একজন খারাপ লোকের গল্প

একজন খারাপ লোকের গল্প

স্বাধীনতা দিবসটা মফস্বলে কাটাতে হবে আলমকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা কাজে ঢাকা ছাড়তে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্টহাউসে ওঠেনি, এক বন্ধু তাকে একটা নিরিবিলি রেস্টহাউস পছন্দ করে দিয়েছে – এটা সায়েন্স ল্যাবরেটরির। মির্জাপুর মৌজায় – চৌদ্দপাই মোড়ে ফায়ার ব্রিগেডের বিপরীতে। প্রায় ৫০ একর জায়গাজুড়ে ল্যাবরেটরির চৌহদ্দি। উঁচু পাঁচিলঘেরা। রেস্টহাউসটা প্রায় মাঝখানে। খোলা জায়গায়। পাশে আমবাগান ও অন্যান্য বৃক্ষশোভিত। পুবমুখী দোতলা বাড়ি। দক্ষিণে আছে প্রশস্ত বারান্দা। নিচে পাঁচটি, ওপরে তিনটি কামরা। ওপরের কামরাগুলো এসি, নিচে এসিহীন – আর আছে বসার বড় কামরা, রান্না ও ভাঁড়ারঘর। এতো নিরিবিলি যে রাতে আলমের ভয়ই লাগে। এছাড়া রাতে আছে হাজার উচ্চিংড়ের ডাক – বসন্তকাল বলে আছে ঝিঁঝিঁর ঐকতানও। একমাত্র পুরনো এসিটা গোঁ-গোঁ করে এদের সংগীতকে ব্যাহত করে। তবে এসি বন্ধ করলেই সে ঐকতান একটানা অল ক্লিয়ার সাইরেনের মতো বেজেই চলে।

একা আছে রেস্টহাউসে। বাবুর্চিও নেই। রাত ১০টার দিকে কাজ সেরে সে চলে গেছে। তার নিরাপত্তার জন্যে অবশ্য দুজন নৈশপ্রহরী আছে ভবনের অন্দরে। এরা আসলে টহল দিয়ে বেড়ায়, তবে মূল দায়িত্ব রেস্টহাউসের নিরাপত্তা। এটা তাদের নিত্যদিনের ডিউটি, রেস্টহাউসে কেউ থাকুক না থাকুক।

মফস্বলের স্বাধীনতা দিবস দেখার একবার তার ইচ্ছে হয়েছিল, পরে তা মানসে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। এইসব দিবসের ধরাবাঁধা ছক তার ভালো লাগে না। ছোট আড্ডা বা সাহিত্য সংগীত অনুষ্ঠান হলে সে উপভোগ করে। তাই মোবাইলে বেশ কয়েকজনের ডাকাডাকির উত্তরে সে শরীর খারাপের দোহাই দেয়। এই একটা ব্যাপারে কেউ চাপাচাপি করতে পারে না বলে রক্ষে।

স্বাধীনতা দিবসে বাবুর্চির ছুটি। তবু সকালে নাস্তা দিয়ে গিয়েছিল। দুপুরে তাকে নিজে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আলম ঠিক করে, আজ কারো বাসায় যাবে না। রাস্তার পাশে যেসব ছোট-ছোট খাবার দোকান থাকে ওখানে দুপুরের আহার সারবে। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সে রেস্টহাউস থেকে বেরোয়। দুপুর ১২টা। সূর্য মাথার চাঁদিতে। আলম বেরোনোর সময় হলুদ রঙের ক্রিকেট ক্যাপটা নিতে ভোলে না। টাক ঢাকা যাবে, আর রোদ। বরং এই অবসর জীবন শুরুর বয়সটাও ঢাকা পড়বে। মাথায় ক্যাপ লাগিয়ে রেস্টহাউস থেকে বেরিয়ে নিজের মধ্যে একটা জোয়ান-জোয়ানভাব অনুভব করে। মাঝ-চৈত্রের রাজশাহীর রোদ বেশ ধারাল। মাথায় না লাগলেও গায়ে বিঁধে।

চৈত্রেই যদি এই অবস্থা, এবার বৈশাখ আর জ্যৈষ্ঠে গরমটা খুব জোরেই পড়বে… মনে-মনে বলে আলম।

গেট পার হয়ে রাস্তায় বেরোতেই তপ্ত পিচঢালা রাস্তার গরম হলকা টের পায়। নালার পাশে কয়েকটা চায়ের দোকান। সকালে নাস্তা করেছে একদিন, কিন্তু দুপুরের খাবারের কোনো ব্যবস্থা দেখল না। এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে, আপনারা কেউ ভাতের ব্যবস্থা করেন না?
না। এখানে শুধু চা। আপনি বিনোদপুর চলে যান।
শহরের দিকে যেতে চাই না, বলে আলম।
তাহলে আপনি একটা অটো করে দেওয়ানপাড়ার মোড়ে চলে যান, ওখানে ভাতের দোকান পাবেন।

দেওয়ানপাড়ার মোড়টা খুব একটা দূরে নয়। জায়গাটা তার চেনা। অটোতে পাঁচ টাকার মামলা। সে রাস্তা পার হয়ে অটোর জন্যে অপেক্ষা করে।

এই মোড় পার হলেই ধান-গম গবেষণার বিশাল খামার। সবুজে ছাওয়া। দূরে গবেষণাগার দেখা যায়। জায়গাটা এখনো বেশ ফাঁকা-ফাঁকা, তার বেশ ভালো আগে এমন জায়গা দেখলে। রাজধানীতে বাস করে শহরের কোনো ফাঁকা অংশ চোখে পড়ে না। এখানে চোখ দুটো তার তৃপ্ত হয়। মনে-মনে ভাবে, আচ্ছা, এখানে একটা বাসা ভাড়া নিলে হয় না। মাঝে-মাঝে সময় কাটিয়ে যাবে! এখানে দূষণের মাত্রা এখনো সহনীয় পর্যায়ে আছে। আগের বরেন্দ্রভূমি এখন অনেক বদলে গেছে, এখন অনেক গাছপালা… মানুষজন বেশ সচেতন। সবুজের মূল্য বুঝেছে।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি, একটা অটো পেয়ে গেল। দু-তিন মিনিটের মধ্যে দেওয়ানপাড়ার মোড়ে। এখানে বেশ কয়েকটা ভালো খাবারের দোকান আছে। একটায় ঢুকে দেখল এই দুপুরেও লোকে চা-নাস্তা খাচ্ছে। টেবিলে কোথাও ভাতের চিহ্ন পেল না। ছুটির দিন। সবাই অলস প্রহর কাটানোয় ব্যস্ত।

দোকানিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে এখানে খাবার ব্যবস্থা নেই এবং কোনো দোকানেই। তবে মোড়ের বিপরীত দিকে একটা দোকান আছে।

গাছের ছায়াতলে থাকা দোকানগুলোর অবস্থান ছাড়তেই রোদ তীব্র ফলা বিদ্ধ করে। রাস্তার ওপারে গিয়ে কোনো দোকান চোখে পড়ে না। ভাবে, মিথ্যে বলল নাকি! হঠাৎ তার নজর পড়ে একটা ছাপড়ামতো দোকান নালার পাশে। একটা বেঞ্চও তার দৃষ্টিগোচর হলো। তাহলে এটাই সেই খাবারের দোকান! এপারের দোকানের সঙ্গে যার তুলনাই চলে না। জায়গাটা প্রায় ফুট দশেক নিচে। গড়ান রাস্তা। সাবধান না হলে বিপদ হতে পারে। একটা শীর্ণ ময়লা জলধারা বয়ে চলেছে। পাশে উড়ছে বালি। রোদে তেতে রয়েছে। চিকচিক করছে। অগত্যা সে সাবধানে নিচে নামে।

দূর থেকে যতোটা কুৎসিত লেগেছিল, কাছে এসে ততোটা খারাপ লাগে না তার। শুধু পরিবেশটা বৈরী।

ব্যবস্থাটি খুবই অল্প পরিসরে। মাথার ওপর ছাউনি হলো নীল মোটা পলিথিন। বাতাসে পতপত করে উড়ছে। দুটি বেঞ্চ। মাঝে একটা মাঝারি টেবিল। বেশ পুরনো। ওপরে কোনো টেবিল-ক্লথ নেই। একেবারেই জন্মদিনের পোশাকে। চেয়ার আছে দুটো। তার একটিতে মধ্য-পঞ্চাশ বয়সের এক লোককে দেখল। কালো বড়, কোঁকড়া সাদা-কালো চুল, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি… গায়ে হাতঅলা গেঞ্জি, পরনে চেক লুঙ্গি। আরো আছে একটা মেয়ে। বয়স সাতাশ-আটাশ হবে। বেশ ভালো স্বাস্থ্য। সবুজ শাড়ি পরা। হরতন আকারের মুখ, মুখে কিছুটা মেছতা পড়েছে, তবে স্বাস্থ্য ভালো। বসে বঁটিতে তরকারি কুটছে। পাশেই একটা ডালায় বাটা মাছ রাখা, মসলা মাখানো। পেছনে একটা বড় ডেকচি ঢাকনি দেওয়া। আর একটা ডেকচি আধো খোলা, ভাত দেখা যাচ্ছে। আছে একটা পুরনো র‌্যাক। তাতে থালাবাসন ও অন্যান্য তৈজসপত্র রাখা।

খালি চেয়ারে না বসে আলম বেঞ্চিতেই বসে। পকেট থেকে তার নোটবইটা বের করে। তারপর দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে, আপনার নাম?
সিরাজ।
কতদিন চালাচ্ছেন হোটেল?
আপনি এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সে আশ্বাস দেয়।
কী করেন আপনি?
আমি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করি। কিছু লেখালেখিও করি।
তাহলে ঠিক আছে, সহজ আশ্বস্ত ভাব প্রকাশ করে সিরাজ। কী জানতে চান?
এই কতদিন এই কাজ করছেন, আগে কী করতেন…
তার কথার মাঝেই সিরাজ বাগড়া দেয়, দেখেন, আমি একটা খারাপ মানুষ, কী হবে এসব জেনে?
চমৎকৃত হয় আলম। এমন করে তো কেউ কোনোদিন অচেনা লোকের সামনে কথা বলে না! লোকটা তো সাধারণ আর ১০টা লোকের মতো নয়। সব খারাপ লোকই তো নিজেকে ভালো জাহির করতে চায়। নিজেকে পর্দার আড়ালে রাখে।
আপনি নিজেকে খারাপ মানুষ বলছেন কেন?
কারণ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারিনি…
সে তো অনেকেই পারে না, তা বলে তাকে তো খারাপ মানুষ বলা যায় না। আপনার ছেলেমেয়ে ক’জন?
১০ জন। খারাপ লোক হলাম না?
না, তা কেন! আমরাই তো আট ভাইবোন।
আপনার মা কজন?
কেন, একজন।
আমার ছেলেমেয়ের মা চারজন।
তাতে কী। আপনি তো শরিয়ত মেনেই চলেছেন। বরং আপনার যে বত্রিশজন ছেলেমেয়ে হয়নি, সেটাই তো বড় কথা।
আরো ১০ জন হয়েছিল, মারা গেছে…
দুঃখিত…

দুজন কয়েক মিনিট চুপচাপ। মানুষের অন্তর্লোকের কথা তো আর শোনা যায় না, কিন্তু ধারণা করা যায়। লোকটি কি মর্মবেদনায় ভুগছে? ভাবে আলম। এসব ভাবছে আলম, এমন সময় সিরাজ বলে, রাতে তাড়ি না খিলে থাকতে পারি না। তারপরও বলবেন খারাপ লোক নই?

কী যে বলেন সিরাজ, আপনারা যাদের ভালো লোক বলেন, তাদের অনেকেই রাতে ক্লাবে গিয়ে বা বাসায় ইয়ার-দোস্তদের নিয়ে বিদেশি দামি মদ রোজ না পান করলে চলে না। তাদের তো কেউ খারাপ মানুষ বলে না।

তাড়ি খাওয়া ছাড়াও আরো কিছু দোষ… কথাটা ফুরোয় না সিরাজের, সেই সময় মেয়েটি কড়াইয়ে মসলামাখা বাটা মাছ দেওয়ায় গরম তেলে আওয়াজ ওঠে। সিরাজের সঙ্গে মেয়েটির চোখাচোখি হয়। মেয়েটির চাউনি পাথরের মতো শক্ত।
আলম যা বোঝার বুঝে নিয়েছে।
সে সিরাজকে নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করে, রাঁধছেন উনি কে? কাজের মেয়ে?
না। আমার বউ। ছোটবউ।
আলম বোঝে নাটক বেশ জমে উঠেছে।
সে সহজ করার জন্যে বলে, শুনুন সিরাজ, ধনী লোকেরা হোটেলে রুম ভাড়া নেয়, বিদেশ চলে যায়… এটাই তো ভালোমানুষি… আপনি অত নিজেকে খারাপ ভাবছেন কেন?
আলোচনা ব্যক্তিগত খাত থেকে অন্যদিকে ফেরানোর জন্যে আলম বলে, আপনাদের এই জায়গাটার নাম কী?
ওদিকটা দেওয়ানপাড়া। এদিকটা মাসকাটাদিঘি।
বাহ্, বেশ মজার নাম তো! মাসকাটাদিঘি…
পেছনে একটা দিঘি আছে, এটা কাটতে নাকি এক মাস সময় লেগেছিল… তাই মাসকাটাদিঘি।
পেছনে জমি কিনতে পাওয়া যাবে? আলমের ইচ্ছা এই শহরে একটা বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি করবে।
না। এখানে সব পুরনো ধনী লোকদের বাস। কেউ জমি বিক্রি করবে না। অনেকটা ভেতরে গেলে জায়গা পেতে পারেন।
জায়গাটা খুব সুন্দর। প্রচুর গাছপালা, আর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পাকা একটা রাস্তা।
জায়গা দিয়ে কী করবেন? বাড়ি বানাবেন?
না, একটা বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি করব। মূলত কম্পিউটার ট্রেনিং… এই রকম। খুব বেশি জায়গা লাগবে না। বিঘাখানেক হলেই চলবে।
আপনি তো দেরি করে ফেলেছেন। এখন জাগয়ার দাম তো অনেক! এখানে আট থেকে ১০-১২ লাখ কাঠা… দুবছর আগে অর্ধেকেরও কম ছিল।
এতো দাম বেড়েছে!
হ্যাঁ। তাছাড়া এখন আর লোকে জমি বেচতেই চায় না।
আপনার জমি নেই?
জমি থাকলে এই নালার ওপর হোটেল বসাই। তিন কাঠার ওপর বসতবাড়িটা আছে। তাই পথে বসতে হয়নি।
মাছের রান্নার গন্ধটা ক্ষিদে ধরিয়ে দেয় আলমের।
সে বলে, খাওয়া দেবেন কখন?
এই তো মাছটা রান্না হয়ে গেলেই খেতে পারেন। এখানে সবাই আসে দুটোর পর। পেছনে যে করাতকল আছে ওখানকার কর্মীরা সব হাজির হবে। তখন বসার জায়গা পাবেন না।
ডেইলি কতজন কাস্টমার হয়?
৪০ থেকে ৫০। খাবার কিছুই পড়ে থাকে না। ওই হিসাবেই পাক করা হয়।
মাছ কত করে নেন?
১৫ টাকা।
আর মাংস?
৪০। ভাত ১০। ডাল পাঁচ, ভাজি ১০।
এতে আপনার চলে?
চালাই। চলে না।
মাছরান্না শেষ। বেলা প্রায় সোয়া একটা। পেটের মধ্যে ক্ষিদেটা পেকে উঠেছে।
আলম বলে, এখন খাবার দেওয়া যায়?
যাবে।
সিরাজ স্ত্রীকে নির্দেশ দেয় খাবার দিতে।
থালাটা বেশ পরিষ্কার করে ধুয়ে দেয় সিরাজের স্ত্রী।
ভাত বেশ গরম। মাছের তরকারিটা আরো গরম।
একটা মাছ খেয়ে আলম খুব তৃপ্ত। এমন স্বাদ অনেকদিন পায়নি। সে বলেই বসে। মাছটা খুব ভালো রান্না হয়েছে, আরেকটা দিন।
টাটকা মাছ তো। আর এদিকে নদীর মাছও পাওয়া যায় – বলে সিরাজ।
মাছ খাওয়া শেষে আলম বলে, মাংসের ডেকচিটা একটু খুলুন তো!
সিরাজের বউ ঢাকনি খোলে। মাংসের ঘ্রাণ বাতাস ভরে তোলে। লালচে ঝোল আর তেল ভাসছে। লোভ হচ্ছিল আলমের, কিন্তু মাছের স্বাদটা আর নষ্ট করতে চাইল না।
বলে, থাক! মাছ খাবার মজাটা তাহলে নষ্ট হয়ে যাবে। আর একদিন এসে খাব।
খাওয়া শেষে হাত-মুখ ধুয়ে সে বেশ আরাম করে বসে। তখনো অন্য খদ্দের আসেনি।
সিরাজ এই সময় মুখ খোলে, স্যার, আমার অবস্থা এতো খারাপ ছিল না। একসময় ছ-লাখ টাকার ক্যাশ নিয়ে বিজনেস করেছি। কিন্তু স্যার নসিব… নসিবে তো বিশ্বাস করতে হবে… সব ভেস্তে গেল। আজ হাতে ক্যাশ পাঁচ হাজার টাকাও নেই।
কিসের ব্যবসা করতেন?
সাইকেল আর সাইকেলের পার্টস। সারা রাজশাহী শহরে আমরা মাত্র তিনজন ব্যবসায়ী ছিলাম। ভালো আয় হতো। ব্যাংক থেকে কিছু লোন নিয়ে ব্যবসাটা বড় করার ব্যবস্থা নিচ্ছিলাম, কিন্তু বললাম যে স্যার, সবই নসিব… নসিবে না থাকলে হাজার চেষ্টা করেও কোনো লাভ নেই।
কী হলো আপনার ব্যবসার?
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সিরাজ। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। যেন কথাটা শোনেইনি।
জোর একটা দমকা হাওয়া কিছু বালি উড়িয়ে নিয়ে গেল। পতপত করে আওয়াজ তুলতে থাকে ঢাকনি-পলিথিনে। বাতাস বেশ গরম। জ্বলন্ত স্টোভের হাওয়ার সঙ্গে মিশে তা আরো শক্তি পায়।
রাজশাহী শহরে এই পদ্মার বালি একটা ঝামেলা… বলে সিরাজ।
আলম ভাবে, সিরাজ কি কথা ঘোরাতে চাচ্ছে।
নদী মরে যাওয়ায় আপনাদের এই বিপত্তি দেখা দিয়েছে… না হলে এমনটা হতো না।
আমার ব্যবসাটাও ওই পদ্মার মতোই মরে গেল। ফারাক্কার বাঁধে মরল পদ্মা, আর আমার ব্যবসাটা মরল প্রতিযোগিতায়। টিকতে পারলাম না। আমাদের ব্যবসার সফলতার জন্যে অনেকে এদিকে ঝুঁকে পড়ল। তাদের অনেকের মূলধন বেশি, তাই আর টিকতে পারলাম না। ব্যাংকের লোন শোধ করব না সংসার চালাব… শেষে একেবারে শেষ হয়ে গেলাম। বড় সংসার…
এই সময় একদল শ্রমিককে দোকানে ঢুকতে দেখে আলম বলে, সিরাজ সাহেব, আজ চলি। পরে আসব।
জি আসেন।
বেলা তখন প্রায় ২টা। রাস্তা প্রায় খালি। একটা অটো পেয়ে উঠে বসে। অল্পক্ষণের মধ্যেই রেস্টহাউসে ঢুকে এসিটা ছেড়ে তবে স্বস্তিবোধ করে।
পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সেরে আলম সোজা সিরাজের দোকানের উদ্দেশে রওনা দেয়।
দেওয়ানপাড়া মোড়ে নেমেই হকচকিয়ে গেল আলম। দেখল একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়ানো। কয়েকজন লোক জটলা পাকিয়েছে। তার মাঝ দিয়ে সিরাজকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে পুলিশ-ভ্যানে তোলা হচ্ছে। আলম দ্রুত এগিয়ে যায়।
সে জিজ্ঞেস করে, কী হলো সিরাজ?
নোংরা পরিবেশে দোকান চালাই, তাই পাঁচ হাজার টাকা ফাইন। কোথা থেকে দেবো পাঁচ হাজার টাকা! তার চেয়ে ১৫ দিন জেল খেটে আসি।
আলম দেখে সিরাজের দোকানের টেবিল-চেয়ার সব ওলটানো। ওর ছোটবউটা ওখানে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে।

বলেছিলাম না স্যার, আমি খারাপ লোক। এবার স্যার সত্যি খারাপ হয়ে ফিরব।
পুলিশ-ভ্যান শহরের দিকে যাত্রা করে। আলম গরমটা ভালোভাবে টের পায়। রাস্তার পিচ প্রায় গলে গেছে। আকাশে চোখ রেখে কোথাও একটুকরো মেঘের দেখা পেল না। রাস্তার নিচে সিরাজের দোকানের নীল পলিথিনটা শুধু পতাকার মতো পত-পত করে উড়ছে। গতকাল ছিল স্বাধীনতা দিবস। আজ যেন তার রেশ এখনো কিছুটা রয়ে গেছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত