২০১৪ সালে বেবীটা মিসক্যারেজের পর থেকে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ি। এমন কোন কিছু নেই যে করিনি। মধ্য রাতে গোসল করে উঠানে দাঁড়িয়ে ওষুধ খাওয়া থেকে শুরু করে কোন কিছু আর বাদ রাখিনি। ডাক্তার দেখিয়েছি কত জন হিসেব নেই। দুনিয়ার টেস্ট করেছি স্বামী স্ত্রী দুজনের কিন্তু কোন সমস্যা ধরা পড়েনি। ডাক্তারের ওষুধ খেয়েছি।
ইঞ্জেকশন দিয়েছি যে কত। কিন্তু কোন ভাবেই বাচ্চার মুখ দেখিনি। প্রতিমাসে পিরিয়ড হয়ে যেতো। ডাক্তার কবিরাজ হুজুর সব দেখিয়েছি।ওষুধ খেয়েছি,মহিলাদের দেয়া ওষুধ খেয়েছি।বরের এক বন্ধু বল্লো হারবালের ওষুধ খাওয়া।তাই খেয়েছি। শেষমেস আই ইউ আই পর্যন্ত করেছিলাম। কিন্তু কোন ভাবেই রেজাল্ট পজিটিভ আসেনি। এরপর সব কিছু করা ছেড়ে আল্লাহ্র উপর সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বসে রইলাম। একদিন একটা ভিডিওতে দেখলাম,আর একটা বইয়েও মনে হয় দেখেছিলাম। লিখা যে, কেউ যদি এক টানা সাত টা রোজা করে।আর সেহরির এবং ইফতারের সময় ”ইয়া মুসাব্বিরু” ২১ বার পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে সেই পানি দ্বারা ইফতার করে এবং সেহরী করে। এবং বাচ্চার জন্য হাত তুলে মোনাজাতে নিয়ত করে। তাহলে ইনশাল্লাহ আল্লাহ্ তায়ালা তাকে সন্তান দিবেন। আর সেই সন্তান কখনোই নষ্ট হবেনা।
কথা গুলো পড়ার সাথে সাথে বিশ্বাস করে ফেললাম মনে প্রাণে। আর ডিসিশন নিলাম এই আমল আমি করবো। এরপর একটা দুইটা গ্রুপেও দেখলাম কয়েকজন আপু বলেছেন এই আমল করে তারা সফল হয়েছেন। আশা আরো বেড়ে গেলো। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো আমার বর। আমার বর আমাকে রোজা থাকতে দিবেনা। আমার নাকি শরীর খারাপ করবে। আর নফল রোজা বরের অনুমতি ছাড়া নাকি রাখা যায়না। তারপর শুরু হলো আমার বরকে বোঝানোর পালা। আমি তাকে অনেক অনুরোধ করে রাজি করালাম।আর বললাম সাতটা দিনই তো রোজা রাখি। সে রাজি হলো। এরপর থেকে আমি রোজা রাখা শুরু করলাম। রোজা রাখতে হবে একটানা সাত টা।
মাঝে গ্যাপ দেয়া যাবেনা। কিন্তু এমন সমস্যায় পড়লাম যে,আমি ৫ টা রোজা শেষ করতাম আর পিরিয়ড হয়ে যেতো।চার টা শেষ করতাম পিরিয়ড হয়ে যেতো। একবার তো ছয়টা শেষ করলাম কিন্তু পিরিয়ড হয়ে গেলো সাত দিনের দিন। হলো না আমার রোজা কমপ্লিট। অথচ তখন আমার পিরিয়ড ডেট ও থাকতোনা। আর আমার পিরিয়ড অনিয়মিতও ছিলোনা। হয়তো আল্লাহ্ আমার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন যে আমি হাল ছেড়ে দেই কিনা। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি।এভাবে চেষ্টা করতে করতে অনেক দিন কেটে যায়। এই যে শেষ বারের মত জুন মাসে আমি আবার রোজা রাখি। আর আল্লাহ্র রহমতে আমি এবার সাতটা রোজাই কমপ্লিট করতে পারি। আর রোজা কমপ্লিট করার দুই কি তিন দিন পরই আমার পিরিয়ড হয়। আর ওটাই ছিলো আমার লাস্ট পিরিয়ড।
জুনের ১৮ তারিখ। আর আল্লাহ্র রহমতে জুলাইর ২৬ তারিখে আমি বাসায় ইউরিন টেস্ট করে দেখি আলহামদুলিল্লাহ্ রেজাল্ট পজিটিভ। সাথে সাথে আমি আলহামদুলিল্লাহ্ পড়ে ফেলি। দু চোখ ভিজে যায় আমার। আল্লাহ্ তায়ালা অবশেষে আমার আর আমার বরের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। গত পরশু আমি আল্ট্রা করি,আল্ট্রার রুমে ঢোকার আগ মুহূর্তে আয়াতুল কুরসি,হাসরের শেষ তিন আয়াত পড়তে থাকি।চোখের জল আমি ধরে রাখতে পারিনা। ভয়ে হাত পা কাঁপছিলো। মনে মনে দোয়া করছিলাম,আল্লাহ্ কে বলছিলাম আল্লাহ্ তুমি আমাকে সন্তান দিও। ওকে ভালো রেখো। আমার বর বাইরে বসে আছে।মনে মনে ভাবছিলাম যদি রিপোর্টে খারাপ কিছু আসে তাহলে আমি ওকে কি জবাব দিবো।
এত দিনের আশা ভরসা। আল্ট্রা রুমে ডাকলো আমাকে। আমি শুয়ে আল্লাহ্কে ডাকছি।চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়ছে। আল্ট্রার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম,সব ঠিক আছে? তিনি বললেন,বাচ্চা ভালো আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,কত সপ্তাহ ওর? তিনি বললেন,৮ সপ্তাহ ৬ দিন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,হার্টবিট এসেছে? তিনি বললেন,হ্যাঁ এসেছে। আমি এবার জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম। তিনি আর তার সাথের মেয়েটা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন,কি হয়েছে।কাঁদছো কেন? বললাম অনেক বছর পর,অনেক সাধনার সন্তান তো তাই। বাইরে বেড়িয়ে বরের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমাদের বাচ্চা ভালো আছে। বাচ্চার হার্টবিট এসেছে। ওর বয়স আট সপ্তাহ ছয় দিন। আমার বর আমার চোখ মুখ মুছে দিচ্ছে।
বেচারা এত বছরে একটা বারের জন্য আমাকে সন্তান হয়নি বলে কোন কথা শোনায়নি।বরং পরিবারের সবাইকে বলে দিয়েছে,আমার বউকে কেউ যেন বাচ্চা নিয়ে কোন কথা না শোনায়।আল্লাহ্ যেদিন আমাদের সন্তান দিবেন,সেদিনই হবে আমাদের সন্তান। ওর বন্ধুরা ওর পরে বিয়ে করেও বাবা হয়ে গেছে দুই তিন সন্তানের। তবুও কখনো বলেনি ওরা বাবা হলো আমি এখনো হতে পারলাম না। অনেকেই ওকে অনেক কথা বলতো কিন্তু ও কোন দিন আমাকে কোন কিছু বলেনি। এমন স্বামী পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। আল্লাহ্ যেন ওকে পরজন্মেও আমার স্বামী করেন। আলহামদুলিল্লাহ্ আমার বাচ্চা ভালো আছে। এখন আমার বাচ্চার বয়স নয় সপ্তাহ শেষ।দশ সপ্তাহে পড়েছে। ওর হার্টবিটও এসেছে আলহামদুলিল্লাহ্। সবাই আমার কলিজাটার জন্য দোয়া করবেন। আর অবশ্যই আপনারা যারা মা হতে পারছেন না। তারা এই আমলটি করবেন। ইনশাআল্লাহ আল্লাহ্ তায়ালা আপনাকে নিরাশ করবেন না।
আর নামাজ পড়বেন, প্রতি ফরজ নামাজের শেষে মোনাজাতে রাব্বিলা তাজারনি ফারদাও ওয়া আন্তা খাইরুল ওয়ারেসিন। রাব্বি হাবলি মিল্লাদুনকা জুররিয়াতান তাইয়্যেবাতান ইন্নাকা সামিউদ্দোয়া। আর রব্বি হাবলি মিনাস সলিহিন পড়বেন। এগুলো নেক সন্তান লাভের দোয়া। আমি পড়েছি। আপনারাও পড়ুন। আর অবশ্যই মোনাজাতে সন্তান চাওয়ার আগে আল্লাহ্র কাছে সকল পাপের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিবেন। আস্তাগফিরুল্লাহ কয়েক বার পড়ে নিবেন। আল্লাহ্ তায়ালা সবাইকে মা হওয়ার তওফিক দান করুন। আমিন। সবাই আমার এবং আমার সন্তানের জন্য দোয়া করবেন। আসসালামু আলাইকুম।
গল্পের বিষয়:
গল্প