অন্ধকারে জারুল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা অজ্ঞাত মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম দাম কত?মেয়েটি উৎসুক মুখে বললো রাত প্রতি ৫০০ টাকা। আপনার জন্য ২০০ টাকা কম।আমি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম তোমার দাম জানতে চাইনি।ওখান থেকে যে বাদাম খানা ছুঁড়ে মারলে তার দাম কত?মেয়েটি এবার স্তব্ধ হয়ে গেল।জোছনার আলো যেন গাছের ফাঁক দিয়ে ঢুকে মেয়েটির শরীর বেয়ে বেয়ে পড়ছে।একটু আগে জোছনার এতো তেজ ছিল না।মেয়েটি আস্তে আস্তে এগিয়ে আমার পাশে বেঞ্চিতে বসলো।গা ঘেঁষে বসেনি।আমাদের মাঝে সামাজিক দূরত্ব বজায় ছিল।
মেয়েটির নাম জানতে চাইলাম।জবাবে বললো জারুল।আমি রসিকতা করে বলে ফেললাম যখন কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কাউকে ডাকো তখন কি নামটাও কৃষ্ণচূড়া হয়ে যায়?মেয়েটি জবাব দিলনা।তার মুখে হতাশার ছায়া।কারণ সমস্ত পার্কে একমাত্র আমি বাদে আর কোন লোক নেই।লোক কম থাকা মানে ওদের জন্য সমস্যা।ইনকাম কম!মেয়েটি আঁচল থেকে এক মুঠো বাদাম বের করে বেঞ্চিতে রাখলো।মনে হয় আমাকে খেতে বলার সাহস পাচ্ছে না।আমি সেখান থেকে কয়েকটা বাদাম চিবুলাম।তারপর পকেট থেকে ৫০০ টাকার নোট বের করে জারুলকে দিতে চাইলে সে ঘোর আপত্তি জানালো।জবাবে আমাকে বললো সব কিছুর দাম টাকা দিয়ে হয়না।আপনি যে আপনার মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়েছেন বিনিময়ে কি সে আপনার থেকে টাকা নিয়েছে? কি অদ্ভুদ মেয়ে!কিসের সাথে কি মিলাতে আসলো?নিশ্চয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে।নাকি জারুলের গভীর কথাটির অর্থ বুঝতে ব্যর্থ আমি।
আজকে আমার স্ত্রী নীহারিকার ডেলিভারী।হালকা দুশ্চিন্তায় আছি। হসপিটালে নীহারিকার বাপের বাড়ির সবাই রয়েছে।আমিও ছিলাম।একটা কাজে এসে পাশের মসজিদে এশার নামাজ পড়ে নিয়েছিলাম।যাবার পথে এই শুনশান পার্কে এসে বসে পড়লাম।জারুল সেই কারণটাই জানতে চাইলো আমার কাছে।কেন এই নির্জন পার্কে একা বসে আছি?কিছুক্ষণ আগে ল্যাম্পপোস্টটাও নিভে গেল।জোছনার জন্য সমস্যা হচ্ছেনা যদিও।জারুলের মত মেয়ের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন আমি বোধ করিনা।তারপরও মনের অজান্তে বলে ফেললাম আসল কারণ।
পার্কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে ভেসে উঠলো এই বেঞ্চির উপর তিনজন মানুষ বসে আছে।একজন বাবা,একজন মা আর একজন ছেলে।বয়স সাত কি আট হবে।ছেলেটিকে তার বাবা-মা খুব করে আগলে রেখে আছে।আদর করছে।কপালে ও গালে চুমু খাচ্ছে।অদ্ভুদ এক আকর্ষণের টানে এখানে চলে আসলাম।তাই কিছুক্ষণ বসে আছি।আর কিছু সময় পর আমিও বাবা হতে চলেছি।জারুল হুট করে বলে ফেললো নিশ্চয় Broken Family থেকে বড় হয়েছেন।আশ্চর্য!জারুল মেয়েটি একথা কি করে জানলো?সে কি মানুষের কথা বুঝে ফেলার অদ্ভুদ ক্ষমতাপ্রাপ্ত নাকি?আমি জবাবে কিছু বললাম না।খানিকক্ষণ নীরব থাকলাম।তারপর বললাম তুমি ইংরেজী জানা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এসব কাজ করো কেন?জারুল উত্তর দিল তাকে নাকি আমরাই ভালো থাকতে দিলাম না।তারপর বিশ্রী এক হাসির শব্দ।বুকটা আঁতকে উঠলো!
আচ্ছা জারুল!ধরো সময় এগিয়ে যাচ্ছে।তুমি আর আমি একইভাবে এই বেঞ্চিতে বসে আছি।তোমার বয়সের কোন পরিবর্তন হলোনা।তুমি একই রকম যুবতী রয়ে গেলে।কিন্তু সময়ের সাথে আমি বুড়ো হয়ে গেলাম।ঠিক তখন আমি তোমার বাবার বয়সী হয়ে যাবো।কিংবা ধরো সময় এখান থেকে পেছন দিকে চলছে। তখন আমি একটা বাচ্চা ছেলে।ঠিক তোমার ছেলের বয়সী।আর বর্তমানটাই আমি তোমার ভাই বা পরম বন্ধুর বয়সী।তাহলে সবার মাঝে খদ্দেরকে খুঁজো কেন?এই কথা শুনে জারুলের চোখ ছলছল করে উঠলো।মনে হল জারুল আমাকে অনেক কথা বলতে চায়।হয়তো তার অতীত জীবনের কথা।কিংবা বর্তমান।
সেই মুহূর্তে সোহাগের ফোন।সোহাগ আমার শালা।সুখবর নিশ্চিত নাকি!ফোন রিসিভ করে ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম আমার নাকি একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে।আকাশের দিকে তাকিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে ফেললাম।পরক্ষণে সোহাগ গম্ভীর মুখে বললো সে পৃথিবীর আলোতে চোখ মেলতে পারেনি।ফোনটা আমার শ্বশুড়মশাই নিয়ে কেঁদে-কুটে একসার।সে বলছিল বাবা সায়েম আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও।আজকে আমার পাপের জন্য নীহারিকার এত বড় ক্ষতি হয়ে গেল।সে বারবার তার পাপের কথা বলছিলো।কারও পাপের শাস্তি অন্য কেউ পাবে কেন?আমার শ্বশুড়মশাই এক প্রকার বলেই ফেললো সে নাকি তার মেয়ের বয়সী একজনের মস্ত বড় সর্বনাশ করে দিয়েছিল।সেটা তার মেয়ের জীবনের উপর দিয়ে গেল।
আমিও তো শাস্তি পাচ্ছি এখন।সেটা কার পাপের ফল?এসব মনগড়া কথা মানতে আমার কষ্ট হচ্ছে বিধায় ফোন নামিয়ে ফেললাম।পাশে চেয়ে দেখি জারুল মেয়েটি উধাও!পুরো পার্কে আমি একা!বেঞ্চি থেকে বাদামগুলো তুলে পাঞ্জাবির পকেটে পুরে নিলাম।তারপর হসপিটালের রাস্তা না ধরে নির্বিকার উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলাম।হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।রোদের সময় বৃষ্টি হতে দেখেছি।যাকে আমরা বলি কানাশিঁয়ালের বিয়ে।কিন্তু এমন জোছনার আলোয় বৃষ্টি এই প্রথম দেখলাম।জোছনায় বৃষ্টিস্নান হয়ে গেল।এই পৃথিবীতে আসলে সবকিছুই সম্ভব।রাস্তায় হাঁটুজল হয়ে গেছে ততক্ষণে।নাকি সবকিছু আমার ভ্রম!
নির্ঘুম কিছু ল্যাম্পপোস্টের আলো গায়ে লাগছে।দেয়ালের পোস্টার গুলো গুমড়ে কাঁদছে মনে হল।পাশ কাটিয়ে যাওয়া প্রাইভেট কার গুলো কাঁদামাখা পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।অথচ আমি অনুভূতিশূণ্য! আমার মেয়ের মুখ আমি একটিবারের জন্য দেখতে চাইছি না কেন?এক পলক দেখাতে বিশাল মায়া আমাকে আচ্ছাদিত করে ফেলবে সেজন্য নাকি?আমি তো এমন ভীতু কোনদিন ছিলাম না।আচ্ছা আমার মেয়ের মুখখানা কার মতো হয়েছে?আমার মায়ের মত কি?যার চেহারা আমার মনে নেই।হয়তো মুখখানা দেখতে হয়েছে জারুল মেয়েটির মত!!!
গল্পের বিষয়:
গল্প