পায়রা হামার লদীটো! – কুথা কুন্ঠে বটে তু?

চোতবোশেখের নিদয়া রোদে সীসা গলে আসমান ঝলসায় নদীতে আগুন লাগে। দূরে পায়রা নদীতে তপ্ত লাভা ঝলকায়। ওপারে ধোঁয়া ধোঁয়া ঝাপসা আমবাগান। তারো পারে দিগন্ত তামাপোড়া। লয়াগন্জের চক ওটা। এপারে এটা খোজাপুরের দিয়াড়। এখানে গ্রামগুলো গায়ে গায়ে হুমড়ি খেয়ে : নোনাডাঙ্গা, ক্যাশরডাঙ্গা, ঢুলিগাতী, হোসেনগন্জ যেন মায়ের পেটের ভাইবোন।

দেখেশুনে একটা শেঁয়াকুলঝোপের আড়াল নিয়ে আরাম করে বসে নিয়েছে কছিমবুঢ়া। আড়াইদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য। তলপেটে খাম। আজ যদি দয়াবর্ষণ হয়। মুখ বাঁকিয়ে কোঁত দিতে দিতে, হায়, সংসারচিন্তা তাকে আতান্তরে ফেলে দেয়! এমন যে এই সাধ্যিসাধনা তারির মধ্যেও। আয়তুনবান্দী পরশু রেতে ছোটবউমার ঠেঁই নালিশ দিয়েছে : কালুভাইকে অখনই একটো বিহ্যা দিয়া দ্যান কেনে। গায়ে হাত দিয়্যা নখ্রা করে হেই চাচি গ! হুম! ব্যাটাকে শাদি দিতে হব্যে খন্দ উঠলে পর। তাবাদে – তাবাদে – হায় – দেড়টি মাত্র বাতকর্ম সারতে পেরেছে কছিমবুঢ়া, এমন সময় মাথার উপর তীব্র তীক্ষ চিঁহিহিইইই- আকাশের এমাথাওমাথা চিরে নানাখান হয়ে গেল। বাহ্যেত্যাগ মাথায় উঠল। খয়রা রঙের পালক, ঢাউস দুটো ডানা, বাঁকানো ঠোঁট – ঝাঁ ঝাঁ ভাজাপোড়া রোদে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে কছিম। চোখের ওপরপাতায় হাতআড়াল করে নজরে আনার চেষ্টা করে। হেঁ! শিকারি বাজই বটে। মাথার উপর গোল হয়ে চক্কর দিচ্ছে। একেকবার পাক দিয়ে উড়ে চলে যায় হুই হোথাকে দূরে নজরের বা’রসীমানায় ক্যাশরডাঙ্গা, লয়নপুর কাঁহা কাঁহা মুলুকে! ফের আবার ফিরে আসে হিঁ মোদের ই খোজাপুর গাঁওট্যের চটান আশমানে। খালভরা গুয়োট্যা- কেনে – ব্যুলি কেনে তু লজর দিবি হামার ই ধনসোহাগী মাটিবেটির পানে? হাঁর বাগানে গাছে গাছে আম, দিয়াড়জমিনে কালাই-কুশোর-গহম, ঘরে ঘরে ডোল ভরা ধান আর জরুবহুদের ওলান ভরা দুধ। কী চাহ তু ই সোনাফলা দ্যাশে? যাযা : – অপয়া ইবলিসটো, তু আরো উত্তর দ্যাশে যা। অফলা মঙা হোথাকে। মানহুষে মানহুষ নাইখ। হামারঘে ই পায়রা লদীতে য’দিন পানি আচে ভরভরন্ত, ত’দিন কিসের লেগে ডরভয়? তু ভিনআশমানে যা দিকিন বাপো! হাতে তালি দিয়ে দিয়ে অপদেবতা তাড়ায়। আর টানা উড়াল দিয়ে পাখশাট মেরে পাখিটি উধাও হয়ে যায়।
ফল যা হবার তাই হল আখেরে। কোঁতের পর কোঁত, মাল আর নিকলায় না। শুভকর্মে আজো বাগড়া। গুদাম খালাস না করেই ব্যাজার মুখে উঠে পড়ে কছিম। আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজোবেকা…  … … অভ্যেসদোষে মলত্যাগের দোয়া বকে বিড়বিড় করে। ঠিক আচে, পরমাসেই বিহ্যা লাগাবু দামড়া ব্যাটা কালুটোকে। শোরের বাচ্চা হামার! শুখা বুকে তুড়ি বাজিয়ে আলকাপের সুর ধরে কছিম।
খোজাপুরের আকাশে লু হাওয়ার হল্কা। বুঝি কপালভুরু পুড়ে যায়।

দুই
খোজাপুরের সড়কে বিয়ের বাদ্যি বাজে।
দিনভর হাঁসফাঁস। মেহমানদের গিসগিস। পিলে ওঠা বাচ্চাদের ট্যাঁটানি। কুকুরবেড়ালের কাড়াকাড়ি এঁটো নিয়ে। সব ছাপিয়ে ঢোলডগরের ঢ্যামকুড়কুড় আর মেয়েদের বিয়ের গীত রগড়মশ্করা ঢলাঢলি। তা বলে এত ঢলক জোছনায়! ঢল নেমেছে বেগবাড়িতে। আলো তো নয় যেন বা দুধ হলুদপারা বলক তোলা দুধ, হলুদবরণ দুধসর। উঠোনবাড়ি সদরহালট থইথই চাঁদের বানে। জোহরওয়াক্তে বর নিয়ে বরযাত্রীরা রওনা দিয়ে গেছে। প্রথমে গোগাড়িতে নদীঘাটা। ট্রলারে নদী পেরিয়ে তাবাদে আবার গোগাড়ি। আলাইপুরের সরকারবাড়ি দশমাইলের পাড়ি। কলেমা পড়ানো খাওনদাওন বাহাছতক্রার নারীআচার – বউ নিয়ে ফিরতে ফিরতে রাতকাবার।

চাঁদের আলোর ঢলকানিতে বরের বাড়িতে ইষ্টিকুটুম-বউঝিউড়িতে রঙ্গলীলার ধুম লেগেছে। পয়লা একচোট রঙমাখামাখি হুড়োহুড়ি দঙ্গলে মিলে। তাবাদে এখন নাচনাগানা ডাঁসা ডব্কি মেইয়্যাগুলাতে। রাঙাঠোঁট ফুলকিভাবী গুলনাহার হাঁটুর ফাঁকে পাকড়িয়ে ধরে ঢোলকে ঘা মেরে যায় ঝাঁপতালে। অষ্টসখী গীত গায় সমস্বরে। কে মূলগায়েন কে দোহার হুদো নাইকো তার। রসের ভাবী আলতাবিবি, কোমরে কোমরবিছা কানে কানপাশা, ডানহাত ডানকোমরে বামহাত বামকপালে ঘুরেফিরে নেচে চলেছে দুলকি তালে ধপর ধপর। কিবা থলথলে কোমরখান বাপো হে! য্যান কামের পৈঠা ভারী। জমিনে গোড়ালি গেড়ে ঘুল্লি দেয় সোয়াপাক। দিয়াড়মাটি পাষাণকঠিন। তারো চাইতে চোঁয়াড়কঠিন বরীনবালার চরণ দুখান বটে। ভাঙে না ভি মচকায় না। আ দ্যাখো দ্যাখো তামাশাখান! আলতাবিবির পাছু পাছু কুঁজিবুড়ি ভি ধেই ধেই নাচন ধরেছে। মাথায় পোকায় কাটা তুর্কি টুপি হাতে লাঠি পিঠে কুঁজ। চাঁদের আলোয় আমড়াতলায় গাজন লেগেছে। একদল ঝিবহুতে মিলে গাছের ফাঁকে ফাঁকে লুকোচুরি খেলায় মেতেছে। একজন কু দিয়ে গাঢাকা দেয় অন্ধকারে। অন্যেরা আঁতিপাঁতি খুঁজে মরে। না পেয়ে খিলখিল হাস্যভরে ভেঙে পড়ে। রসের ফুলজানবেওয়াকে হেঁসেলঘরের পিছুবাগে একলা পেয়ে শাড়ি পরা উঁচু লম্বা কে একজন ‘এই ধর‌্যাছি আসামি’ বলে বুকে খাবল বসায়। ক্যা বটে হে তুমহি? গলার আওয়াজ চাপা তবু মোটা। হাতের থাবায় কড়া চাপ। বুকের নরম মাংস ছিঁড়ে নিল য্যান। ক্যা ক্যা বটে তু মিনসেপারা? নাগাল কাটিয়ে ছুট দেয় শাড়িপিন্ধন নাঙ পুরুষটি। ‘ঢ্যামনা হামার!’ তুরবুর তুরবুর গাল পাড়ে ফুলজানবেওয়া।

তিন
পুবদিক ফর্সা হতে লেগেছে। পাকুড়ডালে অকালকোকিল একলা বসে কুহর কাটে কুহুউ।
দূরসড়ক থেকে ঢোলডগরের আওয়াজ ভেসে আসে। হোই! দুলহা ফিরছে বহু লিয়্যা। উঠ্ গ সভে। ধানদুব্বা লিয়্যায়। লহমার মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় বেগবাড়িতে গুঁড়োগুঁড়ি বুড়োবুড়িতে।

প্রথমে বরবেশে টোপর মাথায় কালুবেগ। তার পিছে ঘোমটা টানা বহু হুরিমতীবিবি। কালুমিয়ার চেহারা আলুথালু। ঝড়ে বাড়ি খাওয়া দশা। পান্জাবির বামআস্তিন ছেঁড়া। কোনায় রক্ত লেগে আছে। ডানহাতটি যথারীতি পকেটে। ছুঁড়িগুলান বহুকে দেখে গা টেপাটেপি করে : গতরে মুটকি! কী আখাম্বা লম্বা বাপরি! হাড্ডি মোটা হাতের গাঁঠ। কালুমিয়াকে চিবায়্যা খায়্যা লিব্যে কহছি!

কালুর এই বেহালাতের পিছনকার ইতিহাসটুকু যেমন নাটকীয় তেমনি করুণ। সংক্ষেপে বয়ান করি।

বিয়েবাড়ির আড়ং জবর জমে উঠেছিল। খাওনদাওন, কিচ্ছাশোলোক, দেনমোহর বাঁধা, কলেমা পড়া; চলছিল ভালোই। নওশা কালুমিয়া বেশ যতেœর সঙ্গে ডানহাতখানি পান্জাবির সাইডপকেটে সেঁধিয়ে রাখতে পেরেছিল। খাওয়ার সময়েও কারুর নজরে পড়ে পারেনি। যেহেতু গ্রামবাংলার আমজনগণ স্বভাবত ক্ষুৎকাতর। তদুপরি, চোখের উপর মছ্লিমাংস-দহিসন্দেশ। কিন্তু ল্যাঠা বাধলো যখন কলেমাপাঠের অন্তে ঘটকমিয়া কালুকে কানে কানে সবক পঁহুচ করল, মিয়াজি! উঠ্যা দাঁড়ান কেনে। ময়মুরুব্বি সভাজনে ঘুর‌্যা ঘুর‌্যা সেলামালকি দ্যান। জবুথবু কালু উঠে তেভেঙ্গো হয়ে দাঁড়ায়। রুমালসহ হাতখানি তুলে কপালে ঠেকায়। তখন আনতাউড়ি কাণ্ড ঘটে যায় একখান। পাশের বাড়ির লজিংমাস্টার আনারুল ছুটে এসে কালুমিয়ার হাত থেকে রুমালটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে মারে ঘটকের মুখের উপর। দুলহামিয়ার ডানহাতখানা খপ করে ধরে ফেলে। চেষ্টা করেও কালু সে হাত পকেটে ঢুকিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। হাতখানা হাজেরানে মজলিশের সামনে উঁচু করে তুলে ধরে আনারুল পরমুহূর্তে ফেটে পড়ে বাজখাঁই গলায়, কী – হচে তো? লজর কর‌্যা দেখ্যাছেন সভে লরলারী? দুলহামিয়ার ডাহিন হস্তে অঙ্গুলি নাইখ একটো। অখে লিজগাঁওয়ে বুল্যে চারআঙুলে কালু। কেমুন? কহে কিনা? নাম্বার ওয়ান ফোরটুয়েন্টি চিটার দু’নাম্বারী মাল। বুল্যে -! এমত পোদ্দারী গার্জিয়ানগিরির জরুর হক আছে আনারুল মাস্টারের। কেননা তার পিন্ধনে ফুলপেন্টুল বাঁহাতে ঘড়ি এই রেতের বেলায় চোখে সানগ্লাস; অধিক মুখে হিংলিশ। লাগেরে লাগ ধুন্ধুমার মর্হরম। মছ্লিমাংসে-দহিসন্দেশে একাকার। তিনুঘটকের দাড়ি ছেঁড়ে। কছিমবুঢ়ার চোখেমুখে ভির্মি লাগে। কার জানি হেঁসোর ডগায় আঁচড় লাগে কালুর আস্তিনে। জামা ছিঁড়ে রক্ত ছোটে। বাড়ির ভিতর থেকে ডুকরানির রোল ওঠে। জমির সরকার তড়্পে ওঠে বাঘের মতো, হেঁএএ! খুঁতো মাল চালাইতে আইসছে! যা লিয়্যা যাগে ফিরত। দিব্যো না হামারঘে মেইয়্যা। বুঢ়ি কর‌্যা রাখ্যা দিব্যো ঘরে। কালুর মুখে রাওটি সরে না। সারেজাহানের মালেক তাকে জন্মেতেই মেরে রেখেছে। কছিমবেগ চাপা গলায় বলে, হিঁইইঃ! রোয়াব কত! বিলাকের ট্যাকায় মোহাজন, তার আবার ফুটানি! এই সময় বাড়ির ভিতর থেকে কনের জননী একজন মুনিষকে দিয়ে কনের বাপকে ডেকে পাঠায়। একে টাকার গরম, তার উপর মেয়ের বিয়ে-বিয়ের কেত্তনে মাথাগরম। ঘরে ঢুকে গিন্নির উপর তম্বি ঝাড়তে থাকে জমির সরকার। শান্তিবালা প্রথমটা কোনো কথা বলে না। দম নেবার জন্যে জমির একটু থামলে খুব কঠিন গলায় বলে, মাস্টোরকে রুখো। পরের ছ্যাইলার অংগে খুঁত দেখলা, তুমহার মেইয়্যার গভ্ভে যি উ মাস্টোরের বীজ আচে। শুনো, উ খোজাপুরের ছ্যালা য্যান ফিরত না যায়। গাল হাঁ হয়ে যায় জমিরের। হঠাৎ চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। বাল কামাইছিস ঘরে বস্যা? মেইয়্যার উপর লজর দিতে পারিসনে? বলতে বলতে হন্হন্ করে বাইরে চলে যায়। বিয়ের আসর আবার জমে ওঠে। জমির সরকার কছিমবেগের হাত জড়িয়ে ধরে বলে, খ্যামাঘেন্না দ্যান কেনে বেহাই সাহেব। বহু লিয়্যা ঘরোৎ যান ছহিছালামতে। আনারুল মাস্টার লাফ দিয়ে ওঠে, নো নো Ñ ভেরি ব্যাড ভেরি ব্যাড। জমির তাকে তেড়ে যায় হিংস্রভাবে, তুই চুপ্পো ফোঁপরদালাল। পরের বাড়ি খাস পরের বাড়ি শুস। তু ক্যা বট হে ফাল পাড়িস? লেঙ্গুড় গুটিয়ে কেটে পড়ে আনারুল।

গোগাড়ি গ্রামসীমানা ছাড়িয়ে এবারে ফাঁকা এলাকায় উঠে এসেছে। সড়কের দুধারে মাঠের পর মাঠ। কোথাও কোথাও ফসলের জমি। কী ফসল? গম? না গম তো এখন ফলে না। কুশোরও নয়। হবে হয়তো ভুট্টাটুট্টা। ইরিবোরোও হতে পারে। হাল আমলে এ চাষটার খুব চলন শুরু হয়েছে সরকারি প্রকল্পের আওতায়। রাতের নিশুতি প্রহরটুকু কেটে গেছে। এখন শুধু ভোরবেলাকার নিঃশব্দ প্রস্তুতি আকাশমাটিতে। মরাজোছনায় নেয়ে ওঠা আলোআঁধার, মাঝে মাঝে জোনাকপোকার উড়ে বেড়ানো আলোর ফুটকি। চারদিক শান্ত জীবন্ত। যেন আলিঝালি মায়াপুরী। সামনেপেছনে বরযাত্রীবাহী গোগাড়ির সারি। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ। গোরুগুলোর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পথ চলা। ঢুলু ঢুলু চোখ গাড়োয়ানের থেকে থেকে হুঁশিয়ারি : আবে হ্যাট হ্যাট – ডাহিন সিধা। ছইয়ের ভিতর আর কেউ নেই। শুধু ওরা দুজনা। কথা নেই কারো মুখে। হুরিমতী বসে আছে খাম ধরে। ঘোমটা খসে খোঁপায় আটকে আছে। মাঝে মাঝে কানপাশা-রুলি চিকচিক করে উঠছে। কী ভাবছে সারাটি পথ? ঝুঝি মনে মনে দুখালছে মাবাপের লেগে। কান্দো সোনা কান্দো। হামার ঘরে লিয়্যা যাই আগে। তুমহাক হামি পিরিতের রসে চুবায়্যা রাখবো। নতুন আশনাইয়ে ভিজে জবজবে হয়ে ওঠে কালুর দিলখান।
এদিকে ভোর হয়ে আসতে লেগেছে এতক্ষণে। লিলুয়া বায়ে ডানা পত্ পত্ করে কাকোয়াল পক্ষি উড়ে যায়। বৈশাখের এই ভোরহাওয়া হালকা মোলাম পরশে বুকের কপাটে চুমকুড়ি কাটে। বলতে চায়, চোখ মেলে দেখো, পুবআকাশ জেগে উঠছে। মাটিতে চেতন লাগছে। বৃক্ষদের পাতায় পাতায় শিরায় শিরায় শিহরণ। গাঁয়ের পাঠশালায় উপরের ক্লাশের এক বখাটে পোড়োর কাছে ছেলেবেলায় শেখা ইংরিজিটা অস্ফুটে আওড়ায় কালু : আই লাব ইউ।
হুই দেখা যায় পায়রা নদীর উঁচু পাড়। ঢালু ঘাট। গোযানগুলো পৌঁছে যায় একে একে। ট্রলার অপেক্ষা করছে কাল বিকেল থেকে। একটা পানসি নৌকো বাঁধা আছে সামান্য দূরে। দলনেতা কছিমবেগের নির্দেশে বরবধূ পানসিতে উঠে যায়। বাকিরা সবাই ট্রলারে ওঠে। সকালবেলার প্রথম আলো এসে পায়রা নদীটিকে মনের মতো করে সাজাতে বসল। কপোলে গোলাপি রাগ, কপালে রূপালি ছটা, কোমরে কল্লোল, বুকে ঢেউ, দু’তীরে সবুজ পাড়। ছপ ছপ শব্দ বৈঠায়। মন্দ মন্দ দুলুনি নৌকোয়। পুবালি বাতাসে মাঝির গলা ছেড়ে গান। আদিগন্ত উদোম আকাশের তলায় ভেসে চলা পানশি। তার ছইয়ের ভেতর বরকনের জোড়। নদীর শান্ত শ্রী দেখতে দেখতে কালুর পাঁজর উপ্চে বোল ওঠে। আদুরে গলায় বলে, ই লদীটো হামারঘে গাঁওগঞ্জের পেরাণ। পায়রা লদী নাম। ছটুকালে ঝাঁপালছি। জোয়ানকালে বাইচ খেলি। আঁই গ হুরি, তু হামার পায়রাবিবি। লয় কিনা ব্যুল। হুরি নিসাড় হয়ে বসে ছিল সারাপথ। উদ্বেগে-উৎকণ্ঠায় মুখে কথাটি সরেনি। পাগলশিশুটির প্রণয়প্রলাপ শুনতে শুনতে ধড়ে প্রাণ আসে এতক্ষণে। এই প্রথম সে চোখ তুলে কালুর মুখখানি পূর্ণ পলকে দেখে। কালু গদগদ গলায় বকে চলে, ঘরোত চ পহেলা। তুকে কালাইর রুটি খিলাইবো, হাঁ? হুরির গলার মাংসে তিনটে মালার ভাঁজ। কালু শুনেছে এই নারীরা গীত গাহে জবর। রোসো, বাড়ি লিয়্যা লিইখন। সোহাগ ঢালা গলায় বলে, তুতে হামাতে চান্দের আলায় নাহিবো ই লদীতে। তাবাদে Ñ! রাতজাগা ক্লান্তিতে ঝিমুতে লেগেছে হুরিমতী ওরফে কালুর পায়রাবিবি। কী একটা অজানা পাখির কর্কশ ডাকে তার তন্দ্রা ভেঙে যায়। পাখিটাও মনে হয় নদী পাড়ি দিচ্ছে উড়ে উড়ে। শুখা দেশের মেয়ে সে। এই প্রথম পরিচয় হচ্ছে পানির দেশের সঙ্গে। চোখ মেলে রৌদ্রজ্বলা পানির দৃশ্য দেখতে থাকে। কালু ঠায় বসে থেকে হরবোলা পাখির মতো একা একা বকে চলেছে। শ্বশুরবাড়িতে এত যে প্যাঁদানি খেয়েছে, চোখেমুখে কোনো বিকার নেই তার। হুরি মনে মনে নিশ্চিন্ত হয়, এই চারআঙুলে পুরুষটি ব্যক্তিত্বহীন হলেও আসলে নিরাপদ। জামা ছেঁড়া, হাতায় শুকনো রক্তের দাগ। ব্যাচারা! হুরি আস্তে আস্তে বলে, পিরানটো খুল্যে দ্যান। লদীর পানিতে ধুয়্যা দিই। তার এই হঠাৎ প্রস্তাবে চমকে যায় কালু। সামলে নিয়ে হেসে বলে, অখন আর শুখাইবে না। পারে আস্যা পড়্যাছে লাও।

ডাঙার মাটিতে পা রাখতেই চারআঙুলে কালুবেগের ছুরতকিসিমে দারুণ একটা নতুন জেল্লা চোখে পড়ে হুরির। চলনে ভারত্ব। চাহনিতে গাঢ়ত্ব। গলার স্বরে ওজন। মোটামুটি একটা আত্মস্থ পুরুষ মানুষ। মেয়েরা মনে হয় এরকমটাই চায়। ভেড়–য়া নয় আকাট। চারআনা তেজ দুআনা কিরদানি। সেই সঙ্গে বোলবোলাও কিছুটা থাকে তো থাকুকগে। হুরিমতী ধাতস্থ হয় এতক্ষণে। কালু জাঁক করে জানান দেয়, ই গাঁওট্যে হামার খোজাপুর বটে। গোরুর গাড়ি গ্রামসীমানার মুখোমুখি পৌঁছে যায়। পেছনে বরযাত্রীর বহর। বাদ্যিবাজনার জোকারজিগির। দূরে দূরে পাকুড়বটঅশথনিমবৃক্ষের ছায়াঘন জটলা। চোখ জুড়নো এত সবুজ! হুরিমতীর নজরে পলক সরে না। তারপর ধীরে ধীরে শুরু পুরো মহল্লার। গায়ে গায়ে বসতবাড়ি। দুচারখানা পাকা কোঠাবাড়িও। ফাঁকে ফাঁকে ক্ষেতখামার। ই ভুট্টাক্ষ্যাত হামারঘে। ভুট্টার খই খেচিস কখুনো? হামি খিলাবো তুকে। বাড়ি চল। উ জমিনে কুশোর ফলে গহম ফলে। অখন তরমুজের সিজিন বটে। তরমুজ ভি খাবি তু প্যাট পুরে‌্য। বাড়ি চ আগে। কালুর গলায় রোয়াবি চাড় দেখে পুলক লাগে হুরির। কেন লাগবে না? পুরুষরা প্রতাপী মেয়েরা আশ্রয়কামী। উল্টোটা হলেই ল্যাঠা। বড় চৌহদ্দিঅলা দেয়ালঘেরা বাড়ি দেখিয়ে কালু বুক উঁচিয়ে ঘোষণা দেয়, ই হামারঘে বেগবাড়ি। তুহার শ্বশুর কছিমুদ্দিন মোহাজন হামার দাপুটে বাপুটো। অখন বুঢ্ঢা হলছে। মাথায় ছিটও আচে হালকা-পাতল। খাব্যে কচুঘেচু হাগব্যে বাহিরবাড়িত। বেগবাড়ির পেসটিজ ধুলায় ডল্যাছে। শ্বশুরবাড়ির নাম শুনে মাথায় ঘোমটা টেনে নামিয়ে দেয় নববধূ। ঢোলে কাঠি পড়ে দ্বিগুণ বেগে। ধানদুব্বো সাজিয়ে নতুন বহুকে বরণ করে নিতে এগিয়ে আসে এয়ো বধূয়া।

বেলা চড়ছে চড়্চড়্ করে। বৈশাখী সূর্যে এই আগবেলাতেই জ্বলনপোড়ন। লু হাওয়া হল্কা ছড়াতে শুরু করেছে।

চার
বেগগুষ্ঠি ধনেজনে রমরমা। তিনখানা হাল, দুইজোড়া মোষ, একজোড়া গাইগোরু। আদরেকদরে হুরিমতীর পা পড়ে না মাটিতে। কালো তাতে কী! রূপেগুণে পয়ালক্ষ্মী। পারলে চরণদুখানি মাথায় করে রাখে কালু চারআঙুলে খুঁতো কালুবেগ। হুরি কাঁচা টক আম খোঁজে। ল্যাংড়া-গোপালভোগে স্বাদ মিঠা। লুকিয়ে পোড়ামাটি খায়। বমি করে অসময়ে। দুআড়াইমাস পরে বিছানায় বুকে মুখ চেপে ধরে কালু বলে, হেই হুরি! সাচ্ কহবি তো? মা কী বুলবার লাগ্যাছে? হুরি রসাল গলায় বলে, হাঁ গে! হামার গভ্ভে তুহার আওলাদ আসবার চাহে। কালু ক্ষিপ্ত হয়ে ফুকরে ওঠে, সাচ কহছিস? হুরির তলপেটে হাতের পাতা চেপে ধরে আসন্ন প্রাণের পদধ্বনি আন্দাজ করার চেষ্টা করে। হুরিমতী তার হাতখানা সরিয়ে দিতে দিতে বলে, অখনই পাগলা হচে! আরে, আরো দেড়দুমাস যাইবার দাও। ত্যাখন ডংকা বাজাইবে প্যাটে। শুনবা তুমহি। কালুবেগ খুশিতে গলে মেতে মেতে বলে, তু হামাক একটো ব্যাটাবাচ্চা দিবি কিন্তুক। হুরি বলে, আল্লাকে চাহো খাসদিলে। তাকে বুকের মধ্যে পিষে যেতে যেতে কালু বলে, হামার পায়রাবিবিটো তু! হুরির ঠোঁটে চুমু খেতে গিয়ে কড়া রাগপোড়া গন্ধে মুখ ফিরে আসে কালুর। আঁতকে উঠে জিগ্যেস করে, ই বোঁটকা গনধোট্যা কিসের বটে হে? হুরি হেসে দিয়ে অম্লান বদনে বলে, বিড়ি খেচি। কেনে তুমহার মাবহিন খায় না? হামার বাপভেয়েরা তো ফেনসিডিল খায়। বঢার থাক্যা চালান লিয়্যাসে বিলাকে। তুমহাক ভি খিলাব্যো হামি, হাঁ?
দেখতে দেখতে বেগবাড়িতে নসিব ডাইনে ফেরে। পায়রা নদীর জোয়ারে বান ডাকে। নয়াবহুর জাদুছোঁয়ায় কছিমবেগের দুয়ারে হাতি বান্ধা পড়ে। কালুর মা বলে, ব্যাটার বহু হামার পয়মন্ত আচে! বহুর পয়ে সংসারে মরাতরুলতায় কাঁঞ্চা সোনা ফলে। সেই ঠ্যাকারে হুরির পা পড়ে না মাটিতে। তার দেহঘটে রূপ উপ্চে পড়ে। হাসলে পরে মুক্তো ঝরে পড়ে। আর তার গর্ভের সন্তান ছমাস পেরিয়ে সাতমাসে পড়ে। কালু তার তলপেটে কান পেতে প্রাণলক্ষণ শুনতে পায়। হুরিমতীর কানে কানে বলে, কী নাম রাখবো ব্যুল তো? ইকরামুদ্দিন। সভে ব্যুলবে কালুবেগের ব্যাটা ইকুবেগ। সাতদিন পর এক দুপুরে সবগুলো গাছ থেকে আশ্বিনা আম পেড়ে মোষের গাড়ি বোঝাই করে ফেলে। রাতে হুরিকে বুকে নিয়ে বলে, কাল ফজরে আশ্বিনার চালান লিয়্যা সদরে যাব্যো। এবারে দাম বহুত। র্ধু ফাগ্লি! ডর পাস কেনে? হামি তো তিনচারদিনের ভিতরি ফির‌্যা আসবো। তুর লেগে মেঘডুম্বর শাড়ি লিয়্যাসবো। হুরি সারাটা রাত ঠান্ডা কাষ্ঠ হয়ে পড়ে থাকে বিছানায়। বচনহারা বদনখানি, অশ্র“ধোয়া নয়নদুটি। ভোরবিহানে নাস্তা খেয়ে আমের গাড়ি নিয়ে বিদায় জানায় কালু। মাচাচিদের সমুখে আলাদা করে কিছু বলা হয় না হুরিকে। কাছে এসে শুধু বলে, আসি তভে। হুঁশমতন থাকিস বহু। হুরি মুখে আঁচলচাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। আয়তুনবান্দী তাকে ধরে বাড়ির ভিতর নিয়ে আসে।
সারা দিনমান বুকের উপর পাষাণ গুরুভার। সে তো নেই। সুজনির উপর ফুলকাঁথা বিছানো। মাথার দিকে দুটো বালিশ পাতানো, একটি বালিশ হা-হা শূন্য। সে নাইখ। মেঘডুম্বর বসনের আঞ্চলখানি ভুয়া মায়া হয়ে মিলিয়ে যায় আন্ধারি কুহকে। ঘোর নিশি উজাগর যায়। কুলনারীর পহিল এ বিচ্ছেদরাতের প্রহর বিফলে গোঙায়। ফাগুনচোতের মুখর কোকিলের গলা ধসে গেছে আশ্বিনের তাতে। পাইকড়ডালে বস্যে বস্যে অখন ভাঙা গলা পাকলায় শুধু। আর কার যেন সে মনউচাটনী মন্ত্রস্বর কানের কাছে গুঞ্জরায় : আই লাব ইউ! পায়রা হামার পায়রাবিবি! আই লাব ইউ! বিরহের বাণবেঁধা এ সঘন রাত তবু তো ফুরায়। কিন্তু নিলাজ নিঠুর সূর্যরোশনি যে আড়ালভাশুর কিছুই রাখতে জানে নাকো। অন্ধিসন্ধি যেখানে যা কিছু উথলচাপা কান্না, দিনের লুচ্চা রোদ্দুর সব উদোম করে দিতে চায়। বিরতি আহারে জীর্ণ বাস পরে ধেন্ধা ধরা নয়ানে টালুমালু ইতিউতি চায়। চুলের জট ছাড়াতে বসে আয়তুনবান্দীর জানপেরেশান। নিরলে বসে শাশুড়ি গজরায়, এ কেমুন ধারা পিরিতের চরিত মা গে! আর বুঝিন কেরুর খসম বৈদ্যাশেতে যেচে লয়? প্যাটের মধ্যে গ্যাদাবাচ্চাটো যি পিলা চমকিয়্যা খুন হব্যে। হামার বংশের চির‌্যাগ বুল্যে কথা। আঃ হায় গ! ক্যা শোনবেক দুঃখীলতার মরমছেঁড়া কান্না? হুই চারআঙুলে খুঁতো সোয়ামিটো বিনে তার যি আজ কেওই নাইখ ই দোজাহানে। বহুত আগের বাসি খবর, উ আনারুল মাস্টোরট্যাক তাড়হিয়্যা দেলছে পাশের গেরস্থ। যাক্! মরুগ্গে চুলহ্যায়!

হায় গ হামার শিকলবাঁধা ভানুমতী সময়! চউখের পর দিয়্যা চুরি কর‌্যা আসে চুরি কর‌্যা যায়। কথাটি কহে না, কেরুর পানে চাহে না। সুমোয়! তুর মায়াদয়া নাইখ দেলে! পায়রার পানি জোয়ারে ফাঁপে, ভাঁটায় সরে। ইকুবেগ আধবুঢ়া হয়। হুরিমতী থুত্থুুড়ে বুঢ়ি হয়ে বিছানা নেয়। ফজলির পর আশ্বিনার চালান নিয়ে জেলাসদরে রওনা দেবার আগক্ষণে হুরিবুঢ়ি লাঠিভর দিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে ইকুর সমুখে দাঁড়ায়। ইকু হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে। কী দিগদারি করিস তু যাবার টাইমে! লে মা অখন ছাড়্ দিকিনি। অ্যানেক ব্যালা হয়্যা গেলেছে। হুরিবুঢ়ি সাঁড়াশির মতো ইকুর হাত চেপে ধরে শাদা চুলের জটাসুদ্ধ মাথা দোলাতে দোলাতে বলে, না বাপো! হামি তুকে আমের চালান লিয়্যা গোন্জে যেতে নাহি দিব্যো বাপজি হামার। ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে হেসে বলে ইকু, ই লে মা। তুর কি মাথা খারাপ হয়্যা গেলছে? অখন কি বাবজানের সি আমলট্যে আচে লিকিন? ইট্যা তো আভি মুবাইলের জুমানা বটে। ঢেলি ঢেলি বাতচিৎ হচে। তু খামখা ডরাসনি মা। তোর বহুমার ঠেঁই মুবাইল রাখ্যা দিলছি। চুন্নুবালা শরমে চোপা রাঙিয়ে কামরাঙ্গাটি হয়। সপ্তাহান্তে একদিন লাভের কড়ি গুনতে গুনতে ইকুবেগ ঘরে ফেরে। ফেরে না কেবল সেই পথহারা বাউরা মানুষটি। কোথায় কোন্ অচেনা দেশের বেগানা বাঁকের চিরআড়ালে নেই হয়ে গেল সে! দিন যায় মাস যায়, বছর সেও গুজর যায়। ফেরে না সে। ফাল্গুনের দুপুরে পাইকড়ডালের উচ্চডালে বসে এক বেহায়া কালো কোকিল তারস্বরে চিক্কুর পাড়ে। সে তো ফিরে আসে না।

চুন্নুবালার রাশিভাগ্যি আর ইকুবেগের বুদ্ধিবলে শ্রী ফিরে আসে আলুথালু সংসারে। রাখী মালের কারবারে দেড়া নাফা, চোরাই গোরুর বেচাকেনা, বাড়ির হাতায় মুদিদোকান, রাত জেগে বিছানায় বসে শ-টাকার নোট গুনতে গুনতে ইকুমিয়ার চোখে চশমা ওঠে। মাথায় টুপি মুখে দাড়ি ইকুবেগ এখন ‘বেগসাহেব’। খেতে বসে প্রথম লোকমা মুখে তুলতে গিয়ে বলে, ‘বিসমিল্লা’! খাওয়া শেষে ধোয়া হাতখানা দাড়িতে বুলোতে বুলোতে বলে ‘আলহামদুলিল্লাহ’! ছানায়পোনায় ছয়লাপ ভেতরবার। ইকুর বউ চুন্নুবালা তার মাজননীর মতোই বছরবিয়োনী মেইয়্যামানুষ একনম্বরের। বেগবাড়ির সীমাসরহদ্দ বেড়েই যায়। দুখানা নতুন ঘর ওঠে পাঁচিল ঘেঁষে। জলুস দেখে পড়শীর চোখ টাটায়।

চুন্নুবালা কোলের ছানাটিকে নিয়ে বড় খাটটাতে হাতপা ছড়িয়ে একলা শোয়। বাচ্চাটার নানা হ্যাপা। মাঝরাত্তিরে জেগে গিয়ে মায়ের মাই হাতড়াবে। মুঠোয় না পাওয়া অব্দি ট্যাঁ ট্যাঁ চেঁচিয়ে ঘর ফাটাবে। মুতে কাঁথা ভেজাবে। বাধ্য হয়ে আলাদা খাটে বিছানা নিতে হয়েছে ইকুকে।

ত্যাখুন আঘনমাসের রেতের বেলা। ভোরটা হবু হবু লেগেছে। তাহাজ্জদের নমাজ সেরে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে ইকু। ফজরের অজু করতে ওঠার কথা ছিল মনে মনে। আনতাউড়ি হঠাৎ গোরুমোষের হাম্বাহোঁক্কা রবে ঘুম কেঁচে যায় ইকুর। চোখ কচ্লে উঠে বসে বাইরেকার সম্ভাব্য আলামত ঠাহর করার চেষ্টা করে। কিসের উৎপাত ঘটতে পারে এই ফজরবিহানে? চোরধাড় নয়তো? নাকি বাঘডাসায় ধরেছে? ওদিকের খাটে হাতপা মেলে দেয়ালপাট হয়ে ঘুমাচ্ছে চুন্নুবালা। ইকু চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। পুবের আকাশ ফিকে হয়ে এসেছে। থকথকে কুয়াশা হিমে জমাট। ফ্যাকাশে তারা একটিদুটি। জন্তুগুলো ইকুকে দেখে চিনতে পেরেছে। কেউ কান নাড়াচ্ছে কেউ ল্যাজ চাপড়াচ্ছে। পুরু পুরু পশম ঠান্ডায় খাড়া হয়ে উঠেছে। ফারাগাইটার পিঠে হাত রাখে ইকু। তার চামড়া লাই পেয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে। চারদিকে চোখ বোলায়। কোথাও কোনো ব্যত্যয়লক্ষণ মালুমে আসে না। ফজরের অজু সেরে নেবার জন্যে পেছন দিকে পা বাড়িয়েই চমকে ওঠে ইকু। মায়ের ঘরের দুয়ার হাট করে খোলা। কেন জানি আডাক ডেকে ওঠে মনের মধ্যে। দ্রুত হেঁটে সোজা ঘরে ঢুকে পড়ে ইকু। না তো! বিছানা খালি। মা নেই কোথাও। এ মা! মা গে! কথি গেলছিস তু মা? ঘরে নেই বারান্দায় নেই আঙ্গনের চতুঃসীমায় কোথাও কোনো লেশনিশানা নেই হুরিবুঢ়ির। জলজ্যান্ত মানুষটা। শোকেতাপে মাথার ঠিক ছিল না। তা বলে এমন করে রাতারাতি… … …? ওদিকে রোদও উঠে পড়েছে তালগাছের মাথা ছাড়িয়ে। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। আঁতিপাঁতি তন্ন তন্ন করে খোঁজে সবাই মিলে। মা গে! তু কুন্ঠে গেলছিস হামাক ফেল্যা? বুঢ়ামানুষ ইকুর চোখের পানি গড়িয়ে দাড়ি ছোঁয়। চুন্নুবালাও চোখ মোছে আঁচলডগা দিয়ে। হুরিমতীর দেখা মিলল শেষতক। বাড়ির বাইরে গোরস্তানে। বকুলতলায়। কছিমবেগ আর তার বিবি সুনাভান দুজনার দুটো কবর পাশাপাশি। মাথার দিকে কালসাক্ষী বকুলবৃক্ষ। তার বাঁকা শিকড়ে ঠেস দিয়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে গাল হাঁ করে বসে আছে হুরিবুঢ়িটা। লাঠিখানা কোঁখের ফাঁকে আধশোয়া অবস্থায় এলানো। মা! মা গে! তু হিথাকে কেনে? ইকু ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাত ধরে টেনে তুলতে গেলে পাশে গড়িয়ে পড়ে হুরি। অঘ্রানের হিমে পাঁশুটে রং। জমে ঠান্ডা কাঠদেহ। হেই মা! বাপজিট্যে আগেই গেলছে। অখন তু ভি গেলি? হামি কেনে বাঁচ্যা আছি হায় হায় গ? আল্লামালেক! কহ তু কহ মোক। যখন মায়ের লাশ নিয়ে ঘরে ফেরে ইকু আর তার বউ, সূর্য তখন ওম পাঠাচ্ছে পৃথিবীর জীবজগতে। দাফনকাফন সারা হতে হতে জোহরের ওয়াক্ত উতোর। শ্বশুরশাশুড়ির পাশে সেবাদাসীটির মতো শান্তিঘুমে শুয়ে থাকে হুরিমতী। হায়! ঘরছোড় কালুবেগ হারাউদ্দিশ কোথায় কোন্ গরঠিকানায়?

পাঁচ
কী জাড়! কী জাড়! বাপ রি বাপ! বুঢ়ারা বুল্যে, মাঘমাসের জাড়ে বাঘ পলায়। ইবারের ই মাঘট্যে ই শালো ঘোগের বাচ্চা ধাড়ি ঘোগ আচে মন ব্যুলে। দুহাঁটুর মধ্যে থুঁতনি গুঁজে বসে ঠক ঠক করে কাঁপে ইকু বুঢ়াটা। চুন্নুবালা কম্বলের মধ্যে কোঁ-কোঁ করে। আ গ অয় শাহুর বাপ! ই শীতে বুঢ়ারা কেহ বাঁচবে লিকিন? হাঁর বাপের বাড়ির দ্যাশে তাকে থামিয়ে দিয়ে শাহু বলে, অখন তো হ্যালা ঝইরচে। আর ক’দিন পর যি আগুন জ্বইলব্যে, ত্যাখুন? আসলেই চোতমাসটা এলো যেন আগুনডানায় ভর দিয়ে। গাছপালা ঝলসিয়ে তাবৎ মাটিজমিন পুড়িয়ে খাক করে দিয়ে। কিন্তুক তার পরপর যি বোশেখ মাসটা এলো, ওঃ! ইবারকার ই বোশেখটা Ñ ইটো যি আস্ত দুজখ লাগচ্যে! বুকের ভিত্রি আস্ত ক্বালিজাটো গল্যা যাবার চাহে! পুবড্যাঙ্গার ফাহিমবুঢ়্যা চোখ উল্টিয়ে তড়্পে তড়্পে অক্কা পালছে। ইবারে ক্যা খ্যাপে যাব্যে ক্যা জানে? সবার চোখে আতঙ্ক, সবার মুখে কুলুপ।

চাকা তো থেমে থাকে না। এরি মধ্যে সংসারের রঙ্গশালায় কুশীলবের আসাযাওয়া। নাতিপোতায় ছয়লাপ বেগবাড়ির প্রতি কামরা। আরো দুখানা নতুন বসতঘর ওঠে চৌহদ্দির সীমানায়। ইকুর কমজোরি দাঁতগুলো নড়ে পড়ে। চোখের নজর জিলজিলে। চুল আগাপাছতলা সাদা। পিঠ ঝুঁকিয়ে চলতে হয়। চুন্নুবালার চুলেও শাদা ছোপ। ফোলাচোপা তুব্ড়ে আস্ত শুঁটকি বেগুন।

ই সব কী অনাহক কাণ্ডট্যা শুরু হয়্যা গেলছে দ্যাখোদিকিন! আল্লামিয়্যার গজব লাম্যা আইসচে লিকিন দুজখের আগুন হয়্যা? পায়রা লদী শুখালছে দিনকে দিন। চটান চর পড়্যাছে দিয়াড় জুড়্য।ে গনগনে তাত ধরা লু হাওয়া। কথি বা হাওয়া? শুধু শাদা বালুর ঝামাল। দাঁতে বালি চোখে বালি কানে বালি প্রতি নিঃশ্বাসে কিচকিচে বালিদানা। খোজাপুরবাসী কপালে হাত উঁচিয়ে দূরে বহুদূরে নজর পাঠিয়ে আসন্ন সর্বনাশের ইশারালক্ষণটা আঁচ করার চেষ্টা করে। হ্যাঁ, মালুম হচ্ছে একটু একটু করে। আকাশজোড়া শাদারঙের বিশাল আজদাহা দানোটা দিয়াড় থেকে উঠে আসছে ওই। শাদা বালুর ডানা। শাদা বালুর লটাপট চুল। চোখেমুখে সাদা ফেনিল জিঘাংসা।

হেঁ! পাপের ভরা পুর‌্যাছে বটে ইবারা। হামি ই সাফ ব্যুলছি, হামারঘে ই খোজাপুর, নোনাড্যাঙ্গা, ক্যাশরগোন্জো, ঢুলিগাতী, হোসেনগোন্জো তামাম মুল্লুক মিশমার হয়্যা যাব্যেক। ইকুবুঢ়া ভুরু কুঁচকে আপন মনে বিড়বিড় করে চলে।

ছয়
জগৎপারাবারের তীরে বালকেরা করে খেলা। আমোদলোভী চ্যাংড়া সমাজ Ñ এই মুক্ত চরাচরে এরা আসে কোথা হতে কী এদের হালসাকিন কোন্ সে গেরস্থের সন্ততি এরা সব Ñ কে জানে বার্তা? উধাও গগনতলে লীলাচপল বালখিল্যদল। দিকদিগন্তে ধূ ধূ উধাও বালুপ্রান্তর, দিগন্তদাগ ডিঙানো অশেষ বালুচর। মধ্যিখানে ব্রাত্য বালকদলের খেউড়মত্ত খেলা। খেলায় ভিন্নমাত্রা যোগ হলো কিম্ভুতদর্শন এক আগন্তুক বৃদ্ধের আবির্ভাবকে কেন্দ্র করে। ধূসর শাদাটে বাবরি, ঘাড়গর্দান অব্দি এলানো লটাপট। বলিরেখায় বিদীর্ণ মুখ। দুচোখে জ্বলজ্বলে আগুন। আর ডান হাতের পাতাটির ডগায় প্রকট মাত্র চারটে আঙুল। পরনে যে শতচ্ছিন্ন কপ্নিটি, তার কোনো মৌলিক রং ছিল কিনা কস্মিনকালে, কে জানে? সারা গায়ে বোঁটকা দুর্গন্ধ। খেলাভাঙা ছেলেরা নাকে হাত চাপা দিয়ে গোল্লাচোখে চেয়ে থাকে। সামান্যক্ষণ মাত্র। তারপরই নতুন খোরাক পেয়ে খেলায় মেতে ওঠে আবার। লোলচর্ম ন্যুব্জদেহ বেচারা বৃদ্ধ পাছায়পিঠে চিমটি আর খোঁচা খেতে খেতে জেরবার হয়ে ওঠে। জ্যাঠা খেলুড়েরা তাকে গোল হয়ে ঘিরে নাচে, হুল্লোড় তোলে গম্ভীরা গায় :
হে নানা! চারআঙুলে বুঢ়া হামার না – না – হে  –
আশমান থাক্যা গির‌্যাছে নানা বদন চাঁন্দের পানা –
– না – না -হে –
প্রবীণ এক গাঁওবুঢ়া দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল এতক্ষণ। মানুষটার নাচার দশা দেখে এগিয়ে আসে কাছে। আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করে, আ গ বাবজি! নিবাস কুন্ঠে বটে তুমহার? কিবা পরিচয়? অচিনবুঢ়া কঁকানো গলায় বলে, হামার তো নিবাস নাই – ঢুঁঢ়্যা পেছি না। তুমহি ক্যা বুল্যো তো? গাঁওবুঢ়া, হাঁরা তো লদীভাঙ্গা বানভাসি মানহুষ। লতুন ঘর বান্ধ্যাছি হুই অখেনে চরজমির পরে। আর তুমহি? আগন্তুক বুঢ়া, – হামি মোদের খোজাপুর গাঁওট্যে ঢুঁঢ়্য।ি মোদের পায়রা লদীটো ঢুঁঢ়্য।ি গাঁওবুঢ়া কপালে হাত দিয়ে বলে, কী আজব কথা বুল্যে কী আঁই! উ সি পায়রা লদীউদি আচে লিকিন আজো? শুখায়্যা মরুভুঁই বিলকুল। শও শও বচ্ছোর আগের কাহানি সি। দাদাপরদাদার মুখে শুন্যাছি ভাসা ভাসা। নয়াবুঢ়া আর্তনাদ করে ওঠে, কী কহ তুমহে? হামার সি খোজাপুর গাঁওট্যে? হামারঘে বেগবাড়ি? গাঁওবুঢ়া করুণ হেসে বলে, উ সব আচে লিকিন হায়? খোজাপুর, নোনাড্যাঙ্গা, ক্যাশরড্যাঙ্গা, ঢুলিগাতী, হোসেনগোন্জো … … … স  –  ব সব উড়্যাছাড়্যা বেঠিকানা হয়্যা গেলছে। উ দিয়াড়উয়াড় নাইখ জি। নয়াবুঢ়া চুল ছেঁড়ে কপাল চাপড়ায় : হায় হায়! হামার পায়রাবিবি Ñ হামার পায়রা লদীটো?

দূরে বহুদূরে – ধিকিধিকি আগুন জ্বলে শাদা বালু ঢাকা পায়রার চরে। বুক চাপড়াতে চাপড়াতে নওবুঢ়া ছুটে চলেছে। দিকদিগন্তে মর্শিয়ার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি : পায়রা হামার লদীটো! তু কুথা কুন্ঠে হামার পায়রাবিবি?

মাথার উপর চক্কর দিয়ে দিয়ে উড়ন্ত শিকারি বাজ। তার র্মচেরঙা ডানায় বাঁকা ঠোঁটেনখে কটা চোখে জ্বলন্ত জিঘাংসা।

পায়রার চরে দূর মরুবালুর বুকে ছুটন্ত কালো বিন্দুটা আস্তে আস্তে শূন্য হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে।
– ১৭-০৫-২০১২

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত