রেণুকা এসেছে!
ফ্ল্যাটের ঝুলবারান্দামতন চিলতে জায়গাটায় বিরজাবালা নাতি কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের অজান্তেই অপেক্ষা করছে, ছেলে নিখিল কখন আসে। সেই সকালবেলা যায় নিখিল, একটা বড়োসড়ো গাড়ি আসে নিতে, তারপর নাকি কোথায় কোথায় ঘোরে; বলে, ফিল্ডে কাজ। তাই সন্ধ্যার আগে আগে, না তাও সবদিন নয়, কোনো কোনো দিন বিকেলের আলো সামনের বাড়িগুলোর গা থেকে সরে গেলেই বিরজাবালা এখানে আসে। তিনতলার এ-জায়গা থেকে গেটটা ভালো দেখা যায়। বারবার সে গেটের দিকে তাকায়, কখন ছেলের গাড়ি এসে থামে। থামেও কোনো কোনো দিন। হয়তো, নিখিল সেদিন একটু আগেই এসেছে। বিরজাবালা তখন কোলের নাতিকে বলে, ‘ও দাদা, দেখো ওই যে বাবা আইচে। দেখচো দাদা?’ নৈর্ঋত হয়তো তা বোঝে কি বোঝে না। কিন্তু গাড়ি এসে থেমেছে, গাড়ির কাছে যেতে হবে ঠাকুমার কোল থেকে নেমে Ñ এজন্যে তিনতলা থেকেই, ঠাকুমার কোল থেকে ঝুলে একেবারে গাড়ির কাছে যেতে চায়। তখন বিরজাবালা মনে মনে বলে, দেকচো, এইটুক মানুষ বাপের জইন্যে কী করে। ততক্ষণে নিখিলকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চলে যায়। কোনোদিন যায়ও না! হয়তো নিখিলকে আবার বেরুতে হবে। অবশ্য তাতে বিরজাবালার নাতির একটা সুযোগ হয় গাড়িটার কাছে যাওয়ার। গাড়ি তখন গেটের ভেতরে ঢোকে।
রেণুকার রিকশা এসে গেটের সামনে দাঁড়ায়। এ-বাড়ির সামনে কতই তো রিকশা থামে। বিরজাবালা কতজনকে নামতে দেখে। তাদের কেউ কেউ এ-বাসায় আসে। সবাইকে যে চেনে তাও না। বউমা সুপর্ণার বাপের বাড়ির দিককার অনেককেই তো চেনে না। তেমন কেউ একজন এ-বাসায় ঢুকলে সে বোঝে একটু আগে রিকশা থেকে নামতে দেখেছে। অন্যান্য বাসায়ও আসে কত মানুষ। তাছাড়া এখান থেকে সবাইকে দেখে ঠিকঠাক ঠাওরও করতে পারে না। চেনা মানুষ নামলেও অনেক সময় এত দূর থেকে দেখে সে চিনতে পারে না। কিন্তু কত আর দূর, বিরজাবালা জানে, আসলে তার চোখ জোড়া গেছে; সে ভাবে, বয়স হইচে না?
রেণুকাকে নামতে দেখে বিরজাবালার পয়লা মনে হয়, মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগে। কোথায় যেন দেখেছে। প্রথমেই তার রেণুকার কথা মনেও পড়েনি। ভারী শরীরের মহিলা, মাঝবয়স; বোঝা যায়, মাথার চুল কমে এসেছে, কিন্তু এই যে রেণুকা তা মনে হয়নি। মাঝবয়সী সে-মহিলাকে দেখতে দেখতে, বিরজাবালার একবার শুধু কেন যেন মনে হয়েছিল এটা রেণুকা হতে পারে। কিন্তু সঙ্গের লোকটা কে? দেখে, দুজন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একখানা কাগজের সঙ্গে নম্বর মিলায়। নিজেদের ভেতর কীসব বলে। একবার তিনতলার দিকে তাকায়। আর তখনই ওই তাকানোর ভঙ্গিটাতেই বিরজাবালা ভাবে, যদি ভুল না দেখি, তাইলে এইটা রেণুকাই। বয়স হইছে মেয়ের। হ্যাঁ, তা হইচে। বিরজাবালা হিসাব করে, দাদায় যখন মারা গেল, তখনই ওয়ার বয়স তিরিশ কি আরো বেশি। হ্যাঁ, তা হবে।
বিরজাবালার বড়দা পটুয়াখালী কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী বিহারীলাল যখন দেহরক্ষা করেন, তখন রেণুুকার বয়স তিরিশের বেশি। বিহারীলালের ছোট মেয়ে, বছর পাঁচেক আগে শেষবার বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাশের চেষ্টা করেছে, হয়নি। বাকি সব সাবজেক্টে পাস, ইংরেজিতে ফেল। এ নিয়ে বিহারীলালের কষ্টের কোনো অন্ত ছিল না। নিজে এত ভালো ইংরেজিতে, শেক্সপিয়র থেকে এখনও মুখস্থ বলতে পারেন অনর্গল। বিএম কলেজে ইংরেজি কবিতা আবৃত্তিতে ফার্স্ট হইচেন সেই ঘোরতর ব্রিটিশ আমলে। তা নিয়ে আত্মীয়স্বজন কি বন্ধুবৃত্তে বিহারীলালের অহংকারের অন্ত ছিল না। কিন্তু এই হাসিখুশি আর আমুদে মানুষটার এমন অহংকারের কণামাত্রও তো মেয়েটার ভেতরে বর্তানোর কথা। কিন্তু এর ছিটেফোঁটা পায়নি মেয়ে। ফলে, রেণুকা বার-দুই বিএ ফেল করার পরে তার বিয়ের জন্যে বিহারীলাল উঠেপড়ে লাগেন। বরিশাল, ফরিদপুর, ঢাকা, খুলনা, যশোরের মতন নমঃশূদ্রপ্রধান এলাকা এবং পশ্চিমবাংলায় নগর কলকাতায় ছড়ানো-ছিটানো আত্মীয়স্বজন পরিচিতজন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কাউকেই জানাতে বাকি রাখেন নাই। এসেছেও ভালো ভালো সম্বন্ধ। কিন্তু দিন যে ধীরে ধীরে বদলে গেছে তাও যেন জানা ছিল না এই প্রবীণ আইনজীবীর। মেয়ে রেণুকা তার মেধা আর কর্মক্ষমতার কিছু পাক বা না-পাক অহংকারের যেটুকু পেয়েছে, তাতেই তার নাক ছিল উঁচু। এমনিতে রেণুকার নাকটা তেমন খাড়া না, বোঁচাও না। বিরজাবালার মতন। পিসিতে ভাইঝিতে গায়ের রঙে মিল নেই। মুখের গড়নেও না। বিরজাবালা ফর্সাই, রেণুকা শ্যামলা। বিরজাবালার মুখখানা একটু লম্বাটে, রেণুকার মুখ গোল। শুধু নাকের গড়নে আর মাথার চুল যা কিছু মিল। সেজন্যে মানুষ বলত, তুই তোর ছোট পিসির মতন হইচিস। কিন্তু যদি ছোট পিসির মতন স্বামীভাগ্য হতো মেয়ের!
তা না হওয়ার কারণ রেণুকার ওই অহংকার। বিহারীলাল যে সম্বন্ধই আনে, রেণুকার পছন্দ হয় না। এই ছেলের ঘাড় খাটো, সেই ছেলের কপাল উঁচু, ওই ছেলের গায়ের রং কালো, সে-ছেলের বাপের দুই বিয়ে, ওই ছেলের দেশের মানুষ মাঠে পায়খানা করে, সেই ছেলের এক বোন মুসলমানের সঙ্গে গেছে Ñ এসব যত আপত্তি। এই ফিরিস্তির শেষ নেই। বিরজাবালাকে তার বউদি বলত, তোমার দাদা লাই দিয়ে ছোডো মাইয়ার মাথা খাইচে। ওনারে রাজপুত্তুর আইন্যা দাও। বর্ধমানের মহারাজার কোনো ছওয়াল অবিয়াত থাকলে খবর পাঠাও। আর নয় খোঁজ নেও, উত্তমকুমার আরেটা বিয়া করে নাকি, তয় যেন রেণুরে নেয়। কাছেই দাঁড়িয়েছিল বিরজাবালার বড়দির কলকাতায় থাকা মেয়ে নন্দিনী, সে বলেছিল, খারাপ হবে না মামিমা, রেণুদিরে উত্তমকুমার নেলে, সুপ্রিয়া দেবীরে ডাকে বেণু আর রেণুকাদিরে ডাকপে রেণু!
এসব রঙ্গতামাশার কথা। কিন্তু মনে তো আজকাল আগের দিনের কত কিছুই উঁকি মারে বিরজাবালার। মনে পড়ে… এভাবে একদিন দাদায় চোখ বুজল। তার আগে এক ছেলে এসেছিল রেণুকাকে দেখতে, সবাই মনে করেছিল এবার রেণুকার বিয়েটা হয়ে যাবে। বিহারীলাল তখন প্রায় বিছানপড়তা। শরীর ভালো যাচ্ছিল না। ডায়াবেটিস-হাইপ্রেসার কতকিছু। তাও যদি বুঝত মেয়ে। তবে, বিহারীলালেরও রেণুকার বিয়ে দেওয়া নিয়ে খুঁতখুঁতানি কমেছে। যেন মেয়েটাকে পার করতে পারলে বাঁচেন। রেণুকার বড় ভাই বোনদের বিয়ে দিয়েছেন কত আগে, আগের বোনটারও বিয়ে হয়েছে দেশ স্বাধীনের পর পর। কিন্তু বিহারীলাল তখন যত নমনীয়ই হোন, রেণুকা সেবারও বিয়ে করল না। কারণ অতি তুচ্ছ। তবে, বিরজাবালার কাছে কারণ যত তুচ্ছই মনে হোক, হয়তো রেণুকার কাছে বিষয়টি তেমন ছিল না।
পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখতে এসে জানিয়ে গেছে, মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। এবার মেয়ে পক্ষের লোকজন পাত্রর বাড়িঘরদোর দেখতে যাবে। তার আগে ডাক মারফত তারা পাত্রের একখানা পাসপোর্ট সাইজ ছবি পাঠিয়েছে। অফিসিয়াল ছবি। কোট পরা। পাত্র সুদর্শন। বিরজাবালার মনে আছে, সে তখন নিখিলকে নিয়ে ঝালকাঠি থেকে পটুয়াখালী গিয়েছিল অসুস্থ বিহারীলালকে দেখতে। নিখিল তখন সবে কলেজে উঠেছে। নিখিলের বড় বোন নীলিমা, সে রেণুকার কত ছোট, তার বিয়ে হয়েছে, এক মেয়ে জামাইয়ের পোস্টিং পটুয়াখালীর কলাপাড়া। পটুয়াখালীতে বিহারীলালকে দেখে তারা কলাপাড়া যাবে। সে-সময়ে, সেই পাত্রের ছবি দেখেছিল বিরজাবালা কী সুন্দর দেখতে ছেলেটা! বয়স একটু বেশি। তা তো একটু বেশি হবেই, রেণুকার বয়সই তখন তিরিশ ছুঁয়েছে। কিন্তু ওই ছেলেকেও বিয়ে করতে রাজি হলো না রেণুকা। কারণ, ছেলের গোঁফ আছে। গোঁফ আছে তো কী? গোঁফ তো নিখিলের বাবারও ছিল। কিন্তু গোঁফঅলা ছেলে একেবারেই পছন্দ না রেণুকার। উপায় না দেখে, বিহারীলাল পাত্রপক্ষের কাছে চিঠি লিখল : পাত্রের সর্বাঙ্গীণ তাহাদের পছন্দ হইয়াছে, কিন্তু তাহার কন্যা পাত্রর গোঁফ পছন্দ করিতেছে না, যদি তাহার কন্যার অভিপ্রায় অনুযায়ী পাত্র গোঁফ ছেদন করে, তাহা হইলে তাহার কন্যা এ-বিবাহে রাজি আছে।
কিন্তু এতে যেন ফল উলটো হলো। পাত্রপক্ষ জানাল, তারা আর এ-সম্বন্ধ নিয়ে কথা এগোতে রাজি নয়। পরে ঘটক মারফত শুনেছিল, পাত্রপক্ষ বলেছে, যে-মেয়ে বিয়ের আগেই এমনসব কথা বলে, তার সঙ্গে তারা কোনোভাবে সম্বন্ধ করতে রাজি নয়। তারা এখনই আশঙ্কা করতে পারছে যে, এই মেয়ে বিয়ের পরে কী করতে পারে।
তখন, কেউ কেউ বলেছিল, বিহারীলালের কারণেই তার ছোট মেয়েটির এ-অবস্থা। বিহারীলালই লাই দিয়ে দিয়ে মেয়ের মাথা নষ্ট করেছে।
কেউ বলেছিল, দরকার কী রেণুকার অত মতামত নেওয়ার।
কেউ বলেছিল, রেণুকার বিয়ের আগে গোঁফ নিয়ে এত কথা বলার কী দরকার ছিল? বিয়ের পর বরকে বুঝিয়ে বললে সে নিশ্চয়ই রেণুকার কথা শুনত। গোঁফ কাটত।
কেউ বলেছিল, কী দরকার ছিল অত মেয়ের মতামত নেওয়ার। বাপে যদি বলে কলাগাছ বিয়ে করতে, তাহলে তা-ই করবে। মতামত নিয়ে নিয়ে মেয়েকে মাথায় তোলা হয়েছে। আইজ এটা তো কাইল ওটা। এত কী!
কিন্তু বিহারীলাল বুঝেছিলেন অন্য, দিন পালটে গেছে। যে-মেয়ে সংসার করবে তার মতামতের একটা গুরুত্ব আছে। তাছাড়া নিজের চোখের সামনে দেখেছেন, তার বড় বোনটারে বাবা নিজের জেদে যে-ঘরে বিয়ে দিয়েছেন, এ-কাজ না করলেও পারতেন তার বাবা, সেই বোনটা স্বামীর সংসারে সুখী হয়নি। নিজের বড় মেয়ের ক্ষেত্রেও তিনি একই কাজ করেছেন বলতে গেলে। যদি সেদিন নিজের বউ বা মেয়েটির বা ছেলেদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন তাহলে অমন জামাইয়ের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে হয় না।
ফলে, নিজের পারিবারিক অভিজ্ঞতা আর অতীত ও বর্তমানের তফাৎকে মেশাতে গিয়ে রেণুকার বিয়ে না দিয়েই বিহারীলাল চোখ বুঝলেন। বিয়ে হলো না রেণুকার। এরপর যা হয় আর কি, ভাইয়ে ভাইয়ের ভাগাভাগির সংসার, রেণুকা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে, কখনো এক জেলা থেকে অন্য জেলায় এমনকি কখন কলকাতার বোনদের শ্বশুরবাড়িতে ধাক্কা খেতে লাগল। এই চলতে চলতে একদিন সময় গড়িয়ে এমন হলো যে, তখন বোঝা গেল, বাপ মারা যাওয়ার পর এই এতগুলো বছর রেণুকার দিকে আসলে কেউ তাকায়নি। আর রেণুকাকে এখন আর বিয়ে দেওয়ারও বয়স নেই।
রেণুকাও দেখতে পেল, এখন ভাগ্নিদের বিয়ে দেওয়ার সময় এসে গেছে, ধীরে ধীরে ভাইঝি, এমনকি ভাইপোরাও বিয়ে করতে শুরু করেছে।
আর রেণুকাও একদিন যেন সবার অলক্ষে, অথবা, সবার সামনে থেকেও যেমন সামনে ছিল না এ-অবস্থা থেকে কোথায় নিরুদ্দেশ হলো।
দুই
হুঁ, রেণুকাই। বিরজাবালা তাকিয়ে থাকল। দেখল, সঙ্গের লোকটা উলটোদিকের বাড়িটা দেখছে। উলটোদিকের বাড়িটার রং লালচে। সেজন্যে কি?
এ-সময় রেণুকা বারান্দায় নাতি কোলে বিরজাবালাকে দেখতে পেয়েছে। লোকটাকে যেন কী বলল। তারপর দুজন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল।
এদিকে বিরজাবালা কিন্তু এখনো নিশ্চিত নয়, সে সত্যি রেণুকাকেই দেখেছে কিনা। তার মনে হয়েছে, এটা রেণুকা হতে পারে। একটু মোটা হয়ে গেছে মেয়েটা। শরীরের বাঁধন শিথিল। বয়সের ছাপ পড়েছে। তা তো পড়বেই। নীলিমারও কত বড় রেণু। নীলামার বয়সই প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর হলো।
এ-সময়ে দরোজায় কলবেল বাজল। কলবেলটা এই বারান্দা লাগোয়া ঘরের পাশের স্পেসে। এ-সময়ে কলবেলের আওয়াজে নৈর্ঋত মনে করে, নিখিল এসেছে। কিন্তু এখন নিচে গাড়ি না আসায় তা ভাবল না। কিন্তু বিরজাবালার দিকে তাকাল। যেন কেউ এসেছে, তাদের দেখতে যাওয়া উচিত।
বিরজাবালা দরজায় আসে। তাহলে তার অনুমান ঠিক। রেণুকাই। এতক্ষণে মেয়ে নিচ থেকে এই তিনতলা পর্যন্ত এসেছে।
বিরজাবালা দরজা খুলে রেণুকার মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘আয়।’ রেণুকাকে দেখেই বিরজাবালার মুখখানা হাসিতে ভরে গেল। কতদিন পরে ভাইঝিকে দেখল সে। মুখের ওই হাসি আরো ছড়িয়ে দিয়ে সে আবার বলল, ‘আয় মা, আয়। কতদিন পর তোরে দেখলাম।’
ততক্ষণে রেণুকা বিরজাবালাকে প্রণাম করেছে। দরজার সামনে প্যাসেজমতন জায়গায় বিরজাবালা একটু পেছনে সরে আসতে আসতে বলল, ‘থাক আয়।’
তারপর যেন এই প্রথম রেণুকার ঘাড়ের পাশ থেকে পেছনে তাকাল। রেণুকা যখন সিঁড়ির মুখে, তারপর দরজা দিয়ে রেণুকা ঢুকতে ঢুকতে বিরজাবালা রেণুকার পেছনের লোকটাকেই দেখছিল। কিন্তু এই দেখে নেওয়া, রেণুকার ও লোকটার ঘরের ভেতরে ঢোকা, এরপর রেণুকার বিরজাবালাকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অরুণ নিজের নাম ও ঠিকানা প্রায় পুরোটাই বলল, ‘নমস্কার। আমার নাম অরুণ অধিকারী। বাড়ি বরগুনায়। আপনাগো কাঁঠালিয়ার কাছেই।’
বিরজাবালা এমনভাবে তাকাল যেন এই প্রথম সে ভালোমতো অরুণকে দেখছে। বলল, ‘আসেন।’
তবু কেন যেন এখন রেণুকার সঙ্গে একটা লোক, কী তাদের সম্পর্ক লোকটাকে নিয়ে বিরজাবালার সন্দেহ কাটেনি।
রেণুকা ও অরুণকে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বিরজাবালা অরুণকে ভালোমতো নিরীক্ষা করল। নৈর্ঋত তার কোলে। রেণুকা বলল, ‘পিসিমা, নিখিলের ছেলে?’ তারপর নৈর্ঋতকে কোলে নিতে চাইল। কিন্তু নৈর্ঋত রেণুকার কোলে গেল না। বিরজাবালা বলল, ‘থাউক, যাবে না এট্টু আগে ঘুম দিয়ে ওডছে। কান্দবে ওর মা এহোনো ঘুমায় মুখে এ-কথা বললেও চোখ তার অরুণকে দেখে চলেছে। হবে, রেণুর চেয়ে বয়স বেশি। গলার কাছে চামড়া দেখলে বোঝা যায়। এট্টা চুলও পাকে নাই নিশ্চয়ই কলপ দেওয়া। তবে চুল পাতলা হয়েছে। একসময় মাথায় চুল ছিল।
এদিকে রেণুকা বুঝেছে, বিরজাবালা অরুণকে নিরীক্ষা করছে। সে পিসির চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার নৈর্ঋতের দিকে চেয়ে হাসল, ‘ও বাবা, আসো, আসো না।’ বলতে বলতে বিরজাবালাকে বলল, ‘পিসিমা, আপনার শরীর-টরীর আছে ভালো?’
‘আছি, বাছা চলতেছে তয় চোখ ভালো কাজ করে না। আর, আইজ এ-জায়গায়, কাইল ও-জায়গায় এইয়া করি ’
রেণুকা বিরজাবালার মুখের দিকে চেয়ে থাকল। কী আর হইছে পিসিমার কী সুন্দর শরীর, স্বাস্থ্য এখনো। তবু এ-কথার পিঠে যা বলতে হয়, ‘খাওয়া-লওয়া ঠিক আছে?’
‘আছে, ডাক্তার তো সব খাইতে কইচে’ বলে, জানতে চাইল, ‘তুই বাসা চিনলি কীভাবে?’ বলতে বলতে বড় সোফার সামনের খাটে বসে বিরজাবালা। নৈর্ঋতকে কোল থেকে নামিয়ে খাটে বসায়।
‘সকালে নিখিলের অফিসে ফোন করছেলাম। ও দেল। বাসার ফোন নাম্বারও দেচেল, বাসার ফোনে ফোন করলাম, আসল না মনে হয় লাইন খারাপ নিখিলের সঙ্গে কথা কইতে কইতে ও বাসার নাম্বার দিয়া কইল, দিদি, আমি ব্যস্ত, তুমি বাসায় ফোন করো সুপর্ণা তোমারে সব বুঝাইয়া দেবে তারপর বাসায় ফোন করি আসে না – নিখিলের বউর নাম সুপর্ণা?’
‘হয়। বউমাও একবার নিখিলের সাথে কথা কইল – তারপর যে ফোন কাটল তো কাটল, আর লাইন নাই –
‘নিখিল কইল, উলটো দিকের বাড়িটার রং পেরায় লাল – আমরা বাড়ির নাম্বার মিলাইয়া দেখলাম উলটাদিকের বাড়ির রং লাল – তারপর দেখলাম বারান্দায় আপনারে -’
‘বয়, আসতেচি –
‘না না, আপনে বসেন -’
কিন্তু এই প্রথম বিরজাবালা নিজের জড়তা কাটিয়ে রেণুকার সঙ্গে এসেছে তাই হয়তো অরুণকে বলল, ‘একবার বরগুনা গেছেলাম, সে অনেকদিন আগে, হিন্দুস্থান-পাকিস্তানেরও আগে ওর পিসামশাইর সঙ্গে’ – বিরজাবালা রেণুকাকে দেখায়, ‘কী সুন্দর আপনাগো ওইদিক – তখন আমাগো ছেলেপেলে হয় নাই – কত ঘোরতাম – আমাদের এক বেয়াই বাড়ি ছেল -’
‘কোন গ্রামে?’ অরুণ জানতে চায়।
‘মনে নাই। তয় তারা এখন আর কেউ নাই – সবাই ইন্ডিয়ায় গেচে।’ বলে নৈর্ঋতকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
রেণুকা বলল, ‘পিসিমা ব্যস্ত হবেন না, বসেন কথা কই।’
‘না রে, দেখি ওয়ার মা ওঠছে নাকি –
আসলে বিরজাবালা চাইছিল, অথবা জানত, একটু চা বানানোর কথা বলে উঠে এলে তার সঙ্গে রেণুকাও আসবে। সে তো জানে না, সঙ্গের লোকটি, অরুণ যার নাম, তার সঙ্গে রেণুকার সম্পর্ক কী? জানে না, এই এতগুলো দিন কোথায় প্রায় নিরুদ্দেশ হয়ে ছিল মেয়ে? মাঝখানে একবার সিলেট না শেরপুর কোথা থেকে একখানা চিঠি লিখেছিল পটুয়াখালীর বাড়ির ঠিকানায়। তারপর আবার লাপাত্তা। ওদিকে এমন কেউ নেই যে, এ-ঠিকানায় খোঁজ নিতে যায়। নিখিল তবু তার এক সহকর্মীকে দিয়ে খোঁজ নিয়েছিল, কিন্তু সেখানে তখন আর ছিল না রেণুকা। কোথায় গেছে তাও কেউ বলতে পারে না। আবার, এমন কথাও জেনেছিল, কোনোদিন নাকি ওই জায়গায় ছিল না ওই নামের কেউ। তাহলে রেণুকা নাম বদলেছে? রেণুকার সামনে বসে কথা বলতে বলতে, কি রেণুকাকে দেখার পর ওইসব প্রশ্ন মাথায় আসলেও অরুণ নামের অপরিচিত লোকটার সামনে সে তা জানতে চায় কীভাবে? বরং বিরজাবালা চাইছিল, সে উঠে আসলে সঙ্গে রেণুকাও উঠে আসবে।
ঘটলও তাই। নৈর্ঋতকে নিয়ে মাঝখানের ডাইনিং প্যাসেজটা ছাড়িয়ে আসতে আসতে রান্নাঘরের মুখে রেণুকা বিরজাবালাকে একপাশ থেকে প্রায় জড়িয়ে ধরল, ‘ও পিসিমা, কতদিন বাদে আপনারে দেখলাম, বাবায় মরার পর একবার আইচেলেন নিখিলরে নিয়া Ñ তারপর আর দেখি নাই। নিখিল তখন কেবল ভার্সিটিতে পড়ে, সে আইজ কতদিন।’
বিরজাবালা একটু যেন অস্বস্তিতে পড়ল। আবার হয়তো না। এতদিন বাদে রেণুকার সঙ্গে দেখা, তার একমাত্র দাদার আদরের ছোট মেয়ে, সে তার ছোট পিসি। অরুণ নামের লোকটা সঙ্গে না থাকলে হয়তো ঢোকার দরজায় দাঁড়িয়েই রেণুকা তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁদত। এতে অন্য একটি হিসেবও মিলিয়ে নিল বিরজাবালা, তাহলে ওই লোকটার সঙ্গে রেণুকার সম্পর্ক যা-ই থাক, তার সামনে পিসিকে জড়িয়ে ধরে এতদিন বাদে দেখা হওয়ার জন্যে তাহলে কাঁদা যায় না। নৈর্ঋত বিরজাবালার ডান হাতে, রেণুকা বাম দিক দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। বিরজাবালার চোখেও জল এলো। জল হয়তো এসেছে শুধু এই জন্যে নয় যে, এতদিন বাদে রেণুকাকে দেখছে সে, হয়তো এই জন্যেও, তারা বড়দা এই ছোট মেয়েটার কোনো গতি করে যেতে পারে নাই, সে-মেয়ে কোথায় না কোথায় থাকে; দেখো আজ খোঁজ নিয়ে ছোট পিসিমাকে দেখতে এসেছে।
সমস্ত দুঃখকে মিশিয়ে যেন বিরজাবালা রেণুকাকে বলল, ‘বয় আমার ধার দিয়া, দেহি শুনি তুই আছো কেমন?’
‘আছি – বাইচা আছি, পিসিমা – খারাপ না।’ রেণুকা নাক টানে, চোখের জল মোছে আঁচল টেনে; আর এদিকে নৈর্ঋতকে বিরজাবালা রেণুকার কোলে দিতে দিতে বলে, ‘দেখি দাদা, পিসির কোলে যাও এট্টু, আমি একটু চুলাটা জ্বালাই –
নৈর্ঋত রেণুকার কোলে যায়। বিরজাবালা গ্যাসের চুলায় কেটলি দিতে দিতে বলে, ‘আছো কোথায় এহোন?’
‘চট্টগ্রাম -’
‘চট্টগ্রাম? শোনচেলাম, তুই নাকি ময়মনসিংহের কি শেরপুর না কোন জায়গায়, নাকি সিলেট ছিলি?’
‘শেরপুর ছেলাম – সেই চাকরি ছাড়ার পর এহোন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার – এসব জায়গায় ছেলাম – এহোন আবার চট্টগ্রাম।’
‘কিসে কাজ করো তুই?’
‘এট্টা মিশনারিতে, খ্রিষ্টানগো –
‘খিরিসটানগো?’
‘হয় –
‘তুই খিরিসটান হইচো নাকি?’
‘না।’
‘সাতের ওই ব্যাডা খিরিসটান?’
‘না। তয়, সে কোনো ধর্মকম্মের ব্যাপারে নাই –
‘দেইহাই আমার সেইয়া মনে হইচে – কী জানি নাম কইল, অরুণ না অজয় –
‘অরুণ অধিকারী।’
‘হয় অরুণ। চায় চিনি খায়?’
‘খায়’
‘তুই খাও?’
‘খাই।’
এইসব বলে বিরজাবালা ধীরে ধীরে আসল কথায় ঢুকতে চায়। তার আগে আবার নৈর্র্র্ঋতকে কোলে নিয়ে ফ্রিজ থেকে মিষ্টির প্যাকেট বের করে। চায়ে চিনি খায় যখন, তাহলে মিষ্টি দেওয়া যাবে। বিরজাবালা একহাতে দুটো প্লেটে মিষ্টি সাজানোর উদ্যোগ নিলে রেণুকা বলে, ‘আমারে দিয়েন না। আমরা একটু আগে ভাত খাইচি। আইচি তো অফিসের কাজে। ওনারে দেন। দেন, আমি দিয়া আসি।’
রেণুকা বসার ঘর থেকে রান্নাঘরের দরজায় ফিরে বলল, ‘ওর মা – সুপর্ণা উঠবে না?’
‘ওঠপে। ঘুমাক – বউর মাথা ধরছে – দুপুরেও কিছু খায় নাই কইতে গেলে, আজকাল খুব মাথায় যন্ত্রণা হয় বউর।’
‘কেন?’
‘কী জানি – মনে হয় চোখে সমস্যা হইতেচে।’
‘তা হতে পারে। আমারও আগে মাথা ধরত।’
‘গেছে এখন?’
‘পেরায় –
‘অরুণের বাড়ি বরগুনা কোথায়?’
‘সদরে –
‘তোর সঙ্গে পরিচয় কোথায়?’
‘কক্সবাজার – এই কাজে আসার পর-
বিরজাবালা এমনভাবে প্রশ্ন করছে যেন সে ইতিমধ্যে কিছুটা হলেও বুঝে গেছে রেণুকার সঙ্গে অরুণের সম্পর্ক কী। এখন হয়তো সেই হিসাব পুরোপুরি মিলিয়ে নিতে চাইছে। কিন্তু বিরজাবালা কথা বলার ধরনে নিজের সেই বোঝাবুঝি কোনোভাবে বুঝতে দিতে চাইল না। আবার এদিকে হয়তো রেণুকা চাইছিল, তার বলার চেয়ে পিসিমা জানতে চাক।
‘এহোন কী সিদ্ধান্ত নেচো?’ মুখে একটু হাসির আভাস এনে বিরজাবালা রেণুকার দিকে চাইল, কিন্তু ওই আভাসটুকু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল। কেননা, তার এ-কথায় রেণুকার মুখের রেখার কোনো পরিবর্তন হলো না। এতে বিরজাবালাও যেন কথাটার কোনো সদুত্তর পাবে না বুঝে গেল।
বিরজাবালা রেণুকার মুখের দিকে আবার তাকাল। চোখ দেখল। আর শুনল রেণুকা বলছে, ‘সিদ্ধান্ত কী, পিসিমা। কোনো সিদ্ধান্তই নাই।’
‘তয় –
‘আমাগো চাকরিতে বিয়া নাই। বিয়া করা যাবে না। খ্রিষ্টান মিশনারিদের কাজ তো সবাই নান-ফাদার -’ বলে বুঝল ভাঙানো দরকার, ‘সব খ্রিষ্টান সন্ন্যাসী-মহিলাই বেশি – পুরুষও আছে কিছু -এগো বিভিন্ন কায়-কারবার, দেশি-বিদেশি অন্য ধর্মের যারা তাগো কাজে নেবে, কিন্তু তারাও বিয়া করতে পারবে না।’
‘তার?’
বিরজাবালার ‘তার’ মানে তারপর, কিন্তু জানতে চাওয়াটা এমন বোঝাল যেন মনে হলো, তাহলে এ-লোকটার সঙ্গে তুই আছিস কেন? অথবা, এমনও হতে পারে, তাহলে তোদের এ-সম্পর্কের গন্তব্য কী? অথবা, হতে পারে, তাহলে সম্পর্কটা কেমন?
বিরজাবালা পিরিচে কাপ রেখে এক কাপ চা রেণুকার দিকে এগিয়ে দিলো অরুণকে দিয়ে আসার জন্যে। রেণুকা ফিরে আসলে তার হাতে কাপ দিলো। রেণুকা নৈর্ঋতের হাতে যে-বিস্কুটখানা দিয়েছিল, তা হাতেই ধরা। সন্ধ্যার আগে নৈর্ঋতের জন্যে দুধ চাপাতে হবে।
‘কোনো তারপর না, পিসিমা।’
‘কেন?’
‘আপনে কী ভাবতেছেন?’ এই সময় বিরজাবালা সুপর্ণা আর নিখিলের ঘরে উঁকি দেয়। নৈর্ঋত বলে, ‘মা যাব’- বিরজাবালা তাকে ‘না দাদা, মা ঘুমায়’ – বলে পাশের ঘরের দিকে এগোয়। খাটে বসে কথা বলবে। তার আগে রেণুকাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুই মিষ্টি খাইলি না?’ রেণুকা এদিক-ওদিক মাথা নাড়ে। বিরজাবালা নিজের খাটের এক কোনায় বসে, রেণুকা অন্য কোনায়। নৈর্ঋতকে খাটের ওপর ছেড়ে দিয়ে রেণুকাকে বলে পায়ের কাছে বলটা তুলে নৈর্ঋতের হাতে দিতে। তারপর একদম রেণুকার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাবিটাবি নাই কিছু –
‘না, পিসিমা’, রেণুকা লক্ষ করছে নিজের ভেতরের জড়তা সে কোনোভাবে সরাতে পারছে না। বাবার ছোট বোন, তার পিসি; তাদের মাঝখানে আরো দুই ভাইবোন রেণুকার কাকা ও বড় পিসি। একজন বেঁচে আছে, একজন নেই। এখন ছোট পিসির সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার মতো জড়তাহীন সে হতে পারছে না। বিয়ে না করার এ-সমস্যা। বিবাহিত মহিলারা একে অন্যের সঙ্গে অবলীলাক্রমে কত পদের কথা বলে। রেণুকা দেখেছে, সেখানে থাকলে তাকে সরে যেতে হয়, অথবা চুপচাপ শুনে যেতে হয়, যেন এ-বিষয়ে বলার মতো কোনো অভিজ্ঞতা তার নেই। তাই বিরজাবালাকে এখন কী বলতে হয়, কী বলবে ভাবতে ভাবতে, কীভাবে বলতে ঠিক করতে করতে বলল, ‘আপনে কি বিয়ার কথা কয়েন? আর বিয়া, এই বয়সে আর বিয়া করলে কী, না করলে কী? সময়মতো বিয়া হইলে, আমার ছেলেপেলে এহোন বড় হইত – পেরায় ভার্সিটিতে পড়ার বয়স হইত, মাইয়া থাকলে শাশুড়ি হইতাম – বয়স তো আমার কালে কালে কম হইল না, পঞ্চাশ ছুঁলো -’
বিরজাবালা লক্ষ করল, কথাগুলো বলতে বলতে রেণুকা যেন একটু নিজের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল, অথবা হারিয়ে গেছিল, যেন এই কথাগুলোর কোনোটা সে নিজেকে বলছিল না, নিজের সম্পর্কে এই স্বগতোক্তি শুধু বাতাসকেই শোনাল, সেখানে বিরজাবালা নেই।
বিরজাবালা ভাবল বলে, নিজের দোষে আইজ তোর এই অবস্থা। কিন্তু তা বলল না। সেও প্রায় একইভাবে বলল, ‘কত ভালো ভালো সম্বন্ধ আইচে তোর, বিয়া করলি না -’
রেণুকা যেন কথাটা শুনল না। নৈর্ঋতের দিকে চাইল। সেখান থেকে মুখ ঘোরাল। প্রসঙ্গ পালটাইতে চাইল। তারপর উঠে ঘরের সুইচবোর্ডে আলো জ্বেলে দিলো। হ্যাঁ, আলো জ্বালানো দরকার ছিল।
‘বিয়া করা যাবে না পিসিমা। তার আর কোনো দরকার নাই তয় সেরও আমার মতন অবস্থা এদেশে কেউ নাই একলা মানুষ, এই চাকরি নিয়া আছে। মিশনারির লোকজন কইচে একসাতে থাকলে থাকতে পারি তাতে তাদের সমস্যা নাই যেখানে অফিস আমাদের তার পাশে ছোট্ট কোয়ার্টার মতন আছে, সেখানে থাকতে তাগো পয়সা-কড়িও দেওয়া লাগবে না, কিন্তু বিয়া করা যাবে না। আমরা এহোনো সেখানে উঠি নাই ’
বিরজাবালা রেণুকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই তাকিয়ে থাকায় বিস্ময় যেমন আছে, একই সঙ্গে সহানুভূতি আর সমর্থনও কম নেই। সে আর রেণুকা একই গোষ্ঠীর মেয়ে, পিসি-ভাইঝি কিন্তু দেখো জীবনে কত তফাৎ। এমন কথা বিরজাবালা শুনেছে, বিদেশে এখন নাকি দুজন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে থাকে, কোনোদিন তারা বিয়ে করে না; বাংলাদেশেও তাই – তার ভাইঝি রেণুকার জীবনে। হতে পারে, পড়ছে মেয়ে খ্রিষ্টানদের পাল্লায়, বিদেশিদের অফিস, সেখানে এসব ঘটনা তো ঘটতেই পারে। যদি রেণুকার অফিসসংক্রান্ত এ-বিষয়গুলোর অনেকখানিই তার কাল্পনিক। খ্রিষ্টান মিশনারি শোনার পর বিরজাবালা মনে মনে বানিয়ে নিয়েছে যে, রেণুকা যাদের সঙ্গে কাজ করে তারা বিদেশি। সাদা চামড়ার। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মেয়েটা এমন কাজ করতেই পারে। তবে, এ-কাজে জাত যাবে না; কিন্তু ঘটনাটা কেমন, মানুষকে কীভাবে বলা যায় এমন লজ্জার কথা। সাদা চামড়াদের পক্ষে এর সবই সম্ভব বিয়ে না করেও একসঙ্গে দুজন মানুষের থাকতে দেওয়া!
‘হইল।’ বিরজাবালা রেণুকার কথার উত্তরে বলল, ‘তবু নিজেগো জাত-ধর্মের এট্টা সংস্কার তো আছে; কায়দা আছে – দেকতে আসতেছে কেডা -পারলে কালীবাড়ি যাইয়া একবার কপালে সিন্দুর ছোঁয়াইয়া আয় তারপর থাক একসঙ্গে –
বিরজাবালা নিজের মতন একটা সমাধান দিয়ে দিলো। ভেতরে ভেতরে অর্থাৎ নিজে নিজে এমন কথা কখনো রেণুকা ভাবে নাই, তাও না। সে কথা বলেওছে অরুণকে। কিন্তু অরুণ রাজি না। ধর্মকর্ম নিয়ে, এসব কালীবাড়ি যাওয়া নিয়ে অরুণের কোনোই আগ্রহ নেই। তবু বিরজাবালার দেওয়া এমন সমাধানের উত্তরে রেণুকাকে বলতেই হলো, ‘দেখি, পিসিমা আলাপ করে কী কয় আমিও সেইয়া ভাবছি।’
যদিও বিরজাবালা ভাবল, সময়মতো তো তোর কপালে সিন্দুর ছোঁয়াইতে পারলি না যদি এহোন এই সুযোগে কপালে সিন্দুর ওঠে; কিন্তু মুখে বলল, ‘তাই করিস, তারপর শাঁখা-সিন্দুর পরলি না পরলি, সেয়া দেখতে আসতেছে কেডা –
এই সময় নৈর্ঋত খাটের ওপর দাঁড়িয়ে বিরজাবালার দিকে হাত বাড়িয়েছে, তাকে কোলে নেওয়ার জন্যে। বিরজাবালা নাতি কোলে নিতে নিতে শোনে বসার ঘর থেকে অরুণ ডাকল রেণুকাকে। বিরজাবালা নৈর্ঋতকে কোলে নিতে নিতে বলল, ‘তোরে ডাকে, যা Ñ কতক্ষণ একলা একলা বসাইয়া থুইয়া আইছো –
বিরজাবালা বলতে চাইছিল, জামাইকে বসাইয়া থুইয়া আইছো, কিন্তু বলল না।
রেণুকা বলল, ‘যাই বসুক, জানে তো কতদিন পর পিসিমার সাথে দেখা হইল Ñ’
‘তবু, যা ’
এই সময় এ-ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল সুপর্ণা। ঘুম থেকে উঠে চোখে জল দিয়েছে, চুলে জল লেগে আছে, কিন্তু চোখ ফোলাফোলা, দীর্ঘ ঘুম থেকে উঠেছে বোঝা যায়। বিরজাবালার দিকে লজ্জিত চোখে তাকিয়ে আছে, দেখছে ছেলেকেও। শাশুড়ির প্রতি মহাকৃতজ্ঞ সুপর্ণা এতক্ষণ ছেলেকে সামলে রেখেছে। কিন্তু সুপর্ণা দরজায় দাঁড়িয়ে রেণুকাকে দেখে থমকাল। বিরজাবালা বলল, ‘আসো বউমা, এই যে তোমার এক দিদি, রেণুকা কইচি না কত ওর কথা, আমার বড়দার ছোট মেয়ে।’
সুপর্ণা ‘দিদি, নমস্কার’ বলে রেণুকার পায়ের দিকে ঝুঁকতেই রেণুকা সুপর্ণাকে থামাল, তারপর জড়িয়ে ধরল, ‘কতদিন ভাবি আসপো তোমাগো দেখতে, কিন্তু আসাই হয় না।’ সুপর্ণা সুন্দরী, গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা রেণুকার তাকে দেখেই পছন্দ হলো। সুপর্ণার চিবুকে হাত দিয়ে বলল, ‘কী সুন্দর দেখতে তুমি, বউ ’
এ-সময় আবার বসার ঘর থেকে রেণুকার নাম ধরে ডাকল অরুণ। আর একই সময়ে সুপর্ণা বলছিল, ‘মা, দিদিরে চা -টা কিছু দিছেন?’ কিন্তু, এই ডাকে সুপর্ণা যেন একটু চমকে তাকাল, বসার ঘরে কে? সে তো ভেবেছিল রেণুকা একলাই এসেছে। অরুণ ততক্ষণে বসার ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে, সুপর্ণা যেখানে দাঁড়ানো সেখান থেকে তাকে দেখা যায় না; কিন্তু বিরজাবালা দেখল, রেণুকাও দেখেছে। অরুণ আবার বসার ঘরে ঢুকে গেছে।
বিরজাবালা রেণুকার দিকে চাইল, এর অর্থ, শোন, ডাকে কেন? আর একই সময়ে সুপর্ণা শাশুড়ির দিকে তাকালে, দেখল বিরজাবালার ঠোঁটে ঈষৎ হাসি। রেণুকা ওই রুমের দিকে চলে গেলে বিরজাবালা নৈর্ঋতকে সুপর্ণার কোলে দিতে দিতে বলল, ‘রেণুর সাথে একসাথে কাজ করে ’
‘আমিও তো তাই ভাবলাম, রেণুদির সাথে আবার কে? আর বিয়ে করলে রেণুদির হাতে শাঁখা-সিন্দুর কিছু থাকত।’
‘তা থাকবে না –
‘কেন – মুসলমান নাকি?’
‘না, ওরা যে-জায়গায় কাজ করে সে-জায়গায় বিয়া করতে পারবে না।’
‘ওমা, এইরকম জায়গা আছে নাকি?’
‘কী বলল, খিরিসটান মিশনারি নাকি’
‘তাই নাকি, কী বলেন?’
‘হইতে পারে আবার নাও হইতে পারে হয়তো বানাইয়া কয়, দুজন একসাথে থাকপে আর নয় এহোনি থাকে একসাথে – সেই জন্যে।’
সুপর্ণা মুখ টিপে হাসল। তারপর প্রসঙ্গ পালটাল, ‘মা, নৈর্ঋতের দুধ গরম দিছেন?’
‘হয়, ফ্রিজ থেকে বের করে রাখছি। দাঁড়াও চুলাটা ধরাই ’ বলে সুপর্ণার কাছে জানতে চাইল, ‘ওই ঘরের দিকে যাবা না? দেইখা আসো, লোকটার সাথে এট্টু কথা বলবা না?’
সুপর্ণা আবার হাসল।
তিন
কিন্তু বিরজাবালা রান্নাঘরের দিকে আর সুপর্ণা নৈর্ঋতকে কোলে নিয়ে বসার ঘরের দিকে যেতে যেতে রেণুকা বসার ঘর থেকে বের হয়ে আসল। পেছনে অরুণ দাঁড়ানো। রেণুকা ডাকল, ‘পিসিমা?’
বিরজাবালা রান্নাঘরের দরজা থেকে বলল, ‘আসি, বয়।’
‘না পিসিমা, আর বসব না। আমরা যাই -’
‘কেন, যাবেন কেন, দিদি?’ সুপর্ণা বলল, ‘থাকেন, কতদিন পরে আসলেন। ওনার সাথেও আলাপ হলো না।’ বলে সুপর্ণা অরুণের দিকে চাইল, ‘আমি সুপর্ণা -’
অরুণ তার পরিচয় দিতে দিতে বিরজাবালা সামনে এসে দাঁড়াল, ‘যাবি কেন? নিখিল আসল না’
ফাঁকে সুপর্ণা বলল, ‘আজ মনে হয় আসতে দেরি হবে –
বিরজাবালা বলল, ‘থাক, নিখিলের সাথে দেখা কইরে যাস –
তারপর অরুণকে বলল, ‘ও বাবা, থাকেন আমার ছেলে আসুক-
‘না, তা হয় না। তয় আইজ রাতে দুটো ডালভাত মুখে দিয়া তারপর যাইয়েন – রেণুরে কতদিন পরে দেকলাম -’
এ-কথা বলতে বলতে বিরজাবালার গলা আবার ধরে আসছে। সত্যি ভাইঝিটারে কতদিন পরে দেখল সে। এই লোকটা – যা-ই হোক – বিরজাবালার কাছে ভাইঝি জামাইয়ের মতন।
‘না পিসিমা, আমাদের সন্ধ্যার পরে একটা মিটিং আছে।’ অরুণ বলল, ‘তারপর আইজ রাতেই আবার চট্টগ্রামে চলে যেতে হবে। ১১টায় বাস – অফিসের লোকজনের সাথে রাতের খাওয়া –
‘তয় আর কী কব?’
রেণুকা একটু এগিয়ে গেল একসময়, সুপর্ণার কাছে। নৈর্ঋতকে কোলে নেওয়ার ভঙ্গি করলে নৈর্ঋত তার কাছে না আসলে হাতের ভাঁজ থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলো নৈর্ঋতের ছোট হাতে। বলল, ‘নেও বাবা।’ তারপর সুপর্ণাকে বলল, ‘ওর জন্যে কিছু আনতে পারি নাই ওর কথা ফোনে নিখিল বলেও নাই তার আগে অবশ্য লাইন কাইটে গেছে’
সুপর্ণা বলল, ‘দিদি থাকতে পারলে থাকেন ’
‘না রে আর একদিন আসপো যদি বাঁচি ’
বিরজাবালা দুধের বাটি ডাইনিং টেবিলে রেখেছে। রেণুকা তাকে প্রণাম করে উঠতে বিরজাবালা বলল, ‘তয় থাকপি না, না? কী আর কব নিখিলের সাথেও দেখা হইল না তোর ছোটবেলায় এত রেণুদি করত, মনে আছে তোর’
অরুণ দরজা খুলেছে। রেণুকা আবার সুপর্ণার কাছে আসে। বিরজাবালার দিকে তাকায়। বিরজাবালার কাছে আসে। জড়িয়ে ধরে। কাঁদে, ‘পিসিমা, আবার দেখা হবে।’
বিরজাবালা বলল, ‘ঢাকা -টাকা আসলে আসিস, নিখিলের
বউছেলেরে দেখে যাস, নিখিল নাকি মোবাইল নেবে ফোন করে নাম্বার নিস ফোন করিস সুযোগ থাকলে -’
‘আমি যেখানে থাকি সেখানে ফোন নাই। তয় অফিসে মোবাইল নেবে শুনছি -’
‘তয় চিঠি লিখিস -’
‘আচ্ছা। যাই, পিসিমা -’
অরুণ বলল, ‘নমস্কার -’
দরজা দিয়ে বের হয়ে সিঁড়িতে নেমে যেতে যেতে রেণুকা আবার তাকাল। সিঁড়ি অন্ধকার হয়ে আসছে। বিরজাবালা আলো জ্বালাতে জ্বালাতে ওই আধো অন্ধকার ভাইঝির নেমে যাওয়া দেখল।
সিঁড়ির আলো জ্বালিয়ে দরজা দিতে দিতে সুপর্ণা তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই লোকটাকে বিয়ে করবে?’
‘না, বিয়ে না ওগো চাকরিতে নাকি বিয়ে করা যাবে না – একসাথে থাকপে -’
‘থাকুক না, খারাপ কী? মা, রেণুদি বুড়ো হয়ে আসতেছে – তবু এই বয়সে – একটা অবলম্বন। দুইজন দুইজনারে যেটুক দেখে রাখতে পারে -’
সুপর্ণার কথায় বিরজাবালা যেন ভরসা পেল; রেণুকার জন্যে প্রয়োজনীয় অনুমোদনও। যেন তাতে নিখিলেরও অনুমোদন আছে। বিরজাবালার ভাইয়ের মেয়ে। এই অনুমোদনটুকু যেন তার দরকার ছিল। অথবা, সুপর্ণার এ-কথা তার নিজের কাছেও অনুমোদন পেল, কথাটাই তার জন্যে অবলম্বন হয়ে উঠল।
‘হয় তাই, খারাপ-ভালো আর কী? মাইয়াডার এই বয়সে এট্টা গতি হইল।’ বলতে বলতে বিরজাবালা বসার ঘরের ঝুলবারান্দাটার দিকে গেল, যদি রেণুকাকে আবার দেখা যায়। আজ দেখল প্রায় কুড়ি বছর বাদে, আবার কবে দেখবে তার ঠিক আছে?…