ঘুম থেকে উঠে শোনতে পেলাম, কিচেনের দিক থেকে আমার সাত মাস বয়সী ছেলে আদনানের কান্নার আওয়াজ। কিচেনের দিকে গিয়ে দেখি; আমার স্ত্রী শান্তা চুলার এক পাশে আটার রুটি ছেঁকতেছে। আদনানকে কোলে নিয়ে চুলার অপর পাশে আদনানের জন্য দুধ গরম করছে। শান্তা পিছন ফিরে তাকিয়ে, আমাকে দেখে বলল; যাও তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো; আমি টেবিলে নাস্তা নিয়ে আসছি। সকালের ভ্যাপসা গরমে শান্তা ঘেমে একাকার। ওয়াশরুমে গিয়ে দেখি দুই বালতি কাপড় ভিজিয়ে রাখছে কিছু না ভেবেই দাঁত ব্রাশ শেষ করে, কাপড় কাচতে শুরু করলাম। শান্তা টেবিলে নাস্তা দিয়ে, শান্তা খাটের উপর পা মেলে আদনানকে শুয়িয়ে চামিচ দিয়ে আদনানের মুখে দুধ দিতে দিতে বললো; আম্মা আপনার ছেলেকে একটু বলেন, আমি টেবিলে নাস্তা দিয়ে আসছি।
আমি ওয়াশ রুম থেকেই শুনছিলাম শান্তার কথা গুলো আম্মা ওয়াশ রুমের দিকে এগিয়ে এসে বললো ওমা ওমা আমার ছেলেটা এত বউ পাগল হইলো কবে? আম্মার কথার কোন উত্তর না দিয়ে কাপড় কাচতে লাগলাম। আম্মা শান্তাকে গিয়ে বললো বৌমা আমাকে বলেই পারতে, আবিরকে কেনো কাপড় কাচতে বলছো শান্তা আম্মার কথা শোনে ওয়াশ রুমের সামনে এসে বলল? এই তোমাকে কি কাপড় কাচতে বলছি, আমিই তো বাবুকে দুধ খায়িয়ে এসে কাচতাম। তোমার কাপড় কাচা পরিষ্কার হবে না, রাখো; আমি আসতেছি। এবার শান্তাকে একটা মুচকি হাসির সাথে বললাম, ছয় বছর ম্যাচে থেকে পড়াশোনা করছি, নিজের কাপড় নিজেই ধুয়ে পড়ছি। তোমার কাছে কাপড় কাচা শিখতে হবে না আমার! শান্তা আমার গা ঘেষে ওয়াশ রুমের ভিতরে ঢুকে কাপড় গুলো পানিতে চুবাইতে লাগলো।
অফিসের টাইম হয়ে গেলো, নাস্তা করে বের হয়ে গেলাম। একসময় শান্তাও চাকরি করতেন। আব্বা ঢাকার বাহিরে থাকতেন। শান্তার আর আমার অফিস টাইমে আম্মা আমাদের ঢাকার বাসায় একা থাকতে হবো। বিভিন্ন নাটকের সিরিয়াল, পত্রিকা পড়েই সময় কাটাতেন। তাই বাসায় সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে ছিলাম। যাতে অফিস থেকে আম্মার অবস্থান খেয়াল রাখতে পারি। বাসায় একা থাকেন কখন কোন অসুবিধা হয়ে যায়। বলা তো যায় না। আজ একটু কৌতহল নিয়ে পিসিতে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চালু করলাম। কারণ শান্তাকে আমি অফিসে বসে সারাক্ষণ ফেসবুকে অনলাইনে দেখতে পাই। তো কাজও তো করতে হয়, আচ্ছা একটু দেখি কি করে দেখলাম শান্তা নাস্তা করতে পাশে আদনানকে বসিয়ে চিমটি চিমটি রুটি আদনানের মুখেও দিচ্ছে। বাবা এসে বললে বৌ মা একটু চা বানিয়ে দিয়ো তো?
শান্তা চলে গেলো বাবার জন্য চা বানাতে,,,,চুলায় গরম পানি বসালো। এখনো পানি ঝরা কাপড় গুলো বালতিতেই পড়ে আছে কোথাও মেলানো হয়নি। শান্তার নাস্তার পেলেটে একটা রুটি পড়ে আছে। শান্তা চুলায় পানি গরম দিয়ে আদনানকে ঘুম পড়াতে চলে গেলো। শান্তা আবার নিজের রুমে ঢুকলো বাকি রুটিটা শান্তা খেয়ে নিলো। অফিসের কাজ করছিলাম ফাঁকেফাঁকে সিসিটিভির ফুটেজে চোখ রাখছিলাম। আদনানকে ঘুম পাড়িয়ে আম্মার রুমের দিকে শান্তা পানের ভাঁটা নিয়ে যাচ্ছে। আব্বাকে চা দিয়ে এবার বালতি ভর্তি কাপড় নিয়ে ছাঁদে গেলো। দুইবারে দুইটি বালত কাপড় ছাদে নিলো। এবার ছাদ থেকে কাপড় মেলিয়ে নিজের রুমে এসে ফ্যানটা ছেড়ে বেচারি একটু বসলো আদনানের ঘুম শেষ। আবার আদনানের দুধ গরম করতে চুলায় গেলো। আদনানকে দুধ খায়িয়ে ফ্রিজ থেকে মাছ নামিয়ে পানিতে ভিজালো। রান্নাবান্না শুরু করলো,,,,, তার মধ্যেও এদিক সেদিক কত কি যে করলো। এবার বেচারি হাতে মোবাইলটা নিলো, আমি মনে মনে ভাবছি, এই বুঝি আমাকে ফোন করবে। আমার ফোনের রিং বাজলো বেলা বাজে দুইটা। ফোনটা রিসিভ করে কানে দিয়ে বললাম, হুম শান্তা বলো? শান্তা অপর পাশ থেকে বলল তুমি খাবার খেয়ে নিও। আমি বললাম হুম খাবো; আচ্ছা রাখি বাই। হুম বাই।
শান্তা গোসলের জন্য কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিক যাচ্ছে, বুঝতে পালাম আম্মা ডেকে কিছু একটা বললো। শান্তা থেমে গেলো। শান্তা কাপড় গুলো আবার নিজের রুমে খাটের উপর রেখে আসলো। এবার দেখলাম, শান্তা ফ্রিজ থেকে বেগুন নামালো। বেগুন সিদ্ধ করে; ভর্তা বানালো। এখন আবার কাপড় নিয়ে গোসলে গেলো। শান্তা গোসল করে আসলো। শান্তা কিন্তু ফেসবুকের অনলাইনে এখনো দেখতে পাচ্ছি। আদনানকে দুধ খায়িয়ে শান্তা খাইতে বসলো খাওয়া শেষ করে টিভির রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভিটা ছাড়লো। হঠাৎ হাত থেকে রিমোট টা রেখে আব্বার রুমের দিকে গেলো। তারপর কিচেনে গিয়ে চুলায় পানিয়ে বসিয়ে আবার নিজের রুমে আসলো। হয়তো আব্বা চা বানিয়ে দিতে বলছে।
আব্বার দুবেলা চা খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে। হ্যাঁ ঠিকিই, শান্তা এবার চা বানিয়ে আব্বার রুমে দিয়ে আসলো। আমি অফিসে বসে বসে সিসিটিভির ফুটেজে এই কান্ড দেখে আমি অভাক ; ভাবতে লাগলাম কিভাবে সম্ভব। একটা মেয়ে বাবা মা ছেড়ে স্বামীর সংসার করতে আসে। অচেনা অজানা অপরিচিত একটা জায়গায় এসে সবাইকে মানিয়ে নিয়ে সংসার করছে। আমি অফিসে একটা কাজ করি, তাতেই কত বিরক্ত হয়ে যাই। কোম্পানি বেতন দেয় ৬০ হাজার টাকা প্লাস। আমাকে যদি কেউ বলে, শান্তার এই কাজ গুলো করতে ৮০ হাজার টাকা বেতন দিবে। তবুও আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। কোন ভাবেই সম্ভব না, ভাবতে লাগলাম। অফিস থেকে বাসায় ফিরে খাবার টেবিলে বসে বসে মাকে বললাম, আম্মা তোমরা তো সারাদিন বাসায় থাকো।
শান্তারে একটু হেল্প করা যায়না। শান্তা বেচারি একা এত কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠে, হিমশিম খেতে হয় ওর। আবার একটা বাচ্চা, রান্নাবান্না তোমাদের আদেশ উপদেশ শোনতে শোনতে বেচারি এক মিনিট বসার সুযোগও পায়না। মা বললো ‘আরে তোর মাথাটা বৌমা নষ্ট করছে বুঝি? শান্তা তখন টেবিলে রাতের খাবার পরিবেশন করছে। আব্বা আম্মা আমি আমরা ভাত খাচ্ছি, শান্তা পরে বসবে। আমার খাবার খাওয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে, শান্তা টেবিলে সব খাবার রেডি করে নিজে খেতে বসলো। আব্বা খাবার খেয়ে শেষ করে বলল বৌমা গামছাটা দেও তো। শান্তা টেবিল থেকে উঠে গিয়ে আব্বাকে গামছাটা দিলো হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ, আম্মা বললো- দেখো তো বৌ মা কে আসছে? শান্তা বামহাতেই যথা সন্মানের সাথে আব্বার হাতে গামছাটি দিয়ে।
শান্তা দরজাটা খোলেই বলল- আম্মা বড় আপু আসছে আমি বড় আপুকে বললাম কি রে কোন ফোন করলি নাহ কিছু না হঠাৎ চলে আসলি যে। বড় আপু হাও মাও করে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেন। আমি আর ওদের বাড়িতে যাবো না, এই পাঁচটা বছর ‘আমার জীবনডা তামাতামা হয়ে গেছে। আব্বা আপুর দিকে তাকিয়ে বলল কি হয়েছে রে মা? শান্তা ভাত খাওয়া শেষ না করেই হাতটা ধুয়ে ফেললো.আপু বললো কিছু হয়নি, সবই আমার কপাল। আম্মা আবার জিগ্যেস করলো কি হয়েছে তোর, ইফরানের সাথে ঝগড়া করে আসছিস? আপু প্রতিউত্তরে বলল হ্যাঁ। আম্মা আবার জিগ্যেস করলো কেনো? আপু বলল- ওরা সবাই নবাবজাদা সব কিছু আমি রেডি করে দিলে ওরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খায়। ওরা বাসার একটা কাজও করে না, সারা দিন আমাকে দিয়েই বাসার সব কাজ করায়। আমাকে মনে হয় ঐ বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসাবে রাখছে। ইফরানকে কিছু বললেই বকাঝকা করে আমি আর ঐ বাড়িতে যাবো না।
আম্মা রেগে চিল্লাফাল্লা শুরু করছে। শান্তাকে বলছে- বৌমা আমার রুম থেকে মোবাইলটা নিয়ে আসো? আমি এক্ষুনি কমজাতের বাচ্চারে ফোন দিয়ে জিগ্যেস করবো। আমার মেয়েটা কি ওদের বাড়ির কাজের মেয়ে নাকি? ওরা সব নবাবজাদা ঘুমাবে আর খাবে আমার মেয়েটাকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করাবে। ওরা কি পাইছে, আমার মেয়েটারে নিজে না খেয়ে খাওয়াইছি, বড় করছি, পড়াশোনা করাইছি, মানুষ করছি। হেরার বাড়িতে নিয়ে কামলার মতো খাটাইতে! যাও ফোনটা নিয়ে আসো? এবার আমি খাবারের টেবিল এর পাশের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শান্তাকে বললাম শান্তা বসো, শান্তা মোবাইল আনার জন্য আম্মার রুমের দিকে যাবে একটু উচ্চ সূরে, শান্তার হাতটা ধরে, একটা জারি দিয়ে বললাম- তোমাকে বসতে বলছি বসো!! আম্মা আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো।
এই প্রথম আজকে স্ত্রীর জন্য আব্বা আম্মার মুখের উপর কথা বলবো,,,,, আম্মাকে বললাম….তুমি নাহ কিছুক্ষণ আগে বললা, তোর মাথাটা বৌমা নষ্ট করছে বুঝি?এখন কেনো ইফরানকে ফোন দিবে? ও এটা নিজের মেয়ে বলে, শান্তা তো পরের মেয়ে। নিজের মেয়েকে নিজে না খেয়ে খাওয়াইছো, বড় করছো মানুষ করছো আর শান্তার বাপ মা শান্তাকে রাস্তার ইট পাথর খাইয়ে বড় করছে তাই নাহ আম্মা। নিজের ছেলে দুই বালতি কাপড় কাচলেই, ছেলে বউ পাগল হয়ে যায়! আর মেয়ের জামাই কাচলে লক্ষি জামাই হয়ে যেতো; তখন আর কমজাত থাকতো না বেশিজাত হয়ে যেতো? শান্তা আমার মুখ চেপে ধরে আম্মাকে বলতে লাগলো আম্মা বিশ্বাস করেন আমি আপনার ছেলেকে সংসারের ব্যাপারে কিচ্ছু বলি নাই- আপনারা আমার নিজের বাবা মায়ের মতোই…….
গল্পের বিষয়:
গল্প