আম্মা যেদিন মারা গেল, সেদিন আব্বাকে কাঁদতে দেখেনি। ১১ বছর বয়সে সেদিন ভেবেছিলাম, হয়তো আব্বা আম্মাকে ভালোবাসেনা। তাই কাঁদেনি। কিন্ত, এটা কখনো ভাবিনি, মানুষ অতিরিক্ত শোকে পাথরে পরিণত হতে পারে। সবাই যখন আম্মাকে কবরে শোয়াতে ব্যস্ত। তখন আমি ভয়ে তটস্থ হয়ে আছি এই ভেবে, সৎ মা আসবেনা তো? আম্মার চল্লিশা হয়ে গেল। আমার মনে আম্মার মৃত্যুর শোক, সাথে সৎ মায়ের ভয়ের ঝর। ঠিক এর পরের দিন সকালেই আব্বাকে বলা আত্মীয়-স্বজনের নানা কথা কানে এলো আমার।
— ‘মেয়েকে একা কোনদিন মানুষ করতে পারবি? ওর তো একটা সঙ্গী দরকার। এভাবে তো আজীবন চলবে না।’–
— ‘তোর তো আর সন্তান নেই। সম্পতি কে সামলাবে? মেয়েরা সম্পতি সামলাতে পারে নাকি?’–
— ‘ এই অনাথ মেয়েকে কে বিয়ে করবে? মা ছাড়া মেয়েকে কে বাড়ির বউ করবে?’
আমার খুব কান্না পেয়েছিল সেদিন। কষ্ট নিয়ে চিন্তা করেছিলাম, সৎ মা কি খুব দরকার? পরেদিনই বাবা নিয়ে এলেন এক উপহার। ভয়ের উপহার। সৎ মা! ঘরে বসে কান্না করা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না আমার। পরের দিন আমি আবারো কান্না করেছিলাম, না সৎ মায়ের জন্য নয়। রক্তে ভেসে গিয়েছিলো সারা শরীর। ঘরে বসে কাঁদছিলাম, এসময় মেয়েদের সবচেয়ে দরকার মাকে। আমার তো সেটাই নেই। তখন ঘরে এলেন নতুন মা। সৎ মা আর না বলি। তাকে দেখে আমার কান্না আর ভয় দ্বিগুণ হলো। হয়তো এখনি আমাকে মেরে ঘরের সব কাজ করাবেন। না, সেটা হয়নি। তিনি আমাকে অবাকের উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বললেন,
— ” বেশী কষ্ট পাচ্ছিস? ভয় পাস না। এসময় ভয় পেলে হবে না। আমাকে তুই সৎ মা ভাবতে পারিস, কিন্ত আমি তোকে সৎ মেয়ে ভাবি না। তাই তোর সব কথা আমাকে বলবি। তোর সবকিছুর দায়িত্ব আমার। বুঝলি?”
আমি কান্না থামিয়ে হা করে তাকিয়ে ছিলাম। তিনি আমাকে একটা জিনিস দিয়ে বললেন,
— ” এটা পরে নিয়ে খেতে আয়। এসময় ভালো খাবার না খেলে আরো অসুস্থ হয়ে পরবি তো!” সেদিন তাকে নিজের মায়ের স্থান দিতে না পারলেও, তার প্রতি বিশ্বাসের স্থান তৈরি হয়েছিলো। একজন মা তার সন্তানকে যেভাবে যত্ম করে সবসময়, সেভাবেই তিনি আমাকে যত্ন করতেন, ভালোবাসতেন। তবুও আমি তাকে নিজের মা ভাবতে পারিনি। কোনদিন মা পর্যন্ত ডাকিনি। এ নিয়ে তার আফসোসের শেষ ছিলো না। সবসময় বাবাকে বলতেন,
— ” আমি কি কোনদিনও মিহির আসল মা হতে পারবো না?” বাবা তার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। আর আমি এসব দেখে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকতাম তাদের দিকে।
এরপর পেড়িয়ে গেল অনেকটা সময়। বড় হয়েছি আমি। তখন কলেজে পড়ি। তার চুল পেকে গেলেও ভালবাসা একটুও কমেনি। আমি তাকে পাত্তা দিতাম না। কখনো প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলতাম না। কিন্ত, তিনি হাসিমুখে আমার সব দায়িত্ব পালন করতেন। আমাকে সবসময় নজরে রাখতেন। কিন্ত, সেই নজরের মধ্যেও আমি ভুল করে বসি। এক হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে পরি। যার ফলাফল হয় ভয়াবহ।ঠকে গিয়েছিলাম সেই ভালোবাসার মানুষের কাছে। তখন নতুন মা-ই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সাহস জাগিয়েছিলেন। অতীতের ভুল ভুলে ভবিষ্যতে এগিয়ে যেতে বলেছিলেন। আমার কষ্টের ভাগ নিয়েছিলেন। ৫ বছর পর, আমি প্রথম যেদিন একজন সফল বিজন্যাস ওমেন হিসেবে পরিচিতি পাই, সেদিনই সুখ আমায় রেখে চলে গেল। ব্রেন হ্যামারেজ ছিল। হসপিটালে নেয়ার পর মা কয়েক ঘন্টা বাঁচতে পেরেছিলেন। হ্যাঁ.. সেদিন প্রথম মা ডেকেছিলাম তাকে। তার শেষ কথাটা ছিলো,
— ” আমাকে একবার মা বলে ডাকবি?”
বলেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। একবার মা ডাকারও সুযোগ পাইনি। চিৎকার করে ডাকলেও তিনি আর সুযোগ দেননি। তারপর নিজেকে শক্ত করে গড়ে তুললাম। কোন জিনিসের পরোয়া করিনি কোনদিন। নিজের স্থান নিজে তৈরি করে নিতে শিখেছি। সমাজে মা ছাড়া কিভাবে চলতে হয় তা শিখেছি!” চোখ বন্ধ করে এক শ্বাসে কথাগুলো বলে থামল মিহি। বেষ্ট বিজন্যাস টাইকুন এওয়ার্ড হাতে নিয়ে তার বলা কথাগুলো শুনে বাকিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা কথা বলতে ভুলে গিয়েছে। তবে, ক্যামেরা চালু থাকায় সবকিছু লাইভ দেখছে সারা দেশের মানুষ। মিহির চোখে পানি, ঠোঁটে হাসি। সে আবার বলে,
— ” আমার এই পর্যন্ত আসার সব কৃতিত্ব আমার মা, আর নতুন মায়ের।” কথা শেষ করেই স্টেজ হতে নেমে গেটের দিকে দৌড়ে গেল মিহি। সাংবাদিকরাও তাড়াহুড়া করে সেদিকে গেল। তবে, মিহির কাছে যাওয়ার আগেই গার্ডরা আটকে দিলো তাদের। মিহি গাড়িতে ওঠার আগ মুহূর্তে কেউ মৃদু স্বরে তাকে ডাকল,
— ” মিহি!” মিহি ফিরে তাকায়। মানুষটাকে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। তার কাছে যাওয়ার পর ব্যক্তিটি অবাক স্বরে বলে,
— ” তুমিহ!” মিহি তাচ্ছিল্যর হাসি হাসে। বলে,
— ” অবাক হচ্ছেন কেন? আমি আপনার প্রেমে অন্ধ হয়ে আত্মহত্যা না করে কিভাবে এতদূর আসলাম তা ভেবে? বাই দ্যা হয়ে, আপনিও শুনলাম বেষ্ট ইয়ং বিজন্যাসম্যান এওয়ার্ড পেয়েছেন। সো কনগ্ৰেচুলেসনন!” সামনে থাকা ব্যক্তিটি মিহির কথায় শুধু মাথা নিচু করে চলে যায়। মিহি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে চলে আসে বাসায়। নিজের রুমে দৌড়ে এসে সেই পুরষ্কারটা দু’টো ছবির সামনে রাখে। একটা তার নিজের মায়ের, অন্যটাও তার মা’য়ের। তবে সে নতুন মা। মিহি প্রথমে নিজের মায়ের ছবিতে তাকিয়ে বলে,
— ” মা, আজকে আমার এই পুরষ্কারের পাওয়ার জন্য কৃতিত্ব তোমার অনেক। তোমার সাথে শুরু হয়েছিলো আমার প্রথম জ্ঞানার্জন। সেখান থেকে এ পর্যন্ত আসার প্রতিটা পদে এক অদৃশ্য শক্তি তুমি আমায় দিয়েছো। তাই তোমাকে অনেক ভালবাসি।” এরপর আরেক মায়ের ছবিতে তাকাতেই কথা আটকে গেল তার। কোনরকমে বলল,
— ” এখন আমি বুঝতে শিখেছি, সব সৎ মা-রা এক হয় না।”
গল্পের বিষয়:
গল্প