রাস্তার ওপর বেড়াটা দেখলে ময়নার মন কোঁকড়া হয়, যেন একটা সুচ-বসানো সুতার গোল্লা, কেউ কোনো নেড়িকুত্তাকে – ‘আ তু তু, দে দৌড়’ – বলে সুতার বলটা ছুড়ে দিলো, অমনি গড়িয়ে গড়িয়ে কিছুটা খুলে, কিছুটা জট পাকিয়ে ঢালের কাছে গিয়ে ঝুপ। তারপর ঢাল থেকে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েই রাস্তার সঙ্গে একাট্টা, তারপর পার হওয়ার আগ পর্যন্ত চিৎ। দুপাশের মাটি, নলখাগড়া শুইয়ে ফেলে বুক চওড়া করতে চাইলেও আর উপায় নেই। বহুব্যবহৃত ময়নার রাস্তা তবু এখনো বিনীত। বিনীত কি আর স্বেচ্ছায়? শরীর বিছিয়ে না দিয়ে উপায় কী? মফিজের মা, ময়না, নুর আলি আর গোল্লার বাপেদের দিন-রাতের মাথা জাগানোর দায়ভার অলিখিতভাবে এ-রাস্তার। বুকের ওপর সারাক্ষণ ধুলো-কাদা ওড়ানো, তোবড়ানো ঘূর্ণির মতো মানুষ। এপারের-ওপারের। চেনা, অল্পচেনা, অচেনাও। তাদের মাটিফাটা পায়ের গোড়ালিতে হাওয়াই চপ্পলের ইয়ার্কি। ধুলাবালি-আচ্ছাদিত ফুর্তিমত্ত জিয়ল মাছের উল্লাসে একজন আরেকজনের গায়ে ঠেস-ধাক্কা দিয়ে হি-হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে। তারপর একটু গিয়েই শ্বাসবন্ধ, পানির অভাবে মৃতপ্রায়। কতদূরই বা দৈর্ঘ্য রাস্তার? ওই তো গ্রামের শেষ, তারপর ও-মাথায় আবার শুরু, তা গ্রাম বলা যায় আবার যায়ও না। স্কুলের তবু গোটাকয় ছাত্র আর এক মাস্টার আছে। হাসপাতালে যন্ত্রপাতি কিছু থাকলেও ডাক্তার থাকে না। থানায় আবার দরকারের চেয়ে বেশি পুলিশ। শুধু এ-রাস্তাটা, যেন পাহাড় ভেঙে জেগে ওঠা, ঘোর বর্ষায় তার অভিমান একটা জেদের আস্তর গায়ে মেখে বসে থাকে। বাক্স-বস্তা-মানুষ-মেয়েমানুষ-গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি তখন, সুতরাং মান ভাঙানোর খায়েশে কর্দমাক্ত মাটিকে ছেনে তোলার মতো আদর করে পা ফেলে। নইলে খরায় তো কাঁটাতারের স্পর্শ বাঁচিয়ে জুতা-স্যান্ডেল হাতে করে, পায়ের ফাটা গোড়ালি দিয়ে লাফিয়ে গরম ধুলা-ধুলা মাটিতে কোনোরকমে পড়লেই হয়, জ্যান্ত পোকামাকড় তারপর বালি ঝাড়তে ঝাড়তে যেন দৈনন্দিন রোষ আর রাগ গায়ে না মাখতে মাখতেই ঢালের খাঁজকাটা পরতগুলো এক দুই তিন করে পার হলেই এক ঝাপটায় রাগটা, ক্রোধটা কেমন পানি-পানি, পলকা শুকনো পাতার মতো ফুরফুরিয়ে উড়ে যেতে চায়। তখন নিজের রাস্তা, নিজের দেশগেরাম!
আগে রাস্তাটা ময়নার আপন, অতিক্রান্ত দুপুরে নিজের শরীরের ছায়ার মতো লম্বা ছিল, আছে, যেতে-আসতে, প্রয়োজনীয় কিন্তু গুরুত্বহীন। মফিজের জন্য যেমন ময়না, একফালি চ্যালা-কাঠের টুকরা। মফিজ নিজে এর উলটোদিকে শুয়ে থাকা কুড়াল, মুখের কাছে পাকা বোয়ালের পেটির মতো চকচকে ধার, সেই ধার চ্যালা কাঠের দিকে চেয়ে মিটমিট হাসে। নিজেই মনে মনে চিরে ফালি ফালি হয় ময়না, বুকের ভেতরটা একটা থরথর করা বাচ্চা পাখি, খালি কাঁপে। ভয় যদিওবা, পাটির মতো গুটিয়ে রাখে কিন্তু কান্না? ক্ষয় করে ফেলা নিজের মধ্যেকার ঝড়বৃষ্টি? চোখের পাড় ঘেষে কান্নার বাঁধ আরো শক্ত করে ময়না। নিজেকে সে ভেন্নার গাছ ভাববে না। কম হতে যাবে কেন? চেরা কাঠ বলে তার রকমসকম নেই? আঁচলের মাথা দলা করে থুপথুপ চোখের পানি চেপে শুকিয়ে নেয় সে। একগলা জোয়ার ভাসানি পানি পেলে ভেসে যাওয়ার স্বপ্নটাও দেখে ফেলতে পারত। কিন্তু নদীই নেই, আবার জোয়ার! আর জোয়ার তো তার মতো মেয়েমানুষের ইচ্ছায় গা তুলবে না, নদীর নিয়ন্তা হলো চাঁদ-সূর্য, তাদের নির্দেশক্রমে চলে। কাজেই নিজেকে উপড়ে ফেলার বিতণ্ডা করে লাভ নেই। তবু ময়নার কালো চুলের কিঞ্চিৎ চ্যাপ্টা মাথায় এ-কথার উইপোকারা ফনফন উড়তেই থাকে। পরখের সাহস নিয়ে দু-একদিন যে বসে পড়ে না তা না…, কিন্তু আজকে সে-পারাপারের সময় স্থির হয়ে থাকে। আর কোত্থেকে মফিজের মাঝারি গড়নের কেজো শরীরটা উড়ে এসে তার ছায়া হয়ে যায়, শরীরটায় গনগনে কয়লা ভরা, কালো কলকি একদম। একেকবারে সারাজীবনের উত্তাপ নেয় ময়না।
– ‘খালি ছাই তোক দিবার নোয়ায়, নাল টকটকা আগুনগুলা দিমু, তলপেটত থুইস, আগুনের ফুল নিয়া হামাক ভালোবাইসবার হোবে… কয়া দিলাম কিন্তুক আর একটা কতা, হামরা এই ছিটমহল ছাড়ি চলি যামো, কুণ্ঠে সেইটাই ভাবছু, পচাগড় গেলে হয় না? জনগিরস্তি ত মুই জানোই, আর তুই রান্ধাবাড়া’… বেলাহাজ রকমের শিশু শিশু ঠেকে তখন মফিজকে। পেটের ওপরে হাত ছুঁইয়ে যদি স্বপ্নটাকে বাইরে আনা যেত! সত্যি কেমন গনগনে গরম! এই আগুন কোথায় তৈরি হয়?
– ‘উদিক দিয়া হাটিস ক্যানে মা?’ কাঁটাতারের কথা খেয়াল ছিল না। দু-চারটা ঘষটা, উষ্টা, গোল্লার বাপের কথার বেমক্কা খোঁচায় আবার সোজা হয়ে হাঁটে ময়না। মফিজের মা তার হাত টেনে থাকে বলে তার আরো অধৈর্য লাগে, আর কতদূর! এই বুড়ি না থাকলে সে বিছিয়ে-থাকা শিমুল ফুলের ওপর মফিজকে নিয়ে শুয়ে নিজেদের চেহারা দেখতে চেষ্টা করত। আজকে তো আবছা প্রায় দেখেই ফেলেছিল! মনে মনে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে ময়না। তার চুল খোলা, কোমর আর পিঠ অনাবৃত। দিক হারানো পায়রার পড়ো মাঠের ধান খোঁটার মতো মফিজ তার পিঠ খুঁটে দেয়, ঘামাচির দানাগুলো নখের নিচে কাতর হলে ময়না নিজেও পিঠ-বুক মুচড়ে আদরখাকি হয়, মফিজের ভেতরকার তাপ শান্ত ময়ালের মতো পিছলে-ছেঁচড়ে ময়নার বুকের কাছে ঘূর্ণি তোলে। তার স্তনাগ্র তখন সতর্ক। সেইবেলা তার ভাত না খাওয়া শিরদাঁড়া সজাগ হয়ে আর বাঁকা হওয়ার কথা ভুলে যায়। ধুলার রাস্তায় গড়াগড়ি দিতে দিতে ময়নার মনে হয় আজ কতদিন মফিজের সঙ্গে তার দেখা নাই! দুই মাস! ডান কনুইয়ের আঁচিল আরো গাঢ় বেগুনি বর্ণ ধারণ করল? চুলগুলিতে ধুলার পুরু আস্তর? ওর দাঁতের ফাঁক থেকে এক কণা কামড় এসে ময়নার আঙুলের ডগা কাঁপিয়ে তোলে। এত পাষাণ হয় মানুষ! যাওয়ার সময় একবারও পেছন ফিরে চায় না, যতবার যায় কী এক সংশয়ে ঢেকে দিয়ে যায় ময়নার দুনিয়া! গুটানো পাটিটা বিছিয়ে আবারো কাঁদতে বসবে সে? চোখের পানিতে বুকের ভারের ঢেঁকিটা তুলতে কষ্ট হয় তার।
মফিজের মা তার নুয়ে আসা কোমর সিধা করার চেষ্টা নিয়ে দুই হাতই বাড়িয়ে দেয়। ময়নার ধ্যানভঙ্গ হলে সে অল্প তেতে ওঠার ভঙ্গি করে – ‘হাতখান দিয়া ভর দ্যান না ক্যানে?’ তাতেই ব-দ্বীপের তাবৎ নাব্যতা এসে নাগাল খোঁজে নিশ্চিন্তির, তখন গোল্লার বাপের বাগানো হাতও তার সহায়। বুড়ি চলে আসে সরু রাস্তার চওড়া বুকে।
মফিজের মা ফোঁপড়া কচুরিপানার মতো তারপর হাটের মানুষের দিকে হনহনিয়ে ছুটে যায়। পেছনে গোল্লার বাপ লুঙির ভাঁজ খুলে ভদ্রস্থ হওয়া আর মফিজের মায়ের কাছাকাছি হওয়ার দ্রুততায় ব্যতিব্যস্ত হাঁটে। সারের ডিলার সাদেক ঝাঁপ তোলা দোকানের তদারকি রেখে তাদের কাছে সহসাই আসে না। দূরসম্পর্কের ভাগ্নের সঙ্গে দেখা করার কথাই ভাবতে পেরেছে মফিজের মা, সেই ভরসায় অমনোযোগ পেয়ে নিজের ছেলের কথা মনে করে আরেকটু চোখের পানি ফেলে। ময়নার ছাপা শাড়ির ঘোমটা পড়ে যায়, ব্লাউজের বাইরে ফর্সা কাঁধের বেআইনি দাগের ওপর ভাজা পেঁয়াজের মতো কড়কড়া রোদ লাগে। তখন তার খোলা গায়ের অনধিকারচর্চা উদ্দিশ করে উচ্চৈঃস্বরে গীত শোনায় বুড়ি। মফিজের মতো ছেলেকে দূরে রেখে তার মায়ের কুঁকড়ে যাওয়া কয়লার মতো দেহাবয়বের সামনে ময়না কেন মিইয়ে যায় না – বুড়ির কণ্ঠস্বরের মেজাজ এ-বিষয়কে ঘিরে সাময়িক আবর্তিত হলে এ নিয়ে ময়না নিজে দুরকম ভাবে, এক. এ নিয়ে ভাবতে হবে কেন? নিজের অন্তর্লীন রক্তের চলাচল তো সে এ-ত্বকে হাত বুলিয়েই পায়, এখনো মসৃণ, কচি বেগুনের পেলবতা। এই পেলব ঘিরে সুখ-শিহরণের বাকবাকুম তাকে এখনই থামিয়ে দিতে হবে! তার জন্য কি এপার-ওপারের লেনদেন থেমে আছে?
নিজেদের ছিটমহলের বাইরে এ-হাটে ময়না আগেও এসেছে। মফিজের সঙ্গে না, তার নিজের বাপ যেদিন গরু বিক্রির পারমিট পেত, ঢেউ না খেলানো বুক নিয়ে সে চট আর প্লাস্টিকের ব্যাগে দড়ির গোছা নিয়ে বসে থাকত, তাকে গরুর রশি ধরিয়ে দিয়ে বাপ কতদিন হাটের তোলা দিয়ে আসতে গেছে। সারের ডিলারের দোকানের পাশ দিয়েই যাওয়া-আসা। আর এখন ময়নার পরিচয় ‘মফিজের কথা পাকা বউ’। পানচিনি শেষ, এখন শুধু মফিজের ফেরার অপেক্ষা। সাদেক ডিলারের চোরা চোখ ময়নাকে জরিপ করে, ত্রস্ত করে। তাদের বসতে আহ্বান জানালে বুড়ির মুখের শিরা-উপশিরা পদোন্নতির আনন্দে চকককে হয়।
সাদেক ডিলারের গোলগাল মুখের টোলে আত্মবিশ্বাস – আগেই খবর পেয়েছে, মফিজ থানা থেকে হাসপাতালে স্থানান্তর হয়েছে। থানা চত্বরের নিমগাছের নিচে অপেক্ষমাণ ভ্যানগাড়ি পার হয়ে এ-খবর দিলে ময়না, গোল্লার বাপ আর মফিজের মা পরস্পর পরস্পরের নির্বিবাদ কথা না চালাচালিতে মন্দের ভালো বুঝে উঠতে পারে।
– ‘হসপিটালত মোনে কয় না মাইরধোর করবে’, সাদেক ডিলার এই কৌতূহলের কোনো সহজপাচ্য জবাব দিতে পারে না। এলাকার মেম্বার অথবা চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে এ-সংক্রান্ত ধারণা পরিষ্কার হতে হয় – এটা তার মনে হয়। তবে মফিজ তো চোর-বাটপার না। গোল্লার বাপের সঙ্গে জন খেটেছে সেই কিশোরকাল থেকে।
– ‘অয় তো প্যাটত পাত্থর বান্ধাই আছিল, কিন্তুক এইখানত থাকিয়া আর কোন কায়-কারবার করিবা পারিবে অয়। প্যাটের টানোত না হইলে কেউ এইরকম কারবারে জড়ায়া যায় বাপ, মোর ছুয়াডা ইগলা পারে না তাকতো তুমরা চিনেন, চিনেন না?’ বছরে কতশত মানুষ এপার যায়, ওপার যায় – বর্ডারে ব্যবসা-বাণিজ্য, গরু-ছাগল আর মানুষের পেটের ধান্ধা করে, তাদের মধ্যে শুধু মফিজ কেন অবৈধ পাচারের অভিযোগে কাঁটাতারে আটক হবে! তাকে পিটিয়ে আধমরা করে এপারের পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে – এ বিস্ময়ের সংক্রমণ অন্যদের মধ্যে চালান করে মফিজের মায়ের অস্বস্তি জোটে। ছুটে আসা বাতাসে তার ধুলা-ধুলা চুল উড়ে চলে যেতে চায়। ময়না কপাল ঢেকে ঘোমটা দিয়েছে, তার চোখও ঢেকে ফেলতে ইচ্ছে করে। ফাল্গুনের গা এমন ঠান্ডা দিচ্ছে কেন কে জানে, একটা চাদর সঙ্গে আনলে হতো। গোল্লার বাপের চিন্তিত কপালের নিচে দুচোখ বন্ধ, তার চাদরের ভেতর বাতাস ঢুকে ফুলে ফুলে উঠছে। ভ্যানগাড়ির দুলুনিতে ময়নার বেজায় ঘুম পায়।
– ‘ইগলা সব জানেনই তো… টাকা খিলানোর জাগা’, – সাদেক ডিলারের দম ধরানো কণ্ঠস্বর খ্যাক্কর খ্যাক্কর রাস্তাভর্তি গর্তের ঠোক্করে দুলে ওঠে। মফিজের মা ময়নাকে আঁকড়ে ধরে ভারসাম্য রাখে। ময়না পেট উপড়ে বেরিয়ে আসা ঢেঁকুর আটকে রাখতে আঁচলের খুট কামড়ায়। হাসপাতাল দূরের গন্তব্য নয়। স্থির হয়ে দম নেবে নাকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে পড়বে, বোঝার আগেই সরু রাস্তা ফুরিয়ে দোকানপাট এগিয়ে আসে। রকমারি দোকান-ফার্মেসি-ফলের সমাহার আর গোস্ত-ভাতের হোটেলের মাছ-মুরগির ছবিওয়ালা সাইনবোর্ডের জটলার ভেতর থেকে মফিজের মায়ের কৃশকায় হাত তাকে টান দিলে তার মাথা ঘোরে।
হাসপাতালের ময়লা হলুদ ঘর বেঘোর বিকেলবেলায় ম্যান্দামারা হয়ে ঘুমের গুঞ্জন তুলছে। প্রবেশপথে কেউ আটকায় না। মফিজের মা ময়নার বাহুমূল আঁকড়ে কালশিটে দাগ করে ফেলে। ভুরুক করে অচেনা একদলা গন্ধে ময়নার পেট উলটিয়ে আসে। সাদেক ডিলার মুখ ফুটে গালাগাল করে ওঠে – ‘শালার হসপিটাল? নাকি পায়খানাত আসি গেলাম!’
ঢোকার পথ একটু বাড়তেই জরুরি বিভাগ, বাইরে অ্যাম্বুলেন্স লেখা জানালাভাঙা গাড়ি। ভেতরে দরজার মুখে কয়েকজন মানুষের জটলা। ভেতরে টেবিলের সামনে দুজন নারী-পুরুষ বসে। মফিজের মা আর ময়না একপাশে অপেক্ষা করলে সাদেক ডিলার গোল্লার বাপকে নিয়ে খবর আনতে যায়। নির্বিবাদ বাতাস আরো কিছু গন্ধ উড়িয়ে আনলে ময়নার মাথা ঘোরা বেড়ে যায়। সাদেকের পরিষ্কার লুঙি, ফুলহাতা শার্ট কিছু খবর সংগ্রহ করতে উদ্যত হওয়ার আগে একজন গলায় ডাক্তারি যন্ত্র ঝুলিয়ে এসে ডিউটিরত লোকটার সঙ্গে কথা বলে। সাদেক অতএব সমীহ করা দূরত্বে পিছিয়ে আসে। ভালো স্বাস্থ্য এই মাঝারি গড়নের লোকটা নিশ্চয়ই ডাক্তার। ময়নার অদম্য ইচ্ছের একরত্তি স্ফুলিঙ্গজুড়ে আগুন জ্বলে ওঠে। না, সে এ-আগুন নিভতে দেবে না। বেঞ্চে বসেও ঘুরতে থাকা মাথা সবেগে নাড়িয়ে সোজা করতে চায় সে। মফিজের জন্য এই ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবে সে। দরকার হলে পা জড়িয়ে ধরবে। চোখের পানির আবেদন নিশ্চয়ই নামঞ্জুর হবে না!
সাদেক ডিলার ডাক্তার আর ডিউটিরতদের কথাবার্তার মধ্যেই প্রবেশ করতে পেরেছে দেখে ময়নার উৎসুক দাঁত আঁচলের কোনা কামড়ে কামড়ে ভেজায়। উঠে দাঁড়াতে চাইলে মফিজের মা তাকে টেনে বসায়। বসে পড়লেও বারবার মনে হয়, সাদেক হয়তো গুছিয়ে কথাগুলো বলতে পারছে না। একঝটকায় মফিজের মায়ের হাত ছাড়ানোর বেজায় ইচ্ছাকে নিমরাজি করিয়ে বসে থাকে সে। ডিলারের ব্যাটাকে সবকিছু খুলে বলে দিলে ভালো হতো। তখন মফিজের মা চিৎকার করবে, তাকে খানকি আখ্যা দিয়ে হাসপাতালের বিল্ডিং ছত্রখান করে দেবে – এ-ভাবনা ময়না আর জরুরি বিভাগকে মুহূর্তের জন্য বিচ্ছিন্ন করে। বাইরে অ্যাম্বুলেন্সের ওপরে তখন একদল পাতিকাকের মিছিল শুরু হয়।
রাস্তার এপার-ওপার এমন পাতিকাউয়া দিয়ে ভর্তি দেখে ময়নার নিজেরও গায়ের রংটাকে একটু বেআইনি মনে হয়। গাছপাতার গায়ের সাদা রঙের ধুলো আর তারও অধিক ফকফকা সূর্যের ধক্ মানুষের ত্বক প্রকাশিত হতে দেয় না এখানে। ফলাফল তোফাজ্জল, মফিজের মামাতো ভাই, ফিরে না-আসা মফিজ তো বটেই এমনকি এপার-ওপারে তাবৎ মানুষের গায়ের বর্ণ নিকষ তামাটে। তারা রাস্তা পার হয়, ওপার যায়, এপার আসে তামা বর্ণ তামা বর্ণই থাকে। তখন ময়না নামের এ-মেয়েটা কোত্থেকে পায় এই রং? যখন মফিজের মায়ের খোলা গীতের গলা ক্রন্দসী হয়ে আকাশ বিদীর্ণ করে তোলে, তখন তা আকাশ-ফিরতি ময়নার ত্বকেই ধাক্কা খায়, যেন তার ত্বক সাততলা দালানের গভীর দেয়াল। তার রাগে ধুপধাপ শব্দ হয় একেকবার, আর অন্যান্যবার নিংড়াতে থাকে তাদের নিচু হয়ে থাকা ঘরের চালে ধরে আসা বৃষ্টির ফোঁটার মতো, থেমে গিয়েও টুপটাপ – টাপটুপ ফোঁটায় ফোঁটায়।
– ‘মফিজ নামের কেউ এই হসপিটালত ভর্তি হয় নাই’ – কাজ শেষ করার ক্লান্তি আর সন্তুষ্টি দুই-ই খেলে যায় সাদেকের গলায়। থানা থেকে তিনজনকে নিয়ে এসেছিল পুলিশ। একজন জন্ডিসের রোগী। দ্বিতীয়জনের স্ত্রী এসে তাকে দেখাশোনা করছে, অবশ্যই পুলিশের অনুমতিসাপেক্ষে। আর তিন নম্বর লোকটি মৃত্যুবরণ করেছে, তাকে ডোমঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার নামধাম-পরিচয় সাদেক ডিলারের কাছে উদ্ঘাটন করা হয়নি – এটা পুলিশের কাছ থেকে শুধু পরিবারের লোকজন সংগ্রহ করতে পারবে। এখন মফিজের মায়ের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কী করবে, তারা কি সেই তৃতীয় ব্যক্তির লাশ শনাক্ত করতে যাবে? সেক্ষেত্রে তাদের আবার থানায় গিয়ে পুলিশের অনুমতিপত্র আনতে হবে।
– ‘অয় যে মফিজ তা ক্যায় কবার পারবে? মফিজ তো নাও হবার পারে!’ – ময়নার বিড়বিড় মেঝের ঠান্ডায় চোখ বুজতে চায়।
– ‘ও মাগো মোর ছাওয়ালটাক মারি ফেলাইছে?’ মফিজের মায়ের বিদীর্ণ করা চিৎকার কোনো দিকনিশানা পায় না, উঁচু সিলিংয়ে ঠোক্কর খেয়ে নিচে নেমে আসে। পরক্ষণেই – হতেই পারে না, কিন্তু না হলে তার ছেলে কোথায় গেল ইত্যাকার বিলাপে শোরগোলের মাঝখানে জরুরি বিভাগ থেকে পুরুষ কর্মচারী বেরিয়ে আসে।
এখানে কান্নাকাটি করা নিষেধ – এমন নোটিশ চোখেমুখে ফুটিয়ে লোকটা ফিরে গেলে ময়না ডাক্তারকে আর খুঁজে পায় না। তার ভয়াবহ রকমের ক্ষুধা লাগে আর মনে হয়, ক্ষুধার তোড়ে ভেতরের আরেকটা হৃৎস্পন্দন হজম হয়ে যাচ্ছে। ময়না মোচড়ায়, পেট-পিঠ, যেমন করত মফিজের পাশে সংক্ষিপ্ত শোয়ার সময়।
মফিজের দেহখান ময়না চেনে বইকি। দিনের আলোয় একরকম চেনে, রাতের ঝুম অন্ধকারে আরেক রকম স্পর্শ চেনে। যতই না তার মুখাবয়ব বিকৃত হয়ে যাক, যতই তাকে অত্যাচার করা হোক, ঘুমিয়ে থাকা মফিজের ভঙ্গি চিনতে তার কোনো ভুল হবে না। কিন্তু অনপনেয় কৌতূহলে, ভয়ে আর কান্নায় তার কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। মফিজ তার ক্রমাগত উদ্ধত পৌরুষ নিয়ে কেমন নাকাল হয়ে শুয়ে আছে চাটাই প্যাঁচানো হয়ে তা না দেখার তাড়নায় সে আড় গেঁড়ে বসে থাকে। তার চোখ অস্থির হয় ডাক্তারের খোঁজে। আজকের মতো এমন করে সে কি আর হাসপাতালে আসবে? তারা তো ছিটমহলের বাইরে সহসা আসে না। মফিজ থাকলে আছে, না থাকলে সে কী করবে? তারচেয়ে ডাক্তারকে গিয়ে পায়ে ধরলে হয় না? সে এই আজাবের মধ্যে দিয়ে যেতে চায় কিনা এই নিয়ে ভাবনার আর অবসর কোথায়? চোখের পানিতে দুনিয়া ভাসিয়ে সে বলবে, ‘মোর প্যাটের আগুনের ফুল উগরি ফেলাও ডাক্তারসাব। মফিজ না থাকিলে মুই ওই ফুল দিয়া কী করি?’
নিজের হাহাকারের সঙ্গে অনাগত সন্তানের কান্নাটা ময়নার কাছে চূড়ান্ত অচেনা। কোথায় গেল বেজন্মা ডাক্তারটা? ময়নার চোখের সামনে থেকে কোথায় উধাও হয়ে গেল মফিজের মতন?
হঠাৎ জরুরি বিভাগের সামনে ভিড় বেড়ে যায়, কোনো মুমূর্ষু রোগীর আগমনের ব্যস্ততা। জরুরি বিভাগের সে-লোকটাকেও আর দেখতে পায় না ময়না। তার ঘোরলাগা চোখ প্রায় চরকির মতো ঘোরে। সাদেক ডিলার ডাক দেয়, মফিজের মা তার হাত ধরে টান দেয়। ময়নার চোখ দেয়ালঘেঁষে সটান ছাদে চলে যায়। সেখান থেকে জরুরি বিভাগের দরজায়, ভিড়ের ফাঁকে ডাক্তারের সাদা কোট দেখা দিয়ে ছলকে গেলে ময়না দাঁড়িয়ে পড়ে। গলায় ঝোলানো ডাক্তারি যন্ত্রটা দেয়ালঘড়ির মতো দোলে, এমন ঘড়ি ময়না কেবল ছোটবেলায় তাদের মসজিদে দেখেছে। তার ইচ্ছে করে ডাক্তার এসে ওই যন্ত্রটা তার বুকে-পেটে চেপে চেপে দেখুক, তারপর কোনোভাবে তার ভেতরের দ্বিতীয় হৃৎস্পন্দনটাকে বন্ধ করে দিক। কতরকম উপায় আছে ডাক্তারের কাছে! মফিজের কাছেই শুনেছে। নিজের বুকের ধুকধুক বন্ধ রেখে সেখানে সে আর কারো হৃৎস্পন্দন জারি রাখতে চায় না। ভিড়ের ভেতর ডাক্তার খুঁজতে উদ্যত হলে মফিজের মা তাকে আবারো চেপে ধরে। ময়না এবার থামে না, উড়ে যেতে চায়, ছাদে, সেখান থেকে নেমে সোজা ডাক্তারটার চেম্বারে পৌঁছে যাওয়া যাবে। কিন্তু ছাদে গিয়ে সে আটকে থাকে, মফিজের মা তার পা ধরে ঝুলতে থাকে, তার সঙ্গে হাত লাগায় গোল্লার বাপ, লুঙি কাছা মেরে নিয়ে, সাদেক ডিলার – শার্টের ফুলহাতা গুটিয়ে। ময়না না নামতে পারছে, না পারছে উড়ে নিজের ইপ্সিত গন্তব্যে চলে যেতে। এখানে বড় ভিড়, ময়নাকে ঘিরে মানুষের জটলা আর হইচই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ডিউটিরত নারী-পুরুষ দুজনই ওয়েটিংরুমে। ত্রাহি ত্রাহি চিল-চিৎকার দিচ্ছে পাতিকাকগুলো। দু-একজন বলছে – ‘একখান মই আনেন বাহে।’
ময়না একটা ফোকর খোঁজে, যেখান দিয়ে ওই রাস্তাটার ওপারে চলে যাওয়া যায় – কাঁটাতারের ঘোরেল বেড়া পার হয়ে রাস্তার যেখানে নদীর সঙ্গে সংযোগ, সেখানে সে বুক বিছিয়ে দেবে। তার ওপর দিয়ে ডিঙিয়ে নিশ্চয়ই কেউ যাবে না!