনেক গল্পই করলেন। এক পর্যায়ে আমি তাকেও অনেক ট্রাস্ট করে ফেলি। আবির আমাকে ওর কথার জালে আমাকে এমনভাবে ফাঁসিয়েছে যে আমি পুরাই ওর হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছিলাম ও যেটাই বলতো সেটাই কোনো প্রকার যাচাই বাছাই ছাড়াই বিশ্বাস করে নিতাম।
এভাবেই ঘোরের মধ্যে দিনগুলো কাটতে লাগলো। এরপর একদিন আবির জানালো যে ভাবির বোনের ট্রান্সফারের জন্য ৮/৯ হাজার টাকা লাগবে। আরো বেশি লাগতো কিন্তু ও নাকি রিকুয়েস্ট করে কমিয়েছে। আর এটাও বললো যে টাকাটা আগে বিকাশ করে হবে। পরে ভাবিকে জানালাম, ভাবির খালু জানালো যে আগে কাজ হবে পরে টাকা হাতে দিবো। আমি চাচ্ছিলাম না যে আগে টাকা দিয়ে কাজটা হোক, কারণ কাজ না হলে পরে আমি লজ্জায় পড়ে যাবো। এইদিকে বড় বোনের ননদের মেয়েও ট্রান্সফার হতে চায়, আপু আর দুলাভাই ফোন দিয়ে প্রেসার দিতে লাগলো। যতই ঝামেলা এড়িয়ে যেতে চাচ্ছি ঝামেলা ততই যেনো আমাকে ঘিরে ধরছে। আমি ওদেরকে জানালাম যে আর কিছুদিন সময় লাগবে, পরে সবাই একটু শান্ত হয়।
এরপর আমার এক পরিচিত আপু একটা ঝামেলায় পড়লো, আমাকে জিজ্ঞেস করলো এনএসআই এর কারো নাম্বার দিতে পারবো কিনা। তখন আমার সাবরিনা ভাবির কথা মনে পড়লো। তারপর সাবরিনা ভাবির থেকে ভাইয়ার নাম্বার নিয়ে আমার পরিচিত আপুটাকে দিলাম। এইদিকে ভাইয়া, মানে যিনি ডাচ বাংলা ব্যাংকে জব করেন তিনি আবিরের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। পরে তিনি ভাবিকে ফোন দিয়ে জানালেন যে, আবির তার সাথে ভালো করে কথা বলেনি এমনকি পরিচয়ও ঠিকমত দেয়নি। এরপর আবির আমাকে ফোন দিয়ে ঝাড়লো। কেন আমি তাকে সময় দিচ্ছি না, এতো তাড়াহুড়া কেন আমার, সময় হলে ও নিজেই মামাকে অফিসে নিয়ে যাবে। এই কথাগুলো শুনে আম্মা আর ভাবির উপর অনেক রাগ হলো। ভাবিকে বললাম, আপনারা এতো তাড়াহুড়া কেন করতেছেন। ভাবি জানালো, বড় মামা বলছে হলে এখনই না হলে নাই। এই বিষয়টাকে বেশি বাড়ানো উচিত না। এইকথা শুনে আমিও আর কিছু বললাম না। কিছুদিন পর আবির কল দিয়ে জানালো আর আমার সাথে দেখা করবে।
আমি বললাম যে, আগে মামা দেখা করবে পরে আমি দেখে করবো। পরে আবির মামাকে ফোন দিয়ে দেখা করার সময় ফিক্সড করলো। আগের দিন মামার সাথে দেখা করবে আর পরের দিন আমার সাথে। ইজতেমার জন্য বের হতে পারবো না, তাই আগের দিন কাজিনের বাসায় চলে আসলাম। ঐদিন সন্ধ্যায় ভাবি আর মামা ফোন দিয়ে জানালো যে আবির দেখা করে নাই। এই নিয়ে মামা আমার সাথে ভালোই রাগ করলো। আমিও আবিরকে ফোন দিয়ে সেই রাগারাগি করলাম, বললাম যে আমার সাথে যেনো আর যোগাযোগ না করে। ও অনেক মাফ চাইলো আর বললো, ভার্সিটির সিনেট ইলেকশন ছিলো তাই আসতে পারিনি। পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ও মেসেজ দিয়েছে যে ও আমার বাসার সামনে। আমি প্রথমে মজা ভাবছিলাম পরে দেখি আসলেই আসছে। আমি ওরে বললাম চলো বড় আপুর বাসায় যাই। ও বললো যে দুলাভাই থাকলে যাবে না।
আমি বললাম দুলাভাই অফিসে এখন। ও কিছুক্ষণের মধ্যেই ও আপুকে পটিয়ে নিলো। এমন সময় ভাবি কল দিয়ে জানালো আমাদের ঐ আত্মীয় আবিরের অফিসে গিয়েছিলো, কিন্তু এই নামের কাউকে পায়নি। আমি কি বোকা আবিরের সামনেই সব বলে দিলাম। আবিরের মুখটা কালো হয়ে গেলো, ও দ্রুত কথার টপিক চেঞ্জ করে ফেললো। ও বললো আজকেই ট্রান্সফারের কাজটা করে দিতে পারবে। এরপর আমি ভাবিকে ফোন দিলাম যে কাজটা করাবে কিনা, ভাবি বললো আগে কাজ হবে পরে টাকা দিবে। এই কথা শুনে আবির রেগে গেলো আর বললো করবো না এই কাজ। এইটা শুনে আমি তো মহা খুশি, যাক একটা ঝামেলা কমলো। কিছুক্ষণ পর আবির আবার বলতে শুরু করলো, আমার ফ্রেন্ড কাজটা প্রায় করেই ফেলছে এখন না করলে ও খুব রাগ করবে।
তাছাড়া ওর সাথে আমার রিলেশনও নষ্ট হয়ে যাবে। ওর শুকনা মুখ দেখে আমি দুলাভাইকে ফোন দিয়ে বললাম ট্রান্সফারের জন্য ১০হাজার টাকা পাঠাইতে। দুলাভাই সাথে সাথেই টাকাটা বিকাশ করে দিলো। আবির দুলাভাইকে বললো মেয়েটাকে নিয়ে ভার্সিটি চলে যেতে, মেয়েটার সাইন লাগবে। আবির বিকাশ থেকে টাকা তুলে আমার হাতেই দিলো আর বললো তোমার হাতেই থাক পরে চেয়ে নিবো। আপুর থেকে বিদায় নিয়ে বাসে উঠলাম শাহবাগ যাবো বলে, ঐখান থেকে ওর ফ্রেন্ড টাকা নিয়ে যাবে। বাসে থাকা অবস্থাতেই ও আমাকে বললো চলো আজকেই তোমার মামার সাথে দেখা করি, কালকে তো অফিস থাকবে। এটা শুনে আমি অনেক খুশি হলাম, এইবার মামার রাগ ভাঙ্গবে। আমি বললাম, মামাকে ফোন দিয়ে জেনে নাও উনি কোথায় আছেন। মামা আমাদের পুরান ঢাকার একটা প্লেসে যাইতে বললেন।
এরপর আমরা ধানমন্ডি স্টার কাবাবে দুপুরের খাবার খাইলাম। খাওয়ার সময় ও একজনকে ফোন করে অনেক রিকুয়েস্ট করলো ট্রান্সফারের কাজটা যেনো দ্রুত হয় এর জন্য। আমারও বিশ্বাস চলে আসলো যে ও কাজটা পারবে।
এরপর একটা কল আসলো ওর বন্ধু নাকি টাকা নেওয়ার জন্য আসছে। ও বাইরে গেলো টাকা দিতে, আমি ভাত খাচ্ছিলাম তাই আর যাইনি। এরপর পুরান ঢাকার দিকে রওনা দিলাম, বাসে বসে ও ওর ফ্রেন্ডকে কাজটা তাড়াতাড়ি করে দেওয়ার জন্য রিকুয়েস্ট করলো আর আমার দুলাভাইয়ের সাথেও কথা বললো। মামার সাথে দেখা হওয়ার পর মামা আমাকে বললো তুমি কেন আসছো? যাও তুমি বাসায় যাও আমি ওর সাথে কথা বলছি, এই বলেই মামা পাশের এক দোকানে ডুকলো। পাশেই বাস স্ট্যান্ড ছিলো, আবির বললো যে চলো তোমাকে বাসে তুলে দেই। তুমি দুলাভাইয়ের কাছে যাও আমি মামার সাথে কথা বলে আমার ফ্রেন্ডকে নিয়ে আসতেছি। আমি বাসে উঠার আগে ফোনে রিচার্জ করতে চাইলাম, ও বললো যে ও রিচার্জ করে দিবে। কিছুক্ষণ পর মামা ফোন দিয়ে বললো ছেলে কই রে? আমি বললাম ঐখানেই তো ছিলো।
মামা পরে বললো ওরে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস কর কই আছে। এইদিকে আমার ফোনে টাকাও নাই। প্রায় ৩০ মিনিট পর ফোনে টাকা আসলো,আমি ওকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম মামাকে না বলে কই চলে গেছো তুমি? ও বললো যে আমি তো ঐখানেই ছিলাম। একটু পর ফোন দিয়ে দেখি আবিরের ফোন সুইচড অফ। এইদিকে আমি টেনশনে শেষ। এরমধ্যে মামা ফোন দিয়ে জানালো আবির মামাকে ফোন দিয়ে বলছে যে ওর একটা কাজ ছিলো তাই চলে গেছে। এই কথা শুনে রাগে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। ভার্সিটি গিয়ে দুলাভাইয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছি, ওর কোনো খোঁজ নাই। সন্ধ্যার আজান দিয়ে দিলো তাও ওর কোনো খবর নাই।
লজ্জায় দুলাভাইকে মুখ দেখাতে পারছিলাম না। ব্যপারটা দুলাভাই বুঝতে পারলো, ভাইয়া বললো তুমি এতো টেনশন নিও না। টাকা গেলে গেছে কিন্তু তুমি শক্ত থাকো। ভাইয়া আমার অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলো। আমি বললাম ভাইয়া আমি আপনার টাকা দিয়ে দিবো, আমি এখন বাসায় যাবো। এই বলে আমি ভীড়ের মধ্যে দুলাভাইকে রেখেই বাসে উঠে গেলাম। আমাকে বাসায় গিয়ে যে করেই হোক ওর সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। আর এটাও প্রুভ করতে হবে আমার সন্দেহ সত্যি কিনা। ততক্ষণে বাসার সবাই সব জেনে গেছে। এতো ভয়ংকর একটা দিন ছিলো। বাসায় গিয়ে এক ঘন্টার মধ্যে সব বের করে ফেললাম। বাসায় গিয়ে সাবরিনাকে নক দিলাম সব জানাবো বলে,কিন্তু কি ভেবে জানালাম না। পরে ভাবলাম সাবরিনার আইডি হ্যাক করবো।
একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে হ্যাক করার পদ্ধতি কিছুটা আমার জানা আছে। পরে লিগ্যাল ওয়েতে আইডিটা হ্যাক করলাম। আইডি হ্যাক করে বুঝতে পারলাম এইটা ঐ ছেলেরই আইডি। একদিকে আম্মা বকাঝকা করতেছে আরেক দিকে ভালোবাসার মানষের এই রূপ। হার্ট এট্রাকের উপক্রম হয়ে গিয়েছিলো। ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেলো। একটা বাটপারের সাথে সারাদিন ছিলাম এই ভেবেই গা শিউরে উঠলো। পরের ২ দিন আবিরের সাথে ভালো করে কথা টাকা ব্যাক করার ট্রাই করলাম, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। পরে মাথায় আসলো যে ও হয়তো আমার ফ্রেন্ডের টাকাও দেয়নি। পরিবারের সবাই আমাকে বুঝালো যে থাক বাদ দে, টাকা যা যাওয়ার গেছে। কিন্তু তোর যে কিছু হয়নি সেটাই অনেক। পরিবারের কাছে সারাজীবনের জন্য আমি ছোটো হয়ে গেলাম, নিজের রেপুটেশন একবারে মাটির সাথে মিশে গেলো।
এই ছিলো একজনের অন্ধভাবে ভালোবাসার পুরস্কার। ভালোবাসা আসলেও অন্ধ হয়, আর এতোটাই অন্ধ হয় যে ভালোবাসার মানুষের কোনো অপরাধই চোখে পড়ে না। এই মেয়েটা হয়তো আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে ভয় পাবে, কারণ একজন পুরুষের খারাপ রূপটা সে দেখে নিয়েছে। এইখানে মেয়েটার কোনো দোষ নাই। কারণ মেয়েটা ছেলেটাকে পাওয়ার জন্য ওর পুরো ফ্যামিলিকে নিয়ে আগাচ্ছিলো। হায়রে মানুষ!! জীবনে কি এতোই টাকার অভাব? আজ মরলে কাল দুইদিন, তাহলে কি হবে এতো টাকা দিয়ে?
গল্পের বিষয়:
গল্প