এক সপ্তাহের টানা ব্যাস্ততার পর আজ একটু সময় পেয়ে ফেইসবুকে ঢুকলো মিতু। ডাটা অন করতেই টুংটাং মেসেজ আসতে শুরু করলো।কেউ জিজ্ঞেস করছে কোথায় ছিলে এতদিন?কেউ আবার বলছে বর পেয়ে আমাদের ভুলে গেলে চলবে?আবার কেউ বলছে অবশেষে ঘুম ভাঙলো ম্যাডামের? কেউ আবার বলছে মরে গেছিস নাকি?মিতু একটু মুচকি হাসলো।আসলে এরা সবাই মিতুর খুব কাছের বান্ধবী।এমনিতে মিতুর ফ্রেন্ডলিস্টে কোনো ছেলে ফ্রেন্ড নাই।যে কয়জন আছে সবাই পরিচিত।মিতু বান্ধবীদের মেসেজ রিপ্লাই দিয়ে ফেইসবুকে কে কি পোস্ট করছে দেখতে লাগলো।অনেকেই ফানি পোস্ট দিছে,মিতু দেখে দেখে হাসছে।কিন্তু মুহূর্তেই হাসিটা কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো,যখন মিতুর প্রাক্তন সাব্বিরের এর প্রোফাইল টা অ্যাড ফ্রেইন্ড হয়ে সামনে আসলো।
মিতুর বুকের ভিতরে চিন চিন ব্যাথা অনুভব হচ্ছিলো।মিতু প্রোফাইলে ঢুকে সাব্বিরের এর ছবি গুলো দেখছে।একটা ছবি চোখে পরলো,যে ছবিতে সাব্বির আর একটা মেয়ে।ছবিটা জুম করে দেখছিল মিতু।তবে কি এটাই ওর বউ!শুনেছি বিয়ে করছে।প্রাক্তন আত্মীয় হওয়াতে অনেক সময় না চাইতেও অনেক খবর পেয়ে যায় মিতু।
বাহ্ কি সুন্দর মেয়ে টা।দুজনকে খুব সুন্দর মানিয়েছে।ছবিটা যতটুকু সম্ভব জুম করলো মিতু।সাব্বির কি সুন্দর করে ডান হাতটা মেয়েটার হাতে রেখে,বাম হাত দিয়ে মেয়ে টাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।মেয়ে টা সাব্বিরের গালের সাথে গাল মিলিয়ে মিষ্টি একটা হাসি মুখে।বাহ্ কত সুন্দর ছবি।আচ্ছা ছবিতে যতটা ভালবাসা প্রকাশ পাচ্ছে,সত্যিই কি তাদের ভালোবাসাটা ততোটা গভীর?নিজেকেই প্রশ্ন করছিল মিতু।
মনে পড়ে গেলো পুরোনো দিনের কথা গুলো সাব্বির আর মিতু এক ই ক্লাসে পড়তো।যখন দুইজনেই বি.এ থার্ড ইয়ারে তখন পারাপর্শির কাছে মিতুর বিয়ের বয়স চলে যাচ্ছিলো বলে কানাঘুষা চলছিলো অপর দিকে সাব্বিরের বিয়ের বয়স হয়নি,এমন কথাও শুনতো মিতু।যখন মিতুর বিয়ের কথা চলছিলো,সাব্বির কে সে অনেকবার বলেছে,চলনা পালিয়ে যাই।সাব্বির তখন রাজি হয়নি। রাজিই বা হবে কিভাবে,সাব্বির তো তখন মাত্র পড়াশুনা করছিল।তখন ও তার জিবনে অনেক কিছু করার বাকি ছিল।পড়াশুনা করবে,ভালো জব করবে।পরিবারের কথা ও তো ভাবতে হবে।সেম ইয়ারের প্রেমের কারণেই হয়তো শেষ পর্যন্ত পূর্ণতা পাইনি তাদের ভালোবাসা।সাব্বির সেদিন মিতুকে বলেছিল
-বিয়েটা কি কোনো ভাবে থামানো যায়না?
– না যায়না।আমি একজন মেয়ে,তুমি বুঝবা না একজন মেয়ের জীবনের জটিলতা।
লোকে বলে আমার বিয়ের বয়স পাড় হয়ে যাচ্ছে।একজন বাবার কাছে এই কথা কতটা কষ্টের বলে বুঝানো যাবেনা।আর যদিও এই বিয়ে ভেঙ্গে দেই তাতেই বা কি লাভ! কাল বাবা আবার নতুন কোনো সমন্ধ দেখবে।এভাবে আর কতদিন চলবে?সেই এইচ এস সি থেকে বিয়ের তোড়জোড় চলছে,বাবা কে মানা করতে করতে এই পর্যন্ত এসেছি।আর কত?আমি ক্লান্ত আমি আর পারছিনা।
সাব্বির শেষ বারের মত মিতু কে অনেক অনুরোধ করলো বিয়েতে মত না দেওয়ার জন্য কিন্তুু মিতুর ও তো কিছু করার ছিলনা। সাব্বির মিতুর মামাতো ভাই হওয়ার কারণে বিয়ের দাওয়াতে ও ছিল।মিতুর বিয়ের দিন সাব্বির কে শেষ বারের মত জানালার পাশে সিগারেট খেতে দেখেছিলো মিতু।ছেলেটা তো আগে এমনটা করেনি তবে আজ থেকে কি শুরু করলো?মিতু বাসর ঘরে যাওয়ার আগে চিৎকার করা কান্নার শব্দটা সাব্বিরের কান দিয়ে ঢুকে একদম বুকের ভিতর লাগছিলো।সাব্বির সিগারেট এর ধোয়ার মাঝে নিজেকে হারানোর চেষ্টা করেও পারেনি।প্রিয় মানুষকে অন্য কারো বাসর ঘরে দেখার মত কষ্ট যেনো মৃত্যুকে ও হার মানায়।
বিয়ের দুই বছর পর মিতুর সাথে সাব্বিরের দেখা হয়।মিতুর বাবার বাসায় সাব্বির কি যেনো একটা কাজে গেছিলো,সেখানেই দেখা হয় দুজনার।সাব্বির মন দিয়ে মিতু কে দেখছিলো।মেয়েটা আগের থেকে অনেক টাই শুকিয়ে গেছে।চোখের নিচে কেমন কালো হয়ে গেছে।মনে হয় যেনো কতরাত ধরে সে ঘুমায় না।মুখে কোনো হাশি নেই।তবে চেহারার মায়াবী ভাবটা এখনও সেই আগের মতই আছে।সাব্বিরের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল,মিতুর সাথে কথা বলার কিন্তু সময় সুযোগে তা আর হয়ে উঠেনি।মিতু ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
পরেরদিন মিতুর বান্ধবী রিয়ার কাছে গিয়ে সাব্বির অনেক অনুরোধ করে মিতুর সাথে একবার দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য।রিয়া প্রথমে রাজি না হলেও পরে রাজি হয়। রিয়া আর মিতু এক ই অফিসে জব করে।রিয়া সাব্বির কে বললো,প্রতিদিন অফিস শেষে আমরা বিকেলের দিকে সামনের পার্কে কিছুক্ষন আড্ডা দেই।আপনি ঐ সময় আইসেন তাহলেই দেখা হবে মিতুর সাথে।যেমন কথা তেমন কাজ।সাব্বির সময় মতই পৌঁছে গেলো পার্কে। দূর থেকে রিয়া আর মিতু কে দেখতে পেলো।দুজন বসে বসে গল্পঃ করছে।সাব্বির গিয়ে সামনে দাড়াতেই রিয়া চমকে উঠলো।ওখান থেকে চলে আসার চেষ্টা করলে,সাব্বির হাত ধরে থামিয়ে দেয় মিতুকে।
– কি করছেন! হাত ছাড়ুন।কেউ দেখলে আবার মাইন্ড করবে। সাব্বির হাতটা ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো
– কেমন আছো?
– যেমন থাকার কথা ছিলো।
– দেখে তো মনে হচ্ছে খুব ভালো আছো।
– যদি আপনার তাই মনে হয় তবে সেটাই ঠিক।
– এখনও কি ভালোবাসো আমায়।
-( মিতু কিছুক্ষন চুপ থেকে)বিয়ে করেছ?
– নাহ্।
– কেনো?
– তোমার মত কাওকে পাইনি বলে।তোমার জায়গাটা কাওকে দিতে পারবোনা বলে।
চোখের পানি যখন টুপ করে ফোনের স্ক্রিনে পরলো,ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো মিতু।সাব্বিরের কথা গুলো এখনও ওর কানে স্পষ্ট ভাবে বাজছে।ফোনটা রেখে বারান্দায় গ্রিল ধরে দাড়িয়ে,একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো।আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলতে লাগলো তবে কি ধরে নিবো আমার জায়গাটা এতদিনে কাওকে দিতে পেরেছো? বিশ্বাস করো বিয়ের এত বছর পরেও তোমার জায়গাটা আমি তাকে দিতে পারিনি। তুমি সেদিন জিজ্ঞ্যেস করেছিলে কেমন আছি? একজন মেয়ে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে স্বামীর কাছে ধর্ষণ হয়ে যেমন থাকে আমি তেমন ই আছি। জানতে চেয়েছিলে না,এখনও ভালোবাসি কিনা তোমায়? প্রতিরাতে স্বামী পাশে থাকা সত্বেও,মাঝরাতে তোমার কথা ভেবে বালিশ চাপা দিয়ে চিৎকার করে কান্না করাকে যদি ভালোবাসা বলে তবে এখনও ভালোবাসি তোমায়।
সেদিন অনেক কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারিনি,হয়তো আর কখনো বলাও হবেনা।তবে আমি জানি তুমিও আমাকে একসময় মিস করবে।যখন তোমার পুরো পরিবার কে নিয়ে কোনো এক নদীর ধারে ঘুরতে যাবে,সবাই পাশে থাকা সত্বেও তুমি আমাকে মিস করবে।কোনো এক জোৎস্না রাতে চাঁদ দেখার সময়,বউ পাশে থাকা সত্বেও তুমি আমাকে মিস করবে।অথবা কোনো এক হলুদ বিকেলে মিষ্টি রোদের মায়ায় তুমি আমায় খুঁজবে।কারণ আমার সাথেও এমনটাই হয়।আজও প্রিয় গানে, প্রিয় সময়ে,না চাইতেও তোমাকে মিস করে ফেলি।অবশ্য আমার ধারণা ভুল ও হতে পারে,তুমি হয়তো আমার জায়গাটা তাকে দিয়েই দিয়েছো আমার জায়গা তুমি তোমার বউকে দিতে পারলেও,আমি কখনো তোমার জায়গাটা কাওকে দিতে পারবোনা।কেনো জানি মনে হচ্ছে তোমার ঐ ছবিটা শুধুই লোক দেখানো কারণ আমার ঘরের দেওয়ালেও টাঙানো আছে এমন লোক দেখানো ভালোবাসার কত ছবি।
জানি ভুলতে চেয়েও তোমাকে কখনো ভোলা হবেনা।অনেক কথা বলার থাকলেও আর বলা হবেনা। ভাবলেও কোনো কিছু পাল্টাবে না, কাদলেও আর তোমাকে কাছে পাওয়া হবেনা।কোনোভাবেই তোমাকে আর পাওয়া সম্ভব না।মনের মাঝে তোমার জায়গাটা আজীবন ই খালি রয়ে যাবে। মনের মাঝে আজীবন তুমি রবে নিরবে….
গল্পের বিষয়:
গল্প