আজ অবন্তী অনেকক্ষণ যাবত জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার আকাশে উড়ন্ত কিছু রঙিন ঘুড়ির দিকে। ঘুড়িগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে একবার এদিক, আরেকবার ওদিক। ঘুড়ি উড়ছে অনেক দূর আকাশে অথচ লাটাই হাতে ঘুড়ির মালিক নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘুড়িটিকে ইচ্ছে মতো উড়ার সুযোগ দিলেও কোন একসময় ঠিকই গুটিয়ে নিবে। বাতাসে ঠিক মতো না উড়লে সে নিচ থেকে বকবক করতে থাকবে।
অবন্তী ভাবতে লাগলো, এই ঘুড়ি গুলোর সাথে আমাদের মতো মেয়েদের কত মিল। আমরা যতই কাজ করি, সংসার সামলাই না কেন দিনশেষে পুরুষটির মুখে শুনতে হয় সারাদিন বাড়ি থেকে কী করিস? কোনো কাজ ঠিকমতো পারিস না। আমাদের লাটাই টাও তাদের হাতে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অবন্তীর চোখের কোনায় নোনাজল জমা হলো। হঠাৎ শাশুড়ির ডাক শুনতে পেল, “বউমা এক কাপ চা দিয়ে যাও তো।” ” এক্ষুনি নিয়ে আসছি মা। ” বলেই অবন্তী দৌঁড়ে রান্নাঘরে চলে গেল। এক কাপ চা হাতে নিয়ে শাশুড়ির ঘরে পা রাখতেই ঝাঁঝালো কণ্ঠে শুনতে পেল, “এক কাপ চা আনতে বুঝি এত সময় লাগে? তোমাদের দিয়ে একটা কাজও ঠিকঠাক হয় না।”
অবন্তী চায়ের কাপটি দিয়ে সোজা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। তার রুম থেকে ছেলের কান্নার আওয়াজ আসছে। এতক্ষণে ছেলেটার ঘুম ভেঙে গেছে তাই কান্না করছে এভাবে। তাড়াহুড়ো করে রুমে গিয়ে ছেলের কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পাশের রুম থেকে জোরে জোরে চিৎকার করে ননদ বলতে লাগলো, ” সারাদিন তো শুয়ে-বসেই দিন কাটেবনবাবের মেয়ের। সামান্য ছেলেটিকেও সামলে রাখতে পারে না? কলেজ থেকে এসে ঘুমাতে এলাম তবুও শান্তিতে ঘুমাতে পারি না এদের জন্য। “
অবন্তী কথাগুলো শুনে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। ছেলেকে কোলে নিয়ে ফিডারে দুধ গুলিয়ে খাওয়াতে লাগলো। বিকেল হয়ে এলো তবুও তার নিজের খাওয়াটা এখনো হয়নি। একবার খেতে বসলো তখন শশুরের ডাক এলো। ভাতের থালাটা সরিয়ে উঠে গেল। অথচ বাড়ির কেউ জিজ্ঞেস করে না একবার সে খেয়েই কি না। এতে অবন্তীর কোনো দুঃখ নেই এখন কারণ তার সয়ে গেছে। রাতে নীলয় অফিস থেকে বাসায় ফেরার সাথে সাথেই ছেলের কাছে নালিশ দেওয়া শুরু করে দিলো, “তোর বউকে কোনো কাজের হুকুম দিলে কখনোই সময় মতো করে না। সারাদিন আলসেমি করে করে বিকেলে গোসল করে ছোট বাচ্চাটার অসুখ বাঁধায়। ” বোন বলা শুরু করলো, “কেমন মা হয়েছে যে ছেলেকে সামলে রাখতে পারে না। কান্নার শব্দে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারি না। “
মা আর বোনের কথা শুনে বউয়ের প্রতি বেশ মেজাজ খারাপ হলো নীলয়ের। রুমে গিয়ে আচ্ছা রকম ঝাড়ি নিলো। দুই একটা চড় থাপ্পড় ও মারলো। অবন্তী একটু শব্দও করলো না। চুপচাপ সহ্য করতে লাগলো। ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। চোখে তার পানি, এই কান্না দেখার সময় নেই নীলয়ের। কয়েকবছর পরে, নীলয়ের বোন নীলার বিয়ে হয়ে গেছে। নীলয় এসেছে বোনের বাড়িতে। রাত হয়ে যাওয়ায় বোনের শশুর বাড়ির লোকজন তাকে বাসায় ফিরতে দিলো না। পরেরদিন ভোরে নীলয়ের ঘুম ভেঙে গেল। সে রুম থেকে বেরিয়ে এসে খেয়াল করলো, নীলা রান্নাঘরে। বাড়ির সবাই এখনো ঘুমাচ্ছে। সে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সকাল আটটা বাজতে বাজতে নাস্তা রেডি হয়ে গেল। তবুও তার শাশুড়ি ঘুম থেকে উঠে কড়া স্বরে বলতে লাগলো, নাস্তা বানাতে এত দেরি হয় কেন? সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে কী হয়?
নীলয় ভাবতে লাগলো, যেই বোনটা সকাল দশটার আগে ঘুম থেকে উঠতো না, কখনো রান্নাঘরে উঁকিও দিতো না সে আজ আটটা নাগাদ নাস্তা বানানো শেষ করলো তবুও কথা শোনার হাত থেকে রেহায় পেল না। সকলে নাস্তা করলো অথচ নীলা নাস্তা করলো না। এঁটো থালাবাসন গুলো নিয়ে ধুতে গেল। তারপর নোংরা কাপড় ভিজিয়ে দুপুরে রান্নার জন্য সবজি কাটতে লাগলো। এর মাঝেও তার খাওয়া হয়নি। কাজগুলো খুব তাড়াতাড়ি করছিল মনে হচ্ছে আরো কতকাজ বাকি আছে। সবজি কাটা শেষ হলে ভেজানো কাপড়গুলো ধুয়ে শুকাতে দিলো। এর মাঝে ডাক এলো শশুরের জন্য কিছু শুকনা খাবার দিয়ে আসতে সাথে এক কাপ চা। শশুরের খাবার দিয়ে এসে কোনোরকম নাকে মুখে দুগাল খেয়ে সে আবার রান্না করতে চলে গেল। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে ঘর মুছে ফেলল। সংসারের বাকি কাজগুলো করলো। সবার খাওয়া হলে সবকিছু গুছিয়ে গোসল করতে গেল। তখন বেলা বাজে ৪ টা। দুপুরের খাবার এখনো খায়নি। অদ্ভুত ব্যাপার হলো কেউ তাকে খেতে বলেনি এক বারের জন্যও।
আজ বোনকে দেখে নীলয়ের অবন্তীর কথা মনে পড়লো। নিশ্চয়ই মেয়েটাও এভাবে সারাদিন কষ্ট করে তবুও ঝাড়ির হাত থেকে সে রেহায় পাই না। মাঝে মধ্যে উপহার স্বরুপ চড় থাপ্পড়ও খায়। সে উপলব্ধি করতে পারলো অবন্তীর প্রতি তার যত্নশীল হওয়া উচিত। আর কতদিন এভাবে তাদের ঝাঁঝালো কথা সহ্য করবে? নীলয় আজ ভীষণ অনুতপ্ত হলো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো আজই বাসায় গিয়ে সরি বলবে তার অর্ধাঙ্গিনীকে। যে তার সবটা দিয়ে সংসারটা আগলে রেখেছে,,,,,,,,,,!!
গল্পের বিষয়:
গল্প