আজকে হঠাৎ করে বাবা বাইরে থেকে এসে মাকে জিজ্ঞেস করলো; তোমার ছেলে কই?আমি ভাবলাম বাবা হয়তো কোনো কাজে ডেকেছে তাই মা উত্তর দেওয়ার আগেই আমি সামনে গিয়ে বললাম; এইতো বাবা আমি।বাবা আমার কাছে এসে সজোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো; এত বড় ছেলে হয়েছিস এখনো বাবার কাঁধে বসে খাচ্ছিস,সারাদিন বাড়িতে টো টো করে বেড়াচ্ছিস,কোনো কাজ নাই,কাম নাই,তুই আজ ই আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবি,যাহ।
আমি থ হয়ে এক মিনিটের মত দাঁড়িয়ে ছিলাম,কোনো শব্দ করতে পারিনি।শুধু দু চোখ দিয়ে পানি যাচ্ছে আর ভাবতেছি বাবা কেনো আজ হঠাৎ করে এমন করলো?যে বাবা কোনোদিন আমাকে রাগ করে পর্যন্ত কথা বলেনি সেই বাবা আজ আমার গায়ে হাত তুললো?এভাবে বকাবকি করলো,তাও কোনো কারণ ছাড়াই হুট করে!কোনোভাবেই মনকে বুঝাতে পারছিনা কি হলো।
সাধারণত যারা আমাদেরকে কখনো রাগ করেনা,জোর গলায় কথা বলেনা,খুব আদর করে,তারা যখন সামান্য ধমক বা রাগ করে কথা বলে তখন অন্যরকম প্রচণ্ড খারাপ লাগে।কারণ, সে মানুষটা আমাকে সব সময় আদর ভালোবাসা ই দিয়েছে কখনো রাগ করেনি,তাই তার হঠাৎ করে এমন অস্বাভাবিক আচরণ করলে খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক।ঠিক তেমনটা আজ বাবার সাথেও হলো।প্রচণ্ড রকমের খারাপ লাগছিলো। রুমে গিয়ে প্রচুর কাঁন্না করছিলাম আর মনে মনে ভাবতেছি ছেলে হয়ে জন্মানোটা বোধহয় জীবনে সব থেকে বড় ভুল হয়েছে।নির্দিষ্ট বয়স পার হয়ে গেলে পরিবারের কাছেও আর কোনো দাম থাকেনা যতদিন না একটা ভালো চাকরি পাই।এমনকি যে বাবা মা সারাজীবন আশ্রয় দিয়ে বড় করে তোলে তারাও তখন আর দায়িত্ব নিতে চায়না।ঠিক তেমনটা আজ বাবা মুখের উপর বলে দিলো।
এমন পরিস্থিতিতে মেজাজ প্রচুর খারাপ। তাই ভাবলাম বাড়ি ছেড়ে এবার চলে যাবো যেদিকে দুচোখ যায়।যেহেতু বাবাও বলে দিলো মুখের উপর তাই আর নির্লজ্জের মত থাকার কোনো মানেই হয়না।মনের ভিতর যত কিছু মাথায় আসুক না কেনো,বাবার একটা জিনিস ই ঘুরপাক খাচ্ছে কেনো আজ বাবা হঠাৎ এমন করছে,নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার জন্য সব ঠিকঠাক করলাম।যাওয়ার সময় কাউকে জানাবোনা,যেদিন টাকা পয়সা করতে পারবো সেদিন বাড়ি আসবো,আর নাহয় আসবোনা কোনোদিন।কিন্তু যাওয়ার জন্য পকেটে কোনো টাকা নাই।তাই আজকে যাওয়া আর হবেনা।কালকের দিন থেকে টাকা ম্যানেজ করে পরশু ভোরে ভোরে রওয়ানা দিবো সবাইকে ঘুমে থাকতে,তাছাড়া শুক্রবারে মা জগিং করতেও বের হয়না,সুবিধা হবে।
সেদিন রাতে মা অনেক জোরাজোরি করলো কিন্তু আমি কিছুতেই কিছু খাইনি,খাবোওনা পণ করেছি।মাকে সাফ সাফ বলে দিছি; যেদিন কামাই করতে পারবো সেদিন এ বাড়ির ভাত খাবো,এছাড়া আর খাবোনা।মা বললো; শুন বাবা রাগ করিস না,আজ দেখি হঠাৎ তোর বাবার মেজাজ খারাপ কিন্তু কেনো সেটাতো জানিনা,আর বাবারা সন্তানদেরকে এরকম রাগ করেই,তাই বলে তুইও এমন রাগ করবি? মা যতই বুঝাচ্ছে আর আমার মাথায় ঢুকতেছেনা।বাড়ি থেকে পালাবোই।সেদিন আর খাইনি। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বন্ধু রুস্তমের কাছে চলে গেলাম।গিয়ে তাকে অন্য একটা কাজের কথা বলে কিছু টাকা ধার নিলাম।এবার মোটামুটি শান্তি লাগতেছে,বাড়ি থেকে পালানোর জন্য সমস্ত কিছু রেডি করা শেষ।বাড়িতে গিয়ে টাকা সহ মানিব্যাগ বরাবরের মত আমার বালিশের নিচে রাখলাম নিশ্চিন্তে।
পরদিন ভোরে সবাই ঘুমে থাকতে থাকতে আমি বেরিয়ে পড়লাম।বের হওয়ার সময় মানিব্যাগ টা আর ভালো করে চেক করলাম না।রাস্তার মাথা থেকে একটা রিক্সা নিয়ে স্টেশনের দিকে রওয়ানা হলাম।স্টেশনে নেমে ভাড়া দিতে গিয়ে দেখি আমার মানিব্যাগে টাকা নাই।হঠাৎ করে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।মনে মনে ভাবতেছিলাম বোধহয় বালিশের নিচে পড়ে গেছে তাই রিক্সা ওটা নিয়েই আবার রওয়ানা হলাম বাড়ি দিকে।গিয়ে দেখি মানিব্যাগ যেখান থেকে নিলাম সেখানেই টাকা পড়ে আছে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, মানিব্যাগ নেওয়ার সময় সেখানে কোনো টাকা ই দেখিনাই।দাঁড়াইয়া এখন অত কিছু ভাবার সময় নেই,সবাই আবার উঠে যাবে তাই টাকা নিয়ে সবে মাত্র ঘর থেকে পা বাড়াবো,অমনি পিছন থেকে মা হাত ধরে বললো; দাঁড়া সানভি!
-মা তুমি!
-তোর মানিব্যাগ টা আমি লুকিয়েছি।
-মানে?
-তুই যে বাড়ি থেকে পালানোর জন্য সব বন্দোবস্ত করছিস সব আমি জানি।আর তার জন্য যে রুস্তম থেকে টাকা ধার নিলি তাও জানি।
-কিভাবে?
-তোর বাবা তোকে কালকে বকাবকি করে বাজারে যাওয়ার পর রুস্তমের সাথে দেখা,তারপর তোকে বুঝাতে বললো অকারণে যে রাগ করলো।তারপর রুস্তম বললো; সেতো আজকে একটা কাজের কথা বলে আমার থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছে।তারপর তোর বাবার সন্দেহ হলো যে তুই হয়তো বাড়ি থেকে পালানোর জন্যই টাকা ধার নিলি।রাতে বাড়িতে এসে তোর ব্যাগ চেক করে দেখে যে তুই সত্যিই বাড়ি থেকে পালানোর জন্য ব্যাগ গুছিয়ে রাখছিস,আর মানিব্যাগে টাকা।তারপর আমাকে গিয়ে বিস্তারিত বললো এবং শিখিয়ে দিলো মানিব্যাগ টা সরিয়ে রেখে ভোরে ভোরে তোর দিকে নজর রাখা।
-ইস!সেদিন আমাকে অকারণে বকে আজ উনি দরদ দেখাচ্ছে যেনো বাড়ি থেকে না পালাতে পারি।
-তাহলে শুন সেদিন কেনো তোকে বকেছিলো হঠাৎ করে।তোর জন্মের পর তোর বাবার খুব শখ ছিলো তোকে বিদেশে পড়াশুনা করাবে,আমাকে প্রায়ই বলতো; আমার ছেলে বিদেশ থেকে ডিগ্রী নেবে কিন্তু তুই তো জানিস তুই সপ্তম শ্রেণীতে থাকাকালীন তোর বাবা দুর্বৃত্তদের চক্রান্তে পড়ে মিথ্যা মামলায় ফেঁসে এক বছর জেল খেটে সর্বহারা হয়ে গেছে।তার পুরো ব্যবসা এলোমেলো হয়ে গেছে।তারপর থেকে এখনো সোজা হয়ে উঠতে পারেনি।সেদিন চায়ের দোকানে সাজেদ খন্দকার তার ছেলেকে নিয়ে খুব প্রশংসা করছে যে কিছুদিন পর বিদেশ থেকে ডিগ্রী নিয়ে আসবে,আর তোকে বাবাকে বলছে; আপনার এই দামড়া ছেলেকেটাকে বাড়ি রেখে খাওয়াচ্ছেন কেনো?ভালো কোথাওতো পড়াতেও পারেন নি,ভালো চাকরিওতো কপালে জুটবেনা,তারচেয়ে যেকোনো একটা কাজে লাগিয়ে দিন।
এটা শুনার পর তোর বাবার নিজের প্রতি নিজের রাগ হলো যে; কি করলাম জীবনে সন্তানের জন্য,আমার সন্তান আমার ব্যাপার অন্য মানুষ কেনো জ্ঞান দিবে,ছেলে হয়ে কি অন্যায় করেছে নাকি।তাই নিজের উপর রাগে ক্ষোভে বাড়িতে এসে তোকে বকা দিয়েছে।তোকে বকা দিয়ে রাতে এসে কাঁন্না করছিলো আমার কাছে।তোর বাবা তোকে প্রচুর ভালোবাসে।উপরে দিয়ে প্রচুর রাগ দেখালেও ভিতরে লুকিয়ে আছে অপ্রকাশিত ভালোবাসা।
মা এসব কথা বলছে আর আমার চোখ দিয়ে পানি যাচ্ছে।সেদিন যে অনুমান করেছিলাম বাবা নিশ্চয়ই কোনো কারণে বকা দিয়েছে আর আজ তার প্রমাণ পেলাম।সেদিনের ঘটনার জন্য বাবার প্রতি আমার ভুল ধারণা ভেঙ্গে গেলো।আর বুঝতে পারলাম যে,বাবাদের কঠোর আচরণের মধ্যেও ভিতরে লুকিয়ে থাকে অপ্রকাশিত ভালোবাসা,যা কখনো মুখ ফুটে বলা হয়ে উঠেনা।
মা আমাকে বুকে টেনে নিয়ে চোখের পানি মুছে দিচ্ছিলো,হঠাৎ চোখ গেলো ভিতরের দরজার দিকে।দেখি বাবা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের এসব শুনছে।দৌঁড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁন্না করে দিলাম।বাবা বুকে টেনে নিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো; যা রিক্সার ভাড়া টা দিয়ে তাকে বিদায় করে হাত মুখ ধুয়ে আয়,সকালের নাস্তা খাবো একসাথে!
গল্পের বিষয়:
গল্প