তিন বছরের রিলেশনের পর বিয়ে হয়েছিল খুব ধুমধামেই।দুই পরিবারের সবারই সম্মতি থাকলেও আমার শাশুড়ী মার একটু আপত্তি ই ছিল।তার বোনের মেয়ে মানে আমার খালাশাশুরীর মেয়ের সাথে আলিফের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।কিন্তু একমাত্র ছেলের ইচ্ছার কাছে পেরে উঠেননি।তারউপর আমার বাবার মানে শশুড়ের ইচ্ছাও ছিল প্রবল তাই আমাকে বৌমা না বানিয়ে উপায় ছিল না।আমি আমার বংশের সবথেকে বড় মেয়ে।আমার থেকে ছোট যে ভাইটি সেও আমার দশ বছরের ছোট হবে।
ছোট থেকে চাচা চাচি দাদা দাদি থেকে শুরু করে পাড়ার প্রতিটা মানুষের ই ভালবাসা পেয়েছি।তাই ছোট থেকেই যথেষ্ট জেদি আর একগুঁয়ে। আমার বিয়েতে পুরো পাড়া যেন সেজেছিল নতুন উদ্দমে পাখিরাও যেন নতুন পেয়েছিল নতুন ভাষা।চারিদিকে আলোকসজ্জা কত সুন্দরই ছিল না দিন টা!
*আলিফ ছিল প্রচুর গম্ভীর আর স্বল্পভাষী। আর এদিকে আমি ওর উলটো।প্রচুর চঞ্চল আর সারাদিন বক বক করতাম।কিভাবে যে আমাদের মাঝে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা ভাবলে এখনো অবাক লাগে।অবশ্য কথায় আছে চরিত্রে বৈসাদৃশ্য থাকলেই নাকি সম্পর্ক জমে বেশি কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কেন উল্টো টা হল তা বুঝতে পারিনি।আমি হলফ করে বলতে পারি আমার দেখা পুরুষ বা ছেলেদের মধ্যে সব থেকে সুন্দর আলিফ।বাঙ্গালি মেয়েরা তার স্বামি কে সুদর্শন বলে প্রশংসার জন্য কিন্তু আমি মিথ্যে বলছিনা।কে জানত যে ওর রুপ ই ওর কাল হয়ে দাঁড়াবে।
ইউনিভার্সিটির মেয়েদের লিডার ছিলাম আমি।র্যাগ দেয়া থেকে শুরু করে কোন অনুষ্ঠান এ কি আয়োজন হবে এসব আমাকে না জানিয়ে কেউ করার সাহস পেত না।আলিফ কে অনেক মেয়েই মনে মনে পছন্দ করত কিন্তু আমার বয়ফ্রেন্ড জন্য কেউ চোখ তুলেও তাকাতে পারত না।আলিফ অবশ্য আমার এই ধরনের ব্যবহার মোটেও পছন্দ করত না ও অনেকবার আমাকে বলেছে লিডারশীপ ছেড়ে দাও তো।ও বলত “তুমি কি নরমাল হবে না?মাঝে মাঝে তোমাকে দেখে আমার নিজেরেই ভয় হয়।” আমি উত্তরে বলেছিলাম ভয় পাওয়া তো ভালই।আমরা একসাথে অনেক ঘুরেছি খেয়েছি।অনেক মধুর ছিল দিনগুলো। কখনও কখনও ওর হাত ধরেই দুই তিন ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম।ও অবশ্য কখনই আমার হাত ধরেনি সেচ্ছায়।আমি ভাবতাম হয়ত ও নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল অনেক বেশিই।
ও অনেকবারই আমাকে বলেছে ”আচ্ছা তুমি যে আমায় এত ভালবাস আমি কি তোমার ভালবাসার মর্যাদা দিতে পারব?”আমি হেসে বলতাম পারবেনা কেন।ভালবাসলে ভালবাসা পাওয়া যায়।আমি তোমাকে যতটুকু ভালবাসব বিনিময়ে তুমি ততটুকুই দেবে।ও চুপ হয়ে থাকত আমি আবারও বক বক করা শুরু করে দিতাম।আমি ওকে পাগলের মত ভালবাসতাম।বাসতাম বলছি কেন এখনও বাসি।কিন্তু ও আমার ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারেনি। বিয়ের প্রথম ক’দিন ভালই কাটছিল।তবে আমার শাশুড়ী মা আমার কাজ নিয়ে একটু আকটু বলত কিন্তু আমি ওত টা আমলে নিতাম না।কয়েকদিন ঘুরাঘুরি শপিং ডিনার সব মিলিয়ে অনেক সুন্দর দিন কাটাচ্ছিলাম।আমার সাথে ঘুরতে গেলে ও সবসময় মাথা নিচু করে থাকত।
কখনও মেয়েদের দিকে তাকায়নি হয়ত আমার ভয়ে।একদিন একটা রেস্টুরেন্ট এ খেতে গিয়েছি এক মেয়ে কয়েকবার আলিফের দিকে তাকিয়েছে বিষয়টা আমি খেয়াল করছিলাম আলিফ অবশ্য বার বার বলছে খাচ্ছো না কেন।আমি ওই মেয়ের সাথে ঝগড়া পর্যন্ত করতে গিয়েছিলাম।সেদিন আলিফ হালকা রাগ করেছিল আর বলেছিল”এই সামান্য কারণে তুমি পাবলিক প্লেসে এভাবে সিনক্রিয়েট করতে পারলে?আর আমি তো তাকাইনি ওই মেয়ের দিকে তাহলে সমস্যা কোথায়?”আমি ওকে বলেছিলাম অনেক সমস্যা। তোমাকে হারানোর অনেক বেশি ভয়।ও শুধু বলত “আমাকে এভাবে পাগলের মত ভালবেসো না আর তোমার রাগ কমাও।” আমি ওর জন্য রাগ কমিয়েছিলাম অনেক টাই।নিজেকে চেইঞ্জ করেছিলাম। ওর জন্য রান্না করে অফিসে নিয়ে যেতাম।রাতে ওর পছন্দের শারী পরে সেজে থাকতাম।কত কিই না করেছি এখন ভাবলে হাসি পায়।
আমাদের বিয়ের দেড় মাস পর আলিফের খালাতো বোন আসে বেড়াতে।ওর বোনের নাম অয়নী আর এই অয়নীর সাথেই আলিফের বিয়ে দেয়ার চিন্তা করেছিলেন মা।অয়নী অবশ্য আলিফের মতই সুন্দর।শুধু সুন্দর ই না ওর কন্ঠ ও মধুর কিন্তু আমি ওকে মোটেও সহ্য করতে পারতাম না কারণ যতই হোক আমার আলিফের সাথে ওর বিয়ের চেষ্টা করা হয়েছিল।ক’দিন থেকে আলিফ আমাকে ইগনোর করছে।রাতে বিছানায় অন্যপাশ ঘুরে শোয়।আমিই যেচে ওর বুকে মাথা দেই কিন্তু ও আমাকে টেনে নিত না।
আমি কষ্ট পেয়েছি অনেক কিন্তু বুঝতে দেইনি।অয়নী চলে গেল কয়দিন পরেই।আলিফ সবসময় ফোনে বিজি থাকত কখনও কথা বলত তো কখনও এমনিই ফোন নিয়ে থাকত।আমি ওকে জিজ্ঞেস করতাম কি এত ফোনে তোমার?ও উত্তরে হেসে বলত আরেকটা সংসার।আমি আর কিছু বলতাম না।দিনে দিনে আমাদের মাঝে দূরত্ব টা বাড়তেই আছে।রাতে প্রায়ই দেখতাম কার সাথে যেন মেসেজিং করে।অনেকবার জিজ্ঞেস ও করেছি কিন্তু ও তেমন কিছুই বলেনি।মাঝে মাঝেই ওকে ধরে কাদতাম আর বলতাম তুমি এমন হয়ে যাচ্ছো কেন?ও বলত “তুমি একটু বেশিই ভাবছো।”আমাদের দিন গুলো এভাবেই যাচ্ছিল।ক’দিন পর আবারও অয়নী আসল এবার ওকে আরও বেশি অসহ্য লাগছিল।মা আর অয়নী সবসময় কি যেন গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করে আমাকে দেখলেই চুপ হয়ে যায়।
সেদিন রাতে আমার ঘুম হঠাৎ ভেঙ্গে যায়।ঘুম ঘুম চোখেই বিছানা হাতরিয়ে দেখি আলিফ নেই।বাথরুমেও চেইক করলাম সেখানেও নেই।কিচেন ড্রয়িং সব চেইক করলাম নেই ও কোথাও।কিঞ্চিৎ সন্দেহ হচ্ছিল। অয়নীর রুমের দরজা টা খোলা।কেন জানি কোন একটা শক্তি আমায় ওইদিক ঠেলছিল আমিও এগুচ্ছিলাম।আলিফ আর অয়নীকে খুব অপ্রিয়কর অবস্থায় দেখে ফেলি কিন্তু ওরা আমার উপস্থিতি বুঝতে পারেনি।আমি চলে আসলাম নিজের রুমে শুয়ে পড়লাম।পরের দিনই অয়নী চলে গেল।আমি দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছিলাম আলিফ বলত ” তোমার কি কিছু হয়েছে?ডাক্তার দেখাতে হবে?”আমি ওকে বলতাম মনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল।ও বলত ‘সবসময় ফাজলামো কোরো না তো।”আরও কয়েকটা দিন কেটে গেল।
খুব চিন্তাভাবনা করেই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড অবনী কে কল দিয়ে বললাম “আমি তোর কাছে কিছু জিনিস চাইব তুই কোন কিছুর কারণ জানতে চাইবি না”। ও আমায় বলল” কি এমন জিনিস চাই তোর?”আমি বললাম এসিড।অবনী অরগানিক কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়া শোনা করেছে এখন একটা প্রাইভেট কম্পানিতে কাজ করছে।যেকোনো কেমিক্যাল কালেক্ট করা ওর কাছে খুবই সামান্য ব্যাপার।ও অবাক হয়ে বলল “হঠাৎ এসিড কেন?” আমি ওকে বললাম আমি তো আগেই বলেছি তুই কারণ জিজ্ঞেস করবিনা।ও বলল,”আচ্ছা ঠিক আছে কাল নিস এখন।”
পরেরদিন বিকালে এসিড টুকু নিয়ে এলাম।রাতে আলিফের পছন্দের সব খাবার রান্না করেছি।ওর পছন্দের শারী পরে সেজে আছি।শারী টা ও বিয়েএ পর পর ই কিনে দিয়েছিল।আজ একটু বেশিই ভালভাবে সেজেছি।ওর আসার জন্য অপেক্ষা করছি। এসে খেয়ে আমার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে বলল,”আজ হঠাৎ এভাবে সেজেছো?কোন স্পেসাল ডে আজকে?”আমি বললাম তুমি চাইলে সব দিনই স্পেশাল। ও হেসে হেসে বলল,”আজ কিন্তু একটু বেশিই সুন্দর লাগছে তোমায়।”আমি বললাম হয়ত আজ তুমি সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছো তাই।ও আর কিছু বলল না।
অনেকদিন পর সেচ্ছায় আমাকে টেনে নিয়েছে আজ। রাত আড়াইটা পার হয়েছে আলিফ ঘুমিয়েছে আমার চোখে ঘুম নেই।ডিম লাইটের আলোয় ভালভাভে দেখে নিলাম।খুব আলতো করে ওর মাথা বুলিয়ে দিলাম।ঘুমালে কত সুন্দর ই না লাগে আর এই সৌন্দর্যের জন্যই হয়ত আলিফ বিবাহিত হওয়া স্বত্তেও অয়নী ওকে পছন্দ করে।না এই সৌন্দর্য শুধুই আমার।ওর সৌন্দর্য না থাকলে নিশ্চয়ই অয়নী আর ফিরেও তাকাবে না।এসিডটুকু ওর মুখে ছুড়তেই চিল্লানো শুরু করেছে বাবা মা ঘর থেকে চলে এসেছে।আমার কষ্ট হয়েছিল খুব কিন্তু আমি তো নিজের ভালবাসাকে না হারানোর জন্যই এমন টা করেছি।ওকে হাসপাতালে নেয়া হল আর আমাকে জেলে।
এখানে আর থাকতে ভাল্লাগছেনা।জেলে ছিলাম তাই হয়ত ভাল ছিল।একটু পর পর এসে ইঞ্জেকশন দিয়ে যায়।জেলে গিয়ে চুপচাপ ছিলাম আমি। আমার পাশের কয়েদি গুলো বার বার ক্ষেপাতো। আমাকে বলত আমি নাকি স্বামী নির্যাতন করেছি।আমি ডায়নি স্ত্রী।আরও অনেক কথা আমি চুপ করে শুনেই যেতাম।রাতে ঘুমের মাঝেই নাকি হেসেছি জোরে জোরে। কখনও কেদেছি । আমার এসব লক্ষ্মণ দেখে জেল থেকে মেন্টাল আ্যসাইলামে সিফট করে দিল।বাবা মা আসে মাঝে মাঝে দেখতে।
শুনেছি আলিফের মুখটা এখন বিকৃত হয়ে গেছে এখন আর ওর দিকে দেখলেই ভয় লাগে।যদিও আর একটি বারের জন্যও আলিফ দেখা দেয় নি।কিন্তু আমি ভয় পাব না বরং ভালবাসব।নিজের স্বামী যেমনই হোক তাকে ভয় নয় ভালবাসতে হয়।আমি বার বার আলিফের কাছে যেতে চাই এরা আমায় যেতে দেয় না। আমি এত করে বুঝাচ্ছি যে আমি পাগল নই এরা কেউ বিশ্বাস ই করেনা।আজকাল খুব খারাপ লাগে। সব নার্স গুলো ও আমাকে স্বামী নির্যাতন কারী বলে ক্ষেপায়।ওই যে একজন আসছে ইনজেকশন পুশ করতে।
গল্পের বিষয়:
গল্প